ভক্তি-পর্ব
প্রথম পরিচ্ছেদ
লৌকিক প্রথামতে নুরল এসলামের বিবাহের ক্রিয়াপর্ব সমাধা হইয়া গিয়াছে। তিনি এক্ষণে অফিসের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন। স্ত্রী আপন পিত্রালয়ে। মাসাধিক পর নুরল এসলাম তাহাকে পত্র লিখিলেন, “প্রাণাধিকে! এত অল্প সময়ে ভক্তি ও সদ্ব্যবহারে নাকি তুমি ফুফু- আম্মার মন কাড়িয়া লইয়া গিয়াছ; তাই তিনি তোমাকে আনিবার নিমিত্ত উতলা হইয়াছেন। আগামী ১৭ই অগ্রহায়ণ তিনি তোমাকে আনিবার নিমিত্ত এখান হইতে লোক পাঠাইবেন। তোমার সই এখন কোথায়? দোস্ত সাহেব বি-এল পরিক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হইয়াছেন। খবরের কাগজে নাম দেখিয়া বেল্লায় ‘তার’ করিয়াছি। তুমি কেমন আছ? খোদার ফজলে আমরা সকলে ভাল আছি। আগামীতে তোমাদের সর্বাঙ্গীন কুশল সংবাদ লিখিবে।” ইতি— তারিখ, ১৩ই অগ্রহায়ণ।
তোমারই–
নুরল এসলাম
আনোয়ারা পত্র পাইয়া স্বামীকে পত্র লিখিল। ইহাই তাহার প্রেমময় জীবনের প্রথম পত্র–
“পাক্ জনাবে কোটি কোটি কদমবুসি পর আরজ,
আপনার পবিত্র হস্তের সুধালিপি পাইয়া সুখী হইলাম। আমার একমাস ‘নফল রোজা’ মানত ছিল, এখানে আসিয়া কয়েকদিন পর তাহা আরম্ভ করিয়াছিল। আজ রোজার ১১ দিন, আর তিন সপ্তাহ পর আমাকে লইয়া গেলে ভাল হয়; কারণ তথায় যাইয়া রোজা করিবার নানারূপ অসুবিধা হইতে পারে। পত্রমধ্যে যে টুক্রা কাগজগুলি পাঠাইলাম সেগুলি স্বহস্তে পোড়াইয়া ফেলিবেন। দাসীর বেয়াদবী ও ধৃষ্টতা মাফ করিবেন। আমি এখানে আসিবার এক সপ্তাহ বাদ সই বেল্লা গিয়াছে। সে-ও তথা হইতে আমাকে লিখিয়াছে, তাহার স্বামী প্রশংসার সহিত বি-এল পাস করিয়াছেন। আমি পরমানন্দে সন্দেশ চাহিয়া তাহাকে পুনরায় পত্র লিখিয়াছি। আপনার শরীর কেমন আছে? দাদী আম্মার দোওয়া জানিবেন। বাটীস্থ আর আর সকলের মঙ্গল জানিবেন। খোদার মরজি এখানে সকলে ভাল আছেন। আরজ ইতি তারিখ, ১৫ই অগ্রহায়ণ।
সেবিকা–
আনোয়ারা
নুরল এসলাম যথাসময়ে পত্র পাইলেন। খুলিবামাত্র কতকগুলি টুকরা কাগজপত্র বাহির হইয়া পড়িল। তিনি বিস্মিত হইয়া কাগজগুলি যথাযথভাবে জোড়াতালি দিয়া দেখিলেন; তাহা তাঁহার নিজহস্তে লিখিত পূর্বকথিত সেই তিন হাজার টাকার কাবিননামা। অনেকক্ষণ পর্যন্ত নুরল ইস্লাম অবাক ও স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। তারপর স্বাগত ভাবিলেন, “প্রিয়ে! তুমি সত্য সত্যই স্বর্গের আনোয়ারা (জ্যোতির্মালা), তোমার তুলনা মর্ত্যে সম্ভবে না।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
নুরল এসলামের বিবাহের পর দেখিতে দেখিতে চারটি বৎসর অতীতের পথে অনন্ত কালসাগরে মিশিয়া গিয়াছে। সময়ের এই ক্ষুদ্র অংশটুকুর মধ্যে পারিবারিক জীবনে তথা বিরাট বিশ্বপরিবারের ছোট বড় কত ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, কে তাহার সংখ্যা করিবে।
নুরল এসলাম সতীনের ছেলে; উপার্জনক্ষম। জুট-কোম্পানির ম্যানেজার সাহেব তাঁহার কর্মদক্ষতায় ও স্বভাবগুণে ক্রমশ বেতন বৃদ্ধি করিয়া দিতেছেন। এখন তাহার বেতন ৮০ টাকা।
নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নুরল এসলামের সহিত সাধিয়া বিবাহ দিতে যাইয়া প্ৰত্যাখ্যাত হইয়াছেন এই জন্য নুরল এসলামের বিমাতা আপনাকে যারপরনাই অপমানিত বোধ করিয়াছেন। পরন্তু নুরল এসলাম তাঁহার প্রস্তাব উপেক্ষা করিয়া হুরপরীর মত সুন্দরী স্বভাব- সুশীলা বিদূষী ভাষা গৃহে আনিয়াছেন—তাহার উপর যে ভার্যা সর্বগুণান্বিতা এবং গৃহস্থালির সর্ববিষয়ে পরিষ্কার পরিছন্নতায় ঘরবাহিরের সমস্ত কার্যের শৃঙ্খলা পারিপাট্য বিধানে ও অবিশ্রাম কর্মপ্রিয়তায় সে অল্পদিনেই প্রবীণা গৃহিণীর ন্যায় গৃহলক্ষ্মী হইয়া উঠিয়াছে। তাহার হাতের গুণে শাক-ভাতও অমৃতের মত বোধ হইতেছে।
এক রাত্রি আহারান্তে সালেহা তাহার মায়ের কাছে শুইয়া বলিতে লাগিল, “মা, আজ সকালে ভাবী যে মুড়িঘন্ট পাক করিয়াছিলেন, তাহার স্বাদ এখনও জিহ্বায় লাগিয়া রহিয়াছে। তিনি যে ডাইল পাক করেন, শুধু তাই দিয়া ভাত খাইয়া উঠা যায়।”
মা। (দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া) ও ভাল পাকে বিষ মাখান; তাহাতে আমাদের মরণ।
মেয়ে। সে কি মা! ৩/৪ বছর হইল খাইতেছি মরি ত’ না?
মা। অভাগীর বেটি তুই তা বুঝবি কি করিয়া
মেয়ে। বুঝাইয়া দেও না!
মা। বৌ-এর রূপে নুরল আজকাল ভেড়া বনিয়াছে। বৌ ঘরগৃস্থালী, চাকর-চাকরাণী সব আপনার করিয়া লইয়াছে। রকমে রকমে বুঝিতেছি, বৌ-ই সংসারের সব, নুরল এখন তালে তালে তারি আদেশ-উপদেশ মত সংসার চালায়। সে আর সংসারের জমা খরচ রাখে না, বৌ-এর হাতে সব ছাড়িয়া দিয়াছে। সেদিন রাত্রে জমাখরচ লিখিবার সময় নুরলকে বলিয়াছে কাপড় থাকিতে সকলকে জোড়ায় জোড়ায় কাপড় দিবার কি দরকার ছিল? তাহাতেই ত’ এ মাসে খরচ বাড়িয়া গিয়াছে। সকলের মানে তুই আর আমি।
মেয়ে। তুমি যতই বলনা কেন, ভাবী আমাদের অনিষ্ট করবেন না। তিনি আমাকে কত ভালবাসেন, আদর করেন, হাতে তুলে কত জিনিস খাইতে দেন, কত মিঠা কথা বলেন। তোমাকেও ত’ খুব ভক্তি করেন, আদরের সহিত কথা কন। সকলের কাপড়ের কথা বলিয়াছেন মিথ্যা কথা কি? তোমার আমার জোড়া-ধরা কাপড় ত’ ঘরেই তোলা রহিয়াছে।
মা। বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তুই গোল্লায় যা, বুঝাইলাম কি, আর বুঝিলি কি।”
মেয়ে। কি বুঝাইলে?
মা। দুইদিন পরে আমাদিগকে বৌ-এর বাঁদী হইয়া সংসারে থাকিতে হইবে। একটু আগেই এক জোড়া কাপড় দিয়াছে, তাই তাহার পরানে সয় নাই। এমন ছোট লোকের মেয়ে কি আছে!
মেয়ে। না, ভাবী ছোটলোকের মেয়ে নয়। আমি শুনিয়াছি, ভাবীর বাপের বাড়িতে বড় বড় টিনের ঘর, পালে পালে গরু-ভেড়া, চাকর-বাকর বাড়ি ভরা।
মা। হাবা মেয়ে, বড় বড় টিনের ঘর থাকিলেই বুঝি বড় লোক হয়? ওর বাপ দাদা যে ভুঁইমালী ছিল, তার মা আবার চোরের মেয়ে।
মেয়ে। তুমি বল কি! তবে কি ভাবীর বাপ-দাদারা আমাদের ঝাড়ুদার বলাই মালীদের জাত? ওরা নাকি হিন্দু ছোটলোক। বলাইয়ের বৌ ত’ আমাদের ঘরে ঢুকিতেই সাহস পায় না।
নুরল এসলামের প্রপিতামহের আমল হইতে হিন্দু ভূঁইমালী তাহাদের উঠান পরিষ্কার করিত, ঘরের ডোয়া বাঁধিত, এজন্য মালার চারকান জমি ছিল। এক্ষণে বলাই মালী সেই কাজ করে।
মা বলিল, “হ্যাঁ, ওর বাপ-দাদারা আগে হিন্দু ভূঁইমালী ছিল, শেষে জাত যাইয়া মুসলমান হয় এবং ভূঁইয়া খেতাব পায়।”
মেয়ে। ভাবীর মা কি সত্যই চোরের মেয়ে?
মা। নয় ত’ কি?
মেয়ে। তুমি এত কিরূপে জান?
মা। তোমার মামুর মুখে শুনিয়াছি বৌ-এর বাপ-দাদার খবর; আর বৌ-এর বাপের বাড়ির বাঁদীর মুখে শুনিয়াছি তার মার পরিচয়।
সালেহার মামু ও আনোয়ারার বাঁদী যে ঐরূপ কথা বলিয়াছিল, তাহা সত্য। তাহাদের ঐরূপ বলিবার কারণ ছিল। সালেহার মামু নুরল এসলামের সহিত কন্যা বিবাহ দিতে যাইয়া প্রত্যাখ্যাত হন এবং আনোয়ারার দাসীকে আনোয়ারার বিমাতা গোলাপজান জ্বালাতন করিত
মেয়ে। শুনিয়া ঘেন্নায় পরাণ যায়। এতদিনে বুঝিলাম ভাবী আমাকে এত আদর করে কেন। আর তোমাকেই বা ভক্তি করে কেন। আমার মনে হয়, ভাইজান কেবল মাথার চুল ও রূপ দেখিয়া এমন ঘরে বিবাহ করিয়াছেন। আমি কাল হইতে বৌ-এর কাছে এক বিছানায় বসিব না, তাহাকে মালীর মেয়ে ডাকিব।
মা। তুই যে আমার কথা বুঝিতে পারিয়াছিস, এ-ও ভাগ্গির কথা।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পরদিন রবিবার। আজ নুরল এসলামের অফিস হইতে বাড়ি আসিবার দিন। ইংরেজ বণিকেরা রবিবারে অফিস বন্ধ না রাখিলেও সেদিন তাঁহাদের বৈষয়িক কার্যাদি কম হয়। ম্যানেজারের প্রিয়পাত্র নুরল এসলাম এ-নিমিত্ত শনিবার বৈকালে বাড়ি আসিয়া থাকেন, সোমবার অপরাহ্ণে অফিস হাজির হন।
আনোয়ারা রোজ প্রাতে কোরান শরীফ পাঠ করে। আজ পড়িতে পড়িতে একটু বেলা হইয়াছে। সালেহা তাহার ঘরের কাছে গিয়া কহিল, “আজ যে মালীর মেয়ে কোরান পড়া এখন শেষ হ’লো না? রোজই ভাতের বেলা হয়, আমি যে খিদেয় মরি, তা কে দেখে?” একথা নুরল এসলামের ফুফু-আম্মার কানে গেল।
ফুফু-আম্মার নাম পূর্বেও দুই তিনবার করা হইয়াছে; কিন্তু তাঁহার বিশেষ কোন পরিচয় বলা হয় নাই। তিনি নুরল এসলামের পিতার চাচাতো ভাগিনী; পৌঢ় বয়সে বিধবা হইয়া একটি পুত্র ও একটি কন্যাসহ অনন্যোপায়ে নুরল এসলামের পিতার আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহার ন্যায় ধার্মিক স্ত্রীলোক কম দেখা যায়। ইনি বারো মাস রোজা রাখেন এবং সর্বদা তী পাঠে রত থাকেন। ইনি নুরল এসলামের পিতার কনিষ্ঠ ছিলেন; কিন্তু ইঁহার স্বভাব ও ধর্মশীলতা দেখিয়া, নুরল এসলামের পিতা ইঁহাকে সহোদরা জ্যেষ্ঠা ভগিনী অপেক্ষা অধিক ভক্তি ও যত্ন করিতেন। নুরল এসলামের পিতার মৃত্যুর অল্প দিন পরেই ক্রমে ফুফু-আম্মার পুত্রকন্যাদ্বয় কাল কবলে পতিত হয়। এক্ষণে নুরল এসলামই তাঁহার পুত্র-কন্যা। নুরল এসলামের গৃহস্থালীই তাঁহার নিজের গৃহস্থালী। অতঃপর আমরা তাঁহাকে কেবল ফুফু-আম্মা বলিয়া ডাকিব।
ফুফু-আম্মা সালেহার কথা শুনিয়া কহিলেন, “তুই ও কি কথা বলিলি? তোর কি আদব আক্কেল কিছুই নাই? হইলই যেমন সৎ-ভাইয়ের বৌ; সম্বন্ধে তাহার বাপ-মা যে তোর তা- ঐ মা-ঐ হন। আনোয়ারা সালেহার কথায় ভাবিল, “আমি রোজই বাগানের ফুল দিয়া তার খোঁপা বাঁধিয়া দিই, ছেলেমানুষ তাই না বুঝিয়া ঐভাবে বুঝি ঠাট্টা করিয়াছে।” কিন্তু সালেহার মা ননদের কথায় গর্জিয়া উঠিয়া কহিলেন, “ছুঁড়িটা রোজই খিদেয় কষ্ট পায়, তাই সকাল সকাল বৌকে পাক করিতে বলিতে গিয়াছে, তাতে তুমি আদব-আক্কেল তুল্লে? আদব- আক্কেল কাকে বলে তা কি তোমরা জান?”
ফুফু। আমরা জানি না বটে; কিন্তু আপনার মেয়ের যে তা’ আছে— দেখা গেল।
সালেহা। আপনি আর বড়াই করিবেন না, আপনার ভাই-পুত যে মালীর ঘরে বিয়ে করিয়াছে, তা বুঝি আমি জানি না?
ফুফু। ও মা, সে কি কথা!
সালেহা। ভাবীর বাপ-দাদারা ভূঁইমালী ছিল, শেষে জাত যেয়ে মুসলমান হয়ে ভূঞা হয়েছে; তার মা আবার চোরের মেয়ে; এসব কথা আর চাপা দিলে চলিবে না। আমি সব শুনিয়াছি। ছি, ছি! এমন বৌ ঘরে আনিয়া আবার বড়াই?
ফুফু-আম্মা ত’ শুনিয়া অবাক। আনোয়ারা আকাশ পাতাল ভাবিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। কথিত আছে—পৃথিবী সর্বংসহা হইলেও সূঁচের ঘা সহ্য করিতে পারে না; আর স্ত্রীলোক পরম ধৈর্যশীলা হইলেও পিতা-মাতার অযথা নিন্দাবাদ সহিতে পারে না। সালেহার কথায় আনোয়ারার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল, সে উচ্চবাচ্য না করিয়া সারাদিন অনাহারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাটাইল।
অপরাহ্ণ ৪টায় নুরল এসলাম বাড়ি আসিলেন। তাঁহার আগমনে আজ কেহই আনন্দিত নহে। ফুফু-আম্মা তাঁহাকে স্নেহ-সম্ভাষণ করিলেন না। বিমাতার মুখ বিষাদ-বিষে পূর্ণ। সরলা সালেহাও উৎফুল্লা নহে। নুরল এসলাম কাপড় ছাড়িতে ঘরে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু হায়, গৃহে প্রবেশ মাত্র যে জন ভক্তির সহিত তাঁহার পদচুম্বন করিয়া নিজ হাতে গায়ের পোশাক খুলিয়া লয়, সে নিকটে আসিল বটে। কিন্তু তাহার চাঁদপানা মুখ আজ বিষাদ-মেঘে আবৃত, তাহার প্রেমময় সাদর-সম্ভাষণ নীরব; নুরল এসলাম ব্যাকুলভাবে কহিলেন “তোমার মুখ ত’ কখনও এরূপ মলিন দেখি নাই, কারণ কি?” আনোয়ারা ভগ্ন হৃদয়ের অদম্য দুঃখ চাপা দিয়া কহিল, “অসুখ করিয়াছে।” নুরল এসলাম তাহা বিশ্বাস করিলেন না।
বিবাহের কিছুদিন পর হইতে নুরল এসলামের বিমাতা, তাঁহার স্ত্রীকে নানা প্রকার অকথ্য, অশ্রাব্য কথায় জ্বালাতন করিতেছেন, ছল-ছুতায় ছোটলোকের মেয়ে বলিয়া কত মর্মাঘাতী ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিয়া আসিতেছেন; কিন্তু ধৈর্যের প্রতিমা আনোয়ারা পিতৃগৃহে অবস্থানকালে যেরূপ বিমাতার অত্যাচার নীরবে সহ্য করিয়া কাল কাটাইয়াছে, পতিগৃহে আসিয়াও সেই সৎ-শাশুড়ীর দুর্ব্যবহার সহ্য করিয়া তাহারই মুখাপেক্ষীনী হইয়া, তাঁহারই মনস্তুষ্টি সম্পাদনে দেহ-মন নিয়োজিত করিয়া স্বীয় কর্তব্য পালন করিতেছে। স্বামী শুনিলে মনে ব্যথা পাইবেন বলিয়া শাশুড়ীর দুর্ব্যবহারের কথা সে একদিনের জন্যও স্বামীর কানে দেয় নাই। যখন শাশুড়ীর নিষ্ঠুর বাক্যবাণে তাহার হৃদয়ের অন্তস্থল ছিদ্র হইয়া যাইত, তখন সে নির্জনে নীরবে অশ্রুপাত করিয়া শান্তিলাভ করিত।
নুরল এসলাম স্ত্রীর মুখে কোন কথা না জানিতে পারিলেও তাঁহার সরলা ফুফু-আম্মার মুখে যাহা শুনিলেন, তাহাতেই বুঝিয়াছিলেন, বিমাতা তাঁহার পারিবারিক সুখ-শান্তির ঘরে আগুন ধরাইয়া দিয়াছেন এবং সে আগুন তাহার প্রেমময়ী প্রাণাধিকা জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইতেছে; কিন্তু ধৈর্যবশত মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিতেছে না। এ পর্যন্ত নুরল স্ত্রীর দেখাদেখি নীরবে সব সহ্য করিয়া আসিতেছেন কিন্তু আজ স্ত্রীর বিষাদমাখা মুখ দেখিয়া তাঁহার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করিল। তিনি ফুফু-আম্মাকে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাড়িতে আজ কি হইয়াছে?’
ফুফু। বাবা, হবে আর কি? তোমার জাতি-পাতের কথা শুরু হইয়াছে।
নুরল। (ব্যাকুল ভাবে) সমস্ত কথা খুলিয়া বলুন!
ফুফু। তুমি নাকি মালীর মেয়ে বিবাহ করিয়াছ? বৌমার বাপ-দাদারা নাকি ভূঁইমালী ছিল, শেষে জাত যাইয়া মুসলমান হয়, সেই হইতে তাহাদের ভূঁইয়া খেতাব হইয়াছে। তার মা নাকি আবার চোরের মেয়ে?
নুরল এসলাম শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “এমন কথা কে বলিল?”
ফুফু। সকাল বেলা সালেহা বলিয়াছে।
নুরল। সে এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কোথায় পাইল?
ফুফু। জানি না।
নুরল এসলাম সালেহাকে ডাকিলেন। সালেহা নুরল এসলামের ক্রোধ দেখিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে উপস্থিত হইল। নুরল সহোদরা ভগিনি জ্ঞানে সালেহাকে এতদিন স্নেহের ‘তুই’ শব্দ ব্যবহার করিতেন। আজ কহিলেন, “সালেহা! তুমি ঠিক করিয়া বল, তোমার ভাবী যে মালীর মেয়ে, একথা তোমাকে কে বলিয়াছেন?” সালেহা নীরব। নুরল তাহাকে ধমক দিয়া কহিলেন, “বল না ঠিক কথা, না বলিলে তোমার ভাল হইবে না।” সালেহা পিছন ফিরিয়া মায়ের ঘরের দিকে চাহিল, মা ইশারায় বলিতে নিষেধ করিলেন। নুরল আবার কহিলেন, “বল না?” সালেহা কহিল, “বলিতে পারিব না।” নুরল সক্রোধে কহিলেন, “ কেন পারিবে না? তোমাকে বলিতেই হইবে।” সালেহা ভয় পাইয়া কহিল, “মা বলিয়াছে।” নুরল কহিলেন, ‘যাও।”
অনন্তর নুরল মায়ের ঘরের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “মা, আপনাকে কয়েকটি কথা বলিব। বাবাজানের মৃত্যুর সময় আপনার যে ব্যবহার দেখিয়াছি, তাহাতেই মর্মে মরিয়া আছি! আপনার আচার-ব্যবহার দেখিয়া, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বিবাহ করি নাই। করিলে এতদিনে উৎসন্ন যাইতাম। আপনি শরিফের ঘরের মেয়ে বলিয়া সর্বদাই অহঙ্কার করেন, কিন্তু ইহা আপনার অশিক্ষার ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। বংশ গৌরব কাহারও একচেটিয়া নহে। আল্লাহতায়ালা বড় ছোট করিয়া কাহাকেও পয়দা করেন নাই। সকলের মূলেই এক আদম! তবে কার্যবশত সংসারে বড় ছোট হইয়া গিয়াছে। আমাদের মোগল, পাঠান, শেখ প্রভৃতি শ্রেণীভাগের মূল ইহাই। ফলত বংশমর্যাদা সব দেশে, সব কালে সৎ-অসৎ কার্যফলের উপর নির্ভর করিয়া আসিয়াছে। আমরা সম্ভ্রান্ত শেখ বংশোদ্ভূব। যে বংশে আমি বিবাহ করিয়াছি, তাহারাও সম্ভ্রান্ত শেখ। আপনার বাপ-দাদারাও বুনিয়াদি শেখ ব্যতিত আর কিছুই নহেন। সুতরাং বংশের গৌরব করা আপনার উচিত নয়। আবার যাহারা ভূমির অধিপতি তাঁহারা ভৌমিক বা ভূঞা। আমার শ্বশুরের পূর্ব পুরুষেরা ভূমির অধিপতি অর্থাৎ রাজা ছিলেন, তজ্জন্য তাহাদের খেতাব হইয়াছে ভূঞা। আপনি যদি কল্পনা করিয়া এই সম্মানিত উপাধি কদর্য করিয়া থাকেন, তবে আপনার তওবা করা উচিত। আর যদি অন্য কাহারও নিকট শুনিয়া ঐরূপ বলিয়া থাকেন, তবে তাহাকে হিংসুক, নীচাশয় বলিতে হইবে। আমার শাশুড়ী-আম্মা জীবিত নাই; কিন্তু তিনি আমার শ্বশুরদিগের অপেক্ষাও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ছিলেন। আমার সৎ-শাশুড়ী এখন আছেন, তাঁহার পিতৃবংশ আশরাফ না হইলেও অধুনা তাঁহারা আশরাফের ক্রেতা। যাহা হউক, একাল পর্যন্ত আপনার ব্যবহারে আমি মর্মপীড়া ভোগ করিয়া আসিতেছি। এক্ষণে বিনীত প্রার্থনা, আর আমাকে কষ্ট দিবেন না, সদয়-স্নেহ দৃষ্টিপাতে সংসার করুন।”
নুরল এসলামের কথা শুনিয়া, তাহার বিমাতা ক্রোধে, অভিমানে উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “আমি যদি বড় ঘরের মেয়ে হই, তবে এ অপমানের প্রতিফল তোকে ভোগ করিতেই হবে। আমি কসম করিলাম, আজ হইতে তোর ভাত-পানি আমার পক্ষে হারাম আমি কি একেবারেই মরিয়াছি যে, তোর সোহাগের বৌ-এর বাঁদী হইয়া সংসার করিব? পৃথক হইলে আমার ভাত খায় কে? কালই ভাইকে ডাকিব, তোর মুখ দোরস্ত করিব, পৃথক হইলে, তবে ভাত-পানি ছুইব।”
নুরল এসলাম কহিলেন, “তাহাই হইবে, কিন্তু অনাহারে দুঃখ পাইবেন না; এখন এই অন্নে আপনার অধিকার আছে।’
অতঃপর নুরল এসলাম ঘরে যাইয়া স্ত্রীকে কহিলেন, “তুমি আর দুঃখ করিও না, এখন হইতে যদি ওঁর শিক্ষা না হয়, তবে উপায় নাই।”
আনো। আমি যে ভয়ে আপনার নিকট আম্মাজানের কোন কথা খুলিয়া বলি না, আপনি আমার সেই ভয় দশ গুণ বাড়াইয়া তুলিলেন।
নুরল। কিসের ভয়ের কথা বলিতেছ?
আনো। উনি যেরূপ কসম করিলেন, যদি রাগের মাথায় কালই পৃথক হ’ন, তবে দেশময় আমাদের দুর্নাম রটিবে। লোকে আপনাকে বলিবে, স্ত্রৈণ হইয়া মাকে পৃথক করিয়া দিল; আমাকে বলিবে, বৌটি ডাইনী, ভাল সংসার নষ্ট করিল। তখন উপায় কি?
নুরল। ন্যায় পথে থাকিলে লোকে কি বলিবে, সে ভয় আমি করি না।
আনো। না করুন, তথাপি আম্মাজানকে তিরস্কার করিয়া ভাল করেন নাই। হাজার হইলেও তিনি আমাদের গুরুজান; বিশেষতঃ আমার জন্য তাঁহাকে অতদূর বলা ভাল হয় নাই।
নুরল। আমি ত তাঁহাকে তিরস্কার করি নাই। কেবল তাঁহার ব্যবহারে দুঃখিত হইয়া উপদেশ ভাবে কয়েকটি কথা বলিয়াছি মাত্র।
ক্ষণমাত্র মৌনাবলম্বন করিয়া কহিলেন, “সংসার বড়ই কঠিন স্থান; এক আধটুকু উচ্চবাচ্য না করিলে তিষ্টান কঠিন।”
আনো। আমার বিবাহের পূর্বেও কি আম্মাজান সর্বদা সংসারে অশান্তি ঘটাইতেন?
নুরল। আমার ফুফু-আম্মাজান পবিত্রতা ও সরলতার প্রতিমূর্তি। মা এ সংসারে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে হাড়ে হাড়ে জ্বালাইতেছেন। আমার প্রতি মা’র হিংসা চিরদিনই আছে, তবে বিবাহের পর তাঁহার হিংসা যেন আরও বাড়িয়া উঠিয়াছে।
আনো। বাড়া কমাইলে ক্রমে সবই কমিতে পারে।
নুরল। এ বাড়া কমাইবার উপায় নাই।
আনো। এক উপায় আছে।
নুরল। কি উপায়?
আনো। আমি তাঁহার মতিগতি যেইরূপ বুঝিতেছি, তাহাতে বোধ হয় আপনি এ দাসী ত্যাগ করিলে, তাঁহার সমস্ত হিংসার আগুন পানি হইতে পারে।
নুরল এসলাম শিহরিয়া উঠিল এবং বিস্ফারিত নয়নে দৃঢ়তার সহিত কহিলেন, “চন্দ্ৰ সূৰ্য কক্ষচ্যুত হইতে পারে, তথাপি তোমাকে পরিত্যাগ অসম্ভব পরস্তু ওরূপ কথা চিন্তা করিবার পূর্বে এ হৃদয় যেন দোজখের আগুনে পুড়িয়া ভস্ম হয়।”
এই সময় চাকরানী আসিয়া পাকের আঙিনায় যাইতে আনোয়ারাকে ইঙ্গিতে ফুফু- আম্মার আদেশ জানাইল। আনোয়ারা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
পরদিন রবিবার পূর্বাহ্নে নুরল এসলামের বৈঠকখানায় গ্রামের গণ্যমান্য প্রধান প্রধান লোক আসিয়া সমবেত হইতে লাগিলেন। কিছু বেশি বেলায় একটা তাজী ঘোড়ায় চড়িয়া গোপীনপুর হইতে নুরল এসলামের সত্মার ভাই—আলতাফ হোসেন সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অবস্থা শোচনীয় হইলেও তাঁহার সম্পদকালের আমীরী চালচলন কমে নাই। আমাদের অপরিণামদর্শী আভিজাত্যাভিমানী মহাত্মা অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হইয়া অধঃপাতের চরম সোপানে পদার্পণ করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন। ইহা যে আমাদের সমাজের দুর্ভাগ্যের একটি কারণ, তাহা বলাই বাহুল্য।
যাহা হউক, বৈঠক বসিল। সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর মধ্যে যাহারা প্রকৃত অবস্থা জানেন, তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “আমরা মনে করিয়াছিলাম, দেওয়ান সাহেবের মৃত্যুর পর ছেলের সহিত তাঁহার সৎ-মা পৃথক হইবেন; কিন্তু ছেলের গুণেই এতদিন সংসারটি বাঁধা ছিল।” যাঁহারা ভিতরের অবস্থা জানেন না, তাঁহারা কহিলেন, “পুরান সংসার, একত্র থাকাই ত ভাল ছিল, হঠাৎ এরূপ পৃথক হওয়ার কারণ কি?” আলতাফ হোসেন সাহেব কহিলেন, “জামানার দোষ, আজকালকার ছেলেরা বৌ-বশ হইয়া তাহাদের পরামর্শ মত অনেক ভাল সংসার নষ্ট করিয়া ফেলিতেছে।” ২/৪ জন প্রাচীন ব্যক্তি তাঁহার কথায় সমর্থন করিলেন।
যাহা হউক, একত্র থাকার জন্য অনেকে নুরল ও তাঁহার বিমাতাকে নানা প্রকারে বুঝাইলেন; কিন্তু বিমাতার উৎকট জেদের ফলে বণ্টনই সাব্যস্ত হইল। অনেক বাদানুবাদের পর স্থিরীকৃত হইল, নুরল এসলাম পুরান বাড়িতে থাকিবেন। পুরান বাড়ির পশ্চিমাংশে তাঁহার সৎ-মার বাড়ি হইবে। নূতন ঘরবাড়ি করিয়া দেওয়ার নিমিত্ত নগদ আড়াই শত এবং সালেহার বিবাহের খরচ সাড়ে তিন শত, মোট ছয় শত টাকা ১৫ দিনের মধ্যে নুরল এসলামকে তাহার বিমাতার হাতে দিতে হইবে। বিমাতার কাবিন বাবদ অর্ধেক ভূ-সম্পত্তি লেখা ছিল, তাহা তাহাকে নির্দিষ্ট করিয়া পৃথক করিয়া দেওয়া হইল। এই সম্পত্তি স্বাধীনভাবে ভোগের নিমিত্তই তিনি পরিণাম চিন্তা না করিয়া সগর্বে-পৃথক হইলেন।
বন্টনের পর বিমাতা পৃথক পাকের বন্দোবস্ত করিয়া পানি স্পর্শ করিলেন। হায় রে জিদ! হায় রে অশিক্ষিতা কৌলিণ্যাভিমাণী রমণী! তোমাদের জন্য কত সুখের সংসার যে দুঃখে ভাসিয়াছে ও ভবিষ্যতে আরও ভাসিবে তাহার সংখ্যা করা অসম্ভব।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পনর দিন পর নুরল এসলামকে ছয় শত টাকা দিতে হইবে,—এই ভাবনার তিনি অস্থির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার হাতে যাহা ছিল, বিবাহের ব্যয়ে তাহাও নিঃশেষ হইয়াছে; তবে তিনি ঋণগ্রস্ত হন নাই—এই যা’ লাভ। সোমবারে তিনি চিন্তিত মনে বেলগাঁও অফিসে গমন করিলেন। পতিপ্রাণা আনোয়ারা পতির মনোভাব বুঝিয়া তাঁহার নিজ হৃদয়ে ধারণ করিল সে মধুপুরে পত্র লিখিল :
“দাদিমা! আমার ভক্তিপূর্ণ শত সহস্র সালাম জানিবে। অনেক দিন তোমাদের পত্র পাই না, এজন্যও চিন্তিত ও দুঃখিত আছি। সত্বর তোমাদের কুশল সংবাদসহ পত্র লিখিবে।
“গতকল্য আম্মাজান পৃথক হইয়াছে। তজ্জন্য আমাদের কিছু ঠেকাঠেকি হইয়াছে। পত্রপাঠ আমার নিজ টাকা হইতে, ছয় শত টাকা তোমার দুলাভাইজানের নামে—যাহাতে পরবর্তী সোমবার বেলগাঁও পৌঁছে, এইরূপ তাগিদে পাঠাইবে। বাবাজান ও মা’কে এবং ওস্তাদ চাচাজান ও চাচি আম্মাকে আমার সালাম জানাইবে। বাদশা ভাই কেমন আছে? সে স্কুলে যায় তো? ভোলার মা, গদার বৌ, মার সই—ইহাদের কুশল সংবাদ লিখিবে। আমাদের বালিকা-বিদ্যালয় কেমন চলিতেছে? জেলা হইতে হামিদার পত্র পাইয়াছি। সই কিছু খুলিয়া লিখে নাই; কিন্তু চিঠির ভাবে বুঝিলাম, সে অন্তঃসত্ত্বা। উকিল সয়া দৈনিক ৫০ টাকা ফি লইয়া মফঃস্বলে মোকদ্দমায় গিয়াছেন। আমরা ভাল আছি।”
ইতি–
তোমার জীবনসর্বস্ব–”আনার”
সপ্তাহ শেষ—শনিবার নুরল এসলাম বাড়ি আসিলেন। টাকা সংগ্রহ না হওয়ায় তাঁহার মুখ মলিন। আনোয়ারা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার চেহারা এত খারাপ হইতেছে কেন?”
নুরল। আর কয়েকদিন পরেই সালেহাদিগকে টাকা দিতে হইবে, এ পর্যন্ত তাহা সংগ্রহ হইল না। ম্যানেজার সাহেব সহকারী তহবিল হইতে বিনা সুদে দুই শত দিতে চাহিয়াছেন; অবশিষ্ট টাকা কোথায় পাইব, সেই ভাবনায় বড়ই চিন্তিত হইয়াছি।
আনো। মার মরণকালে আমাকে উপদেশ দিয়াছিলেন, ‘মা সংসারে যত বিপদে পড়িবে, ততই খোদাকে আঁকড়াইয়া ধরিবে, বিপদ আপনা-আপনি ছাড়িয়া যাইবে।’ নুরল সোৎসাহে স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিল। আনোয়ারা পতির মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিতভাবে কহিলেন, কি! আপনার মুখে হঠাৎ যেন বেহেস্তের জ্যোতি ফুটিয়াছে।”
নুরল। তোমার মুখে স্বর্গীয়া আম্মার উপদেশের কথা শুনিয়া আমার মনের অবসাদ যেন নিমিষে অন্তর্নিহিত হইয়াছে! আমি আজ সারারাত্রি বন্দেগীতে কাটাইব।
আনো। ভাগা-ভাগির গণ্ডগোল-অসুখে এ কয়েকদিন আমিও ওজিফা পড়িতে পারি নাই। আজ রাত্রিতে প্রাণ ভরিয়া কোরান শরিফ পড়িব।
আহারান্তে রাত্রিতে ধর্মশীল দম্পতি, সঙ্কল্পিত ধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন।
নুরল এসলাম বেলগাঁও যাইবেন। আনোয়ারা অতি প্রতুষ্যে উঠিয়া তাঁহার পাকের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইয়াছে। পাকান্তে নিজ হস্তে স্বামীকে স্নান করাইল। স্নানান্তে উপাদেয় অন্নব্যঞ্জন আনিয়া তাঁহার সম্মুখে রাখিল। নুরল এসলাম আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। আনোয়ারা পান তৈয়ারী করিতে বসিয়া হাসি হাসি মুখে কহিল, “আজ রাত্রিতে আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি, এক পরমা ধার্মিকা বৃদ্ধা আপনাকে অর্থাভাবে চিন্তিত দেখিয়া বলিতেছেন, “বৎস, চিন্তিত হইও না; তোমার প্রাপ্য কিছু টাকা আমার নিকট মওজুদ আছে, তাহা হইতে কতক টাকা তোমার সংসার খরচের জন্য দিলাম।’ আমার বিশ্বাস, আপনি বেলগাঁও যাইয়া আজ কি কাল তাহা পাইবেন। দাসীর অনুরোধ, স্বপ্ন সফল হইলে টাকা গ্রহণে সঙ্কোচ করিবেন না।”
নুরল এসলাম স্ত্রীর স্বপ্নের ভাব কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। খোদা ভরসা করিয়া বিস্মিতচিত্তে অশ্বারোহণে বেলগাঁও রওয়ানা হইলেন। তিনি বরাবর ঘোড়ায় চড়িয়া বেলগাঁও যাতায়াত করেন।
নুরল এসলাম বেলগাঁও উপস্থিত হইয়া সবেমাত্র অফিসের কার্যে মনোযোগী হইয়াছেন, এমন সময় ডাকপিয়ন যাইয়া তাঁহাকে সালাম করিয়া দাঁড়াইল এবং ব্যাগ হইতে একখানি মনি অর্ডারের ফরম বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিল। তিনি ফরম পড়িয়া দেখিলেন, ছয়শত টাকার মনি অর্ডার। প্রেরিকা দাদিমা, গ্রাম, মধুপুর। নুরল তখন স্ত্রীর স্বপ্নের অর্থ বুঝিলেন এবং খোদাতায়ালার নিকট কৃতজ্ঞতা জানাইয়া কহিলেন, “দয়াময়! আমি নগণ্য নরাধম, তুমি আমাকে এমন স্ত্রী-রত্ন দান করিয়াছ!”
শনিবার নুরল টাকা লইয়া বাড়ি আসিলেন। আনোয়ারা টাকার ব্যাগ দেখিয়া হাসিতে হাসিতে কহিল, ‘দাসীর স্বপ্ন ত বৃথা যায় নাই। ‘
নুরল। শুনিয়াছি বেহেস্তের হুরেরা স্বপ্নের নায়িকা; সুতরাং তাহা বৃথা হইতে পারে না।
এই বলিয়া তিনি ছয়শত টাকার তোড়া আনোয়ারার নিকটে দিলেন এবং কহিলেন, “এ টাকা আমি লইব না।”
আনো। কেন?
নুরল। কেন আর বলিতেছ কেন? তিন হাজার টাকার কাবিন গেল। তারপর আরও কত কি উপহার, আবার এককালে এই ছয়শত টাকা।
আনো। তাতে কি?
নুরল। তাহা হইলে যে, বেচারার নিজস্ব বলিয়া কিছু থাকে না।
আনো। প্রয়োজন?
নুরল। সংসার বড় কঠিন স্থান।
আনোয়ারার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, সে ছলছল নেত্রে উর্ধ্বে তাকাইয়া কহিল, “তবে আমি কি পর? আমার জিনিস কি আপনার নয়?” নুরল তাহার কথার ভাবে ও অবস্থাদৃষ্টে একান্ত মুগ্ধ ও বিচলিত হইলেন।
অনন্তর নুরল এসলাম কহিলেন, “টাকাগুলি কার?”
আনো। আপনার।
নুরল। দাদী-আম্মা পাঠাইয়াছেন?
আনো। আপনার টাকা তাঁর কাছে মজুদ ছিল।
নুরল। বুঝিলাম না।
আনো। বাবাজান যদি আমার বিবাহ বাবদ আপনার নিকট টাকা চাহিতেন, আর আপনি যদি তাহা দিতে অস্বীকার করিতেন, তবে এ বিবাহে বিঘ্ন ঘটিত। তজ্জন্য দাদিমা সংকল্প করিয়াছিলেন, আপনি টাকা দেওয়া অস্বীকার করিলে, গোপনে আপনার নিকট (বাপজানকে দিবার জন্য) ইহা পাঠাইতেন। এ সেই টাকা। এই টাকা বিবাহের জন্য আবশ্যক হয় নাই, আপনার নামেই মজুদ রাখা হইয়াছিল।
নুরল। বাপজান যদি হাজার টাকা চাহিয়া বসিতেন?
আনো। দাদিমা আপনার প্রতি আমার মনের ভাব টের পাইয়া বলিয়াছিলেন, যত টাকা লাগে দিয়া আনোয়ারাকে সুখী করিব।
নুরল। তিনি সেকেলে লোক, প্রেম-মাহাত্ম্যের পক্ষপাতী?
আনো। তিনি বলিয়াছেন যে, ‘আমিও স্বরম্বরা মতে বিবাহিতা হইয়াছি।’
আনোয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধে নুরল এসলাম শেষে টাকা গ্রহণে স্বীকৃত হইলেন এবং পরদিন ২/৪ জন সম্ভ্রান্ত প্রধানের মোকাবিলায় তিনি বিমাতাকে নগদ ছয়শত টাকা গুণিয়া দিলেন। পত্নীর পতিপ্রাণতায় তাঁহার চিত্তের ভার কমিয়া গেল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
একযোগে ৬০০ টাকা হাতে পাইয়া নুরল এসলামের বিমাতা, গোপীনপুর হইতে ভ্রাতাকে আবার ডাকিয়া পাঠাইলেন।
ভগ্নিপতির মৃত্যু হইয়াছে; কিন্তু ভগ্নি আছে, তাহার নামেই দুই হাজার টাকার কাবিনের তালুক আছে, বিবাহযোগ্য সুন্দরী ভগিনেয়ী আছে, তদপুরি নিজের বিবাহযোগ্য পুত্রও আছে। এই সকল উপকরণ যোগে আলতাফ হোসেন সাহেব পূর্ব হইতেই দুরাশার সংসারে এক সুখের সুরম্য সৌধ নির্মাণের সঙ্কল্প করিয়া বসিয়াছিলেন। বাসনা পথে যে বিঘ্ন ছিল, ভগ্নী পৃথক হওয়ায় তাহা দূর হইয়াছে; সুতরাং ভগ্নীর এ আহ্বানে তিনি সেই কথা মনে করিয়া অনতিবিলম্বে রতনদিয়া উপস্থিত হইলেন। যথাসময়ে ভ্রাতা-ভগ্নীকে নির্জনে কথোপকথন আরম্ভ হইল।
ভ্রাতা। ডাকিয়াছ কেন?
ভগ্নী। অনেক কথা আছে।
ভ্রাতা। নুরল টাকা দিয়াছে?
ভগ্নী। জী হ্যাঁ।
ভ্রাতা। ধাঁ করিয়া এত টাকা কোথায় পাইল? তলে তলে বুঝি অনেক টাকা পুঁজি করিয়াছিল?
ভগ্নী। তা কি আর বলিতে হইবে? তালুকের খাজনা বছরে প্রায় ৫/৬ শত টাকা, তার মাহিনা ৫/৬ শত টাকা, এত টাকা কোথায় যায়? ইচ্ছামত খরচের জন্য একটি পয়সাও হাতে পাইতাম না। কেবল এক মুঠো ভাত ও একখানি বস্ত্ৰ।
ভ্রাতা। তাতে আর ভুল ‘কি? আমি ভাবিয়া দুঃখিত হইতাম, তোমার থাকিয়াও নাই। যাক, পৃথক হইয়া ভালই করিয়াছ, এখন দু’ পয়সা হাতে পাইবে।
ভগ্নী। ভাইজান, আমার বাড়ি-ঘরের বন্দোবস্ত করিয়া দিন। আমাকে স্থিতি না করিয়া আর বাড়ি ফিরিতে পারিতেছেন না। তারপর স্থিতি হইলে সংসার কিভাবে চলিবে, তাহারও ঠিকঠাক করিয়া দিতে হইবে।
ভ্রাতা। পৃথক হওয়ার পর হইতে তোমাদের ভাবনায় রাত্রিতে ঘুম হয় না। এখন দেখিতেছি বাড়িঘর যেন করিয়া দিলাম, এক-আধজন পুরুষ মানুষ না থাকিলে চলিবে কিরূপে? তালুকের খাজনাপত্র আদায় হেফাজত এসবও করিতে হইবে; উপায় কি? তালুক যখন পৃথক করিয়া লওয়া হইল, তখন নুরল তোমার দিকে একেবারেই ফিরিয়া চাহিবে না।
ভগ্নী একটু রাগভরে কহিলেন, “সে না দেখিলে কি আমার চলিবে না?”
ভগ্নী। যদি কথা রাখেন তবে বলি।
ভ্রাতা। তোমার কথা না রাখিলে চলিবে কেন?
ভগ্নী। আপনার খাদেম আলীকে আমি চাই; সালেহার পতি মানান মত হইবে।
ভ্রাতা মনে মনে হাতে স্বর্গ পাইলেন। তথাপি ভগিনীর নিকট একটু আদর জানাইয়া কহিলেন, “তার মাকে একবার জিজ্ঞাসা করিতে হইবে!”
ভগ্নী। আমি গত বৎসর আভাসে ভাবী সাহেবাকে একটু বলিয়াছিলাম, তিনি বলিলেন, “তোমাদের ছেলে তোমরা লইবে তাতে আপত্তি কি?”
ভ্রাতা। তিনি রাজী হইলে আর কথা নাই।
ভগ্নী। খাদেমকে পাইলে আমার সবদিক বজায় থাকিবে। সে সংসার, তালুক সব দেখিবে; আমিও কূল রক্ষা করিয়া মেয়ে বিবাহ দেওয়ার দায় হইতে খালাস পাইব।
ভ্রাতা আচ্ছা, তোমার ইচ্ছামতই কাজ হোক
আলতাফ হোসেন সাহেবের পূর্বকথিত পুত্রের নাম খাদেম আলী। খাদেম আলী দুইবার মাইনর পরীক্ষায় ফেল হইয়া অধ্যয়ন শেষ করিয়াছে। এক্ষণে সে নবীন যুবক, দেখিতে সুন্দর। কখন দুবেলা, কখন একবেলা, কখনও বা দুই একদিন পর বাড়িতে আহার করে তদ্ব্যতীত সে বাড়ির সহিত আর কোন সম্বন্ধ রাখে না। গ্রামের দুষ্ট যুবকদের সহিত তাহার ঘনিষ্ট সম্বন্ধ। পার্শ্ববর্তী হাটবাজার, শহর-বন্দরের কু-স্থানগুলি তাহার সুপরিচিত।
নগদ টাকা হাতে পাইয়া আলতাফ হোসেন সাহেব ২০/২৫ দিনের মধ্যে ভগ্নীর ঘরবাড়ি প্রস্তুত করিয়া দিলেন। মহানন্দে ভগ্নী নিজ বাটিতে আসিলেন। এখানে আসিয়া তিনি প্রস্তাবিত বিবাহ, কার্যে পরিণত করিতে ইচ্ছা করিলেন। অভিমান ও জিদের বশে নুরল এসলামকে উপেক্ষা করিয়াই বিবাহের বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু নুরল এসলাম লোক পরম্পরায় যখন বিবাহের কথা শুনিলেন, তখন তাঁহার মহান হৃদয়ে দারুণ আঘাত লাগিল। তিনি বিমাতার ব্যবহারে দুঃখিত হইয়াও নূতন বাড়ি দর্শন উপলক্ষে তাঁহার বাড়িতে উপস্থিত হইলেন। বিমাতা তাঁহাকে খানিকটা গর্বের সহিত কহিলেন, “বাপু, পায়ে ঠেলিয়াছে, কুঁড়েঘর দেখিয়া কি করিবে?” নুরল এসলাম কহিলেন, “মা, উল্টা বলিতেছেন, তা বলুন, আমি একটা কথা বলিতে আসিয়াছি, শুনুন। “
বিমাতা। কি কথা?
নুরল। শুনিলাম, খাদেমকে নাকি আপনি ঘর-জামাই রাখিতেছেন?
বিমাতা। হ্যাঁ, তাহাই ত’ মনে করিয়াছি।
নুরল। আমার অমতে আপনি সালেহার বিবাহ দিতে পারেন না; তবে আপনি সুখ- স্বচ্ছন্দে থাকিবেন বলিয়া যখন পৃথক হইয়াছেন, তখন বিবাহে বাধা দিব না। তবে এ বিবাহ আমার মত নাই জানিবেন। বিবাহ দিলে সালেহাকে দোজখে ফেলা হইবে। কারণ, খাদেম মূর্খের মধ্যে গণ্য, বিশেষত তাহার চরিত্র মন্দ
বিমাতা। তা’ হইলেও বড় ঘরের ছেলে ত’? আর সালেহা আমার চোখের উপর থাকিবে। আমি ত’ বিবাহ দিবই।
নুরল বাক্যব্যয় নিস্ফল জানিয়া বাড়িতে ফিরিয়া আসিলেন।
সময়ান্তরে ভগ্নী ভাইকে কহিলেন যে, “উপস্থিত বিবাহ কার্যে নুরল এসলাম নিষেধ করিতে আসিয়াছিল।”
ভ্রাতা। তোমার সুখ-সুবিধা যাতে না হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত শয়তান যে কত চেষ্টা করে, তাহার সীমা নাই।
ভগ্নী। আমিও তাই মনে করিয়া তাহার কথা গ্রহ্য করি নাই।
যথাসময়ে যথাবিধি খাদেম আলীর সহিত সালেহা খাতুনের বিবাহ হইল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বিবাহের পর ছয় মাস এইরূপে কাটিল। এ কয় মাস খাদেমের স্বভাব প্রকাশ পায় নাই, পরে পুরাতন স্বভাব আবার দেখা দিল।
অনন্তর খাদেম আলীর বিলাসপূর্ণ বেলগাঁও যাতায়াত আরম্ভ করিয়া স্বীয় দুশ্চরিত্রের পরিচয় দিতে লাগিল। টাকার অভাব হইল না শাশুড়ীর তালুকের খাজনা, বাজে খাজনাও জোর-জুলুম করিয়া সে যাহা আদায় করিত, তাহার হিসাব-নিকাশ তাহার শাশুড়ীকে বড় দিত না। অধিকাংশ টাকা ইন্দ্রিয়সেবা ও বিলাস-ব্যসনে ব্যয় করিতে লাগিল। শাশুড়ী মনে করিয়াছিলেন—ক্ষুদ্র সংসার, তালুকের খাজনা-পত্রে সুখে-স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইবে; কিন্তু জামাতার গুণে তাহা চলিল না। অল্পদিন মধ্যেই ভগ্নী ভ্রাতাকে সংসার অচল হওয়ার কথা জানাইলেন। ভ্রাতা আসিয়া পুত্রকে শাসন করিলেন; কিন্তু বাৎসল্যপ্রযুক্ত তাহার সর্বনিবাশী চরিত্র-দোষের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া ধীরে ধীরে ভগ্নীকে কহিলেন “আমি তোমার খুব স্বচ্ছলভাবে দিনপাতের নিমিত্ত এক বুদ্ধি স্থির করিয়াছি।” ভগিনী শুনিয়া আশ্বস্থচিত্তে কহিলেন, “কি বুদ্ধি করিয়াছেন, ভাইজান।
ভ্রাতা। ঘর-বাড়ি প্রস্তুত ও ছেলেমেয়ের বিবাহ-খরচ বাদ তোমার হাতে এখন কত টাকা আছে?
ভগ্নী। শতখানেক পরিমাণ টাকা হইবে।
ভ্রাতা। তাছাড়া, তোমার নিজ তহবিল কিছু নাই কি?
ভগ্নি। অনেক দুঃখ-কষ্ট করিয়া হাজার খানেক টাকা রাখিয়াছিলাম।
ভ্রাতা। তুমি ঐ টাকা হইতে সাতশত টাকা আমার হাতে দাও। বেলগাঁও নূতন উন্নতশীল বন্দর হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু জুতার দোকান একটিও নাই, বড়ই সুযোগ। কলিকাতায় আমার দোস্ত মোহাম্মদ সাহেব বড় দোকানদার। ঐ টাকা দিয়া এবং দোস্তের নিকট হইতে বাকি করিয়া আনিয়া, হাজার বারশত টাকার একটি জুতার দোকান খুলিয়া দেই। খাদেম আমার দুইবার ইংরেজি পরীক্ষা দিয়াছে। সে চাকর-বাকর রাখিয়া স্বচ্ছন্দে দোকান চালাইতে পারিবে।
ভগিনী শুনিয়া কিছু মলিন মুখে কহিলেন, “ভাল মানুষের ছেলের জুতা বিক্রি করা কি অপমানের কথা নয়?”
ভ্রাতা। কলিকাতায় যে সকল বড় লোকেরা জুতার দোকান চালায়, তাহাদের কাছে আমরা মানুষই নই।
ভগ্নী। নুরল এসলাম যে ঠাট্টা করিবে?
ভ্রাতা। তাহার গোলামীর অপেক্ষা এ কার্য ভাল।
ভগ্নী। ইহাতে কত লাভ হইবে?
ভ্রাতা। তোমার সাতশত টাকা মজুতই থাকিবে। তাহা হইতে মাসে মাজে ৭০/৮০ টাকা লাভ দাঁড়াইবে। দোকান ক্রমে বড় হইলে আরও বেশি লাভ হইবে। ফল কথা, সাহেবের গোলামী করিয়া নুরল এসলাম যাহা রোজগার করে, এ কার্যে তাহার অপেক্ষা বেশি লাভ হইবে। লাভের টাকাতেই তোমাদের খুব স্বচ্ছন্দে সংসার চলিয়া যাইবে, সঙ্গে সঙ্গে তালুকের টাকা তুমি সিন্দুকে তুলিতে পারিবে।
সতীনের ছেলের চাইতে জামাতা বেশি উপার্জন করিবে শুনিয়া ভগিনী ভ্রাতার হাতে তখনই সাতশত টাকা গণিয়া দিলেন।
আলতাফ হোসেন সাহেবের বৈষয়িক বুদ্ধি মন্দ ছিল না; কিন্তু চরিত্রহীন পুত্রের দোষে যে সমূলে ব্যবসায়ে হানি হইবে, তাহা তিনি ভাবিয়া দেখিলেন না।
আড়ম্বর সহকারে বেলগাঁও বন্দরে জুতার দোকান খোলা হইল। খাদেম আলী দোকানে সর্বেসর্বা হইল। ক্রয়-বিক্রয় প্রথম প্রথম খুবই চলিতে লাগিল। খাদেম গেরদায় ঠেস দিয়া, আলবোলার রজত-নল মুখে ধরিয়া দোকানে বসিল। বিনামা-বিক্রিত নগদ মুদ্রা ঝনাৎ-ঝন – ঝনাৎ শব্দে তাহার সম্মুখে আসিতে লাগিল। ইন্দ্রিয়পরায়ণ নবীন যুবকের বিকৃত মস্তিষ্ক রৌপ্য-চাক্তির চাচিক্যে একেবারে বিগ্রাইয়া গেল। সে অধিকতর পাপাচারী হইয়া উঠিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
খাদেম আলীর এই সুখ-সম্পদের সময়, তাহার আর ৩/৪ টি নূতন ইয়ার জুটিল। ইয়ারগণ তাহার সমবয়স্ক নবীন যুবক। প্রায় সকলেই ধনীর সন্তান, সকলেই পিতামাতার অন্যায় আব্দারে, অনুচিত বাৎসল্যে লালিত-পালিত-আদরের পুতুল। বিলাস-ব্যসন ও ইন্দ্রিয়সেবা ইহাদের নিত্যনৈমিত্তিক কার্য। ইহারা না পারে এমন দুষ্কার্য ছিল না। ইন্দ্রিয়পরায়ণ খাদেম আলীর অর্থোন্নতি দেখিয়া পাপিষ্ঠেরা ঘন ঘন তাহার দোকানে যাতায়াত আরম্ভ করিল। ক্রমে তাহারা খাদেম আলীকে নিজ দলে টানিয়া লইল। ক্রমে তাহাদের সহিত খাদেম আলীর অকৃত্রিম হৃদ্যতা জন্মিয়া গেল।
এই সময় একদিন ইয়ারদল, খাদেম আলীর দোকানে বসিয়া তাহাকে বিশেষভাবে চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “ভাই খাদেম! মিঠাই খাইতে খাইতে নাড়ীতে ময়লা ধরিয়াছে। তোমার নূতন দোকানে নূতন রোজগার, আজ রাত্রিতে দোকানে তোমাকে পোলাওয়ের ভোজ দিতে হইবে।
খাদেম। এ ত’ আনন্দের কথা! কিন্তু এসলাম ভাইকে দেখে ভয় হয়। তোমরা জান, তিনি আমার কুটুম্ব—সাহেবের বড় বাবু। আমার স্বভাব মন্দ বলিয়া তিনি আমার বিবাহে নারাজ ছিলেন। আমার শাশুড়ী বলিয়াছেন, নুরল এসলাম যেখানে, তুমিও সেখানে আছ; সে যেন তোমাকে মন্দ বলিতে না পারে, এমনভাবে চলিবে। আমাদের আমোদ-আহ্লাদ, গান বাজনার কথা যদি নুরল এসলাম ভাই সাহেবের কানে যায়, তবে মুস্কিল।
সমসের। তাঁর চাপরাসীর মুখে শুনিলাম, তিনি আজই বাড়ি যাইবেন!
করিম। তবে আর ভয় কি?
গনেশ। কি ভাই খাদেম, মোরগের না খাসির যোগাড় দেখবো?
গণেশ হিন্দুর ছেলে, লেখাপড়া জানে; আজন্ম ভীত পরন্তু মাথা পাগলা; পাপ ঘনিষ্ঠতায় তাহার জাতিভয় ধর্মভয় বিলুপ্ত হইয়াছে।
খাদেম। তা হ’লে তোমরা যা ভাল বুঝ।
রাত্রিতে মোরগ পোলাওয়ের দাম দেওয়া হইল। দোকান ঘরের প্রকোষ্ঠে পাক ও পানাহার শেষ করিয়া ইয়ারগণ গান-বাজনা, গল্প-গুজব আরম্ভ করিল। কথা প্রসঙ্গে আব্বাস আলী কহিল, “আচ্ছা, তোমরা এ যাবৎ যত স্ত্রীলোক দেখিয়াছে, তাহার মধ্যে কাহাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী বলিয়া জান?” আব্বাস আলীর কথায় ইয়ারগণ খুশি হইয়া স্ব স্ব মত ব্যক্ত করিতে লাগিল। গণেশ কহিল, “বেশ কথা তুলিয়াছ হে আব্বাস, তোমাকে ধন্যবাদ! এমন না হইলে তোমাকে দলপতি বলিয়া মানে কোন্ শালা!”
সমসের গণেশের গা ঘেঁষিয়া বসিয়াছিল সে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বল সমসের, তোমারি মত আগে শুনা যাক্!”
সমসের। আমাদের পাড়ার আলী মামুদের মেয়ে জমিলা।
করিম। না, না, রামজয় ঘোষের বউ।
গণেশ। এসব চেয়ে বেশি সুন্দরী, আমাদের জগত্তারণ বাবুর ভগ্নী নিস্তারিণী ঠাকুরাণী। আহা, বলিব কি, এমন সুন্দরী তোমাদের দুনিয়ায় নাই হে, বেশি আর কি বলিব :
“তড়িৎ ধরিয়া রাখে কাপড়ের ফাঁদে
তারাগণ লুকাইতে চাহে পূর্ণ চাঁদে।”
সমসের। ভেরী গুড।
গণেশ। “কে বলে শারদশশী সে মুখের তুলা,
পদনখে পড়ে তার আছে কতগুলা!”
পয়জার উদ্দিন। এক্সেলেন্ট!
তিলক দাস নামে আর একজন মূর্খ লম্পট সেদিন ইয়ারদলভুক্ত হইয়াছিল। সে গণেশের রূপ বর্ণনা শুনিয়া কহিল, ‘গণেশদা ও কি ঘোড়ার ডিম ক’লা তোমার ওসব কিড়িমিড়ি ত’ বুঝলেম না।’
গণেশ। তিলক-দা এমন প্রাণমাতান কথা বুঝিলে না! তোমার মত গর্ভস্রাবত’ আর দেখি নাই। যদি না বুঝিয়া থাক তবে শুন :
ঠানের মাথারচুল যেন অমাবস্যার আঁধার। মুখখানি তার পূর্ণিমার চাঁদ। কথাতে লবণ-ঝাল দুই-ই আছে। গাল দুটি যেন হলুদ মাখান। দাঁত-গুলি তার পুঁটি মাছ। বুকখানি লাইয়ের জাংলা আর কি। আহা! ঠাকুরুণের পেটটি যেন সুন্দর একটি হাঁড়ী! নিতম্ব যেন মশলাপেষা আস্ত পাটা। পা দু’ খানি মস্ত দুটো কলাগাছ। গায়ের রং আগুনের মত। শরীর ঠাণ্ডা—জলের ন্যায়। অধিক কি বলিব, দিবসেই যেন ধরিয়া খাইতে চায়।
রূপ বর্ণনা শুনিয়া সকলেই হোঃ হোঃ করিয়া হাসিতে লাগিল; কিন্তু তিলক হাসিল না। গণেশ কহিল, “কি হে তিলক, ঠাণের রূপের কথা শুনিয়া দশা ধরিল নাকি?”
তিলক। না ভাই, আমি একটা হিসাব করিতেছিলাম।
গণেশ। কিসের হিসাব?
তিলক। গণেশ-দা, ঠাণ নিকা বসিলে আমি মুসলমান হইতাম।
গণেশ। একেবারে জাত দিবি? কেন রে, এত সখ কেন?
তিলক। ভাই আমি গরিব মানুষ, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটি, তবু সংসার চলে না; তুমি ঠাকুরুণের রূপের যে তালিকা দিলে, তাতে আমি হিসাব করিয়া দেখিলাম ঠাকুরুণ গিন্নী হইলে কেবল চাল কিনিয়া দিলেই গোজরান চলিবে কারণ—ময়মশলা, মাছতরকারী, হাঁড়ি- পাতিল সব ত ঠাণের সঙ্গেই আছে।
পুনরায় সকলে হোঃ হোঃ করিয়া হাসিয়া উঠিল। এইরূপ হাসি-ঠাট্টায় রমণীরূপের ব্যাখ্যা চলিতে লাগিল। সর্বশেষ খাদেম আলী কহিল, “তোমরা যদি কারো কাছে না বল, আমি একটি যুবতীর কথা জানি, তাঁর মত সুন্দরী এদেশে আর নাই। তাঁর মাথায় চুল পায়ে ঠেকে, শরীরের বর্ণ কাঁচা হরিদ্রার মত।” সকলেই তখন দম ধরিয়া খাদেমের মুখের দিকে চাহিল। সে পুনরায় কহিল, “তোমরা বলবে না ত?” সমস্বরে উত্তর হইলে, ‘না, না, না, “ খাদেম তথাপি অনুচ্চস্বরে ভয়ে ভয়ে কহিল, “আমাদের নুরল এসলাম ভাইয়ের স্ত্রী।” সকলে শুনিয়া স্তম্ভিত হইল। শেষে আব্বাস কহিল, “তোমার সঙ্গে কথাবার্তা চলে ত’?”
খাদেম। আমি তাঁকে এ পর্যন্ত দেখি নাই।
সকলে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল! আব্বাস হাসির স্বরেই কহিল, “এক বাড়িতে থাক, অথচ তাঁকে দেখ নাই, কেমন কথা হে? বিশেষত তুমি তাঁর নন্দাই!
খাদেম। বাড়ি একই বটে, কিন্তু পৃথক আঙ্গিনা। ভাই সাহেবের আঙ্গিনার আটা-পেটা উঁচু বেড়া, চাঁদ-সূর্য প্রবেশের যো নাই। বিশেষত তাঁহার সহিত আমাদের বনিবনাও নাই। যাওয়া-আসা একরূপ বন্ধ।
আব্বাস। তোমার স্ত্রীও কি সে আঙ্গিনায় যায় না?
খাদেম। সে মাঝে মাঝে যায়। আমি তাহারই মুখে একদিন শুনিয়াছি!
আব্বাস। তারি সাহায্যে একদিন দেখিবার উপায় করিতে পার না?
খাদেম। বাড়ি যাই না বলিয়া সে আমার কতকটা অবাধ্য হইয়া উঠিয়াছে।
আব্বাস। আচ্ছা, তোমাকে কাল হইতে তিন দিনের ছুটি দেওয়া গেল, ইহারই মধ্যে বউ বাধ্য করিয়া তাহার সাহায্যে বড় বাবুর বউকে দেখিবে। সত্যই তার মাটি-ঠেকান চুল আর হদির মত রং কি-না?
অতঃপর আব্বাস খাদেমকে নির্জনে ডাকিয়া লইয়া কহিল, “ভাই আমি যাহাতে দেখিতে পাই, সে সুযোগটাও করিয়া আসিও। এ কয়টা দিন আমি তোমার দোকানের কাজ চালাইব। বলি, আমাকে বিশ্বাস কর ত’?”
খাদেম। তোমরা বড় লোক, টাকার কুমীর, তোমাদিগকে কে অবিশ্বাস করিবে?
বাস্তবিক বেলগাঁও অঞ্চলে আব্বাসের পিতার খুব নামডাক মানসম্ভ্রম। অবস্থাও খুব ভাল। কেবল তেজারতি কারবারে ৬/৭ লাখ টাকা খাটে, ৩০/৩১ টি গোলাবাড়িতে বিভিন্ন জেলায় তাঁহার ধান-চাউল, পাটের ব্যবসায় চলে; এতদব্যতীত কিছু ভূ-সম্পত্তিও আছে। আব্বাস আলী পিতামাতার অতি সোহাগের একমাত্র সন্তান, গ্রাম্য-স্কুল-পাঠশালায় পড়িয়া তাহার বিদ্যা সাঙ্গ হইয়াছে। যৌবনের প্রারম্ভে সংসর্গ দোষে তাহার এইরূপ মতিগতি। আজকাল আমাদের দুর্ভাগা সমাজে এইরূপ পিতা ও পুত্রের সংখ্যা কম নহে।
খাদেম আলী বাড়ি আসিয়া রাত্রিতে অনেক সাধ্য-সাধনায় সালেহাকে বশ করিল অনন্তর তাহার সাহায্যে পরদিন নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রীকে দেখিল। তার পরদিন দোকানে গিয়া আব্বাসের নিকট কহিল, “ভাই, এমন চিজ আর কখন দেখি নাই। স্ত্রীলোক যে এমন খুবছুরত থাকিতে পারে, তাহা আগে জানিতাম না। সত্যই বলিতেছি, এমন রূপসী এদেশে কেন, এ পৃথিবীতে নাই। সাক্ষাৎ বেহেস্তের হুর। আমি দেখিয়া বেহুঁশ হইয়াছিলাম, আল্লা মেহেরবান তাই রক্ষা।”
আব্বাস দম বন্ধ করিয়া শুনিতেছিল। উদ্বেগাতিশয্যে কহিল, “আমাকে দেখাইবে না?”
খাদেম। দেখাইবার ত’ খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারা কঠিন।
আব্বাস। কেন? তুমি কিরূপে দেখিলে?
খাদেম। আমার স্ত্রীর নিকটে দেখার কথা পাড়াতে সে কহিল, চাঁদ-সূর্য তাঁর মুখ দেখিতে পায় না, আপনি দেখিবেন কিরূপে? তবে রোজ যদি বাড়ি আসেন, তবে কলাকৌশলে একদিন দেখাইতে পারি। আমি ভাবিলাম বাড়ি আসার জন্য স্ত্রী এই ফিকির খাটাইতেছে। স্বীকার করিয়া কহিলাম, কাল দেখাইতে পার কিনা? সে কহিল, চেষ্টা করিব, আপনি সারাদিন বাড়িতে থাকিবেন।
পরদিন একপ্রহর বেলার সময়ে স্ত্রী আমাকে কহিল, ভাই কাল বাড়ি আসেন নাই, চাকর দুইজন স্থানান্তরে গিয়াছে, আপনি এ অবসরে বৈঠকখানার আট-চালার পশ্চিম দিকের আড়ার উপর নিঃশব্দে উঠিয়া দেখিয়া আসুন, নিচে থাকিলে দেখা যাইবে না, ভাবী এখন তাঁহার খিড়কীর বাগানে চুল শুকাইতেছেন, ঐ স্থান দুই মানুষ উঁচু বেড়ায় ঘেরা। স্ত্রীর আদেশ মত আমি যথাসময়ে যাইয়া এইরূপ কষ্ট করিয়া দেখিয়া আসিয়াছি।
আব্বাস। ভাই খাদেম, তুমি আমার হৃদয়বন্ধু। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে ঐরূপ করিয়া একটিবার দেখাও।
খাদেম কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, “তবে আমাকে পুনরায় আজ বাড়ি যাইতে হইবে।” আব্বাস আলী কহিল, “ভাই খাদেম যতবার ইচ্ছা বাড়ি যাও, যেমন করিয়া চালাইতে হয়, আমি তোমার দোকান চালাইব। দেখ, গত তিন দিনে তোমার চাইতে অনেক বেশি বিক্রয় করিয়াছি।”
খাদেম বৈকালে বাড়ি গেল। পরদিন দোকানে আসিয়া কহিল, “ভাই আব্বাস, তোমার জোর কপাল; হুর দর্শনের শুভযোগ উপস্থিত অদ্য ভাই সাহেব কলিকাতা যাইবেন, বৈকালে আমরা দুইজন আমাদের বাড়িতে যাইব। তারপর নির্ভাবনায় তোমাকে হুর দেখাইব।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
অগ্রহায়ণ মাসের মধ্যভাগে নুরল এসলাম কোম্পানির কার্যে কলিকাতা গমন করিলেন। পরামর্শানুযায়ী বৈকালে আব্বাস ও খাদেম রতনদিয়ায় উপস্থিত হইল। ঘন ঘন বাড়ি আসায় সালেহার স্বামী-ভক্তি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। খাদেম স্ত্রীর সাহায্যে নুরল এসলাম সাহেবের স্ত্রীকে দেখার সময় ঠিক করিয়া আব্বাস আলীর সহিত যথাসময়ে পূর্বকথিত বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিল। আব্বাস আলী নিঃশব্দে আড়ার উপর উঠিয়া বসিল। বাঞ্ছিতরত্ন নয়নগোচর হওয়ায়, আব্বাস সঘননিঃশ্বাসে কাঁপিতে লাগিল। খাদেম দেখিল আব্বাস পড়িয়া যায়; এ জন্য সে আব্বাসকে দেওয়ালের কাঠ চাপিয়া ধরিতে ইঙ্গিত করিল। আব্বাস তাহাই করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে নামিয়া আসিয়া উভয়ে খাদেমের নূতন বৈঠকখানায় যাইয়া উপবেসন করিল। অতঃপর কথা আরম্ভ হইল।
খাদেম। কেমন দেখলে?
আব্বাস। বলিয়া বুঝাইতে পারিব না। তুমি কিরূপ দেখিয়াছিলে?
খাদেম। ভাবী উত্তরমুখে চৌকির উপর বসিয়া আছেন, তাঁর চুলগুলি কাঠের আলনায় রূপার দাঁড়ে করিয়া রৌদ্রে ছড়ান রহিয়াছে।
আব্বাস। আমিও প্রথমে সেইরূপ অবস্থায় দেখিলাম; শেষে তিনি চুলগুলি গোছাইয়া দক্ষিণমুখে বাগানের দিকে তাকাইলেন। তাঁর চুল প্রায় মৃত্তিকা স্পর্শ করিল। ওই সময়ে আমি তাঁহাকে দেখিয়া অবশ হইয়া কাঁপিতেছিলাম। তুমি কাঠ ধরিতে ইশারা না করিলে, আমি ধপ করিয়া মাটিতে পড়িয়া যাইতাম। ভাই খাদেম, তোমার সেইদিনের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বাস্তবিক স্ত্রীলোক যে এত সুন্দর আছে, জানি না! আরব্যোপন্যাসে অনেক সুন্দরী স্ত্রীলোকের অদ্ভুত কাহিনী পাঠ করিয়াছি, কিন্তু এমন রূপ, এমন চুলের কথা কোথাও পাই নাই।
খাদেম। নুরল এসলাম ভাইয়ের জীবন সার্থক, এমন রত্ন লাভ করিয়াছেন।
আব্বাস। খাই খাদেম, এ রত্ন যে স্পর্শ করে নাই, তার জীবন বৃথা।
খাদেম একটু দম ধরিয়া থাকিয়া কহিল, “হাজার টাকা ব্যয় করিলেও পারবে না।”
আব্বাস। পাঁচ হাজার!
খাদেম। ও কথাই বলিও না।
আব্বাস। ভাই কথায় বলে, টাকায় বাঘের চোখ মেলে। টাকায় কি না হয়?
নবম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলামের কলিকাতা যাইবার চারিদিন পরে একটি বৈষ্ণবী ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলিয়া তাঁহার বাড়ির উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। বৈষ্ণবীর কপালে, কণ্ঠে ও বাহুতে হরিনামের তিলক কাটা, গায়ে নামাবলী, কাঁধে কন্থার ঝুলি, মাথার চুল উর্দ্ধমুখে খোঁপা করা।
এই সময় আনোয়ারা দক্ষিণদ্বারী ঘরের দাওয়ায় তাহার ফুফু-শাশুড়ীর নিকট বসিয়া, দাসীর ব্যবহারের জন্য একটি বালিসের খোল সেলাই করিয়া দিতেছিল। তাহার সরল ফুফু- শাশুড়ী বৈষ্ণবীকে দেখিয়া কহিলেন, “কি গো, তোমাকে যে অনেকদিন পরে দেখিলাম?”
বৈষ্ণবী। মা দুই বৎসর নবদ্বীপে ছিলাম। অল্পদিন হইল দেশে আসিয়াছি, এখন ঘন ঘন দেখিবেন। আপনাদের দুয়ারে না আসিলে কি আমাদের উপায় আছে?
ফুফু-শাশুড়ী দাসীকে ভিক্ষা দিতে ডাকিবেন, কোন উত্তর পাইলেন না। আনোয়ারা তখন সেলাই রাখিয়া ভাণ্ডার-ঘর হইতে ভিক্ষা আনিয়া বৈষ্ণবীর সম্মুখে রাখিল। বৈষ্ণবী আনোয়ারার আপাদমস্তক বিস্ময় বিস্ফারিত তীব্র দৃষ্টিতে সতর্কতার সহিত দেখিয়া লইল। এবং ফুফু-শাশুড়ীকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “মা, ইনি কে?”
ফুফু। ছেলের বৌ।
বৈষ্ণবী। সিঁধির সিন্দুর অক্ষয় হউক।
আনোয়ারার কপালে সিন্দুর ছিল না। মুলমান-মহিলাগণ সিন্দুর ব্যবহার করেন না। বৈষ্ণবীর এইরূপ উক্তি তাহার বাঁধা গত। অতঃপর সে ভিক্ষা লইয়া প্রস্থান করিল।
বৈষ্ণবীর নাম দুর্গা। তাহাকে দুর্গার মত সুন্দরী দেখাইত বলিয়া তাহার পৈতৃক গুরুদেব দুর্গা নাম রাখিয়াছিলেন। দুর্গা রাজবংশী ধীবরের মেয়ে। বাল্যকালে বিধবা হইয়া ভরা- যৌবনে প্রতিবেশী এক স্বজাতি যুবকের অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়া আসাম নওগাঁয় চলিয়া যায়। তথায় সাত বৎসর অবস্থানের পর যুবক চিররোগা হইয়া পড়িলে, দুর্গা তাহাকে ত্যাগ করিয়া এক উত্তরদেশীয় যুবকের আশ্রয় গ্রহণ করে। সে চাকুরি উপলক্ষে তাহাকে কামরূপ লইয়া যায়। সেখানে যাইয়া দুর্গা অনেক তন্ত্রমন্ত্র শিক্ষা করে। কিছুদিন অবস্থানের পর, রক্ষক ও রক্ষিতার মধ্যে মনোমালিন্য ঘটায়, রক্ষিতা তথা হইতে পুনরায় নওগাঁ পলাইয়া আসে এবং এক বিখ্যাত বাবাজীর আখড়ায় যাইয়া বৈষ্ণবী হয়। আখড়ায় অবস্থান করিতে করিতে দুর্গা অন্য এক নবীন বৈষ্ণবের অধীনতা স্বীকার করিয়া, শেষে তাহাকে লইয়া পিতার দেশে চলিয়া আইসে; কিন্তু পিত্রালয়ে বা পিতার গ্রামে যাইতে সে আর সাহস পাইল না। আব্বাস আলীর পিতা রহমতুল্লা মিঞা, নিজ গ্রাম ভরাডুবার উপকণ্ঠে, নিজ তালুক মধ্যে দুর্গার আখড়া স্থাপন করিয়া দিলেন। সেই হইতে সে তথায় বসবাস করিয়া আসিতেছে। অনেকদিন হইল দুর্গার শেষ বৈষ্ণব ঠাকুরের লোকান্তর ঘটিয়াছে। অতঃপর সে আর নির্দিষ্ট অন্য বৈষ্ণব গ্রহণ করে নাই। এখন দুর্গা প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধকালের সন্ধিস্থলে দণ্ডায়মানা। ভিক্ষা ও কামরূপী মন্ত্রে চিকিৎসা তাহার জীবিকা নির্বাহের ভান মাত্র। হীরা যেমন সুন্দরের মাসী ছিল, দুর্গা সেইরূপ আব্বাস আলীর মাসী হইল এবং তাহার অনুগ্রহে মাসীর গ্রাসাচ্ছাদন চলিতে লাগিল।
দুর্গা ভিক্ষা লইয়া আখড়ায় উপস্থিত হইলে, আব্বাস আলী যাইয়া হাজির হইল।
আব্বাস বলিল, “মাসী খবর কি?”
মাসী। যাদু একদিনেই খবর। ৩/৪ মাসে পাও যদি তাহাও ভাল।
আব্বাস বিলম্বের কথায় বিষণ্ন হইল, তথাপি উদ্দাম বাসনাবশে কহিল, “মাসী, দেবীদর্শন ঘটিয়াছে ত?”
মাসী। যাদু, দেবী নয়, তার চেয়েও বেশি। ভুবন ঘুরিয়াছি, এ জীবনে অমনটি দেখি নাই। হিন্দু-মুসলমান, রাজা-বাদশার ঘরেও অমন পাত্রী জন্মায় না; যেন সাক্ষাৎ পরী, এখন তোমার কপাল।
আবাস। আশা পুরিবে ত?
মাসী। দুর্গা যাহা মনে করে, তাহা সম্পন্ন করে। তবে আজকার ভাবে যাহা বুঝিলাম, তাহাতে কাজ হাসিল করিতে বিলম্ব ঘটিবে।
আব্বাস। কত বিলম্ব?
মাসী। ঠিক বলিতে পারি না। মাস দুই তিন লাগিতে পারে।
আব্বাস। মাসী, এত বিলম্ব প্রাণে সহিবে না; টাকা যত লাগে লও, সত্বর আশা পূরণের চেষ্টা দেখ। একবার হাতে পাইলে আর ছাড়িব না, দেশ ত্যাগ করিতে হয় তাও কবুল।
মাসী। যাদু, শীতে কষ্ট পাইতেছি, হাত খালি, উপায় কি? তারপর ভবানীর মা পরশু নবদ্বীপে যাইবে, তাহাকেও কিছু না দিলে নয়।
আব্বাস কোমর হইতে ২৫টি টাকা খুলিয়া মাসীর হাতে দিল এবং কহিল, “টাকা যত লাগে দিব, কিন্তু—”
মাসী। বিলম্বে কার্যসিদ্ধি—যদি প্রাণে বাঁচি।
আব্বাস চলিয়া গেল।
দশম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলাম তিন সপ্তাহ পর কলিকাতা হইতে বাড়ি আসিলেন। তাঁহার চেহারা মলিন, গলার আওয়াজ বসা। দেখিয়া আনোয়ারার প্রফুল্ল মুখ শুকাইয়া গেল। সে বিষাদস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অমন হইয়াছেন কেন? শরীর যে মাটি হইয়াছে।”
নুরল। কয়েকদিন শীতে ভুগিয়া সর্দি ধরিয়াছে। সর্দিতে গলার আওয়াজ বসিয়া গিয়াছে। আবার গতকল্য গাড়িতে উঠিতে বুকে আঘাত লাগিয়া অত্যন্ত কষ্ট পাইতেছি। আজ যেন একটু জ্বর জ্বর বোধ হইতেছে।
আনো। আর আফিসে যাইয়া কাজ নাই, শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আপাতত দুই সপ্তাহের ছুটি দিন।
নুরল। আচ্ছা, কাল প্রাতে দেখা যাইবে।
রাত্রিতে নুরল এসলামের জ্বর একটু বেশি হইল। তিনি খুক খুক্ করিয়া কাশিতে লাগিলেন। প্রাতঃকালে দেখা গেল, তাঁহার গলার স্বর আরও বসিয়া গিয়াছে, কাশির সঙ্গে রক্ত উঠিয়াছে। রক্ত দেখিয়া আনোয়ারার আত্মা চমকিয়া গেল। নুরল এসলাম বিবাদের আরজীর সহিত ম্যানেজার সাহেবকে লিখিলেন, “অনুগ্রহ পূর্বক আমার জন্য এসিস্ট্যান্ট সার্জন বাবুকে পাঠাইবেন। রাত্রিতে চাকর বেলগাঁও গেল। এসিস্ট্যান্ট সার্জন আসিলেন ও দেখিয়া ঔষধ দিয়া ভিজিট লইয়া চলিয়া গেলেন। ম্যানেজার সাহেব এসিস্ট্যান্ট সার্জনকে ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নুরল এসলামকে কেমন দেখিলেন?”
এঃ সাঃ। অবস্থা ভাল নয়। ক্ষয়কাশের পূর্ব লক্ষণ বলিয়া বোধ হইল।
সাহেব শুনিয়া দুঃখিত হইলেন।
ইহার এক সপ্তাহ পরে দুর্গা বৈষ্ণবী পুনরায় নুরল এসলামের বাড়িতে ভিক্ষার নিমিত্ত উপস্থিত হইল। সে দাসীর মুখে শুনিল, নুরল এসলাম কলিকাতা হইতে পীড়িত হইয়া বাড়ি আসিয়াছেন।
নুরল এসলামের পীড়ার প্রথম হইতেই আনোয়ারার অর্ধাশন, অনিদ্রা আরম্ভ হইল। সে ফুফু শাশুড়ীর হস্তে সাধারণ পাকের ও গৃহস্থালির অন্যান্য বিষয়ের ভার ন্যস্ত করিয়া স্বামীর শুশ্রূষায় আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিল। সে স্বামীর পার্শ্বে বসিয়া তাঁহার পার্শ্ব পরিবর্তন ও নিঃশ্বাস ত্যাগ গণিতে লাগিল। আদেশ শ্রবণে কর্ণকে সতর্ক করিয়া রাখিল। পথ্য বন্ধন, ঔষধ সেবন প্রভৃতি কার্য নিজ হাতে অতি সাবধানে করিতে লাগিল; কিন্তু দিন যতই যাইতে লাগিল, নুরল এসলামের পীড়া ততই বাড়িয়া চলিল। আনোয়ারা হতাশ মনে তীর-বিদ্ধা হরিণীর ন্যায় সে পীড়া নিজ হৃদয়ে অনুভব করিতে লাগিল। সে থাকিয়া থাকিয়া স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনার কেমন বোধ হইতেছে? কি করিলে শান্তি পাইবেন, বলুন, আমি তাহাই করিতেছি।” নুরল এসলাম স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া বলেন, “প্রিয়ে! অদৃষ্টে বুঝি আর শান্তি নাই।” শুনিয়া বুক ভাঙ্গিয়া গেলেও আনোয়ারা স্বামীর সাহস ও ধৈর্যাবলম্বনের নিমিত্ত অশ্রু সম্বরণ করিয়া বলে, “সে কি কথা! এই ত শীঘ্রই ভাল হইবেন। “
২৫/২৬ দিন ডাক্তারী মতে চিকিৎসা চলিল; কিন্তু কিছুই সুফল বুঝা গেল না। রোজ দ্বিপ্রহরের পর হইতে ২/৩ ডিগ্রী করিয়া জ্বর হইতে লাগিল। কাশি পাকিয়া পুঁজে পরিণত হইল, পুঁজে রক্তমিশ্রিত হইয়া উঠিতে লাগিল; কন্ঠস্বর ভাঙ্গা-ভাঙ্গা—আরও অস্পষ্ট হইয়া উঠিল, চক্ষু বসিয়া গেল, কন্ঠের হাড় বাহির হইয়া পড়িল। নুরল এসলাম ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া একেবারে শয্যাশায়ী হইলেন। আনোয়ারা অনন্যোপায়ে প্রিয়সখী হামিদাকে জেলার ঠিকানায় পত্র লিখিতে বসিল। চোখের পানিতে তাহার পত্র ভিজিয়া গেল। সে আদ্র কাগজেই লিখিল, “সই, তোমার সয়া গুরুতর পীড়িত, পত্র-পাঠ সয়াকে দেখিতে পাঠাইবে।”
একাদশ পরিচ্ছেদ
একদিন শনিবার অপরাহ্ণে আট বেহারার একখানি পাল্কি নুরল এসলামের বৈঠকখানার সম্মুখে আসিয়া থামিল। একজন নবকান্তি সোনার চশ্মাধারী যুবক পাল্কী হইতে বাহির হইয়া বৈঠকখানায় উঠিল; এবং তথায় অল্পক্ষণ বিশ্রামের পর বাটীস্থ জনৈক দাসীর আহ্বানে বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ইনি হামিদার স্বামী, জজকোর্টের উদীয়মান উকিল—মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন।
উকিল সাহেব বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলে আনোয়ারা পতির নিকট হইতে খিড়কীর দ্বার দিয়া বাহির হইয়া পাকের আঙ্গিনায় চলিয়া গেল। উকিল সাহেব ঘরে প্রবেশ করিলেন। ফুফু-আম্মা মাথায় কাপড় দিয়া দরজার পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বন্ধু, বন্ধুর চেহারা দেখিয়া মর্মাহত হইলেন। বন্ধুদর্শনে পীড়িত বন্ধুর চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, তিনি অস্পষ্টস্বরে কহিলেন, “দোস্ত, আর বাঁচিবার আশা নাই। অভাগিনী আনোয়ারা রহিল, দেখিও।” উকিল সাহেব নিজে চোখের পানি মুছাইয়া দিলেন এবং আশ্বাস দিয়া কহিলেন, “এর অপেক্ষা কঠিন পীড়ায় লোকে আরোগ্যলাভ করে, খোদার ফজলে তুমি সত্বর আরাম পাইবে। আমাকে পূর্বে খবর দাও নাই কেন?” নুরল দুর্বলতায় ও ভাঙ্গা গলায় ভালমত উত্তর দিতে পারিলেন না। তাঁর ফুফু-আম্মা বারান্দা হইতে কহিলেন, “বাবা ব্যারামের শুরু হইতেই বেলগাঁও-এর বড় ডাক্তার ঔষধ করিতেছেন। তাই আমরা প্রথমে তোমাকে জানাই নাই। কিন্তু দুই একদিন করিয়া প্রায় একমাস যায়, ঔষধে কোন ফল হইতেছে না। ছেলে দিন দিন আরও কাহিল হইয়া পড়িতেছে।” উকিল সাহেব সমস্ত অবস্থা শুনিয়া কহিলেন, “এ পীড়ার ডাক্তারী ঔষধে ভাল ফল হইবে না, কবিরাজী মতে চিকিৎসা করিতে হইবে। আমি এখনই বাসায় গিয়া কাল ভোরে তথাকায় বড় কবিরাজকে পাঠাইব, আল্লার ফজলে তাঁহার ঔষধে ভাল ফল হইবে। আমি মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইব, আপনারা চিন্তিত হইবেন না।” এই সময় রৌপ্য-ফুরসীতে দাসী তামাক আনিয়া উকিল সাহেবের নিকট রাখিল। তিনি তামাক খান, আনোয়ারা তাহা জানিত; তাই দাসীকে আদেশ করিয়াছিল। উকিল সাহেব তামাক খাইয়া প্রস্থানে উদ্যত হইলেন, ফুফু-আম্মা কহিলেন, ‘বাবা আজ থাক, এখন রাতমুখে কিরূপে যাইবে?” উকিল সাহেব কহিলেন, “আজ না গেলে কাল পূর্বাহ্নে কবিরাজ ঔষধ করিতে পারিবেন না। যতই বিলম্ব হইবে ততই অনিষ্ট।” এই সময় দাসীর আসিয়া কহিল, “বউ-বিবি আপনাকে সালাম জানাইয়াছেন এবং একটু অপেক্ষা করিতে বলিতেছেন।” এই বলিয়া সে পুনরায় উকিল সাহেবকে তামাক সাজিয়া দিল।
অনুমান ১৫ মিনিট পরে দক্ষিণদ্বারী ঘরের বারান্দায় দাসী পরিবেশনের স্থান করিয়া উকিল সাহেবকে তথায় ডাকিয়া লইয়া বসিতে দিল। একটু পরে এক রেকাব গরম পরোটা ও এক পেয়ালা হালুয়া তাহারা সম্মুখে আসিল। তিনি দেখিয়া সহর্ষে কহিলেন, “একি! এত সত্বর এরূপ আয়োজন কিরূপে হইল।” দাসী কহিল, “বউ-বিবি এখনই ইহা নিজ হাতে করিয়াছেন।” উকিল সাহেব খাদ্যসামগ্রীর যথাযোগ্য সদ্ব্যবহার করিতেছেন; আনোয়ারা ইত্যবসরে দাসীর দ্বারা ৮ জন বেহারা ও একজন চাপরাশীর উপযুক্ত জল-খাবার বাহির বাড়িতে পাঠাইয়া উকিল সাহেবের পান-তামাকের বন্দোবস্ত করিল।
উকিল সাহেব যাইবার সময় সকলকে বিশেষভাবে আশ্বস্ত করিয়া পাল্কীতে উঠিলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ইতিমধ্যে একদিন দুর্গা পুনরায় ভিক্ষাচ্ছলে নুরল এসলামের বাড়িতে আসিল। দাসী তাহাকে ভিক্ষা আনিয়া দিল। আনোয়ারাকে না দেখিয়া দুর্গা দাসীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের বৌঠাকুরাণীকে ত’ দেখি না?” দাসী কহিল, “দেওয়ান সাহেব পীড়িত হওয়ার পর তিনি সর্বদা তাহার নিকটে থাকেন।”
দুর্গা। দেওয়ান সাহেবের কি ব্যারাম?
দাসী। জ্বর, কাশ ও গলার আওয়াজ বসা।
দুর্গা। কে চিকিৎসা করেন?
দাসী। বন্দরের বড় ডাক্তার।
দুর্গা কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিল, তারপর চলিয়া গেল। এই সময়ে আনোয়ারা শয়নঘরে স্বামীকে নিজ হাতে তুলিয়া পথ্য সেবন করাইতেছিল।
দুর্গা পথে যাইতে যাইতে চিন্তা করিতে লাগিল, একবার কথাবার্তা ধরাইতে পারিলে বুঝিতে পারিতাম, আমার যাদুর শিকারের গতি কোন দিকে। তা’ নির্জনে রহস্যালাপই যে কঠিন ব্যাপার দেখিতেছি।
কয়েকদিন পর আব্বাস আলী মাসীর সহিত দেখা করিল ও কহিল, “মাসী, আর যে সহে না!”
মাসী। যাদু, সবুরে মেওয়া ফলে; ভাগ্য তোমার অনুকূল বলিয়াই বোধ হইতেছে। আব্বাস। কেমন করিয়া বুঝিতেছ?
মাসী। দেওয়ান সাহেবের কঠিন ব্যারাম, অবস্থা এখন-তখন
আব্বাস। আমিও ত’ বেলগাঁও রতীশবাবুর কেরানীর নিকট শুনিলাম, তাঁহাকে ক্ষয়কাশে ধরিয়াছে, বড় ডাক্তার বলিয়াছেন, বাঁচা কঠিন।
মাসী। আমিও দেখিয়াছি ক্ষয়কাশের রোগী প্রায়ই বাঁচে না।
আব্বাস। মাসী, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক, তাহা হইলে চারিমাস দশ দিন আর যাইতে দিব না, শাদী করিয়া সাধ পুরাইব।
মাসী। ঘন ঘন শিকারের সন্ধানে ঘুরিলে লোকে সন্দেহ করিতে পারে; এ নিমিত্ত দুই তিন সপ্তাহ আর আমি রতনদিয়ায় যাইতেছি না। তুমি বেলগাঁও যাইয়া তাহার অবস্থার খবর লইও।
আব্বাস। তাই বলিয়া তুমি নিশ্চিন্ত থাকিও না।
মাসী। তোমার কার্য হাসিলের জন্য আমার রাত্রিতে ঘুম হয় না; নিশ্চিন্ত থাকা দূরের কথা।
এদিকে উকিল সাহেব বাসায় যাইয়া, অতি প্রত্যুষে টাউনের বড় কবিরাজ বিষ্ণুপদ কবিভূষণ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং বন্ধু নুরল এসলামের পীড়ার অবস্থা জানাইয়া তাঁহাকে রতনদিয়ায় যাইতে অনুরোধ করিলেন। কবিরাজ মহাশয় খ্যাতনামা গঙ্গাধর কবিরাজের ছাত্র। এ নিমিত্ত শহরে তাঁহার নাম ডাক খুব বেশি, হাতযশও মন্দ নয়। তিনি উকিল সাহেবকে কহিলেন, “আমি মফঃস্বলে বড় যাই না, বিশেষত আমার তিলমাত্র অবসর নাই।”
উকিল সাহেব কহিলেন, “তবে কি আমরা গরিব মানুষ আপনার অনুগ্রহ লাভে বঞ্চিত হইব?” কবিরাজ মহাশয় উকিল সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, তবে আপনার অনুরোধে স্বীকৃত হইলাম। আমার ভিজিটের কথা বোধহয় আপনি জানেন? মফঃস্বলে দৈনিক ৫ টাকা।
উ। রোগী গরিব, টাকা আমাকে দিতে হইবে। অনুগ্রহপূর্বক দৈনিক ৩ টাকা করিয়া স্বীকার করুন, কৃতজ্ঞ থাকিব।
কবি। পাল্কীভাড়া ও ঔষধের দাম পৃথক লাগিবে—অবশ্য জানেন।
উ। আমার ৮ বেয়ারার পাল্কী আছে, তাহাতেই যাতায়াত করিবেন।
কবিরাজ মহাশয় মুখখানি একটু ছোট করিলেন; কারণ পাল্কীভাড়া দ্বিগুণ চার্জ করিয়া অর্ধেক টাকায় কাজ সারিতেন, তাহা হইল না। উকিল সাহেব ৫০ টাকার একখানি নোট কবিরাজ মহাশয়ের হাতে দিয়া কহিলেন, “এখনই পাল্কী পাঠাইতেছি, আপনি এই বেলাতেই যাইয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিবেন। অবস্থা বুঝিয়া দুই একদিন থাকিতে হইলেও থাকিয়া আসিবেন।” কবিরাজ মহাশয় সম্মত হইলেন।
কবিরাজী মতে চিকিৎসা আরম্ভ হইল। নুরল এসলাম প্রথমত অনেকটা সুস্থ হইলেন। তাঁহার জ্বর ও স্বরভঙ্গ কমিয়া আসিল, কাশির সঙ্গে পুঁজ-রক্ত উঠা বন্ধ হইল। তিনি ক্রমে শয্যায় উঠিয়া বসিলেন, যষ্টিভরে ক্রমে ক্রমে ২/১ পা করিয়া হাঁটিতে লাগিলেন। তুষার- শৈত্য-সঙ্কুচিতা নলিনী যেমন তরুণ-অরুণ-আভা বক্ষে লইয়া হাসিতে হাসিতে ফুটিয়া উঠে, পতির আরোগ্য লক্ষণ দৃষ্টে আনোয়ারাও সেইরূপ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। একদিন নুরল এসলাম স্ত্রীকে কহিলেন, “অনেকদিন হয় গোসল করি নাই, নামাজও কাজা হইতেছে; আজ আমাকে গোসল করাও, প্রাণ ভরিয়া নামাজ পড়িব।
স্ত্রী। কবিরাজকে না জিজ্ঞাসা করিয়া গোসল করিবেন?
নুরল। কবিরাজ ত বলিয়াছেন গরম জলে স্নান করিতে পারেন।
আনোয়ারা পানি গরম করিয়া নিজ হাতে স্বামীকে গোসল করাইল। পুষ্টিকর লঘুপাক খাদ্যাদি নিজ হাতে প্রস্তুত করিয়া তাঁহাকে তৃপ্তির সহিত ভোজন করাইল। প্রথম বেলা একরূপ কাটিল; কিন্তু, হায়! অপরাহ্ণে নুরল এসলামের গা গরম হইয়া উঠিল, রাত্রিতে কাশি বৃদ্ধি পাইল। তিনি পুনরায় পূর্ববৎ কাতর হইয়া পড়িলেন। পুনরায় কবিরাজ আসিলেন, ঔষধ চলিতে লাগিল; কিন্তু প্রথমবারের ন্যায় সত্বর আর ফল হইল না। নুরল এসলাম চিররোগা হইয়া পড়িলেন। প্রিয় সুহৃদ উকিল সাহেব মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। আনোয়ারার ধৈর্য ও পতিব্রতা যেন নারীজাতির শিক্ষার জন্য ক্রমশ স্ফূর্তিলাভ করিতে লাগিল।
আনোয়ারা স্বামীর পীড়ার আরম্ভকাল হইতেই, নামাজ অন্তে তাঁহার আরোগ্য-কামনায় মাথা কুটিয়া মোনাজাত করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মোনাজাতের সময় তাহার বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া যাইত। খোদাতালার নিকট মোনাজাত করিতে লাগিল। প্রত্যহ এশার নামাজ বাদ হাত তুলিয়া বলিত, “হে দয়াময়! তোমার পবিত্র নামে আরম্ভ করিতেছি। সমস্ত প্রশংসা তোমার। হে সর্বশক্তিমান খোদা! তুমি আঠার হাজার আলমের মালিক। তুমি মানুষের নিকট নিরানব্বই নামে প্রকাশিত। হে দয়াময়! দাসীকে বলিয়াকে দাও, কোন নামে ডাকিলে তুমি তুষ্ট হইবে? কোন্ নামে ডাকিলে তুমি দাসীর স্বামীকে আরোগ্য করিবে? নাথ! আমি জ্ঞানহীন মূঢ়মতি বালিকা, আজ তোমাকে তোমার প্রকাশিত সমুদয় নাম ধরিয়াই ডাকিতেছি।” এইরূপ কাতরতা প্রকাশ করিয়া বালিকা খোদাতালার নিরানব্বই নাম ধরিয়া প্রার্থনা করিত। ভক্তি-জনিত অশ্রুধারায় তাহার দেহবস্ত্র সিক্ত হইয়া যাইত। বালিকা শেষে বলিত “প্রভো! আঁধারে থাকিয়া ডাকিতেছি বলিয়া কি দাসীর প্রার্থনা শুনিবে না? হে রহিম-রহমান! তুমি বুঝিতেছ—দেখিতেছ, তবে কোন্ প্রার্থনা শুনিবে? দয়াময়! দাসীর হৃদয়ের ভাব বুঝিয়া যদি পতি-সেবার অধিকার দিয়াছ, তবে এত সত্ত্বর তাহা হইতে বঞ্চিত করিও না। তাঁহার চরণ সেবায় দাসীর নারীজন্ম ধন্য হইতে দাও।”
আনোয়ারা কায়মনোবাক্যে এইরূপ প্রার্থনা শেষ করিয়া স্বামীর চরণে হাত বুলাইত। বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বিশ্বাস না করিলেও আমরা জানি, বালিকা যেদিন এইরূপ বিশেষভাবে মাথা কুটিয়া পতির আরোগ্য-কামনায় প্রার্থনা করিত, সেদিন, নুরল এসলামের সুনিদ্রা হইত এবং পরদিন তিনি আপনাকে অনেকটা সুস্থ বোধ করিতেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মাসাধিক পর একদিন অপরাহ্ণে দুর্গা আবার নুরল এসলামের বাড়িতে ভিক্ষার ভানে উপস্থিত হইল। সেদিন দেখিল, আনোয়ারা পশ্চিমদ্বারী ঘরে আসরের নামাজ অন্তে হাত তুলিয়া মোনাজাত করিতেছে, তাহার নেত্রদ্বয় হইতে অবিরাম অশ্রু ঝরিতেছে। দুর্গা আনোয়ারার এবম্বিধ অবস্থা দেখিয়া দ্বারের চৌকাঠের উপর বসিল। বসিয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিল, ‘স্বামী অনেকদিন ধরিয়া কাতর—সেবা-শুশ্রূষায় বিরক্ত ধরিয়াছে; তাই যাতনা সহিতে না পারিয়া হয় স্বামীর, না হয় নিজের মৃত্যু কামনা করিতেছে। শিকারের উপযুক্ত সময় বটে।’ আনোয়ারা অনেকক্ষণ পর মোনাজাত শেষ করিয়া চোখের পানি মুছিয়া পাশ ফিরিয়া বসিতেই দেখিল, সম্মুখে দুর্গা। দুর্গা কহিল, “মা, কাঁদিতেছেন কেন?” আনোয়ারা দুর্গার কথার ভঙ্গি ও মুখের চেহারায় বিরক্ত হইয়া কোন উত্তর করিল না। দুর্গা ব্যথার ব্যথী হইয়া কহিল, “মা, ও দুঃখ আমিও পোহাইয়াছি। আপনার এই বয়সেই একবার ঠাকুর মরণাপন্ন কাতর হয়; তখন সুখ-সন্তোষ বিসর্জন দিয়া না খাইয়া না শুইয়া তাহার সেবা করিলাম; কিন্তু তাহাকে আর ফিরাইতে পারিলাম না। কি করিব? সবই অদৃষ্টের লেখা। আমরা হিন্দুর মেয়ে, সারা জীবন বিধবা থাকিয়া কাটাইলাম।” দুর্গার কথা আনোয়ারার কানে ভাল লাগিল না, সে ঘর হইতে উঠিয়া গেল। রান্নার আঙ্গিনায় যাইয়া দাসীকে আদেশ করিল, “বৈষ্ণবীকে ভিক্ষা দিয়া বল, ও যেন এ বাড়িতে আর ন আসে।” দাসী ভিক্ষা দিয়া দুর্গাকে কহিল, “তুমি এ বাড়িতে আর আসিও না।”
দুর্গা। কেন গো, কেন?
দাসী। বউ-বিবির হুকুম।
দুর্গা। কি অপরাধ করিলাম?
দাসী। তা তুমি জান।
দুর্গা “আচ্ছা” বলিয়া, রাগে গর্গর্ করিতে করিতে চলিয়া গেল এবং পথে বলিতে বলিতে যাইতে লাগিল, ‘কত রূপসী দেখিয়াছি এমন বদ-দেমাগী ত কোথায় দেখি নাই; যেন কত বড় নবাবের কন্যা; ঘেন্নায় কথা কন না। দুর্গার কথা আর কেহ শুনিল না। কেবল সালেহার মার কানে গেল। তিনি প্রাচীরের আড়ালে থাকিয়া দুর্গাকে ইশারায় ডাকিতেছেন। সে সালেহাদিগের আঙ্গিনায় ঢুকিয়া পড়িল। সালেহার মা তাহাকে আদর করিয়া বসিতে দিয়া কহিলেন, “তুমি অমন বকাবকি করিতেছ কেন?”
দুর্গা। মা, আমরা দশ দুয়ার মাগিয়া খাই, তা ও-বাড়ির বউ আমাকে ভিক্ষা দিবে না বলিয়া জবাব দিয়াছে।
সালেহার মা। বউকে তুমি কি বলিয়াছিলে?
দুর্গা। মা, বলিব আর কি। একালে কি কারো ভাল করিতে আছে? আমি ভিক্ষার জন্য যাইয়া দেখি, বউ পশ্চিমদ্বারী ঘরে পশ্চিম মুখে বসিয়া হাত তুলিয়া কাঁদিতেছে, তাহার দুঃখ দেখিয়া দুঃখ হইল, তাই বলিয়াছিলাম,–সোয়ামী কাতর, কাঁদবার কথাই ত’, উপায় কি? বিপদে ভগবান ভরসা!
সালেহার মা। এ ত’ ভাল কথা। তা’ তুমি ত’ বৈষ্ণবী, আমি বড় ঘরের মেয়ে হইয়া বৌয়ের জ্বালায় দু’দিন সংসারে তিষ্টিতে পারিলাম না। স্বামী-সোয়াগী স্বামীকে পরামর্শ দিয়া আমাকে পৃথক করিয়া দেওয়াইয়াছে।
দুর্গা। আমার নাম দুর্গা বৈষ্ণবী। আমি এ অপমানের শোধ লইব, তবে ছাড়িব।
সালেহার মা। কেমন করিয়া লইবে?
দুর্গ। যেমন করিয়া হোক।
কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া দুর্গা কহিল, “আপনারা ও-বাড়িতে যাতায়াত করেন না?”
সালেহার মা। বেশি না, নুরল কাতর শুনিয়া একবার দেখিতে গিয়াছিলাম। আমার এক অবুঝ মেয়ে আছে, সে চুপে চুপে অনেক সময় যায়।
এই সময় সালেহা সেখানে আসিল।
দুর্গা। এইটি কি আপনার মেয়ে? সালেহার মা। হ্যাঁ।
হীরা প্রকৃতি দুর্গা, তাহাকে শুনাইয়া কহিল, “দেওয়ান সাহেবের যে ব্যারাম তা তাহার বড় ডাক্তার-কবিরাজের অষুধ খাইলেও সারিবে না।’
সালেহার মা। তবে কিসে সারিবে?
দুর্গা। যাহাতে সারিবে আমি তাহাই বউটিকে বলিতে গিয়াছিলাম, তা’ কালের দোষ। ভাল করিতে গেলে লোকে মন্দ বুঝে। আমাকে বউটি তাহাদের বাড়ি যাইতে নিষেধ করিয়াছে।
সালেহা। তোমরা যাহাই বল অমন ভাল বউ কোথাও নাই। অমন মিষ্টি কথা আর কোন মেয়েলোকের মুখে শুনি নাই।
সালেহার মা চোখ রাঙ্গাইয়া কহিলেন, “দ্যাখ বজ্জাতের বেটি, তোর যে বড়ই বাড়াবাড়ি দেখিতেছি।”
মেয়ে চুপ করিল। দুর্গা বিদায় হইল।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
যেদিন আনোয়ারা দুর্গাকে তাড়াইয়া দেয়, তার পরদিন সালেহা সকালবেলা চুপে চুপে নুরল এসলামের আঙ্গিনায় গেল, তখন আনোয়ারা রান্নাঘরের আঙ্গিনায় উপস্থিত ছিল।
সালেহা। ভাবি, ভাই সাহেব কেমন আছেন?
আনোয়ারা। পূর্বের ন্যায়, কিন্তু কাশি একটু বাড়িয়াছে।
সালেহা। কাল বিকালে যে বৈষ্ণবী আপনাদের আঙ্গিনায় ভিক্ষা করিতে আসিয়াছিল, তাহাকে আপনি তাড়াইয়া দিয়াছেন কেন?
আনোয়ারা। (সালেহার মুখের দিকে চাহিয়া) তুমি কিরূপে জানিলে?
সালেহা। সে আমাদের বাড়িতে বলিয়া গিয়াছে।
আনোয়ারা। তাহার কথা ও ভাবভঙ্গি আমার নিকট ভাল বোধ হইল না।
সালেহা। আপনি তাহাকে তাড়াইয়া দিয়া ভাল করেন নাই।
আনোয়ারা। কেন?
সালেহা। সে কহিল, ভাইজানের ব্যারাম ডাক্তার-কবিরাজের অষুধ-পত্রে আরাম হইবে না। যাহাতে আরাম হইবে সে তাহা জানে।
আনোয়ারা। বদ্ স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিতে নাই।
সালেহা। ফকির বৈষ্ণব কাহার মধ্যে কি গুণ আছে বলা যায় না। মামুজানের মুখে শুনিয়াছি, ঠাকেঠিকে দুনিয়া। হয়ত ঐ বৈষ্ণবীর অষুধপত্রে ভাইজান আরামও হইতে পারেন।
আনোয়ারা ভাবিতে লাগিল, সালেহা ত’ মন্দ কথা বলিতেছে না। বৈষ্ণবীই বা মন্দ কথা কি বলিয়াছে? দাদিমাও বলিতেন, ঠাকেঠিকে দুনিয়া। ফকির সন্ন্যাসীকে অবজ্ঞা করিতে নাই। গোলেস্তায় পড়িয়াছি, সামান্য ঝিনুকে মতি থাকে, লতা-গুল্মেও সিংহ বাস করে। বৈষ্ণবী সালেহার কাছে বলিয়াছে, যাহাতে ব্যারাম সারে তাহা আমি জানি। বহু দেশে ঘোরে, অনেক জানাশুনা থাকিতে পারে; সুতরাং তার ঔষধে রোগ সারিবে বিচিত্র কি? এইরূপ চিন্তা করিয়া আনোয়ারা সালেহাকে বলিল, “বুবু, সত্যই কি বৈষ্ণবী তোমার ভাইজানের পীড়ার ঔষধ জানে বলিয়াছে?”
সালেহা। আমি কি আপনার নিকট মিথ্যা বলিতেছি?
আনোয়ারা। তবে ত’ বৈষ্ণবীর উপর রাগ করিয়া ভাল করি নাই। এখন তাহাকে পাইবার উপায় কি?
সালেহা। আপনি যখন তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছেন, তখন সে বিনা ডাকে আসিবে বলিয়া বোধ হয় না।
আনোয়ারা। কাহাকে দিয়া ডাকাইব?
সালেহা। আচ্ছা, আমি চেষ্টা করিয়া দেখি।
আনোয়ানা। বুবু, তোমার পায়ে পড়ি, সে যাহাতে আসে অবশ্য তাহাই করিবে।
বৈষ্ণবীকে তাড়াইয়া দিয়া সে যারপরনাই অন্যায় কার্য করিয়াছে বলিয়া মনে করিল এবং তজ্জন্য অনুতাপে দগ্ধ হইতে লাগিল।
এদিকে দুর্গা আখড়ায় বসিয়া আব্বাস আলীকে ডাকিয়া পাঠাইল। সে শ্রবণমাত্র ব্যস্ত হইয়া উপস্থিত হইল।
দুর্গা। যাদু, বড় কঠিন স্থান। তোমার মনোমোহিনী আমাদের সীতা সাবিত্রীকে হারাইয়া দিয়াছে।
আব্বাস। সে কেমন?
দুর্গা ভিক্ষা নিষেধের কথা প্রভৃতি আব্বাস আলীর নিকট খুলিয়া বলিল।
আব্বাস। তবে এখন উপায়?
দুর্গা। দুর্গা নিরুপায়ের খুব উপায় জানে?
আব্বাস। মাসী, কি উপায় করিবে?
দুর্গা। উপায়ের পথে পা দিয়া তবে বলিব। বাছা, দু’দিন সবুর কর, আজ নিজের ভাবনায় ব্যস্ত আছি।
আব্বাস। মাসী, তোমার আবার নিজের ভাবনা কি?
দুর্গা। ঘরে একমুঠা চালও নাই, ভিক্ষা ত কেবল তোমারই কার্যোপলক্ষে। কাল হাট হইবে কি দিয়া, তাই ভাবিতেছি।
আব্বাস পকেট হইতে ১০টি টাকা বাহির করিয়া দুর্গার হাতে দিল এবং বলিল, “মাসী, অভাবের ভাবনা মোটেই ভাবিনও না! মোনবাঞ্ছা সিদ্ধি হইলে একযোগে তিনশত টাকা পাইবে।”
পরদিন আব্বাস আলী বেলগাঁও বেড়াইতে গেল। তথায় খাদেম আলী তাহাকে বলিল, ভাই এক সুখবর, তোমার প্রাণমোহিনী দুর্গাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছে, তুমি যাইয়া অদ্যই তাহাকে তাহার নিকট পাঠাইয়া দাও।
আব্বাস। তোমার মুখে সন্দেশ। আমি এখনই চলিলাম।
দুর্গার সহিত আব্বাস আলীর ষড়যন্ত্রের কথা খাদেম আলী সব জানে। তাহার চরিত্র মন্দ, এ নিমিত্ত নুরল এসলাম যারপরনাই দুঃখিত এবং তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট! পাপমতি খাদেমও নুরল এসলামের প্রতি দারুণ বিদ্বেষপরায়ন এবং এই কারণে সে এই ষড়যন্ত্র দলভুক্ত। খাদেম আলীর স্ত্রী সেই দিনই তাহার নিকট দুর্গাকে নুরল এসলামের বাড়িতে আসার সংবাদ দিতে অনুরোধ করে।
আব্বাস আখড়ায় আসিয়া দুর্গাকে কহিল, “মাসী, এইবার বুঝি তোমার শ্রম সার্থক হয়।”
দুর্গা। মাসীর শ্রম বিফলে যাইবার নহে; তবে আজ শ্রম সফল হইবে কিরূপে বুঝিতেছি না।
আব্বাস। তোমার উর্বশী তোমাকে ডাকিয়া পাঠইয়াছে।
দুর্গা। কে বলিল?
আব্বাস। উর্বশীর নন্দাই খাদেম আলী।
দুর্গা। এত সত্ত্বর, তবে অষুধ ধরিয়াছে! আচ্ছা, দু’দিন পরে যাইব। আব্বাস। আজই যাও না কেন?
আব্বাস। যাদু, এরূপস্থলে ডাকামাত্র হাজির হইলে বুজুর্কি কমিয়া যায়, যত গৌণ করিব, ততই আগ্রহ হইবে। বাড়া আবেগের মুখে কাজ হাসিলের সুযোগ বেশি।
আব্বাস। বুঝিলাম, এমন চিক্কণ বুদ্ধি না হইলে কি তুমি যেখানে সুঁচ চলে না সেখানে ফাল চালাও!
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
চিকিৎসার ত্রুটি নাই, তথাপি পীড়া উপশমের কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। পীড়া যখন বেশি বাড়িয়া উঠে, তখন পতিপ্রাণা বালিকার ক্ষুদ্র হৃদয়খানি নানা আশঙ্কায়, নানা সন্দেহে আলোড়িত হইতে থাকে। সে কখন ভাবে, তাহার সেবা-শুশ্রূষার ত্রুটিতেই বুঝি এরূপ হইতেছে। আবার ভাবে, তাহার নিয়মিত রূপে ঔষধ সেবন করানোর ভুল-ভ্রান্তিতে বুঝি পীড়া বৃদ্ধি পাইতেছে। তাই সে নামাজ অন্তে প্রার্থনার সময় মাথা কুটিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলে, ‘দয়াময় খোদা! দাসীর দোষে স্বামীর পীড়া বাড়াইও না। জননী উপদেশ দিয়া গিয়াছেন, ‘মা, নিজের দোষে স্বামীর অসুখ-অশান্তি যাহাতে না হয়, তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখিবে; অন্যথায় পরকালে দোজখের আগুনে দগ্ধিয়া দগ্ধিয়া কাল কাটাইতে হইবে।’ নাথ! জননীর উপদেশ দাসীর হৃদয়ে চিরাঙ্কিত হইয়া রহিয়াছে। প্রভো! চারিমাস যাইতে বসিল, রোগের যন্ত্রণা স্বামী আর কতকাল সহ্য করিবেন? হায় বিধাতঃ! তাঁহার সুগঠিত দেহ অস্থি কঙ্কালসার হইয়াছে; তাহার সুন্দর মুখখানি একেবারে মলিন হইয়া গিয়াছে, তাঁহার সুধামাখা কথা নিদারুণ রোগযন্ত্রণায় আর বাহির হইতেছে না। হে রহিম-রহমান! আমায় ফেরেস্তার মত পতির এ অবস্থা যে আর প্রাণে সহিতেছে না? করুণাময়! দাসীর শেষ প্রার্থনা, তুমি তাঁহার দুরারোগ্য ব্যাধি দাসীর দেহে সঞ্চারিত কর দাসী অক্লেশে অম্লানচিত্তে তাহা সহ্য করিবে। অনাথপতি! দাসীকে আর কাঁদাইও না। “
কিন্তু হায়! বিধাতা বুঝি সতীর সাধনায় কর্ণপাত করিলেন না। পতি ক্রমশ মৃত্যুর নিকটবর্তী হইতে লাগিল। একদিন আনোয়ারা স্বামীর পদপ্রান্তে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল, “বৈষ্ণবীকে তাড়াইয়া দেওয়াতে বুঝি স্বামীর পীড়া বাড়িয়া উঠিয়াছে। এবার সে আসিলে তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিব, স্বামীর আরোগ্য হেতু সে যাহা বলিবে তাহাই শুনিব। সালেহা বলিয়া গিয়াছে, আমি তাহার আসিবার উপায় করিব। সে কি কোন উপায় করিতে পারে নাই? হায়! বৈষ্ণবী বুঝি আর আসিবে না। কেন তাহাকে আসিতে নিষেধ করিয়াছি? তাহার ঔষধে বুঝি স্বামী আমার নিরাময় হইতে পারিতেন। হায়! কি সর্বনাশ করিয়াছি! নিজ দোষে পতির মৃত্যুর কারণ হইলাম।” ভাবিতে ভাবিতে বালিকার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল । কিয়ৎক্ষণ পর চোখের জল মুছিয়া স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ আপনার কেমন বোধ হইতেছে?” নুরল এসলাম কহিলেন, “কিছু বুঝি না। যখন তুমি গায়ে পায়ে হাত বুলাও, তখন মনে হয় ব্যারাম বুঝি সারিয়া গিয়াছে। আবার ধীরে ধীরে শরীর খারাপ হইতে থাকে।” আনোয়ারা দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলিয়া আগ্রহের সহিত স্বামীর পদে হাত বুলাইতে লাগিল; এমন সময় ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলিয়া দুর্গা নুরল এসলামের আঙ্গিনায় আসিয়া দাঁড়াইল; আনোয়ারা বৈষ্ণবীর গলার আওয়াজ শুনিয়া ধীরে ধীরে তখন বাহিরে আসিল এবং দুর্গাকে দেখিয়া যেন হাতে স্বৰ্গ পাইল।
হায় পতিপ্রাণা বালিকা! প্রথম দিন ভিক্ষা দিতে যাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করাও আবশ্যক মনে কর নাই, দ্বিতীয়বার যাহার কথা শুনিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিয়াছিলে, অসতী বলিয়া যাহাকে বাড়ির উপর আসিতে পর্যন্ত নিষেধ করিয়াছিলেন, আজ তাহার কন্ঠস্বর মাত্র শুনিয়া বাহিরে আসিলে, দেখিয়া হাতে স্বর্গ পাইলে; পতির প্রাণরক্ষায় উন্মাদিনী তুমি! তোমার এ ব্যবহার, তোমার মনের এ ভাব, সতী ব্যতীত অন্যে কি বুঝিবে?
আনোয়ারা দুর্গাকে রন্ধনশালার দিকে ডাকিয়া লইয়া গেল।
দুর্গা। মা, ডাকিয়াছেন কেন?
আনোয়ারা। না বুঝিয়া তোমাকে বাড়ির উপর আসিতে নিষেধ করিয়াছিলাম, মনে কিছু করিও না।
দুর্গা। না মা, সে কথা আমি তখনই ভুলিয়া গিয়াছি। দেওয়ান সাহেবের শরীর কেমন?
আনোয়ারা। তাঁর কাশি একটু বাড়িয়াছে।
দুর্গা। যে দুরন্ত ব্যাধি, কবিরাজি ঔষধ-পত্রে তাহা আরাম হইবে না।
আনোয়ারা বুক চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তবে কিসে আরাম হইবে?
দুর্গা। আরামের উপায় আছে, কিন্তু বড় কঠিন।
আনোয়ারা। হাজার কঠিন হোক তুমি আমাকে খুলিয়া বল।
দুর্গা। মা, আমরা হিন্দু, আমাদের তেত্রিশ কোটি দেবতা; ক্ষয়কাশ, যক্ষ্মাকাশ, ওলাওঠা প্রভৃতি রোগকেও আমরা দেবতা বলিয়া মানি। ইহারা যাহাকে ধরেন, তাহার নিস্তার নাই; তবে দেবতাগণকে তুষ্ট করিতে পারিলে তাহারা ছাড়িয়া দেন।
আনোয়ারা। তোমার দেবতারা কিসে তুষ্ট হন?
দুর্গা। আপনার স্বামীকে ক্ষয়কাশ-দেবতা আশ্রয় করিয়াছেন, তাঁহাকে ছাড়াইতে হইলে, জীব-সঞ্চার-ব্রত সাধন করিতে হইবে, কিন্তু তা করা বড় কঠিন ব্যাপার।
আনোয়ারা। জীব-সঞ্চার-ব্রত কিরূপ?
দুর্গা। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে মঙ্গলবার বা শনিবার দুপুর রাত্রিতে শ্মশান হইতে মরা আনিয়া তাহার উপর বসিয়া যোগমন্ত্র পড়িতে হয়। তারপর গলায় কাপড় দিয়া ধন্বন্তরী দেবতাকে বলিতে হয়, ‘হে মহাপ্রভু! আমার অমুক রোগীর শরীর হইতে অমুক রোগকে ছাড়িবার আদেশ করুন! তার ভোগের জন্য জীব দিতেছি।’ এই কথার পরই, যিনি ব্ৰত করিবেন, তিনি মরার শিয়রের দিকে দাঁড়াইয়া কাহারো নাম তিনবার উচ্চারণ করিবেন, রোগটি তখনই রোগীর দেহ হইতে যাইয়া তাহাকে আশ্রয় করিবে। ফলে, রোগী সুস্থ হইয়া উঠিবে; কিন্তু যাহার নাম করা হইবে, সে এ রোগে আক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিবে। ইহাই জীবন-সঞ্চার-ব্রত।
দুর্গার কথা শুনিয়া সভয়ে বালিকার দেহ কন্টকিত হইয়া উঠিল, মুখের বর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গেল। তাহার মনে এক বিষম আন্দোলন উপস্থিত হইল, ‘স্বামী এবং ধর্ম কাহাকে রক্ষা করি?’ এই বিরোধের ঘাতপ্রতিঘাতে তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়খানি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। সে কিছুই করিতে না পারিয়া নীরব হইয়া রহিল।
দুর্গা। মা, আপনি কি ভয় পাইলেন?
আনো। না ভয় পাই নাই।
দুর্গা। তবে ব্রত করাইবেন?
আনোয়ারা। বৈষ্ণবী, তুমি বড়ই ভয়নাক কথা তুলিয়াছ। আমি স্বামীর জন্য প্রাণ দিতে তিলমাত্রও কুণ্ঠিত নহি; কিন্তু ধর্মভয়ে আমার প্রাণ কাঁপিতেছে। আমাদের কেতাবে এরূপ ব্রত করা শেরেক্। যিনি প্রাণ দিয়াছেন তিনিই রক্ষা করিবেন-আমি স্বামীর প্রাণের বদলে আমার হৃদয়ের রক্ত দিতে প্রস্তত আছি।
বল, তোমার এই ধর্মবিরুদ্ধ ব্রত ভিন্ন আর কোন উপায় আছে কি? কিন্তু আমি কোন শেরেকের কাজ করিতে পারিব না। আমাকে খোদার কাছে এক দিন অবশ্যই জবাব দিতে হইবে।
দুর্গা চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। কিছু পরে বলিল, “মা, অন্য আর এক উপায়ে আছে।”
আনোয়ারা। ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “আর কি উপায়?”
দুর্গা। সে উপায়ও বড় কঠিন।
আনোয়ারা। যতই কঠিন হোক না, তুমি খুলিয়া বল।
দুর্গা। মৃতসঞ্জীবনী বলিয়া এক রকম গাছ আছে। অমবস্যার মাথায় দুপুর রাতে এলো চুলে পূর্বমুখো হইয়া সেই গাছের শিকড় এক নিঃশ্বাসে তুলিতে হয়।
সেই শিকড় বাটিয়া খাইলে সকল রোগ আরাম হয়।
আনোয়ারা। এ আর কঠিন কি?
দুর্গা। না মা, যে সেই শিকড় তুলিবে তার সেই ব্যারাম হইবে। তাতে তার মরণ নিশ্চয়; প্রাণের বদলে প্রাণ, বুঝিলেন ত? এখন সেই শিকড় তুলিবে কে?
আনোয়ারা। লোকের অভাব হইবে না। তবে সে গাছ চেনা যায় কিরূপ?
আনোয়ারার উত্তেজিত ভাবদৃষ্টে দুর্গা বুঝিল, সে জালে পড়িয়াছে। তখন দুর্গা বলিল, “আগামী শনিবারে অমাবস্যা, সুতরাং আপনার স্বামীর প্রাণরক্ষার শুভ লক্ষণ দেখা যাইতেছে। আমি সেই রাত্রিতে গাছ চিনাইয়া দিব।”
আনোয়ারা। বৈষ্ণবী, তুমি কি অভাগিনীর এতখানি উপকার করিবে?
দুর্গা। সে কি মা! আপনাদের খাইয়া দাইয়া আমরা মানুষ। এখন যদি কিছু উপকার করিতে পারি সে ত আমার ভাগ্যের কথা।
আনোয়ারা। খোদা তোমার মঙ্গল করুন। আচ্ছা তুমি যে দুপুর রাতে আসিবে তাহা আমি কি করিয়া জানিব?
দুর্গা। তাও ঠিক, তবে চলুন, গাছ এখনই দেখাইয়া দিতেছি।
আনোয়ারা। না, আমি ত পর্দার বাহিরে যাই না।
দুর্গা। তবে শনিবার রাতে আসাই স্থির রহিল। আমি আসিয়া আপনাকে ডাকিব। আনোয়ারা। তা করিও না, কি জানি, ফুফু-আম্মা যদি কিছু বলেন। তুমি কোন সংকেতে ঠিক সময়ে আমাকে জানাইতে পার না?
দুর্গা। (একটু চিন্তা করিয়া) আচ্ছা, আমি ঠিক দুপুর রাত্রির সময় আপনাদের উঠানে পর পর দুইটি ঢিল ফেলিব, তাহাতে আপনি বুঝিবেন, আমি আসিয়াছি। সেই সময় আপনি আপনাদের বৈঠকখানার বাগানের সামনে আসিবেন।
আনোয়ারা আশ্বস্ত হইয়া বৈষ্ণবীকে একটু বসিতে বলিয়া ঘর হইতে ২০ টি টাকা আনিয়া দুর্গার হাতে দিল এবং কহিল, “আজ তুমি আমার মা’র কাজ করিলে; তোমার জল খাইবার জন্য এই সামান্য কিছু দিলাম, কিছু মনে করিও না।’
দুর্গা জিব কাটিয়া কহিল, “হরে কৃষ্ণ! না, মা, আমি কিছুতেই আপনার টাকা নিতে পারি না। আপনার দুঃখ যদি কিছু দূর করিতে পারি, তবে তাহাই আমার পুরস্কার। আমি টাকা চাই না।”
আনোয়ারা তবুও তাহার হাতে টাকা গুঁজিয়া দিল। পাপীয়সী আর দ্বিরুক্তি করিল না। কেবল যাইবার সময় বলিয়া গেল, “মা, দেখিবেন এ কথা অন্য কাহারও নিকট প্রকাশ করিবেন না।”
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
শনিবারের আর দুইদিন মাত্র বাকী। চিন্তার অনন্ত-তরঙ্গঘাতে বালিকার কোমল হৃদয় আলোড়িত ও ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত হইতে লাগিল। সে একবার ভাবিল, সমস্ত কথা স্বামীর নিকট খুলিয়া বলি; আবার ভাবিল, তিনি যদি বিশ্বাস না করেন, অথবা প্রাণের বদলে প্রাণ রক্ষা করা ঘৃণা বোধ করেন, তবে আর তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিলাম না। অতএব আগে তাঁহাকে এই কথা জানাইব না। এইরূপ বিতর্ক করিয়া আনোয়ারা স্বামীকে কিছু জানাইল না।
রাত্রিতে আনোয়ারা ঘরে আসিল; এশার নামাজ অন্তে অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করিল। তাহার পর যথাবিধানে পতি পরিচর্যায় নিযুক্ত হইল। সতীর সেবা-সাধনায় রোগক্লিষ্ট অতি শান্তির কোলে সুনিদ্রিত হইলেন। সতী তখন পতির পদপ্রান্তে বসিয়া একখানি চির বিদায়লিপি লিখিতে আরম্ভ করিল। রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর। উদ্বেগ ও চিন্তার আতিশয্যে বালিকা পরিশ্রান্ত। তথাপি লিখিতে আরম্ভ করিল, –
“জীবনসর্বস্ব!
মনে করিয়াছিলাম—এ জীবন বাসন্তী পূর্ণিমার রাত্রি স্বরূপ আপনার পবিত্র সহবাসসুখে অতিবাহিত হইবে; কিন্তু হায়। ভাগ্যে তাহা ঘটিল না।” এই পর্যন্ত লিখিয়া মুগ্ধ বালিকা ধীরে অবসন্ন দেহে পতিচরণ তলে তন্দ্রাভিভূতা হইয়া পড়িল। তন্দ্রাবেশে সে স্বপ্নে দেখিতে লাগিল, তাহার সম্মুখে দণ্ডধারী এক মহাপুরুষ দণ্ডায়মান, তাঁহার জ্যোতির্ময় দেহ হইতে কর্পূরের সুবাস নির্গত হইতেছিল। তিনি বালিকার প্রতি সকরুণ স্নেহদৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে তাহার দেহে হস্তার্পণ করিলেন। তাঁহার জ্বালাময় স্পর্শে বালিকা শিহরিয়া উঠিল। আবার পর মুহূর্তে দেখিতে লাগিল-বিশ্বগ্রাসী গভীর অন্ধকার, গভীরতমরূপে দশদিক হইতে তাহার নিকটে ঘনাইয়া আসিতেছে, এবং তাহার মধ্য হইতে তামস-ঝটিকার আবর্ত মহাকায় বিস্তার করিয়া মহাবেগে, মহাগর্জনে ঊর্ধ্বগামী হইতেছে। নিচে তামস-সাগর বক্ষে কালের করাল-কল্লোলে মহাভেরীর ন্যায় অনবরত ভীমরব তুলিয়া যেন তরঙ্গভঙ্গ তাণ্ডব নৃত করিতেছে। আকাশ সাগর একাকারে একের গায়ে অন্যে মিশিয়া গিয়াছে; মিলনের কেন্দ্র হইতে কোটি বজ্রনাদে ভীমরব ধ্বনিত হইতেছে; সে ভীমরবে গ্রহগণ যেন কক্ষত্যাগ করিয়া দিগন্তে ছুটাছুটি করিতেছে; মুহুর্মুহু বিদ্যুদ্বিভায় নয়ন ঝলসিয়া যাইতেছে। কি ভীষণ দৃশ্য! বিভীষীকাময়ী লীলা! বালিকা স্তব্ধনিঃশ্বাসে নিস্পন্দ নয়নে, ভীতিশূন্য মনে এই দৃশ্য দেখিতে লাগিল। আবার একি! আরও ভীষণ দৃশ্য! সর্বসংহারক লগুড়হস্তে যুগল জ্যোতির্ময়ী মূর্তি বালিকার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত! বালিকা একবার সভয়ে করুণ বিলাপে কহিল, “কে তোমরা? আইস, পতি পরিচর্যায় ত্রুটি হইয়া থাকিলে তোমাদের হস্তের লগুড়াঘাতে দাসীর মস্তক চূর্ণ করিয়া ফেল।’ দৃপ্তা তেজোময়ী বালিকার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতেই যুগল মূর্তি অন্তর্হিত হইল। অতঃপর সে দেখিতে পাইল, অনন্ত অপূর্ব এক আলোকময় দেশ তাহার পুরোভাগে প্রকাশিত। কি সুন্দর সোনার দেশ! বালিকা হর্ষোৎফুল্ল চিত্তে স্বর্ণরাজ্যে প্রবেশ করিল; চতুর্দিকে দৃষ্টি যোজনা করিয়া দেখিতে লাগিল, সে দেশের উদ্যান সমতল গহ্বর নির্ঝর আলোকমালা বক্ষে নিত্য উদ্ভাসিত। সে দেশের অধিবাসিগণ জ্যোতির্ময় বস্ত্রলঙ্কারে চিরশোভিতহিংসা-বিদ্বেষ, শোক-তাপ, মায়া-মোহবর্জিত—নিত্য শান্তিসুখে পরিসেবিত। বালিকা দেখিল, তাহার সম্মুখে সতীমহল। সতীমহলের শোভা অনুপম। স্বর্ণময় অট্টালিকার মধ্যে মণিখচিত পর্যাঙ্কে পয়ঃফেনসন্নিভ শয্যায় সতীকুল সমাসীনা। শত শত রূপসী শিরোমনি হুর তাহাদের, সবার রত আছেন। সতীগণ পতিসেবা পুণ্যফলে সারাবন তহুরা পানে আত্মহারা হইয়া বিভূ গুণ-গাণে রত আছেন। বালিকা সতীমহলের একটি বিরাট অট্টালিকা দেখিয়া সুখরোমাঞ্চ কলেবরে তাহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান হইল। সে সৌধ কারুকার্যে অতুলনীয়, সৌন্দর্যে অদ্বিতীয়। সে সৌধ গৌরবে সমুন্নত সৌরভে পুরিত, শোভন উদ্যানে বেষ্টিত। সর্বোৎকৃষ্ট অট্টালিকা হইতে একে একে খোদেজা, ফাতেমা, রহিমা, হাজেরা, আছিয়া, আয়েশা, জোবেদা প্রমুখ সতীকুলরমণীগণ বাহির হইয়া বালিকাকে স্বৰ্গীয় পুষ্পমাল্য ভূষিত করিয়া স্নেহাশীর্বাদ জ্ঞাপন করিলেন। বালিকা সেই অট্টালিকার অন্য প্রকোষ্ঠে তাহার জননীকে দেখিতে পাইল। সে তখন মা-মা, বলিয়া মাতৃ-মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করিল। মা ভিতর হইতে দ্বাররুদ্ধ করিয়া কহিলেন “বৎসে, এখন নয়, স্বামীসেবা ব্ৰত শেষ করিয়া যথা সময়ে আসিবে, কোলে তুলিয়া লইব।“
হঠাৎ বালিকার তন্দ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। সে জাগিয়া থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল এবং ভাবিতে লাগিল, একি দেখিলাম! আমি সুপ্ত না জাগ্রত? কোথায় গিয়াছিলাম? মা যাহা বলিলেন, তাহাতে ত, বুঝিতেছি সঙ্কল্প সফল হইবে। দয়াময় আল্লা, দাসীর স্বামীকে রক্ষা কর!
বালিকা ধীরে ধীরে উঠিয়া দুই রেকাত নফল নামাজ পড়িল। তারপর চিঠি লিখিতে আরম্ভ করিল।
“প্রিয়তম
যে বৈষ্ণবী আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে আইসে, সে আপনার পীড়ার অবস্থা শুনিয়া বলিল,—মৃতসঞ্জীবনী লতা ভিন্ন কোন ঔষধে ঐ ব্যাধি আরোগ্য হইবে না।
দীর্ঘদিন ঔষধ সেবনেও আপনার পীড়ার উপশম হইতেছে না দেখিয়া অগত্যা বৈষ্ণবীর ঔষধ পরীক্ষা করিতে মনস্থ করিয়াছি। কিন্তু যে সেই লতা তুলিবে তাহার শরীরে পীড়া সংক্রামিত হইয়া সে মৃত্যুমুখে পতিত হইবে এবং রোগী নিরোগ হইবে। হে হৃদয়সৰ্বস্ব! আপনার জন্য জীবন দেওয়া ত তুচ্ছ কথা, জীবন অপেক্ষাও যদি কিছু অধিকতর মূল্যবান থাকে তাহাও আপনার জন্য অকাতরে দান করিতে দাসী সর্বদা প্রস্তুত। তাই প্রিয়তম, দুই দিন পরে আমি আপনার নিকট হইতে বিদায় লইতেছি; কিন্তু এ বিদায় নহে—অনন্ত স্বর্গে আমাদের অনন্ত মিলন হইবে।
প্রাণপ্রিয় মৃতসঞ্জীবনী লতার গুণ সম্বন্ধে পাছে আপনি অবিশ্বাস করেন বা আমাকে লতা তুলিতে নিষেধ করেন,—এই ভয়ে আপনাকে আগে জানাইলাম না; দাসীর অপরাধ ও ধৃষ্টতা নিজগুণে ক্ষমা করিতে মর্জি হইবে। আপনাকে পতিরূপে পাইয়া অল্প সময়ে যেরূপ সুখী হইয়াছি, যুগ-যুগান্তে বুঝি অন্য কোন নারীর ভাগ্যে তাহা ঘটিবে না। আমি শনিবার নিশীথকে সাদরে আহ্বান করিতেছি আপনাকে রোগমুক্ত করিতে পারিব ভাবিয়া, দাসীর হৃদয়ে যে উল্লাস-লহরী খেলিতেছে, তাহার তুলনা খুঁজিয়া পাইতেছি না। বধির শ্রবণ-শক্তি পাইলে, জন্মান্ধের চক্ষু ফুটিলে, পঙ্গুর পদলাভে যে আনন্দ, আজ ততোধিক আনন্দে দাসীর হৃদয় উৎফুল্ল। আপনার সম্মুখে প্রাণত্যাগ করিব, আহা! আমার তাতে কত সৌভাগ্য! কত সুখ! আপনি বাঁচিয়া থাকিলে সংসারের যে উপকার করিতে পারিবেন, দাসী দ্বারা তাহার শতাংশের একাংশ হইবে না। অতএব দাসীর অভাবে আপনি দুঃখিত হইবেন না। ইতি—
চিরসেবিকা দাসী-
আনোয়ারা”
বালিকা পত্র লিখিয়া নিদ্রিত স্বামীর উপাধানের নীচে তাহা রাখিয়া দিল।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
দুই দিন পর, স্বামী-পরিচর্যা করিতে পারিবে না ভাবিয়া বালিকা কায়মনোবাক্যে তাঁহার সেবা করিতে লাগিল। পাঁচবার নামাজ শেষ করিয়া সঙ্কল্পসাফল্য নিমিত্ত খোদাতায়ালার কাছে পুনঃ পুনঃ মোনাজাত করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে শুক্রবার অতীত হইল। আজ শনিবার প্রাতঃকাল। আনোয়ারা পৌর্বাহ্নিক কর্তব্য সম্পন্ন করিয়া স্নানান্তে স্বামীর শয্যাপার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। ভিজা চুলে তাহার শুষ্ক বস্ত্র ভিজিয়া উঠিয়াছে দেখিয়া, নুরল ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, তুমি আমার সাক্ষাতে আজ কাঠের আলনায় চুলরাশি শুকাও। তোমার চুল শুকানোর জন্য সোনার আলনা তৈয়ার করিয়া দিব আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে তাহা ঘটিল না।”—বলিতে বলিতে নুরল এসলামের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি উচ্ছ্বসিত শোকাবেগ প্রশমিত করিয়া পুনরায় কহিলেন, “আমি তোমাকে মুক্তকেশে দেখিতে ভালবাসি, আমার অন্তিম বাসনা পূর্ণ কর।” আনোয়ারা সসন্তোষ উত্তেজনায় কহিল, “আমি আর লজ্জা করিব না।” এই বলিয়া সে দক্ষিণ দরজার পার্শ্বে গিয়া মাথার কাপড় খুলিয়া ফেলিল এবং কাঠের আলনায় চুলগুলি ছড়াইয়া দিয়া শুকাইতে লাগিল। নুরল মুক্তকেশী সতীর পানে অনিমেষ তাকাইলেন। দৃষ্টিপাতমাত্র তাঁহার রোগজীর্ণ দেহে যেন তড়িৎ প্রবাহিত হইতে লাগিল। তিনি একাল পর্যন্ত স্ত্রীর এরূপ সতেজ ভাব, এরূপ পূর্ণ লাবন্যোদ্ভাসিত মূর্তি আর কখনও দেখেন নাই। সবিস্ময়ে ভাবাবেশে তিনি শয্যার উপর উঠিয়া বসিলেন। বসিয়া সতৃষ্ণনয়নে সতীর স্বর্গীয় তেজোদীপ্ত মূর্তি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আনোয়ারা চুল শুকাইয়া মুক্তকেশেই অনাবৃতমস্তকে পতিপাশে আসিয়া পুনরায় দাঁড়াইল। নুরল আবেগভরে হাত ধরিয়া তাহাকে নিকটে বসাইলেন। সতী প্রেমবিহ্বলচিত্তে পীড়িত পতির কোলে মস্তক স্থাপন করিয়া বলিয়া উঠিল, “হে আমার দয়াময় খোদা, আগামীকল্য হইতে তুমি আমার স্বামীকে রোগমুক্ত কর। আমি যেন তাঁহার কোলে এই ভাবে মস্তক রাখিয়া প্রাণত্যাগ করিতে পারি।” নুরল এসলাম কহিলেন, “প্রিয়ে ও কি বলিতেছে, তোমার হতভাগ্য পতি যে তোমাকে রাখিয়া অগ্রেই মৃত্যুপথের যাত্রী সাজিয়াছে। প্রাণাধিকে, অবধারিত মৃত্যুকে ভয় করি না কিন্তু শত আক্ষেপ, তোমাকে আশানুরূপ সুখী করিতে পারিলাম না। অপার্থিব প্রেমঋণে, স্বর্গীয় ভক্তিপাশে হতভাগ্যের হৃদয় বাঁধিয়াছ; কাবিনের স্বত্বত্যাগ, উপরন্ত অর্থ সাহায্য করিয়া এ-দীনের সংসার ঠিক রাখিয়াছ, ছয় মাস যাবত অনাহারে-অনিদ্রায় সেবাশুশ্রূষা করিয়া দুর্বিষহ রোগযন্ত্রণায় শান্তি দান করিয়াছ, কিন্তু হায় তাহার কণামাত্ৰ প্রতিদানও এই হতভাগ্যের দ্বারা হইল না।”—বলিতে বলিতে উচ্ছ্বসিত শোকাবেগে নুরল এসলামের বাকরোধ হইয়া গেল। তিনি অবলার ন্যায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। আনোয়ারা তাঁহার কোলে মাথা রাখিয়া প্রেমাশ্রুনেত্রে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল, সুতরাং নুরল এসলামের চোখের জল আনোয়ারার চোখের জলে মিশিয়া গেল। আনোয়ারা স্বাগত বলিয়া উঠিল, “দয়াময়, চোখের পানি যেমন চোখে মিশাইল, বৈষ্ণবীর লতার গুণে রোগের পরিণতি যেন এইরূপ হয়।” নুরল এসলাম শুনিয়া কহিলেন, প্রিয়ে, আবার ও-কি কহিতেছ?” আনোয়ারার চমক ভাঙ্গিল, সে সাবধান হইয়া কহিল, “ কৈ, কিছু না।” নুরল সে কথা আর ধরিলেন না; কহিলেন, “প্রিয়তমে, আমার আয়ুষ্কাল ত পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে; বাঁচিবার আশা নাই। আজ যে আমাকে এতখানি সুস্থ দেখিতেছ, ইহা নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের উজ্জ্বলতা বলিয়া মনে করিবে। যাহা হউক, আমার অন্য শরীক নাই। ভূ-সম্পত্তির মূল্য ১০/১২ হাজার টাকা হইবে, তাহার অর্ধেক তোমাকে, অপরার্ধেক ৯ আনা তুল্যাংশে রশিদন ও মজিদনকে এবং ৯ আনা ফুফু আম্মাকে দিয়া গেলাম। বন্ধুবর উকিল সাহেবকে আমমোক্তার নিযুক্ত করিয়াছি; তিনি খুব সম্ভব অদ্য কি কল্য দানপত্ৰ লইয়া এখানে আসিবেন। দানপত্রের লিখিত সম্পত্তি তোমার ইচ্ছামত দান-বিক্রয় বা হস্তান্তর করিতে পারিবে।’
নুরল এসলামের অন্তিমবাণী শুনিয়াও আনোয়ারা বিচলিত হইল না বরং তাহার বিম্বাধারে হাসির তড়িৎ খেলিয়া গেল। তাহার শতদল-বিনিন্দিত বদনমণ্ডলে সৰ্গীয় আভা প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। নুরল এসলাম স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিলেন, কিন্তু সতী প্রকৃতির মর্মাবধারণে অক্ষম হইয়া কিঞ্চিৎ বিমনা হইলেন।
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে শনিবারের দিনের আলো নিভিয়া গেল। সতী মৃত্যুপথের যাত্রীরূপে প্রস্তুত হইতে লাগিল। সন্ধ্যার পূর্বেই সে স্বামীকে আহার করাইল। যথাসময়ে স্ফটিক- শামাদানে মোমের বাতি জ্বালাইল; মগরেবের নামাজ শেষ করিয়া রন্ধন-আঙ্গিনায় প্রবেশ করিল। তাহার হাবভাব স্ফুর্তি দেখিয়া ফুফু-আম্মা স্তম্ভিত হইলেন। বিষাদের প্রতিমূর্তি বউ বিবিকে আজ এরূপ উৎফুল্ল দেখিয়া সুশীলা দাসীও সুখী হইল।
আহারান্তে সকলেই ঘরে গেল। আনোয়ারা ঘরে আসিয়া একাগ্র চিত্তে এশার নামাজ পড়িল। নামাজ অন্তে কায়মনোবাক্যে সঙ্কল্প-সাফল্য হেতু শেষ মোনাজাত করিল। আরাধনা শেষে হৃদয়ের সমস্ত ভক্তি দিয়া পতির চরণে হাত বুলাইতে লাগিল। সতীর হস্তস্পর্শে নুরল এসলাম ক্রমে নিদ্রাভিভূত হইয়া পড়িলেন। আনোয়ারা ঘড়ির দিকে চাহিয়া দাখিল, রাত্রি ১ টা। আর এক ঘন্টা পরে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইবে। তখন তাহাকে সঙ্কল্পসাধনের জন্য বহির্বাটিতে উপস্থিত হইতে হইবে। অসূর্যস্পর্শা বালিকা বধূর গাঢ় তিমিরাচ্ছন্ন গভীর নিশীথে একাকিনী বহির্বাটিতে গমন, ইহাও কি সম্ভব?
রাত্রি ১২টা। আনোয়ারা উৎকণ্ঠিতচিত্তে ঘর-বাহির যাতায়াত আরম্ভ করিল। এদিকে ভীমবৈরবী করাল-কৃষ্ণ-পাপীয়সী কালনিশীথিনী তাহার আগমন ভয়ে ভীত হইয়াই যেন যামঘোষ ঘোষণা ত্যাগ করিয়াছে; ঝিল্লীরব থামিয়া গিয়াছে, দ্বিজগণ শাখিশাখে নীরবে উপবিষ্ট, বায়ু গতিশূন্য বৃক্ষ-পত্ররাজি শব্দহীন। জীবকোলাহল-পূরিত প্রকৃতি একেবারে নীরব নিস্তব্ধ, যেন নিঃশ্বাসরোধে বিগতপ্রাণ। কেবল জাগাত যোগী প্রকৃতির ভয়-কাতর অন্তরোদ্ভূত শাঁশী শব্দমাত্রের অস্তিত্ব অনুভব করিয়া শঙ্কিত। এই ভীষণাদপি ভীষণ সূচিভেদ্য নিবিড় তমসাচ্ছন্ন নীরব নিশীথে পতির রোগমুক্তির কামনায় সতী গৃহ হইতে প্রাঙ্গনে আসিয়া দাঁড়াইল। ঠিক এমন সময় দুইটি ঢিল পর পর আসিয়া প্রাঙ্গনে পতিত হইল। সতী সঙ্কেত বুঝিয়া তাড়াতাড়ি বহির্বাটীর উদ্যান পার্শ্বে আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু হায়! পরক্ষণে গালপাট্টা-বান্ধা একজন যুবক পশ্চাদ্দিক্ হইতে আসিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিল। পরপুরুষ স্পর্শে সতীর দেহ কন্টকিত হইয়া উঠিল, তাহার সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়া গেল।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
এদিকে নুরল এসলাম কাশিতে কাশিতে কিছুক্ষণ পরে জাগিলেন। ঘরে বাতি জ্বলিতেছিল। অন্যান্য দিন কাশিবামাত্র আনোয়ারা উঠিয়া তাঁহার সম্মুখে পিদান ধরে, আজ তিনি কাশি ফেলিবার পিক্দান নিকটে পাইলেন না; উঠিয়া বসিলেন। পীড়ার আরম্ভ হইতে আনোয়ারা স্বামীর শয়ন-খাটের সংলগ্ন চৌকিতে পৃথক শয্যায় শয়ন করে। নুরল দেখিলেন, সে বিছানা শূন্য। ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিলেন ১টা বাজিয়া গিয়াছে; মনে করিলেন বাহিরে গিয়াছে, এখনই আসিবে; কিন্তু হায়! বহুক্ষণ অতীত হইয়া গেল—তথাপি আনোয়ারা ঘরে ফিরিল না। নুরল এসলাম তখন ‘ফুফু-আম্মা’ বলিয়া ২/৩ বার ডাকিলেন। তিনি শশব্যস্তে দরজা খুলিয়া ছেলের ঘরের বারান্দায় আসিলেন। চাকরানী ফুফু-আম্মার ঘরে থাকিত, সেও তাঁহার পাছে পাছে উঠিয়া আসিল।
ফুফু। বাবা ডাক কেন?
নুরল। আপনাদের বউ কোথায়?
ফুফু। ওমা, সে কি কথা। বউ ত আমার কাছে যায় নাই। খুসী, তুমি পাকের আঙ্গিনায় দেখিয়া আইস।
চাকরানীর নাম খুসী, সে আলো জ্বালিয়া রান্নার আঙ্গিনার দিকে গেল। ফুফু ভাণ্ডারঘুর তাঁর শয়নঘর দেখিতে গেলেন। নুরল এসলামের মাথা ঘুরিতে লাগিল। ফুফু-আম্মা ও খুসী হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিল। নুরল এসলাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইল? পাওয়া গেল না?” ফুফু ও খুসী নীরব। নুরল এসলাম হায়! হায়!! করিতে করিতে শয্যায় পড়িয়া গেলেন। ফুফু-আম্মা তাড়াতাড়ি কাছে গিয়া দেখেন, ছেলের মুর্চ্চা হইয়াছে। তিনি ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, এমন সময় “হুরে হু হামবোল হুম” রবে দুইখানি পাল্কি বাড়ির মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। উকিল সাহেব পাল্কীর ভিতর হইতে নামিয়া বন্ধুর ঘরে প্রবেশ করিলেন। ফুফু-আম্মা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “বাবা আমার সর্বনাশের উপর সর্বনাশ! বউ-মা আমার ঘরে নাই! ছেলে তাহা শুনিয়া অজ্ঞান হইয়াছে।” উকিল সাহেব কহিলেন, “আপনার বউ-মা উঠানে পাল্কীর ভিতরে আছেন, তাহাকে ঘরে তুলিয়া লউন। তাঁহার অবস্থাও শোচনীয়। একটা পাতলা গরম দুধ এ সময় তাঁহাকে খাওয়াইতে পারিলে ভাল হয়। আমি দোস্ত সাহেবের মূৰ্চ্ছা ভাঙ্গার চেষ্টা করি।” ফুফু-আম্মা কতকটা বিস্মিত, কতকটা আশ্বস্ত হইয়া বউয়ের কাছে গেলেন।
এদিকে উকিল সাহেব দেখিলেন তাঁহার দোস্তের দাঁত লাগিয়াছে। ব্যারামের শরীর, রাত্রিতে মাথায় পানি না দিয়া তিনি পকেট হইতে একটা ঔষধ বাহির করিয়া তাহার নাকের, নিকট ধরিলেন। ৫/৬ মিনিট পরে জোরে নিঃশ্বাস চলিল, তারপর নুরল এসলাম চক্ষু মেলিয়া ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া তাকাইতে লাগিলেন। উকিল সাহেব বলিলেন, “আমাকে চিনিতে পারিতেছ না?”
নুরল। দোস্ত, তুমি আসিয়াছ! আমার প্রাণের আনোয়ারা—আবার অজ্ঞান হইলেন। উকিল সাহেব চিন্তিত হইলেন। শেষে ইতস্তত করিয়া সাহসের সহিত মাথায় ঠাণ্ডা পানির ধারা দিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে নুরল আবার চক্ষু মেলিলেন, “আমার আনোয়ারা কোথায়?” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। উকিল সাহেব বলিলেন, “তুমি আশ্বস্ত হও, তিনি ফুফু-আম্মার ঘরে আছেন।” নুরল উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “মিথ্যা কথা! তাহাকে আর পাইব না।” উকিল সাহেব নুরল এসলামকে আশ্বস্ত করার জন্য কহিলেন, “আমি সত্যই বলিতেছি, তিনি ফুফু-আম্মার ঘরে আছেন, একটু পরে দেখিতে পাইবে।” নুরল এসলাম কহিলেন, “তবে আমি এখনই দেখিতে চাই,”–এই বলিয়া তিনি বিছানায় উঠিয়া বসিলেন এবং ‘কোথায়’ বলিয়া খাট হইতে নামিরার চেষ্টা করিলেন। উকিল সাহেব তাঁহাকে জুড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “তুমি অত অস্থির হইও না; অসুখ শরীর, পড়িয়া যাইবে।”
নুরল। আমার ব্যারাম সারিয়া পিয়াছে, আমাকে ছাড়িয়া দাও।
বাস্তবিকই তখন তাঁহাকে সুস্থ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। উকিল সাহেব তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়া কহিলেন, “চল, আমিও সঙ্গে যাইতেছি।”
এদিকে ফুফু-আম্মা ও দাসীর যত্ন-চেষ্টায় আনোয়ারা অনেকটা সুস্থ হইয়া উঠিল। নুরল ঘরে প্রবেশ করিলে সে মাথায় কাপড় টানিয়া দিল। তখন অন্যান্য সকলে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। নুরল আনোয়ারার শয্যাপাশে বসিয়া তাহার ঘোমটা খুলিয়া দিলেন। মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাহার গোলাপগণ্ড বহিয়া অশ্রু গড়াইতেছে।
পলকে যেন প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়া গেল। সতী জাগ্রতে যেন স্বপ্ন দেখিতে লাগিল; স্বামীর হস্তস্পর্শে তাহার শিরায় শিরায় তড়িৎ সঞ্চারিত হইতে লাগিল। সে অভাবনীয় শক্তিলাভে শয্যায় উঠিয়া বসিল। কাহারও মুখে কোন কথা নাই। যেন শতাব্দীর বিচ্ছেদের পর পরস্পরের সন্দর্শন, কিন্তু ভাবোচ্ছ্বাসে উভয়ে নীরব। কাহারও বাক্যস্ফুর্তি হইতেছে না, যেন বিশ্বের যাবতীয় প্রেম প্রীতি, সুখ-শান্তি একীভূত হইয়া দম্পত্তির বাকশক্তিকে চাপিয়া ধরিয়াছে। তাই তাহারা শত চেষ্টা করিয়াও মুখ ফুটিতে পারিতেছে না। এই সময় ঊষা দেবী দম্পত্তির এই স্বর্গীয় প্রেমলীলা দর্শনেচ্ছায় পূর্বাশার দ্বার খুলিয়া আসিয়া লীলা গৃহের বাতায়নে উঁকি মারিল। তিনটা দুষ্ট কোকিল নুরল এসলামের আম্রকাননের আশেপাশে পত্রান্তরালে চুপটি করিয়া বসিয়াছিল তাহারা, ‘কি কর ঊষা’ বলিয়া সমস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। ঊষা চোখ রাঙাইয়া তাহাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল; কিন্তু দুষ্টেরা তাহাকে আরও ক্ষেপাইয়া বাতায়ন হইতে তাড়াইবার চেষ্টা করিল। নুরল এসলাম এই সময় মৌনভাব ভঙ্গকরিয়া আনোয়ারাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কাঁদিতেছ কেন?’ আনোয়ারা নিরুত্তর।
নুরল। এ ঘরে আসিয়াছ কেন?
আনো। ফুফু-আম্মা ধরাধরি করিয়া পাল্কীর ভিতর হইতে আমাকে এ ঘরে আনিয়াছেন।
নুরল। পাল্কী! আমাকে ফেলিয়া কোথায় গিয়াছিলে?
আনো। বলিব না।
নুরল। আমাকে না বলিবার তোমার কিছু আছে না-কি?
আনোয়ারা লজ্জিত হইল এবং উত্তর চাপা দেওয়ার জন্য কহিল, “আপনার শরীর কেমন আছে?”
নুরল। তোমাকে পাইয়া নবজীবন লাভ করিয়াছি। আমার যেন কোন পীড়া হয় নাই বলিয়া বোধ হইতেছে।
আনোয়ারা নুরল এসলামের পদ চুম্বন করিয়া কহিল, “আমি যদি সতী হই, কায়মনোবাক্যে যদি খোদাতালার নিকট আপনার আরোগ্যের জন্য মোনাজাত করিয়া থাকি, তবে অদ্য হইতে আপনি নিরোগ হইবেন।”
নুরল। তুমি যে কোন্ সাধনা বলে আমাকে যমদ্বার হইতে ফিরাইয়াছ বুঝিতেছি না। সত্যিই, এখন আমার কোন পীড়া নাই। আশ্চর্যভাবে শরীরে বলধবন হইয়াছে।
আনোয়ারা স্মিতমুখে স্বামীর মুখের দিকে চাহিল, কোন উত্তর করিল না।
নুরল। চল, ঘরে যাই।
আনো। আমার শরীর দুর্বল, উঠিতে পারিব না। এখানে বসিয়াই ফজরের নামাজ পড়িব।
নুরল এসলাম কিছু বলিলেন না। আস্তে আস্তে বাহিরে আসিলেন! বসন্তের প্রাতঃসমীরণস্পর্শে তিনি যারপরনাই সুখবোধ করিতে লাগিলেন। যষ্টিহস্তে কিয়ৎক্ষণ প্রাঙ্গণে পদচারণ করিয়া বহির্বাটির উদ্যানমুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। উকিল সাহেব এই সময় ঘুম হইতে জাগিলেন। তিনি নুরল এসলামকে বাগানপার্শ্বে দণ্ডায়মান দেখিয়া কহিলেন, “কাতর শরীর লইয়া এত প্রত্যুষে উঠিয়াছ কেন?
নুরল। আজ আমার শরীর খুব সুস্থবোধ হইতেছে; আমি যেন নবজীবন লাভ করিয়াছি।
এই বলিয়া তিনি বৈঠকখানা ঘরের বারান্দায় উঠিয়া ইজিচেয়ারে উপবেশন করিলেন। উকিল সাহেব এই বৈঠকখানা ঘরে শয়ন করিয়াছিলেন।
উকিল। সই কেমন আছেন?
নুরল। অনেকটা ভাল; কিন্তু তার কথাবার্তায় আমি ধাঁধায় পড়িয়া গিয়াছি।
উকিল। সে কেমন?
নুরল। রাত্রিতে তার ঘর হইতে উঠিয়া যাওয়া, চেষ্টা করিয়া না পাওয়া, পাল্কীতে চড়া, ফুফু-আম্মার ঘরে শোওয়া, তার সুস্থ শরীর দুর্বল হওয়া,–এই সকল কারণ জিজ্ঞাসা করায় ‘বলিব না’ বলিয়া উত্তর দেওয়ায় মনে অত্যন্ত খটকা লাগিয়াছে।
উকিল। (সহাস্য) সইয়ের প্রতি অবিশ্বাস জন্মিয়াছে নাকি?
নুরল। তার প্রতি আমার বিশ্বাস, হিমাচল হইতেও অচল, অটল।
উকিল। তবে আইস, নামাজ পড়ি।
উভয়ে একত্রে ফজরের নামাজ পড়িলেন। উকিল সাহেব বেহারাদিগকে পাল্কী প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া পোশাক পরিতে লাগিলেন।
নুরল। কোথায় যাইবে?
উকিল। একটু বেলগাঁও হইতে বেড়াইয়া আসি। তারপর তোমার খটকা দূর করিব। রাত্রির ঘটনা সরল ফুফু-আম্মা কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। আনোয়ারা কাহার যেন দৈত্যবৎ মূর্তি দেখিয়াছিল। পলকমাত্রকাল স্পর্শ কাঠিন্য অনুভব করিয়াছিল, আর কিছু জানিত না, কিছুই বুঝিতেও পারে নাই; তাহার সেই মুহূর্তমাত্রের ক্ষীণস্মৃতি পতির আরোগ্যজনিত আনন্দে ডুবিয়া গিয়াছিল।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
আনোয়ারা কি হইয়াছিল?
পূর্বে বলা হইয়াছে বেলগাঁও হইতে জেলা পর্যন্ত নৈঋত কোণে যে বাঁধা সড়ক আছে তাহা রতনদিয়া বাজারের দক্ষিণ পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গিয়াছে। রতনদিয়া হইতে সেই পথে এক মাইল গেলে প্রায় অর্ধ মাইল ব্যাপিয়া সড়কের উভয় দিকে নিবিড় বেতস বন, নিম্ন সমতলে অবস্থিত। দুইখানি গাড়ি বা পাল্কী পরস্পর ঘেঁষাঘেষি ভাবে পাশাপাশি যাতায়াত করিতে পারে, সড়কের প্রস্থ এই পরিমাণ। পাপিষ্ঠেরা আনোয়ারাকে অজ্ঞানবস্থায় পাল্কীতে তুলিয়া এই সঙ্কীর্ণ বেতসবন-পথের মধ্যস্থলে আসিলে, অদূরে সম্মুখে আলো দেখিতে পায়, গণেশ ও কলিম সম্মুখে ছিল। গণেশ কহিল “ভাই আব্বাস; প্রমাদ দেখিতেছি।”
আব্বাস। কেনরে, কেন?
গণেশ। সম্মুখে আলো দেখিতেছি।
আব্বাস লম্ফ দিয়া গণেশের স্থান অধিকার করিল, গণেশ হটিয়া গেল।
আব্বাস। পাল্কী বলিয়া বোধ হইতেছে।
কলিম। পাল্কী ত বটেই; আবার একখানা নয়, দুইখানা।
আব্বাস। হাজারখানা হউক, হাতে কি লাঠি নাই?
কলিম। ওরে, আবার দুই পাল্কীর আগে পিছে যে অনেক লোক দেখিতেছি।
আব্বাসের মুখ শুকাইল। তথাপি সে সাহসে ভর করিয়া কহিল, “আমাদের পাল্কীতে বাতি আছে। উহারা আমাদিগকে কিছু বলিবে না।” পাপিষ্ঠেরা আনোয়ারাকে পাল্কীতে তুলিয়া পাল্কীর সম্মুখে অসীম সাহসে আলো জ্বালাইয়া দিয়াছিল।
দেখিতে দেখিতে সন্মুখের পাল্কী নিকটে আসিল। পাল্কীর আগে পাছে কনেস্টবল দুইজন, চৌকিদার দশ বারজন। অগ্রগামী কনেস্টবল আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা পাল্কী কাঁহাছে আয়া হ্যায়?”
আব্বাস। স্টিমার ঘাটছে।
কনেষ্টবল। কাঁহা যাতা হ্যায়?
আব্বাস। জেলাকো উপর।
কনেষ্টবল। পাল্কীকা আন্দার কোন্ হ্যায়?
আব্বাস। উকিল সাহেবকা বিবি হ্যায়।
কনেষ্টবল। কোন্ উকিল সাহেবকা।
আব্বাস উকিল সাহেবের নাম জানে না। দুই একবার ফিয়ালসিনি মোকদ্দমায় পড়িয়া পিতার সহিত উকিল সাহেবের বাসায় গিয়াছিল মাত্র। উকিল সাহেব খুব জবরদস্ত নামজাদা এবং মুসলমান, সেই মাত্র জানিত। তাই কনেস্টবলের কথার উত্তরে বলিল, “মুসলমান উকিলকা।” অসম্পূর্ণ উত্তর শুনিয়া কনেস্টবলেরা হাসিয়া উঠিল। গণেশ ভাবিল,–আব্বাস ঠকিয়া গিয়াছে, মুসলমান উকিলের নামে বিপদ কাটিবে না। এইরূপ ভাবিয়া সে কহিল, “সিপাই সাহেব, ও শালা লোক বোকার ওস্তাদ হ্যায়, চুড়ানকো ঢেঁকি বলিয়া ফেলতা হ্যায়। পাল্কীর ভিতর ডেপুটি বাবুর মেম সাহেব বিবি রতা।” কনেস্টবলেরা অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। পাল্কীর মধ্য হইতে ডেপুটি গণেশবাহন বাবুও হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। দুইতিন মিনিটে এই সকল কথার রহস্য হইল। এই সময় মধ্যে আব্বাস আলীদিগের পাল্কী ডেপুটি বাবুর পাল্কী অতিক্রম করিয়া আর এক পাল্কীর সম্মুখীন হইল। এ পাল্কীরও আগে-পাছে লোকজন পাইকপ্যাদা। ডেপুটিবাবু নিজ পাল্কী থামাইয়া অনুচরদিগকে কহিলেন, “আভিওস্কা পাল্কী পাকড়লেও।” পশ্চাদ্বর্তী পাল্কী লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “উকিল সাহেব, আপনার সঙ্গের লোক দিয়া সম্মুখের পাল্কী ঠেকাইয়া দেন।” কথানুসারে কার্য হইল। ডেপুটি বাবু হাটিয়া উকিল সাহেবের পাল্কীর নিকট উপস্থিত হইলেন। আব্বাস আলী ও কলিম প্রভৃতি তখন অনন্যোপায়ে লাঠি অবলম্বনে বিপক্ষের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিল। আব্বাসের লাঠির আঘাতে একজন কনেস্টবল ও দুইজন চৌকিদার আহত হইল। কলিম একজন বেহারা ও তিনজন চৌকিদারকে আহত করিল। ডেপুটি বাবু ও উকিল সাহেব দুইটি লোকের পরাক্রম দেখিয়া অবাক হইলেন; কিন্তু তাহারা আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইল না। অবশিষ্ট চৌকিদার ও কনেস্টবলের অবিশ্রান্ত যষ্টি প্রহারে তাহারা মাটিতে পড়িয়া গেল। খাদেম ও গণেশ পলাইতে চেষ্টা করিয়া সড়কের নিচে গড়াইতে গড়াইতে বেতস বনে আটকাইয়া পড়িল। দুইজন বেহারারও ঐ দশা ঘটিল। চৌকিদারগণ তাহাদিগকে পরে খুঁজিয়া বাহির করিল। পূর্বে বলা হইয়াছে ‘গণেশ ভীরু ও মাথা পাগল; সে যখন ধরা পড়িল, তখন উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, শালা আব্বাস এখন কোথায় গিয়াছ? সতীকে ত’ ছুঁইতেও পারিলে না, মাঝ হইতে গণেশ বেটার প্রাণ যায়! হায়, হায়—জাতিও গেল, পেটও ভরিল না!” চৌকিদার হাসিয়া কহিল, “আরে চল্ চল্, তোদের সকলেই সড়কের উপরে আছে, চল্ সেখানে গেলে টের পাবি এখন।”
গণেশ। বাবা, বেতের কাঁটায় বিলক্ষণ টের পাইয়াছি। দেখ না গা দিয়া রক্তগঙ্গা ছুটিয়াছে। ইহার উপর আর টের পাওয়াইলে প্রাণের আশা কোথায়?
চৌকিদার হাসিতে হাসিতে গণেশের হাত ধরিতে উদ্যত হইল।
গণেশ। চৌকিদার বাবা, আমাকে ধ’র না বাবা! আমি কোন দোষ করি নাই বাবা! আমি তোমার বাবা, না না, তুমি আমার–আমাকে রক্ষা কর বাবা!
এই বলিয়া সে স্বেচ্ছায় সড়কের উপর উঠিল। চৌকিদার খাদেম ও দুইজন বেহারাকে বাঁধিয়া সেই সঙ্গে উপরে আনিল।
ডেপুটি বাবু উকিল সাহেবকে কহিলেন, “দেখুন পাল্কীর ভিতরে কে আছে?” একজন চৌকিদার আলো ধরিল, উকিল সাহেব স্বহস্তে পাল্কীর দরজা খুলিয়া দেখিলেন, একজন অনিন্দ্য-সুন্দরী যুবতী অজ্ঞানাবস্থায় পাল্কীতে পড়িয়া আছে; তাঁহার মুখে কাপড় গোঁজা। উকিল সাহেব মুখের কাপড় টানিয়া বাহির করিলেন। যুবতী গোঙাইয়া উঠিল এবং তাঁহার মুখ দিয়া এক ঝলক রক্ত নির্গত হইয়া পড়িল। উকিল সাহেব বাতির আলো তাঁহার মুখের কাছে ধরিয়া ভাল করিয়া দেখিলেন। দৃষ্টিমাত্র তাহার শরীর শিহরিয়া উঠিল। তিনি উচ্চৈস্বরে কহিলেন, “জলদী পানি।” ইংরেজি ভাষায় কহিলেন, “ডেপুটি বাবু, আমার যে বন্ধুকে দেখিতে যাইতেছি, হায়! হায়!! তাঁহারই সর্বনাশ! তাঁহারই স্ত্রী অজ্ঞানাবস্থায় পাল্কীতে পড়িয়া, গলা দিয়া রক্ত উঠিয়াছে!” ডেপুটি বাবু—”এ্যা বলেন কি?” বলিয়া কনেস্টবল ও চৌকিদারগণকে কড়া হুকুম দিলেন, “বেটারা যেন পলাইতে না পারে, বিশেষ সাবধানে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া ফেল।” ডেপুটি বাবুর হুকুম শুনিয়া গণেশ কহিল, ‘হুজুর, এ শালারা বদমাইশের গোড়া, তার মধ্যে ঐ আব্বাস শালাই আদত শিকড়। শালা আমাকে নানা প্রলোভনে ভুলাইয়া সতী-হরণে নিযুক্ত করিয়াছে। আমি ওর পিতার নিকট ৩ শত টাকা ধারি। ঐ টাকার এক পয়সাও সুদ লইবে না বলিয়া প্রলোভন দেখাইয়া আমাকে এই পাপ কার্যে নিযুক্ত করিয়াছে। ও টাকার বলে এ দেশের সুন্দরী কুলবধূ ও কুলকন্যা কিছু বাকি রাখে নাই। কিন্তু আজ শালার বড় আশায় ছাই পড়িল। আমাকে বাঁধিবেন না, আমি ওর সমস্ত সলা-পরামর্শের কথা আপনার নিকট খুলিয়া বলিতেছি।
ডেপুটি বাবু। আচ্ছা, তুই যদি সত্য কথা বলিস, তবে তোকে বাঁধিব না।
গণেশ। হুজুর, কালী মা’র দিব্বি, সত্য ছাড়া একরত্তি মিথ্যা বলিব না। আপনি আমার জন্মের বাবা।
ডেপুটি বাবু গণেশকে একজন চৌকিদারের জিম্মায় দিয়া উকিল সাহেবের নিকট আসিলেন। এদিকে উকিল সাহেব যুবতীর মাথায় পানির ধারা দিতে দিতে সে ক্রমে নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিল, ক্রমে চক্ষু মেলিয়া চাহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে অস্ফুটস্বরে কহিল, “আমি কোথায়?” উকিল সাহেব কহিলেন, “আপনি ভাল স্থানে আছেন।” যুবতী উকিল সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া পুনরায় নয়ন মুদ্রিত করিল।
ডেপুটি বাবু কহিলেন, “খুবই অবসন্ন হইয়াছেন আর বিলম্বের প্রয়োজন নাই। যাওয়ার বন্দোবস্ত করুন।” উকিল সাহেবের পাল্কীতে আটজন বেহারা ছিল। তাহাদের চারজন যুবতীকে স্কন্ধে লইল। ডেপুটি বাবু ঘড়ি খুলিয়া দেখিলেন রাত্রি ১টা।
পথে রওয়ানা হইয়া উকিল সাহেব ডেপুটি বাবুকে ইংরেজিতে কহিলেন, “আমার বন্ধুর এই দুর্ঘটনা যাহাতে প্রকাশ না হয়, আপনি তৎসম্বন্ধে বিশেষ সাবধানতা ও বিবেচনার সহিত কার্য করিবেন। আমরা মুসলমান।”
ডেপুটি বাবু ‘আচ্ছা’ বলিয়া বদমাইশদিগকে লইয়া বেলগাঁও থানার দিকে এবং উকিল সাহেব বন্ধুপত্নীকে লইয়া বন্ধুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হইলেন।
তারপর যাহা ঘটিয়াছে পূর্ব পরিচ্ছেদে সকল কথা লিখিত হইয়াছে।
বিংশ পরিচ্ছেদ
উকিল সাহেব বেলগাঁও উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, থানার আঙ্গিনায় ও আশেপাশে চৌকিদার গিগিজ করিতেছে। থানার দারোগা কামদেব বাবুর উৎকোচপ্রিয়তার ও অর্থলোভে চৌকিদারগণ সময়মত পুরাহালে অনেক দিন যাবৎ মাহিনা পায় না, তাই তাহারা ধর্মঘট করিয়া গোল বাঁধাইয়া তুলিয়াছে। জেলার সিনিয়ার ডেপুটি সেই গোলযোগ নিষ্পত্তির জন্য বেলগাঁও আসিয়াছেন।
শনিবার কোর্টের কার্য শেষ করিয়া বাসায় আসিবার সময় পথে উকিল সাহেবের সহিত ডেপুটি বাবুর দেখা। কথা প্রসঙ্গে ডেপুটি বাবু বলেন, “আগামী কল্য আমাকে বেলগাঁও যাইতে হইবে।” উকিল সাহেব বলেন, “আমিও তাহার সন্নিকটে রতনদিয়া গ্রামে আমার বন্ধুকে দেখিতে যাইব।” ডেপুটি বাবু শুনিয়া কহিলেন, “অসম্ভব গরম পড়িয়াছে, দিনে পথচলা কঠিন। সুতরাং অদ্য রাত্রিতে একসঙ্গে যাওয়া যাক।” উকিল সাহেব কহিলেন, “তাহাই হোক।” পরে উভয়ে রাত্রিতে আহারান্তে একসঙ্গে গমন করিলেন। তারপর পথিমধ্যে যেরূপ ভাবে দস্যুদিগকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে, তাহা পূর্ব পরিচ্ছেদে বিবৃত হইয়াছে।
ডেপুটি বাবু ডাকবাংলায় অবস্থিতি করিতেন। উকিল সাহেবের পাল্কী তথায় উপস্থিত হইলে, ডেপুটি বাবু তাঁহাকে সাদরে সম্ভাষণপূর্বক ঘরে লইয়া গেলেন। এই সময় ঘরের ভিতর একটি রমণী ও একটি নবীন যুবক উপস্থিত ছিল। উকিল সাহেব আসন গ্রহণ করিলে ডেপুটি বাবু আগ্রহ সহকারে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার বন্ধুপত্নী কেমন আছেন?”
উকিল। অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন।
ডেপুটি। তাঁহার পতিপরায়ণতায় শত ধন্যবাদ। এই যে স্ত্রীলোকটি দেখিতেছেন, এইটি বদমাইশ দলের গোড়া। ইহার নাম দুর্গা। আর যুবকের নাম গণেশ। ইহারা নানাবিধ প্রলোভন ও কৌশলে বশীভূত করিয়া সতী হরণের চক্রান্ত করিয়াছি। ইহাদের মুখে যাহা শুনিলাম তাহা যদি সত্য হয়, তবে আপনার বন্ধুপত্নীর মত সাধ্বী সতী জগতে বিরল বলিতে হইবে। পতির প্রাণরক্ষার জন্য সরল বিশ্বাসে, সরল প্রাণে এইরূপ ভাবে প্রাণদানে উদ্যতা কোন রমণীর কথা এ পর্যন্ত শুনি নাই; এমন কি কোন পুরাতন ইতিহাসে আছে কি না তাহাও জানি না।
এই বলিয়া তিনি উকিল সাহেবের নিকট দুর্গার কথিত জীবন-সঞ্চার ব্রতের কথা ও সঞ্জীবনী লতার কথা সবিস্তারে বলিলেন। উকিল সাহেব কহিলেন, “আমার বন্ধুপত্নী যে সতীকুলে কোহিনূর হইবেন, তাহা আমি তাঁহার বিবাহের পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম; কিন্তু এই বৈষ্ণবীর শয়তানী কাণ্ডের কথা শুনিয়া অবাক হইতেছি। এমন ভাবে স্বাধী-সতী কুলবধূকে ঘরের বাহির করিবার এমন অদ্ভুত পন্থার কথা জীবনে কদাচ শুনি নাই।”
ডেপুটি। ইহাদের কঠিন ভাবে শাস্তি দিতে হইবে।
উকিল। আমি আপনার নিকট সর্বান্তঃকরণে তাহাই প্রার্থনা করিতেছি।
ডেপুটি। আপনি যে অপহরণ বৃত্তান্ত গোপন রাখার অনুরোধ করিয়াছেন; আমি তৎসম্বন্ধে এই সমস্ত কথা বিবেচনা করিতেছি
প্রথমতঃ আসামীদিগকে কঠিন শাস্তি দিতে গেলে, মোকদ্দমা দায়রায় সোপর্দ করিতে হইবে; সুতরাং তথায় তৎসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রকাশিত হইয়া পড়িবে।
দ্বিতীয়তঃ আপনার বন্ধুর ঘরজামাই ভগ্নিপতি খাদেম আলী এই অপহরণের পদ প্রদর্শক আসামী। সুতরাং অগ্রে এ কথা আপনার বন্ধুর বাড়ি হইতে সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িবে।
উকিল সাহেব খাদেম আলীর নাম শুনিয়া লজ্জিত ও মর্মাহত হইলেন। সড়কের উপর সে যখন ধরা পড়ে, তখন উকিল সাহেব তাহাকে চিনিতে পারেন নাই।
তৃতীয়তঃ আমি বুঝিতেছি, এই চুরি প্রকাশিত হইলে শুভ ব্যতিত অশুভ হইবে না। কারণ, সীতা-হরণে যেমন যুগ-যুগান্তরাবধি তাঁহার সতীত্ব-মাহাত্ম্য জগতে বিঘোষিত হইতেছে, পরন্তু তাহাতে সূর্যবংশের গৌরবই বর্ধিত হইয়াছে; এ চুরিতেও অবশ্য তদ্রূপ ফল ফলিবে।
উকিল। এস্থলে রাম-পক্ষ হইতে না হইলেও সীতার দিক হইতে বনবাস ঘটিতে পারে। কারণ যে স্বামীর প্রাণরক্ষায় অসঙ্কোচে নিজ প্রাণ বিসর্জনে উদ্যতা, সে যে তাহার স্বামীর লোকাপবাদ দূরীকরণের জন্য স্বেচ্ছায় স্বামীসংসর্গ ত্যাগ করিবে ইহাতে বিচিত্র কি?
ডেপুটি। এমন সতী, স্বামীকে ত্যাগ করিতে পারে না।
উকিল সাহেব কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আপনি জ্ঞানী, বহুদর্শী বিচারপতি। যাহা ভাল বোধ করিবেন তাহাই শিরোধার্য।”
ডেপুটি। ইহাদিগকে এই বেলাতেই জেলায় চালান দিব। মোকদ্দমা গভর্নমেন্টবাদী হইয়া চলিবে।
তারপর হাসিয়া কহিলেন, “আপনাকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইবে।”
উকিল। আপনি ত’ মূর্তিমান গভর্নমেন্ট। এই পবিত্রাসনে আপনাকেই আগে পা দিতে হইবে।
ডেপুটি। (স্মিতমুখে) তাহা ত’ বুঝিতেছি। এই গণেশ বেটাকে সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইতে হইবে।
উকিল। আমিও তাহাই মনে করিয়াছি। একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছি, বদমাইশদিগের প্রতি আপনার সন্দেহ হইয়াছিল কিরূপে?
ডেপুটি। সে এক হাসির কাণ্ডকারখানা; মোটকথা এই গণেশ ও আব্বাসের কথার অনৈক্য হওয়াতে আমার সন্দেহ হয়।
“তবে এখন আসি” বলিয়া উকিল সাহেব বিদায় গ্রহণ করিলেন।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
আব্বাস আলী নামজাদা ধনীর একমাত্র আদরের পুত্র। দুষ্কার্য করিয়া এ পর্যন্ত কেবল অর্থ বলেই রক্ষা পাইয়াছে; কখনও ধরা পড়ে নাই। সে অদ্য থানার ঘরে বন্দী। তাহার হাতে আজ হাতকড়া। তাহার সহিত খাদেম আলী, করিম, দুর্গা তদবস্থায় আবদ্ধা।—একথা বন্দরময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছে। আব্বাস আলীর পিতা রহমতুল্লা মিয়া প্রাতঃকালে আসিয়া দারোগা বাবুকে একশত টাকার নোট দিয়া সেলাম করিয়াছেন। উকিল সাহেবের বিদায়ের পর দারোগা বাবু রহমতুল্লা মিঞাকে কহিলেন, “বড়ই কঠিন ব্যাপার, স্বয়ং জেলার বড় ডেপুটি বাবু গ্রেপ্তারকারী। তাঁহার মত কড়া হাকিম এদেশে আর নাই।”
রহমতুল্লা। যত টাকা লাগে দিতেছি, আপনি আমার ছেলেকে রক্ষা করুন।
দারোগা। কোন উপায় দেখিতেছি না।
রহমতুল্লা। আপনি হাকিমকে যত টাকা লাগে দিয়া উপায় করুন।
দারোগা। বাপরে! তবে এখনই চাকুরিটা খোয়াইয়া জেলে যাইতে হইবে।
রহমতুল্লা মিঞা হতাশ হইয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।
দারোগা। আপনি নিজে যাইয়া তাঁহার পা ধরিয়া কবুল করাইতে পারেন কি না চেষ্টা করুন। তবে ২/৫ হাজার টাকার কথা মুখে আনিবেন না। অনেক উপরে উঠিতে হইবে।
রহমতুল্লা মিঞা তখন অসীম সাহসে ডাকবাংলায় উপস্থিত হইয়া ডেপুটি বাবুর নিকট নিজ পরিচয় দিলেন এবং পুত্রের রক্ষার জন্য তাঁহার পা ধরিয়া একেবারে দশ হাজার টাকা ঘুষের কথায় হাকিম প্রবরের মনে কিঞ্চিৎ ভাবান্তর উপস্থিত হইল, তথাপি তিনি মুখে ক্রোধ জানাইয়া কহিলেন, “তোমার এতদূর সাহস? আমার কাছে ঘুষের প্রস্তাব! তোমাকে জেলে দিব।” আব্বাস আলীর পিতা এগার হাজার স্বীকার করিলেন।
এবার ডেপুটি বাবু সদয়ভাবে কহিলেন, “এ ত’ আচ্ছা লোক দেখিতেছি।”
আব্বাস আলীর পিতা আরও এক হাজার স্বীকার করিলেন।
ডেপুটি। পা ছাড়ুন, উঠিয়া বসুন।
বলিয়া তিনি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, লোকটাকে রক্ষা করা উচিত কি না? পরে রহমতুল্লাহ মিঞাকে কহিলেন, “যেভাবের চুরি, ইহাতে আপনার পুত্র চৌদ্দ বৎসর জেলের কাবেল।” তখন আরও হাজার টাকা স্বীকার করিয়া আব্বাসের পিতা পুনরায় ডেপুটি বাবুর পা জড়াইয়া ধরিলেন। তখন ডেপুটি বাবু তাঁহার হাত ধরিয়া তুলিয়া বসাইলেন। তাহার পর বড়ে দিয়া দাবা মারিয়া জিতিবার মানসে এক নতুন চাল চালিলেন। কহিলেন, “আপনি জেলার বড় উকিল মীর আমজাদ হোসেন সাহেবকে চিনেন?”
রহমতুল্লাহ। চিনি, তাঁর দ্বারা অনেকবার মোকদ্দমাও করাইয়াছি।
ডেপুটি। তিনি এক্ষণে রতনদিয়ায় তাঁহার বন্ধু নুরল এসলাম সাহেবের বাড়িতে আছেন। তিনি এই মোকদ্দমার সাক্ষী, আপনি তাঁহাকে বশ করিতে পারিলে আপনার ছেলের সম্বন্ধে বিবেচনা করা যাইতে পারে।
ডেপুটি বাবুর বিশ্বাস, এক যোগে বেশি টাকা উৎকোচ পাইলে মুসলমান উকিল তাঁহার দোস্তকে রাজী করাইয়া নিশ্চয় মোকদ্দমাও ছাড়িয়া দিবেন।
উকিল সাহেব রতনদিয়ায় আসিয়া নাশতা করিয়া সবেমাত্র বাহির বাড়িতে আসিয়াছেন, এমন সময় রহমতুল্লাহ মিঞা তথায় উপস্থিত হইলেন। উকিল সাহেব তাঁহাকে পূর্ব হইতে জানেন। এজন্য কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিয়া বসিতে বলিলেন। মিয়া সাহেব আদর পাইয়া আশ্বস্ত হইলেন। একটু পরে তিনি সসম্মানে উকিল সাহেবকে নির্জন উদ্যান-অন্তরালে লইয়া গিয়া ছেলের চুরিরকথা বলিয়া ক্রমে ৫ হাজার হইতে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত স্বীকার করিলেন। উকিল সাহেব লোকটা কত টাকা দিতে পারে শুধু এইটুকু জানিবার ইচ্ছায় অপেক্ষা করিতেছিলেন, যখন কুড়ি হাজার টাকা স্বীকার করিয়া মিঞা সাহেব তাঁহার পায়ের উপর পড়িয়া গেলেন, তখন তিনি সজোরে পা ছাড়াইয়া বৈঠকখানার দিকে চলিয়া আসিলেন। উকিল সাহেব অন্তঃপুর হইতে বাহিরে আসিবার কিছু কাল পরে নুরল এসলাম যষ্টিহস্তে বাহির বাড়িতে আসিয়া ঐ ঘটনা দেখিয়াছিলেন। উকিল সাহেব বৈঠকখানায় আসিয়া উপবেশন করিলে নুরল তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপারখানা কি?”
উকিল। ব্যাপার চমৎকার।
নুরল। শুনিতে পাই না?
উকিল। শুনু, গতরাত্রিতে ভরাডুবার দুর্গানাম্নী এক বৈষ্ণবী, ঐ তালুকদারের পুত্র আরও কয়েকটি কুল-প্রদীপের সাহায্যে একটি ব্রত করিয়াছিলেন, কিন্তু ফল বিপরীত হওয়ায় ব্রতসাহায্যকারীর পিতা, ব্রতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর ক্রোধ শান্তির নিমিত্ত আমার নিকট কিছু দক্ষিণা লইয়া আসিয়াছিল।
নুরল এসলাম মনে করিলেন, বন্ধু উকিল মানুষ, তালুকদারের পুত্র ভয়ানক গুণ্ডা, বোধ হয় কোনো ফিয়ালসিনি মোকদ্দমায় পড়িয়া পুত্র রক্ষার্থে উৎকোচ দিতে আসিয়াছেন। তাই জিজ্ঞাসা করিলেন, “দক্ষিণা কত?”
উকিল। কুড়ি হাজার টাকা।
নুরল। গ্রহণ করিলে না?
উকিল। আমাকে তুমি এত ছোট মনে কর?
নুরল। কোন দেবীর ব্রত করিয়াছিলেন?
উকিল। আমার সই আনোয়ারা দেবীর।
নুরল এসলামের চক্ষু বড় হইয়া, উঠিল দম বন্ধ হইবার উপক্রম হইল।
উকিল। (সহাস্যে) ভয় নাই, দম ফেল। তোমার মনের খট্কা দূর করিতেছি!
এই বলিয়া উকিল সাহেব রাত্রির সমস্ত ঘটনা এবং ডেপুটি বাবুর মুখের জীবসঞ্চার ব্রতের কথা ও সঞ্জীবনী লতা তোলার কথা যাহা শুনিয়াছিলেন সমস্ত খুলিয়া বলিলেন। নুরল এসলাম দম ফেলিয়া আশ্বস্ত হইলেন। তিনি স্ত্রীর অভূতপূর্ব পতিপরায়ণতায় অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দ রসে আপ্লুত হইতে লাগিলেন। তিনি স্ত্রীর প্রতি কোন সন্দেহ না করিয়া যে সুখী হইলেন, ইহাতে উকিল সাহেবও পুলকিত হইলেন। এদিকে আব্বাসের পিতা পুনরায় ডেপুটি বাবুর নিকট গিয়া কাঁদিয়া পড়িলেন, কিন্তু কোন ফল হইল না।
উকিল সাহেব সোমবার প্রত্যুষে জেলায় রওয়ানা হইলেন, যাইবার সময় সঙ্গে আনীত হেবানামাখানি বন্ধুর হস্তে দিয়া কহিলেন, “দলিল প্রস্তুত করিয়াছিলাম বলিয়া ইহা তোমাকে দিয়া গেলাম, নচেৎ সতীমাহাত্ম্যের যে ফল দেখিতেছি তাহাতে আল্লাহর ফজলে উহার দরকার হইবে না।”
নুরল। দোস্ত, খোদাতা’লার অনুগ্রহে গতকল্য হইতে সত্যি আমার শরীর বেশ সুস্থ বোধ হইতেছে।
উকিল। সত্যই বলিতেছি, সই-এর মত স্ত্রী যার, তিনি অজয়, অমর।
নুরল এসলাম কহিলেন, “দানের বস্তু আর প্রতিগ্রহণ করিব না। আল্লাহ ভাল রাখিলে অবসর মত উহা রেজিস্টারী করিয়া দিব।”
উকিল সাহেব বিদায় গ্রহণ করিলেন। নুরল এসলাম দলিলখানি লইয়া স্ত্রীর হস্তে দিলেন।
অনন্তর আনোয়ারার ঐকান্তিক সেবা-শুশ্রূষায় নুরল এসলাম অল্প দিনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিলেন। পতির আরোগ্যলাভে সতীর মনে আনন্দ আর ধরে না। এজন্য সতী খোদাতায়ালার নিকট অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে লাগিল।
একদিন আনোয়ারা তাহার শয়ন ঘরের যাবতীয় শস্য ও বস্ত্রাদি দাসীকে রৌদ্রে দিতে আদেশ করিল। দাসী একে একে বালিশ, গদি, তোষক বস্ত্র প্রভৃতি রৌদ্রে দিল। আনোয়ারা সঞ্জীবনী-লতা তুলিবার পূর্ব-রাত্রিতে স্বামীকে যে চিরবিদায়-লিপি লিখিয়া তাহার উপাধান নিম্নে রাখিয়া দিয়াছিল, তাহার স্মরণ ছিল না। নুরল এসলামেরও ইতিপূর্বে তাহা হস্তগত হয় নাই। দাসী বালিশের নিচের সেই চিঠি প্রয়োজনীয় মনে করিয়া মনিবের একটি আচকানের পকেটে রাখিয়া দিল।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
আব্বাস আলী প্রভৃতি বদমাইশেরা জেলায় আসিয়া হাজতে পচিতে লাগিল। বহু বহু চেষ্টা ও অর্থব্যয় করিয়াও আব্বাস আলীর পিতা ছেলের হাজত মুক্তির জন্য জামিন মঞ্জুর করাইতে পারিলেন না। ম্যাজিস্ট্রেট বিচারান্তে মোকদ্দমা দায়রায় দিলেন। আব্বা আলীর পিতার ব্যারিস্টার নিযুক্ত করিলেন। খাদেম আলীর পিতা বেলগাঁওয়ের দোকানপাট ও গোপীনপুরের তালুক বিক্রয় করিয়া আব্বাস আলীর পিতার সহিত এজমালিতে মোকদ্দমার খরচ চালাইতে লাগিলেন। কলিমের পিতা ও গণেশের অভিভাবক প্রভৃতি ব্যয়বাহুল্য করা নিষ্ফল মনে করিলেন। জজ সাহেবের আদেশানুসারে জনৈক উকিল আনোয়ারার জবানবন্দী লইতে রতনদিয়ায় আসিলেন। আসামীর ব্যারিস্টারও সঙ্গে আসিলেন। গভর্নমেন্টের পক্ষ হইতে একজন উকিল নিযুক্ত হইলেন।
নুরল এসলাম স্ত্রীকে কহিলেন, “তোমার জবানবন্দী করিতে জেলা হইতে উকিল- ব্যারিস্টার আসিয়াছেন।”
পূর্বেই বলা হইয়াছে পতিপরায়ণা আনোয়ারার সে করালকালরাত্রির মুহূর্ত মাত্রের ক্ষীণস্মৃতি পতির আরোগ্যজনিত আনন্দে ডুবিয়া গিয়াছিল, তাই যে স্বামীর উত্তরে কহিল, “কিসের জবানবন্দী।”
নুরল। যে যোগ-সাধনায় এই খাকছারকে আজরাইলের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছ।
আনো। আল্লাহতায়ালার দয়ায় রক্ষা পাইয়াছেন, তাহার আবার জবানবন্দী কি?
নুরল দুর্গা বৈষ্ণবীর শয়তানী লীলা ও ষড়যন্ত্রের কথা বর্ণনা করিয়া কহিলেন, “দোস্ত সাহেব পাপিষ্ঠদিগের শাস্তির জন্য এক মোকদ্দমা উপস্থিত করিয়াছেন। সেই মোকদ্দমায় তোমার জবানবন্দী দরকার।”
আনোয়ারা বৈষ্ণবীর বজ্জাতির কথা মনে করিয়া শিহরিয়া উঠিল। ঘৃণায় লজ্জায় সে মরিয়া যাইতে লাগিত। তথাপি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিল, “উহাদিগকে ছাড়িয়া দিলে হয় না?”
নুরল। আমি তোমার মনের উন্নত অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছি, কিন্তু ছাড়িয়া দিবার অধিকারী আমরা নহি, স্বয়ং গভর্নমেন্ট বাদী; তা ছাড়া, এ-ক্ষেত্রে পাপীকে শাস্তি প্রদান করিলেই জগতের মঙ্গল বিধান করা হইবে।
আনো। আমি কেমন করিয়া জবানবন্দী দিব?
নুরল। সেই রাত্রির ঘটনা সম্বন্ধে উকিল-ব্যারিস্টার তোমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তুমি তাহার উত্তর দিবে।
আনো। (প্রেমকোপে স্বামীর দিকে চাহিয়া) উকিল-ব্যারিস্টারের মুখে আগুন, আনোয়ারা খাতুন তাহাদের সহিত কথা বলিবে?
নুরল। (হাসিমুখে) পর্দার অন্তরালে থাকিয়া তাহাদের জিজ্ঞাস্য কথার উত্তর দিবে, তাহাতে দোষ কি?
আনো। (অভিমান কটাক্ষে স্বামীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) দেশমান্য দেওয়ান সাহেবের অসূর্যস্পশ্যা সহধর্মিনী পরপুরুষের সহিত কথা বলিতে ঘৃণা বোধ করে।
নুরল। তবে জবানবন্দী কিরূপে দিবে?
আনো। উকিলের জিজ্ঞাস্য বিষয়ের উত্তর অন্দর হইতে লিখিয়া দিব।
নুরল এসলাম তখন স্বপক্ষে উকিলকে যাইয়া কহিলেন, “আপনারা অনুগ্রহ করিয়া আমার স্ত্রীর লিখিত জবানবন্দী গ্রহণ করুন।”
উকিল। আইন অনুসারে লিখিত জবানবন্দী গ্রাহ্য নহে।
নুরল এসলাম অগত্যা স্ত্রীকে অনেক উপদেশ দিয়া মৌখিক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করিলেন। আনোয়ারা স্বামীর আদেশে মরমে মরিয়া পর্দার অন্তরালে থাকিয়া অনুচ্চভাবে উকিল-ব্যারিস্টারের কথার উত্তর দিতে আরম্ভ করিল।
গভর্নমেন্টের উকিল দুর্গা বৈষ্ণবীর ভিক্ষা করা হইতে আরম্ভ করিয়া বদমাইশদের গ্রেফতার পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনা তন্ন তন্ন করিয়া একে একে সসম্মানে আনোয়ারাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। আনোয়ারার যাহা স্মরণ ছিল, সমস্ত কথার উত্তর দিল। বাহুল্য ভয়ে এখানে তৎসমস্ত উল্লেখিত হইল না; কিন্তু আনোয়ারা যেরূপ সত্যতা ও তেজস্বিতার সহিত উকিলের জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তর করিল, তাহাতে আসামীর ব্যারিস্টার আসামীকে রক্ষা করা সম্বন্ধে নিরাশ হইয়া পড়িলেন। তবে আসামীর আশু মনোরঞ্জনের জন্য আনোয়ারাকে নিম্নলিখিতরূপ কয়েকটি জেরা করিলেন।
ব্যারিষ্ট্যার। আপনি কত রাত্রিতে ঘরের বাহির হইয়াছিলেন?
আনো। দুপুর রাতে——১২টায়।
ব্যারিস্টার। আপনি কি ঘড়ি দেখিয়া বাহির হইয়াছিলেন?
আনো। হ্যাঁ।
ব্যারিস্টার। আপনার সঙ্গে আর কেহ ছিল না?
আনো। না।
ব্যারিস্টার। অত রাত্রিতে একাকিনী ঘরের বাহির হইতে আপনার ভয় হইল না?
আনো। না।
ব্যারিস্টার। অমন সময় পুরুষ মানুষের ভয় হয়, আর আপনার ভয় হইল না?
আনোয়ারা নিরুত্তর।
ব্যারিস্টার। যখন বাহির হন তখন আপনার স্বামী কোথায় ছিলেন?
আনো। ঘরে।
ব্যারিস্টার। নিদ্রিত না জাগ্রত?
আনো। নিদ্রিত।
ব্যরিস্টার। বাহিরে যাইতে আপনাকে কেহ ডাকিয়াছিল কি?
আনো। কেহ না।
ব্যারিস্টার। তবে কোন্ সূত্রে বাহিরে গেলেন?
আনো। বৈষ্ণবীর সঙ্কেতানুসারে।
উকিল বাবু ব্যারিস্টার সাহেবকে বলিলেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তরেই উনি সকল কথা বিশেষভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন, সুতরাং পুনরায় জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন।” ব্যারিস্টার প্রবর ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “আমার প্রয়োজন আছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
উকিল। আচ্ছা করুন।
ব্যারিস্টার। আপনি বাহিরে যাইয়া কাহাকে দেখিতে পাইলেন?
আনো। কাহাকেও দেখিতে পাই নাই, তবে ভীষণ দৈত্যের মত হঠাৎ কে যেন পশ্চাদ্দিক হইতে আসিয়া আমার গলা টিপিয়া ধরিল।
ব্যারিস্টার। আপনি তখন কি করিলেন?
আনো। জানি না।
অতঃপর ব্যারিস্টার আর জেরা করা নিষ্প্রয়োজন বোধ করিয়া চুপ করিলেন। জজের প্রতিনিধি আনোয়ারার জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করিয়া যথাসময়ে জজ সাহেবের নিকট দাখিল করিলেন।
যথাসময়ে জজকোর্টে মোকদ্দমা উঠিল। ডেপুটি বাবু ও উকিল সাহেব একে একে সাক্ষ্য দিলেন। ব্যারিষ্টার সাহেব ডেপুটি বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে সময়ে আপনারা বদমাইশদের গ্রেপ্তার করেন, তখন রাত্রি কত?”
ডেপুটি। ১২ টা ১৫ মিনিট।
ব্যারিষ্টার। ঘটনাস্থল হইতে রতনদিয়া গ্রাম কতদূর?
ডেপুটি। ঠিক জানি না।
ব্যারিস্টার উকিল আমজাদ সাহেবকে একটু কৌশলের সহিত জেরা করিলেন, “আপনারা যখন আসামী প্রেপ্তার করেন তখন রাত্রি কত?”
উকিল। ১২ টা ১৫ মিনিট। ব্যারিষ্টার সাহেবের মুখে মলিনতার ছায়া পড়িল।
ব্যারিস্টার। ঘটনাস্থল হইতে আপনার দোস্তের বাড়ি কতদূর?
উকিল। দেড় মাইল।
গণেশ সাক্ষীরূপে সরলমনে সব ঘটনা খুলিয়া বলিল। আব্বাস, কলিম প্রভৃতি পাষণ্ডেরা দুর্গা বৈষ্ণবীর সাহায্যে যেরূপ কৌশলে কুলবধূকে ঘরের বাহির করে, অতি বিশ্বাস্য প্রমাণ প্রয়োগে গণেশ যে সকল কথা বলিয়া গেল। ব্যারিস্টারের জেরার উত্তরে সে বলিল, ‘আমরা বড় বাবুর স্ত্রীকে পাল্কীতে তুলিয়াই বিরামপুর গ্রামের দিকে ছুটিয়াছিলাম। তথায় আব্বাস আলীর ন্যায় আর একটি লোকের বাড়ি। সে আব্বাস আলীদিগের খাতক। তথায় বড় বাবুর বিবিকে লইয়া রাখিবার কথাবার্তা পূর্বেই সাব্যস্ত হইয়া গিয়াছিল কিন্তু পথেই ধরা পড়িলাম।”
অতঃপর উকিল, ব্যারিস্টারের বক্তৃতা ও আইন-ঘটিত যুক্তি-তর্কের কথা জজ সাহেব শুনিলেন। তদন্তর জুরিদিগকে মোকদ্দমার অবস্থা বুঝাইয়া দিলেন। জুরিগণ একবাক্যে আসামীদিগকে অপরাধী সাব্যস্ত করিলেন।
পরিশেষে জজ সাহেব রায় লিখিয়া হুকুম দিলেন—আব্বাস আলী ও দুর্গা বৈষ্ণবীর প্রতি কঠিন পরিশ্রমের সহিত ৭ বৎসর, কলিম ও খাদেম আলীর প্রতি ৪ বৎসর কারাদণ্ডের আদেশ হইল। বেহারাগণেরও এক বৎসরের শাস্তি হইল। গণেশ প্রকৃত ঘটনার সাক্ষী দেওয়ায় বেকসুর খালাস পাইল। সদাশয় জজ রায়ে আনোয়ারার সরলতা ও পতিপরায়ণতার উল্লেখ করিতে ত্রুটি করিলেন না।
আব্বাস আলী ও খাদেমের পিতা ‘হায় হায়’ করিতে করিতে বাড়ি ফিরিলেন। দেশময় রাষ্ট্র হইল—বেলগাঁও জুট অফিসের বড়বাবুর বিবিকে ঘরের বাহির করিতে যাইয়া গুণ্ডাদলের নিপাত হইল। দীন-দরিদ্র-হিন্দু-মুসলমান কুল-লননাগণ আনোয়ারাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “মা, তোমার সতীপনায় আজ হইতে আমাদের জাতি-মান রক্ষা হইল। অনেক গুণ্ডাভীত মহিলা কেহ কালীর দুয়ারে, কেহ মসজিদে মানত শোধ করিল। কেবল সালেহার মা মাথা কুটিয়া আনোয়ারাকে অভিসম্পাৎ করিতে লাগিলেন। একদিন মাতার এই অবৈধ গালাগালি শুনিয়া সালেহা তাহার প্রতিবাদ করিল। মা ক্ষিপ্তার ন্যায় হইয়া সালেহাকে স্বহস্তে প্রহার করিলেন। কন্যা দুঃখে অভিমানে কাঁদিতে কাঁদিতে যাইয়া আনোয়ারার নিকট উপস্থিত হইল। আনোয়ারা তাহাকে সস্নেহে সাদরে গ্রহণ করিল।
এদিকে খাদেম আলীর পিতা, পুত্রের দোষে সর্বস্ব হারাইয়া সপরিবারে ভগ্নির বাড়ি যাইয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।
আল্লার ফজলে সতীর সেবা-সাধনায় নুরল এসলাম পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করিয়া কোম্পানির কার্যে পুনঃপ্রবৃত্ত হইলেন।