ভক্তিপথ

ভক্তিপথ

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : কলিযুগের পক্ষে নারদীয় ভক্তি। (১-১১-২) জ্ঞানপথ বা কর্মপথের নিন্দা করছেন না ঠাকুর। সব পথ দিয়েই ভগবানের কাছে পৌঁছনো যায়। গন্তব্যস্থল এক, শুধু পথ আলাদা। তবে ঠাকুর বলছেন : এই যুগে সাধারণের পক্ষে ভক্তিপথই ভাল। তাদের জন্য নারদীয় ভক্তি—অর্থাৎ নারদের যেমন ভক্তি। অহরহ তিনি ঈশ্বরের নাম গুণগান করে বেড়াচ্ছেন। তাতেই তাঁর আনন্দ, তাতেই তাঁর তৃপ্তি। কিছুরই তিনি প্রার্থী নন। আমরা বিপদে পড়লে ঈশ্বরের শরণাগত হই, আবার যখন বিপদ কেটে যায়, তখন ভুলে যাই একদম। নারদ কিন্তু সেরকম নন। সারাক্ষণ তিনি ঈশ্বরের নামগুণগান করে বেড়াচ্ছেন। নিজের সম্বন্ধে তিনি বলছেন : ‘অন্তর্বহিশ্চ লোকাংস্ত্রীন্‌ পৰ্য্যেমাস্কন্দিতব্রতঃ’— আমি অস্খলিতব্রত, ব্রহ্মচারী। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল এই তিন লোকে আমার অবাধ গতি। ‘অনুগ্রহান্‌-মহাবিষ্ণোরবিঘাতগতিঃ ক্কচিৎ’— বিষ্ণুর কৃপায় আমার গতিতে কোন বাধাবিঘ্ন নেই, সর্বত্র অবাধে আমি যাতায়াত করি। ‘দেবদত্তামিমাং বীণাং স্বরব্রহ্মবিভূষিতাম্‌’— আমার হাতের যে বীণা, এই বীণা দেবদত্ত। এই বীণা ‘স্বরব্রহ্মবিভূষিতাম্‌’— ঈশ্বরের নাম ছাড়া আর কিছু এতে বাজে না। মূর্চ্ছয়িত্বা হরিকথাং গায়মানশ্চরাম্যহম্‌’— সেই বীণায় হরিনামের মূর্চ্ছনা তুলে আমি সমস্ত জগতে বিচরণ করি। সর্বত্র ভক্তি বিতরণ করি আমি। ঠাকুর বলছেন : ঐরকম ভক্তি চাই। বলছেন : ভক্তিযোগই যুগধর্ম। (১-১১-৪) কারণ, এযুগে আমাদের জীবনধারাটা অন্যরকম। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। এযুগের পক্ষে সোজাসুজি ভগবানের নাম করাই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ।

ভক্তিপথ সহজ

শাস্ত্রে যে সকল কর্মের কথা আছে, তার সময় কৈ? (১-১১-২) এখানে কর্ম বলতে বৈধীকর্ম বুঝতে হবে। আমাদের শাস্ত্রকে দুইভাগে ভাগ করা হয়—কর্মকাণ্ড আর জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ড এই যুগে সাধারণের পক্ষে উপযোগী নয়। ঠাকুর এই প্রসঙ্গে একটা উপমা দিচ্ছেন যে, আজকালকার জ্বরে দশমূল পাঁচন চলে না। (ঐ) দশরকম গাছের মূল যোগাড় করে পাঁচন তৈরী করতে হয়, অনেক সময় লাগে, হাঙ্গামাও নানারকম। তাই আজকাল ফিবার মিক্সচার। (ঐ) ‘ফিবার মিক্সচার’ হচ্ছে ডি গুপ্তের মিক্সচার। ম্যালেরিয়া হলে তখনকার দিনে এই ডি: গুপ্তের মিক্সচার দেওয়া হত। অর্থাৎ ঠাকুর বলছেন : তুমি অত যাগযজ্ঞ আড়ম্বরের দিকে ঝুঁকো না। এসব করবার তোমার সময় কোথায়? এযুগে এসব চলে না। তুমি ভক্তিপথ নাও। সোজাসুজি তাঁকে ডাক। অত আয়োজন-উপচারের তোমার দরকার নেই। কর্ম করতে যদি বল,— তো নেজামুড়া বাদ দিয়ে বলবে। (ঐ)

এই যে কথাগুলি ঠাকুর বলছেন, এগুলি কিন্তু খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ, স্বামী দয়ানন্দ, যিনি আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি সেইসময় যাগযজ্ঞের কথা প্রচার করেছিলেন। ঠাকুরের পথ কিন্তু অন্য। ঠাকুর বলছেন : কর্মকাণ্ড খুব কঠিন। কত কঠিন তা বোঝানোর জন্য একটা গল্প বলছেন : একজন বাড়ীতে শ্রাদ্ধ ক’রেছিল। অনেক লোকজন খাচ্ছিল। একটা কসাই গরু নিয়ে যাচ্ছে, কাটবে বলে। গরু বাগ মানছিল না—কসাই হাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন সে ভাবলে শ্রাদ্ধবাড়ি গিয়ে খাই। খেয়ে গায়ে জোর করি, তারপর গরুটাকে নিয়ে যাব। শেষে তাই ক’রলে, কিন্তু যখন সে গরু কাটলে তখন যে শ্রাদ্ধ করেছিল, তারও গো-হত্যার পাপ হলো। (২-১৯-৭) ইংরেজিতে একটা কথা আছে—abetment। একজন লোক হয়তো নিজে চুরি করেনি, কিন্তু যে চুরি করেছে তাকে হয়তো একটা অস্ত্র জুটিয়ে দিয়েছে, না জেনেশুনেই দিয়েছে—কিন্তু পুলিশ এসে তাকেও ধরবে। একজনের গাড়ি নিয়ে আর একজন ডাকাতি করে এলে পুলিশ গাড়ির মালিককে ছেড়ে দেবে না, কারণ, গাড়িটা তো তারই, সে নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেছে। কর্মকাণ্ডতেও ঠিক তাই হয়। ঠাকুর তাই বলছেন : শাস্ত্রে যেসব যাগযজ্ঞ ইত্যাদি বৈধীকর্মের কথা আছে তার দিকে তুমি বিশেষ ঝুঁকো না। এসব করা খুব কঠিন। কোথা থেকে একটু কিছু হয়ে গেলেই, পান থেকে চুন খসলেই—একে বলে প্রত্যবায়—পুণ্যের জন্য করছিলে, পাপ এসে ঘাড়ে চাপল। ঠাকুর জোর দিচ্ছেন সেইজন্য ভক্তির উপরে ; তাই বলছি, কর্মকাণ্ডের চেয়ে ভক্তিপথ ভাল। (ঐ) উনি যে একটা আইন করে দিতে চাচ্ছেন তা নয়। উনি শুধু উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন, কর্মকাণ্ড খুব কঠিন। দু-একজন হয়তো কর্মকাণ্ডের পথে যেতে পারে। কিন্তু সাধারণের জন্য এপথ নয়। বিশেষত আজকালকার দিনে। বুদ্ধদেবও ছিলেন এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। বুদ্ধদেব বলতেন : তুমি পশুবলি দিলে—কিন্তু তাতে তোমার কি হল? তোমার মনের মলিনতা গেল কি? আসল সমস্যা তো মনে। মনটাকে তুমি জয় করতে পারছ না আর তুমি পশুবলি দিচ্ছ, যাগযজ্ঞ করছ—এতে কি লাভ হল! আমরা দেখি, উপনিষদ্‌ বলছে, জ্ঞানেই মুক্তি—কর্মের দ্বারা কিছু হবে না। বুদ্ধদেবও মোটামুটি এই প্রচার করলেন। সেইজন্য অনেকে বলেন যে, বুদ্ধদেব প্রকারান্তরে বেদান্তই প্রচার করেছিলেন, জ্ঞানকাণ্ড প্রচার করেছিলেন তিনি। বৌদ্ধরা অবশ্য সেটা মানতে চান না। তবে এটা ঠিক, তিনি যা প্রচার করেছেন বেদান্তের সঙ্গে তার অনেক সাদৃশ্য আছে।

ঠাকুর বলছেন, কর্ম করতে যদি বল নেজামুড়া বাদ দিয়ে বলবে। (১-১১-২) কর্মকাণ্ডের মধ্যে এমন কিছু কিছু জিনিস আছে যা নাকি অবশ্য করণীয়, আবার কতকগুলি আছে যা না করলেও চলে। আমরা যে জপ, ধ্যান, বা অল্পবিস্তর প্রাণায়াম করি সেগুলোও কিন্তু কর্মকাণ্ডের মধ্যেই পড়ছে। কিন্তু যে-পথেই যাই না কেন এসব কিছুটা রাখতে হবেই। তাই কর্মকাণ্ডটাকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এগুলি থাকবে। কিন্তু এগুলিই যেন মুখ্য না হয়ে যায়। মুখ্য হৰে ভক্তি, ভালবাসা। ঠাকুর তাই বলছেন : কর্ম করতে যদি বল তাহলে ‘নেজা’ ও ‘মুড়ো’ অর্থাৎ যেটা বাহুল্য সেটা বর্জন করে, যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুই শুধু করতে বলবে। আমি লোকদের বলি, তোমাদের ‘আপোধন্যন্যা’ ও সব অত বলতে হবে না। (ঐ) ব্রাহ্মণদের সন্ধ্যা-আহ্নিকের মন্ত্র পড়তে হয়—ওঁ শন্ন আপো ধন্বন্যাঃ শমু নঃ সন্ত্বনূপ্যাঃ শন্নঃ সমুদ্রিয়া আপঃ শমু নঃ সন্তু কূপ্যাঃ।* উপবীতের পরে ব্রাহ্মণ ছেলেরা এই মন্ত্র পড়ে। আজকাল কি করে জানি না। আগে এক বছর অন্তত সন্ধ্যা-আহ্নিক করতে হত। ঠাকুর বলছেন : তোমাদের অত ‘আপোধন্যন্যা’ করতে হবে না। এযুগে অত সময় নেই মানুষের। তোমাদের গায়ত্রী জপলেই হবে। (ঐ) সহজ, সরল, যা সম্ভব। পুরাণে দেখি, হাজার বছর ধরে তপস্যা করছেন সাধকরা। হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ হয়ে তপস্যা করছেন। এখন তো সেসব সম্ভব নয়। এখন আমাদের সহজ পথে, সংক্ষেপে করতে হবে। কিন্তু করতে হবে। তাই বলছেন : নারদীয় ভক্তি। সরলভাবে ভগবানকে ডাক, ভালবাস।

ঠাকুর জ্ঞানপথের তুলনায়ও ভক্তিপথকে সহজ বলেছেন। জ্ঞানপথ সম্বন্ধে ঠাকুর বলছেন : বড় কঠিন প্রথ। বিষয়বুদ্ধির⋯লেশমাত্র থাকলে—জ্ঞান হয় না। এ পথ কলিযুগের পক্ষে নয়। (১-৩-৬) ভৱানপথে যিনি যান তিনি ‘নেতি নেতি’ করে এই জগৎপ্রপঞ্চকে বর্জন করেন। তাঁর কাছে এই জগৎটা মিথ্যা। কিরকম মিথ্যা? না, ‘শশশৃঙ্গবৎ’। খরগোসের শিং হয় না কখনও। সেটা যেমন একটা অসম্ভব জিনিস, এও তাই। আবার বলছেন : ‘বন্ধ্যাপুত্রবৎ’। বন্ধ্যানারী—সন্তান হয়নি, হবেও না, হতে পারে না ; অথচ তার যেন পুত্র হয়েছে, সেটা যেমন অবাস্তব ব্যাপার—সেইরকম এই জগৎ। এগুলি কি সহজে বোঝা যায়, না বিশ্বাস করা যায়? চোখের সামনে দেখছি এই জগৎ, আমার আত্মীয়-স্বজন প্রিয়জন, কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে—আমি বলব এ মিথ্যা? নাহয় জোর করে বললাম, কিন্তু মনে মনে সেই বিশ্বাসটা কতক্ষণ রাখতে পারব? ঠাকুর তাই বলছেন : ‘ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ কেমন করে বোধ হবে? সে বোধ দেহবুদ্ধি না গেলে হয় না। ‘আমি দেহ নই, আমি মন নই, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নই, আমি সুখ-দুঃখের অতীত, আমার আবার রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু কৈ’? —এসব বোধ কলিতে হওয়া কঠিন। যতই বিচার করো, কোন্‌খান থেকে দেহাত্মবুদ্ধি এসে দেখা দেয়। অশ্বত্থ গাছ এই কেটে দাও, মনে করলে মূলশুদ্ধ উঠে গেল, কিন্তু তার পরদিন সকালে দেখো, গাছের একটি ফেকড়ী দেখা দিয়েছে! দেহাভিমান যায় না। (১-৪-৭) আর যতক্ষণ এই দেহাভিমান থাকে ততক্ষণ ‘আমিই ব্ৰহ্ম’ একথা বলা যায় না। গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :

ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্‌।

অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্‌ভিরবাপ্যতে ॥

—যাঁরা নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তা করেন, তাঁদের সিদ্ধিলাভের জন্য সগুণ উপাসকদের চেয়ে বেশী কষ্ট করতে হয়। কারণ, নির্গুণব্রহ্মে নিষ্ঠালাভ করা দেহাভিমানী ব্যক্তিদের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। সেইজন্যে সাধারণের জন্য ভক্তিপথই সহজ।

ঠাকুরের জীবনের একটা ঘটনা আছে কৃষ্ণকিশোর বলে একজন ছিলেন। তিনি খুব বেদান্ত চর্চা করতেন। তিনি বলতেন, আমি আকাশবৎ। আকাশবৎ কেন বলতেন? আকাশ হঠাৎ মেঘে ঢেকে যায়—কিন্তু মেঘ সরে গেলে দেখা যায় আকাশ যেমন ছিল তেমনই আছে, আকাশের কিছু হয়নি। ঐ আকাশের মতো আমি। আমি দেহ নই, মন নই, বুদ্ধি নই, অহঙ্কার নই—আমি নিত্য-শুদ্ধ-বৃদ্ধ-মুক্ত আত্মা। এই জগৎসংসারে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু আমি নির্লিপ্ত, উদাসীন, দ্রষ্টা। আমার তাতে কিছুই এসে যায় না। কৃষ্ণকিশোর বলতেন : আমি ঐ আকাশের মতো। ঠাকুর ঠাট্টা করে তাঁকে বলতেন : তুমি তো ‘খ’ গো। ‘খ’ মানে আকাশ। একদিন কৃষ্ণকিশোরের বাড়িতে গিয়ে ঠাকুর দেখেন, খুব বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন : কি হল? এমন মনমরা হয়ে বসে আছ কেন? কৃষ্ণকিশোর বললেন : ট্যাক্সওয়ালা এসেছিল, সে বলে গেছে টাকা না দিলে ঘটিবাটি সব নিলাম করে নিয়ে যাবে। ঠাকুর বলছেন ; তুমি তো ‘খ’ গো! অর্থাৎ তুমি তো বল তুমি ব্রহ্ম, তোমার আবার ঘটিবাটি কি? তোমার তো কিছুই যায় আসে না। বিদ্রুপ করছেন কৃষ্ণকিশোরকে। বলতে চাইছেন : তোমার দেহবুদ্ধি রয়েছে, তোমার কাছে সংসার সত্য, অথচ তুমি বেদান্ত-বিচার করছ যে, ব্ৰহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। এই বিচার মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে তোমার ক্ষেত্রে। সেইজন্য জীবনে যখন একটা পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছ, তখন এই বেদান্ত-বিচার তোমার কাজে লাগছে না! তাই ঠাকুর বলছেন : যতক্ষণ দেহবুদ্ধি থাকে ততক্ষণ ‘আমিই সেই’ এই অভিমান করা ভাল নয়। ⋯যে এ অভিমান করে, তার বিশেষ হানি হয় ; এগুতে পারে না, ক্রমে অধঃপতন হয়। পরকে ঠকায় আবার নিজেকে ঠকায়, নিজের অবস্থা বুঝতে পারে না। (ঐ)।

আমাদের সমস্ত সমস্যা মন নিয়ে। মানুষ মনেতেই বদ্ধ মনেতেই মুক্ত। মনকে বলা হয় ‘মত্তকরী’। খেপা হাতি। কখন কি যে করে তার ঠিক নেই কিছু। এই পাগলা হাতিকে বশে আনতে হবে অর্থাৎ দমন করতে হবে। ঠাকুর হাতির তুলনা দিচ্ছেন, ভাগবতেও বলছে সেই কথা। ভাগবতে বলছে :

ক্বচিন্‌নিবৰ্ত্ততেহভদ্ৰাৎ ক্বচাচরতি তৎ পুনঃ।

প্রায়শ্চিত্তমথোহপার্থং মন্যে কুঞ্জরশৌচবৎ ॥

—কখনও কখনও আমাদের মনটা বেশ শুদ্ধ থাকে। যা অমঙ্গল, অশুভ, মলিন— তা থেকে দূরে থাকে। আবার কিছুক্ষণ পরেই মনটা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। মাছি যেমন এই সন্দেশে বসল, পরমুহূর্তেই একটা নোংরা জায়গায় গিয়ে হয়তো বসছে। আমাদের মনটা তো সেইরকম। কাজেই প্রায়শ্চিত্ত করে কি লাভ? প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে ‘কুঞ্জরশৌচবৎ’—হাতির স্নানের মতো। চান করে হাতি পরিষ্কার হচ্ছে আবার একটু পরেই কাদায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। কাজেই, কতবার প্রায়শ্চিত্ত করব? আবার আর এক জায়গায় বলছে : ধর একটা বাঁদর আছে। বাঁদর এমনিতেই খুব চঞ্চল। তাকে মদ খাওয়ানো হয়েছে, আবার একটা বিছেও তাকে কামড়েছে। তার উপর একটা ভূত এসে তাকে ধরেছে। তখন তার যে অবস্থা হবে, আমাদের মনটা হচ্ছে সেরকম। গীতাতে অর্জুন বলছেন :

চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্‌।

তস্যাহং নিগ্রহং মুন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্‌ ॥

—এই মন, এ অত্যন্ত চঞ্চল, একে দমন করা বড় কষ্ট। যেমন বাতাসকে কেউ দমন করতে পারে না, আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারে না, মনটাও হচ্ছে তাই। জ্ঞানপথে এই মনকে অনেক বিচার করে আয়ত্তে আনতে হয়। ভক্তিপথ কিন্তু একেবারে অন্যরকম। অত বিচার করতে হয় না ভক্তিপথে। ভগবানকে ভালবাসতে চেষ্টা করছি, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভক্তিপথ আর জ্ঞানপথের তফাৎটা বোঝানোর জন্য ঠাকুর বলছেন : ধর, খুব জল হয়েছে, সমস্ত মাঠ ডুবে গেছে ; তুমি এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাবে। অন্যসময় হলে তোমাকে মাঠের আল ধরে ধরে যেতে হত। এখন আর আল ধরে যেতে হবে না, নৌকা করে সোজা যে গ্রামে যাবে সেদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে যাও। এই যে আল দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাওয়া সেটা হচ্ছে জ্ঞানের পথ। অনেক তর্ক, অনেক বিচার—শেষকালে গিয়ে পৌঁছবে লক্ষ্যস্থলে। কিন্তু ভক্তির পথে যদি যাও, তাহলে সোজা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারবে। মাঠ জলে ডুবে গেছে, আল দেখা যাচ্ছে না আর, জল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সমস্ত বিচার সমস্ত প্রশ্ন ভক্তির বন্যায় ভেসে গেছে। আর ঘোরাঘুরি করতে হবে না তখন-সোজাসুজি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছনো যাবে। ভক্ত বলে : ‘আমায় দে মা পাগল করে আর কাজ নাই মা জ্ঞান বিচারে।’ —জ্ঞানবিচার আর করতে পারি না, করব না। আমায় পাগল করে দাও তুমি। কিসের পাগল? তোমার প্রেমে পাগল। ‘তোমার প্রেমের সুরা পানে কর মাতোয়ারা’, তোমার প্রেমের সুরা পান করে আমি পাগল হব। ‘ওমা ভক্তচিত্তহরা ডুবাও প্রেমসাগরে’—ভক্তদের চিত্ত তুমি হরণ করে রাখ, তাদের মন তোমাতে মজে আছে। আমাকেও তুমি তাই কর। তোমার প্রেমসাগরে আমাকে ডুবিয়ে রাখ। ঠাকুরের খুব প্রিয় গান এটা, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের রচনা। আর একজন ভক্ত বলছেন :

আমি জানি না তন্ত্র সাধনা।

কেবল কালী নামটি ডাক রসনা ॥

⋯(যার) অন্তরেতে মুক্তকেশী, মুখে দুর্গানাম রটনা ;

গয়া গঙ্গা বারাণসী, ঘরে বসি পায় সেজনা ॥

—আমি তন্ত্র ইত্যাদি জানি না। আমি শুধু মায়ের নাম করি। মায়ের নাম করি বলে ঘরই আমার তীর্থক্ষেত্র। ঘরে বসেই আমি তীর্থস্থানের পুণ্য লাভ করি! —এই হচ্ছে ভক্তিপথ।

ঠাকুর বলছেন : বিড়ালছানা—সে শুধু মিউ মিউ করে। অর্থাৎ ‘মা মা’ করে। তার মা তাকে কখনও বাবুর ধবধবে সাদা বিছানার উপর রাখছে—সে নির্বিকার, নিশ্চিন্ত। কেউ যে এসে তাকে মারতে পারে বাবুর বিছানায় শুয়ে আছে বলে, এ ভাবনা তার নেই। জানে, মা এখানে রেখেছে, মা-ই বুঝবে। আর সত্যিসত্যিই হয়তো কেউ ঢুকল, দেখল যে, একটা বিড়ালছানা বাবুর বিছানায় শুয়ে আছে, বিছানাটাকে নোংরা করে ফেলবে। সে তাড়াতে গেল বিড়ালছানাকে, কিন্তু বিড়ালছানা নির্বিকার। সে মিউ মিউ করছে, ‘মা মা’ করছে। আর সত্যিই মা কোথা থেকে ছুটে এসে তাকে মুখে করে ধরে নিয়ে গেল, হয়তো একটা ছাইয়ের গাদায় নিয়ে রাখল, সেখানেও সে নির্বিকার। ঈশ্বরের উপর ভক্ত এরকম নির্ভর করে থাকে। অত বিচার করে না। সে জানে যে, যতই সে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাবে, ততই বিষয় পেছনে পড়ে থাকবে। যতই সে ঈশ্বরকে ভালবাসবে ততই সে দেখবে যে, তার মন আর অন্যদিকে যেতে চাইছে না। যে মনকে নিয়ে তার এত সমস্যা, দেখবে যে সেই মনই কখন তার বন্ধু হয়ে গেছে। ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে সেই মন আর বাধা নয়—সহায়। আসলে আমরা তো সবাই আনন্দ খুঁজছি। আমরা রসগোল্লা খাই, খেলা দেখি, সিনেমায় যাই—সব ঐ আনন্দের জন্য। কিন্তু সব থেকে যা বড় আনন্দ, সব আনন্দ যা থেকে আসছে—তা হচ্ছে ঈশ্বরলাভের আনন্দ, ব্রহ্মানন্দ। ঠাকুর বলছেন : সেই আনন্দের আস্বাদ যে পেয়েছে, বিষয়ানন্দ তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। যে একবার মিছরির পানা খেয়েছে তার আর চিটেগুড় খেতে ভাল লাগে না। ভাগবতে বলছে :

যস্য ভক্তিৰ্ভগবতি হরৌ নিঃশ্রেয়সেশ্বরে।

বিক্রীড়িতোহমৃতাম্ভোধৌ কিং ক্ষুদ্রৈঃ খাতকোদকৈঃ ॥

—যার হরিতে নিঃশ্রেয়স ভক্তি হয়েছে, সে ঈশ্বরকে নিয়ে খেলা করে, ঈশ্বরকে নিয়েই থাকে সে। আর কোনদিকে সে নজর দেয় না। কারণ, অমৃতসাগর যে পেয়ে গেছে, সে কেন একটা ছোট জলাশয়ের দিকে নজর দেবে? বড় চুম্বক যখন আকর্ষণ করছে তখন ছোট চুম্বক আর কি করবে? ঈশ্বর হচ্ছেন অমৃতসাগর, বড় চুম্বক। আর এই জগৎসংসার, পুত্র-পরিবার, মান-যশ, ভোগ-সুখ এগুলো যেন ছোট্ট একটা পুকুর, ছোট চুম্বক। বড় জিনিস যে পেয়েছে সে ছোট্ট জিনিসের জন্য আর ব্যাকুল হয় না। ঈশ্বরের স্মরণ-মনন, ভজন-কীর্তন এসবের মধ্যে যে একবার আনন্দ পেয়েছে, তার অন্য জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ধীরে ধীরে কমে যায়। আপনা-আপনি তার বিষয়াসক্তি দূর হয়ে যায়। একটা গানে আছে :

কত ঢেউ উঠছে রে দিল-দরিয়ার।

ঢেউ দেখে বুক শুকিয়ে উঠে, না হেরি কোন উপায় ॥

মন মাঝি আনাড়ি, রিপু ছয় জনা দাঁড়ি,

তারা কেউ শুনে না আমার কথা দায় হল ভারি,

এরা ইচ্ছামত কর্ম করে, (বুঝি) মাঝ গাঙে তরী ডুবায় ॥

… … …

প্রেমিক বলে এই বেলা, হরিনামের ভেলা,

রাখনা কাছে ভয় কি তুফান হলই বা মেলা,

যখন ডুববে তরী ভেলায় চড়ি, (ও ভাই) কূল পাবি হরির কৃপায় ॥

—এই হৃদয়রূপ সমুদ্রে কত ঢেউ উঠছে অর্থাৎ কত রকমের বাসনা উঠছে। সেসব দেখে আমি মনে মনে আঁতকে উঠছি। মনে হচ্ছে, এ তো আমার সাধ্যাতীত ব্যাপার—আমি পারব না বোধহয় লক্ষ্যে পৌঁছতে। আমার মনমাঝি একেবারে অনভিজ্ঞ, আর এই নৌকার যারা দাঁড়ি, ছয় রিপু, তারা আমার কোন কথাই শুনতে চায় না। এরা নিজের ইচ্ছামতো চলছে, ভয় হচ্ছে—বোধহয় মাঝনদীতে আমার নৌকো ডুবে যাবে। এই অবস্থাতে একমাত্র ভরসা আমার হরিনামের ভেলা। এই ভেলা আমি কাছে রেখেছি—আর কোন ভয় নেই আমার। যদি ঝড় হয়, নৌকো যদি ডোবেই এই ভেলাতে চড়েই আমি কূলে পৌঁছে যাব। একটা শ্লোকে বলা হচ্ছে : ‘ভক্তবৎসলঃ স্বয়মেব সর্বেভ্যো মোক্ষবিঘ্নেভ্যো ভক্তিনিষ্ঠান্‌ সর্বান্‌ পরিপালয়তি। সর্বাভীষ্টান্‌প্রযচ্ছতি। মোক্ষং দাপয়তি।’ —ভগবান ভক্তবৎসল। তিনি নিজে এসে ভক্তের মুক্তির পথে যত বাধা আছে দূর করে দেন। সর্বতোভাবে তিনি ভক্তকে পালন করেন, তার মনের যত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করে দেন, এমন কি সব থেকে কাম্য যে মোক্ষ, সেই মোক্ষও দেন তাকে। ভগবানের দিকে একটু এগুলে ভগবান নিজে মনের সব মলিনতা দূর করে দেন, ভিতরের-বাইরের সব বাধা দূর করে দেন।

ঠাকুর সেইজন্য বারবার বলছেন ; মোড় ফিরিয়ে দাও। কাম ক্রোধ এসব বিচার করে কি সহজে দূর করা যায়? ঈশ্বরের দিকে এগুলি ঘুরিয়ে দাও। তাহলেই এগুলি দূর হয়ে যাবে। আমি ঈশ্বরকে ভালবাসি। আমার সব বাসনা ঈশ্বরকেন্দ্রিক। তাহলে সেই বাসনা আমার আর বন্ধনের কারণ হয় না, দুঃখের হয় না—মধুর হয়ে যায়। বলছেন : ঘা হয়েছে, ঘা শুকোচ্ছে, তার উপর চামাটি পড়েছে। তুমি যদি এখন রোজ সেই চামাটি তুলতে থাক, ঘা সহজে শুকোবে না। কিন্তু ‘ঘা হয়েছে হয়েছে, আমি চুপচাপ আছি’—এরকম হলে দেখবে, আপনা-আপনি সেই চামাটি শুকিয়ে পড়ে যাবে। অর্থাৎ তুমি ভগবানের উপর নির্ভর করে থাক। তোমার মনের যত মলিনতা, তোমার মনের যত পাপ—এই নিয়ে তুমি অত মাথা খারাপ কোরো না। নিজেকে পাপী মনে কোরো না। ভগবানের নাম করলে সব পাপ দূর হয়ে যায়। হাততালি দিলে যেমন গাছ থেকে পাখিরা উড়ে যায়, ঠাকুর বলছেন, ভগবানের নাম করলে দেহবৃক্ষ থেকে তেমনি সব পাপ চলে যায়। আবার বলছেন : ধর, একটা ঘরে হাজার বছর অন্ধকার জমে আছে। তুমি মনে কোরো না যে সেই অন্ধকার কখনও দূর হবে না। নিশ্চয়ই দূর হবে। তবে তার জন্য ‘অন্ধকার দূর হও, অন্ধকার দূর হও’ বলে চেঁচালে হবে না। আলো আনতে হবে। আলো এলে সব অন্ধকার এক নিমেষে দূর হয়ে যাবে। তোমার মনে মলিনতা রয়েছে? ঈশ্বরকে তুমি ডাক। তিনি সাক্ষাৎ সূর্য-স্বরূপ। তাঁর প্রতি ভালবাসা যখন তোমার জাগবে, তিনি যখন তোমার জীবনে আবির্ভূত হবেন, তিনি যখন তোমাকে নিজের কাছে টেনে নেবেন, তখন দেখবে আপনা-আপনি তোমার মনের সব অন্ধকার দূর হয়ে গেছে, আপনা-আপনি তোমার মধ্যে কত সদ্‌গুণ এসে যাচ্ছে, নতুন মানুষ হয়ে যাচ্ছ তুমি। ভক্তিপথ সহজ কেন? এইজন্যই সহজ যে, এই পথে জোর করে কিছু ত্যাগ করতে হয় না। এই পথে অন্তরিন্দ্রিয় নিগ্রহ আপনি হয়। আর সহজে হয়। (২-৩-৩) ভগবানকে ভালবাসলে স্বাভাবিকভাবেই অন্য সব কিছু ত্যাগ হয়ে যায়। জ্ঞানপথে যেটা বিচার করে করে আনতে হয়—ত্যাগ, নিবৃত্তি বা সংযম—ভক্তিপথে সেটা আপনা-আপনি এসে যায়। ঠাকুরের ভাষায় ; পূবদিকে এগুলে পশ্চিম আপনিই পিছনে পড়ে থাকে। তাঁকে ভালবাসলে বিবেক বৈরাগ্য আপনি আসে। (২-১-২) তাঁর প্রতি ভালবাসা যখন আসে তখন স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-কুটুম্বের উপর সে মায়ার টান থাকে না। দয়া থাকে। সংসার বিদেশ বোধ হয়, একটি কর্মভূমিই মাত্র বোধ হয়। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিন্তু কলকাতা কর্মভূমি ; কলকাতায় বাসা করে থাকতে হয়, কর্ম করবার জন্য।(১-৪-৭) সংসারে ভক্ত তখন অনাসক্ত হয়ে থাকতে পারে। সকলের প্রতি সে তার কর্তব্য করে যায়, কিন্তু জড়িয়ে পড়ে না—নির্লিপ্ত হয়ে থাকে। আর এই ভাবটা তার মধ্যে আসে আপনা-আপনি। সেইজন্যই ঠাকুর বলছেন : ভক্তিপথেই তাঁকে সহজে পাওয়া যায়। (১-৩-৪) কর্মকাণ্ড বা জ্ঞানকাণ্ডের নিন্দা করছেন না ঠাকুর। এগুলোও ঈশ্বরলাভের পথ। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য নয়। সাধারণের জন্য ভক্তিপথই সব থেকে ভাল। গানে আছে যে, ‘(তুই) ভক্তিমন্ত্রে মা ব’লে ডাক, কাজ নাই অন্য আয়োজনে।’ তর্ক, বিচার, আয়োজন, অনুষ্ঠানের কি প্রয়োজন? সব থেকে বড় মন্ত্র ভক্তি। সেই মন্ত্রে ‘মা’ বলে তুমি তাঁকে ডাক। বারবার করে তাই ঠাকুর বলছেন : ভক্তিপথ তোমাদের পথ। এ খুব ভাল—এ সহজ পথ। ⋯এই দুর্লভ মানুষ জনম পেয়ে আমার দরকার তাঁর পাদপদ্মে যেন ভক্তি হয়। (১-৩-৫)

ভক্তিপথে ভাবই প্রধান

ভক্তিপথে একটা ভাব নিয়ে ঈশ্বরের দিকে এগুতে হয়। ঠাকুব বলছেন : তিনি ভাবের বিষয়।(৩-১-৬) বস্তুত, ধর্ম মানেই হচ্ছে একটা ভাব। ভাবটা যেন একটা ঐশ্বর্য সেই ঐশ্বর্য ভগবানকে আকর্ষণ করে আনে। যার যত ভাব, ধর্মজীবনটা তার কাছে তত সহজ, স্বাভাবিক ও মধুর। কেউ ভগবানকে প্রভুরূপে দেখতে পারে—নিজেকে তাঁর দাস ভাবছে। ভগবানকে পিতারূপে দেখছে—নিজেকে তাঁর সন্তান ভাবছে। যে ভাবটা তার ভাল লাগে সেটাকে আগলে ধরা। এই ভাবটা প্রথমে হয়তো একটা আরোপিত জিনিস ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সেই ভাবটাই শেষে বাস্তব রূপ নেয়। সেটাই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে দাঁড়ায়—একমাত্র সত্য হয়ে দাঁড়ায়। সেইজন্যে বলা হয় : ‘যা মতিঃ সা গতিঃ’—যার যেমন ভাব তার তেমনই গতি হয়। সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে : ‘ন দেবো বিদ্যতে কাষ্ঠে ন পাষাণে চ পার্বতি। ভাবেষু বিদ্যতে দেবো ভাবো মোক্ষস্বরূপকঃ।’—ভগবান কাঠেও নেই, পাথরেও নেই, তিনি আছেন ভাবে, ভাব থেকেই মোক্ষ আসে। ভাবই সব। যে কোন একটা ভাব যদি পাকা হয়, তা থেকেই মুক্তি হয়। যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ। সেইজন্য বলা হয়—নিজেকে কখনও ছোট ভাবতে নেই, দুর্বল ভাবতে নেই, পাপী ভাবতে নেই। মানুষ যা ভাবে তা-ই হয়ে যায়। ঠাকুর বলতেন : যে নিজেকে পাপী ভাবে, সে পাপীই হয়ে যায়। বরং ভাবতে হয় : আমি তাঁর নাম করেছি, আমার আবার পাপ কি? এরকম যদি ভাবতে পারি, তাহলেই দেখব, আমি শক্তি পাচ্ছি, সাহস পাচ্ছি, সত্যি সত্যিই আমি পবিত্র হয়ে উঠছি। ভক্তিপথে সেইজন্য ভগবানের সাথে একটা সম্পর্ক পাতাতে হয়। সেটা ভাবতে ভাবতে আমি শেষপর্যন্ত রূপান্তরিত হয়ে যাই। আমি ভাবছি ‘আমি তাঁর সন্তান’। ধীরে ধীরে আমার সমস্ত জীবনধারা পালটে যায়, সমস্ত আচার-আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়—সবাই বুঝতে পারে : ইনি ঈশ্বরের সন্তান, এ ছাড়া ইনি আর কিছু ভাবতে পারেন না।

রামপ্রসাদ এই ভাবের কথা বলতে গিয়ে গাইছেন :

মন কি তত্ত্ব কর তারে যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে।

সে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত, অভাবে কি ধরতে পারে ॥

—মন, তুমি তাঁকে জানবে বলছ? কি করে জানবে তাঁকে? তোমার অবস্থা তো একজন পাগলের মতো, যে অন্ধকার ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁকে ধরা যায় শুধু ভাব দিয়ে, ভাব না থাকলে হয় না!

সমস্ত ভক্তিপথটা এই ভাবের উপর দাঁড়িয়ে আছে। একবার দুজন মুসলমান ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। দুজনেই বেশ পণ্ডিত ব্যক্তি। একজন বলছেন : দেখুন, আমি মসজিদে বিশেষ যাই না। আর নমাজ-টামাজ সাধারণত পড়ি না। মনে মনে ‘আল্লা’কে ডাকি—আমার মনে হয় সেটাই ভাল। আর একজন বলছেন ; না, তা তুমি বলতে পার না। মসজিদে যাওয়া উচিত। আর নমাজ পড়ার যে বিধি আছে, যে ভাবে বলা আছে, ওগুলো করা ভাল। আমি ওগুলো করে থাকি। তারপরে দুজনে বেশ তর্ক বেধে গেছে। তখন আমি বললাম : দেখুন, আপনি যদি নমাজটাকে শুধু একটা physical exercise বলে মনে করেন—শরীরটাকে একবার বাঁকাতে হয় আর একবার সোজা করতে হয়, অতএব এ একটা ব্যায়াম-কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়—তাহলে এর কোন প্রয়োজন নেই। আর যদি একটা শ্রদ্ধার ভাব নিয়ে এটা করেন তাহলে এর নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে, এর উপকারিতা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন। ভাবটাই হচ্ছে আসল। ভাব না থাকলে আচার-অনুষ্ঠান অর্থহীন। একটা গান আছে যে, ‘কাজ কি আমার কোশাকুশি, দেঁতোর হাসি লোকাচার’। ভাববিহীন যে লোকাচার, যন্ত্রচালিতবৎ—তাতে কোন লাভ নেই। সে ‘দেঁতোর হাসি’, নিষ্প্রাণ। কিন্তু ভাব থাকলেই জিনিসটা অন্যরকম হয়ে যায়। ভগবান তো আচার-অনুষ্ঠান দেখেন না, তিনি দেখেন মন, তিনি দেখেন ভাব।

মূর্খো বদতি বিষ্ণায় বুধো বদতি বিষ্ণবে

নম ইত্যেবমর্থঞ্চ দ্বয়োরেব সমং ফলম্।

যস্মৈ দত্তঞ্চ যজ্‌ জ্ঞানং জ্ঞানদাতা হরিঃ স্বয়ম্‌

জ্ঞানেন তেন স স্তৌতি ভাবগ্রাহী জনার্দ্দনঃ ॥

—একজন সংস্কৃত জানে না, মুর্খ—সে বলছে ‘বিষ্ণায়’। বলা উচিত, ‘বিষ্ণবে’, ভুল করে বলছে ‘বিষ্ণায়’। আর একজন পণ্ডিত, সে ঠিক বলছে, বলছে : ‘বিষ্ণবে নমঃ’। কিন্তু দুটিরই অর্থ সমান। ফলও এক। ভগবান যাকে যেমন জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েছেন, সে তাই দিয়েই তাঁর স্তুতি করে। ভগবান এসব দেখেন না। তিনি ‘ভাবগ্রাহী’—ভাবটা দেখেন তিনি। ভাব যদি থাকে তাহলে উচ্চারণ শুদ্ধ হল কি অশুদ্ধ হল, শব্দটা ঠিক বললাম কি না বললাম তাতে কিছু যায় আসে না। একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ; গীতা পাঠ করতে গিয়ে যদি শুদ্ধ উচ্চারণ না হয়, তাহলে নাকি পাপ হয়? এর উত্তর ঠাকুরই দিয়ে গেছেন। ছোট ছেলেমেয়ে ভাল করে ‘বাবা’ বলতে পারে না, ভাল করে ‘মা’ বলতে পারে না—মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করে শুধু। বাবা মনে করছেন তাঁকেই ডাকছে, মা মনে করছেন তাঁকেই ডাকছে। দুজনেই খুশি। ভগবানও তাই। আমার যদি অন্তরে ভক্তি থাকে, তাহলে যে-ভাবেই তাঁকে ডাকি, যে-ভাষায়, যে-নামেই ডাকি না কেন, তিনি বুঝতে পারেন তাঁকেই ডাকছি। সেই ডাক তিনি নিশ্চয়ই শোনেন। চৈতন্যদেব তীর্থভ্রমণে গেছেন। এক জায়গায় দেখলেন এক ব্রাহ্মণ গীতা পড়ছে, ভুল উচ্চারণ করছে। উচ্চারণ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে সংস্কৃত জানে না—অথচ তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। চৈতন্যদেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন :১০

⋯শুন মহাশয়।

কোন্‌ অর্থ জানি তোমার এত সুখ হয়?

—কী তুমি বুঝছ, যার জন্য তুমি এতটা আনন্দ পাচ্ছ? আনন্দে তোমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে?

ব্রাহ্মণ বলছেন :

⋯মর্খ আমি শব্দার্থ না জানি।

শুদ্ধাশুদ্ধ গীতা পড়ি গুরু আজ্ঞা মানি ॥

অর্জুনের রথে কৃষ্ণ হয় রজ্জুধর।

বসিয়াছে যেন তাহে শ্যামল সুন্দর ॥

অর্জুনেরে কহিতেছেন হিত-উপদেশ।

তাহা দেখি হয় মোর আনন্দ-আবেশ ॥

—আমি গীতার অর্থ কিছু বুঝতে পারি না। কিন্তু চোখের সামনে আমি যেন দেখতে পাই অর্জুনের রথের রশি ধরে শ্রীকৃষ্ণ বসে আছেন আর অর্জুনকে গীতা উপদেশ করছেন। তাই দেখে আনন্দে আমার চোখে জল এসে যায়। বস্তুত, কি ভাষা দিয়ে আমরা তাঁকে ডাকতে পারি? কি ভাষা আমাদের আছে যা দিয়ে আমরা তাঁকে বশ করতে পারি? তা কি পারি কখনও? তিনি যদি দয়া করে ধরা দেন, দয়া করে তিনি যদি কাছে আসেন আমার, সহজ হয়ে আসেন—তাহলেই আমি তাঁকে পাই, তিনি ধরা দেন তার কাছে যার ভাব আছে—‘হ’লে ভাবের উদয় লয় সে যেমন, লোহাকে চুম্বকে ধরে।’

মঠে স্বামীজী পুজো করতেন—ভাবের পুজো। ঠাকুরঘরে গিয়ে মুঠো মুঠো ফুল নিয়ে ঠাকুরের পায়ে দিচ্ছেন—কোন মন্ত্র পড়ছেন না। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর পুজো করতেন, সেও ভাবের পুজো। আচার-বিচার, মন্ত্র-তন্ত্র সব তুচ্ছ হয়ে গেছে। মা-ছেলেতে খেলা চলছে। শ্রীশ্রীমার পুজোও ভাবের পুজো। ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে বলছেন : রান্না হয়ে গেছে, খাবে চল। যেন খাবার ঘরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন ঠাকুরকে। রামকৃষ্ণানন্দজী পুজো করতেন, সেও ভাবের পুজো। যাঁরা দেখতেন, তাঁদের মনে হত, ঠাকুর যেন সাক্ষাৎ বসে আছেন। রাত্রে নিজের গরম লাগছে। হঠাৎ মনে হল, ঠাকুরেরও তো গরম লাগছে। সারা রাত জেগে ঠাকুরকে হাওয়া করলেন। ঠাকুরঘরের ছাদ ফুটো, ঠাকুরের পটে বৃষ্টির জল পড়ছে। ঠাকুরের মাথার উপর ছাতা ধরে বসে আছেন। আমরা দেখি—ছবি। কিন্তু তাঁরা দেখছেন—সাক্ষাৎ ঠাকুর বসে আছেন। সেইভাবেই তাঁরা ঠাকুরের সেবা করছেন।

বস্তুত, ভক্তি মানেই ভাবের খেলা। ধ্যান, জপ, পুজো, ভজন—ভাব না থাকলে সব বৃথা।

বহুজাপাত্তথা হোমাৎ কায়ক্লেশাত্তু বিস্তরৈঃ।

ন ভাবেন বিনা চৈব তন্ত্রমন্ত্রাঃ ফলপ্রদাঃ ॥১১

—ভাব না থাকলে জপ, হোম, তন্ত্র-মন্ত্র সব শুধু কায়ক্লেশ মাত্র, পণ্ডশ্রম। ভাববিহীন পুজো পুজো নয়। ভাববিহীন জপ জপ নয়, সে তো বাড়ির পোষা পাখিও অনেক সময় ঠাকুর-দেবতার নাম করে। তাঁর নাম যখন করব, ভাবের সাথে করব, প্রেমের সাথে করব। নাম করতে করতে আনন্দ হবে, চোখ দিয়ে জল এসে যাবে। তাঁর ধ্যান করব—ভাবব, তিনি প্রসন্ন-দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন, আমার কত কাছে রয়েছেন তিনি, আমার আপনার জন—একমাত্র আপনার জন। তবেই তো ধ্যান করে আনন্দ পাব। এই যে লোকে তীর্থে যায়, মনটা যদি তৈরী না থাকে তাহলে তীর্থে গিয়ে লাভ কি? একটা গল্প আছে এক বৃদ্ধা পুরী যাচ্ছেন জগন্নাথ দর্শন করতে। পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সারা রাস্তা তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই—বাড়িতে নতুন লাউগাছ হয়েছে, বৌমা তো ছেলেমানুষ, সে ঠিকমতো দেখাশুনা করবে তো? গরু-ছাগলে খেয়ে নেবে না তো! পুরী পৌঁছে যখন বিগ্রহ দেখার সময় হল, তখন তিনি জগন্নাথকে দেখতে পেলেন না—সেই জায়গায় দেখলেন লাউগাছ। তীর্থে যাওয়ার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন এই যে, এতে ভগবানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, উদ্দীপন এনে দেয়। যাঁর মন তৈরী মন, তাঁর সহজেই উদ্দীপন এসে যায়। আর যাঁর মন তৈরী হয়নি, তীর্থস্থানে গেলেও তাঁর উদ্দীপন হবে না। ঠাকুরের মন যেমন তৈরী। যা কিছু দেখছেন তাতেই ঈশ্বরীয় ভাবের উদ্দীপন হচ্ছে। বারবনিতা দেখছেন—অমনি জগজ্জননীকে মনে পড়ছে তাঁর। ইংরেজ-ছেলে ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে—শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে পড়ছে তাঁর। চিড়িয়াখানায় সিংহ দেখছেন, সিংহবাহিনীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রাজামহারাজ গেছেন পূর্ববঙ্গে, সঙ্গে স্বামী প্রেমানন্দ। নাগমশায়ের বাড়ির পাশে একটি পুকুরের তীরে বসে বলছেন : আহা কি চৈতন্যময় স্থান! কি চৈতন্যময় স্থান! ব্রহ্মের প্রকাশ দেখছেন সর্বত্র। মনটা যদি তৈরী থাকে, উঁচু সুরে বাঁধা থাকে—তাহলে যা দেখি তাতেই উদ্দীপন হয়। সেইজন্য বলছে :১২

মন্ত্রে তীর্থে দ্বিজে দেবে দৈবজ্ঞে ভেষজে গুরৌ।

যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী ॥

—মন্ত্র, তীর্থ, দ্বিজ, দেবতা, দৈবজ্ঞ, ভেষজ আর গুরু—এই কয়টিকে যে যেমনভাবে দেখবে সে তেমন ফল পাবে। ওষুধে যার বিশ্বাস থাকবে, সে বেশী ফল পাবে। তেমনি মন্ত্র, গুরুবাক্য ইত্যাদিতে যার বেশী বিশ্বাস, সে বেশী ফল পাবে। যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ । অনেক সময় এরকম হয় যে, কথকতা হচ্ছে, যে কথকতা করছে, সে হয়তো উচ্চারণ ভাল করছে না কিংবা হয়তো তার গলায় মিষ্টতা নেই—কিন্তু খুব. ভাবের সাথে করছে। তার ফলে শুনতে ভাল লাগছে, যারা শুনছে তাদের মধ্যে ভাবের একটা উদ্দীপন হচ্ছে। একজন গান গাইছে—সুর, তাল, কণ্ঠস্বর সব সুন্দর, সব ঠিক ঠিক হচ্ছে, কিন্তু ভাব নেই, তাই নীরস মনে হচ্ছে, কোথায় যেন কিসের অভাব রয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আবার আর একজন গাইছে, গলা হয়তো ততটা ভাল নয়, কিন্তু ভাব দিয়ে গাইছে—তার গান শ্রোতাদের অন্তর স্পর্শ করছে। ভাববিহীন পূজা, ভাববিহীন স্তোত্রপাঠ, ভাববিহীন ভজন—নিষ্প্রাণ বলে মনে হয়। ভাবই হচ্ছে আসল। সেই ভাব যেখানে আছে, সেখানেই আনন্দ।

ঠাকুর সেইজন্য বলছেন : তাঁকে লাভ করতে হ’লে একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য বা মধুর। (৩-২-২) ঈশ্বরের সঙ্গে একটা সম্পর্ক পাতাতে পারলে ধর্মজীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আমরা হিন্দুরা কি করি? ভোরবেলা বিগ্রহকে ঘুম থেকে তুলি। ফুল, চন্দন, কাপড় দিয়ে সাজাই, খেতে দিই, শয়ন দিই। অর্থাৎ আমাদেরই মতো মানুষ তিনি—আমারই ঘরের একজন। দূরের কেউ নন। বাড়ির যারা পরিজন তাদের এক এক জনের সাথে আমার এক এক রকম সম্পর্ক—কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ পুত্র, কেউ কন্যা। ঈশ্বরের সাথেও যদি এরকম একটা সম্পর্ক পাতানো হয়, তাহলে ধর্মজীবনটা অনেক সহজ এবং মধুর হয়ে আসে। ভক্তিশাস্ত্রে দেখি যে, ভক্ত প্রধানত এই পাঁচটি ভাবে ভগবানের চিন্তা করে—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। ঠাকুর বলছেন : শান্ত—ঋষিদের ছিল। তাঁদের অন্য কিছু ভোগ করবার বাসনা ছিল না। (ঐ) শান্ত ভাবে শুধু ভালবাসা আর নির্ভরতা। কোন মমত্ববুদ্ধি নেই। বিদ্যাপতি যেমন বলছেন :১৩

তুহুঁ জগ-তারণ, দীন-দয়াময়,

অতয়ে তোহারি বিশোয়াসা ॥

⋯ ⋯ ⋯

ভণয়ে বিদ্যাপতি, শেষ শমন-ভয়

তুয়া বিনু গতি নাহি আরা।

আদি-অনাদিক-নাথ কহায়সি,

অব তরণ-ভার তোহারা।

—তুমি জগতের ত্রাণকর্তা, দীনের প্রতি তোমার কত দয়া। এইজন্যই তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস। কারণ, আমিও জগতের একজন। আমাকেও তাহলে তুমি দয়া করবে। মৃত্যুকে আমি আর ভয় করি না। তুমি ছাড়া আর কোন গতি নেই। যা কিছু আদি ও অনাদি তার নাথ তুমি। আমাকে তারণ করার ভার তোমারই।

শান্ত ভাবের আর একটা লক্ষণ হচ্ছে নিষ্ঠা। যেমন স্ত্রীর স্বামীতে নিষ্ঠা, —সে জানে আমার পতি কন্দর্প। (ঐ) দাস্য ভাব কি? দাস্য ভাবে ঈশ্বর প্রভু, ভক্ত তাঁর ভৃত্য। যেমন হনুমানের। রামের কাজ করবার সময় সিংহতুল্য। স্ত্রীরও দাস্য ভাব থাকে, —স্বামীকে প্রাণপণে সেবা করে। মার কিছু কিছু থাকে—যশোদারও ছিল। (ঐ) দাস্য ভাবের লক্ষণ হচ্ছে সেবা। দাস্য ভাব কিরকম হয় তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ভক্ত বলছে :১৪

হরি হরি, হেন দিন হইবে আমার।

দুহুঁ-অঙ্গ পরশিব দুহুঁ-অঙ্গ নিরখিব

সেবন করিব দোহাঁকার ॥

⋯ ⋯ ⋯

কনক-সম্পুট করি কর্পূর তাম্বূল পূরি

যোগাইব অধর-যুগলে ॥

—প্রভু, এমন দিন কবে আমার হবে, যেদিন আমি তোমাকে আর শ্রীমতীকে নয়ন ভরে দেখব, তোমাদের চরণ স্পর্শ করব, সেবা করতে পারব তোমাদের দুজনের? কিভাবে সেবা করব তোমাদের?—তাম্বূলে কর্পূর মিশিয়ে সেই তাম্বূল দিয়ে তোমাদের ঠোঁট রাঙিয়ে দেব। এই হচ্ছে দাস্য ভাব, সেব্য-সেবক ভাব। ঈশ্বর সেব্য, ভক্ত তাঁর সেবক।

সখ্য ভাব হচ্ছে : বন্ধুর ভাব। (ঐ) ঈশ্বর আর ভক্ত বন্ধু। দুজনেই সমান। সখ্য ভাব যার, সে ভগবানকে বলে : এস, এস কাছে এসে বস। (ঐ) উদাহরণ দিচ্ছেন ঠাকুর : শ্রীদামাদি কৃষ্ণকে কখন এঁটো ফল খাওয়াচ্ছে, কখন ঘাড়ে চড়ছে। (ঐ) শ্রীদাম, সুদাম—এঁরা হচ্ছেন ব্ৰজের রাখাল। ব্রজের রাখালদের এই সখ্য ভাব। শ্রীকৃষ্ণকে তাঁরা বন্ধুভাবে দেখতেন। তাঁর সঙ্গে একসাথে গরু-বাছুর চরাতেন, খেলাধুলা করতেন। এক জায়গায় বর্ণনা পাচ্ছি যে ব্রজের রাখালরা কিভাবে কৃষ্ণের সাথে খেলতেন :১৫

কেহ শিঙ্গা করে চুরি কেহ ফেলে দূর করি

পুন দেই হাসিয়া হাসিয়া।

কৃষ্ণ যদি থাকে দূরে ধাঞা ধাঞা শিশু চলে

পুন আইসে কৃষ্ণ পরশিয়া ॥

—এই হচ্ছে সখ্য ভাব। অর্জুনেরও সখ্য ভাব।

বাৎসল্য ভাব কি? ঈশ্বর সন্তান বা সন্ততি, ভক্ত তাঁর জননী। বাৎসল্য ভাবের লক্ষণ হচ্ছে লালন। ভগবানকে ভক্ত যেন কোলে-পিঠে করে লালন করছে। যেমন যশোদার। স্ত্রীরও কতকটা থাকে, —স্বামীকে প্রাণ চিরে খাওয়ায়। ছেলেটি পেট ভরে খেলে তবেই মা সন্তুষ্ট। যোদা, কৃষ্ণ খাবে বলে ননী হাতে করে বেড়াতেন। (ঐ) উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে :১৬

মাতা মোরে পুত্রভাবে করেন বন্ধন।

অতি হীনজ্ঞানে করে লালন পালন ॥

ভগবান বলছেন ; মা আমাকে পুত্রভাবে বেঁধে রেখেছেন। আমি যেন তাঁর কাছে কত ছোট হয়ে গেছি। আমি যে জগতের ঈশ্বর তা তিনি ভুলে গেছেন। সন্তানজ্ঞানে তিনি আমাকে লালনপালন করছেন।

আর মধুর ভাব হচ্ছে : ঈশ্বর কান্ত, ভক্ত কান্তা ; ঈশ্বর প্রেমাস্পদ, ভক্ত তাঁর প্রেমিক ; ভক্ত নারী, ঈশ্বর তার স্বামী। যেমন শ্ৰীমতীর। স্ত্রীর মধুর ভাব। এ ভাবের ভিতরে সকল ভাবই আছে—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য। (ঐ) শান্তের নিষ্ঠা, দাস্যের সেবা, সখ্যের বিশ্বাস, বাৎসল্যের লালন আর কান্তার একাত্মতা—এ সবকটির মিশ্রণ ঘটেছে মধুর ভাবে। যত ভাব আছে তার মধ্যে সবথেকে গভীর হচ্ছে মধুর ভাব। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলছেন :১৭ ‘সেই প্রেমা নৃলোকে না হয়’ —এইরকম প্রেম আর দেখা যায় না। কিন্তু এই মধুর ভাব সকলের জন্য নয়। যতক্ষণ দেহবুদ্ধি থাকে ততক্ষণ এই মধুর ভাব অভ্যাস করা চলে না, তাতে মধুর ভাবের বিকৃতি ঘটবার ভয় থাকে।

এই ভাবগুলোর যে কোন একটাকে ধরে এগিয়ে যেতে হয়। দৃঢ়ভাবে ধরতে হয়। ভাসা-ভাসা নয় বা ‘ভাবের ঘরে চুরি’ নয়। ভাবের ঘরে চুরি কিরকম? সেই যে ব্রাহ্মণের গল্প আছে*—বাগান আমি করেছি আর গরু মেরেছে ইন্দ্র। ঠাকুর এই কথা বলতেন যে, ‘ভাবের ঘরে চুরি’ রেখো না। যে ভাবটা ধরব ঠিক ঠিক ধরব। মন-মুখ এক করে ধরব। যদি আমি ঈশ্বরকে প্রভু হিসেবে দেখি, নিজেকে মনে করি তাঁর দাস তাহলে আমার প্রতি-আচরণে সেটা ফুটে উঠবে, আমার সমস্ত জীবনটা ঐ একটা ভাবকে কেন্দ্র করে চলবে। শাস্ত্রে বলছে :১৮ ‘দৃঢ়ভাবনয়া চেতো যদ্‌ যথা ভাবয়ত্যলম্ তৎ তৎ ফলং তদাকারং তাবৎ কালং প্রপশ্যতি।’ —যে দৃঢ়ভাবে কোন একটা ভাব গ্রহণ করে, যথাকালে সে সেই ভাবের ফল পেয়ে থাকে।

ভগবানের ঐশ্বর্য দেখতে নেই

হিন্দুদের বৈশিষ্ট্য এই যে ঈশ্বরকে আমরা আত্মীয় করে তুলি—দূরে সরিয়ে রাখি না। ব্রাহ্মসমাজে যাঁরা বক্তৃতা করতেন, তাঁরা অনেকে বক্তৃতায় বলতেন : হে ঈশ্বর, তুমি কি সুন্দর ফুল করেছ, আকাশ করেছ, তারা করেছ, সমুদ্র করেছ—কী অপূর্ব তোমার সৃষ্টি, ইত্যাদি। ঠাকুর বলছেন : এসব কেন বলছ? এসব তো তাঁর ঐশ্বর্য। এই ঐশ্বর্য বর্ণনা করে তুমি যেন তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছ। এত সম্পদ তাঁর, ধনী তিনি——ধনী হলেই তিনি ‘বাবা’, আর গরীব যদি হন তাহলে ‘বাবা’ নন? তুমি কি তাঁর সম্পদের জন্য তাঁকে ‘বাবা’ বলছ, সম্মান দিচ্ছ? যদি সম্পদ না থাকত, তাহলে তাঁকে সম্মান করতে না? ভালবাসতে না ? ‘বাবা’ বলে ডাকতে না তাঁকে? তা নয়। ‘বাবা’ বাবা। যে কোন অবস্থাতেই তিনি আমার বাবা। ঠাকুর বলছেন : কি জান? মানুষ নিজে ঐশ্বর্যের আদর করে ব’লে, ভাবে ঈশ্বরও ঐশ্বর্যের আদর করেন। ভাবে, তাঁর ঐশ্বর্যের প্রশংসা করলে তিনি খুশী হবেন।⋯ যখন বিষ্ণুঘরের গয়না সব চুরি গেল, তখন সেজোবাবু আর আমি ঠাকুরকে দেখ্‌তে গেলাম। (সেজোবাবু অর্থাৎ মথুরাবাবু। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কথা বলছেন ঠাকুর।) সেজোবাবু বললে, ‘দূর ঠাকুর! তোমার কোন যোগ্যতা নাই। তোমার গা থেকে সব গয়না নিয়ে গেল, আর তুমি কিছু কর্‌তে পারলে না !’ আমি তাঁকে বললাম, ‘এ তোমার কি কথা! তুমি যাঁর গয়না গয়না কোরছো, তাঁর পক্ষে এগুলো মাটির ডেলা! লক্ষ্মী যাঁর শক্তি, তিনি তোমার গুটিকতক টাকা চুরি গেল কি না, এই নিয়ে কি হাঁ করে আছেন? এ রকম কথা বল্‌তে নাই।’(২-১০-৪) বলছেন :ঈশ্বর কি ঐশ্বর্যের বশ? তিনি ভক্তির বশ। তিনি কি চান? টাকা নয়। ভাব, প্রেম, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য এই সব চান। (ঐ) চৈতন্যচরিতামৃতে বলছে ; ঐশ্বর্য নিয়ে মেতে থাকলে ‘সঙ্কুচিত প্রীতি’ হয়ে যায়। তাঁর প্রতি ভালবাসাটা কমে যায়। তাঁকে পর করে ফেলি যেন। তিনি ভালবাসা চান, ভালবাসতে হয় তাঁকে। ঠিক ঠিক যে ভক্ত তার কেবলা রতি। দেখিলে না মানে ঐশ্বৰ্য্য কেবলার রীতি।১৯—সে ঐশ্বর্য জানে না, ভগবানকে সে শুধু ভালবাসে। কাজেই, সব ঐশ্বর্য ভুলে যেতে হয়। আপনার থেকেও আপনার মনে করতে হয় তাঁকে। ঠাকুর বলছেন : তিনি তো ধর্ম-মা নন। আপনারই মা ! (১-১২-৫) মায়ের উপর জোর চলে। (১-১২-৯) তোমরাও মার কাছে আবদার করো, তিনি অবশ্য দেখা দিবেন। (১-১২-৫) বলছেন : ত্রৈলোক্যের মায়ের জমিদারী থেকে গাড়ি গাড়ি ধন আসছিল, সঙ্গে কত লাল পাগড়ীওয়ালা লাঠি হাতে দ্বারবান্‌। ত্রৈলোক্য রাস্তায় লোকজন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, জোর ক’রে সব ধন কেড়ে নিলে। (১-১২-৯) ত্রৈলোক্য মথুরবাবুর ছেলে, রানী রাসমণির নাতি। রানী রাসমণির কোন ছেলে ছিল না—মেয়ে ছিল। প্রথমে মথুরবাবু রানীর তৃতীয় মেয়েকে বিয়ে করেন। সে মারা গেলে পরের মেয়েটিকেও বিয়ে করেন। ত্রৈলোক্য তারই ছেলে। মায়ের জমিদারি থেকে টাকা আসছে। ত্রৈলোকের টাকার দরকার—জোর করে সে মায়ের টাকা কেড়ে নিল। মায়ের ধনের উপর খুব জোর চলে। বলে নাকি ছেলের নামে তেমন নালিশ চলে না। (ঐ) অন্য কেউ নিলে হয়তো আদালতে নালিশ করতেন। কিন্তু ছেলে নিয়েছে, তাই আর নালিশ করা চলে না। অনেক সময় দেখা যায়, ছোট ছেলেকে মা হয়তো বলেন : এই, তুই টাকা নিবি না। মা হয়তো মুঠো করে রেখেছেন, বলছেন : একটাকা তোকে দেব না, তুই আট আনা নে। ছেলে শুনছে না। সে মা-র মুঠো খুলে জোর করে টাকা নিয়ে নেয়। আর মা তাতে মনে মনে হয়তো একটু খুশিই হন। জগজ্জননীর যা কিছু ধন-সম্পদ, তাতে আমার ন্যায্য অধিকার। কি সেই সম্পদ ?—প্রেম, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য ইত্যাদি। আমাকে এসব দিতে তিনি বাধ্য। যদি না দেন কেড়ে নেব। মুঠো খুলে নিয়ে নেব। ঠাকুরকে দেখি, মাকে বলছেন ; দেখা দিবি না? এই আমি গলায় খাঁড়া বসালাম। মা বেচারী আর কি করেন ? বাধ্য হয়ে দেখা দিলেন। বাড়িতে ছেলে যেমন মাকে ভয় দেখায় : আমাকে এটা দেবে না? এই আমি বাড়ি ছেড়ে চললাম। আর মা-ও সঙ্গে সঙ্গে বলছেন : ওরে যাস্‌না, দিচ্ছি। ঠাকুরেরও যেন তাই। সেইজন্য শ্রীঅরবিন্দ বলছেন : ২০ আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যটা শ্রীরামকৃষ্ণ যেন জোর করে দখল করে নিয়েছিলেন (‘taking, as it were, the kingdom of heaven by violence’)।

ঠাকুর বলছেন : কথায় বলে, মায়ের টান বাপের চেয়েও বেশী। (ঐ) আমাদের বয়স যতই হোক, অসুখ করলেই কিন্তু মা-র কথাটাই আগে মনে এসে যায়। মায়ের থেকে বেশী আপনার আর কাউকে ভাবতে পারি না। সেইজন্য, বাংলাদেশের সাধকসমাজের এটা একটা বৈশিষ্ট্য যে, ঈশ্বরকে মা বলে ডাকা। অনেকে বলেন, এটা তন্ত্রের প্রভাবে হয়েছে। যে কারণেই হয়ে থাকুক, এটা আমরা দেখে থাকি যে, যুগে যুগে কত মাতৃসাধক এদেশে এসেছেন। যেমন রামপ্রসাদ।

রামপ্রসাদ বলছেন :

এবার আমি বুঝব হরে।

(মায়ের) ধরব চরণ লব জোরে।

ভোলানাথের ভুল ধরেছি বলব এবার যারে তারে।

পিতা হ’য়ে মায়ের চরণ হৃদে ধরে কোন বিচারে ॥

⋯ ⋯ ⋯

মায়ের ধন সন্তানে পায় সে ধন নিলে কোন্‌ বিচারে।

আপন ভাল চায় যদি সে চরণ ছেড়ে দিক্‌ আমারে ॥

শিবঠাকুরকে ভয় দেখাচ্ছেন রামপ্রসাদ—এবার তুমি দেখবে আমি কি করি! তোমার ভুল আমি ধরে ফেলেছি। স্বামী হয়ে তুমি স্ত্রীর পা বুকে করে রেখেছ কি ভাবে? এ তো আমার বুকে থাকার কথা, আমি সন্তান। তুমি যদি ভালয় ভালয় মায়ের পা আমাকে ছেড়ে না দাও, সবাইকে আমি তোমার ভুলের কথা বলে দেব। আর তাতেও যদি মায়ের পা না ছাড়, তাহলে জোর করে ঐ পা আমি কেড়ে নেব । আমি জানি, ঐ চরণ আমার। এতে আমার জন্ম-জন্মান্তরের অধিকার । —কী অদ্ভুত একটা ভাব ! ঈশ্বরকে ভয় করছে না ভক্ত, সমীহ করছে না বরং উলটে ভয় দেখাচ্ছে । একেবারে আপনার জন তো ! একটুও দূরত্ব নেই । তাই কোন সঙ্কোচ নেই, দ্বিধা নেই, ভক্ত-ভগবানের মাঝে আর কোনকিছুর আড়াল নেই । বাস্তবিক, ভক্তি যত গভীর হয়, ঈশ্বরকে তত কাছের বলে মনে হতে থাকে। বাড়িতে নতুন জামাইকে প্রথম প্রথম কত আদর-যত্ন করা হয়, তার তখন বিশেষ সম্মান। ধীরে ধীরে জামাই পুরনো হয়ে আসে—জামাই তখন ঘরেরই একজন । তার কাছে কারও কোন সঙ্কোচ নেই তখন, জামাইয়েরও নেই। তখন শাশুড়ীই হয়তো জামাইকে বলছেন: বাবা, দোকান থেকে এটা একটু এনে দেবে? আর জামাইও হাসিমুখে সেটা এনে দিচ্ছে। ঘরেরই ছেলে তো! যাকে আমরা বলি informal relation। ভগবানের সাথে সেরকম informal relation পাতাতে হয়। রাজা মহারাজ বলতেন : ভগবানের সাথে আটপৌরে সম্পর্ক পাতাও। আটপৌরে সম্পর্কটা কি? আটপৌরে কাপড়ের কথা শুনি আমরা। সেই কাপড় অষ্টপ্রহর অর্থাৎ সবসময় পরা যায়। ঈশ্বরের সাথে আটপৌরে সম্পর্ক পাতাতে হবে। অর্থাৎ মনে করতে হবে: সবসময় তিনি আছেন আমার সাথে। আমার ঘরের লোক তিনি। তার চেয়েও নিকটজন। তাঁর আর আমার মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। চণ্ডীতে আমরা দেখি, দেবীর কত স্তব, কত স্তুতি, কত মহিমা-কীর্তন সারা চণ্ডী জুড়ে। দেবী সেখানে দুষ্টের দমন করছেন, শিষ্টের পালন করছেন। অথচ সেই দেবী—আমাদের বাংলাদেশে ঘরের মেয়ে হয়ে গেছেন। আগমনী ও বিজয়া গানে দেখি, দেবীর সব ঐশ্বর্য আমরা ভুলে গেছি। উমা দেবী নন সেখানে, ঘরের মেয়ে। বাঙালীর মেয়ে উমা। হিমালয়ের স্ত্রী মেনকা—উমা এঁদের মেয়ে। কিন্তু বাঙালী মনে করে তাদের সকলের মেয়ে উমা। বছর পরে মেয়ে পিত্রালয়ে আসছে। সারা দেশ মেতে উঠেছে আনন্দে। উমা ঘরে এসেছে, মেনকা তার খোঁজখবর নিচ্ছেন। শিব তো শ্মশানচারী। মেনকা শুনেছেন সেকথা। উমাকে তাই জিজ্ঞেস করছেন : শিবের সাথে থাকতে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না?—

কেমন করে হরের ঘরে ছিলি উমা বল মা তাই

কত লোকে কতই বলে, শুনে প্রাণে মরে যাই॥

মার প্রাণে কি ধৈর্য ধরে, জামাই নাকি ভিক্ষে করে,

এবার নিতে এলে পরে, (বলব) উমা আমার ঘরে নাই॥

চিতাভস্ম মাখি অঙ্গে, জামাই ফিরে নানা রঙ্গে,

তুই নাকি মা, তারি সঙ্গে তোর সোনার অঙ্গে মাখিস্‌ ছাই।

—অদ্ভুত কল্পনা! যিনি জগতের অধীশ্বরী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কর্ত্রী, তিনি মেয়ে হয়ে এসেছেন। দশভুজা তিনি, কিন্তু তাহলেও তিনি আমাদের মেয়ে। আর মায়ের সেই কন্যা-রূপে বাঙালী মুগ্ধ হয়ে আছে। সারা বছর বাঙালী অপেক্ষা করে, বছর শেষে কবে উমা ঘরে আসবে। কল্পনা নয়, সত্যিই তো তিনি মেয়ে হয়ে আসেন। রামপ্রসাদ বেড়া বাঁধছেন আর তিনি মেয়ে হয়ে তাঁকে সাহায্য করছেন। ভগবানও বোধহয় আনন্দ পান সব ঐশ্বর্য ফেলে দিয়ে সহজ সরল ভাবে ভক্তের কাছে আসতে।

ভক্তের প্রয়োজনেই ভগবান ছোট হয়ে, সমস্ত ঐশ্বর্য গোপন করে আসেন। ভক্তের সামর্থ্য তো সীমিত। তিনিও তাই সীমিত হয়েই ভক্তের কাছে আসেন। তিনি তাঁর পূর্ণ বিভূতি নিয়ে এলে ভক্ত তাঁকে ধরতে পারত না। গীতাতে আছে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন। অর্জুন দেখলেন: এ কী, কৃষ্ণই তো সব! সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবকিছু তাঁর মধ্যে। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান— সব তাঁর ইঙ্গিতে হচ্ছে। অর্জুন বলছেন:২১

যথা নদীনাং বহবোহম্বুবেগাঃ সমুদ্রমেবাভিমুখা দ্রবন্তি।

তথা তবামী নরলোকবীরা বিশন্তি বাক্ত্রাণ্যভিবিজ্বলন্তি॥

যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ।

তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকাস্তবাপি বাক্ত্রাণি সমৃদ্ধবেগাঃ ॥

—চারপাশে তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি। আর সেই সব মুখ জ্বলছে। এক সঙ্গে বহু নদী যেমন প্রবল বেগে সমুদ্রে গিয়ে মেশে, কুরুক্ষেত্রের এইসব বীর যোদ্ধারাও তেমনি প্রবল বেগে তোমার জ্বলন্ত মুখের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। পতঙ্গ যেমন আগুনের মধ্যে গিয়ে পড়ে, মানুষ সেইভাবে নিজেদের বিনাশের জন্য তোমার মুখের ভিতরে প্রবেশ করছে। ‘আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপো নমোহস্তু তে দেববর প্রসীদ’২২—তোমার এই উগ্ররূপে আমি তোমাকে চিনতে পারছি না। আমাকে বল, তুমি কে? তোমাকে আমি প্রণাম করছি। আমার প্রতি তুমি প্রসন্ন হও। এর পরে অর্জুন বলছেন:২৩ ‘সখেতি মত্বা প্রসভং যদুক্তং হে কৃষ্ণ হে ‘যাদব হে সখেতি’—তোমাকে আমি ‘সখা বলেছি, ‘কৃষ্ণ’ বলেছি, ‘যাদব’ বলেছি—তোমার স্বরূপ বুঝতে না পেরে, না জেনে কত অপরাধ তোমার কাছে করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। বলছেন : তোমার এই বিশ্বরূপ দেখে আমি খুশি হয়েছি, খুশি হয়েছি কারণ এই রূপ ‘অদৃষ্টপূর্ব’। আগে যা কেউ দেখেনি, তা তুমি কৃপা করে আমাকে দেখিয়েছ, কিন্তু এই বিশ্বরূপ দেখে আমি আবার ভয়ও পেয়েছি। কেন বলছেন ‘ভয় পেয়েছি’? কারণ, এতে যেন শ্রীকৃষ্ণকে দূরের বলে মনে হচ্ছে। যেমন আমরা গোপীদের ক্ষেত্রে দেখি। মথুরায় ‘রাজবেশে শ্রীকৃষ্ণ আছেন—গোপীরা তাঁকে দেখে মাথায় কাপড় দিচ্ছেন। বলছেন : এ কে? এঁকে তো আমরা চিনি না, পরপুরুষ ইনি। তাঁরা যাঁকে চেনেন তাঁর হাতে মোহন বেণু, মাথায় শিখিপাখা—তিনি তাঁদের ব্রজের রাখাল। শ্রীকৃষ্ণের রাজবেশ তাঁদের কাছে অপরিচিত। অর্জুনেরও ঠিক সেই অবস্থা। তিনি যাঁকে চেনেন, তিনি তাঁর সখা, তাঁর রথের সারথি, অতি আপনার জন। শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখে তাই তিনি ভয় পেয়ে গেছেন। বলছেন :২৪ ‘তদেব মে দর্শয় দেব রূপং প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস’—হে দেবেশ, হে জগতের আধার, তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। কৃপা করে তুমি তোমার আগের রূপ আমাকে দেখাও। তোমার এই বিভূতি তুমি সংবরণ কর, এই ঐশ্বর্য তুমি লুকিয়ে ফেল। এতদিন তোমাকে যে রূপে দেখে এসেছি, সেই রূপেই তুমি আমার কাছে এস। অর্জুনের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিভূতি সংবরণ করলেন। অর্জুন আশ্বস্ত হলেন।

যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন :২৫

আমার শপতি লাগে না ধাইও ধেনুর আগে পরাণের পরাণ নীলমণি।

নিকটে রাখিহ ধেনু পূরিহ মোহন বেণু ঘরে বসি আমি যেন শুনি ॥

—তুমি গরু চরাতে যাচ্ছ, গরুর আগে আগে যেও না কিন্তু—গরু তোমাকে গুঁতিয়ে দেবে। বেশী দূরে যেও না। আর যেখানেই থাক, মাঝে মাঝে বাঁশি বাজিও। ঘরে কাজকর্ম করব—তোমার বাঁশির শব্দ শুনে বুঝতে পারব, তুমি কাছাকাছি রয়েছ। ভাবতে অবাক লাগে—যিনি স্বয়ং ভগবান, বিপদতারণ মধুসূদন তাঁকে বলছেন তুমি সাবধানে থেকো। অন্য কোন সম্প্রদায়ের লোক হয়তো বলবে, এ কিরকম! তুমি কোন্ ছার! তুমি ঈশ্বরের সঙ্গে সখ্যতা পাতাচ্ছ, তুমি তাঁকে সন্তান ভাবছ? কিন্তু হিন্দুরা দেখেছে, একটা সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে পাতালে তাঁকে সহজে ভালবাসা যায়। আমি তাঁর স্তব-স্তুতি করলাম, তাতে তিনি যতটা খুশি হন, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হন তাঁকে ভালবাসলে। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে :২৬

আপনাকে বড় মানে আমারে সম হীন।

সেই ভাবে হই আমি তাহার অধীন ॥

ভগবান বলছেন : ‘যে নিজেকে আমার থেকে বড় মনে করে, আমি তার অধীন হয়ে থাকি। ভক্ত মনে করে আমি ভগবানের চেয়ে বড়। কেন সে এরকম মনে করে? কারণ, ভগবানকে সে ভালবাসে। ভালবাসার লক্ষণই এই যে, প্রেমাস্পদকে ছোট করে দেখে। যশোদা ভাবছেন : শ্রীকৃষ্ণকে আমি না দেখলে কে দেখবে? গোপীরা লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছে, পাছে কৃষ্ণ বাঘের কবলে পড়েন।

সদা কৃষ্ণ ব্যাঘ্ৰ হৈতে রক্ষার কারণে।

লগুড় হস্তেতে ফিরে শ্রীকুঞ্জের বনে ॥২৭

যিনি সকলের রক্ষাকর্তা, তাঁকে রক্ষা করার জন্য ভক্ত ব্যস্ত। আর ভগবানও খুশি হন তাতে। এতে তিনি অপমানিত বোধ করেন না বা ক্রুদ্ধ হন না। বলছেন :‘সেই ভাবে হই আমি তাহার অধীন’—এইভাবে ঐশ্বর্য ভুলে শুধু ‘মানুষ’ হিসেবে, একান্ত আপনার জন মনে করে যে আমাকে ভালবাসে, আমি তার গোলাম হয়ে থাকি। তার ভালবাসায় আমি বাঁধা পড়ে থাকি।

ব্রাদার লরেন্সের সম্বন্ধে বই আছে : ‘দি প্র্যাকটিস অফ দি প্রেজেন্স অফ গড’। তিনি এটাই সাধনা করেছিলেন। সবসময় মনে করতেন, ভগবান যেন তাঁর সাথে সাথে রয়েছেন। তাঁর সাথে কথা বলছেন, রাগ করছেন, অভিমান করছেন। কাজ করতে গিয়ে কোন ভুল করে ফেলেছেন, তার জন্য হয়তো কেউ বকেছে। মনে দুঃখ পেয়েছেন, ভগবানকে বলছেন : তুমি কেন আমাকে আগে থেকে সাবধান করে দিলে না? তাহলে তো আমাকে এরকম তিরস্কার সহ্য করতে হত না। আপনার জন তিনি। আমার মনের যা কিছু খেলা, রাগ দুঃখ অভিমান আনন্দ সব তাঁকে নিয়ে। এই হচ্ছে আটপৌরে সম্পর্ক।

শ্ৰীশ্রীমা কলকাতা থেকে যাচ্ছেন জয়রামবাটী। পথে এক জায়গায় রান্না-বান্না করছেন। হাঁড়ি ভেঙে সব ভাত ছড়িয়ে পড়ল। মা সেই ভাতই উপর থেকে একটু নিয়ে ঠাকুরকে নিবেদন করছেন। বলছেন : ঠাকুর, আজ যা মেপেছ, তাই তোমাকে দিলাম। জয়রামবাটীতে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়েছে। শ্রীশ্রীমার যিনি মা, শ্যামাসুন্দরী দেবী, তিনি জগদ্ধাত্রীর কানে কানে বলে দিচ্ছেন ; মা-জগাই, আবার এসো। যেন ঘরের মেয়ে—শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আপনার জন তিনি, তাঁর সঙ্গে এসব চলে।

রামপ্রসাদ বলছেন :

মন বলি ভজ কালী ইচ্ছা হয় তোর যে আচারে।

গুরুদত্ত মহামন্ত্র দিবানিশি জপ করে ॥

শয়নে প্রণাম-জ্ঞান, নিদ্রায় কর মাকে ধ্যান,

আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মারে ॥

—শয়ন শয়ন নয়, মাকে প্রণাম ; ঘুমিয়ে আছি, যেন মায়ের ধ্যান করছি। আহার করছি, যেন মাকে আহুতি দিচ্ছি। সবসময়, সব অবস্থায়, সব কাজের মধ্যে তাঁকে স্মরণ করছি। আমরা হিন্দুরা ‘secular’ আর ‘spiritual’—এরকম কোন ভাগ করি না। এটা ধর্ম আর এটা ধর্ম নয়—এরকম বলি না। আমাদের সম্পূর্ণটাই ধর্ম, সম্পূর্ণটা ‘spiritual’। আমি কিছুদিন আসামে ছিলাম একসময়। সেখানে খ্রীষ্টান মিশনারীরা নানারকম প্রচার করে অনেককে খ্রীষ্টান করেছিল। মিশনারীরা তাদের বলে দিয়েছিল, রবিবার ভগবানের দিন—God’s Day. ওদের ভাষায় ‘Ka sngi Blei.’ হিন্দুদের তারা বলত : তোমরা ভগবানকে একটুও স্মরণ কর না। ছটা দিন তো তোমরা নিজেদের জন্য রেখে দিয়েছ, অন্তত রবিবারটা ভগবানের জন্য রেখে দাও। মজা হচ্ছে : রবিবার তো কোন কাজ করা চলবে না। এক দোকানে চা কিনতে গেছি, দোকানী খ্রীষ্টান। গরিব মানুষ, চা বিক্রি হলে দুটো পয়সা আসবে, তার খুব ইচ্ছে চা বিক্রি করে—এদিকে আবার রবিবার। তখন সে বলছে : একটা কাজ কর, ঐ শেলফ থেকে তুমিই চায়ের প্যাকেটটা নিয়ে নাও, আর দামটা ঐ বাক্সে রেখে দাও। কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে শুধু ঐদিন নয়, সবদিনই ভগবানের দিন, সব মুহূর্ত ভগবানের মুহূর্ত, আর সব কাজ ভগবানের কাজ। স্বামীজী যেমন বলছেন, Sunday-hat। অর্থাৎ রবিবার গীর্জায় যাব তার জন্য আলাদা একটা টুপি আমি টাঙিয়ে রেখেছি। সেটা অন্য দিন অন্য সময় ব্যবহার করি না। ভগবানের সাথে আমার সম্পর্ক ঐ Sunday-hat-এর মতো নয়। তাঁর সঙ্গে আমার প্রতি মুহূর্তের সম্পর্ক, নিত্যকালের সম্পর্ক। অনেকে প্রশ্ন করেন : জপ করব—বাসি কাপড়ে করব, না কাপড় বদলে করব? বিছানায় বসে করব, না আসনে বসে করব? চান না করে করলে কি দোষ হবে? ইত্যাদি। এ সম্বন্ধে ঠাকুর-মা-স্বামীজী যা বলে গেছেন তার সারকথা হচ্ছে: তিনি আমার আপনার জন। তাঁকে ডাকবার জন্য অত বাছবিচার করব কেন? যখন যে-অবস্থায় থাকব, ডাকব। ছেলে যে মাকে ডাকে, সে কি কিছু নিয়ম মেনে ডাকে? বিছানায় শুয়ে মা-র সঙ্গে গল্প করছে। খেতে খেতে মা-র সঙ্গে কথা বলছে। তা না হলে এরকম যদি করে যে, মা-র সঙ্গে কথা বলব তার আগে কাপড়টা পালটে নিই, গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে আসনে গিয়ে বসি, তারপর কথা বলব—তাহলে তো লোকে নিশ্চয়ই বলবে, ‘পাগল’। এও ঠিক তাই। তিনি আমার সত্যিকারের মা। যখনই পারব, তাঁকে ডাকব। চান করে ডাকব, চান না করেও ডাকব। আসনে বসে ডাকব, আসনে না বসেও ডাকব। সম্ভব হলে সবসময় তাঁকে ডাকব। মঠে আমরা দেখেছি স্বামী শান্তানন্দকে। মায়ের সন্তান। সকলে খুবই সম্মান করতেন তাঁকে। এখনও তাঁর কথা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করা হয়। তিনি জপ করতেন—ঘুরছেন, ফিরছেন, লোকের সাথে কথা বলছেন, আবার গিয়ে একটু জপ করে আসছেন। বিছানায় বসেই জপ করছেন। কোন বাছবিচার নেই। একজন শ্ৰীশ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল: আপনি তো ভোরবেলায় ঠাকুরের নাম করতে বলেছেন, কিন্তু আমার যে ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়ার অভ্যাস। মা বলছেন : চা খেয়েই জপ কর না কেন!—তাঁর সাথে আমার ভালবাসার সম্পর্ক, অন্তরের সম্পর্ক, নিয়ম-বিধি সেখানে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার গুরুদেবকে (মহাপুরুষ মহারাজ—স্বামী শিবানন্দ) জিজ্ঞেস করেছিলাম: রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জপ করতে পারি কি? তিনি বলেছিলেন: নিশ্চয়ই পার, তবে দেখো বাবা, গাড়ি চাপা পড়ো না যেন।

ঈশ্বরকৃপা ও ব্যাকুলতা

আমরা সাধারণত মনে করি, অনেক জপ-ধ্যান করলেই বুঝি ভগবানকে পাওয়া যাবে। তার কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই। তাঁর কৃপাতেই তাঁকে পাওয়া যায়। শ্রীশ্রীমা বলতেন : জপ-ধ্যান করলে ইন্দ্রিয়গুলি সংযত হয়ে আসে ঠিকই। কিন্তু ঈশ্বরকে তাঁর কৃপা ছাড়া পাওয়া যায় না। ঠাকুরও সেই কথাই বলেছেন : এই কর্মের দ্বারা তাঁকে পাওয়া যাবে, আর এ কর্মের দ্বারা পাওয়া যাবে না, তা নয়। তাঁর কৃপার উপর নির্ভর। (১-১৩-৩) ঈশ্বর সম্বন্ধে বলা হয়, তাঁর বালকের মতো স্বভাব। তিনি যে কাকে কখন কৃপা করবেন, সে আমরা বলতে পারি না। এ প্রসঙ্গে আনাতোল ফ্রাঁস-এর একটি গল্প মনে পড়ছে—Our Lady’s Juggler. এক যাদুকর যাদু দেখায়। কিন্তু আসলে সে ভক্ত—বিশেষত মা মেরীর প্রতি তার খুব ভক্তি। সে যেখানে থাকত, তার কাছাকাছি একটা মঠ ছিল। সেই মঠের যিনি প্রধান—একজন সন্ন্যাসী তিনি—তাঁর সংস্পর্শে এসে সে সাধু হয়ে গেল। আর সে যাদু দেখায় না—সেই মঠেই থাকে। সেই মঠের সবাই মা মেরীর উপাসনা করেন। অনেক সাধু আছেন সেখানে। তাঁদের নানা রকম গুণ। কেউ ধর্মপুস্তক লেখেন, কেউ সেই বই-এর অনুলিপি রাখেন, কেউ আবার সেই বই-এর পাতায় নানা রকম ছবি আঁকেন ; কেউ মেরীর সম্বন্ধে স্তোত্র রচনা করেন ; কেউ আবার তাঁর গান গেয়ে থাকেন। কিন্তু যা কিছু তাঁরা করেন, মনে করেন যে, মেরীর জন্যই করছেন, এসবের মাধ্যমে তাঁকেই সম্মানিত করছেন। এঁদের এই সুন্দর জীবনযাত্রা দেখে সেই যাদুকরের নিজের সম্বন্ধে খুব ধিক্কার এল : আমি বই লিখতে পারি না, ছবি আঁকতে পারি না, স্তোত্র রচনাও করতে পারি না—কিছুই জানি না আমি। আমার এমন কোন গুণ নেই যা দিয়ে মায়ের সেবা করি। ছি ছি! কী হতভাগ্য আমি! কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল: আমি তো যাদু দেখাতে পারি। ঠিক আছে, এই দিয়েই আমি মাকে খুশি করতে চেষ্টা করব। তারপর থেকে সে একটা সময় বেছে নিল, যখন মা মেরীর মন্দিরে কেউ থাকে না। সেই সময় সে মন্দিরে গিয়ে মেরীর সামনে যাদু দেখায়। প্রতিদিন এরকম করে। ধীরে ধীরে তার সব দুঃখ চলে গেল, চোখে মুখে আনন্দের ভাব ফুটে উঠল। কিন্তু রোজ রোজ তো একটা কাজ লুকিয়ে করা যায় না। ধীরে ধীরে মঠে একটা গুঞ্জন উঠল : কী করে লোকটা প্রতিদিন একা একা? মঠাধ্যক্ষের কানে গেল। তিনি আর দুজন বৃদ্ধ সাধু একদিন চুপি চুপি দেখতে গেলেন ব্যাপারটা। গিয়ে দেখেন যে, সেই যাদুকর মাথা নীচে আর পা উপরে করে কয়েকটা ছুরি আর তামার বল নিয়ে মা মেরীকে খেলা দেখাচ্ছে।—সেই খেলা যা সে লোককে দেখাত, যা দেখে লোকে তার প্রশংসা করত। এঁরা বুঝলেন : লোকটার নিশ্চয়ই মাথাখারাপ হয়েছে। না হলে মন্দিরে ঢুকে যাদু দেখায়? এ তো ভয়ানক অনাচার। এক্ষুনি ওকে এখান থেকে সরিয়ে দাও। —সরিয়ে দিতে যাবেন, এমন সময় এঁরা দেখলেন : মা মেরী বেদী থেকে নেমে আসছেন ; যাদুকর যাদু দেখিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। মেরী এসে সেই ঘাম মুছিয়ে দিলেন।—এই দৃশ্য দেখে সেই সাধুরা খুব অবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা তো কত প্রার্থনা করেছেন, কিন্তু মেরী তো তাঁদের দেখা দেননি। অথচ এই যাদুকর সেসব কিছু না করেই মেরীর দেখা পেয়ে গেল। ধর্মজীবনে এরকম ঘটে থাকে। ঠাকুর গল্প করছেন: একজন লোক শবসাধনা করবে বলে গভীর জঙ্গলে গিয়ে শব ও অন্যান্য সব জিনিস যোগাড় করে বসেছে, বাঘে এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল। আর একজন বাঘের ভয়ে গাছে উঠেছিল। সে এসে ঐ শবে বসতেই মায়ের দেখা পেয়ে গেল। সেইজন্য ঠাকুর বলছেন যে, এই মন্ত্র পড়লে তাঁকে পাওয়া যায়, বা এই পথে চললে তাঁকে পাওয়া যায়—এরকম জোর করে কিছু বলা যায় না। তাঁর কৃপায় তাঁকে পাওয়া যায়।

তার মানে কি আমাদের কিছু করণীয় নেই? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? ঠাকুর তারও উত্তর দিচ্ছেন। বলছেন যে, ব্যাকুলতা চাই। তিনি কৃপা করেন ব্যাকুলতা থাকলে। বলছেন : তবে ব্যাকুল হ’য়ে কিছু কর্ম ক’রে যেতে হয়। ব্যাকুলতা থাক্‌লে তাঁর কৃপা হয়। (ঐ) উদাহরণ দিচ্ছেন যে, পুরী যাবে বলে বেরিয়ে একজন হয়তো উত্তরদিকে হাঁটছে। কিন্তু তার যদি তীব্র ইচ্ছা থাকে তাহলে একজন না একজন তাকে বলে দেবে যে, পুরী উত্তরে না, দক্ষিণে। একটু হয়তো সে ঘুরবে, কিন্তু শেষকালে সে পুরীতে পৌঁছবেই।

একটা সুন্দর গল্প বলছেন ঠাকুর : একজনের বাড়িতে ভারী অসুখ—যায় যায়। কেউ বললে স্বাতী নক্ষত্রে বৃষ্টি পড়বে, সেই বৃষ্টির জল মড়ার মাথার খুলিতে থাক্‌বে, আর একটা সাপ ব্যাঙকে তেড়ে যাবে, ব্যাঙকে ছোবল মারবার সময় ব্যাঙটা যাই লাফ দিয়ে পালাবে, অমনি সেই সাপের বিষ মড়ার খুলিতে পড়ে যাবে ; সেই বিষের ঔষধ তৈয়ার করে যদি খাওয়াতে পার, তবে বাঁচে। (ঐ) একেবারে একটা অসম্ভব জিনিস বলে মনে হবে। কিন্তু যার বাড়িতে অসুখ সে ছাড়বার পাত্র নয়। সেই লোক দিন-ক্ষণ-নক্ষত্র দেখে বাড়ি থেকে বেরুলো, আর ব্যাকুল হ’য়ে ঐ সব খুঁজতে লাগলো। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাক্‌ছে, ‘ঠাকুর! তুমি যদি জোটপাট ক’রে দাও, তবেই হয়।’ এইরূপে যেতে সত্য-সত্যই দেখতে পেলে, একটা মড়ার মাথার খুলি পড়ে রয়েছে। দেখতে দেখতে এক পশলা বৃষ্টিও হ’ল। তখন সে ব্যক্তি বলছে, ‘হে গুরুদেব! মড়ার মাথার খুলিও পেলুম, আবার স্বাতীনক্ষত্রে বৃষ্টিও হ’লো, সেই বৃষ্টির জলও ঐ খুলিতে প’ড়েছে; এখন কৃপা করে আর কয়টির যোগাযোগ ক’রে দাও ঠাকুর।’ ব্যাকুল হয়ে ভাবছে। এমন সময় দেখে একটা বিষধর সাপ আস্‌ছে। তখন সে লোকটির ভারী আহ্লাদ হ’ল ; আর সে এত ব্যাকুল হলো যে বুক দুর দুর করতে লাগলো ; আর সে বলতে লাগলো, ‘হে গুরুদেব! এবার সাপও এসেছে; অনেকগুলির যোগাযোগও হ’ল। কৃপা করে এখন আর যেগুলি বাকী আছে, সেগুলি করিয়ে দাও!’ বল্‌তে বল্‌তে ব্যাঙ্‌ও এলো, সাপটা ব্যাঙ তাড়া করে যেতেও লাগলো ; মড়ার মাথার খুলির কাছে এসে যাই ছোবল দিতে যাবে, ব্যাঙটা লাফিয়ে ওদিকে গিয়ে পড়লো আর বিষ অমনি খুলির ভিতর প’ড়ে গেল। তখন লোকটি আনন্দে হাততালি দিয়ে নাচতে লাগলো। তাই বলছি ব্যাকুলতা থাকলে সব হয়ে যায়। (ঐ)

অনেক সময় দেখা যায়, একজনের মনে একটা প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্য তিনি মনে মনে ছটফট করছেন। অথচ কাকে জিজ্ঞেস করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি হয়তো মঠে গেছেন, একজন সন্ন্যাসীর কাছে গেছেন, গিয়ে দেখলেন যে, ঠিক ঐ প্রশ্ন, যে প্রশ্নটা তাঁর মনে জেগেছে, সেটা নিয়েই তিনি আলোচনা করছেন। প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়ে গেলেন। যীশুখ্রীষ্ট বলছেন :২৮ ‘Knock, and it shall be opened unto you.’ দরজায় ধাক্কা দাও একটু। ধাক্কা না দিতেই যে দরজা খুলে যাবে, তা নয়। তা-ও অবশ্য যায় কোন কোন সময়—কিন্তু ঐ যে আপনা-আপনি দরজা খুলে গেল বলে আমরা মনে করি, সেও মনে একটা ব্যাকুলতা এসেছিল বলেই। ব্যাকুলতা থাকলে সব অনুকূল হয়ে যায়। যে বাধা মনে হচ্ছিল দুস্তর, কখনও আমি পার হতে পারব না—সেও দূর হয়ে যায়। অসম্ভব সম্ভব হয়। হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। ঠাকুর বলতেন : যে ঈশ্বরের দিকে এক পা এগিয়ে যায়, ঈশ্বর তার দিকে দশ পা এগিয়ে আসেন। সত্যি সত্যি যে ভগবানকে চায় সে শেষ পর্যন্ত ভগবানকে পেয়েও যায়। সে অসাধ্য সাধন করে ফেলে। আমরা সাংসারিক জীবনেও দেখি যে, যদি কেউ একটা জিনিসের জন্য ব্যাকুল হয় এবং সেটা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে, তাহলে সেটা পেয়েও যায় সে। শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখের সময় তাঁর আমলকী খেতে ইচ্ছে হয়েছে, মুখে ভয়ানক অরুচি। আমলকীর সময় নয়, কোথাও আমলকী পাওয়া যাবে না। কিন্তু নাগমশায়—তিনি শুনলেন শ্রীরামকৃষ্ণের ইচ্ছের কথা, কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লেন। তিন দিন তাঁর দেখা নেই। কোথা থেকে খুঁজে খুঁজে তিনি আমলকী নিয়ে এলেন। আসল কথা হচ্ছে এই ব্যাকুলতা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আমাদের তো কত কিছু আকাঙক্ষা মনে জাগে। কখনও আকাঙক্ষা জাগে সাহিত্যিক হব, না হয় গাইয়ে হব, আরও কত কি হব। কিন্তু সেই আকাঙক্ষার পূর্তির জন্য যে ব্যাকুলতা দরকার, যে সাধনার দরকার, যে অধ্যবসায় দরকার, তা যদি না থাকে তাহলে কোন আকাঙক্ষা আমাদের পূর্ণ হয় না। আর সবচেয়ে বড় যে জিনিস-ঈশ্বরলাভ—তার জন্য আরও অনেক বেশী ব্যাকুলতা থাকা দরকার। সাধারণ পার্থিব বস্তু লাভ করার যে আকাঙক্ষা তার চেয়ে আরও অনেক বেশী আকাঙ্ক্ষা থাকা দরকার, তবেই ঈশ্বরলাভ হয়। ঠাকুর বলছেন; তিন টান একত্র হলে তবে তিনি দেখা দেন—বিষয়ীর বিষয়ের উপর, মায়ের সন্তানের উপর, আর সতীর পতির উপর টান। এই তিন টান যদি কারও একসঙ্গে হয়, সেই টানের জোৱে ঈশ্বরকে লাভ করতে পারে। (১-১-৫) ঠাকুর গান করতেন :

ডাক দেখি মন ডাকার মত কেমন শ্যামা থাক্‌তে পারে।

কেমন শ্যামা থাক্‌তে পারে, কেমন কালী থাক্‌তে পারে॥ (ঐ)

বলছেন : ডাকার মতো ডাকো, মন-প্রাণ দিয়ে ডাকো। যে ডাকার মতো ডাকে, সমস্ত অন্তর দিয়ে ডাকে, শ্যামা-মা তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন না। এই ব্যাকুলতা আমরা ঠাকুরের জীবনে দেখেছি। যুগে যুগে যাঁরা ঈশ্বরকে ডেকে তাঁকে লাভ করতে পেরেছেন, তাঁদের সকলের জীবনেই এই ব্যাকুলতা দেখেছি। ‘ডাকার মতো’ ডেকেছিলেন তাঁরা, তাই তাঁকে পেয়েছিলেন। মীরাবাঈ যেমন গাইছেন :

প্যারে দরসন দীজ্যো আয়, তুম বিন্‌ রহ্যো ন জায় ॥

জল বিন্‌ কঁবল, চংদ বিন্‌ রজনী, ঐসে তুম দেখ্যাঁ বিন্‌ সজনী

⋯ ⋯ ⋯

দিবস ন ভুখ নীদঁ নহি রৈণা, মুখ সূঁ কথন ন আরৈ বৈণা।

কহা কহূঁ কুছ কহত ন আরে মিলকর তপত বুঝায় ॥

ক্যৃঁ তরসাবো অংতরজামী, আয় মিলল কিরপা কর স্বামী।

মীরা দাসী জনম জনমকী পরী তুম্‌হারে পায়॥

—হে প্রিয়তম, তুমি দর্শন দাও আমাকে। তোমাকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারছি না। তোমাকে না পেয়ে আমার অবস্থাটা কিরকম জান?—পদ্মকে জল থেকে তুলে নিলে যেমন হয় কিংবা আকাশে চাঁদ না থাকলে যেমন হয়। তোমাকে বাদ দিয়ে আমারও সেই অবস্থা। আমার জীবনটা শূন্য, অন্ধকার। আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধ নেই, রাত্রে চোখে ঘুম নেই। মনে কথা জমে আছে—কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। আমার সব জ্বালা জুড়োত, যদি তোমার দেখা পেতাম। প্রভু, তুমি তো অন্তর্যামী। তবে কেন আমাকে এত দুঃখ দিচ্ছ? আমাকে কৃপা কর তুমি। আমি তোমার জন্মজন্মান্তরের দাসী। তোমার পায়ে পড়ে আছি।—এই বলছেন মীরাবাঈ। ঠাকুর বলতেন : মানুষের মনটা দাঁড়িপাল্লার মতো, একদিকে হেলল—সংসার, আর একদিকে হেলল—ভগবান। মীরাবাঈ-এর জীবনে দেখি, তাঁর ‘দাঁড়িটা একেবারে সেইদিকে হেলে আছে যেইদিকে ভগবান। আর সবকিছু অন্যদিকে—ঐশ্বর্য, মান-মর্যাদা সবকিছু।

বিদ্যাপতি বলছেন :২৯

পাখীক পাখ মীনক পানি।

জীবক জীবন হাম ঐছে জানি॥

—পাখির যেমন ডানা, তুমি তেমনি আমার। ডানা-ছাড়া পাখি অসহায়, তোমাকে না পেয়ে আমিও অসহায়। মাছকে জল থেকে তুললে মাছ যেমন ছটফট করে, বাঁচতে পারে না—আমিও বাঁচতে পারছি না তোমাকে ছাড়া। আমার প্রাণের প্রাণ তুমি। লালন ফকির বলছেন :৩০

তার সাক্ষী আছে চাতক রে,

ও সে কোট সাধনে যায় মরে,

চাতক অন্য বারি খায় না রে,

থাকে মেঘের জল-আশায়॥

বনের পশু হনুমান, রাম বিনে তার নাই ধিয়ান,

মুদিলেও তার দু’নয়ন অন্য রূপ না ফিরে চায়॥

রামদাস মুচির ভক্তিতে

গঙ্গা এল চাম-কেঠোতে।

—চাতক মেঘের জল ছাড়া অন্য জল খায় না। মরে যাবে, তবুও সে অন্য জল খাবে না। এমনই তার নিষ্ঠা। হনুমান—রাম ছাড়া অন্য কিছু সে জানে না। সবসময় সে রামরূপ ধ্যান করছে। চোখে সে রাম ছাড়া আর কিছু দেখে না। রামদাস জাতিতে ছিলেন মুচি, অথচ তাঁর ভক্তিতে মা-গঙ্গা তাঁর কুটিরে এসেছিলেন। কাজেই ব্যাকুলতা থাকলে সব সম্ভব হয়। ‘ব্যাকুলতা চাই। ঠাকুর বলছেন : প্রাণ আটুপাটু করতে হবে। একজনকে জলে চেপে ধরলে তার যেমন দম বন্ধ হয়ে আসে, মনে হয় এক্ষুনি মরে যাব বাতাস না পেলে—তেমনি আটুপাটু করতে হবে ঈশ্বরের জন্য। এমন ব্যাকুলতা যে, মনে হবে তাঁর দেখা না পেলে আর এক মুহূর্তও বাঁচব না। ‘হচ্ছে হবে’ এ ভাব নয়। ঠাকুর পছন্দ করতেন না। একটা গান আছে-‘হরিষে লাগি রহরে ভাই তেরা বনত বনত বনি যাই’—হরির কথা চিন্তা কর, ধীরে ধীরে তোমার সব হয়ে যাবে। ঐ ‘বনত বনত বনি যাই’ ঠাকুর পছন্দ করতেন না। বলতেন : ‘বনত বনত’ কি রে? এক্ষুনি হবে, এই জন্মেই হবে। এইরকম রোখ চাই। দুজন চাষীর গল্প করতেন ঠাকুর। জমিতে জল দিতে হবে। পাশেই একটা খাল আছে। সেই খাল থেকে নালা কেটে জমিতে জল নিয়ে আসতে হবে। চাষী সেই নালা কাটছে। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে, খাওয়ার সময় হয়েছে, খেতে আসছে না। তখন স্ত্রী গেছে মাঠে, গিয়ে বলছে—তুমি কি খেপেছ নাকি? এত বেলা হল, এখনও স্নান করলে না, খেলে না! শিগ্‌গির বাড়ি চল। নালা কালকে কাটবে। সেই চাষীও ‘আচ্ছা, তাই হবে, কালকেই হবে’খন’ বলে সুড়সুড় করে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু আর একজন চাষী, সে-ও নালা কাটছে, তাকে গিয়ে যখন তার স্ত্রী বলল, ‘চল, বাড়ি চল’—সে তখন স্ত্রীকে প্রায় মারতে যায়। যতক্ষণ না সে একটা নালা কেটে সেই জমিতে জল দিতে পারল, ততক্ষণ সে খেতে এল না। যখন নালা কাটা হয়ে গেল, তখন সে বাড়িতে গিয়ে বলল ; এবার তামাক সেজে দাও, তামাক খাই ; তেল দাও, মাথায় তেল দিই, এইবার স্নান করব। নিশ্চিন্ত। এই ব্যাকুলতা, এই রোখ। ঠাকুর এই রোখ পছন্দ করতেন। স্বামীজীকে যে এত ভালবাসতেন, এই কারণে। স্বামীজী যেটা ধরতেন, শেষ না দেখে ছাড়তেন না। সবকিছুতেই এই রোখ চাই। ‘হচ্ছে হবে’ এই ভাব যদি থাকে, তাহলে কোনদিনই হবে না। ঠাকুর বারবার বলছেন : ব্যাকুলতা চাই। অবশ্য এই ব্যাকুলতাও তো জোর করে হয় না। মনে আমাদের যতক্ষণ বিষয়বাসনা খুব বেশী থাকে ততক্ষণ ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা আসে না। তবুও চেষ্টা করে যেতে হয়। তাঁকে ডেকে যেতে হয়, তাঁর নাম করে যেতে হয়। ঠাকুরকে একজন বলছেন : তাঁর নাম করতে ভাল লাগছে না কেন? বুঝতে পারি, তাঁকে ডাকা উচিত, অথচ তাঁকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না, তাঁর নাম করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঠাকুর বলছেন : প্রার্থনা কর। ব্যাকুল হয়ে তাঁকে প্রার্থনা কর, যাতে তাঁর নামে রুচি হয়। (২-৩-৩) তিনিই একমাত্র ‘দেনেওয়ালা’। তাঁর কাছে চাও। ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা কর। ভক্তি, বিশ্বাস, বিবেক, বৈরাগ্য, এমনকি ব্যাকুলতা—তাও তিনিই দেবেন। ঠাকুরকে যদি কেউ বলত, ‘আমার ধ্যানজপ ভাল হয় না’, ঠাকুর বলতেন : ওরে, প্রার্থনা কর, মার কাছে প্রার্থনা কর। মা সব ঠিক করে দেবেন। ভক্তিপথে এই হচ্ছে মূলমন্ত্র : ব্যাকুলতা, ব্যাকুলভাবে তাঁর কাছে প্রার্থনা। তিনি সব দেবেন। ধর্মপথের সব অন্তরায় দূর করে দেবেন। দেখা যাবে, যা চেয়েছি, তার অনেক বেশী হয়তো দিলেন। তিনি যখন দেন, দু-হাত ভরে দেন, অকৃপণ হস্তে দেন। আর ভক্ত—সে ধন্য হয়ে যায় ঈশ্বরের কৃপায়। তাঁর কৃপার রাজ্যে তো কোন নিয়ম নেই। নিয়ম যদি থেকেও থাকে—তাঁরই নিয়ম, সেই নিয়ম তিনিই ভাঙতে পারেন। নিয়ম বোধহয় তিনি ভাঙেন ব্যাকুলতা দেখলে। ঠাকুর বলছেন : হাজার বছরের জমাট অন্ধকার একটা বাতি আনলে মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। ব্যাকুলতা থাকলে তিনি মুখ তুলে চান—তাঁর কৃপা-কটাক্ষে মনের সব মলিনতা তখন নিমেষে দূর হয়ে যায়। আমরা তো দেখি, ধর্মরাজ্যে কত অসম্ভব সম্ভব হয়। দস্যু রত্নাকর—বাল্মীকি হয়ে গেলেন। বিল্বমঙ্গল—উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন, কত বড় ভক্ত হয়ে গেলেন তিনি। St Francis:of Assisi,তিনিও প্রথম জীবনে উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন। তাঁর জীবনে কী পরিবর্তন এল—মহাপুরুষ হয়ে গেলেন তিনি। ধর্মরাজ্যেই এসব ঘটে। অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়। মানুষ দেবতা হয়ে যায় তাঁর কৃপায়।

বলছেন : খুব ব্যাকুলতা চাই। খুব ব্যাকুলতা হলে সমস্ত মন তাঁতে গত হয়। (২-১২-২), একটা গল্প বলছেন ঠাকুর : একজনের একটি মেয়ে ছিল। খুব অল্পবয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে গিছিল। স্বামীর মুখ কখনও দেখে নাই। অন্য মেয়ের স্বামী আসে দেখে। সে একদিন বললে, বাবা, আমার স্বামী কই? তার বাবা বললে, গোবিন্দ তোমার স্বামী ; তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দেন। মেয়েটি ঐ কথা শুনে ঘরে দ্বার দিয়ে গোবিন্দকে ডাকে আর কাঁদে ;—বলে, গোবিন্দ! তুমি এস, আমাকে দেখা দাও, তুমি কেন আসছো না। ছোট মেয়েটির সেই কান্না শুনে ঠাকুর থাকতে পারলেন না ; তাকে দেখা দিলেন। (ঐ) ঠাকুর বলছেন :বালকের মত বিশ্বাস। বালক মাকে দেখবার জন্য যেমন ব্যাকুল হয়, সেই ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতা হ’ল তো অরুণ উদয় হ’ল। তার পর সূর্য উঠবেই। এই ব্যাকুলতার পরেই ঈশ্বর দর্শন। (ঐ) ঠাকুর আর একটি গল্প বলতেন। ছোট ছেলে, বনের পথ দিয়ে তাকে পাঠশালায় যেতে হয়, ভয় পায়। মাকে বলাতে মা বলে দিয়েছে : বনে তোর এক দাদা আছে, নাম মধুসুদন। ভয় পেলে তাকে ডাকবি, সে এসে তোকে পৌঁছে দেবে। বনের মধ্যে গিয়ে সে ভয় পেয়েছে। কাঁদছে আর ডাকছে—কোথায় দাদা মধুসূদন, তুমি এসো, আমার খুব ভয় করছে। তার কান্না দেখে ভগবান আর থাকতে পারলেন না। দেখা দিলেন, তাকে সঙ্গে করে পাঠশালার রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। আর বললেন : তুই যখনই ডাকবি, তখনই আমি আসব। আবার আর একটি ছেলের গল্প বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ : তার বাবা একদিন কোন কাজে অন্য জায়গায় গেছে, যাওয়ার আগে ছোট ছেলেটিকে বলে গেছে : তোকে রেখে যাচ্ছি, তুই-ই আজ ঠাকুরকে ভোগ দিবি। সে তো চান করে এসে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করেছে। ঠাকুরের সামনে থালায় করে খাবার রেখেছে। রেখে বলছে : ঠাকুর খেয়ে নাও। তার ধারণা, ঠাকুর সত্যি সত্যিই খাবেন! অনেকক্ষণ সে অপেক্ষা করল, কিন্তু ঠাকুর আর খান না। তখন সে কেঁদে ফেলেছে : ঠাকুর তুমি শিগ্‌গির এসে খাও, অনেক দেরি হয়ে গেল, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তার কান্না দেখে ঠাকুর আর স্থির থাকতে পারলেন না। বিগ্রহ থেকে বেরিয়ে এসে সত্যি সত্যি খেতে লাগলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : এই বালকের বিশ্বাস ! এই ব্যাকুলতা! (ঐ) ঐরকম বিশ্বাস ও ব্যাকুলতা চাই। চাওয়ার মতো চাওয়া চাই। যে আন্তরিকভাবে তাঁকে চায়, সেই তাঁকে পায়। বলছেন : একটা সুযোগ হওয়া চাই। সাধুসঙ্গ, বিবেক, সদ্‌গুরু লাভ, হয় তো একজন বড় ভাই সংসারের ভার নিলে। (১-১৩-৩) ব্যাকুলতা থাকলে এইসব সুযোগ এসে যায়। হাতের কাছে যেন ভগবান সব জুটিয়ে দেন। একজন হয়তো কলকাতার ছেলে, কর্মসূত্রে গেছে বোম্বে। বোম্বে শহরের এক প্রান্তে একটা বাড়ি নিয়ে হয়তো আছে। ভাবছে, এ কোথায় এলাম? ছিলাম কলকাতাতে—মা-কালীর শহর, কাছেই দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় মঠ। কী সুন্দর জায়গা! কেমন ছিলাম, আর সেখানে কত বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে আমরা ঈশ্বরচিন্তা করতাম, সৎপ্রসঙ্গ করতাম, ইত্যাদি। কিন্তু যদি ব্যাকুলতা থাকে, তাহলে দেখা যাবে ঠাকুরের অনুগ্রহে সেখানেই সে বন্ধুবান্ধব পেয়ে গেল—যারা তারই মতো ভক্ত। দেখা গেল, তারা হয়তো আগে যারা ছিল কলকাতাতে তাদের চেয়েও আরও আপনার জন হয়ে গেছে। সমভাব, সমচিন্তা। তাদের নিয়ে সে একটা আলাদা জগৎ গড়েছে—মহা-আনন্দে আছে। বাস্তবিক, ধর্মজীবনে এরকম ঘটে থাকে। ঠাকুর সেইটেই বলতে চাচ্ছেন যে, ব্যাকুল হও; ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকলে দেখবে, সব অন্তরায় দূর হয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে যা অসম্ভব বলে মনে হয়, এমন জিনিস সব ঘটছে।

চার রকমের ভক্ত

ভক্তিপথে যাঁরা চলছেন, তাঁদের সবাইকে কিন্তু এক পর্যায়ে ফেলা যায় না। তাঁদের মধ্যেও রকমভেদ আছে, বৈশিষ্ট্য আছে, নানারকম স্তর আছে। ঠাকুর বলছেন : যেমন সংসারীদের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণ আছে ; তেমনি ভক্তিরও সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণ আছে। (১-৩-২) ভক্তির সত্ত্ব কি? ভক্তির সত্ত্ব যার আছে, সে ধ্যান করে অতি গোপনে। (ঐ) মশারির ভিতরে বসে হয়তো ধ্যান করছে। সবাই ভাবছে, ঘুমোচ্ছে, কিন্তু আসলে ধ্যান করছে। গোপনে ঈশ্বরকে ডাকছে। এদিকে শরীরের উপর আদর কেবল পেটচলা পর্যন্ত ; শাকান্ন পেলেই হ’ল। খাবার ঘটা নাই। পোষাকের আড়ম্বর নাই। বাড়ির আসবাবের জাঁকজমক নাই। (ঐ) অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন। আর কি? সে কখনও তোষামোদ ক’রে ধন লয় না। (ঐ) আমি মাথা বিকিয়েছি একজনের কাছে—ঈশ্বরের কাছে। আর কার কাছে আবার মাথা নোয়ব? তাও আবার তুচ্ছ ধনের জন্য? কারও আমি অপেক্ষা রাখি না। একমাত্র ‘দেনেওয়ালা’ ঈশ্বর। তিনি যা দেন, যেমন দেন, তাতেই আমি খুশি।—এই হচ্ছে সত্ত্বগুণী ভক্তের ভাব। ভক্তির রজঃ থাকলে সে ভক্তের হয়তো তিলক আছে, রুদ্রাক্ষের মালা আছে। সেই মালার মধ্যে মধ্যে আবার একটি সোনার দানা। যখন পূজা করে, গরদের কাপড় প’রে পূজা করে।(ঐ) সে একটু বাইরের আড়ম্বর পছন্দ করে। লোককে জানাতে চায়, ‘এই দেখ আমি কত বড় ভক্ত’। ভক্তির তমঃ যার হয়, তার বিশ্বাস জ্বলন্ত। ঈশ্বরের কাছে সেরূপ ভক্ত জোর করে। যেন ডাকাতি ক’রে ধন কেড়ে লওয়া। ‘মারো কাটো বাঁধে।’ এইরূপ ডাকাত-পড়া ভাব। (১-৩-৩) ঠাকুর বলতেন : ভক্তির তম খুব ভাল জিনিস। রামপ্রসাদের ছিল এই ডাকাতপড়া ভাব। রামপ্রসাদ মাকে ভয় দেখাচ্ছেন : মা, তুমি আমাকে দেখা দিচ্ছ না তো—আমি এবার তোমার নামে মামলা করব। মায়ে-ছেলের ঝগড়া—লোকে তো আর এটাকে ভাল চোখে দেখবে না, লোকে নিন্দে করবে। তখন দেখব, তুমি কি কর, দেখা না দিয়ে যাও কোথায়। গিরিশ ঘোষের এই ভক্তির তম—জ্বলন্ত বিশ্বাস। ঠাকুর বলছেন : পাঁচ সিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস। কৃপা করবে না মানে? করতেই হবে কৃপা। তা না হলে তুমি কিসের অবতার? এই হচ্ছে গিরিশ ঘোষের ভাব। ডাকাত-পড়া ভাব। কান্নাকাটি নয়, অনুনয়-বিনয় নয়—জোর করে, জুলুম করে। আপনার জন তিনি, কাজেই এরকম জোর করা চলে। ভক্তির তম যার হয়, তার আর একটা লক্ষণ হচ্ছে, পাপ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। সে বরং বলে : কি। আমি তাঁর নাম ক’রেছি—আমার আবার পাপ! (ঐ) পাপ হয়তো আমি অনেক করেছিলাম। কিন্তু তাঁর পুণ্যনাম যখনই আমি উচ্চারণ করেছি, সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত পাপ নিশ্চয়ই দূর হয়ে গেছে। আর আমি পাপী নই। সে জোর দিয়ে বলে : আমি তাঁর ছেলে! তাঁর ঐশ্বর্যের অধিকারী! (ঐ) ঠাকুর এই ধরনের মনোভাব পছন্দ করতেন। বলছেন : ভক্তির তমঃ আনো। বলল, কি। রাম বলেছি, কালী বলেছি, আমার আবার বন্ধন ; আমার আবার কর্মফল। (৫-৭-১) আর আছে, ত্রিগুণাতীত ভক্ত। (২-১০-৪) সত্ত্ব, রজ, তম এই তিন গুণের অতীত সে। তাঁর বালকের স্বভাব। ঈশ্বরের নাম করাই তাঁর পূজা। শুদ্ধ তাঁর নাম। (ঐ)

বৈধীভক্তি, প্রেমভক্তি ও জ্ঞানমিশ্রাভক্তি

‘কথামৃতে’ দু-রকম ভক্তির কথা বলছেন ঠাকুর। একরকম ভক্তি হচ্ছে বৈধীভক্তি বা বিধিবাদীয় ভক্তি। আর একরকম ভক্তি হল প্রেমাভক্তি বা রাগভক্তি। এত জপ করতে হবে, উপোস করতে হবে, তীর্থে যেতে হবে, এত উপচারে পুজো করতে হবে, এত বলি দিতে হবে—এসব হচ্ছে বৈধীভক্তি। ঠাকুর বলছেন : বৈধীভক্তি হতে যতক্ষণ, যেতেও ততক্ষণ। স্থায়ী হয় না। বৈধীভক্তিতে ভগবান লাভ হয় না। তার জন্য চাই প্রেমাভক্তি বা রাগভক্তি। বলছেন : ভক্তি দ্বারাই তাঁকে দর্শন হয়; কিন্তু পাকা ভক্তি, প্রেমাভক্তি, রাগভক্তি চাই। (১-৪-৭) কোন বিধি থাকে না তখন। কালবৈশাখীর ঝড় যখন আসে, তখন সব উড়িয়ে নিয়ে যায়, সব একাকার হয়ে যায়। তেমনি প্রেমের ঝড় যখন আসে সব বিধিনিষেধ উড়ে যায়। কোন নিয়ম নেই, লজ্জা নেই, সামাজিক কোন অনুশাসন নেই। ঈশ্বরকে ভালবাসি, জগৎসংসার তার কাছে তুচ্ছ। এই হচ্ছে প্রেমভক্তি বা রাগভক্তি। সেই ভক্তি এলেই তাঁর উপর ভালবাসা আসে। যেমন ছেলের মার উপর ভালবাসা, মার ছেলের উপর ভালবাসা, স্ত্রীর স্বামীর উপর ভালবাসা। ⋯এই অনুরাগ, এই প্রেম, এই পাকা ভক্তি, এই ভালবাসা যদি একবার হয়, তা হলে সাকার-নিরাকার দুই সাক্ষাৎকার হয়। (ঐ)

ঠাকুর বলছেন : গোপীদের ভক্তি প্রেমাভক্তি ; অব্যভিচারিণী ভক্তি, নিষ্ঠা ভক্তি। (২-৫-১) অব্যভিচারিণী ভক্তিতে কোন বিচার নেই। শুধুই ভালবাসা। নির্বিচার ভালবাসা। অর্থাৎ ঐ শুদ্ধা ভক্তি’। আর একরকম ভক্তি হচ্ছে ব্যভিচারিণী ভক্তি। বলছেন : ব্যভিচারিণী ভক্তি কাকে বলে জান? জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি। যেমন, কৃষ্ণই সব হয়েছেন। তিনিই পরব্রহ্ম, তিনিই রাম, তিনিই শিব, তিনিই শক্তি। (ঐ) কিন্তু প্রেমাভক্তিতে এসব বিচার নেই। দ্বারকায় হনুমান এসে বললে ‘সীতা-রাম দেখবো’। (ঐ) হনুমান রামসীতা ছাড়া আর কিছু জানেন না। দ্বারকায় গিয়ে বলছেন ; সীতারাম দেখব। তখন শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে বললেন : তুমি সীতা হ’য়ে ব’স, তা না হলে হনুমানের কাছে রক্ষা নাই। (ঐ) শ্রীকৃষ্ণ রামরূপ ধরলেন আর রূক্মিণী সীতারূপ ধরলেন—হনুমানের জন্য। পাণ্ডবেরা যখন রাজসূয় যজ্ঞ করেন, তখন যত রাজা সব যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসিয়ে প্রণাম করতে লাগলো। বিভীষণ বললেন, আমি এক নারায়ণকে প্রণাম করবো আর কারুকে করবো না। (ঐ) তখন শ্রীকৃষ্ণ নিজে যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করলেন। তাই দেখে বিভীষণ রাজমুকুটসুদ্ধ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন যুধিষ্ঠিরকে। অব্যভিচারিণী ভক্তির উদাহরণ দিচ্ছেন ঠাকুর : কি রকম জান? যেমন বাড়ীর বউ! দেওর, ভাশুর, শ্বশুর, স্বামী সকলকে সেবা করে, পা ধোবার জল দেয়, গামছা দেয়, পিঁড়ে পেতে দেয়, কিন্তু এক স্বামীর সঙ্গেই অন্য রকম সম্বন্ধ। (ঐ) নিজের ইষ্টের সঙ্গে সম্পর্কটা আলাদা। আর সব দেবদেবীকে সম্মান করি, ভক্তি করি—কিন্তু ভালবাসি শুধু একজনকে, আমার যিনি ইষ্ট, তাঁকে। এই প্রেমাভক্তিতে দুটি জিনিস আছে। ‘অহংতা’ আর ‘মমতা’। (ঐ) ‘আমি’ আর ‘আমার’। এখানে ‘আমি-আমার’ বাদ দিতে হবে না। ভক্ত ভগবানের সেবা করছে, ভাবছে—আমার ভগবান, আমি না দেখলে কে তাঁকে দেখবে? যেমন যশোদা। যশোদা ভাবতেন, আমি না দেখলে গোপালকে কে দেখবে, তা হলে গোপালের অসুখ ক’রবে।⋯আর ‘মমতা’ আমার জ্ঞান, আমার গোপাল। (ঐ) সেখানে ‘আমি’ টন্‌টনে। আমার ছেলে গোপাল। আমার উপরে নির্ভর করে আছে। আমি তাকে না খাওয়ালে কে তাকে খাওয়াবে? আমরা ছবিতে দেখি, মা-যশোদার হাত থেকে ভগবান ক্ষীর-ননী নিয়ে খাচ্ছেন। ভক্ত দান করছে, ভগবান হাত পেতে নিচ্ছেন। চিরকাল ভগবান ভক্তের কাছে দীন হয়ে আছেন। গ্রহণ করছেন ভক্তের কাছ থেকে। যেন গ্রহণ করবার জন্য কত উন্মুখ হয়ে আছেন তিনি। আমরা ‘গোপালের মা’র কাহিনী জানি। শ্রীরামকৃষ্ণের অপূর্ব এক মহিলা ভক্ত। নাম অঘোরমণি দেবী। ভগবানকে গোপালভাবে দেখেন। বালবিধবা, ব্রাহ্মণী, গরিব—দিনরাত ঈশ্বরচিন্তায় মেতে আছেন। আর অত্যন্ত কঠোর জীবনযাপন করেন। শুনেছেন, দক্ষিণেশ্বরে এক সাধু আছেন। গেছেন দক্ষিণেশ্বরে একদিন। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলেন তিনি। বুঝলেন যে, ইনি অসাধারণ মানুষ। দ্বিতীয়বার যখন গেছেন, দেখামাত্র ঠাকুর বলছেন : কি এনেছ আমার জন্য, দাও। তিনি কি একটা সস্তা সন্দেশ এনেছিলেন আঁচলে বেঁধে, খুব সঙ্কোচের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণকে দিলেন আর শ্রীরামকৃষ্ণ তাই-ই তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন। আবার বলছেন : তুমি আমার জন্য সন্দেশ কিনে আন কেন? নাড়ু করে রেখে দেবে, তা-ই মাঝে মাঝে আনবে। কিংবা তুমি যা নিজের হাতে রাঁধ, লাউশাক-চচ্চড়ি, কিংবা আলু-বেগুন-বড়ি দিয়ে সজনে-খাড়ার তরকারি—তাই নিয়ে আসবে। গোপালের মা মনে মনে ভাবছেন : ভাল সাধু দেখতে এলাম! ধর্মকর্মের কথা নেই, কেবল খাই খাই। ভাবলেন যে, আর আসবেন না। কিন্তু সেই সাধুর এমনই আকর্ষণ যে কয়েকদিন পরেই সেই চচ্চড়ি রান্না করে এনে উপস্থিত। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে তা খাচ্ছেন আর বলছেন : সুধা।—কেন সুধা? ভক্তিমিশ্রিত, তাই সুধা। তারপর সেই গোপালের মার কত রকম অনুভূতি হল। গোপালের দেখা পেলেন তিনি। আর দেখলেন, ঠাকুরই তাঁর গোপাল। গোপাল মিলিয়ে গেল শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। গোপালের মা যখন ঠাকুরের কাছে আসতেন, অনেক সময় ঠাকুরও যেন গোপাল হয়ে যেতেন। ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়তেন, হাবভাব সব বালগোপালের মতো হয়ে যেত। ভক্তকে খুশি করবার জন্য ভগবান তো সবসময় ব্যস্ত। ভক্ত চাচ্ছেন তুমি এই রূপে এসো—বালগোপালরূপে এসো। ভগবান সেই রূপে আসছেন। যিনি জগতের অধীশ্বর, তিনি শিশু হয়ে আসছেন। যেন অসহায় তিনি। ভক্তের মুখ চেয়ে আছেন। আর ভক্ত ভাবছে : আমি না দেখলে কে দেখবে ভগবানকে! শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : এই হচ্ছে প্রেমভক্তি। ভক্ত এই বিচার করে না যে, তিনি সর্বভূতে বিরাজ করছেন, তিনি সর্বশক্তিমান, এই জগৎসংসার তিনি চালাচ্ছেন। ভক্ত ভাবে : আমি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই, তিনি আমার ভগবান। —এই হচ্ছে ‘অহংতা’ আর ‘মমতা’। বলছেন :কৃষ্ণকে ভগবান ব’লে যশোদার বোধ ছিল না। ⋯উদ্ধব বল্‌লেন, ‘মা! তোমার কৃষ্ণ সাক্ষাৎ ভগবান, তিনি জগৎ চিন্তামণি। তিনি সামান্য নন।’ যশোদা বললেন, ‘ওরে তোদর চিন্তামণি নয়, আমার গোপাল কেমন আছে জিজ্ঞাসা করছি। —চিন্তামণি না, আমার গোপাল।’ (ঐ)

ঠাকুর বলছেন : গোপীদের কি নিষ্ঠা! (ঐ) শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় গেছেন। গোপীরা তাঁর বিরহে কাতর। এমন সময় উদ্ধব একদিন এসেছেন বৃন্দাবনে। উদ্ধব এসেছেন শুনে গোপীরা সবাই তাঁর কাছে ছুটে এসেছেন, জিজ্ঞেস করছেন : তুমি তো মথুরা থেকে এসেছ, শ্রীকৃষ্ণের খবর কিছু জান? কেমন আছেন তিনি? আমাদের কি তিনি ভুলে গেছেন? তারপর তাঁরা উদ্ধবকে নিয়ে বৃন্দাবনের বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন: এইখানে তিনি এই করেছিলেন, এইখানে তিনি আমাদের সাথে খেলা করতেন, ইত্যাদি। উদ্ধব তখন গোপীদের বোঝাচ্ছেন : তোমরা কৃষ্ণের জন্য অত ব্যাকুল হয়েছ কেন? কৃষ্ণ তো ভগবান। তিনি সর্বভূতে রয়েছেন, সর্বত্র রয়েছেন। তোমরা ভাবছ কেন যে তিনি এখানে নেই! গোপীরা বলছেন: আমরা মূর্খ নারী, আমরা ওসব জানি না। তিনি ভগবান কি ভগবান নন তা আমরা জানি না। আমরা সেই কৃষ্ণকে জানি, যিনি এখানে বাঁশি বাজাতেন, মাঠে গরু চরাতেন, আমাদের সাথে যিনি কত রঙ্গরস করতেন। কেবল আমাদের বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে জানি, যিনি এখানে নানা ক্রীড়া করিয়া গিয়াছেন। ⋯আমরা মুক্তি—এ সব কথা বুঝি না। আমরা আমাদের প্রাণের কৃষ্ণকে দেখিতে চাই। (ঐ) উদ্ধব গোপীদের বোঝাচ্ছেন : তোমরা শ্রীকৃষ্ণের জন্য এত কান্নাকাটি করছ কেন? শ্রীকৃষ্ণ তো ভগবান, ভগবানকে পেতে গেলে সাধনভজন করতে হয়। তোমরা তাঁর ধ্যানচিন্তা কর। তখন গোপীরা উত্তর দিচ্ছেন—এখানে সুরদাসের একটা দোহাঁ উদ্ধৃত করছি :৩১ ‘উধো, মন নাহী দস বীস। এক হুতো সো গয়ো হরি কে সঙ্গ, কো আরাধৈ তুব ইস?’ —উদ্ধব, আমাদের তো দশ-বিশটা মন নেই, একটা মাত্র মন। আর সেই মন চলে গেছে শ্যামের সঙ্গে। মনই যখন তিনি চুরি করে নিয়েছেন, তখন আর কেমন করে তাঁর আরাধনা করব? যে মন দিয়ে তাঁর ধ্যান করব, সেই মন যে তাঁরই কাছে। ঠাকুর বলছেন : গোপীদের কি নিষ্ঠা! মথুরায় দ্বারীকে অনেক কাকুতি-মিনতি ক’রে সভায় ঢুকলো। দ্বারী কৃষ্ণের কাছে, তাদের লয়ে গেল। কিন্তু পাগড়ী বাঁধা শ্রীকৃষ্ণকে দেখে তারা হেঁটমুখ হয়ে রইল। পরস্পর বল্‌তে লাগলো, এ পাগড়ী-বাঁধা আবার কে! এঁর সঙ্গে আলাপ ক’ল্লে আমরা কি শেষে দ্বিচারিণী হবো! আমাদের পীতধড়া মোহনচূড়াপরা সেই প্রাণবল্লভ কোথায়! (ঐ) আমরা তো এঁকে চিনি না, ইনি কে? আমরা চিনি তাঁর সেই রাখালরূপকে। তিনি আমাদের ব্রজের রাখাল—সেই রূপেই তাঁকে আমরা দেখতে চাই! ঠাকুর বলছেন : দেখেছ, এদের কি নিষ্ঠা! বৃন্দাবনের ভাবই আলাদা! (ঐ)

প্রশ্ন হল : কোন্‌টি ভাল, জ্ঞানমিশ্রিতা ভক্তি, না প্রেমাভক্তি? (ঐ) ঠাকুর বলছেন : ঈশ্বরে খুব ভালবাসা না হলে প্রেমাভক্তি হয় না। (ঐ) প্রেমাভক্তি খুব ভাল জিনিস কিন্তু সহজে আসে না। একেবারে শেষের কথা প্রেমাভক্তি। তার আগে পর্যন্ত জ্ঞানমিশ্রাভক্তি। ভক্তিও আছে আবার বিচারও আছে। সর্বসাধারণের জন্য জ্ঞানমিশ্রাভক্তি। ভক্তির সাথে সাথে আমার যদি বিচারবুদ্ধি না থাকে তাহলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। গোঁড়ামি, সঙ্কীর্ণতা—এসব দেখা দিতে পারে। ধর্মজীবনে ভাবাবেগের মূল্য নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সবসময় একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ‘ফলেন পরিচীয়তে’। যদি দেখা যায়, ভাবাবেগের ফলে আমার ত্যাগ, প্রেম, পবিত্রতা—এসব গুণ বাড়ছে, তাহলে নিশ্চয়ই তা ভাল। না হলে, তার কোন মূল্য নেই। সাধারণত দেখা যায়, যুক্তিহীন ভাবোচ্ছাস—সেটা আমাদের ধর্মজীবনে কোন স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে না। সেইজন্য ভাব চেপে রাখতে হয়। আর বিচারবুদ্ধি সবসময় সজাগ রাখতে হয়। আর একটা জিনিস মনে রাখতে হয়—বিনা মূল্যে, বিনা পরিশ্রমে, বিনা সংযমে কিছু পাওয়া যায় না। সে যে পথেই হোক না কেন—জ্ঞানপথেই হোক, কিংবা ভক্তিপথেই হোক। প্রেমাভক্তি খুব ভাল—কিন্তু প্রথমে জ্ঞানমিশ্রাভক্তি, প্রেম আসে একেবারে শেষে।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : ঈশ্বরে খুব ভালবাসা না হলে প্রেমাভক্তি হয় না।⋯তিন বন্ধু বন দিয়ে যাচ্ছে, বাঘ এসে উপস্থিত। একজন বললে, ‘ভাই! আমরা সব মারা গেলুম!’ আর একজন বললে, ‘কেন? মারা যাব কেন? এস ঈশ্বরকে ডাকি।’ আর একজন বললে, ‘না, তাঁকে আর কষ্ট দিয়ে কি হবে? এস, এই গাছে উঠে পড়ি।’ যে লোকটি বললে, ‘আমরা মারা গেলুম’, সে জানে না যে ঈশ্বর রক্ষাকর্তা আছেন। যে বললে, ‘এস, আমরা ঈশ্বরকে ডাকি’, সে জ্ঞানী ; তার বোধ আছে যে ঈশ্বর সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সব করছেন। আর যে বললে, ‘তাঁকে কষ্ট দিয়ে কি হবে, এস গাছে উঠি’, তার ভিতরে প্রেম জন্মেছে, ভালবাসা জন্মেছে। (ঐ) একটা গল্প আছে যে, নারদের ভয়ানক অহংকার যে তাঁর মতো ভক্ত আর কেউ নেই। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সেই অহংকার ভাঙার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ এক ব্রাহ্মণের সাথে দেখা। খালি গা, পরম বৈষ্ণব —প্রাণিহত্যা করেন না তিনি, শুকনো মরা ঘাস খেয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাঁধে একটা তরোয়াল ঝুলছে। তাঁকে ওঁরা জিজ্ঞাসা করলেন : আচ্ছা, আপনি তো প্রাণিহত্যা করেন না, তাহলে তরোয়াল কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? সেই ব্রাহ্মণ বলছেন যে, তরোয়াল রেখেছি তিনজনকে মারব বলে। প্রথমে মারব নারদকে। কেন সে সবসময় প্রভুকে ডাকে? তার ডাক শুনে প্রভু ছটফট করেন, ঘুরে বেড়াতে হয় তাঁর ডাক শুনে। প্রভুকে কষ্ট দিচ্ছে, তাই আমি নারদকে প্রথমে মারব। তারপর মারব অর্জুনকে। কেন সে আমার প্রভুকে দিয়ে সারথির কাজ করিয়েছে? আর মারব দ্রৌপদীকে। দ্রৌপদী আমার প্রভুকে উচ্ছিষ্ট খাইয়েছে। এই তিনজনকে মারব বলে তরোয়াল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ঠাকুর বলছেন : ভক্ত ‘মোরে দেখে হীন, আপনাকে দেখে বড়।’ (১-১১-৭) সবসময় দেখা যায় যে, ভক্তের বিরাট অহংকার। ভগবানকে সে নিজের থেকে ছোট মনে করে। ভগবানের কষ্ট হচ্ছে—তাঁকে রক্ষা করার জন্য সে ব্যস্ত। স্বামীজীর জীবনের একটা ঘটনা। স্বামীজী গেছেন ক্ষীরভবানী মন্দিরে। পুরাতন মন্দির। মুসলমানরা সেই মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে। খুব দুঃখ হল স্বামীজীর। মনে মনে বলছেন : মা, আমি যদি থাকতাম, কিছুতেই এই মন্দির ধ্বংস হতে দিতাম না। প্রাণ দিয়েও তোমার মন্দির রক্ষা করতাম। সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজী দৈববাণী শুনতে পেলেন : বাছা, আমার মন্দির তুমি রক্ষা করবে? আমি তোমাকে রক্ষা করি, না তুমি আমাকে রক্ষা কর? আমার ইচ্ছাতেই এরকম হয়েছে। আর আমি যদি চাই, এক্ষুনি এখানে বিরাট মন্দির গড়ে উঠতে পারে।—ভক্ত কিন্তু সেটা ভুলে যায়। তার বিরাট অহংকার। সবসময় তার চিন্তা, ভগবানের পায়ে যেন কাঁটাটি পর্যন্ত না বেঁধে। শ্রীকৃষ্ণ হেঁটে যাচ্ছেন—গোপীরা ভাবছেন, তাঁর এমন কোমল পা, কঠিন মাটির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে তাঁর কত কষ্ট হচ্ছে। আমরা শুয়ে পড়ি না কেন, আমাদের শরীরের উপর দিয়ে তিনি হেঁটে যান।

রূপ অনাহারে তপস্যা করছেন আর শ্রীকৃষ্ণ গ্রাম্যবালকের বেশে এসে তাঁকে দুধ দিয়ে যাচ্ছেন। সনাতন যখন এই খবর জানতে পারলেন, খুব রেগে গেলেন রূপের উপর, তিনি এসে তিরস্কার করছেন রূপকে :৩২

অনুযোগ কৈল বহু আর্তনাদ করি।

কৃষ্ণে দুঃখ দেহ কেনে অনশন করি॥

—এই যে তুমি অনশন করে আছ, তোমার অনশন দেখে কৃষ্ণ স্থির থাকতে পারছেন না, তাঁকে এসে তোমায় অন্ন জোটাতে হচ্ছে—কেন তুমি তাঁকে এরকম করে কষ্ট দিচ্ছ?

মাধুকরী ভিক্ষা করি উদর ভরহ।

সুকুমার কৃষ্ণচন্দ্রে দুঃখ নাহি দেহ ॥৩৩

—তুমি বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে অন্ন সংগ্রহ কর। কোমল-শরীর শ্রীকৃষ্ণকে আর এভাবে কষ্ট দিও না।—এই হচ্ছে প্রেমোভক্তি। ঠাকুর বলছেন : প্রেমের স্বভাবই এই যে, আপনাকে বড় মনে করে, আর প্রেমের পাত্রকে ছোট মনে করে। পাছে তার কষ্ট হয়। কেবল এই ইচ্ছা যে, যাকে ভালবাসে তার পায়ে কাঁটাটি পর্যন্ত না ফোটে। (২-৫-১) আর ভগবানকেও দেখা যায়, যেখানে এই প্রেমভক্তি, সেখানে তিনি বাঁধা পড়ে থাকেন।

পরিপূর্ণ কৃষ্ণপ্রাপ্তি এই প্রেমা হৈতে।

এই প্রেমার বশ কৃষ্ণ কহে ভাগবতে ॥৩৪

তাঁকে আমরা কোন্‌ নাম দিয়ে ডাকব, কোন্‌ ভাষা দিয়ে ডাকব? আমাদের এই অক্ষম ভাষা, অক্ষম মন-—এই দিয়ে কি তাঁকে ধরা যায়? তাঁকে ধরা যায় ভালবাসা দিয়ে। ভাগবতে ভগবান বলছেন :৩৫ ‘বশে কুর্বন্তি মাম্ ভক্ত্যা সৎস্ক্রিয়ঃ সৎপতিং যথা’—সতী-সাধ্বী নারী যেমন তার ভালবাসা দিয়ে স্বামীকে বশ করে রাখে, ভক্ত তেমনি তার ভক্তির সাহায্যে আমাকে বশ করে রাখে। বলছেন :৩৬ ‘অহং ভক্তপরাধীনঃ’—আমি ভক্তের অধীন। ‘অস্বতন্ত্র ইব’—আমার যেন কোন স্বাধীনতা নেই। যিনি চিরস্বতন্ত্র, স্বাধীন ঈশ্বর, তিনি বলছেন আমি আর স্বাধীন নই, ভক্তপরাধীন। রামপ্রসাদ বলছেন : ‘সে যে ভক্তি রসের রসিক, সদানন্দে বিরাজ করে পুরে।’ ‘পুরে’ মানে ‘হৃদয়পুরে’। সকলের হৃদয়শায়ী যে ঈশ্বর, তিনি ভক্তিরসের রসিক, ভক্তিরস আস্বাদ করতে তিনি ভালবাসেন। ঠাকুর তাঁর সমস্ত জীবন দিয়ে এটাই দেখাচ্ছেন। ভালবাসা দিয়ে মাকে (জগন্মাতাকে) তিনি বেঁধে রেখেছেন। মা তাঁর কাছে বাঁধা পড়ে আছেন। অনেক সময় দেখা যায় ছেলে যা বলে মা তাই মেনে নেন। কেন? মা জানেন, ছেলে আমাকে ভালবাসে। সেইজন্য কখনও ছেলেকে হতাশ করেন না। ভগবানও ভালবাসার কাঙাল। যে তাঁকে ভালবাসে তার সব মনোবাসনা তিনি পূর্ণ করেন। গীতাতে ভগবান বলছেন :৩৭

তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্।

দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপন্তি তে ॥

—আমাতে যারা সতত যুক্ত হয়ে আছে আর আমাকে যারা প্রীতিপূর্বক ভজনা করে, আমি তাদের জ্ঞান দিই, যে জ্ঞানের দ্বারা তারা আমাকে লাভ করতে পারে। মীরাবাঈ বলছেন :

সাধন করনা চাহিয়ে মনবাঁ ভজন করনা চাই।

প্রেম লাগানা চাহিয়ে মনবাঁ প্রীত করনা চাই ॥

⋯ ⋯ ⋯

মীরা কহে বিনা প্রেম্‌সে মিলে নহী নন্দলালা ॥

—ভালবাসা চাই। ভালবাসা না হলে নন্দলালাকে পাওয়া যায় না। আর একজন ভক্ত গাইছেন :

কতদিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার।

হয়ে পূর্ণকাম বলব হরি নাম, নয়নে বহিবে প্রেম অশ্রুধার ॥

⋯ ⋯ ⋯

প্রেমে পাগল হয়ে হাসিব কাঁদিব সচ্চিদানন্দ সাগরে ভাসিব,

আপনি মাতিয়ে সকলে মাতাব, হরিপদে নিত্য করিব বিহার ॥

—প্রেমই হচ্ছে ভক্তের সবচেয়ে কামনার জিনিস। আসলে ভক্তি মানেই প্রেম। নারদীয় ভক্তিসূত্রে বলছে :৩৮ ‘সা ত্বস্মিন্ পরমপ্রেমরূপ পরমেশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেমই হল ভক্তি। প্রেমের প্রতি ঈশ্বর সর্বদাই দুর্বল। যেখানে প্রেম, যেখানে অনুরাগ, সেখানে তিনি ধরা দেন। সাধারণত ভগবান ভক্তকে আকর্ষণ করেন। কিন্তু আবার এও দেখা যায় যে, ভক্ত ভগবানকে আকর্ষণ করছে। ঠাকুর বলছেন : কখনও ভগবান চুম্বুক, ভক্ত ছুঁচ⋯ আবার কখনও ভক্ত চুম্বুক পাথর হন, ভগবান ছুঁচ হন। ভক্তের এত আকর্ষণ যে তার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে ভগবান তার কাছে গিয়ে পড়েন। (১-১১-৭) বলছেন যে, ভক্তের হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা। ভক্ত ভগবানকে হৃদয়ে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। (ঐ) বড় সুন্দর একটা কথা বলছেন Eckhart। বলছেন :৩৯ ‘Love is like a fisheriman’s hook.’—ভালবাসা যেন একটা বঁড়শি। এই বঁড়শি দিয়ে ঈশ্বরকে ধরা যায়। ঠাকুর বলছেন : প্রেম রজ্জুর স্বরূপ। প্রেম হলে ভক্তের কাছে ঈশ্বর বাঁধা পড়েন আর পালাতে পারেন না। (৩-১১-৩) ভালবাসা যেন দড়ি। সেই দড়ি দিয়ে ভক্ত ভগবানকে বেঁধে রাখে।

ঠাকুর কয়েকরকম ঈশ্বরপ্রেমের কথা বলেছেন। যেমন একাঙ্গী প্রেম, সাধারণী প্রেম, সমঞ্জসা প্রেম, সমর্থা প্রেম। একাঙ্গী প্রেম কি রকম? ভালবাসা একদিক থেকে। যেমন জল হাঁসকে চাচ্চে না, কিন্তু হাঁস জলকে ভালবাসে। (২-২৪-৬) সাধারণী প্রেম—নিজের সুখ চায়, তুমি সুখী হও আর না হও, যেমন চন্দ্রাবলীর ভাব। (ঐ) সমঞ্জসা প্রেম কি রকম? আমারও সুখ হোক, তোমারও হোক। (ঐ) এই ভাব। ঠাকুর বলছেন : এ খুব ভাল অবস্থা। (ঐ) সমঞ্জসা প্রেমে কান্তাভাবের উদয় হয় আর শ্রীকৃষ্ণের পত্নী হিসাবে তাঁকে সেবা করবার ইচ্ছে হয়। যেমন রুক্মিণী। কিন্তু ঠাকুর বলছেন : সকলের উচ্চ অবস্থা—সমর্থা। (ঐ) ‘সমর্থা’ কেন বলা হয়? কারণ, এই প্রেম কৃষ্ণকে সম্যক্‌ভাবে বশ করতে সমর্থ। সমর্থাপ্রেমে কৃষ্ণসুখেই সুখ, নিজের সুখের জন্য একটুও বাসনা তাতে নেই। যেমন শ্রীমতীর। কৃষ্ণসুখে সুখী, তুমি সুখে থাক, আমার যাই হোক। (ঐ) গোপীদেরও এই ভাব। ঠাকুর বলছেন : গোপীদের এই ভাব বড় উচ্চ ভাব। (ঐ) এই হচ্ছে অহৈতুকী ভক্তি, বা শুদ্ধা ভক্তি। ভক্ত ভগবানকে ভালবাসছে—কোন কারণ নেই তার পেছনে, কোন প্রত্যাশা নেই। ভালবাসি তাই ভালবাসি, কেন ভালবাসি জানি না।

অহৈতুকী ভক্তি

সব থেকে শ্রেষ্ঠ এই অহৈতুকী ভক্তি বা শুদ্ধা ভক্তি। গীতায় বলছে : ৪০ ‘ভক্ত্যা লভ্যস্তু অনন্যয়া’—অনন্য ভক্তি থাকলে তাঁকে লাভ করা যায়। বাইবেলে আছে:৪১ ‘I the Lord your God am a jealous God.’ ভগবান বলছেন : তিনি বড় হিংসুটে। তিনি চান, তাঁকে ছাড়া আর কোন কিছু যেন আমরা না ভালবাসি। দুধও খাব, তামাকও খাব—তা হবে না। শুধু তাঁকেই ডাকতে হবে। ‘No one can serve two masters; …You cannot serve God and mammon.’৪২—ভগবান এবং ভোগসুখ, এই দুয়ের উপাসনা তুমি একসাথে করতে পার না। ভগবানকে পেতে হলে আর সবকিছু তোমাকে ছাড়তে হবে। ‘অনন্যাভক্তি’ চাই তোমার। অনন্যাভক্তি অথাৎ একমুখী ভক্তি। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু চাই না—এই ভাব। ঠাকুর যেমন প্রার্থনা করছেন : লোকমান্য চাই না, আর কিছু চাই না—শুধু শুদ্ধা ভক্তি চাই। ডি. এল. রায় একটা গানে বলেছেন :

ভালোবাসো নাহি বাসো—নইকো তারও অভিলাষী ;

আমরা শুধু ভালোবাসি⋯ভালোবাসি⋯ভালোবাসি ॥

—তুমি আমাদের ভালবাস কি না জানি না, জানতে চাইও না—আমরা শুধু তোমায় ভালবাসি। প্রকৃত ভালবাসা এই রকমই। তাকে অনেকে নিন্দে করে অন্ধ ভালবাসা বলতে পারে। কিন্তু আমরা যাকে ভালবাসি, নির্বিচারেই ভালবাসি। কেন ভালবাসি, এ যদি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, উত্তর দিতে পারব না। তার নাকটা এইরকম, তার কানটা এইরকম, চোখটা এইরকম—এসব বিচার করে কেউ কাউকে ভালবাসে না। যদি বিচার করে ভালবাসে, তাহলে তা প্রকৃত ভালবাসা হল না। প্রকৃত ভালবাসা সবসময়ই অন্ধ। ভালবাসি, তাই ভালবাসি—কেন ভালবাসি জানি না।

চৈতন্যচরিতামৃতে আছে : ৪৩

রাগানুগামর্গে তাঁরে ভজে যেইজন।

সেইজন পায় ব্রজে ব্রজেন্দ্রনন্দন ॥

—রাগ-সহ, অনুরাগ-সহ অর্থাৎ ভালবাসা-সহ যে তাঁকে ডাকে, সে-ই তাঁকে পায়। এখানে ভালবাসা মানে অহৈতুকী ভালবাসা। যে-ভালবাসার পিছনে কোন প্রত্যাশা নেই। স্বামীজীকে একবার একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ভালবাসার সংজ্ঞা কি? স্বামীজী বলছেন : নিষ্কাম ভালবাসা। ঠাকুর যেমন বলেছেন : ‘অমলা’। যে ভালবাসার মধ্যে স্বার্থগন্ধ রয়েছে, সে-ভালবাসা ‘অমলা’ নয়। আমাকে অর্থ দাও, মানযশ দাও, স্বাস্থ্য দাও— তাহলে আমি তোমাকে ভালবাসব ; আগে দুহাত ভরে তোমার কাছ থেকে নেব, তারপর ভালবাসব—না, তা নয়। স্বামীজী বলছেন : সে তো দোকানদারি। ভালবাসা হচ্ছে নিষ্কাম ভালবাসা, অহৈতুকী ভালবাসা—অন্য ভালবাসা ভালবাসা নয়। আমি যাঁকে ভালবাসি, নির্বিচারে ভালবাসি। সেই ভালবাসার জন্য আমি হয়তো কষ্ট পাচ্ছি তবুও ভালবাসি। ভাল না বেসে আমি পারি না। তিনি মুখ তুলে চান বা না চান, তিনি কৃপা করুন বা না করুন—তবুও আমি তাঁকে ভাল না বেসে পারি না। এই হচ্ছে নিষ্কাম, অমলা, অহৈতুকী ভক্তি। এই হল প্রকৃত অনুরাগ। একটা দোহাঁতে আছে :

ব্ৰহ্ম নহী, মায়া নহী, নহী জীব, নহী কাল।

অপনী হু সুধি না রহী, রহোঁ এক নন্দলাল ॥

—ব্রহ্ম বুঝি না, মায়া বুঝি না, জীবও বুঝি না—এ সব বেদান্তের ভাষা বুঝি না। কাল বা সময় বুঝি না, বুঝি না নিজেকেও—আমার কাছে নিজেরও কোন অস্তিত্ব নেই। আমার আছেন শুধু নন্দলাল, আমি কেবল তাঁকেই জানি।

আমরা ভক্তিশাস্ত্রে দেখি এই অহৈতুকী ভক্তির জয়গান। ভাগবতে বলছে :৪৪ প্রকৃত ভক্ত কি বলে জান? সে বলে ; ‘ন পারমেষ্ঠ্যং ন মহেন্দ্ৰধিষ্ণ্যং ন সার্বভৌমং ন রসাধিপত্যম্।’ ব্রহ্মপদ চায় না সে, ইন্দ্রপদও চায় না। সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর কিংবা পাতালের অধিপতি হবে, এও সে চায় না। ‘ন যোগসিদ্ধীঃ’—নানারকম সিদ্ধাই বা বিভূতি চায় না। শূন্য দিয়ে উড়ে যাবে, জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে, কিংবা ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দেবে, এইসব .. অলৌকিক ক্ষমতাও সে চায় না। ‘নাপুনর্ভবম্‌’—এমন কি সব থেকে যা কাম্য জিনিস, মোক্ষ বা মুক্তি—তাও সে চায় না। তাহলে কি চায় সে? ঈশ্বরকে চায় শুধু। ‘ময্যর্পিতাত্মেচ্ছতি মদ্বিনান্যৎ’— ভগবান বলছেন : এইরকম ভক্তের সমস্ত মন-প্রাণ আমাতে অর্পিত হয়ে আছে, আমাকে ছাড়া আর কোন কিছুই সে চায় না। ঠাকুর বলছেন : প্রহ্লাদের অহৈতুকী ভক্তি ছিল। (১-১৫-৩) প্রহ্লাদ বলছেন ভগবানকে :৪৫ ‘মা মাং প্রলোভয়োৎপত্ত্যা সক্তং কামেষু তৈ র্ব্বরৈঃ’।—আমাকে বর দিয়ে প্রলুব্ধ কোরো না। এমনিতেই আমি দুর্বল, আমার মধ্যে আসক্তি রয়েছে। বর দিয়ে সেই আসক্তিকে তুমি বাড়িয়ে তুলো না। ‘ত্বাং উপাশ্রিতঃ!’—আমি তোমার আশ্রয়প্রার্থী, তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। আমি বর চাই না—আমি শুধু তোমাকে চাই। বলছেন :৪৬ ‘যস্ত আশিষ আশাস্তে ন স ভৃত্যঃ’—যে কোন কিছু কামনা করে ঈশ্বরের কাছে, সে দাস বা ভক্ত নয়। ‘স বৈ বণিক্‌’—সে আসলে বণিক, ব্যবসা করতে চায় ভগবানের সাথে। স্বামীজী যেমন বলছেন : দোকানদারি। স্বামীজী আরও বলতেন ভক্ত হবে অশুল্কা দাসিকা। ‘অশুল্কা’—কোন বেতন নেয় না। আবার ‘দাসিকা’—দাসী নয়, তার চেয়েও ছোট। কোন কামনা নেই ঈশ্বরের কাছ থেকে, কোন অভিযোগও নেই তাঁর প্রতি। এই হচ্ছে অহৈতুকী ভক্তি। দিলীপ রায়ের গানে আছে : ‘জ্বালিব আরতি- এই শুধু চায় প্রাণ’। আমি তোমার আরতি করব, তোমার নাম করব, তোমার পুজো করব—এ ছাড়া আর কিছু চাই না। এ থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না। আমাকে তোমার নামগান করতে দাও—তাতেই আমার আনন্দ। তুমি আমাকে আর কিছু দিলে কি দিলে না, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

ঠাকুর বলছেন : যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ক’রবে, তাঁর পাদপদ্মে একমাত্র ভক্তি প্রার্থনা ক’রবে। (১-১৮-৪) ‘কৃষ্ণভক্তিব্যবহিতং ভক্তানাং নাভিবাঞ্ছিতম্‌’৪৭ – কৃষ্ণভক্তি ছাড়া ভক্ত আর কিছু চায় না। অন্য কিছু কামনা নেই তার। ‘অল্পবুদ্ধিরিমং যোগং সেবতে সাধকাধমঃ’৪৮ —যারা অধম সাধক, অল্পবুদ্ধি, তারাই এসব যোগের সাধন করে সিদ্ধাই লাভ করবে বলে, অলৌকিক শক্তি পাবে বলে। কিন্তু প্রকৃত যে ভক্ত, সে ভক্তি ছাড়া আর কিছু চায় না। শ্রীশ্রীমা বলছেন : ভগবানের কাছে কিছু চাইবে না, যদি কিছু চাইতে হয়, তাহলে ‘নির্বাসনা’ চাইবে। ভগবানের কাছে বলবে, তিনি যেন তোমার সব বাসনা দূর করে দেন। কিন্তু শ্রীশ্রীমা-ই আবার বলছেন : তাঁর কাছে ভক্তি চাওয়া যেতে পারে, ভক্তি-কামনা কামনার মধ্যে নয়। ঠাকুর অহল্যার উদাহরণ দিচ্ছেন : অহল্যার শাপ মোচনের পর শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে বললেন, তুমি আমার কাছে বর লও। অহল্যা বললেন, রাম, যদি বর দিবে তবে এই বর দাও—আমার যদি শূকর যোনিতেও জন্ম হয় তাতেও ক্ষতি নাই ; কিন্তু হে রাম! যেন তোমার পাদপদ্মে আমার মন থাকে। (১-১৮-৪) অহল্যা পাথর হয়ে গেছিলেন একটা অন্যায় করার জন্য। অন্যায়টা তাঁর না অন্য কারও বিচার করা কঠিন। কিন্তু তাঁর স্বামী গৌতম মুনি তাঁকে শাপ দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি পাথর হয়ে গেছিলেন। গৌতম মুনি বলেছিলেন : রামচন্দ্র এই বনে আসবেন। তিনি যখন তোমাকে স্পর্শ করবেন, তখন তুমি আবার মানুষ হয়ে যাবে। অধ্যাত্ম রামায়ণে বর্ণনা আছে :৪৯ রামচন্দ্র গেছেন গৌতম মুনির আশ্রমে। তাঁর সঙ্গে আছেন বিশ্বামিত্র। বিশ্বামিত্র রামকে বলছেন : এই সেই অহল্যা, তপস্যা করছে তোমার জন্য। তোমার অপেক্ষায় রয়েছে সে। তুমি তাকে স্পর্শ করবে তবে আবার সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। রামচন্দ্র তাঁকে স্পর্শ করলেন। ‘ননাম রাঘবোহইল্যাম্‌’—স্পর্শ করার পর রামচন্দ্র তাঁর কাছে নত হলেন। এত কঠোর তপস্যা করেছেন অহল্যা, তাই তাঁকে নমস্কার করছেন রামচন্দ্র। নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন : ‘রামোহহম্‌’—আমিই সেই রাম, যাঁর অপেক্ষায় তুমি এত বছর কাটিয়েছ। ‘ততো দৃষ্ট্বা রঘুশ্রেষ্ঠং পীতকৌষেয়বাসম্‌’—অহল্যা দেখলেন, রঘুকুলনিধি তাঁর সামনে। পরনে তাঁর হলুদ পোশাক। ‘ধনুর্বাণধরং রামং লক্ষ্মণেন সমম্বিতম্‌’—রামের হাতে তীরধনুক, সঙ্গে লক্ষ্মণ। দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ‘সম্পূজ্য বিধিবদ্রামমর্ঘ্যাদিভিরনিন্দিতা’— ভাল ভাল অর্ঘ্য এনে রামচন্দ্রকে: পুজো করলেন। ‘হর্ষাশ্রুজলনেত্ৰান্তা’—চোখে জল এসে গেছে আনন্দে। যাঁর ধ্যানে এতদিন কাটিয়েছি আজ তিনি আমার সামনে উপস্থিত! ‘দণ্ডবৎ প্রণিপত্য সা’—সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করছেন রামকে। ‘উত্থায় চ পুনর্দৃষ্ট্বা রামং রাজীবলোচনম্‌’—প্রণাম করে উঠে আবার পদ্মলোচন রামকে দেখছেন। দেখে যেন আর আশ মিটছে না। ‘পুলকাঙ্কিতসর্বাঙ্গা গিরা গদগদয়ৈড়য়ৎ’— সর্বাঙ্গে পুলক দেখা দিয়েছে। আনন্দে গদগদ স্বরে অহল্যা স্তব করছেন : ‘অহো কৃতার্থাস্মি জগন্নিবাস তে পাদাব্জসংলগ্নরজঃকণানহম্‌ স্পৃশামি’— হে জগন্নিবাস, আমি কৃতার্থ—তোমার পাদপদ্মের ধূলিকণা আজ স্পর্শ করতে পেরেছি। ‘যৎ পদ্মজশঙ্করাদিভিৰ্বিমৃগ্যতে রন্ধিতমানসৈঃ সদা’—যে ধূলিকণা লাভ করতে না পেরে বিষ্ণু, মহেশ্বর এঁদের মতো দেবতারাও ক্ষুব্ধ মন নিয়ে খুঁজে বেড়ান। (‘মৃগ্‌’ ধাতুর অর্থ খোঁজা)। তারপরে অহল্যা প্রার্থনা করছেন :‘দেব মে যত্র কুত্রাপি স্থিতায়া অপি সর্বদা’—হে রামচন্দ্র, যে অবস্থায় আমি থাকি না কেন, আমার কিছু বলবার নেই, শুধু একটি আমার প্রার্থনা : ‘ত্বৎপাদকমলে সত্তা ভক্তিরেব সদাস্তু মে’-তোমার পাদপদ্মে যেন সর্বদা আমার ভক্তি থাকে। এ ছাড়া আমার আর কোন কামনা নেই।

আবার নারদকেও দেখছি, ভগবানের কাছে শুদ্ধা ভক্তি চাইছেন। ঠাকুর বলছেন : রাবণ বধের কথা স্মরণ করাবার জন্য নারদ অযযাধ্যায় রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি সীতারাম দর্শন করে স্তব করতে লাগলেন। রামচন্দ্র স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘নারদ! আমি তোমার স্তবে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি কিছু বর লও।’ নারদ বললেন, ‘রাম! যদি একান্ত আমায় বর দেবে, তো এই বর দাও যেন তোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধা ভক্তি থাকে, আর এই ক’রো যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!’ রাম বললেন, ‘আরও কিছু বর লও।’ নারদ বললেন, ‘আর কিছুই আমি চাই না, কেবল চাই তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধা ভক্তি।’ (১-১৭-৫) অধ্যাত্ম রামায়ণে দেখছি, নারদ প্রার্থনা করছেন :৫০ ‘অহং তদ্ভক্তভক্তানাং তদ্ভক্তানাঞ্চ কিঙ্করঃ’— তোমার যারা ভক্ত তাদের আমি ভক্ত। শুধু তাই নয়, তাদের যারা ভক্ত, আমি তাদেরও কিঙ্কর, দাস। বলছেন : ‘অতো মামনুগৃহ্নীষ্ব মোহয়স্ব ন মাং প্রভো’—আমাকে এইটুকু অনুগ্রহ কর তুমি, আমাকে মোহমুগ্ধ কোরো না। তোমার মায়ায় আমাকে ভুলিয়ো না। কেন বলছেন এই কথা? কারণ, মোহমুগ্ধ হলে ভগবানকে ভুলে যাবেন।

চৈতন্যদেব প্রার্থনা করছেন :৫১ ‘ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে’—হে জগদীশ, আমি ধন, জন, সুন্দরী স্ত্রী কিংবা পাণ্ডিত্য, কিছুই চাই না। ‘মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি’—তোমার প্রতি জন্মে জন্মে যেন আমার অহৈতুকী ভক্তি থাকে। মুক্তিও চাচ্ছেন না। বলছেন : বারবার আসব, তাতেও আমার কোন দুঃখ নেই। কিন্তু যেন আমার অহৈতুকী ভক্তি থাকে।

আবার দেখছি, যশোদার প্রার্থনা। রাধা এসেছেন যশোদার কাছে। বলছেন :৫২ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং চৈতন্য, আমি হচ্ছি তাঁর শক্তি। বরং বৃণুষ্ব ভদ্রং তে যৎ তে মনসি বাঞ্ছিতম্‌’—যা তোমার মনে ইচ্ছা হয়, আমার কাছ থেকে তুমি চেয়ে নাও। ‘সর্বং দাস্যামি ভবতীং জ্ঞানিনামপি দুর্লভম্‌’—যা জ্ঞানীরা পায় না, এমন জিনিসও আমি তোমাকে দিয়ে দেব। যশোদা বলছেন : কি চাই জান? ‘হরৌ চ নিশ্চলা ভক্তিঃ তদ্দাস্যং বাঞ্ছতিং মম’-ভগবানে যেন আমার অচলা ভক্তি থাকে, আর আমি যেন তাঁর দাসী হয়ে থাকতে পারি। এই আমার কাম্য।

মীরাবাঈ বলছেন : মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসরা ন কোঈ—গিরিধারী গোপাল ছাড়া আমার আর কেউ নেই! রাজবধূ ছিলেন মীরাবাঈ। রাজৈশ্বর্য, সমাজ সংসার, সব ত্যাগ করে পথে বেরিয়েছিলেন কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য।

ভগবানের আকর্ষণ এমনই দুর্বার। দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে চলেছি, বাদুলেপোকা যেমন আলো দেখলে ছুটে চলে। ঈশ্বর ছাড়া আর কোন চিন্তা নেই—এমন কি, আমি যে আছি সে চিন্তাও থাকে না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন : হাত পা ছেড়ে দিয়ে তালগাছ থেকে লাফিয়ে পড়া। ঈশ্বরকে পাব কি পাব না আমি জানি না। হয়তো একুল-ওকুল দুই-ই যাবে। তবুও তাঁর এমনই আকর্ষণী শক্তি যে, আমার নিশ্চিন্ত নিরাপদ যে আশ্রয় তা ছেড়ে আমি ছুটেছি। তাঁর জন্য আমি কত কষ্ট স্বীকার করছি, পদে পদে বাধা, পদে পদে বিপদ—তবুও তাঁকে না ডেকে থাকতে পারি না। তাঁকে ডাকাই আমার স্বভাব। ঠাকুর বলছেন : খানদানী চাষা কখনও চাষ বন্ধ করে না—বৃষ্টি হোক আর না-ই হোক। প্রকৃত ভক্ত যে, সে সব সময় ঈশ্বরকে ডেকে যায়। ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনছেন কি শুনছেন না তা নিয়ে সে চিন্তা করে না। তাঁর নামগান করতে ভাল লাগে, তাই সে তাঁর নামগান করে। তাঁর নামগানের যে আনন্দ তাতেই সে ভরপুর হয়ে যায়, ধন্য হয়ে যায়। ভগবান বিনিময়ে তাকে কিছু দিলেন কি দিলেন না, এ চিন্তা করবার তার কোন অবকাশ থাকে না। এই হচ্ছে অহৈতুকী ভক্তি।

শ্রীরামকৃষ্ণ একবার কিছুদিনের জন্য স্বামীজীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনিতে তো ‘নরেন নরেন’ করে পাগল। নরেন এলে নিজে একেবারে বিহ্বল হয়ে যেতেন। কি করবেন ঠিক করে উঠতে পারতেন না। যা কথাবার্তা, তখন বেশীর ভাগই বলতেন নরেনের সঙ্গে বা নরেনের দিকে তাকিয়ে। সেই নরেনের সাথে তিনি কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। অন্যদের সাথে বলছেন—তাঁর সাথে বলছেন না। স্বামীজী আসেন, চুপ করে বসে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর চলে যান। দিনের পর দিন এরকম ঘটে যাচ্ছে। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : তুই যে আমার কাছে আসিস, কেন আসিস? আমি তো তোর সঙ্গে কথাও বলি না। স্বামীজী বলছেন ; আমি কি আপনার কথা শুনতে আসি? আপনাকে ভালবাসি, তাই আসি। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন : তার জন্য ভাববেন না যে, আপনি যা বলবেন তা-ই আমি মেনে নেব! ঠাকুর তখন খুব খুশি, বলছেন : তোকে আমি পরীক্ষা করছিলাম। তোর মতো আধারই এতটা সহ্য করতে পারে। অন্য কেউ হলে কবে চলে যেত। —এই হচ্ছে অহৈতুকী ভালবাসা। মতপার্থক্য আছে, অন্যান্য অমিল আছে, তবুও ভালবাসা ঠিক আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি স্বামীজীর ভালবাসা শুদ্ধ ভালবাসা। কোন কামনা নেই তাতে, স্বার্থগন্ধ নেই—কোনরকম মলিনতা নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন শরীর ত্যাগ করলেন, প্রতিদিন রাত্রে স্বামীজী কাঁদতেন—গোপনে। ভোরবেলা দেখা যেত চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে। এত ভালবাসা।

সুরদাস বলছেন : ‘সুরদাস মন উল্লাস রামচন্দ্রকে চরণ আশ যুগ যুগ হো ম্যয় দাস গাওয়ত নাম রাম রাম রাম’—আমি তোমার জন্মজন্মান্তরের দাস। চিরকাল আমি এই রামনাম করে যাব। তোমার চরণের আশাতে আমি বসে আছি। তোমার চরণ একদিন আমি লাভ করব, এই চিন্তাতেই আমার মন আনন্দে ভরে আছে। তুলসীদাস বলছেন :৫৩ ‘চহৌ ন সুগতি’—মৃত্যুর পরে ভাল গতি হবে আমার, স্বর্গে যাব, এ আমি চাই না। ‘সুমতি’—অনেক বিদ্যাবুদ্ধি হবে আমার, অনেক পাণ্ডিত্য হবে তাও চাই না। ‘সম্পত্তি কচ্ছু রিধি সিধি বিপুল বড়াই’—সম্পত্তি হবে, যোগবিভূতি লাভ করব কিংবা খুব মানসম্মান হবে—এও আমি চাই না। আমি শুধু চাই ‘হেতু রহিত অনুরাগ রামপদ বঢ়ো অনুদিন অধিকাই’—রামের পাদপদ্মে আমার যেন অহৈতুকী অনুরাগ হয়, আর সেই অনুরাগ যেন দিন দিন বাড়তে থাকে। নারদীয় ভক্তিসূত্রে বলছে :৫৪ ভক্তের একমাত্র কাম্য-বস্তু, ভক্তি, শুদ্ধা ভক্তি। ‘যৎ প্রাপ্য ন কিঞ্চিৎ বাঞ্ছতি’—সেই ভক্তি পেলে সে আর কিছুই চায় না। ‘আমি যেন ভালবাসতে পারি তোমাকে’—এই তার একমাত্র প্রার্থনা।

ঠাকুর বলছেন : আমি মা’র কাছে একমাত্র ভক্তি চেয়েছিলাম। মা’র পাদপদ্মে ফুল দিয়ে হাত জোড় করে বলেছিলাম, মা, এই লও তোমার অজ্ঞান, এই লও তোমার জ্ঞান, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। (১-১৮-৪) বলা হয় যে, মুক্তির থেকেও ভক্তি দুর্লভ। শ্রীশ্রীমা বলছেন : মুক্তি তো প্রতিক্ষণেই দেওয়া যায়, কিন্তু ভক্তি ভগবান সহজে দিতে চান না। ঠাকুরও বলতেন সেই কথা। ঠাকুর একটা গান গাইতেন :

আমি মুক্তি দিতে কাতর নই,

শুদ্ধা ভক্তি দিতে কাতর হই (গো)।

আমার ভক্তি যেবা পায়, তারে কেবা পায়,

সে যে সেবা পায়, হয়ে ত্রিলোকজয়ী ॥ (২-৫-১)

ভগবান বলছেন : আমি মুক্তি দিই, কিন্তু শুদ্ধা ভক্তি দিতে চাই না—সেখানে আমি একটু কৃপণ। যে সত্যি সত্যি আমার প্রতি ভক্তি পেয়েছে, শুদ্ধা ভক্তি পেয়ে গেছে—সে ধন্য। তাকে তখন আর কে পায়? সে তখন ত্রিলোকজয়ী। সমস্ত ত্রিভুবনের সে যেন রাজা। আমি নিজে তখন তার সেবা করি।

শুন চন্দ্রাবলী ভক্তির কথা কই,

মুক্তি মিলে কভু ভক্তি মিলে কই।

ভক্তির কারণে পাতাল ভবনে,

বলির দ্বারে আমি দ্বারী হয়ে রই॥ (ঐ)

—মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু ভক্তি তার চেয়েও দুর্লভ—পাওয়া যায় না সহজে। এই ‘ভক্তির কারণে’ আমি ‘বলির দ্বারে’ দ্বারী হয়ে আছি। ভাগবতে আছে :৫৫ ‘যন্নোহসুরাণামসি দুর্গপালঃ’—ভক্তদের জন্য তুমি অসুরদের দুর্গরক্ষা করছ।

শুদ্ধা ভক্তি এক আছে বৃন্দাবনে,

গোপ গোপী বিনে অন্য নাহি জানে।

ভক্তির কারণে নন্দের ভবনে,

পিতা জ্ঞানে নন্দের বাধা মাথায় বই। (ঐ)

—শুদ্ধা ভক্তি কি জিনিস তা একমাত্র বৃন্দাবনের গোপ-গোপীরাই জানে, তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি এই ভক্তির আকর্ষণে নন্দের ঘরে জন্মেছিলাম। পিতা বলে তাঁকে স্বীকার করে নিয়ে আমি তাঁর কত সেবা করেছি—যেহেতু তিনি ভক্ত ছিলেন তাই। গীতাতে ভগবান বলছেন : ৫৬ ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহম্‌’—ভক্তের ‘যোগ’ এবং ‘ক্ষেম’ আমি বহন করি। যা তার নেই, যোগ করে দিই, আর যা আছে, তাকে রক্ষা করি। ‘ভক্তের বোঝা ভগবানে বয়’। চিরকাল একথা সত্য। রামপ্রসাদ বেড়া বাঁধছেন, মা এসে তাঁকে দড়ি যুগিয়ে দিচ্ছেন। রামপ্রসাদ নিজেই গাইছেন : ‘যেই ধ্যানে একমনে, সেই পাবে মা তোমায় তারা। তখন একবার এসে কন্যারূপে, রামপ্রসাদের বেঁধো বেড়া।।’ তুমি একবার এসে রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিয়ে যেও, যদি আমি একমনে তোমাকে চাই। শুদ্ধা ভক্তি যেখানে সেখানে তিনি ধরা দেন।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, ঠাকুরের ‘কল্পতরু’ হওয়ার ঘটনা। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে ১ জানুয়ারি ঠাকুর ‘কল্পতরু’ হয়েছিলেন। কাশীপুর উদ্যানবাটী। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই শেষ দিনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছেন। নিচে অন্যান্য ভক্তেরা আছেন, গিরিশ ঘোষও আছেন। গিরিশকে দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : গিরিশ, তুমি যে আমার সম্বন্ধে এত বলে বেড়াচ্ছ, কি দেখেছ তুমি আমার সম্বন্ধে? গিরিশ ঘোষ তখন হাতজোড় করে বলছেন : প্রভু, ব্যাস-বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর কথা কি বলব? এই শোনামাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হলেন, বললেন : তোমাদের চৈতন্য হোক। সঙ্গে সঙ্গে কারও ইষ্টদর্শন হল, কেউ হাসতে লাগল, কেউ কাঁদতে লাগল, কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল: কে কোথায় আছিস, আয়—আজ প্রভু কল্পতরু হয়েছেন। যেটার কথা বিশেষভাবে বলতে চাইছি সেটা হচ্ছে : নিচে যখন এসব হচ্ছে, শ্রীরামকৃষ্ণের দুই সেবক লাটু মহারাজ আর শরৎ মহারাজ তখন শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে। শ্রীরামকৃষ্ণ নিচে নেমেছেন, এই অবসরে তাঁরা তাঁর বিছানা নিয়ে রোদে দিচ্ছেন, ঝেড়েঝুড়ে বিছানাটাকে পেতে দিচ্ছেন। তাঁরা শুনছেন নিচে একটা কিছু কাণ্ড হচ্ছে, কিন্তু গেলেন না তাঁরা। সবাই বলল : কেন গেলে না? বঞ্চিত হলে! শরৎ মহারাজ বললেন : আমরা যে তাঁর বিছানাপত্র রোদে দিচ্ছিলাম—কখন তিনি উঠে আসবেন, তাই তাড়াতাড়ি করছিলাম। তাছাড়া, পাবার ইচ্ছা তো মনে আসেনি—তিনি যে আমাদেরই ছিলেন! এই হচ্ছে শুদ্ধা ভক্তি। তিনি আমার আপনার জন। আমার যখন যা প্রয়োজন হবে তিনি নিজেই দেবেন। চাইতে হবে কেন? আমি তাঁর সেবা করে যাচ্ছি—কিছু চাচ্ছি না তাঁর কাছে। তিনি স্বেচ্ছায় যা দেবেন, যখন দেবেন—তাতেই আমি খুশি। আর যদি না দেন কিছু—তাতেও আমি খুশি। আমার কাজ আমি করে যাব। আমার কাজ তাঁকে ভালবাসা, তাঁর সেবা করা। শঙ্করাচার্য গীতার ভাষ্যে একজায়গায় বলছেন :* অনাসক্ত হয়ে কাজ করা মানে ঈশ্বরের জন্য কাজ করা—ঈশ্বরের অর্চনা করছি, এই ভাব নিয়ে কাজ করে যাওয়া। আমি ঈশ্বরকে খুশি করব বলেও কাজ করছি না। তিনি খুশি হতে পারেন, নাও হতে পারেন। আমি কাজটা তাঁর উদ্দেশে করছি—এটুকু শুধু বলতে পারি। তিনি তাতে খুশি হবেন কি হবেন না তা-ও আমি জানি না। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। মহাপুরুষ মহারাজ খুব অসুস্থ তখন। খাওয়া-দাওয়ার খুব নিয়মকানুন! রোগীর ঝোল খান। একদিন বলে বসলেন : আজকে ঠাকুরকে যা যা নিবেদন করা হয়েছে সব নিয়ে এস। সবাই প্রমাদ গণলেন! একজন সেবক (স্বামী গঙ্গেশানন্দ)—তিনি এগিয়ে এলেন, বললেন : দেখুন মহারাজ, আমার পাপ হোক আর যা-ই হোক, এ আমি কিছুতেই আপনাকে খেতে দেব না।—প্রকৃত সেবকের তো এরকমই হতে হয়। আমি সেবক আপনার, যাতে আপনার ভাল হয় তাই আমি করব। আপনি খুশি হবেন বলে কি আপনাকে এমন একটা জিনিস খেতে দেব, ডাক্তার যা নিষেধ করে দিয়েছেন, যা খেলে আপনার ব্যাধি বেড়ে যাবে? সে আমি কিছুতেই হতে দেব না। আপনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন, আমাকে অভিশাপ দিতে পারেন—তবুও আপনাকে এমন কিছু আমি করতে দেব না যাতে আপনার ক্ষতি হয়। এই হচ্ছে প্রকৃত ভালবাসা। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন : সত্যিকারের ভালবাসা কিরকম জান? ভালবাসার পাত্রকে বুঝতে না দেওয়া যে আমি তাকে ভালবাসছি। নিভৃতে, সকলের দৃষ্টির অন্তরালে, যে প্রিয়পাত্র তারও অজ্ঞাতসারে তাকে সেবা করা, ভালবাসা, তার মঙ্গল করা। সকলকে জানিয়ে, ঢাক পিটিয়ে নয়। ভালবাসা যত গোপনে রাখা যায়, ততই তার মাধুর্য বেশী হয়। স্বামীজী বলছেন : ‘দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।’ সর্বস্ব উজাড় করে দাও-বিনিময়ে কিছু চেও না। এই হচ্ছে ভালবাসা। ভগবানের জন্য ভক্ত তার সর্বস্ব দিয়ে দেয়, অকৃপণ হস্তে। কি দিল তার হিসাব করে না সে। সে শুধু দিতে জানে, নিতে জানে না। গাছ যেমন—দেয় শুধু। ভক্তও শুধু দিতে জানে। তার দেওয়ার কোন বিরাম নেই। যেন ভগবানের কত প্রয়োজন, সে না দিলে ভগবানের আর জুটবে না। কি পাচ্ছে, তার বিচার করছে না। হয়তো তিরস্কার পাচ্ছে, হয়তো কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে—তবুও দিয়ে যাচ্ছে সে। আমাদের দেশে গুরুসেবার কত আশ্চর্য আশ্চর্য গল্প আছে। গুরু নির্যাতন করছে, কত কঠিন পরীক্ষার মধ্যে শিষ্যকে ফেলছে—তবুও শিষ্য হাসিমুখে সব সহ্য করছে, তার গুরুসেবায় কোন ত্রুটি নেই, গাফিলতি নেই। স্বামীজী বলতেন : গুরুকে দ্বার মে কুত্তেকে মাফিক পঢ়ে রহো—কুকুরের মতো গুরুর কাছে পড়ে থাকো। কুকুরকে দয়া করে কোনদিন হয়তো খেতে দেওয়া হল, কোনদিন হয়তো লাথিই মারল কেউ—কুকুর পড়ে আছে। ভগবানকে ঐভাবে ভালবাসা। কোন প্রতিদান চাই না। কেন ভালবাসি জানি না। সব অবস্থায় একভাবে যে তাঁকে ভালবেসে যেতে পারে সে-ই প্রকৃত ভক্ত।

ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক

কতভাবে ভক্ত ভগবানের সঙ্গে খেলা করে। ভগবান ভক্তকে পরীক্ষা করেন আবার ভক্তও ভগবানকে পরীক্ষা করে। ভক্তও ভগবানকে যাচাই করে নেয়—দেখি তো ভগবান আছেন কিনা। দেখি তো তিনি এই প্রার্থনা শোনেন কিনা। আর ভগবান যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভক্তের প্রার্থনা পূরণ করতে! ভক্তের যত অসম্ভব আবদার তিনি পূরণ করছেন। কখনও কখনও অবশ্য এও মনে হয় যে, তিনি যেন ভক্তের প্রতি নির্দয়। ভক্তকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলে চুপ করে আছেন। ভক্তের হয়তো প্রাণ যায়—কিন্তু তিনি চুপটি করে মজা দেখছেন। কিন্তু ভক্ত তবুও ছাড়ে না ভগবানকে। যত দুঃখ দাও, যত কঠোর হও, আমি তোমায় ধরে আছি। আমার সম্পদে-বিপদে, শোকে-আনন্দে, পরাজয়-পতনে—সব অবস্থায় আমি তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। একটা গান আছে—ঠাকুরের প্রিয় গান সেটা। ভক্ত বলছে সেই গানে :

যদি বল ছাড় ছাড় আমি না ছাড়িব।

বাজন নূপুর হয়ে, মা তোর চরণে বাজিব॥

—তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে চাইতে পার, কিন্তু মা, আমি তোমাকে ছাড়ব না। চিরকাল আমি তোমার চরণে থাকব, তোমার পায়ের নূপুর হয়ে চিরকাল আমি বাজব। চিরকাল ভক্ত-ভগবানের এই লুকোচুরি খেলা চলছে। আর তাতে কত বৈচিত্র্য, কত মাধুর্য। সেই খেলায় হয়তো দুঃখ আছে—কিন্তু সেই দুঃখও মধুর হয়ে যায়। ভগবানকে নিয়ে ভক্ত কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। ভগবানকে পাচ্ছি না বলে কান্না আছে—কিন্তু সেই কান্নার পর হাসি আছে, যখন ভগবান আসেন। কান্না আছে বলেই হাসির মূল্য আছে। শুধু যদি হাসিই থাকত, তাহলে হাসির আর কোন মূল্য থাকত না। ঠাকুর তাই বলতেন যে, ভক্তিপথে কত বৈচিত্র্য—জ্ঞানপথ সেই তুলনায় একঘেয়ে। আবার বলছেন : রোশনচৌকি। রোশনচৌকি অর্থাৎ সানাই। দুটো সানাই একসাথে বাজছে। একটাতে শুধু পোঁ ধরে আছে—একটা সুর, একটানা, কোন বৈচিত্র্য নেই। আর একটাতে নানা সুরের বৈচিত্র্য, নানা রকমের রাগরাগিণী। ঠাকুর বলছেন : ঐ যে পোঁ ধরে আছে, সেটা যেন জ্ঞানপথ। আর যেটা থেকে নানারকম সুর শোনা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে ভক্তিপথ। আমাদের যে ভক্তিশাস্ত্র—এ একটা বিরাট সম্পদ। কত বিচিত্র কাহিনী, কত স্তোত্র, কত গান। ভক্ত যে কতভাবে ভগবানকে দেখছে, আর ভগবান যে কতভাবে ভক্তের সঙ্গে খেলা করছেন, তার কোন শেষ নেই যেন। ভক্তরা কতরূপে ভগবানকে চিন্তা করেছেন তার কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি। শিবের ধ্যান :

ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং

রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নং।

পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্ৰকৃত্তিং বসানং

বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রংত্রিনেত্রম্‌ ॥

—শিবের রূপ রজতগিরিসদৃশ—রুপোর পাহাড়ের মতো। চন্দ্র তাঁর ভূষণ। তাঁর চার হাতের এক হাতে রয়েছে পরশু অথাৎ কুঠার, এক হাতে মৃগ, এক হাতে তিনি বর দিচ্ছেন, আর এক হাতে অভয় দিচ্ছেন। সবসময় তিনি প্রসন্ন। ব্যাঘ্রচর্ম পরে পদ্মাসনে বসে আছেন। চারদিক থেকে দেবতারা তাঁর স্তব করছেন। বিশ্বের আদিতে তিনি রয়েছেন, তিনিই বিশ্বের মূল বা কারণ। সকলের সমস্ত ভয় তিনি দূর করে দেন। তাঁর ত্রিনেত্র, পঞ্চবদন।—এই হচ্ছে ভক্তের কল্পনায় শিবের রূপ।

আবার, রামচন্দ্রের সম্বন্ধে বলছেন তুলসীদাস : ‘নব কঞ্জলোচন’—চোখ দুটি কিরকম? যেন সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্ম। ‘কঞ্জমুখকর’—মুখ এবং হাতও সেই পদ্মের মতো। ‘কঞ্জপদ’-পা, তাও পদ্মের মতো। ‘কঞ্জারুণম্‌’–পদ্মের যে রং সেইরকম লাল রং তাঁর পায়ের তলার। তারপর বলছেন ‘কন্দর্প’ অগণিত অমিত ছবি নব নীল-নীরদ সুন্দরম্‌’—তাঁর ছবি কন্দর্পকে হার মানায়। আর দেহের রং—সে-ও নীল মেঘের মতো। শ্রীকৃষ্ণের বর্ণনা দিচ্ছেন গোবিন্দদাস। ভক্ত এঁরা। এগুলো শুধু কবিতা নয়—এইসব সাধককবির অন্তর্জীবনের প্রতিচ্ছবি। বলছেন :৫৭ ‘ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়’—শ্রীকৃষ্ণের যে লাবণ্য সমস্ত পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়েছে, সমস্ত পৃথিবী যেন তাঁর সেই অঙ্গকান্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে। ‘ঈষৎ হাসির তরঙ্গ-হিলোলে মদন মূরুছা যায়’—শ্রীকৃষ্ণের মুখে ঈষৎ হাসি, সেই হাসি এত সুন্দর যে মদন পর্যন্ত মূর্ছা যায়। এই যে ‘ঈষৎ হাসি’, এই হাসি আমরা ঠাকুরের ছবিতেও দেখতে পাই। সাধারণ হাসি নয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে beatific—স্বর্গীয়। স্বর্গীয় হাসি। ভগবানের যত ছবি ভক্তেরা কল্পনা করেছেন, তার মধ্যে এই হাসি দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণ লোকে সেই হাসি ধরতে পারে না, কিন্তু ভক্তের চোখে ধরা পড়ে।

এই যে মা-কালীর কল্পনা, এ একটা অদ্ভুত কল্পনা। ভগবান খুব মধুর এই ভাবতেই আমরা সাধারণত ভালবাসি। কিন্তু একমাত্র আমাদের দেশেই আমরা ভগবানকে ভয়ঙ্কর রূপেও পুজো করে থাকি। শিবের প্রলয় রূপ, মা কালীর রূপ—এ আমাদেরই কল্পনা। ভগবান মধুর, ভগবান সুন্দর। আবার সেই ভগবানই কঠোর, নিষ্ঠুর, প্রলয়ঙ্কর। ভগবানই সব হয়েছেন —দুটো শক্তি নয়, একটাই শক্তি। তাঁকে সেই রূপেও আমি ভালবাসছি। জগতে সৃষ্টি আছে ধ্বংস আছে, সুখ আছে দুঃখও আছে, হাসি আছে কান্নাও আছে। ভগবান যে রূপে আমার কাছে আসছেন সেই রূপেই তাঁকে আমি নিচ্ছি। স্বামীজী ‘মৃত্যুরূপা মাতা’ কবিতায় লিখছেন :৫৮ ‘সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে, কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।’ ভয়ঙ্করকে যে ভালবাসে, মৃত্যুকে যে ভালবাসে—তার কাছে মা আসেন। নিবেদিতার জীবনে দেখছি—বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তিনি বলছেন : ‘কালী, কালী, কালী’। প্রকৃতির ভয়ঙ্করীরূপ—সেই রূপের মধ্যে মাকে দেখছেন। তিনি ভয়ঙ্কর হয়েছেন, তিনিই আবার সুন্দর। তিনি গান তিনি ছন্দ, তিনি কবিতা তিনি ফুল, তিনি করুণা তিনি হাসি। কিন্তু তিনিই আবার কান্না। তিনি ব্যথা, তিনি মৃত্যু, তিনি ভীমা, তিনি ভয়ঙ্করী। কিন্তু তবুও তিনি মা—আমার আপনার জন। মা ক্রুদ্ধ হয়েছেন, মা আমাকে তিরস্কার করছেন—তবুও মা, আমারই মা, আমি তাঁকে ভালবাসি। সারদাদেবীর জীবনে দেখি, একটা বেরাল খুব উত্ত্যক্ত করছে তাঁকে, তিনি আর না পেরে ভয় দেখানোর জন্য লাঠি তুলেছেন—সেই বেরাল গিয়ে তাঁরই পায়ের কাছে লুকোচ্ছে। আমরাও ঐ বেরালের মতো। মা আমার কাছে ধ্বংসের রূপ ধরে এসেছেন—কিন্তু কী করতে পারি আমি? আমার তো তিনি ছাড়া কেউ নেই। আমি তাঁর পায়ে মাথা দিয়ে আছি। রামপ্রসাদ বর্ণনা করছেন মায়ের :

ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে, গলিত-চিকুর আসব-আবেশে

বামা রণে দ্রুতগতি চলে, দলে দানবদলে, ধরে করতলে গজ গরাসে

কালীর শরীরে রুধির শোভিছে, কালিন্দীর জলে কিংশুক ভাসে,

নীল কমল শ্রীমুখমণ্ডল, অর্ধচন্দ্র ভালে প্রকাশে॥

—ঢলে ঢলে আসছেন মা। এলোকেশী। তাঁর চুল এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন যেন একটা গলিত জিনিস। যুদ্ধে চলেছেন মা। দ্রুতগতিতে চলেছেন। দানব দমন করছেন আর হাত দিয়ে ধরে হাতির দেহ গিলছেন। যুদ্ধ করছেন, তাই সর্বাঙ্গে তাঁর রক্ত লেপে রয়েছে। মায়ের গায়ের রং কালো। তার উপরে এই লাল রক্ত। দেখে মনে হচ্ছে, যেন কালো জলে লাল পলাশফুল ভেসে রয়েছে। মার মুখ নীল পদ্মের মতো, আর কপালে তাঁর অর্ধচন্দ্র।—কী অদ্ভুত কল্পনা! মা এখানে ভীষণা—কিন্তু ভক্ত তবুও মুগ্ধ হয়ে আছেন, মুগ্ধ হয়ে তাঁর রূপ বর্ণনা করছেন।

ভক্ত কিন্তু সবসময় জানে যে মার হাতেই সব। মা তার সর্বশক্তিময়ী—ভক্তি-মুক্তি সবকিছুর চাবি মার হাতে। রামপ্রসাদ তাই বলছেন :

আয় মন বেড়াতে যাবি।

কালীকল্পতরুমূলে রে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি॥

—মন তো সবসময় ছটফট করছে। মনের স্বভাবই হচ্ছে বেড়াতে যাওয়া। রামপ্রসাদ মনকে বলছেন : ‘কালীকল্পতরুমূলে’ বেড়াতে চল্‌। কল্পতরুর নীচে বসে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। কালী হচ্ছেন সেই কল্পতরু। কালীরূপ কল্পতরুর নীচে ‘চারিফল’ পাওয়া যায়। চারিফল অর্থাৎ চতুর্বর্গ—ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। এর বাইরে মানুষের আর কিছু চাইবার থাকে না। কালীকে ডাকলে এ সবই পাওয়া যায়। আর একটা গানে রামপ্রসাদ বলছেন :

ডুব দে রে মন কালী বলে,

হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।

⋯ ⋯ ⋯

রতন মাণিক্য কত প’ড়ে আছে সেই জলে।

—‘কালী’ নাম করে হৃদয়ের মধ্যে ডুবে যাও। এই হৃদয় হচ্ছে রত্নাকর, সমুদ্র—কত রত্ন আছে সেখানে। জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, পবিত্রতা—এগুলি হচ্ছে সেই রত্ন। সেই সমুদ্রে ডুব দাও মার নাম করে। মার যদি কৃপা হয়, তাহলে সব তিনি দেবেন। তিনি ‘ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু’—ভক্তের সমস্ত বাঞ্ছা তিনি পূরণ করে দেন। রামপ্রসাদ বলছেন :

মন কেন মায়ের চরণছাড়া।

ও মন ভাব শক্তি, পাবে মুক্তি, বাঁধ দিয়া ভক্তিদড়া ॥

নয়ন থাকতে না দেখলে মন, কেমন তোমার কপাল পোড়া।

মা ভক্তে ছলিতে তনয়া-রূপেতে, বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া ॥

—মন, তুমি কেন মায়ের চরণ ভুলে রয়েছ! মার কথা চিন্তা কর তুমি—মাকে ভাবলেই মুক্তি। মায়ের কত কৃপা দেখ তো! মা নিজে এসে মেয়ের রূপ ধরে বেড়া বেঁধে দিয়ে গেলেন। কিন্তু এমনই কপাল তোমার, তুমি তাঁকে চিনতে পারলে না!

রামপ্রসাদের আর একটা গানে দেখছি, মা আর ভীষণা নন, ভয়ঙ্করী নন—একেবারে ঘরের মা। মা আর ছেলের মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। অভিমান করছেন রামপ্রসাদ, বলছেন, তোমাকে আমি আর ‘মা’ বলে ডাকব না।

মা মা বলে আর ডাক্‌ব না।

ও মা, দিয়েছ দিতেছ কতই যন্ত্রণা ॥

ছিলেম গৃহবাসী, বানালে সন্ন্যাসী,

আর কি ক্ষমতা রাখ এলোকেশী,

ঘরে ঘরে যাব, ভিক্ষা মেগে খাব,

মা বলে আর কোলে যাব না ॥

ডাকি বারে বারে মা মা বলিয়ে,

মা কি রয়েছ চক্ষুকর্ণ খেয়ে,

মা বিদ্যমানে, এ দুঃখ সন্তানে,

মা ম’লে কি আর ছেলে বাঁচে না ॥

এবার দুটো কাহিনী উল্লেখ করছি—রূপ আর সনাতনের। এঁরা দু-ভাই। চৈতন্যদেবের লীলাসহচর। গৌড়ের রাজা হুসেন শাহের কাছে তাঁরা কাজ করতেন। হুসেন শাহের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। দুজনেই ভক্ত—কিন্তু সরকারী কাজ করেন, বাইরে থেকে দেখে লোকে মনে করে ঘোর বিষয়ী। একদিন ভোরবেলায় রূপ চলেছেন হুসেন শাহের দরবারে—ডাক পড়েছে, যাচ্ছেন। কিন্তু সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি, রাস্তায় কেউ বেরোয়নি। শুধু তিনি বেরিয়েছেন। এক বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তায় জল জমে গেছে, জলের ভিতর দিয়ে পালকিবাহকেরা হেঁটে যাচ্ছে—ছপ্‌ছপ্‌ শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দ শুনে সেই বাড়ির যে কর্তা সে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করছে—আচ্ছা, এত ভোরে এই বৃষ্টির মধ্যে কে যাচ্ছে? তার স্ত্রী উত্তর দিচ্ছে : হয় কুকুর, বা চোর, আর নাহলে ‘নফর’—ক্রীতদাস। তা না হলে এই দুর্যোগের মধ্যে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়? এই কথা শুনে রূপের মনে ধিক্কার এল, তিনি সংসার ত্যাগ করলেন। আর সনাতনের জীবনের একটা ঘটনা—তিনি তখন বৃন্দাবনে আছেন, রোজ ভিক্ষা করতে বের হন। সেখানে চৌবে বলে এক ব্রাহ্মণের বিধবা পত্নী আছেন—তাঁর বাড়িতে গিয়ে রোজ ভিক্ষে করেন। সেই বিধবা পত্নীর মদনগোপাল বিগ্রহ আছে। বিগ্রহ দেখে সনাতন এত ভালবেসে ফেলেছেন যে, তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে ঐ মদনগোপালকে তিনি তাঁর কাছে রেখে দেবেন, তাঁর সেবা করবেন। কিন্তু বলতে পারছেন না। তিনি সবসময় দেখতে পাচ্ছেন যে, মদনগোপালও তাঁর দিকে চেয়ে আছে, তাঁকে যেন ডাকছে, আহ্বান করছে। তার কথা তিনি ভুলতে পারেন না। মদনগোপালের টানে রোজ তিনি সেই বাড়িতে যান। ঐ চৌবে-গৃহিণীর একটি ছেলে আছে—সদন। সনাতন লক্ষ্য করেছেন যে, চৌবে-গৃহিণী মদনগোপালকে সেই ছেলের মতো দেখেন। বিগ্রহরূপে দেখেন না, সন্তানরূপে দেখেন। যেন দুটি ছেলে—মদন আর সদন। সদনের বড় ভাই মদন। সদনকে যা খেতে দেন, মদনকেও তাই খেতে দেন। একদিন সনাতন চৌবে-গিন্নীকে বললেন : মা, এই যে তুমি মদনগোপালকে মানুষরূপে দেখছ, এ ঠিক হচ্ছে না। তাঁর সেবার ব্যাঘাত হচ্ছে। ভাল করে তাঁর সেবার ব্যবস্থা করা উচিত। তখন চৌবে-গৃহিণী বললেন : তুমি ঠিকই বলেছ, আমি বুঝতে পারিনি। এর পর থেকে আমি ঠিকমতো সেবা করব, বিগ্রহের সেবা যেমন হয়। তাই করছেন তিনি—মদনগোপালকে আর সদনের মতো দেখেন না, তাঁর জন্য এখন বিশেষ ব্যবস্থা। এদিকে রাত্রিবেলায় মদনগোপাল চৌবে-গৃহিণীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ; এ কি করছ তুমি? আমি যে কিছুই খেতে পারছি না। তুমি মোটেই আমার যত্ন করছ না। আমাকে দেখছ না। এরকম করে তুমি আমায় রেখেছ কেন? আগে যেমন দেখতে—পুত্ররূপে, মদন আর সদন দুই ভাই আমরা—সেইভাবে দেখ আমাকে। তখন চৌবে-গৃহিণী আবার সেই আগের মতো সেবা করতে লাগলেন—মানুষ হিসেবে। সনাতন তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন, আর প্রতিবাদ করলেন না। কিন্তু তাঁর বড় সাধ যে নিজের কাছে রেখে মদনগোপালকে সেবা করেন। তারপরে একদিন মদনগোপাল নিজেই ঐ চৌবে-গৃহিণীকে বললেন, আমি ঐ সাধুর কাছে গিয়ে থাকব। সনাতন খুশি হয়েছেন, তবুও বললেন : আমি তোমাকে কি খেতে দেব? চৌবে-গৃহিণী কত ভাল জিনিস তোমাকে খাওয়ায়, আমি তো আর সেসব দিতে পারব না। মদনগোপাল বলছেন : তুমি যা খাও, তাই আমাকে খেতে দিও। অর্থাৎ, রোজ তো তুমি আটার পিণ্ড খাও, সেটা আগুনে পুড়িয়ে আমাকে খেতে দিও। সেরকমই ব্যবস্থা হল। রোজ রোজ মদনগোপাল ঐ আটার পিণ্ড খান, নুনও জোটে না, একঘেয়ে। শেষকালে আর পেরে উঠলেন না। একদিন দেখা দিয়ে বললেন : দেখ, আর পেরে উঠছি না আমি—রোজ রোজ এই আটার পিণ্ড! মাঝে মাঝে একটু ভালমন্দ কিছু দিও। সনাতন বললেন : আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম। আমি আর ভালমন্দ কোথায় পাব—তুমি নিজেই ব্যবস্থা করে নাও। তা-ই করলেন মদনগোপাল। এক সওদাগরের জাহাজ সেখানে আটকে গেল। সওদাগর এসে সনাতনকে বললেন : আমি বড় বিপদে পড়েছি, আমাকে উদ্ধার করুন। এই যে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছি, এতে যে লাভ হবে, এই টাকা আমি সম্পূর্ণ মদনগোপালের সেবায় দেব। সওদাগরের জাহাজ উদ্ধার হল। সনাতনকে কথামতো তিনি সেই টাকা দিলেন। সেই টাকা দিয়ে মদনগোপালের মন্দির হল, সেবার ব্যবস্থা হল, ভালমন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা হল—সব হল। কিন্তু ঐ আটার পিণ্ড—ওর মায়া ঠাকুর ছাড়তে পারেননি। এখনও সেই আটার পিণ্ড আগুনে পুড়িয়ে মদনগোপালকে দেওয়া হয়। —এই হচ্ছে সনাতনের কাহিনী। কি অদ্ভুত কাহিনী! ঠাকুর তাই বলছেন : ভক্তের ভগবান, —ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ⋯। (১-৭-৪) ভক্ত ভগবানের সঙ্গে বিলাস করে—হাসে-কাঁদে, নাচে গায়।(ঐ) ভক্ত-ভগবানের লীলায় কত বৈচিত্র্য—নানা রং, নানা সুর তাতে। একঘেয়েমি নেই।

ভক্তের দৃষ্টিতে জগৎ ও জীবন

ভক্তের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে এই জগৎকে বর্জন করে না। ঠাকুর বলছেন : উত্তম ভক্ত নিত্য-লীলা দুই-ই নেয়। জ্ঞানী শুধু নিত্য নেয়। তার কাছে এই জগৎ স্বপ্নবৎ—সত্য একমাত্র ব্রহ্ম। কিন্তু ভক্ত, সে লীলা স্বীকার করে, জগৎকে স্বীকার করে। ভগবানই সবকিছু হয়েছেন, সবকিছু করছেন। সবকিছুর মধ্যে ভগবান আছেন। ভক্ত তার মন-প্রাণ সবকিছু দিয়ে সেই ভগবানকে ধরার চেষ্টা করছে। তার সবকিছুর মধ্যে ভগবান। এমন একটা মনের ভাব নেই, এমন একটা আবেগ নেই, এমন একটা চিন্তা নেই তার, যা ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে নয়। তার সমস্ত জীবনটা, জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ঈশ্বর-কেন্দ্রিক। জীবনটা যেন তার একটা নাটক আর সেই নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন ঈশ্বর স্বয়ং। তার কোনটা বৃথা নয়। তার সবকিছু ঈশ্বরকে নিয়ে, ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে সে থাকতে পারে না। ভাগবতে আছে যে, ভক্ত কি চায়? ভক্ত বলে : আমার জিভ যেন শুধু তোমার কথাই বলে। ‘বাণী গুণানুকথনে’—আমার মুখ দিয়ে যখন যে শব্দ বেরোবে সে যেন তোমার সম্বন্ধে হয়। আমার কণ্ঠ সর্বদা যেন তোমার গুণকীর্তন করে। মুণ্ডকোপনিষদে যেমন বলা হয়েছে : ‘অন্যাবাচো বিমুঞ্চথ’—ব্রহ্মতত্ত্ব আলোচনা কর সবসময়, তাছাড়া অন্য সব প্রসঙ্গ পরিত্যাগ কর। ভক্তও তেমনি বলে : তোমার প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ যেন আমি না করি। ‘শ্রবণৌ কথায়াম্‌’—এই কান যেন শুধু তোমার কথাই শোনে। তুলসীদাস যেমন বলছেন, যে-কান অেমার কথা শোনে না, সেই কান সাপের গর্ত ছাড়া আর কিছু নয়। ‘হস্তৌ চ কর্মসু’—এই হাত দিয়ে আমি যেন সর্বদা তোমার সেবা করতে পারি। ‘মনস্তব পাদয়োর্নঃ স্মৃত্যাম’—আমার মন পড়ে থাকবে তোমার পাদপদ্মের স্মৃতিতে। ‘শিরস্তব নিবাসজগৎপ্রণামে’—আমার এই মাথা সবসময় তোমার নিবাস যে জগৎ তাকে প্রণাম করবে। ‘দৃষ্টিঃ সতাং দর্শনেহস্তু ভবত্তনূনাম’—চোখ দিয়ে যেন আমি সবসময় সাধুদের বা ভক্তদের দেখি—যাঁরা তোমার তনুস্বরূপ, যাঁদের মধ্যে তোমার বিশেষ প্রকাশ।৫৯ আমার দেহ-মন-প্রাণ-বুদ্ধি, আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে আমি তোমার লীলা আস্বাদ করব। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন,ভক্ত ভগবানের সঙ্গে বিলাস করে। মুক্তিও সে চায় না। ‘মুক্তি নিরাদর ভগতি লোভানে।৬০ মুক্তি চাই না আমি, ভক্তি চাই। চিনি হতে চাই না, চিনি খেতে চাই। ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে চাই না। আমি ঈশ্বরের থেকে আলাদা হয়ে তাঁর সঙ্গে খেলা করব, তাঁর লীলা দেখব। জ্ঞানী বলে যে, তার যেন পুনর্জন্ম না হয়। কারণ, এই সংসার তার কাছে মিথ্যা। ভক্ত কিন্তু বারবার ফিরে আসতে চায়। বারবার এসে সে ভগবানের লীলা আস্বাদ করতে চায়। ‘কথামৃতে’ই ঠাকুর নিকষার গল্প বলছেন। রাবণের মা নিকষা। রাম যখন লঙ্কায় প্রবেশ করলেন, দেখলেন, নিকষা পালাচ্ছে। লক্ষ্মণ রামকে বলছেন : দেখেছ, নিকষার সব ছেলে যুদ্ধে নিহত হয়েছে—তবুও তার জীবনের প্রতি কি মায়া। নিকষা বলছেন : না রাম, প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছি না আমি। তোমার লীলা দেখে আমার সাধ মেটেনি। যদি বেঁচে থাকি, তোমার আরও কত লীলা দেখতে পাব। সেইজন্য পালাচ্ছি।—জীবনের প্রতি মায়া তাঁর ঠিকই, কিন্তু এ মায়া রামচন্দ্রের জন্য, রামচন্দ্রের লীলা দেখবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলছেন : ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ ভক্তের কাছে এই জগৎ সুন্দর। সৌন্দর্যরূপ ঈশ্বরের প্রকাশ সবকিছুর মধ্যে, তাই সবকিছু সুন্দর। সংসার ‘মজার কুটি’ তার কাছে। জগৎ থেকে পালিয়ে যায় না সে—জগৎকে নিবিড়ভাবে ভালবাসে। কারণ, জগৎ তো সে দেখছে না—সে দেখছে ঈশ্বরকে, তার প্রিয়তমকে। সর্বজীবে তিনি, সর্বভূতে তিনি। যা কিছু দেখে সে—তাঁর বিগ্রহ। মন্দিরে রয়েছে তাঁর বিগ্রহ, চোখ বন্ধ করে অন্তরে দেখছি তাঁর বিগ্রহ—আবার চোখ খুলেও দেখছি সেই বিগ্রহ। তাঁর সচল বিগ্রহ আমার চারপাশে। নানা নামে, নানা রূপে। কাউকে বর্জন করতে পারি না, কাউকে ঘৃণা করতে পারি না। সবাইকে ভালবাসি। ভাল না বেসে পারি না। এই হচ্ছে ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা তুকারামের গল্প জানি। যোড়শ শতাব্দীর লোক। শ্রীকৃষ্ণের খুব একজন বড় ভক্ত। তুকারামের বাবার অবস্থা ভাল ছিল। চাষবাস করতেন। কিন্তু তুকারামের দুর্বুদ্ধি হল ব্যবসা করতে গেলেন। ব্যবসা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হলেন। তাঁর দুই স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রী একেবারে অনশনে মারা গেলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী বেঁচে ছিলেন—কিন্তু তিনি এমন গঞ্জনা দিতেন স্বামীকে যে, তুকারাম্‌ শেষ পর্যন্ত গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। তারপরে তিনি ঈশ্বরের নামগান করে বেড়াতেন, আর লোকের সেবা করতেন। নিজে খেতে পান আর না পান, কিছু অন্ন যদি সংগ্রহ করতে পারতেন তাহলে কোন বুভুক্ষু লোক হয়তো আছে, তাকে দিয়ে দিতেন। যা তাঁর সামর্থ্য সেই অনুযায়ী লোকের সেবা করতেন আর মুখে বিষ্ণুনাম করতেন। কিন্তু সব যুগেই সম্ভবত কিছু লোক থাকে, যাদের ধারণা, ঈশ্বরের চিন্তা যে করছে সে কেন আবার লোকের সেবা করবে? শুধু ঈশ্বর নিয়ে থাক না কেন? জগৎ অনিত্য, জগতের যত জীব, তারাও অনিত্য—তাদের দিকে কেন সে মন দেবে? তুকারামকেও অনেকে নিন্দে করত। একটা আধুনিক বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি—তারা কি বলত আর তুকারাম তাদের কি উত্তর দিতেন।৬১ নিন্দুকদের প্রশ্ন :

ওরে তুকা,

তুই নাকি রে কৃষ্ণপ্রেমে আত্মহারা,

কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু নাই তোর?

কৃষ্ণই ধ্যান, কৃষ্ণই জ্ঞান,

—তবে কেন এমন মোহডোর?

জীবপ্রেমের মায়ায় কেন এমন বদ্ধ হলি?

⋯ ⋯ ⋯

যে দুটি হাত প্রভুর যুগল ভৃত্য

মানুষ সেবার তুচ্ছ ব্রতে

সে হাত রত নিত্য?

—তুকারাম, তুই মুখে বলছিস যে তুই শ্রীকৃষ্ণের পায়ে আত্মসমর্পণ করেছিস—কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু জানিস না। আর এদিকে তুই করছিস কি? মানুষের পিছনে তো ঘুরে বেড়াচ্ছিস। ছি ছি ছি, কী মোহ তোর!

তুকারাম উত্তর দিচ্ছেন :

⋯আমি বধূ,—

কৃষ্ণ আমার বঁধু—

বঁধুর তরেই বুকে আমার

জমাট বাঁধা মধু।

শ্বশুরবাড়ির চাকায় আমি

বাঁধা আছি বটে,

শাউড়ি দেওর ননদ জায়ের

সেবায় সময় কাটে,—

ওদের ভালোবাসেন বঁধু

তাই তো আমি বাসি,

নইলে ওরা কেউ নয় মোর,

—একান্ত তাঁর দাসী ॥

—শ্রীকৃষ্ণ আমার স্বামী, আমি তাঁর বধূ। শ্রীকৃষ্ণের জন্য আমার হৃদয়ে ভালবাসা জমাট হয়ে আছে। আমি গৃহবধূ, তাই আমার সমস্ত সময় কাটে এই শাশুড়ি, দেওর, ননদ, জায়ের সেবাতে। আমি ওদের সেবা করি এই কারণে যে, শ্রীকৃষ্ণ ওদের ভালবাসেন। এই জগৎ শ্রীকৃষ্ণের সংসার। যত নরনারী, প্রাণী—তাঁর আত্মীয়, প্রিয়জন। শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়জন—তাই আমারও প্রিয়জন। তাদের ভিতর দিয়ে আমি তাঁরই সেবা করছি ; শ্রীকৃষ্ণ খুশি হবেন, এইজন্য আমি এদের সেবা করি। কারণ, আমি যে একান্তভাবে তাঁর দাসী ছাড়া আর কিছুই নই। তাঁর যাতে সুখ, তাতেই আমার সুখ।ভক্ত এইভাবে জগৎকে দেখে।

প্রথম প্রথম রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা যখন উত্তরাখণ্ডে রোগীদের সেবা করতেন, অন্য সাধুরা নিন্দে করত। তাঁদের নাম হয়ে গেছিল ‘ভাঙ্গী সাধু’। ভাঙ্গী অথাৎ মেথর। তাঁরা দেখেছেন, এই সাধুরা রোগীদের মলমূত্র পর্যন্ত পরিষ্কার করে। মেথরের কাজ তো সেটা—সাধু হয়েও মেথরের কাজ করছে, তাই ‘ভাঙ্গী সাধু’। কিন্তু স্বামীজী বলছেন : শিবজ্ঞানে জীবসেবা। জীব ‘জীব’ নয়—শিব। নর-নারায়ণ। ঠাকুর বলে গেছিলেন এই কথা—স্বামীজী সেই কথা জগতে প্রচার করলেন। বললেন :

বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?

জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

নতুন কথা নয়। একথা আমাদের দেশে ছিল—‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’, ‘ব্রহ্মময়ং জগৎ’, ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’। ঠাকুর-স্বামীজী নতুন করে সেই কথা আমাদের শোনালেন। কাজেই, ভক্তি মানে জগৎবিমুখতা নয়—জগৎকে ঈশ্বরবুদ্ধিতে গ্রহণ। আর, ঈশ্বরবুদ্ধিতে যে জগৎকে দেখে, জগতের কল্যাণ সে-ই করতে পারে। কারণ, তার বুদ্ধি নির্মল, চিন্তা স্বচ্ছ। সে যা কিছু করে তার দ্বারাই অন্যের কল্যাণ হয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলছেন : এই যে লোকে বলে, দেশের কল্যাণ করব—এটা ইংরেজি শিক্ষার বদহজম। নিজের চরিত্র তৈরী না হলে কেউ দেশের কল্যাণ করতে পারে না। ঈশ্বরের দিকে যে মন দিয়েছে, তার চিন্তা ও কাজ অপরের কল্যাণের কারণ হয়। প্রকৃত ভক্ত—সে যদি কাউকে কটু কথাও বলে, তাতেও অপরের কল্যাণ হয়। তার দ্বারা কখনও অন্যের অকল্যাণ হয় না। ভাগবতে একটা শ্লোক আছে যে, গাছের গোড়ায় জল দিলে যেমন সমস্ত গাছটা, তার কাণ্ড, শাখা ইত্যাদি সবই পরিপুষ্ট হয়, তেমনি ঈশ্বরকে আরাধনা করলে সমস্ত জীবের সেবা করা হয়।* ঈশ্বরের চিন্তা করলে জগতের কল্যাণ হয়! সাধুসন্ত, মহাপুরুষ—তাঁদের সামান্য কথা, সামান্য দৃষ্টি, সামান্য হাসি তাতেও লোকের কত কল্যাণ হয়। কত মানুষের জীবন রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাঁরা হয়তো লোকালয় থেকে দূরে আছেন, কিন্তু তাঁদের চিন্তার দ্বারাই মানুষের কল্যাণ হয়। অনেকের ধারণা, এইসব সাধু মহাপুরুষ—এরা সমাজের বোঝা। সমাজকে এরা কি দিচ্ছে? চুপচাপ বসে আছে, অন্যের উপার্জিত অর্থে জীবনধারণ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এঁরাই সমাজের গৌরব। যে কোন দেশে, যে কোন সমাজে, যে কোন যুগে—এঁরাই প্রকৃত গৌরব। মানুষ হয়তো এঁদের চিনতে পারে না, অবহেলা করে—কিন্তু, প্রেম, পবিত্রতা, বিবেক, বৈরাগ্য—প্রভৃতি যে গুণগুলির জন্য মানুষ ‘মানুষ’, এঁরাই সেগুলোকে যত্ন করে ধরে রেখে দেন। সকলের অগোচরে, যুগ যুগ ধরে সেই রত্নগুলি তাঁরা রক্ষা করেন। মানবসভ্যতা টিকে আছে এঁদেরই জন্য। মানবসমাজ চিরঋণী এঁদের কাছে। এঁরা বোঝা নন—পরম সম্পদ। প্রকৃত ভক্ত সকলের প্রতি তার কর্তব্য করে যায়, সকলকে ভালবাসে কিন্তু কারও কাছে সে কিছু প্রত্যাশা করে না। সর্বতোভাবে সে ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে আছে। তার সুখের মধ্যে তিনি, তার দুঃখের মধ্যেও তিনি। সুখ হলে সে বলছে : প্রভু, আমি কি এমন ভাগ্য করেছি, যে তুমি আমাকে এতটা কৃপা করেছ, আমার তো এই যোগ্যতা নেই। সুখের সময় সে এই কথা বলে। ভুলে যায় না তাঁকে। আবার যখন দুঃখ আসে.তখন বলে : প্রভু, আমি জানি না কেন তুমি এই দুঃখ দিয়েছ, তবে তুমি যখন দিয়েছ প্রভু, এ আমার মঙ্গলের জন্যই নিশ্চয় দিয়েছ। এ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। আমার একমাত্র প্রার্থনা, তোমাকে যেন না ভুলি আর সুখ-দুঃখ দুটোই যেন হাসিমুখে গ্রহণ করতে পারি। ভক্ত ভগবানকে ‘দয়াময়’ বলে। এইজন্যই ‘দয়াময়’ বলে যে, সুখ-দুঃখ দুটোকেই সমানভাবে দেখার শক্তি তিনি তাকে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন ; ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ জীবনে আঘাত আসবেই, বেদনা আসবেই, আমি তাঁর কাছে বলব যে, তুমি আমাকে এগুলো দিও না। আমি বলব : আমি যেন এগুলো মাথা পেতে নিতে পারি। এই আঘাত যেন সহ্য করতে পারি আমি। আর এই আঘাত তো তুমিই আমাকে দিচ্ছ প্রভু! তুমি ছাড়া আর কেউ কি কিছু দিতে পারে? সুখ-দুঃখ দুই-ই আমার কাছে সমান। তুমি দিচ্ছ, তাই দুঃখও মধুর আমার কাছে সুখ যতটা মধুর, ঠিক ততটাই। দু-হাত ভরে নেব সেই দুঃখ। ‘কথামৃতে’ ঠাকুর সেই ব্যাঙের গল্প বলছেন। রামচন্দ্র দেখতে পেয়ে ব্যাঙকে আঘাত করে ফেলেছেন। ব্যাঙ-এর গা থেকে রক্ত পড়ছে, তবুও সে চুপ করে আছে। রামচন্দ্র যখন জানতে পারলেন, বললেন : তুমি কেন আমাকে জানালে না যে, তুমি এখানে আছ? ব্যাঙ বলছে : রাম, যখন অন্য কেউ আঘাত করে, তখন তোমাকে ডাকি। স্বয়ং তুমিই যখন আঘাত করছ, তখন আর কাকে বলতে যাব! তাই চুপ করে আছি। মাথা পেতে নিচ্ছি তোমার আঘাত। স্বামীজী বলছেন একটা ঘটনা ; এক সাধককে সাপে কামড়েছে—সে বলছে আমার প্রিয়তমের দূত। সাপ নয়, আমার ভগবান এসে তাঁর ভালবাসা জানিয়ে গেলেন। আর একজন সাধককে বাঘে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সাধক বলছেন : আমার প্রিয়তম তাঁর দূতকে পাঠিয়েছেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই হচ্ছে ভক্তের দৃষ্টি। কত বড় শক্তি ভক্ত অনুভব করে, যার জোরে সে মৃত্যুকে পর্যন্ত ভয় করছে না। মৃত্যুকে হাসতে হাসতে বরণ করছে।

ঠাকুর বলছেন যে, ভক্তের জীবনে যতই দুঃখ আসুক না কেন তার ভক্তির ঐশ্বর্য থাকে, সে ঐশ্বর্য কখনও যাবার নয়। (১-৭-২) ভক্তির ঐশ্বর্য কি? এই বোধ যে সুখে-দুঃখে তিনি আমার আপনার। আমার সর্বস্ব তিনি। আমি তাঁকে কখনও ভুলব না। সুখ-দুঃখ যাই আসুক, তাঁর দান হিসেবে হাসিমুখে গ্রহণ করব। ভক্তের পার্থিব জীবন খুব দুঃখের হতে পারে, কিন্তু এই ঐশ্বর্য তার থাকে। আমাদের আদর্শ হচ্ছে : সুখ-দুঃখ দুটোতেই প্রশান্ত থাকা। ভক্তের জীবনে সেই প্রশান্তি দেখা যায়। ঠাকুর বলছেন : দেখ না পাণ্ডবদের অত বিপদ! কিন্তু এ বিপদে তারা চৈতন্য একবারও হারায় নাই। তাদের মত জ্ঞানী তাদের মত ভক্ত কোথায়? (ঐ) একজন ভদ্রলোকের কথা জানি। তাঁর একমাত্র ছেলে—সদ্য ডাক্তারী পাশ করে মারা গেল। পাড়াপ্রতিবেশীরা সবাই গেলেন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু সেই ভদ্রলোক বললেন : আমাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না। যাঁর জিনিস—তিনি দিয়েছিলেন, তিনিই আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। আমার মনে কোন দুঃখ নেই। আবার আর একজন ভদ্রলোক—তাঁরও পুত্রশোক। তাঁর একমাত্র ছেলে নয়—আরও ছেলে আছে, একটি ছেলে মারা গেছে। ছেলে মারা যাওয়ার পর তাঁকে যখন দেখলাম, লক্ষ্য করলাম, তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছে। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করছেন : বলতে পারেন আমি আর কত দিন বাঁচব? আমি জিজ্ঞেস করলাম ; কতদিন হল আপনার ছেলে মারা গেছে? তিনি বললেন : এত বছর এত মাস এত দিন। দেখলাম, প্রতিটা দিন তিনি গুনছেন। পুত্রশোক ভুলতে পারছেন না কিছুতে। আর সত্যি সত্যিই তিনি আর বেশীদিন বাঁচলেনও না। কিছুদিন পরেই মারা গেলেন। প্রথম জন—ঈশ্বরে নির্ভর করে আছেন, সুখ-দুঃখ দুটোকেই তিনি সমান ভাবে নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় জন—প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা দিন তাঁর কাছে দুঃসহ, জীবন তাঁর কাছে অভিশাপের মতো। কাজেই এটা ঠিকই যে, ভক্ত কোথা থেকে যেন একটা বিরাট শক্তি পায়। সংসারের কোন ঘাত-প্রতিঘাত ভক্তকে বিচলিত করতে পারে না। সাধারণ মানুষ ভেঙে পড়ে—কিন্তু ভক্ত ভেঙে পড়ে না। প্রবল আত্মবিশ্বাস তার। ধীর, স্থির, অটল, অবিচল। সম্রাটের মতো থাকে সে। হয়তো বাইরে সে নিঃস্ব। কিন্তু থাকে একেবারে সম্রাটের মতো। কারণ, এই জগতের কারও কাছে তার কোন প্রত্যাশা নেই। কাউকে সে পরোয়া করে না। তার মানে এই নয় যে, সে উদ্ধত। কিন্তু যখন কোন একটা আদর্শের জন্য সে সংগ্রাম করে, তখন সে কারও অপেক্ষা রাখে না। ডঙ্কামারা ভাব তার। ‘এ সংসারে ডরি কারে,—রাজা যার মা মহেশ্বরী।’ অভয়া আমার সহায়, জগদীশ্বরী আমার সঙ্গে আছেন—আর কাকে আমি ভয় করতে যাব? ত্রিসংসারে আমার ভয় করবার মতো কিছু নেই।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তিপথ

একটা জিনিস লক্ষ্য করবার যে, ‘কথামৃতে’ ভক্তি সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ যা যা বলছেন, যেসব প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা করা হল—শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাঁর জীবনই তাঁর বাণী। বলছেন যে, ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুলতা চাই! এই ব্যাকুলতা যে কতটা হতে পারে তাঁর নিজের জীবনেই দেখি আমরা। নিজেই বলছেন নিজের সম্বন্ধে : বুকের ভিতরটা যেন গামছা নিংড়ানোর মতো কে নিংড়াচ্ছে। এত কষ্ট বোধ করছেন মাকে দেখতে পাচ্ছেন না বলে। চিৎকার করে কাঁদছেন, চারদিকে লোক জমে যাচ্ছে। তিনি যেন ছায়া দেখছেন সব। লোক আছে কি নেই—সেদিকে তাঁর কোন খেয়াল নেই। মুখ ঘষছেন মাটিতে, মুখ কেটে রক্ত পড়ছে। সবাই বলাবলি করছে : শূলবেদনায় কষ্ট পাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলছে : মাতৃশোক, সদ্য মাতৃবিয়োগ হয়েছে, তাই কাঁদছেন। রোমাঁ রোলাঁ বলছেন :৬২

‘As a purring tigress that fascinates her prey, She was to feed upon him, playing with him for ten long enchanted years passed beneath Her gleaming pupils.’

মা-কালী যেন বাঘিনী। বাঘিনী মুখ দিয়ে গর্‌ গর্‌ করে আর শিকারকে যেন সে জাদু করে ফেলে। শিকার স্বাধীন—কিন্তু পালাতে পারে না। আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে। বাঘিনী তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলে, তারপর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে মা কালী যেন সেরকম খেলছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর শিকার। মা-কালী তাঁকে ধরেছেন, তাঁর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছেন দশ বছর ধরে, আর তিল তিল করে তাঁকে গ্রাস করছেন। মায়ের হাত থেকে তাঁর যেন নিস্তার নেই। তিনি যেন চেষ্টা করলেও মাকে ছাড়তে পারবেন না। এই ব্যাকুলতা সম্বন্ধে আর একজন লিখছেন : The mad quest on uncharted seas.—অপরিচিত সমুদ্রে তিনি যেন ছুটে চলেছেন পাগলের মতো। নোঙর ছেঁড়া নৌকা যেমন ছুটে চলে। আদৌ সে কোন জায়গায় গিয়ে তীরে পৌঁছবে কি না, নাকি তার আগেই ডুবে যাবে—তার ঠিক নেই কিছু। তবু সে ছুটে চলেছে—না চলে পারছে না। ঠাকুর সেইরকম ছুটে চলেছেন ঈশ্বরের দিকে। একটা ঝড় যেন এসেছে, সমাজ-সংসার সব তুচ্ছ হয়ে গেছে। কোথায় যাচ্ছি? পাব কি তাঁকে? সংসারে তো আমার কোন অবলম্বন নেই, ইচ্ছে করেই আমি সংসার থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছি—তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু পাব কি আমি তাঁকে? তিনি কি আমার দিকে মুখ তুলে চাইবেন? যদি না চান তিনি? এইভাবে যদি জীবন কেটে যায়?—এ রকম একটা অবস্থা। কাঁদছেন মায়ের কাছে : মাগো, রামপ্রসাদকে তুমি দেখা দিয়েছ, আমাকে কেন দেখা দেবে না তুমি? কোথা দিয়ে দিনরাত্রি কেটে যাচ্ছে খেয়াল নেই কিছু। যখন সন্ধ্যাবেলা মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বেজে উঠত, একেবারে হাহাকার করে উঠতেন—মা,আর একটা দিন কেটে গেল, তোমার দেখা পেলাম না ! আমার জীবনের আর একটা দিন ব্যর্থ হয়ে গেল। তারপর একদিন মনে হল ; এত ডাক্‌ছি, মা তো দেখা দিলেন না? তাহলে কি মার দেখা আর পাবই না? কি লাভ তাহলে এই জীবনে? এই জীবন আর রাখব না। মার মন্দিরে খাঁড়া ছিল, সেই খাঁড়া তুলে নিয়ে নিজের গলায় বসাতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মা তাঁকে দর্শন দিলেন। সেই দর্শন সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : ঘর-বাড়ি মন্দির সব যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। চারদিক থেকে একটা অসীম অনন্ত জ্যোতিঃসমুদ্র তর্জন করতে করতে আমার দিকে ছুটে আসছে। দেখতে দেখতে সেই সমুদ্রের তরঙ্গগুলো তীব্রবেগে আমার উপর আছড়ে পড়ল—আমাকে একেবারে গ্রাস করে ফেলল। আমি হাবুডুবু খেতে লাগলাম, হাঁপাতে লাগলাম, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম আমি।—এই প্রথম দর্শন মা কালীর। তারপর দেখছি, কী অপূর্ব লীলা মায়ে-ছেলেয়। পুজো করছেন—তাতে আর নিয়ম নেই, বিধি নেই, মন্ত্র নেই। মায়ের সাথে কথা বলছেন, মায়ের চিবুক ধরে আদর করছেন। মার মুখের কাছে অন্ন ধরে বলছেন : খা, মা খা! আবার বলছেন : আগে আমি খাব? আচ্ছা, খাচ্ছি!—নিজে খাচ্ছেন, খেয়ে সেটা আবার মায়ের মুখের সামনে ধরছেন। বাড়িতে ছোট ছেলে-মেয়ে যেমন করে। খেতে খেতে মাঝে মাঝে সে হয়তো এঁটো হাত দিয়ে মায়ের মুখে খাবার গুঁজে দিল। আর মার মুখে তখন যে তৃপ্তির ছবি ফুটে ওঠে, তার কোন তুলনা হয় না। ঠাকুর তাই করছেন—মায়ে-ছেলেতে খেলা চলছে। একদিন ভোগ নিবেদন করার সময় দেখলেন, মন্দিরে একটা বেরাল ঢুকেছে। তাকে বলছেন : খাবি মা, খাবি মা? ব’লে, ভোগের জিনিস বেরালকে খাওয়াচ্ছেন। সর্বভূতে মাকে দেখছেন। যাঁরা এসব দেখছেন, তাঁরা ভাবছেন : এ কী, এ তো একেবারে অনাচার! মথুরবাবুর কাছে নালিশ গেল। মথুরবাবু একদিন এলেন পুজো দেখতে। ভাগ্যবান পুরুষ, বিচক্ষণ পুরুষ, এবং ভক্ত। ভক্ত বলেই তিনি বুঝলেন : এ এক অদ্ভুত দৃশ্য! মায়ে-ছেলের দৈবী লীলা! এ দৃশ্য দেখাও ভাগ্যের ব্যাপার। মুগ্ধ হলেন তিনি, বললেন : ওঁকে কেউ কিছু বলবে না। উনি যেমন পুজো করছেন, করতে দাও। আর কতভাবে মা খেলছেন তাঁর সাথে। মা আর মৃন্ময়ী নন—চিন্ময়ী। মার নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখছেন, মা সত্যি সত্যি নিঃশ্বাস ফেলছেন। মা তাঁর সাথে কথা বলছেন, রঙ্গরস করছেন। আবার কখনও দেখছেন : মা ছোট মেয়ের মতো দৌড়ে মন্দিরের ওপরতলায় উঠছেন। মায়ের পায়ের মল বাজছে—ঝম্‌ঝম্‌ শব্দ হচ্ছে। দোতলায় মা এলোচুলে দাঁড়িয়ে গঙ্গা দেখছেন। শুধু তো মাতৃভাবে নয়—সব ভাব দিয়ে তিনি ভগবানকে আস্বাদ করেছেন। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর—কোন ভাব বাদ নেই। আর যখন যে-ভাব ধরছেন, জাপটে ধরছেন। পুরোপুরি সেই ভাবের আচরণ করছেন, কোন খুঁত রাখছেন না। আমাদের শাস্ত্রে আছে :৬৩ ‘ন চ প্রসাদাৎ তপসো বাপ্যলিঙ্গাৎ’। ‘অলিঙ্গ’ তপস্যায় তাঁকে পাওয়া যায় না। লিঙ্গ মানে চিহ্ন, প্রতীক। যে, যে-ভাবে সাধনা করছে, সেই ভাবের ‘লিঙ্গ’ যদি সে ধারণ না করে তাহলে হবে না। ‘লিঙ্গ’ধারণ করলে ঈশ্বরলাভ সহজ হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই ‘লিঙ্গ’ ধারণ করছেন। যখন তিনি দাস্যভাবে, মহাবীরের ভাবে সাধন করছেন—তখন একেবারে হনুমানের মতো ব্যবহার করছেন। দু-পায়ে চলেন না, চার পায়ে চলেন। মাঝে মাঝে গাছে উঠে বসে থাকেন। আর সবসময় মুখে তাঁর ধ্বনি : রাম রাম। যখন বাৎসল্য-ভাবে সাধন করছেন, তখন তিনি জননী আর রামচন্দ্র তাঁর সন্তান। জটাধারী নামে এক রামাইৎ সাধু তাঁকে এক বালক-রামের মূর্তি দিয়েছিল। ‘রামলালা’ মূর্তি। ‘রামলালা’ নিজেই জটাধারীকে বলেছিলেন : আমি এই সাধুর কাছে থাকব। রামলালাকে পেয়ে ঠাকুর মেতে আছেন। তাঁকে নাওয়াচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন—সব সময় সে ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে। ঠাকুর স্নান করতে যান, রামলালাও সঙ্গে যায়। জলে গিয়ে হুটোপুটি করে। একদিন ঠাকুর রেগে মেরেছেন এক চড়। তারপর নিজেই কাঁদতে আরম্ভ করেছেন, মারলাম, মেরে বসলাম, আমার প্রিয়তমকে মেরে বসলাম। কী অদ্ভুত সম্পর্ক! আমাদের কাছে কল্পনা, খুব অদ্ভুত একটা কল্পনা! কিন্তু তাঁর কাছে বাস্তব। আবার যখন বৈষ্ণবমতে সাধন করছেন, তখন তিনি ফোঁটা, তিলক, কণ্ঠি, শ্বেতচন্দন, সাদা কাপড়, সাদা মালা—এ সব ব্যবহার করছেন। যখন শাক্তমতে সাধন করছেন, তখন লালবস্ত্র পরছেন, কপালে সিঁদুর দিচ্ছেন। আবার যখন মধুর ভাবে সাধন করছেন, তখন একেবারে মেয়েদের মতো সাজপোশাক করছেন। নিজেকে ভাবছেন শ্রীমতী। আর তাঁর সমস্ত চালচলন আচার-আচরণ এমনকি শরীরের গঠন পর্যন্ত মেয়েদের মতো হয়ে গেছে। ঠাকুর বলতেন : মিছরির রুটি সোজা করে খাও কিংবা আড়াআড়িভাবে খাও—মিষ্টি লাগবে। ঈশ্বরকে যে যে-ভাবে দেখ না কেন—আনন্দ পাবে। ঠাকুর সেই মিছরির রুটিকে সবরকমে আস্বাদ করেছেন। কোন ভাব বাদ দেননি। তাঁর সমস্ত জীবন ধরে দেখছি,নিরবচ্ছিন্ন ঈশ্বরচিন্তা। মার কাছে প্রার্থনা করছেন : কিচ্ছু চাই না আমার, শুদ্ধা ভক্তি দাও। মনে হয় তাঁর সমস্ত জীবনটাই যেন একটা দীর্ঘ প্রার্থনা। আর সব আনুষঙ্গিক। একা আছেন—ঈশ্বরের নামগান করছেন। ভক্তেরা আছেন—ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করছেন। রাত্রে খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমোচ্ছেন—তাঁর ঘুম নেই। ঈশ্বরের নাম করছেন। প্রার্থনাময় তাঁর সমস্ত জীবনটা। সকালে প্রার্থনা, সন্ধ্যায় প্রার্থনা, দিনে প্রার্থনা, রাত্রে প্রার্থনা, জেগে প্রার্থনা, ঘুমিয়ে প্রার্থনা। সমস্ত জীবনটা তাঁর প্রার্থনা। আর দেখছি ঈশ্বর-নির্ভরতা। ‘আমি’টা নেই তাঁর মধ্যে—শুধু ঈশ্বর। দু-রকমের ভক্ত আছে—বিড়ালছানা আর বাঁদরছানা। তাঁরই দেওয়া উদাহরণ। বাঁদরছানা দু-হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে থাকে, আর মা এক গাছ থেকে আর এক গাছে লাফিয়ে যায়। যতক্ষণ মাকে ধরে আছে সে, ভয় নেই—কিন্তু মাকে ছাড়লেই তার বিপদ। কিন্তু বিড়ালছানার নিজের কোন চেষ্টা নেই, নিজের ভালমন্দ নিয়ে তার কোন ভাবনা নেই। মা যদি তাকে বাবুর বিছানায় রাখে—তাতেও সে খুশি। আবার যদি ছাইয়ের গাদায় রাখে—তাতেও সে খুশি। সে শুধু মিউমিউ করে। ঠাকুরের সেইরকম। বলছেন : আমি কিছু জানি না, খাইদাই আর মায়ের নাম করি। সব অবস্থায় পরিপূর্ণ শরণাগত। মা যা করেন, মা যা বলেন! মন্দির থেকে নামছেন, পিছল, নামতে নামতে বলছেন : মা, পড়ে যাব না তো! আবার তোতাপুরী যখন এলেন বেদান্ত শিক্ষা দিতে, তখনও বলছেন : মাকে জিজ্ঞাসা করে আসি আগে, মা যদি অনুমতি দেন, তাহলে শিখব। সামান্য থেকে অ-সামান্য—সবকিছুতে মায়ের উপর নির্ভরশীল। মা-অন্ত প্রাণ তাঁর। সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, নিন্দা-স্তুতি—সমান তাঁর কাছে। কোন কিছু চান না তিনি, কোন কিছুর প্রয়োজন নেই—মা আছেন তাঁর। আর একটা শুধু বাসনা আছে—ভক্তসঙ্গ করব। ‘চিনি হতে চাই না, চিনি খেতে ভালবাসি’। মার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন : রসে-বশে রাখিস আমাকে। রসে-বশে ছিলেন। শুকনো সাধু হননি। ভক্তসঙ্গ করতে ভালবাসতেন। যেখানে দেখতেন ভক্ত, ছুটে যেতেন। কোন প্রত্যাশা নেই। ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করব, নানাভাবে ঈশ্বরীয় আনন্দ আস্বাদ করব—এইটুকু ইচ্ছা শুধু। আর কী তাঁর শক্তি, কী তাঁর ব্যক্তিত্ব! সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকেরা আসছেন তাঁর কাছে। তাঁরা অভিভূত হয়ে যাচ্ছেন। কাউকে তোষামোদ করছেন না তিনি—গুণীর কদর করছেন, কিন্তু সত্যিকথা বলতে ছাড়ছেন না। সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে বলে বসলেন : তোমাকে সবাই ‘রাজা’ বলে, আমি বলতে পারব না—মিথ্যেকথা বলব কি করে? তুমি তো আর সত্যি ‘রাজা’ নও। বঙ্কিমচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন জীবনের উদ্দেশ্য কি? উদ্ভট একটা উত্তর দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র—কেন যে ওরকম বললেন বুঝতে পারি না। ঠাকুর বিরক্ত হলেন, সর্বসমক্ষে তিরস্কার করলেন বঙ্কিমচন্দ্রকে : তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া দেখছি।—আমরা তাঁর মধ্যে তেজ দেখি, স্পষ্টবাদিতা দেখি। আবার দেখি—কী তাঁর প্রেম! যে আর্ত, যে দুর্বল, যে শরণাগত—তার প্রতি তাঁর কি সহানুভূতি! তাদের অভয় দিচ্ছেন, আশ্বাস দিচ্ছেন, এগিয়ে দিচ্ছেন শ্রেয়ের পথে। আর দেখছি, সর্বভূতে তাঁর ঈশ্বরবুদ্ধি। বলছেন : চোর নারায়ণ, লুচ্চা নারায়ণ। যা দেখছেন তাতেই ঈশ্বরীয় উদ্দীপন হচ্ছে। ফিরিঙ্গী ছেলেকে দেখছেন ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে—শ্রীকৃষ্ণকেই যেন দেখছেন। ‘পতিতা’ রমণীকে দেখছেন—জগজ্জননীকেই দেখছেন তার মধ্যে। অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি! বলছেন : সব রাম দেখছি। সব ঈশ্বর দেখছি। বস্তুত, তিনি যে ‘ভক্তির ঐশ্বর্যে’র কথা বললেন, সেই ঐশ্বর্যের সম্ভার দেখি তাঁর মধ্যে। ভক্তি মানুষকে কতটা পবিত্র করে, কতটা উদার করে, কতটা প্রেমিক করে, কতটা ঈশ্বরনির্ভর করে, কতটা ত্যাগ এবং শক্তি দেয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তিনি। ভক্তির ঐশ্বর্যে ভরপুর শ্রীরামকৃষ্ণ।

আকর-তালিকা

 । ভাগবত, ১/৬/৩২-৩

 । গীতা, ১২/৫

 । ভাগবত, ৬/১/১০

 । গীতা, ৬/৩৪

 । ভাগবত, ৬/১২/২২

 । ত্রিপাদবিভূতিমহানারায়ণোপনিষদ্‌, ৮ম অধ্যায়

 । অষ্টাবক্রসংহিতা, ১/১১

সম্পূর্ণ শ্লোকটি এই :

মুক্তাভিমানী মুক্তো হি বন্ধো বদ্ধাভিমান্যপি।

কিংবদন্তীহ সত্যেয়ং যা মতিঃ সা গতিৰ্ভবেৎ ॥

 । কামধেনুতন্ত্র, ১৫শ পটল

 । নারদপঞ্চরাত্র, ১/১২/৩৯-৪০

১০। চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ৯ম পরিচ্ছেদ

১১। কৌলাবলীতন্ত্র, ১১শ উল্লাস

১২। পঞ্চতন্ত্র, অপরীক্ষিত কারক, ৯০

১৩। বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও অন্যান্য সম্পাদিত, ৮ম সংস্করণ, পৃঃ ১০৫-০৬

১৪। ঐ, পৃঃ ১০৭

১৫। উদ্ধৃত : বৈষ্ণব পদাবলী : পদ ও পদকার, ধীরেন্দ্রনাথ সাহা, ১৯৭৫, পৃঃ ৯

১৬। চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪র্থ পরিচ্ছেদ

১৭। ঐ, মধ্যলীলা, ২য় পরিচ্ছেদ

১৮। যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ, স্থিতিপ্রকরণ, ২১/৫৬-৭

১৯। চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ১৯শ পরিচ্ছেদ

২০। The Synthesis of Yoga, Sri Aurobindo, Centenary Edition, 1972, p. 36

২১। গীতা, ১১/২৮-৯

২২। ঐ, ১১/৩১

২৩। ঐ, ১১/৪১

২৪। ঐ, ১১/৪৫

২৫। বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), পৃঃ ১৭

২৬। চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪র্থ পরিচ্ছেদ

২৭। ভক্তমাল, ৩য় মালা, দেব সাহিত্য কুটীর, ১৩৮৪

২৮। New Testament, St. Luke, Chapter 11, Verse 9 (The Holy Bible, Authorized or King James Version, 1948)

২৯। বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), পৃঃ ৪০

৩০। বাঙলার বাউল ও বাউলগান, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ১৩৭৮, পৃঃ ৫৮১-৮২

৩১। ভ্রমরগীতসার, সুরদাস, ২৩৯, ১ম সংস্করণ, পৃঃ ৪৩৩

৩২। ভক্তমাল, ২য় মালা

৩৩। ঐ

৩৪। চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ৮ম পরিচ্ছেদ

৩৫। ভাগবত, ৯/৪/৪৮

৩৬। ঐ, ৯/৪/৪৬

৩৭। গীতা, ১০/১০

৩৮। নারদীয়ভক্তিসূত্র, ২

৩৯।  Meister Eckhart, A Modern Translation by Raymond Bernard Blakney, 1941, p. 123

৪০। গীতা, ৮/২২

৪১। Old Testament. Exodus, Chapter 20, Verse 5 (The Holy Bible, Revised Standard Version, 1957)

৪২। New Testament, St. Matthew. Chapter 6. Verse 24 (The Holy Bible. Revised Standard Version, 1957)

৪৩। চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ৮ম পরিচ্ছেদ

৪৪। ভাগবত, ১১/১৪/১৪

৪৫। ঐ, ৭/১০/২

৪৬। ঐ, ৭/১০/৪

৪৭। নারদপঞ্চরাত্র, ২/৮/৫

৪৮। যোগতত্ত্ব-উপনিষদ্‌, ২২

৪৯। অধ্যাত্মরামায়ণ, আদিকাণ্ড, ৫ম অধ্যায়, শ্লোক ৩৭, ৩৮, ৪১-৩, ৫৮

৫০। ঐ, অযোধ্যাকাণ্ড, ১ম অধ্যায়, শ্লোক ৩০

৫১। শিক্ষাষ্টকম্‌, ৪

৫২। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ (কৃষ্ণজন্মখণ্ড), ১১১/৬৫

৫৩। বিনয় পত্রিকা, তুলসীদাস, ১০৩

৫৪। নারদীয়ভক্তিসূত্র, ৫

৫৫। ভাগবত, ৮/২৩/৬

৫৬। গীতা, ৯/২২

৫৭। বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), পৃঃ ৩০

৫৮। বাণী ও রচনা, ৭ম খণ্ড, ১৩৮৪, পৃঃ ৪৬০

৫৯। ভাগবত, ১০/১০/৩৮

৬০। রামচরিতমানস, উত্তরকাণ্ড, তুলসীদাস, দোহাঁ ২০৫

৬১। বাণী-বারকরী, নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, ১৩৮৩, পৃঃ ৯০-১

৬২। The Life of Ramakrishna, Romain Rolland, ‘Kali the Mother’, 1929, p. 28

৬৩। মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/২/৪।

* ঠাকুর ‘আপোধন্যন্যা’ বলে সন্ধ্যার এই মন্ত্রটির উল্লেখ করেছেন। সন্ধ্যাবন্দনার সময় এই মন্ত্র উচ্চারণ করে মাথায় জল ছিটোতে হয়। একে বলে ‘আপোমার্জন’। যেখানে যত জল আছে সব আমাদের কল্যাণসাধন করুক— মন্ত্রটির মাধ্যমে এই প্রার্থনা জানানো হয়। সম্পূর্ণ মন্ত্রটির অর্থ : ‘কল্যাণকর হোক আমাদের মরুদেশের জল, কল্যাণকর হোক আমাদের জলা জায়গার জল, কল্যাণকর তোক আমাদের সমুদ্রের জল, কল্যাণকর হোক আমাদের কৃপের জল।’

* ‘সংসার করতে দোষ কি?’ দ্রষ্টব্য

* যোগস্থঃ সন্ কুরু কমার্ণি কেবলমীশ্বরার্থং তত্রাপীশ্বরো মে তুষ্যত্বিতি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।’ (গীতা, ২/৪৮ -এর ভাষ্য)

* যথা হি স্কন্ধশাখানাং তরোর্মূলাবসেচনম্‌।

এবমারাধনং বিষ্ণোঃ সর্বেষামাত্মনশ্চ হি ॥ ৮/৫/৪৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *