‘ভক্ত্যা মামভিজানাতি’
মাত্র দুটি সম্বল। সে-দুটি থাকলেই ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জগতে এখনি প্রবেশ করা যাবে। জিনিস-দুটি কিছুই নয়, আবার ঐদুটিই সব। অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি ঐদুটির কাছে কিছুই নয়, সামান্য খড়কুটো। সম্বল দুটি হলো—বিশ্বাস আর ভক্তি।
শঙ্করাচার্য তিনটি দুর্লভ প্রাপ্তির কথা বলেছেন, প্রথম—’তুমি মানুষ’। দুর্লভ প্রাপ্তি। দ্বিতীয়—মানুষ হয়ে তুমি থেমে রইলে না, তুমি মোক্ষ অর্থাৎ মুক্তিলাভের প্রয়াসী হলে। মুক্তি মানে মৃত্যু নয়। মুক্তির অনেক ব্যাখ্যা। মুক্তিতে ‘খেল খতম’ নয়, মুক্তিতেই ‘শুরু’। শাস্ত্র, বিচার, স্তোত্র, স্তব, যাগ, যজ্ঞ সব থাক, যেমন আছে। আসল অস্ত্র আছে ঠাকুরের ‘অস্ত্রাগারে’। মুক্তির সন্ধান। সেখানেও শঙ্করাচার্যের প্রতিধ্বনি—অদ্বৈত, দ্বৈত, ‘তুমি’ শুধুই ‘তুমি’, অথবা ‘আমিই’ ‘তুমি’, ‘তুমিই’ ‘আমি’, কিংবা ‘আমি’ও নেই ‘তুমি’ও নেই, সবই ‘মায়া’। মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। বেদান্তীদের বিচারের জন্য তোলা থাক ওসব। আসল কথাটি শুনে রাখ—
“ষড়ঙ্গাদিবেদো মুখে শাস্ত্রবিদ্যা,
কবিত্বঞ্চ লোকেষু কীর্তিং বিধত্তাম,
গুরোরঘিপদ্মে মনশ্চেনু লগ্ন
ততঃ কিং ততঃ কিং ততঃ কিং ততঃ কিম্।”
গুরুই বলে দেবেন, মুক্তি কাকে বলে, মুক্তির পথ কি? তাহলে কি প্রয়োজন? মুক্তিমার্গের প্রথম পাঠ কি হবে! গুরুর প্রতি অবিচলিত বিশ্বাস। ঠাকুর বলতেন, আমি কারো গুরু নই, কারো গুরু হওয়ার আমার বাসনা নেই। গুরু, বাবা, কর্তা—এইসব সম্বোধনে আমার গা জ্বলে যায়।
বেশ, তাই হোক। আপনি কারো ‘গুরু’ নন, আপনি বিপর্যস্ত জীবের বন্ধু এক মহাবিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীর ত্রিবিধ গুণে গুণান্বিত এক অগোচর শক্তি। কেমন? প্রকৃত বিজ্ঞানীদের তিনটি সম্বল—পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও সিদ্ধান্ত। এঁরা সবাই বস্তু-বিজ্ঞানী। জীবজগৎ পর্যবেক্ষণ করে কেউ আবিষ্কার করবেন ওষুধ, কেউ পোষ মানাবেন প্রাকৃতিক শক্তিকে, কেউ তৈরি করবেন যন্ত্রদানব। এইসব করতে করতে তাঁদের বোধে ঝলসে উঠবে একটি তত্ত্ব, কোথায় বসে আছ তুমি কীটানুকীট মানব। কার অহঙ্কার, কিসের অহঙ্কার! রহস্যের যতটুকু ঢাকনা এই বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত খুলতে পেরেছি, তাতে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়টি খুলে গেছে—
“তেজোরাশিং সর্বতো দীপ্তিমন্তম্
পশ্যামি ত্বাং দুর্নিরীক্ষ্যং সমন্তাদ্
দীপ্তানলার্কদ্যুতিমপ্রমেয়ম্।” (১১/১৭ )
তোমারই তেজ, তোমারই প্রভা, তোমারই শক্তি, তোমারই স্পন্দন, তোমারই তরঙ্গ, তোমারই বিস্তার, তোমারই সৃষ্টি, তোমারই পালন, তোমারই সংহার। শক্তিই ব্রহ্ম, ব্ৰহ্মই শক্তি। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ।
শঙ্করাচার্য বুঝেছিলেন, নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্ম সকলের উপলব্ধির বিষয় হতে পারে না। শঙ্করপন্থী সন্ন্যাসীরা ক্রমশই নিস্তেজ ক্লীবে পরিণত হচ্ছিলেন। ব্রহ্মে যখন কোন কর্ম নেই, আমাদেরই বা কেন কাজ থাকবে! ভারতবর্ষকে কর্মনাশা সর্বনাশ থেকে বাঁচাবার জন্য এলেন শ্রীরামানুজ। নিয়ে এলেন বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তি মেশালেন। নিশ্চেষ্ট, নিষ্ক্রিয়, সোহহম–সে বহু পরে, পথের শেষে, শেষ নিশানা, যার পরে আর কিছু নেই, সেটি হলো লয়েরই নিলয়। বেশ কথা। এই উপলব্ধি তাঁর, যাঁর সমাধিলাভের অভিজ্ঞতা হয়েছে। রামানুজ এই চরম অদ্বৈতবাদ কেটে দিলেন এই যুক্তিতে—ব্রহ্মকে আমি অস্বীকার করছি না, তবে ব্রহ্মকে আমি সবিশেষ বা সগুণ বলে অভিহিত করছি। কারণ, একটি বিচার—যাতে কোন বিশেষ নেই, যা অদ্বিতীয়, এক রস—বহুর উৎপত্তি তা থেকে কি করে হয়? নামরূপময় বৈচিত্র্য ঘটে কি করে? মূলত যে-সত্তা দ্বৈতহীন তা কি করে দ্বৈতের জনক হয়! এক ‘আমি’ কেমন করে বহু ‘তুমি’ হলো! দ্বৈতহীন সত্তা থেকে দ্বৈত উৎপন্ন হলে সিদ্ধান্ত তাহলে এই হবে—কারণ ছাড়াই কাজ হচ্ছে। যুক্তিতে এই সিদ্ধান্ত টেকে না। তাহলে? তাহলে যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত এই—এই জগৎ-প্রপঞ্চের মূলে আছে অদৃশ্য ও অতি সূক্ষ্ম প্রপঞ্চম এক ব্রহ্মস্বরূপ বা কারণ বস্তু। এই জগৎকারণের কারণ চিদ্ ও অচিবিশিষ্ট ব্রহ্ম। নির্গুণ ও নির্বিশেষ ব্রহ্মকে কারণ বললে অসঙ্গত হবে।
রামানুজ বললেন, সার কথা হলো—মুক্তিতে জীব ব্রহ্মে একেবারে মিশে যায় না। জীব হচ্ছে ভগবানের নিত্যদাস। অতএব মুক্তির পথ কি? শ্রীভগবানের নিত্যদাস্যই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি। এই দাস্যে কেবলি নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ, পরমা মুক্তি। জীব স্বরূপতই ভগবানের দাস। বিস্মৃতির বন্ধন। স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হলেই দুঃখ, যন্ত্রণা।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ আরো, আরো সহজ। বললেন, ভূতকে জানলে ভূতের ভয় চলে যায়। বন্ধনকে জানলে সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি। বদ্ধজীবকে দেখ। একটু সরে এসে দেখ। ‘আমি’, ‘আমি’–’আমি’র টঙ্কার—নীচ অহঙ্কার—কাঁচা আমি। আমার, আমার করতে করতে ভড়ভড় করে সংসার-পাঁকে ডুবে গেল। আর বলতে লাগল, কেয়া বাত, কি তোফা আছি! জালের মাছ। জাল-ফাল নিয়ে অতল পুকুরে, পাঁকে জেবড়ে রইল। বললে, এই বেশ। পরিণতি! মহাকালের কড়ায় সাংসারিক নির্যাতনের আগুনে অহঙ্কারের তেলে ভাজা ভাজা। বেটা বলদ! ঠাকুর বলছেন, হাম্বা, হাম্বা, যতদিন বেঁচে রইল অসীম নিগ্রহ। হালে জুতল। বেধড়ক পেটাল। অবশেষে মরল, এল কসাই। কাটাকাটি হলো। চামড়ায় জুতো হলো। ঢোল হলো, তখনো পেটাই। খুব পেটে সবাই। তখনো নিস্তার নেই। শেষে নাড়িভুঁড়ি থেকে তাঁত তৈরি হয়। সেই তাঁতে ধুনুরীর যন্ত্র হয়, তখন আর হাম্বা হাম্বা—’আমি’, ‘আমি’ বলে না, তখন বলে ‘তুঁহু’, ‘তুঁহু’–’তুমি’, ‘তুমি’। যখন ‘তুমি’, ‘তুমি’ বলে তখন নিস্তার। হে ঈশ্বর, আমি দাস, তুমি প্রভু, আমি ছেলে তুমি মা।
ঠাকুর কিন্তু ব্রহ্ম থেকে সরলেন না। নির্বিশেষ, নির্গুণ, অনন্ত ‘আমি’তে জীবের সবিশেষ ক্ষুদ্র ‘আমি’টিকে খুঁজে নিলেন। চিমটে দিয়ে টেনে টেনে তুললেন, আষ্টেপৃষ্ঠে হড়হড়ে শ্যাওলার মতো লেগে আছে কাম-কাঞ্চন। কলির প্রধান দুটি অবিদ্যামায়া। যখন তুলছেন তখন ছটফট করছে, কাতরে প্রার্থনা করছে—ঠাকুর! ছেড়ে দাও, বেশ আছি, বেড়ে আছি! প্রকৃত গুরু, উত্তম বৈদ্য ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ফণাধারী ফণী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সখা অর্জুনকে বললেন, তোমাকে আমার স্বরূপ, বিশ্বরূপ দেখাব, তবে তোমার ঐ মায়িক চোখে সে- রূপ দেখা যাবে না—
“ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুয়া।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।” (গীতা, ১১।৮)
অঘটনঘটন-যোগশক্তি।
ঠাকুর বললেন, ছটফট করলে কি হবে! ধরেছি যখন ছাড়ছি না। এই নাও হনুমানের দৃষ্টি। রাম জিজ্ঞেস করলেন, হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ? হনুমান বললে, রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি তুমি পূর্ণ আমি অংশ, তুমি প্রভু আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।
জীবশরীরে বোধের রকমফের হবেই, ‘আমি’ হলো ঝুড়ির কাঁকড়া, দাড়া বের করে খড়বড় করে ঝুড়ির গা বেয়ে উঠতে চাইবে। সদা ‘সোহহং’ লক্ষে একজন। ‘আমি’ তো যাওয়ার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।
‘আমি’ রইল এবং ‘ব্রহ্ম’ও রইল। ‘ব্রহ্ম’ অস্পষ্ট ধরাছোঁয়ার বাইরে। ‘আমি’ কিন্তু স্পষ্ট, সোচ্চার এক পরম শত্রু, মিত্রের রূপ ধরে বসে আছে। যে সারথি হয়ে বসে আছে, যে কুব্জা হয়ে অনবরত কু বুঝিয়ে যাচ্ছে, তার হাত থেকে নিস্তারের উপায়?
উপায়—”মামেকং শরণং ব্রজ”। শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত হও। ভক্তি লাভ করে ভক্ত হও। তাঁর কাছে আছে মুক্তির চাবি, মোক্ষের চাবি। তিনি শ্রীভগবানের কণ্ঠে বলছেন (গীতা, ১৮।৫৫) —
“ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।”
সংসারে থাক, মন ফেলে রাখ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণে।