অধ্যায় ছয় – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
শান্তির মঠ, লাসা, তিব্বত
‘কিভাবে হারিয়ে গেল ডুকপা লামা?’ খুব গম্ভীর সুরে আবারো একই প্রশ্ন করল শামান।
ওরা এই মুহূর্তে বসে আছে পাহাড়ের কোলঘেঁষে অবস্থিত মঠের একেবারে শেষ প্রান্তে। এদিকটা একেবারেই নির্জন, মঠের বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ ছাড়া এদিকে বলতে গেলে তেমন কেউ আসে না। ওদের দুজনার সামনেই ছোটো ছোটো মাটির পাত্রে মাখন-চা রাখা, কিন্তু দুজনার কেউই সেদিকে নজর দিচ্ছে না। .
একটু আগে লামা নোরবু যখন বলল ডুকপা লামা হারিয়ে গেছে, মুহূর্তের জন্যে শামানের মনে হয়েছিল যেন পায়ের নিচে মাটি কেঁপে উঠেছে। কিন্তু নোরবুর কাছ থেকে বিস্তারিত সব জানার আগেই ওখানে মঠের প্রার্থনারত ছেলেদের একটা দল চলে আসে, সেইসঙ্গে একজন শিক্ষানবীশ নোরবুকে এসে জানায়, সকালবেলার খাবার দেয়া হয়েছে। ওরা আর কথা না বাড়িয়ে খাবারের জায়গায় চলে যায়।
মঠের খাবার খুবই সাধারণ। নিচু তক্তপোশের মতো ছোটো জলচৌকির ওপরে খাবার সাজানো হয়। সেটাকে ঘিরে সবাই সারি দিয়ে একসঙ্গে খেতে বসে। ওরাও গিয়ে শিক্ষানবীশদের সঙ্গে খেতে বসে যায়। খাবারও খুবই সাধারণ। মঠসংলগ্ন স্থানেই শিক্ষানবীশদেরই চাষ করা সবজি দিয়ে পাতলা তরলমতো একটা জিনিস, যবের রুটি আর মণ্ডের মতো একটা মিষ্টি জিনিস, এটাকে ওরা বলে থুকপা। খাওয়া শেষ করার পর ছোটো ছোটো মাটির পাত্রে পরিবেশন করা হয় মাখন-চা।
খাওয়া শেষ হবার পর চায়ের পাত্র হাতে নিয়ে ওরা চলে আসে মঠের একেবারে শেষ প্রান্তে। এখানে বসে নির্জনে কথা বলা যাবে। কিন্তু বসার পর থেকেই একই প্রশ্ন দুবার জিজ্ঞেস করেও কোনো জবাব পাচ্ছে না শামান।
অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বসে আছে লামা নোরবু। লামারা তাদের বহু বছরের সাধনায় আবেগের সংযত বহিঃপ্রকাশে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন তাদের সেই আবরণ ভেঙে পড়ে তখন খুবই দিশেহারা হয়ে পড়ে তারা। ঠিক তেমনটাই ঘটছে এই মুহূর্তে লামা নোরবুর সঙ্গে। ডুকপা লামা হলো তাদের কাছে বটবৃক্ষের মতো। তার অন্তর্ধানে একদিকে সবাই যেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে ঠিক তেমনি কী করবে বুঝে উঠতেও পারছে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শামান চায়ের কাপ উঠিয়ে চুমুক দিল। সেই পুরনো স্বাদ। কিন্তু তাতে মন বসছে না, বরং ও চায়ে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘নোরবু, আপনি যদি বিস্তারিত না বলেন তাহলে আমি কিন্তু কিছুই করতে পারব না। আর যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই কাজটা আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই কী ঘটেছে খুলে বলুন আমাকে।’
লামা নোরবু চোখ তুলে ফিরে তাকাল ওর দিকে। শামানের কথায় মনে হচ্ছে একটু ভরসা পেয়েছে সে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে যখন কথা বলে উঠল তখন অনেকটাই স্বাভাবিক শোনাল। ‘তুমি ভারতবর্ষের ব্যাপারে কি জানো?
শামান মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল। ‘খুব বেশি কিছু না। এটুকু জানি, ওটা সমতল ভূমি। অনেক সবুজ। জীবনযাপন অনেক আরামের। আমাদের পাহাড়ি জীবনের মতো এত কষ্টের জীবন নয় ওখানে। পানি ফসল খাবার অনেক বেশি সহজলভ্য,’ বলে আরেকটা ব্যাপার যোগ করল। ‘ও হ্যাঁ, সম্রাট আশোকের নাম শুনেছি। সে নাকি জীবনের শেষ একটা অংশ অহিংসার বাণী প্রচার করেছে। আশোকের রাজপরিবার ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজপরিবার। সম্ভবত সবচেয়ে বড়োও। তারা আমাদের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল।’
‘ওদের রাজপরিবারের শাসন শেষ, দিগন্তের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল লামা নোরবু। ‘মৌর্য বংশের পতন হয়েছে ভারতবর্ষে। সম্রাট বৃহদ্রথের শুঙ্গ সেনাপতি তাকে খুন করে নিজেই রাজ্যের দখল নিয়ে নিয়েছে। এমনকি রাজপরিবারের বেশির ভাগ মানুষকেও মেরা ফেলা হয়েছে।’
নোরবুর কথা শুনে চমকে উঠল শামান। ও শুনেছিল সম্রাট আশোক দক্ষিণ ভারতের কলিঙ্গ রাজ্য দখলের সময়ে শেষবার এ রকম ঘটেছিল। এরপর ভারতবর্ষ বৌদ্ধদের শাসনতলে আসার পর এরকম রক্তাক্ত ঘটনা আর ঘটেনি। ‘সম্রাট বৃহদ্রথের সেনাপতি…‘
ওকে কথাটা শেষ করতে দিল না লামা নোরবু, তার আগেই বলে উঠল, ‘নাম পুশ্যমিত্র শুঙ্গ। ব্রাহ্মণ বংশীয় লোক সে, জাতিতে শুঙ্গ বংশদ্ভূত। যদিও সে বুদ্ধ রাজার অধীনে কাজ করত কিন্তু সে বৌদ্ধদেরকে দু চোখে দেখতে পারত না। কিন্তু রাজা এটা জানতেন না। এর ফল রাজা বৃহদ্রথকে ভালোভাবেই ভোগ করতে হয়েছে। তবে রাজা তো গেছেই, তার বোকামির ফল ভোগ করতে হয়েছে তার পরিবারকেও, এখন সেই ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ প্রজাদের।’
শামান চুপ করে রইল। সে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে।
‘ব্রাহ্মণ সেনাপতি রাজা বৃহদ্রথকে খুন করে নিজেকে ভারতবর্ষের আজীবন সম্রাট ঘোষণা করেছে। সেইসঙ্গে মৌর্য সাম্রাজের বিলুপ্তি ঘোষণা করে স্থাপন করেছে শুঙ্গ বংশের শাসন। তবে এতেও সমস্যা ছিল না। সমস্যা অন্য জায়গায়,’ বলে সে শামানের দিকে মুখ তুলে চাইল। শামান এখনো পরিস্থিতিটা ধরতে পারছে না।
‘সমস্যাটা তাহলে কোথায়?’
‘রাজা পুশ্যমিত্র নিজেকে ভারতবর্ষের রাজা ঘোষণা করা মাত্রই সে আরেকটা ঘোষণা দিয়েছে। ভারতবর্ষকে বৌদ্ধ মুক্ত করতে হবে। রাজপরিবার থেকে শুরু করে যেখানে বৌদ্ধ পাও হয় খুন করো, আর না হয় এদেরকে ধরে ভারতবর্ষ থেকে বের করো। তবে খুন করাটাই বেশি শ্রেয়। কারণ রাজা ঘোষণা করেছে একেকজন বৌদ্ধের কর্তিত মস্তক এনে রাজার কাছে দিতে পারলে শত শত স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেয়া হবে।’
‘কি! একজন রাজা এই ঘোষণা দিয়েছে! এটা কিভাবে সম্ভব? এটা কবের ঘটনা?’ শামান জানতে চাইল।
‘আজ থেকে দু-হপ্তা আগের ঘটনা। রাজা এই ঘোষণা দেয়া মাত্রই পুরো ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের ওপরে আক্রমণ শুরু হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে-ধ্বংস করা হয়েছে শত শত মঠ, আশ্রম আর স্তুপা। কাতারে কাতারে খুন করা হচ্ছে বৌদ্ধদের।’
কিন্তু এর সঙ্গে ডুকপা লামার অন্তর্ধানের সম্পর্ক কি?’ বলেই ও ব্যাপারটা খেয়াল করল। হাতে গুণে হিসেব করল এটা বছরের কোনো সময়। সর্বনাশ! বছরের এই সময়েই তো ডুকপা লামার দ্বিবার্ষিক ভ্রমণের সময়।’
‘ঠিক তাই। আজ থেকে দিন বিশেক আগে যখন এই ঘটনা ঘটে তার আগেই ডুকপা লামা তাঁর দ্বিবার্ষিক ভ্রমণে বেরিয়ে গেছিলেন। এসব যখন ঘটছে তখনো আমরা কিছুই জানি না, উনিও জানতেন না। এরপরে এই ঘটনা শুরু হবার পর তার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি আমরা। বারবার দূত পাঠিয়েও কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপর তার সহযাত্রী ভ্রমণকারীদের একজন আহত বিধ্বস্ত অবস্থায় লাদাখে আমাদের এক মঠে পৌছাতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে যখন আমাদের কাছে খবর এসে পৌঁছায় ততক্ষণে সেই আহত সহযাত্রী মারা গেছে,’ বলে সে একটু থেমে ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে আবারো বলতে শুরু করল। ‘কিন্তু মারা যাবার আগে সে যা জানিয়ে গেছে সেটা অত্যন্ত ভয়ংকর।’
‘কি জানিয়ে গেছে সে?’ শামান অনুভব করল ওর তলপেটের নিচে যেন অনেকগুলো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। গলায় শক্ত এক ধরনের অনুভূতি।
যখন বৃহৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকা নির্দিষ্ট কোনো একটা দিকে ঘুরতে শুরু করে সেই চাকার নির্দেশনা অনুযায়ীই পরিচালিত হতে থাকে সাধারণ মানুষের জীবন। সহজভাবে বলতে গেলে কেন্দ্রীয় শক্তির প্রভাবে ছোটো ছোটো ক্ষেত্রগুলো সবসময়ই প্রভাবিত হতে শুরু করে। ঠিক এই ব্যাপারটাই এই মুহূর্তে ঘটছে ভারতবর্ষে,’ লামা নোরবু বলে চলেছে। ‘ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় যা শুরু হয়েছে সেটারই প্রভাব ফলতে শুরু করেছে সমস্ত ভারতজুড়ে। আর সেটারই বলি হয়েছেন ডুকপা লামা। আগেই বলেছি উনি যখন এখান থেকে রওনা দেন তখন তো এসব ঘটনার কিছুই আমরা জানতাম না। উনি খুব স্বাভাবিকভাবেই তার দলবল নিয়ে পরিকল্পনামাফিক দ্বিবার্ষিক ভ্রমণের পরিক্রমা অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই পরিক্রমারই অংশ হিসেবেই উনি সাঁচিতে গিয়ে পৌঁছান।’
‘আমি যতদূর জানি সাঁচিতেই ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো স্তুপাগুলোর একটি অবস্থিত। ঠিক?’
‘হ্যাঁ, সেটা পরিদর্শন করার জন্যেই উনি সেখানে যান। উনি যেদিন সাঁচিতে গিয়ে পৌঁছান তার ঠিক এক দিন আগেই রাজা বৃহদ্রথ তার সেনাপতির হাতে খুন হয়েছেন। সাঁচি রাজ্যটা একটা জঙ্গুলে উপত্যকায় অবস্থিত, পৃথুরা বনভূমিসংলগ্ন এর মূল এলাকাটাকে বলা হয় কন্নোর। কন্নোর এলাকাটা একাধিক ভাগে বিভক্ত। একটা অংশ বৌদ্ধশাসিত শাক্য বংশীয় রাজা বিক্রম শাসন করত, অন্য অংশটা থারু বংশীয় শাসক মানরুর অধীনে শাসিত। দুই গোত্রের ভেতরে ঝামেলা বহু পুরনো ব্যাপার। এই শাসক দলের ভেতরে শাক্য বংশীয় বিক্রমাদিত্যের পরিবার সবসময়ই বেশি প্রভাবশালী। একে তো পারিবারিকভাবে তারা অধিক প্রভাবশালী তার ওপরে রাজা বিক্রমাদিত্যের প্রোপিতামহের শাসনামলে আশোকের সময়ে তারা নিজেদের পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে সরাসরি মৌর্যদের শাসনের অধীনে চলে আসে। ওই সময়ে শাক্যদের একটা অংশ বৌদ্ধ শাসনের অধীনে না এসে আলাদা হয়ে যায়। ওদেরকে বলে লিচ্ছবী। শাক্য আর লিচ্ছবীদের ভেতরে গণ্ডগোল লেগেই ছিল সবসময়।’
‘আজ থেকে বিশ বছর আগে এক যুদ্ধে থারুদেরকে পরাজিত করে শাক্যরাই ওই এলাকার কেন্দ্রীয় শাসন নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ‘এই যুদ্ধের পর থেকে শাক্য বংশই সবসময়ই থারু কিংবা লিচ্ছবীদের থেকে বেশি প্রভাবশালী হিসেবে পুরো কন্নোর এলাকা শাসন করে এসেছে।
লামা নোরবু একটু থেমে যোগ করল, ‘যাই হোক, সেসব অনেক পুরনো কথা। বর্তমানের ঘটনা বলি। ডুকপা লামা সাঁচিতে পৌছানোর পর স্থানীয় রাজাকে নিয়ে সাঁচির স্তুপাতে নিয়মিত দ্বিবার্ষিক আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু ওখানে পৌঁছানোর পর উনারা প্রথমে নাকি পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে পারেনি। কিন্তু স্থানীয় রাজা বিক্রম ডুকপা লামাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলার পরও উনি অনেকটা জোর করেই নিজের কার্যক্রম ঠিক রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তার ধারণা ছিল ধর্মীয় যজ্ঞানুষ্ঠানে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ওই দিনই আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের মাঝখানে সাঁচির স্তুপাতে আক্রমণ হয়। স্থানীয় লিচ্ছবী রাজা হেমচন্দ্র নিজের বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে স্তুপাতে।’
‘সর্বনাশ,’ শামান একেবারে ঠান্ডা গলায় বলে উঠল।
‘আসলে লিচ্ছবী বংশীয় লোকজন আশোকের সময়ে শাক্যদের থেকে আলাদা হবার পর থেকেই সুযোগ খুঁজছিল ওদের ওপরে প্রতিশোধ নেয়ার। কিন্তু তারা দুর্বল হবার কারণেই পিছিয়ে পড়ছিল শাক্যদের থেকে। আর তাই ওরা বহুদিন ধরেই সুযোগ খুঁজেও সুবিধে করতে পারেনি।’
‘এবার পুশ্যমিত্র ভারতবর্ষের শাসন দখল করে নিতেই এই সুযোগটা নিয়েছে ওরা,’ শামান চিন্তিত। ‘কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। এই ঘটনার সঙ্গে ডুকপা লামার অন্তর্ধানের সম্পর্ক কি?’
‘পরিস্থিতি আসলে আমি-তুমি যা ভাবছি সম্ভবত তার চেয়েও অনেক খারাপ। ডুকপা লামার যে শিষ্য লাদাখে আমাদের মঠ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল সে সবকিছু বিস্তারিত বলে যেতে পারেনি। তার আগেই মারা যায় সে। কিন্তু মারা যাবার আগে সে যা বলে যায় ব্যাপারটা অনেকটা এমন; রাজা বিক্রম আর ডুকপা লামা সব ভেবে দ্বিবার্ষিক আয়োজন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তারা যখন তাদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের ঠিক মাঝামাঝি এমন সময় তাদের অনুষ্ঠানের মাঝে সাঁচির স্তুপাতে আক্রমণ হয়। শুধু রাজা বিক্রম আর ডুকপা লামা বাদে বাকি প্রায় সবাইকে খুন করা হয় ওখানে। সাঁচির স্তুপাতে রক্তের বন্যা বয়ে যায়।
‘কিন্তু রাজা বিক্রমের বাহিনী ছিল না সেখানে? তারা কি করেছে?’ শামান কয়েকটা ব্যাপার এখনো ধরতে পারছে না।
‘আসলে সাঁচিতে ঠিক কী ঘটেছিল, তা আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। এমনকি ওখান থেকে আমরা কোনো খোঁজখবরও বের করতে পারছি না। ওই এলাকার মাটি এখন আমাদের জন্যে নরক হয়ে উঠেছে। এ কারণেই আমাদের এই মুহূর্তে এমন একজন দরকার যার যুদ্ধের ব্যাপারে সম্যক অভিজ্ঞতা আছে, সেইসঙ্গে এসব ব্যাপার সামলানোর মতো ক্ষমতা।’
‘আপনি কি চাইছেন, নোরবু?’ শামান নোরবুর দিকে চোখ তুলে তাকাল।
‘শুধু আমি না এই শান্তির মঠের সবাই আমরা মনে-প্রাণে চাই ডুকপা লামা আমাদের মাঝে ফিরে আসুক, নোরবু কোনোমতে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। ‘তাকে যদি মেরে ফেলাও হয়ে থাকতে অন্তত তার স্মৃতিভস্মটুকু হলেও যেন আমাদের মাঝে থাকে,’ নোরবু আর নিজেকে সামলাতে পারল না। টপটপ করে পানি ঝরতে লাগল তার দুই চোখ বেয়ে।
‘আমি যাব,’ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল শামান। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও ওকে ডুকপা লামার কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে। সেটা জীবিত বা মৃত যাই হোক না কেন। ‘কিন্তু আমার কিছু ব্যাপারে সহায়তা লাগবে।’
‘শামান, তুমি যদি যাও তবে আমরা আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমাকে সহায়তা করার। আমি জানি এটা তোমার পেশা। প্রয়োজনে আমি তোমাকে মঠের তরফ থেকে তোমার যা পাওনা…’ নোরবু কথা শেষ করার আগেই শামান এগিয়ে এসে নোরবুর দুই হাত চেপে ধরল।
‘আপনি আমাকে অপমান করছেন নোরবু। আমি…আমি হয়তো চেষ্টা করেও পুরোপুরি এই মঠের একজন হয়ে উঠতে পারিনি, সেটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এই মঠ আমাকে যা দিয়েছে সেই ঋণ আমি কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। বিশেষ করে একটা এতিম অসহায় ছেলেকে ডুকপা লামা যেভাবে বড়ো করে তুলেছেন সে ব্যাপারে আর কিছু নাই বা বললাম। সেই ডুকপা লামা আজ বিপদে আর তাকে উদ্ধার করার জন্যে আমি অর্থ গ্রহণ করব, সেটা ভাবা আমার জন্যে অন্যায় হবে। তবে আমার অন্য কিছু ব্যাপারে সহায়তা লাগবে।’
‘সেটা কি রকম?’ নোরবু জানতে চাইল। শামান রাজি হওয়াতে তার চোখে- মুখে স্বস্তির ছায়া।
‘প্রথমত, এই কাজে আমি আমার দলকে নিতে পারব না। কারণ তারা এই মুহূর্তে এখান থেকে বহুদূরে আছে। আর তা ছাড়া সাঁচিতে খুব বেশি লোকজন নিয়ে গেলে বিপদ আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই আমাকে একাই যেতে হবে।’
‘তোমাকে একা যেতে হবে না শামান। তোমার কি বিধুর কথা মনে আছে?’ ‘বিধু, কোনো বিধু?’ শামান চেষ্টা করেও মনে করতে পারছে না। ‘মোটা করে একটা ছেলে ছিল, খালি মারামারি করত, আর-’
‘বিধু! সর্বনাশ। বিধুর কথা ভুলে যাব, যার তার সঙ্গে মারামারি বাঁধিয়ে দিত। সারাক্ষণ খেত আর কারো কথা শুনতে চাইত না। ওর একটা কান…’
‘হ্যাঁ, তুমি চিনতে পেরেছো শামান। ওর একটা কান অন্য কান থেকে ছোটো ছিল। এ নিয়ে ছোটোবেলা তোমরা তাকে কম জ্বালাতন করোনি,’ নোরবুর মুখে মৃদু হাসি।
‘বিধুর সঙ্গে এই ব্যাপারটার সম্পর্ক কি?’ শামান জানতে চাইল। ওরা মঠের নিচু এলাকার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।
‘শামান, আমি তোমার কাছে সহায়তা চেয়ে যেমন খবর পাঠিয়েছি ঠিক একইভাবে বিধুর কাছেও খবর পাঠিয়েছিলাম সহায়তা চেয়ে। তুমি হয়তো জানো না—তুমি যেমন মঠ থেকে পালিয়ে গেছিলে ঠিক তেমনি বিধুও আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেনি। ও এখান থেকে পালিয়ে বাঙ্গাল প্রদেশ পার হয়ে সপ্তভূমিতে চলে যায়, তারপর সেখান থেকে সিংহল। সিংহলেই বড়ো হবার পর সেখানে সিংহল রাজার সৈন্যবাহিনীতে তিরন্দাজ হিসেবে কাজ করে সে। তোমাকে যখন খবর পাঠাই আমি জানতাম না তুমি যেতে রাজি হবে কি না, তাই আমি বিধুকেও খবর পাঠিয়েছিলাম। সেও চলে এসেছে। তাই আমার মনে হয় সমস্যা না থাকলে তোমরা দুজনে একসঙ্গে যেতে পারো এই অভিযানে। এটা তোমাদের উভয়ের জন্যেই ভালো হবে। এখন চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই,’ বলে জোরকদমে এগোতে লাগল সে।
খানিকটা দ্বিধান্বিত শামান অনুসরণ করল তাকে।