ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৫৮

অধ্যায় আটান্ন – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ

যদিও সন্ধে নেমে এসেছে বনভূমিতে, তবে আকাশে চাঁদ উঠতে এখনো ঢের বাকি। শামান যে ঘোড়াটার ওপরে বসে আছে সেটার গায়ে ধীরে ধীরে হাত বুলাতে লাগল ও। ঘোড়াটা একটু অস্থির হয়ে বারবার হেসা ধ্বনি ছাড়ছিল, শামান হাত বুলাতেই ওটা শান্ত হয়ে এলো অনেকটা। শামান আকাশের দিকে তাকাল, তারপর নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল সামনে।

যদিও ওরা একেবারে ঘন জঙ্গলের ভেতরে অবস্থান নিয়ে আছে তবুও এখান থেকে বিধোরীর দুর্গটা পরিষ্কার চোখে পড়ে। বিশেষ করে দুর্গের মূল ফটক, যেখান দিয়ে রাজা বিক্রমের বহর বের হয়ে আসার কথা। ওরা থারুদের গুদাম এলাকা থেকে রওনা দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে খুব বেশি সময় হয়নি। আগে থেকেই এখানে জাথুরিয়ার নিয়োগ দেয়া একজন লোক অপেক্ষা করছিল। ওরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রওনা দিয়ে এখানে এসে পৌছানোমাত্র লোকটা ওদেরকে জানায় রাজা বিক্রমের বাহিনী এখনো বের হয়নি, যেকোনো সময় বেরুতে পারে। সেইসঙ্গে ওদেরকে অপেক্ষা করার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গাটা দেখিয়ে দেয়, যাতে বিধোরীর মূল ফটক দিয়ে রাজা বিক্রমের বাহিনী বেরিয়ে এলে ওরা পরিষ্কার দেখতে পায়।

শামান বসে থাকতে থাকতে আরেকবার নিজের লোকদেরকে দেখল। ওর দলের সবাই ওর একেবারে অচেনা। অচেনা মানুষ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে উতরানো খুব কঠিন কাজ, কারণ যুদ্ধ মানেই দলগত কাজ। আর তুমি দলনেতা হয়ে যদি নিজের দলের লোকদের শক্তি-সামর্থ্যের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা না রাখো তবে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ আদায় করা খুব কঠিন। তবে অচেনা মানুষ নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে উতরানো ওর জন্যে এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বহুবার ওকে অচেনা লোকজন নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামতে হয়েছে, কিন্তু এর আগে কোনোবারই এখনকার মতো নাজুক অবস্থা ছিল না ওর।

তার ওপরে নিজের বন্ধু, নিজের অস্ত্র কোনোটাই আর নিজের কাছে নেই। কোমরে ঝোলানো তলোয়ারটাতে একবার হাত বোলাল শামান। এই তলোয়ারটা থারু যোদ্ধারা দিয়েছে ওকে একটা তলোয়ার, দুটো ছুরি আর একটা ঢাল। যদিও ঢাল জিনিসটা এর আগে কখনো ব্যবহার করেনি শামান, কিন্তু আজ ঘোড়সওয়ারি হিসেবে যুদ্ধ করার জন্যে এটা লাগতে পারে, কারণ শামান জানে ঘোড়সওয়ারি যুদ্ধে তীরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে হলেও ঢালের প্রয়োজন আছে। আর তলোয়ারটাও ওর প্রিয় কাতানার মতো নয়। কাতানা পাতলা, সমতল আর কোপ মারার অস্ত্র, আর এদের তলোয়ারগুলো খাটো বাঁকা আর ভেদ করার অস্ত্র। যদিও আসার আগে বেশ কিছুক্ষণ অভ্যাস করে নিয়েছে ও, তবুও নিজের অস্ত্র নিজের অস্ত্ৰই।

আবারো ওর ঘোড়াটা নড়ে উঠল, ব্যাপার কি, এই ব্যাটা এরকম নড়ছে কেন, নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল ও। কিন্তু জবাবাটা অবশ্যই অবলা প্রাণীর তরফ থেকে না এসে জবাব এলো সামনে থেকে। ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে বিধোরীর মূল ফটক। ওরা যেখানে আছে সেখান থেকে ফটক খোলার দৃশ্য দেখতে পায়নি কিন্তু ওটার শব্দ শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার। দেখতে দেখতেই ফটক খুলে বেরিয়ে এলো ঘোড়সওয়ারের দল। ওরা যা আশা করেছিল দলটার আয়তন অনেকটা সেরকমই, দলটাকে বেরিয়ে আসতে দেখে খুশি হয়ে উঠল শামান।

রাজা বিক্রমের ঘোড়সওয়ার বাহিনী বেশ দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসছে বিধোরীর মূল ফটক দিয়ে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নামতে নামতে ওদের গতি আরো বেড়ে যেতে লাগল। শামানরা সবাই প্রায় দম আটকে বসে আছে। তবুও ওর দলের লোকজনকে হাতের ইশারায় আবারো সাবধান করে দিল শামান। দেখতে দেখতে রাজা বিক্রমের বাহিনী বিধোরী থেকে নেমে এসে যেখানে পথটা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে সেটার কাছাকাছি চলে এলো।

শমান উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে দলটা কোনোদিকে মোড় নেয় সেটা দেখার জন্যে। দলটা রাস্তাটা যেখানে দুই ভাগে ভাগ হয়েছে সেখানে এসে কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই ওরা যে-রাস্তা অনুমান করে রেখেছিল সেটা দিয়েই প্রবেশ করল। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল শামানের দলের সবাই। যাক তাহলে পরিকল্পনা কাজে লাগতে যাচ্ছে।

দলটা ঝড়ের বেগে ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল। দলটা জঙ্গুলে পথের বাঁকের অন্যপাশে গয়েব হয়ে যেতেই শামান আঙুলের কড়ে এক, দুই, তিন করে গুনতে শুরু করল। বিশ গোনা হতেই ঘোড়ার গায়ে চাপড় মেরে লাফ দিয়ে সামনে এগোল ও ঘোড়া নিয়ে। ওর দেখাদেখি বাকিরাও ঝড়ের বেগে সামনে এগিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে অন্যপাশের জঙ্গলে প্রবেশ করল। পরিকল্পনা কাজে লাগতে যাচ্ছে। এবার বিধুরা ঠিকমতো কাজ করতে পারলেই হয়।

বর্তমান সময়
শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, সিলেট

দরজায় হালকা ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তানভীরের। মুহূর্তের জন্যে খানিকটা দ্বিধা করে চট করে উঠে বসল ও। আপনাতেই ওর দৃষ্টি চলে গেল বিছানার পাশে ছোটো সাইড টেবিলের ওপরে রাখা ঘড়িটার দিকে। সন্ধে পার হয়ে রাত নেমে এসেছে।

ঘুম ভেঙে উঠে বসে তানভীর ঠিক নিশ্চিত হতে পারল না দরজায় কি আসলেই কেউ নক করেছে নাকি শব্দটা ওর মনের ভুল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় আবারো আগের মতোই খুব আলতো ঠকঠক শব্দ হলো। বিছানা থেকে চাদরটা তুলে গায়ে জড়িয়ে এসে দরজাটা খুলে দিতেই চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল সুলতান আর ইকবাল।

ওরা দুজনে ভেতরে ঢুকতেই তানভীর সুলতানের কাছে জানতে চাইল, ‘জালাল ভাইয়ের কী অবস্থা?’ খালি গায়ে ঠান্ডায় প্রায় জমে যাবার মতো অবস্থা ওর কিন্তু সুলতানের সামনে চাদর সরিয়ে কাপড় পরতে ইচ্ছে হলো না। চাদরটা আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিল গায়ে।

‘জালাল স্যার এখন অনেকটা ভালো। জ্ঞান ফিরে আসেনি কিন্তু অপারেশন ভালোভাবেই শেষ হয়েছে, ডাক্তার বলেছে আজ জ্ঞান ফিরে আসবে না, তবে প্রাথমিক বিপদ কেটে গেছে, সুলতান দ্রুত কথাগুলো বলে একবার দরজার দিকে দেখে নিয়ে ওটা ঠেলে বন্ধ করে দিল। তানভীরের কাছে কেন জানি মনে হলো সুলতান আর ইকবাল দুজনেই খুব উত্তেজিত হয়ে আছে কোনো কারণে।

যাক এটা একটা ভালো খবর, জালাল ভাইকে নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। আমি তো ভাবছিলাম—’

তানভীরকে কথা শেষ করতে দিল না ইকবাল। ‘স্যার, অন্য একটা ঘটনা ঘটেছে। আপনাকে জানানো খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল তাই জলদি এলাম আপনার সঙ্গে দেখা করতে…’

‘কি ব্যাপার, হয়েছে কি? দুজনেই খুব উত্তেজিত হয়ে আছো মনে হয়। কোনো সমস্যা নেই, আমরা সম্ভবত জেড মাস্টার আর ব্ল্যাক বুদ্ধার খবর বের করতে পেরেছি। আমি আর টমি মিলে ইএএফকে কিছু ক্লু অ্যানালিসিস করে দিয়েছি। ওরা এতক্ষণে ব্যাপারটা নিশ্চিত করে ফেলার কথা,’ তানভীর সুলতানের দিকে হাত বাড়িয়ে জানতে চাইল, ওর কাছে সিগারেট আছে কি না। সুলতান প্যাকেট আর লাইটার দিতেই সেটা দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে-টানতে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল ও। চাদরটা আবারো ভালোভাবে জড়িয়ে নিল গায়ে।

বস, এগুলো আমরা টমির কাছে শুনেছি কিভাবে তোমরা জেড মাস্টার আর ব্ল্যাক বুদ্ধার ব্যাপারে একটা হাইপোথিসিস ডেভলপ করেছো, সুলতান একটা চেয়ারে বসে ইকবালকে বাইরের দিকে খেয়াল রাখতে বলল। ‘আমরা সে জন্যে উত্তেজিত না। আমরা উত্তেজিত অন্য কারণে। আমি আর ইকবাল এখানে এসেছি ঘণ্টাখানেক আগে। আসার পরে টমির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও পারিনি। একটু আগে টমি আমাদের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করে সব জানিয়ে বলল তোমাকে জানাতে যে, সম্ভবত ইএএফ কোনো একটা শয়তানি করছে। ওরা মনে হয় জেড মাস্টারের লোকেশনের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছে। এরপরেই ওরা পুরো অপারেশন নিজেদের কন্ট্রোলে নিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে। এতক্ষণে অপারেশন ব্ল্যাক বুদ্ধা-ওরা অপারেশরটার এই নামই দিয়েছে—এই অপারেশনটাকে ওরা এতক্ষণে সম্ভবত অফিসিয়ালি নিজেদের কমান্ডে নিয়েও নিয়েছে।’

‘তাই নাকি,’ সুলতানের কথা শুনতে শুনতে তানভীর বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। ‘সমস্ত কিছু করলাম আমরা আর এখন অপারেশন কিভাবে ওরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। দুপুরের পরেও ওদের সঙ্গে কথা বলে আমি যখন পাশা স্যারকে সব রিপোর্ট করলাম তখনো তো এরকম কিছু শুনিনি। পাশা স্যার জানেন, ব্যাপারটা?’

‘স্যারকে একটু আগে আমি জানিয়েছি,’ সুলতান জবাব দিল। ‘পাশা স্যার সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন যেকোনো সময়,’ বলে সুলতান ঘড়ি দেখল। হয়েতো এতক্ষণে রওনা দিয়েও দিয়েছেন।’

পাশা স্যার সিলেটে আসছেন শুনে একটু স্বস্তি বোধ করল তানভীর। ‘আচ্ছা, ইএএফের ওরা আছে কোথায় এখন, এই ল্যাবেই?’

‘ল্যাবেই মানে,’ সুলতান বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বলে উঠল। ‘ওরা তো ল্যাবের কনফারেন্স রুমটাকে পুরোপুরি নিজেদের অপারেশনের কমান্ড রুম বানিয়ে ফেলেছে। অর বেচারা টমিকে খাটিয়ে মারছে।

তানভীর এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি, ‘ সিগারেটটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। তোমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি বেরুচ্ছি।’ সুলতান সামান্য মাথা নেড়ে ইকবালকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

তানভীর দ্রুত ফ্রেশ হয়ে জিন্স, কালো শার্ট, শার্টের ওপরে ভেস্ট আর কালো জ্যাকেট পরে নিয়ে মোবাইলটা তুলে নিয়ে কল দিল পাশা স্যারকে। কিন্তু তার ফোন সুইচড অফ দেখাল। তারপর কল করল মাকে। ‘হ্যালো, মা, হ্যাঁ আমি ভালো আছি… তোমার কী অবস্থা… ও আচ্ছা লোক এসেছিল ফার্নিচারের দোকান থেকে। ওষুধগুলো এনেছিলে? ঠিক আছে বাকি ব্যাপারগুলো আমি ঢাকা এসে সামলাব, কোনো সমস্যা নেই…’ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ও রুমের বাইরে এসে সুলতান আর ইকবালকে সামনে এগোনোর ইশারা করল।

ওদের দুজনকে নিয়ে সোজা হেঁটে চলে এলো ল্যাবের কনফারেন্স রুমের সামনে। ওখানে দুজন কালো পোশাক পরা ইএএফের প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো। ওরা ভেতরে ঢুকতে যেতেই থামিয়ে জানাল ভেতরে ঢোকা নিষেধ। তানভীর নিজের পরিচয় দিল। ওদেরকে ওখানেই অপক্ষো করতে বলে একজন প্রহরী ভেতরে চলে গেল।

তানভীর একটু রাগের সঙ্গেই ফিরে তাকাল সুলতানের দিকে। সুলতান কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহায় একটা ইশারা করল। ব্যাপার কি, ওদের অপারেশন ওদের কাজ, এখন ওরাই বাইরের মানুষ।

‘আপনি ভেতরে আসুন, আর আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন,’ বলে ফিরে আসা প্রহরী তানভীরকে ভেতরে ঢোকার জন্যে ইশারা করল। তানভীর ওদের দুজনকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

কনফারেন্স রুমের ভেতরে রীতিমতো এলাহি কাণ্ড চলছে। রুমের ভেতরটাকে এখন আর কনফারেন্স রুম না বলে এটাকে রীতিমতো মিলিটারি কমান্ডের মতো দেখাচ্ছে। একদিকে বড়ো স্ক্রিনটা ওপেন করা। তাতে এটা-সেটা ছবি ফুটে আছে। এক পলক বুলিয়ে তানভীর অনুমান করল সম্ভবত স্যাটেলাইট নিউজ ফিড হতে পারে। ওটার সামনেই আরো দুজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে টমি। তার চোখ-মুখ লাল আর চেহারা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ওকে দেখে টমি শুকনো হাসি দিল।

কনফারেন্স টেবিলের সর্বাগ্রে দাঁড়িয়ে আছে ইএএফের প্রধান বাবুল আহমেদ, তার পরনে কমান্ডোদের মতো পোশাক। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মোটা গোঁফ, ফারুক। কনফারেন্স টেবিলটাকে ঘিরে বসে আছে একইরকম কমান্ডো সাজে সজ্জিত আরো বেশ কয়েকজন অফিসার। তানভীর তাদের দিকে এগিয়ে যেতে- যেতে অনুমান করল বাবুল আহমেদ সম্ভবত কিছু একটা নিয়ে ব্রিফ করছিল অফিসারদের। ওকে এগোতে দেখে থেমে গেল সে।

‘গুড ইভিনিং অফিসার তানভীর, বাবুল আহমেদ মৃদু হেসে বলে উঠল। যাক ঘুম ভাঙল তাহলে। বিশ্রাম হয়েছে ঠিকমতো?’ বলে সে নিজের অফিসারদের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি,’ বলে সে তানভীরকে দেখাল। ‘উনি, অফিসার তানভীর মালিক, উনিই জেড মাস্টার আর ব্ল্যাক বুদ্ধার সন্ধান বের করেছেন।’

বাবুল আহমেদের কথা একেবারেই পাত্তা না দিয়ে তানভীর বলে উঠল, ‘হচ্ছেটা কি, আমি জানতে পারি?’

বাবুল আহমেদ ওর দিকে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘অবশ্যই অফিসার। তোমাকে না জানালে আর কাকে জানাব,’ বলে সে টমির দিকে ইশারা করল। বাবুল আহমেদের ইশারা দেখে টমি একটা রিমোটে চাপ দিতেই স্ক্রিনে একটা বাংলোর ছবি ফুটে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল তানভীর, লাক্কাতুরার সেই বাংলো—যেখান থেকে ওরা ডক্টর মিতায়ন মানে জেড মাস্টারকে উদ্ধার করে এনেছিল।

‘নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন। আপনার অ্যানালিসিস অনুযায়ী আমরা অনুসন্ধান করে বের করেছি জেড মাস্টার সম্ভবত এখানেই আছে।

‘কিভাবে?’ তানভীর প্রশ্নটা করেই একটু সচেতন হয়ে আবারো জানতে চাইল। ‘মানে, আপনার শতভাগ নিশ্চিত হলেন কিভাবে?’

‘আজ দুপুরের দিকে আপনার সঙ্গে কথা বলার পর আপনার আর টমির হাইপোথিসিস জাজ করার জন্যে বাংলোটার ওপরে নজর রাখতে শুরু করি আমরা। বাংলোটা থেকে সতর্ক দূরত্বে এমনভাবে আমরা আমাদের এজেন্টদেরকে সেট করেছি যাতে ওরা ভেতর থেকে টের না পায় আবার পালাতেও না পারে। আর বাইরে রোড ব্লক ইত্যাদি তো আছেই। একটা পর্যায়ে ওখানে অবস্থান নেয়া আমাদের এজেন্ট কনফার্ম করে বাংলোতে কেউ রয়েছে। কিন্তু কাউকে সে দেখতে পায়নি। তবে সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাংলোর জানালায় এক ঝলকের জন্যে ডক্টর মিতায়ন, মানে জেড মাস্টারকে দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেছে আমাদের সেই এজেন্ট।’

বাবুল আহমেদের কথা এই পর্যন্ত শুনতেই তানভীর উত্তেজিত হয়ে উঠল। ‘তাই নাকি? তাহলে আপনারা এখনো অপারেশন না চালিয়ে বসে আছেন কেন? আমাকেই বা আরো আগে জানানো হয়নি কেন?’

‘এরকম একটা অপারেশনের ব্যাপারে তুমি কী জানো?’ বাবুল আহমেদের পাশে থেকে মোটা গোঁফ ফারুক কথা বলে উঠল। ‘মুখে বললেই এরকম অপারেশন চালানো যায় না, সবাই তো আর তোমার মতো না,’ লোকটা এই পর্যন্ত বলতেই তানভীর চট করে গরম চোখে ফিরে তাকাল তার দিকে।

‘ফারুক, তুমি থামো,’ বাবুল আহমেদ তাকে ধমকে দিল। ‘তানভীর, ও ঠিকই বলেছে। এরকম একটা অপারেশন চালাতে অনেক ধরনের প্রস্তুতি তো লাগেই সেইসঙ্গে অনুমতি ইত্যাদির ব্যাপার আছেতো। আর তা ছাড়া আমরা আসলে রাত নামার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম যাতে আমরা অপারেশন চালাতে গেলে বাংলো থেকে ওরা আগেই টের পেয়ে না যায়,’ বলেই সে ঘড়ি দেখল। এখন বাজে সাড়ে আটটা। আমাদের টিম রেডি আছে, আমরা সাড়ে নয়টায় এখান থেকে বেরুবো, দশটার ভেতরে বাংলোতে অপারেশন চালানোর টার্গেট আমাদের।

তোমার টিমকে আমরা রেগুলার আপডেট জানাব,’ বলে বাবুল আহমেদ হালকা চালে একটা চাপড় মারল তানভীরের কাঁধে। ‘তোমাকে ইএএফের তরফ থেকে ধন্যবাদ। তুমি না থাকলে কিছুতেই ব্যাপারটা এত দ্রুত সমাধান করতে পারতাম না।’

‘স্যার রেগুলার আপডেট মানে?’ তানভীরের গলা উঁচু হয়ে গেছে। টেবিলের চারপাশে তো বটেই রুমের অন্যান্য অংশে অবস্থান করা লোকজন সবাই ফিরে তাকাল ওর দিকে। তানভীর গলা নামিয়ে বলে উঠল, ‘স্যার রেগুলার আপডেটের কথা কেন বলছেন আপনি। আমি আর আমার টিম জীবন বাজি রেখেছি এই অপারেশনের জন্যে। আমরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছি। স্যার, আমরাও এই অপারেশনে অংশ নিতে চাই। এটা আমাদের অধিকার।’

বাবুল আহমেদ কিছু না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল তানভীরের দিকে। ‘অফিসার, ফিল্ড লেভেলে কমান্ডে কাজ হয়। তুমি এসব জানো না, আর তা ছাড়া ফিল্ডে তোমার অভিজ্ঞতাও নেই কাজেই এসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে বরং অন্যান্য দিক দিয়ে আমাদেরকে সহায়তা করো।’

‘স্যার, আপনি আমাদেরকে এভাবে সরিয়ে দিতে পারেন না,’ বলে ও বাবুল আহমেদের পোশাকের হাতা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মোটা গোঁফ ফারুক পিস্তল বের করে চেপে ধরল তানভীরের কপালের পাশে।

অতীত
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর

একদিকে বিধুদের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত শামান, অন্যদিকে ঠিক তেমনি বিধুরাও চরম উত্তেজনায় আছে।

বিধুর দলে আছে পাঁচজন, সেসহ ছয়জন। এই ছয়জনই দক্ষ তিরন্দাজ। অবশ্য এই দলে এতগুলো তিরন্দাজ রাখার পেছনে একটা গুরুতর কারণ আছে। রাজা বিক্রমের দলটাকে জঙ্গুলে পথে আক্রমণ চালানোর পেছনে অন্যতম একটা কারণ হলো যাতে ওরা সংখ্যায় কম হলেও জঙ্গলের আড়াল নিয়ে শাক্যদের কাবু করতে পারে। আর সেটা করতে হলে শামানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওদের দুটো প্রধান হাতিয়ার হলো; ওদেরকে চমকে দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া। এরপর তাদের ছত্রভঙ্গের সুযোগ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত করা। ছত্রভঙ্গ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে লম্বা দাড়ির দলকে, আর দ্বিতীয় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিধুকে। আর দ্বিতীয়টি করতে হলে তিরন্দাজ বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু বিধু ভয় পাচ্ছে অন্য জায়গাতে। একে তো ওর দলে যারা আছে সে নিজে ওদের তির চালনোর দক্ষতার ব্যাপারে খুব বেশি একটা জানে না। সেইসঙ্গে রাজা বিক্রমের বাহিনী যদি আদৌ এই পথে না আসে তবে একটা ভীষণ ঝামেলা হয়ে যাবে। যদিও থারু বাহিনীর লম্বা দাড়ি ওদেরকে কথা দিয়েছে, তার বহু বছরের অভিজ্ঞতা বলে রাজা বিক্রম কখনোই নিজের বিরাট বাহিনী নিয়ে অন্য পথটাতে যাবে না। কারণ সেটা অনেক বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। কারণ ওই পথে বিধোরী থেকে মন্তলা যেতে হলে তাদেরকে পথিমধ্যে একটা খাল পার হতে হবে, ওই খালের ওপরে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে সেতু বানানো আছে। সেতুটা দিয়ে বড়ো বাহন পার করা খুব কঠিন ব্যাপার। কাজেই লম্বা দাড়ির মতে রাজা বিক্রম এতটা বোকা নয় যে সে বুদ্ধমূর্তি আর বন্দিদেরকে নিয়ে ওই পথে যাবে, বিশেষ করে ওই খাল পার হবার ঝুঁকি সে নেবে বলে মনে হয় না।

আর শামানও ওকে বলেছে যদি কোনোভাবে রাজা বিক্রম অন্য পথ ধরে তবে ওর নাকি একটা আলাদা পরিকল্পনা আছে, কিন্তু সেটা যে কী শামান আর বলেনি। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বিধু আনমনেই একবার হাইম ছাড়ল। নিজেদের লোকদের দেখে নিয়ে সামনে ফিরে তাকাল। প্রত্যেকেই প্রস্তুত, প্রত্যেকেই চিন্তিত। বিধু মনে মনে ভাবল এটা ওদের জন্যে জীবন-মরণের লড়াই, ওদের পরিবার-গোত্র আর নেতৃত্ব রক্ষার লড়াই।

সামনে তাকিয়ে বিধু জঙ্গলের পথের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। ওরা যেখানে অবস্থান নিয়েছে সেখান থেকে আরো পাঁচ শ গজ সামনে অবস্থান নেয়ার কথা লম্বা দাড়ির বাহিনীর। ওরা কেমনভাবে অবস্থান নিয়েছে কে জানে। বিধুর দলের আক্রমণের সাফল্যের একটা বড়ো অংশ নির্ভর করছে আসলে লম্বা দাড়ির বাহিনীর আক্রমণের ওপরে। বিধু জঙ্গুলে পথের অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ শিসের শব্দ শুনে সে ঝট করে ওপরে তাকাল। তার দলের একজনকে তুলে দেয়া হয়েছে গাছের ওপরে—যাতে সে দূর থেকে নজর রাখতে পারে। ওই ব্যাটাই নিশ্চয়ই কিছু দেখেছে, না হলে শিস বাজানোর কথা নয়। বিধু ওপরে তাকাতেই দেখতে পেল লোকটা বানরের মতো দক্ষতার সঙ্গে নেমে আসছে গাছের ওপর থেকে। দেখতে দেখতেই সে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল।

আসতাছে, ওরা আসতাছে,’ লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিধু ওর দলের অন্য কজনের দিকে ফিরে সামান্য মাথা নাড়ল। লোকটাও ওর দিকে একইভাবে মাথা নেড়ে মুখের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করে উঠল। রাতের বেলা জঙ্গলের ভেতরে সাদা পেঁচা এ ধরনের শব্দ করে। লোকটা শব্দটা করে উঠতেই একটু পরেই সামনে জঙ্গল থেকে প্রায় একই ধরনের শব্দ ভেসে এলো।

নিজের লোকদেরকে প্রস্তুত হতে বলে বিধু পিঠের ওপর থেকে ধনুকটা টেনে নামিয়ে ওটাতে ছিলা জুড়ে দিয়ে অন্যহাতে তূণীর থেকে তির বের করে আনল একটা। যথাসম্ভব নিঃশব্দে ওর দলের লোকেরাও অনুসরণ করল ওকে।

মঞ্চ প্রস্তুত, এবার দেখা যাক নাটক কেমন হয়।

বর্তমান
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ

তানভীরের কপালের পাশে পিস্তলটা চেপে ধরেই মোটা গোঁফ ফারুক বলে উঠল, ‘সাবধান, স্মার্ট বয়।’

তানভীর তাকিয়ে আছে বাবুল আহমেদের দিকে, সেও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সময় যেন কিছুক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে রইল। বাবুল আহমেদই হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বলল। তারপর তানভীরের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে কমান্ডার, তুমি যদি এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করাটাকে নিজের অধিকার মনে করো তবে আমি তোমাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করব না,’ বাবুল আহমেদ এই পর্যন্ত বলতেই পাশ থেকে মোটা গোঁফ চট করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাবুল আহমেদ তাকে থামিয়ে দিল।

‘কিন্তু শুধু তুমি যাবে, তোমার টিমের বাকিরা এখানেই থাকবে,’ তানভীর কোনো জবাব দেয়ার আগেই বাবুল আহমেদ নিজের ঠোঁটের ওপরে একটা হাত রেখে বলল, ‘আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। এখানেই শেষ,’ বলে বাবুল আহমেদ তার নিজের একজন লোকের দিকে ফিরে ইশারা করে কী জানি বলল। তারপর সামনে ফিরে সে অপারেশনের ব্রিফিং শুরু করতে বলল।

বাবুল আহমেদের নির্দেশ পাওয়া মাত্র ফারুক উঠে দাঁড়াল। টমির হাত থেকে সরুমতো দেখতে রিমোটটা নিয়ে সে টমিকে ধন্যবাদ জানিয়ে অন্যদের দিকে ফিরে বলতে শুরু করল। ‘সবাইকে ধন্যবাদ, আমি ফারুক হাসান, অপারেশন ব্ল্যাক বুদ্ধার স্পেশাল অপস টিমের প্রধান। আমি আপনাদের সংক্ষেপে পুরো অপারেশনটা বলছি। আমরা সোয়াট টিমে আছি আটজন। আমাদের সঙ্গে থাকবে বাবুল আহমেদ স্যার ও অফিসার তানভীর মালিক। এই হচ্ছে সেই বাংলোটা,’ বলে সে রিমোট টিপতেই বাংলোটার দিনের বেলার একটা ছবি দেখা গেল স্ক্রিনে। আবারো রিমোট টিপতেই সেই ছবিটা সরে গিয়ে বাংলোর একটা থ্রিডি ইমেজ ফুটে উঠল। ‘এটা বাংলোর ফ্রন্ট ভিউ, এটা ব্যাক ভিউ আর এই দুটো সাইড ভিউ, আর এটা টপ,’ বলে সে থ্রিডি ইমেজটাকে ওপর থেকে দেখাল। তারপর বলতে শুরু করল।

তানভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে-বুঝে নিতে লাগল। মূলত সোয়াট টিমের মূল চারটা দলসহ ওরা গাড়িতে করে লাক্কাতুরা মেইন রোডের একটু ভেতরেই নেমে যাবে। চারটে দলের ভেতরে একটা দল সোজা চলে যাবে বাংলোর পেছনের পাহাড়ের পাদদেশে। ওরা মূল অপারেশনে অংশগ্রহণ করবে না। ওরা শুধু বাংলোর পেছনটা গার্ড দেবে। যদি কেউ বাংলোর পেছনের পাহাড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে তবে ওরা সেটা ঠেকাবে। আর বাকি তিন দল পায়ে হেঁটে বাংলোটার বাকি তিনদিক কভার করে এগোবে। বাংলোর দুই পাশে যেহেতু কোনো প্রবেশ পথ নেই কাজেই ফারুকের নেতৃত্বে থাকা সামনের দলটার সঙ্গে দুই পাশে থেকে একজন করে এসে যোগ দেবে ওরা ভেতরে প্রবেশ করার সময়। আর বাকি দুজন দুই পাশে অবস্থান নেবে। মূল অপারেশনটা চালাবে আসলে ফারুকের দল। আর ওদের ঠিক পেছনের ব্যাকআপ টিমে থাকবে বাবুল আহমেদ আর তানভীর।

এই হলো মূল পরিকল্পনা,’ বলে ফারুক শেষ করে সবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কারো কোনো প্রশ্ন?’ কেউ কোনো প্রশ্ন করল না দেখে সে বাবুল আহমেদের দিকে ফিরে তাকাল। বাবুল আহমেদ মাথা নাড়তেই সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘সময় হয়ে গেছে, আমরা মুভ করব। প্রত্যেকেই নিজের গিয়ার চেক করে নাও, বাকি ড্রিলিং তোমরা সবাই জানো।’

প্রত্যেকেই যার যার মতো প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। তানভীর উঠে দাঁড়াতেই একজন তরুণ অফিসার ওকে নিয়ে চলে এলো রুমের কোনোার দিকে। ওখানে সেট করা টেম্পোরারি একটা লম্বা টেবিলের ওপরে অস্ত্র থেকে শুরু করে অপারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের ডিভাইস সাজানো আছে।

প্রথমেই লোকটা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্যে তানভীরকে হেডসেট পরিয়ে দিল। ওটা পরে নিতেই তানভীরকে অস্ত্র চুজ করতে বলল। তানভীর দেখল টেবিলের ওপরে হ্যান্ডগান থেকে শুরু করে শর্ট রেঞ্জে যুদ্ধ চালানোর মতো সব ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র সাজানো আছে। ওর ডেজার্ট ঈগলটা জেড মাস্টারের লোকেরা নিয়ে গেছে, কাজেই ওর এখন একটা অস্ত্র দরকার। তানভীর একটা নইন এম এম হ্যান্ডগান তুলে নিতেই লোকটা হোলস্টারসহ ওর জ্যাকেটের ভেতরে সেট করে দিল জিনিসটা।

‘স্যার, এটাও রাখতে পারেন,’ বলে লোকটা একটা মাঝারি সাইজের কমান্ডো নাইফ দেখাল। পাটোয়ারীর দেয়া স্টিলেটোর চেয়ে বেশ বড়ো ছুরিটা। স্টিলেটোটা যেহেতু হারিয়ে ফেলেছে কাজেই এটাই ভরসা। জিনিসটা খাপসহ ওর জিন্স প্যান্টের ভেতরে হাঁটুর নিচে সেট করে দিল সে। সব আরেকবার পরীক্ষা করে নিচ্ছে এমন সময় বাবুল আহমেদ বলে উঠল, ‘সবাই প্রস্তুত? কমান্ডার?’

তানভীর মাথা নেড়ে জবাব দিল, ‘আমি রেডি। চলুন দেখা যাক ভাগ্য কী অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে আমাদের জন্যে।

অতীত
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর

দেখতে দেখতেই জঙ্গুলে পথের অন্যদিকে আলো দেখা গেল। নড়তে থাকা মশালের আলোগুলো দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় ওগুলো ঘোড়সওয়ারদের হাতে ধরা মশালের আলো। দলটা আকারে বড়ো হলেও বিধু অনুমান করল ওরা যতটা আন্দাজ করেছিল দলটা ততটা বড়ো নয়। তারপরেও মশালের আলোয় মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে দলে অন্তত বিশ থেকে পঁচিশজন ঘোরসওয়ার আছে, আর চারটে ঘোড়ার গাড়ি। এর ভেতরে দুটো রাজকীয় গাড়ি আর বাকি দুটো সাধারণ কাঠের গাড়ি। বিধু আন্দাজ করল রাজকীয় গড়িগুলোর ভেতরে রাজা বিক্রম আর তার রাজ দরবারের গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা আছে। আর বাকিদুটোর একটাতে বন্দিরা আর অন্যটাতে অবশ্যই সেই বুদ্ধমূর্তি।

দলটা বেশ বীরদর্পে দ্রুত গতিতে বিধুদের অবস্থান পার হয়ে সামনে চলে গেল। বিধুরা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। বিধুর হিসেব যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে এক্ষুণি খেলা শুরু হয়ে যাবে। দলটা দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপার কি, থামছে না কেন ব্যাটারা। কথাটা বিধু মনে মনে ভেবে শেষও করতে পারল না তার আগেই দলের একেবারে সামনের দিক থেকে ভেসে এলো হেসা ধ্বনি। আচমকা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরলে সাধারণত ঘোড়া এরকম শব্দ করে ওঠে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল বিধু, যাক রাস্তা আটকানোটা ভুল হয়নি, গাছগুলো থামাতে পেরেছে দলটাকে।

জঙ্গুলে পথটা ঠিক যেখানে বাঁক নিয়ে অন্যদিকে রওনা দেবে তার আগ দিয়ে রাস্তার ওপরে ডালপালাসহ পড়ে আছে বিরাট আকারের দুটো গাছ। এমনিতে যদি শুধু গাছ দুটো পড়ে থাকত তবে ঘোড়সওয়ারদের জন্যেও দুটোকে টপকে যাওয়া অতটা কঠিন হতো না কিন্তু গাছদুটো পড়ে আছে ডালপালাসহ, আর তা ছাড়া ঘোড়সওয়ারেরা পার হতে পারলেও ডালপালাসহ গাছ টপকে ঘোড়ার গাড়ি কোনোমতেই পার হতে পারবে না। রাজার বহরের লোকজনের ভেতরে যারা আছে তারা গাছ দুটো দেরিতে দেখতে পেলেও দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে থামালোই, সেইসঙ্গে হাত তুলে পেছনে বাকিদের থামতে বলল। কিন্তু ভুল হয়ে গেল হিসেবে। কারণ একে তো দলটা চলছিল বেশ দ্রুত গতিতে তার ওপরে এরকম হঠাৎ করে থামতে বলাতে পেছনের অনেকেই সময়মতো থামতে পারল না।

পুরো দলটা একটা সুশৃঙ্খল দল থেকে মুহূর্তের ভেতর তালগোল পাকিয়ে গেল। আর এটাই চেয়েছিল শামানের দলের লোকেরা। সেই সুযোগও নিল তারা পুরোপুরি। দলটার সামনের দিকের প্রহরীরা পড়ে থাকা গাছগুলোর সামনে এসে পরীক্ষা করতে লাগল। খুবই অল্প সময় লাগল তাদের এটা বুঝতে যে এগুলো এমনি উপড়ায়নি বা ঝড়ে পড়েনি। এগুলোকে কাটা হয়েছে। প্রহরীদের প্রধান চিৎকার করে দলের সবাইকে সাবধান করে দেয়ার আগেই ধপ করে জঙ্গলের দু পাশে আলো জ্বলে উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের পথের দু পাশ থেকে দুটো বিরাট আকারের জ্বলন্ত গাছের গুঁড়ি গড়িয়ে এসে পড়ল ওদের ওপরে। প্রথম গুঁড়িটা ছোড়া হয়েছিল সৈন্যদেরকে লক্ষ্য করে। ওটা সরাসরি সৈন্যদেরকে আঘাত না করলেও যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের মাথার ওপর দিয়ে ছিটকে গিয়ে লাগল যারা ঘোড়ায় বসে ছিল তাদের ওপরে। বেশ কয়েকজন সৈন্যসহ কয়েকজন ছিটকে পড়ল এদিক- সেদিকে, আগুন ধরে গেল বাকিদের গায়ে। দ্বিতীয় গুঁড়িটা সোজা ছিটকে এসে পড়ল প্রথম ঘোড়ার গাড়িটার ওপরে। ফলাফল হলো ভয়ংকর। গুঁড়িটা ছিটকে এসে ঘোড়ার গাড়ির কাঠের অংশটাকে একেবারে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে পথের ওপরে গড়িয়ে পড়ল আধা ভাঙা গাড়ি, মৃত কাচোয়ান আর আহত ঘোড়াসহ।

রাজা বিক্রমের দলের প্রথম অংশটা প্রায় বিধ্বস্ত হবার সুযোগ নিয়ে জঙ্গলের দু পাশ থেকে তলোয়ার আর বর্শা হাতে ওদের ওপরে আক্রমণ চালাল লম্বা দাড়ি আর তার বাহিনী। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর অনেকে পেছন থেকে যখন দেখল সামনের পথ বন্ধ অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে রওনা দিল। এবার কাজ শুরু করল বিধুর বাহিনী।

রাজা বিক্রমের দলের শেষভাগে ঘোড়ার গাড়িগুলোর শেষে ছিল ঘোড়সওয়ার বাহিনী। বিধু অনুচ্চ স্বরে শিস দিতেই দুই পাশ থেকে তিরন্দাজ বাহিনী পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। সেইসঙ্গে শুরু হলো তিরবৃষ্টি। বিধুর ছুড়ে দেয়া প্ৰথম তিরটা গিয়ে লাগল এক ঘোড়সওয়ারে ঘোড়াতে। ঘাড়ের কাছে তির খেয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়া। গিয়ে পড়ল আরেক ঘোড়ার ওপরে, দুটো ঘোড়া থেকেই ছিটকে পড়ল ওপরে বসা সৈনিক।

জঙ্গলের কিনারায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিধু, পিঠের ওপর থেকে তিরভর্তি তূণীরটা নামিয়ে আনল মাটিতে। একের পর এক তির ছুড়তে শুরু করল সামনের লক্ষ্যের দিকে। সেই সঙ্গে দুই পাশ থেকে সম্মিলিত আক্রমণ চালাল দলের বাকিরা। কিছুক্ষণ টানা তির ছুড়ে বিধু একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল সবাই। শেষ একটা ইশারা করতেই দুজন এগিয়ে এলো সামনের দিকে। একজনের হাতে চামড়া দিয়ে গোল করে বানানো বলের মতো বিশেষ তরলভর্তি গোলক, অন্যজনের হাতে চকমকি। চকমকি ঠুকে গোলকের মাথায় আগুন দিয়ে সেটা সে ছুড়ে দিল পথের ওপরে সৈন্যদের মাথার ওপরে। এক চোখ বন্ধ করে নিখুঁত লক্ষ্যে তির ছুড়ল বিধু। গোলকটা যখন সৈনিকদের মাথার ওপরে তিরটা গিয়ে ফাটিয়ে দিল ওটা। আগুনের গোলার মতো বিস্ফোরিত হলো বিশেষ তরলভর্তি গোলক। টুকরো-টুকরো আগুন ছড়িয়ে পড়ল অস্থিরভাবে নড়া-চড়া করতে থাকা সৈনিকদের মাথার ওপরে-গায়ে, সেই সঙ্গে সবশেষে থাকা ঘোড়ার গাড়িটার কাঠের শরীরের ওপরেও। প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল গায়ে আগুন ধরা সৈনিকরা।

‘এইবার,’ বলে বিধু উঠে দাঁড়াল। তিরভর্তি তূণীরটা পিঠের ওপরে নিয়ে নিজের দলকে সমান্তরালে সাজিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। জীবিত কোনো সৈনিক দেখা মাত্রই তির ছুড়তে লাগল।

রাজা বিক্রমের দলের প্রহরীদের প্রধান দেখল অবস্থা খুবই খারাপ সামনে ওদের সৈন্যদল আক্রান্ত তলোয়ার বাহিনী দ্বারা আর পেছন থেকে ভেসে আসছে সৈনিকদের আর্তনাদ, ওইদিকে কী হচ্ছে কে জানে। তবে এটা বুঝতে তার সময় লাগল না যে ওইদিকটাতেও তাদের বাহিনী আক্রান্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে তারা আটকা পড়ে গেছে জঙ্গলে পথের একেবারে মাঝামাঝি জায়গায়। সামনে এগোবার পথ বন্ধ তার ওপরে পেছনে যাবারও উপায় নেই। সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, পালাবার একটাই উপায় আছে। নিজের সৈনিকদের উদ্দেশ্যে সে চেঁচিয়ে উঠে পালাতে বলল সবাইকে। সেইসঙ্গে নিজে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আক্রমণরত এক থারু সৈন্যকে ঘায়েল করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দৌড় দিল তৃতীয় গাড়িটার দিকে। গাড়ির কাচোয়ান নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। প্রহরী প্রধান লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কাচোয়ানের বসার জায়গায়। এক হাতে কাচোয়ানকে ধরে ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে তারপর কাচোয়ানের বসার জায়গায় উঠে চাবুক চলাল একহাতে।

দুই পাশেই রাস্তা প্রায় বন্ধই বলা চলে। তবুও সে পালাবার উদ্দেশ্যে একহাতে চাবুক তুলে সর্বশক্তিতে সেটা নামিয়ে আনতে যাবে ঘোড়ার পিঠের ওপরে তার আগেই কিছু একটা এসে জড়িয়ে ধরল তার হাতে। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে ছিটকে পড়ল সোজা ঘোড়ার গাড়ি থেকে মাটিতে।

শামান নিজের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে এলো। একহাতে থেমে যাওয়া ঘোড়ার গাড়িটা টেনে থামিয়ে ফিরে তাকাল মাটিতে পড়ে যাওয়া প্রহরী প্রধানের দিকে। ‘আমরা জানতাম দুই পাশে আক্রান্ত হলে তোমরা জঙ্গলে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। আর সেজন্যে প্রস্তুত ছিলাম আমরা,’ বলে সে উঠে বসল ঘোড়ার গাড়িতে। ওটাকে আবারো চালিয়ে নিয়ে এলো পথের ওপরে। ওখানে পথের দু পাশে লম্বা দাড়ি আর বিধুকে দেখতে পেল শাক্যদের গাড়ি আর কিছু আত্মসমর্পণ করা সৈনিকদের পাহারা দিতে।

শামানকে দেখে হেসে উঠে অভিবাদন জানাল। ‘ওস্তাদ, জিতে গেছি আমরা, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল বিধু। শামান কিছু না বলে ঘোড়ার গাড়িটাকে থামিয়ে নেমে এলো। ও জানে প্রাথমিক জয় নিশ্চিত হলেও এখনো অনেক কাজ বাকি।

ও নামতেই লম্বা দাড়ি এসে পরিস্থিতি জানাল। ‘হুজুর, আপনি যেভাবে বলছিলেন সেভাবেই আক্রমণ করা হয়েছে। আর তাতে কাজও হয়েছে। কিছু সৈনিককে বন্দি করা হয়েছে বাকিরা পালিয়ে গেছে কিন্তু রাজা বিক্রম বা শংকরাদিত্যকে দেখিনি আমরা কেউই।’

‘দেখা যাক, এগুলোর ভেতরে আছে কি না?’ বলে শামান বিধু আর লম্বা দাড়িকে নিয়ে চলে এলো গাড়িটার পেছন দিকে। যেহেতু প্রহরী প্রধান এটাকে নিয়ে পালাচ্ছিল তারমানে এটাতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে। গাড়ির কাঠের পাল্লার কবজা খুলে সবাইকে সাবধান থাকতে বলে দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলল শামান। গাড়ির ভেতরে মানুষ থাকতে পারে, জিনিস থাকতে পারে, ভেতর থেকে আক্রমণ হতে পারে এরকম অনেক কিছুই ভেবেছিল শামান কিন্তু যা দেখল এরকম কিছু ভাবেনি ও।

ভেতরটা একদম ফাঁকা। কিছুই নেই।

বর্তমান
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ

কনফারেন্স রুমের বাইরে বেরিয়ে তানভীর দেখল টমি-সুলতান আর ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে। বাবুল আহমেদের কাছে একটু সময় চেয়ে নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল তানভীর।

‘তোমরা হয়তো জেনে গেছো আমি মূল অপারেশনে যাচ্ছি কিন্তু তোমাদেরকে’-

‘বস সেটা কোনো ব্যাপার না কিন্তু সাবধান,’ সুলতান বলে উঠল। ‘পাশা স্যার কতদূর?’ তানভীর প্রসঙ্গ এড়িয়ে জানতে চাইল।

‘সিলেটের কাছাকাছি, একেবারে সঠিকভাবে জানি না আর কতক্ষণ লাগবে কিন্তু উনি চলে আসবেন ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই,’ সুলতান তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছু না বলে মুখটা সুলতানের কানের বেশ কাছাকাছি মুখ নিয়ে এলো তানভীর। তারপর মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘পৌঁছানো মাত্রই পাশা স্যারকে ব্রিফ করবে। আর হ্যাঁ, আমি তো সাবধান থাকবই, তোমরাও সাবধান,’ বলে তানভীর একবার আঙুল তুলে ভি-সাইন দেখিয়ে রওনা দিল বাইরের দিকে।

বাইরে বেরিয়ে দেখল ইএএফের সোয়াট কমান্ডোরা দুটো গাড়ির সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোটা গোঁফ তাদের আরেক দফা ব্রিফ করা হয়ে যেতেই দুটো গাড়িতে উঠে পড়ল ওরা। প্রথমে একটা জিপে বাকি কমান্ডোরা। পেছনে ইএএফের একটা সিভিল মাইক্রোতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে মোটা গোঁফ ফারুক, আর পেছনের সিটে বাবুল আহমেদের সঙ্গে তানভীর।

রাতের বেলা এই রাস্তায় সিলেটের বাইরে থেকে প্রচুর পাথর বহনকারী ট্রাক ঢোকে। সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দু পাশে। ট্রাকগুলোর দিকে তাকিয়ে তানভীরের মনে পড়ে গেল সাস্টে পড়াকালীন সময় মাঝে মাঝে রাতের বেলা এসব ট্রাকে চড়ে ওরা জাফলং চলে যেত বেড়াতে। ওরা কিছুক্ষণ আম্বরখানার রাতের জ্যামে আটকে রইল। তারপর সারি সারি নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পাশ দিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে যেতে শুরু করল ওদের গাড়ি দুটো। বাবুল আহমেদ ফোনে কথা বলেই চলেছে। তানভীর জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবতেই অবাক লাগছে খুব বেশ সময় আগে নয় ডক্টর মিতায়নকে এই রাস্তা দিয়ে লাক্কাতুরার বাংলো থেকে উদ্ধার করে এনেছিল ওরা। এই অল্প সময়ের ভেতরেই কত কী বদলে গেছে। এখন চলেছে ছদ্মবেশী ডক্টর মিতায়ন ওরফে জেড মাস্টারকে সেই একই বাংলোতে অভিযান চালিয়ে ধরে আনার জন্যে।

‘আচ্ছা ডক্টর প্রবীরের ওপরে কি নজর রাখা হচ্ছে?’ বাবুল আহমেদের ফোনে কথা বলা শেষ হতেই তানভীর জানতে চাইল।

বাবুল আহমদ হেসে উঠল। ‘ব্যাটার কোনো নড়াচড়া নেই। সে ল্যাবেই আছে। একেবারেই স্বাভাবিক। সেই একটা ফোন কলের পরে আর কোনো কলও করেনি সে। একবার ভেবেছিলাম ব্যাটাকে ধরে ডলা দিই।’

তানভীর ঝট করে ফিরে তাকাল বাবুল আহমেদের দিকে। সর্বনাশ, তারপর?’

‘নাহ, ওরকম কিছু করা হয়নি। কারণ পরে ভাবলাম, এই ব্যাটাকে ধরলে যদি কোনোভাবে বাংলোর ওরা সতর্ক হয়ে যায়। কারণ হয়তো তার নির্দিষ্ট সময় পর পর যোগাযোগের করার কথা। এই ব্যাটাকে ধরে ফেললে তো আর সেটা হবে না তারচেয়ে বরং সবকিছু স্বাভাবিকই থাক।’

স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল তানভীর। ভালোই করেছেন,’ কথাটা বলে ও সিটে হেলান দিয়ে একবার নিজের অস্ত্রটা বের করে চেক করে নিল। একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে, আর কতদূর রাস্তা বাকি। কিন্তু সেটা করার আগেই সামনে থেকে মোটা গোঁফ জানাল, ওরা প্রায় চলে এসেছে। ওদের গাড়ি আরো কিছুদূরে এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে খানিকটা বাঁক নিয়ে একটু বামে মোড় নিয়ে সেই রাস্তায় নেমে পড়ল—যেটা দিয়ে এর আগেরবার ওরা বাংলোতে গেছিল। অভিজ্ঞ ড্রাইভার আগেই হেডলাইট নিভিয়ে দিয়েছিল, পাশের কাঁচা রাস্তায় নামতেই সে গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে অন্ধকার জায়গায় থামিয়ে দিল।

‘সবাই খুব সাবধান। কোনো শব্দ করা চলবে না, এন্টারনাল কমিউনিকেশন ডিভাইস বাদে সব ধরনের মোবাইল ইত্যাদি বন্ধ,’ ওরা নেমে আসতেই সবাইকে সাবধান করে দিল ফারুক। ওরা দল ধরে সামনে এগোল সারি দিয়ে। আরেকটু এগোতেই ফারুক সবাইকে থামতে ইশারা করল। সবাই থেমে যেতেই মৃদু শিস বাজাল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একই ধরনের শিসের শব্দ ভেসে এলো। একটু পরেই অন্ধকারের ভেতর থেকে ভূতের মতো কালো পোশাক পরা এক লোক এসে হাজির হলো।

বাবুল আহমেদের সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকে ফারুকের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নোয়াল। ‘হাফিজ, এখানকার কী অবস্থা? কোনোরকম মুভমেন্ট?’

‘না স্যার, বাড়ির ভেতরে খুবই সামান্য আলো জ্বলছে। কিছু নড়াচড়া ছাড়া বিশেষ কিছু ঘটেনি। কেউ বেরও হয়নি, ঢোকেওনি,’ হাফিজ নামের লোকটা রিপোর্ট করল।

‘ঠিক আছে, তোমরা পোস্টে ফিরে যাও, আমরা এগোব,’ বলেই ফারুক বাকিদের দিকে ফিরে ইশারা করল। ওরা আবারো সারি দিয়ে এগোল, বেশ খানিকটা এগিয়ে বাংলোতে ওঠার পাহাড়ি ঢাল শুরু হতেই ওরা মূল রাস্তা এড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এখান থেকেই একটা দল চলে গেল পাহাড়ি ঢালের অন্যপাশে। ওরা বাংলোর পেছনটা কভার করবে। বাংলো থেকে যদি কেউ নাইটভিশনে চোখ রাখে থাকে তবুও ওদেরকে দেখতে পাবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। জঙ্গলে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে ওরা বাংলোর একেবারে কাছাকাছি চলে এলো। বাংলো থেকে হাজারখানেক গজ দূরত্বে এসে নিঃশব্দে সবাইকে থামার ইশারা করে ফারুক একবার নিজের তর্জনী তুলে শূন্যে ঘোরাল। সঙ্গে সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত দলে ভাগ হয়ে গেল কমান্ডোরা।

বাংলোটা থেকে খুবই মৃদু আলো ভেসে আসছে। ভালোভাবে খেয়াল না করলে ঠিক বোঝাও যাবে না। দূর থেকে বোঝা তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বাংলোর পাঁচশ গজের ভেতরে প্রবেশ করতেই বাংলোর দু পাশে দুজন বাদে বাকিরা যোগ দিল ফারুকের সঙ্গে। ফারুকদের ঠিক পেছনেই তানভীর আর বাবুল আহমেদ। প্রত্যেকেই প্রস্তুত। বাংলোর কাঠের বেড়া টপকে ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল।

তানভীর দেখল গতবারের অভিযানের ফলস্বরূপ এখানে ওখানে কিছু ভাঙাচোরা এটা-সেটা ছড়িয়ে আছে। বাংলোর সামনেই তেরপলে ঢাকা একটা গাড়ি দাঁড় করানো। তানভীর অনুমান করল এটাই সম্ভবত সেই অ্যাম্বুলেন্স যেটাতে করে তারা এখানে এসেছে। ফারুক ওদেরকে থামতে বলে নিজেরা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ওরা সেই পুরনো খোঁয়াড়টার পেছনে আড়াল নিল। তানভীর দেখল বাবুল আহমেদ হাঁপাচ্ছে। তানভীর নিজের অস্ত্র সামলে সামনের দিকে উঁকি দিল। ফারুকরা বারান্দায় উঠে পড়েছে।

‘স্যার, আমরা কি এগোব না?’ তানভীর অস্থির হয়ে জানতে চাইল।

‘প্রশ্নই আসে না। আমরা এখানেই অপেক্ষা করব,’ বাবুল আহমেদ হাঁপাতে- হাঁপাতে জবাব দিল। এইটুকু পথ পাড়ি দিতেই সে হাঁপিয়ে গেছে। তানভীর উঁকি দিয়ে দেখল ফারুকরা দুজনে বাংলোর দরজার দু পাশে অবস্থান নিয়েছে আর একজন কমান্ডো দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। ফারুক এক-দুই-তিন গুনতেই কমান্ডোটা এগিয়ে লাথি মারল দরজায়। কিন্তু তানভীর অবাক হয়ে দেখল দরজা খোলাই ছিল। কমান্ডোটা লাথি মারতেই সেটা ধাম করে খুলে গিয়ে জোরে বাড়ি খেল অন্যপাশের দেয়ালে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিস্ফোরণ হলো। দরজায় লাথি মারা কমান্ডো বিস্ফোরণের ধাক্কায় বারান্দা থেকে ছিটকে এসে পড়ল একেবারে লনের ওপরে।

অতীত
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর

‘সর্বনাশ, ভেতরে তো… ফাঁকা গাড়ি দেখে বিধু বলে উঠল। বিধুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শামান চেঁচিয়ে উঠে বাকি ঘোড়ার গাড়িগুলোকে খোলার নির্দেশ দিল ও। ওপাশ থেকে প্রথমটা খুলে লম্বা দাড়ি চেঁচিয়ে জানাল ওটাও খালি। শামানের মনে হলো এরকম বোকা ও জীবনেও বনেনি। এই সফরের পুরোটাই সাজানো হয়েছে ওদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে। পথের অন্যপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠে থারু সৈনিকেরা জানাল ওই গাড়িদুটোও ফাঁকা।

‘ওস্তাদ এইডা কি হইলো?’ বিধুর কথার জবাবে শামান কিছু না বললেও হেসে উঠল শাক্যদরে প্রহরীপ্রধান।

‘বোকার দল, এই পুরা যাত্রাটাই সাজানি হইছে তগো বোকা বানানির লাইগা, জাথুরিয়া যারে দিয়া তগোরে খবর পাঠাইছে হেই লোকেই রাজা বিক্রমরে সব জানাই দিছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে। তাই রাজায় পরিকল্পনা বাতিল না কইরা একটু পরিবর্তন করছে। এইদিকের রাস্তায় একটা দল পাঠাইছে যাতে তরা এইদিকে ব্যস্ত থাকতে পারোস। আর অন্য রাস্তা দিয়া…’ লোকটার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে রইল না শামান, তার আগেই ও চট করে সরে এলো ওখান থেকে। যা বোঝার বুঝে গেছে।

শামান দৌড়ে এসে একটা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে লাফিয়ে উঠে বসল ওটাতে। বিধু আর লম্বা দাড়িও দৌড়ে আসছিল ওর পিছু-পিছু, ওকে ঘোড়ায় উঠতে দেখে থেমে গেল ওরা।

‘ওস্তাদ, এখন কি—’  

লম্বা দাড়িকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে উঠল, ‘তোমরা এখানকার কাজ গুছিয়ে যতটা দ্রুত পারো মন্তলার হাটে পৌঁছাও। ওখানে পৌঁছে অস্ত্রসহ সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত থাকবা। আর আমার নির্দেশের অপেক্ষা করবা।’

‘কিসের নির্দেশ, পেছন থেকে জানতে চাইল বিধু—কিন্তু জবাব না দিয়ে ততক্ষণে পূর্ণবেগে ঘোড়া ছোটাতে শুরু করেছে শামান। ঘোড়া নিয়ে সোজা জঙ্গলে প্রবেশ করতে করতে ও মনে মনে ভাবতে লাগল, এখনো একটা উপায় আছে যদি রাজা বিক্রমের বহর সেই বাঁশের সেতু না পার হয়ে থাকে।

শামান এই কয়দিনের যাতায়াতে মোটামুটি পথ চিনে ফেলেছে। ও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ঘোড়া ছোটাল। ওর ভাবনা যদি ভুল না হয় তবে ও এই মুহূর্তে যেখানে আছে সেখান থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মাইল তিনেক উত্তরের দিকে এগোতে পারলে ও সেই পথের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে যেটা দিয়ে রাজা বিক্রমের বাহিনী মন্তলার হাটের দিকে চলেছে। ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে ও মনে মনে হিসেব করল রাজা বিক্রমের বাহিনীর বর্তমান সম্ভাব্য অবস্থান কোথায় হতে পারে। ওরা যখন প্রথম বাহিনীর পিছু নিতে শুরু করে তার ঠিক পর দিয়েও যদি রাজা বিক্রমের বাহিনী মন্তলার হাটের দিকে রওনা করে থাকে তবে এই ঘুর পথে যেতে যেতে ওদের সময় অনেক বেশি লাগার কথা তার ওপরে ওরা যদি ওই কাঠের সেতু পার হতে চায় তবে অবশ্যই ওদেরকে অনেক বেশি সময় নিতে হবে। কাজেই এখনো একটু হলেও আশা আছে। শামান ঘোড়ার গায়ে আরো জোরে চাপড় লাগাল।

আধা ঘণ্টার ভেতরে শামান সেই পথের ধারে পৌঁছে গেল-কিন্তু কোথাও কারো চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না।

ব্যাপার কি? কাউকেই দেখা যাচ্ছে না কেন? ও কি তবে ভুল পথে চলে এলো?

সেই সেতুটাও তো দেখতে পাচ্ছে না। ডানে না বামে এগোবে ঠিক বুঝতে পারছে না শামান। মনে মনে দিকের হিসেব করে ঠিক সন্তুষ্ট না হলেও ও আন্দাজ করল, ডানে এগোনোটাই উত্তম হবে। রাস্তাটাকে হাতের বামে সমান্তরালে রেখে জঙ্গলে প্রবেশ করে এগোতে লাগল ও। আধ মাইলের মতো এগোতেই সামনে মানুষের হাঁক-ডাক শোনা যেতে লাগল। মনের ভেতরে আশাবাদী হয়ে উঠল শামান। ঘোড়ার গতি কমিয়ে আনল।

আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল সেই সেতুটা একে একে পার হচ্ছে রাজা বিক্রম বাহিনীর লোকেরা। একদল সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে সেতুর এপাড়ে, সেইসঙ্গে একটা কাঠের গাড়ি। রাজা বিক্রমকেও দেখতে পেল ও ঘোড়ার পিঠে। লোকটাকে দেখে দাঁতে দাঁত পিষল শামান।

আরেকটা ঘোড়ার গাড়ি সেতু পার হচ্ছে। সবাই সেদিকে তাকিয়ে আছে। লোকজন হাঁক-ডাক করছে। শামান ধীরে ধীরে ঘোড়া থেকে নেমে এলো। ঘোড়টাকে জঙ্গলের ভেতরে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ও উঠে পড়ল রাস্তার ওপরে ঝুঁকে আছে এমন একটা গাছের ওপর। ভয়াবহ একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে ও। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

গাছের ওপরে উঠেই দেখতে পেল দ্বিতীয় গাড়িটা প্রায় সেতু পার হয়ে চলে এসেছে। গাড়িটা এপাড়ে আসতেই রাজা বিক্রমের দলের বাকি লোকেরা দ্রুতই এপাড়ে চলে এলো। শামান মনে মনে হিসেব করছে দুটো গাড়ির কোনোটাতে মূর্তিটা থাকতে পারে। প্রথম গাড়িটা দ্বিতীয়টার চেয়ে তুলনামূলক ছোটো। যদিও পুরোপুরি নিশ্চিত হবার উপায় নেই তবুও মোটামুটি ও আন্দাজ করে নিল মূর্তিটা সম্ভবত প্রথম গাড়িতেই আছে, আর দ্বিতীয় গাড়িতে আছে সম্ভবত বন্দিরা

শামান খুব সাবধানে অবস্থান নিয়ে আছে। এসব কাজে ওর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু সবকিছু এমনভাবে লোকবেষ্টিত হয়ে আছে যে চাইলেও ওর মতো দক্ষ কসরৎকারীর পক্ষেও কিছু করা সম্ভব নাও হতে পারে। বিশেষ করে যে-কাজটা ও করতে যাচ্ছে। সেতুটা পার হয়েই রাজা বিক্রমের দলটা আবারো দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করল। শামানের যতটুকু মনে পড়ে এখান থেকে মন্তলার হাট একেবারেই কাছে। হয়তো মাইলখানেক হবে বড়োজোড়। কাজেই এখান থেকেই দ্রুত পথ চলতে শুরু করার কারণটা আন্দাজ করা যায় সহজেই।

দম বন্ধ করে গাছের ওপরে অবস্থান নিয়ে ও নিচ দিয়ে রাজা বিক্রমের বাহিনীকে এগিয়ে যেতে দেখল। দলের একেবারে অগ্রভাগে একটা সাদা ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে চলেছে রাজা বিক্রম। তার সঙ্গে নিজের বাহিনী। ওদের পিছু পিছু চলেছে ঘোড়সওয়াররা। তার ঠিক পেছনে শংকরাদিত্যকে দেখতে পেল ও। তার নেতৃত্বে দুটো গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আগে ছোটো গাড়িটা সামনে থাকলেও সেতু পার হবার পর বড়ো গাড়িটাকে আগে দেয়া হয়েছে। শামান যে গাছের ডালে অবস্থান নিয়ে আছে সেটার নিচ দিয়ে চলে যাবার সময়ে বড়ো কাঠের গাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে একটু হলেও স্বস্তি বোধ করল শামান। তারমানে মূর্তিটা দ্বিতীয় গাড়িতে থাকার সম্ভাবনা বেশি। প্রথম গাড়িটা পার হয়ে চলে যেতেই শরীরটাকে একেবারে টান-টান করে ফেলল ও।

দ্বিতীয় গাড়িটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। শরীরটাকে আরো টান করে দিল শামান, গাড়িটা ঠিক গাছের নিচে আসা মাত্রই অনেকটা গড়িয়ে পড়ার মতো শরীরটাকে ছেড়ে দিল ও নিচের দিকে। বানর যেভাবে কোনো উঁচু জায়গা থেকে নিচের দিকে লাফ দিয়ে পড়ে, অনেকটা তেমন ভঙ্গিতে ঝুপ করে কাঠের গাড়িটার ওপরে পড়ল ও।

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভেতরে নড়ে উঠল কেউ একজন।

বর্তমান
লাক্কাতুরা টি-এস্টেট, সিলেট

বিস্ফোরণের ধাক্কায় দুজন কমান্ডো লনে ছিটকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বারান্দায় অবস্থানরত বাকি দুজনেই খক-খক করে কাশতে শুরু করেছে। ‘ব্লাডি হেল,’ বলে তানভীর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। পিস্তল হাতে সাবধানে কিন্তু দ্রুত এগোল বাংলোর দিকে। বারান্দায় ফারুক আর তার সঙ্গী অনেকটাই সামলে নিয়েছে। ওরা সোজা হতে-হতেই তানভীরও পৌঁছে গেল।

তানভীরকে দেখে ফারুক বলে উঠল, ‘অ্যামবুশ, দরজায় বোমা সেট করা ছিল। তারমানে ওরা ভেতর থেকে দরজা কভার করছে। ভেতরে ঢুকলেই গুলি করবে।

‘তাহলে আমরা একজন বাইরে থেকে কভার করব। অন্য দুজন ভেতরে ঢুকব। ঠিক আছে?’ তানভীরের কথা শেষ হতেই তার হাতে দুটো বলের মতো জিনিস ধরিয়ে দিয়ে ফারুক মাথা ঝাঁকিয়ে গুনতে শুরু করল। ‘এক-দুই-তিন…’

তিন পর্যন্ত গোনা শেষ হতেই তানভীরের হাতে ধরিয়ে দেয়া ফ্ল্যাশ গ্রেনেড আর স্মোক বম্ব দুটোই পিন খুলে ছুড়ে দিল ভেতরের দিকে। দরজার দু পাশ থেকে সাবমেশিনগান দিয়ে ভেতরে গুলি করতে শুরু করল ফারুক আর তার সঙ্গী। টানা দশ সেকেন্ড গুলি করেই থেমে গেল ওরা। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর দিকে লাফ দিল তানভীর।

অনেকটা অন্ধের মতোই ভেতরে ডাইভ দিয়ে হাঁটুর ওপরে ভর দিয়ে সোজা হলো ও। ঘরের একপাশে একটা উল্টানো টেবিল আর অন্যপাশে একটা সোফা দেখতে পেল। সম্ভবত এই দুটোর আড়ালেই অবস্থান নিয়েছে ওরা। টেবিলটাকে লক্ষ্য করে এক পশলা গুলি করল ও। টেবিলের আড়াল থেকে চিৎকার ভেসে আসতেই ও ঘুরে যেতে শুরু করল সোফার দিকে কিন্তু তার আগেই বুকের একপাশে গুলির ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল আবার। সোফার আড়াল থেকে গুলি করেছে কেউ। মাটিতে পড়ে ব্যথার চোটে দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। বুকের বাতাস সব বেরিয়ে গেছে। গুলি ভেস্টর ওপরে লাগলেও ব্যথার পরিমাণ ভয়াবহ। ও সোজা হবার আগেই দেখল ফারুক আর তার সঙ্গী ভেতরে ঢুকে পড়েছে। দুজনেই সোফা লক্ষ্য করে সমানে গুলি করতে শুরু করল।

ওদের গুলি থামতেই চুপ হয়ে গেল সব। ঘরের ভেতরে এখনো ধোঁয়ায় অন্ধকার। তানভীর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সোফার আড়ালে থাকা লোক দুজনকে দেখল। এরা কেউই জেড মাস্টার না। বাংলোর ভেতরের দিকে ঢুকতে ইশারা করল। ফারুক সবার সামনে, তার পেছনে তানভীর তার পেছনে কমান্ডোরা। একে অপরকে কভার করে এগোল ওরা। ভেতরের করিডরে ঢুকতেই দরজার আড়াল থেকে কেউ একজন ফারুকের সাবমেশিনগানের নল চেপে ধরে ঘুরিয়ে দিল অন্যদিকে। সেইসঙ্গে একটা ছুরি বসিয়ে দিল ফারুকের বুকে। কিন্তু ভেস্টে আটকে গেল সেটা। ফারুককে দরজায় আটকে ফেলাতে পেছন থেকে ওরাও কোনো সাহায্য করতে পারছে না। দুজনেই ধস্তাধস্তি করছে, তানভীর মাটিতে বসে আক্রমণকারীর পা লক্ষ্য করে গুলি করল।

লাথি খাওয়া কুকুরের মতো ‘কেঁউ করে’ শব্দ করে লোকটা টালমাতাল হয়ে গেল। হাত আলগা হয়ে যেতেই লোকটার খুঁতনির নিচে সাবমেশিনগান ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দিল ফারুক। মানুষটা পড়ে যেতেই ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল। কেউ একজন বন্দুক হাতে দাঁড়িয়েছিল করিডরের শেষ মাথায় কিন্তু গুলি না করে সে উলটো ঘুরে দৌড় দিল ভেতরের দিকে। ফারুকও দৌড় দিল তার পিছু-পিছু। তানভীর দেখল লোকটা সেই বেডরুমের দিকে দৌড়াচ্ছে ওখানেই এর আগেরবার ডক্টর মিতায়নকে খুঁজে পেয়েছিল ওরা।

তবে সে বেডরুমে প্রবেশ করতে পারল না। চিৎকার করতে করতে বেডরুমের দরজার কাছে পৌঁছাতেই ফারুক হাঁটু গেড়ে বসে গুলি করল। ফারুকের গুলি খেয়ে বেডরুমের ভেতরে উড়ে গিয়ে পড়ল সে। তানভীর বাকি দুজনকে সাবধান করে দিয়ে সামনে এগোল, আন্দাজ করছে বেডরুমেই সম্ভবত লুকিয়ে আছে জেড মাস্টার। সাবধানে পিস্তল হাতে দরজার পাশে বসে নিচ থেকে বেড রুমের ভেতরে উঁকি দিল ও। কেউ আছে ভেতরে। ফারুকের দিকে ইশারা করে ও চট করে ঢুকে পড়ল কামরার ভেতরে। ও নিশ্চিত জেড মাস্টার ভেতরেই আছে, তাই যেকোনো আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত।

অতীত
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর

যদিও যথাসম্ভব শব্দ কম করার চেষ্টা করছে ও তারপরও একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের পতনের শব্দ কানে যাবে যে কারো। গাড়িটার পেছন থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠে কিছু একটা জানতে চাইল। গাড়ির ভেতরে থেকে কেউ জবাব দিল কিন্তু পেছনের সৈনিককে সে-জবাব শুনে ঠিক সন্তু’ মনে হলো না। সে ঘোড়া নিয়ে চলে এলো গাড়িটার একেবারে পাশে। শামান মটকা মেরে শুয়ে আছে গাড়ির কাঠের ছাদের ওপরে।

সৈনিকটা গাড়ির পাশাপাশি চলতে চলতে গাড়ির জানালা দিয়ে জানতে চাইল শব্দ হলো কিসের। ভেতর থেকে কেউ একজন জবাব দিল, কিছু হয়নি। হয়তো গাড়ির ওপরে জঙ্গল থেকে কোনো প্রাণী লাফিয়ে পড়েছে তাই শব্দ হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষতি হয়নি। সৈনিককে এবার সন্তুষ্ট মনে হতেই সে আবারো পিছিয়ে গিয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গে যোগ দিল।

শামান মনে মনে ভাবল, এবার ওকে কাজ শুরু করতে হবে। একবারই সুযোগ পাবে ও। ছাদের ওপরে শুয়ে শরীরটাকে সাবধানে সামলে কোমর থেকে বের করে আনল বাঁকানো ছুরিটা কাঠের গাড়িটার ছাদের একটা কাঠের জোড়ার ভেতরে চুরিটার একটা মাথা ঢুকিয়ে দিল ও সাবধানে। তারপর সাবধানে ছুরিটাকে এদিক-সেদিক নাড়িয়ে আঙুল ঢোকানোর মতো একটু ফাঁক করল। আরো দুটো তক্তা তফাতে একইভাবে আরেকটা খাঁজ বানাল সাবধানে। তারপর ছুরিটা ভেতরে ঢুকিয়ে দুই হাতে দুই পাশের ফাঁকে দুই হাত ঢুকিয়ে সর্বশক্তিতে এক টান মারল ও। যদিও আন্দাজ করেছিল তক্তাটা এত সহজে খুলবে না তবুও এতটা শক্তি লাগবে ও বুঝতে পারেনি। তারপরও একটানে না হলেও দ্বিতীয়বারের সময় খুলে আনতে পারল দুই তক্তার জোড়াটা।

ওটা খুলেই মাঝখানের ফাঁক দিয়ে নিচের দিকে শরীর গলিয়ে দিল ও। ঝপ করে লাফিয়ে পড়ল কাঠের গাড়ির মেঝেতে। ভেতরে কে আছে কয়জন আছে আন্দাজ করার উপায় ছিল না। ভেতরে নেমেই দেখল একজন মানুষই আছে ভেতরে সে কালো কাপড়ে মুখ-চোখ ঢাকা শামানকে দেখে ভীষণভাবে চমকে উঠল। ওপরে কিছু একটা হচ্ছে বুঝতে পারছিল সে কিন্তু ওপর থেকে এভাবে যমদূত নেমে আসবে ভাবতেও পারেনি বেচারা। কী করবে কাউকে সাবধান করবে বুঝে ওঠার আগেই শামান নিজের লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে খপ করে চেপে ধরল লোকটার মুখ, তারপর ভীষণ শক্তিতে শরীরটাকে ঘুরিয়ে একেবারে নিজের সামনে নিয়ে এলো। হাতের কবজি-কনুই আর কাঁধের চাপে দক্ষতার সঙ্গে মট করে ভেঙে দিল লোকটার ঘাড়।

সাবধানে মানুষটাকে নিচে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। যদিও কাঠের গাড়ির ভেতরটা বেশ অন্ধকার—তবুও ওটার ভেতরে একপাশে রাখা কাপড়ে ঢাকা অবয়বটা চোখে না পড়ার কোনোই কারণ নেই। একটানে কাপড়টাকে সরিয়ে চোখ তুলে তাকাল শামান। অন্ধকারের ভেতরে যেন আরো গাড় এক টুকরো গভীর অন্ধকার। মূর্তিটার কালো অবয়ব যেন অদ্ভুত কোনো এক জাদুকরী শক্তিতে সম্মোহন করে ফেলেছে ওকে। কী জানি আছে মূর্তিটার ভেতরে।

বাইরে থেকে কথাবার্তা ভেসে আসতেই শামান চট করে মূর্তি ঢেকে রাখা কাপড়ের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে অজ্ঞান লোকটার হাত-পা বেঁধে কাপড়ের বাকি অংশটা দিয়ে তাকে ঢেকে দিয়ে আবারো মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়াল। উচ্চতায় ওর থেকেও খানিকটা বড়ো মূর্তিটা। এমন অদ্ভুত কালো ধাতুর মূর্তি শামান এর আগে কখনো দেখেনি। মূর্তিটার কালচে অবয়বের দিকে তাকিয়ে কেমন জানি সম্মেহিতের মতো অনুভব করতে লাগল ও।

কাঠের ঘোড়ার গাড়িটা থামতে শুরু করেছে। শামান মূর্তিটা সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলে উঠল, দেখা যাক ডুকপা লামার কথা কতটা ঠিক হয়, মনে মনে কথাটা বলেই ও মূর্তিটার কাঁধের বিশেষ একটা জায়গাতে চাপ দিল ।

কেমন জানি নিশ্বাস ফেলার মতো শব্দ করে একটা অংশ খুলে গেল মূর্তিটার। এই তাহলে অন্ধকারের অবতার, শামান কথাটা ভাবতেই ঘোড়ার গাড়িটা থেমে গেল। আর শামান ঢুকে পড়ল ফাঁপা মূর্তিটার ভেতরে।

বর্তমান
লাক্কাতুরা টি-এস্টেট, সিলেট

যেভাবে ওরা পুরো বাংলো কর্ডন করে অপারেশন চালিয়েছে তাতে তানভীর ভেবেছিল জেড মাস্টার বেডরুমের ভেতরেই আছে। কিন্তু অস্ত্র বাগিয়ে ভেতরে ঢুকে বেডরুমে কাউকেই দেখতে পেল না ও। ওর সাবধান বাণীর কোনো প্রতি-উত্তরও এলো না বেডরুমের ভেতর থেকে। না কোনো গুলি বা অন্যকিছু।

তানভীর বেডরুমের ভেতরের ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল, যাকে আসলে মানুষ ভেবেছিল সেটা রুমের মাঝখানে দাঁড় করানো একটা বিরাট মূর্তি। বিশেষভাবে বলতে গেলে বুদ্ধমূর্তি। ছয় ফিটের বেশি লম্বা কালো বুদ্ধমূর্তিটার দিকে তাকিয়ে তানভীর আনমনেই বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা।’

ফারুক আর তার সঙ্গী বেডরুম আর লাগোয়া বাথরুম চেক করে ওর পাশে এসে দাঁড়াল।

‘এটাই তাহলে সেই ঐতিহাসিক মূর্তি,’ ফারুকের কথার কোনো জবাব না দিয়ে তানভীর তাকিয়ে রইল মূর্তিটার দিকে। অদ্ভুত এক কালচে সৌন্দর্যের গভীর কালো মূর্তিটা যেন কালো রঙের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বিরাট মূর্তিটার অবয়বে এমন কিছু আছে যে তানভীর চাইলেও চোখ সরাতে পারছে না। মূর্তিটার গায়ে ও হাত দিয়ে দেখল মূর্তিটার কালচে ভাবটা অদ্ভুত, কেমন যেন আশপাশ থেকে আলো সব শুষে নিচ্ছে। আবার মূর্তিটা নিজে খুব কালো যে তাও না। কেমন যেন স্বচ্ছ কালচে ধূসর একটা ভাব ওটার। মূর্তিটার পায়ের কাছেই ও নিজের ডেজার্ট ঈগলটা পড়ে আছে দেখে তুলে নিল। হাতে নিয়ে দেখল খালি ওটা।

মূর্তিটা এতবড়ো আমি ভাবতেই পারিনি,’ ফারুকের কথা শুনে ঘুরে তাকাল তানভীর। তার দিকে ফিরে তানভীর প্রশ্ন করল, ‘মূর্তি তো পেলাম কিন্তু, জেড মাস্টার গেল কোথায়?’

‘এখানে তো নেই, পুরো বাংলো চেক করা হচ্ছে হয়তো আছে কোথাও,’ বলে ফারুক মাছি তাড়ানোর মতো একটা ভঙ্গি করল। ‘যাবে আর কই, ধরা পড়বেই।’

তানভীর তার দিকে ফিরে রাগের সঙ্গে বলে উঠল, ‘আপনি জেড মাস্টারের ব্যাপারে কথা বলছেন, আপনার কি মনে হয় না আমাদের আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত, দেখুন—’ তানভীরেরর কথা শেষ হবার আগেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করল বাবুল আহমেদ।

‘মাই গড,’ সে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছে মূর্তিটার দিকে। ‘এই সেই মূর্তি? অসাধারণ,’ বাবুল আহমেদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মূর্তিটার দিকে।

‘স্যার, জেড মাস্টারকে কিন্তু আমরা পাইনি, আমার ধারণা সে পালিয়েছে। কিন্তু পালিয়ে থাকলেও সে বেশিদূরে যেতে পারেনি। আমাদের এক্ষুণি বাংলোসহ এর আশপাশটা সিল করে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা উচিত।’

‘আছে আশপাশেই, যাবে কোথায়—’

বাবুল আহমেদ কথা শেষ করার আগেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করল দুজন কমান্ডো। ‘স্যার, পুরো বাংলোর প্রত্যেকটি কোনা পরীক্ষা করা হয়েছে, কেউ নেই,’ কমান্ডো রিপোর্ট করতেই সবাই ফিরে তাকাল সেদিকে। তানভীর দুই পা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, ‘আপনি নিশ্চিত?’

‘অবশ্যই, স্যার,’ লোকটা জবাব দিতেই অন্য কমান্ডোর দিকে ফিরে তানভীর বলে উঠল, ‘আপনি তো বাংলোর পাশে ছিলেন, বাংলোর পাশ দিয়ে কেউ বেরোয়নি তো?’

‘স্যার, পাশ দিয়ে বের হবার কোনো রাস্তাই নেই, তাও যদি কেউ বের হতো একপাশে আমি আর অন্যপাশে হাবিব ছিল, আমরা একটা ইঁদুর নড়লেও দেখতে পেতাম, কিন্তু কাউকে দেখিনি।’ লোকটার কথা শেষ হতেই তানভীর ফারুকের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘হয়তো সে পেছন দিয়ে পালিয়েছে-আপনার লোকদের বলেন যারা পেছনে পাহারায় ছিল—’

তানভীর কথা শেষ করার আগেই ফারুক জবাব দিল, ‘এইমাত্র ওদের রিপোর্ট শুনলাম। বাংলোর পেছনের পাহাড় সোজা নিচে নেমে গেছে, ওখানে জঙ্গল শুরু হবার আগে খোলা ফসলের মাঠ। ওদিকে দিয়ে কেউ নামলে ওরা পরিষ্কার দেখতে পেত কিন্তু ওখানেও কিছু নড়তে দেখেনি ওরা। ‘

‘আরে অফিসার,’ পেছন থেকে বাবুল আহমেদ তানভীরের কাঁধে একটা হাত রাখল। ‘তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন। জেড মাস্টার যদি পালিয়েও গিয়ে থাকে, তাতে সমস্যা কোথায়, সে ধরা পড়বেই। মূর্তিটা তো পেয়েছি আমরা,’ বাবুল আহমেদ মূর্তিটার দিকে এগিয়ে ওটার গায়ে হাত বোলাতে শুরু করেছে। ‘হাজার বছরের পুরনো অ্যান্টিক।’

‘স্যার-’ তানভীর তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার অগেই বাবুল আহমেদ ফারুকের দিকে ফিরে ইশারা করল। তানভীর একপা এগিয়ে গেছিল ফারুক আহমেদের দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ লাথি মারল ওর পায়ে। আচমকা হাঁটুর পেছনে লাথি খেয়ে আপনাতেই হাঁটু ভেঙে বাঁকা হয়ে গেল ওর শরীর। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল খালি ডেজার্ট ঈগলটা। তানভীর হাঁটু ভেঙে বসে পড়তেই সামনে থেকে সরাসরি ওর বুকে গুলি করল ফারুক। উজি সাবমেশিনগানের এক পশলা গুলি বুকের ভেস্টের ওপরে লাগতেই প্রায় উড়ে গিয়ে বাংলোর কাঠের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল তানভীর।

আকস্মিক ধাক্কায় ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় অবশ হয়ে আসতে থাকা বাঁ হাতের নিচে বগলের কাছে ডান হাত চলে গেল ওর। রক্তে ভিজে উঠছে জায়গাটা। ভেস্টের ফাঁক গলে একটা বুলেট ঢুকে পড়েছে ওখানে। বহু কষ্টে মাথা তুলে সামনে দেখল। বাবুল আহমেদ হাত-পা নেড়ে কিছু একটা বলছে তার লোকদেরকে। ফারুক মাটিতে পড়ে থাকা তানভীরের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ওদেরকে ছাড়িয়ে তানভীরের দৃষ্টি চলে গেল বেডরুমের মেঝের ওপরে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধমূর্তিটার দিকে। এর আগে যত বুদ্ধমূর্তি দেখেছে সবগুলোর চোখে-মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি বিরাজমান ছিল কিন্তু এই মূর্তিটার অন্ধকার অবয়বের সঙ্গে চোখে-মুখেও কেমন জানি ক্রুরতা। জ্ঞান হারাবার আগে তানভীর মাথায় একটাই কথা ঘুরতে লাগল। এ-কারণেই কি তবে একে ব্ল্যাক বুদ্ধা বলা হয়। কী এই মূর্তির রহস্য?

ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো ওর।

অতীত
মন্তলার হাট, কন্নোর

জীবনে অনেক ধরনের ধাতুর গন্ধ পেয়েছে শামান। বিশেষ করে তামা লোহা আর পিতলের গন্ধ ওর পরিচিত। কিন্তু এরকম গন্ধ কখনো পায়নি ও। গন্ধের বিভিন্ন রকমফের থাকে। কেমন জানি টক-টক একটা গন্ধ। মূর্তির ভেতরটা ভয়ানক টক- টক গন্ধে ভরপুর। প্রথমে বমি ঠেলে আসতে চাইল কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে গেল ঠিক এর কাছাকাছি গন্ধ ছিল শান্তির মঠ থেকে আনা ওর কাতানা জোড়াতে।

কোনো মূর্তির ভেতরে থাকার অনুভূতি কেমন হতে পারে যে না ঢুকেছে তাকে কখনোই সেটা পুরোপুরি বোঝানো সম্ভব নয়। একই সঙ্গে বদ্ধ কোনো জায়গায় আটকা পড়ার অনুভূতি আবার ভাসমান কোনো জায়গায় ভেসে থাকার অনুভূতিকে যদি এক করা যায় তবে এর কাছাকাছি একটা অনুভূতি পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হতে লাগল শামানের। শামানের মতো লম্বা মানুষের জন্যে মূর্তির ভেতরের জায়গাটা একেবারেই অপ্রতুল।

মূর্তিটার ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই একইসঙ্গে অনেকগুলো অনুভূতি খেলা করে গেল শামানের মাঝে। ভেতরে অবস্থান নিয়েই শামান অনুধাবন করতে পারল ওদের ঘোড়ার গাড়িটা থেমে গেছে। ডুকপা লামার নির্দেশনা অনুযায়ী শামান মূর্তির চোখের জায়গাতে বিশেষ কায়দায় চোখ রাখতেই খুবই ছোটো প্রায় সূচের মতো সরু ছিদ্র দিয়ে বাইরে দেখতে পেল ও। প্রথমে সবই অন্ধকার লাগল ওর কিন্তু কাঠের গাড়িটার পেছনের ডালা খুলে যেতেই ওর পড়ল মৃদু আলো। বাইরেটা পুরোপুরি পরিষ্কার বোঝা না গেলেও মোটামুটি ভালোই দেখতে পাচ্ছে শামান এখন।

ওদের গাড়িটা থেমে গেছে, সেইসঙ্গে খুলে গেছে কাঠের গাড়িটার পেছনের ডালা। অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে বাইরে থেকে। কাকে যেন ধমকে উঠল একটা ভারী গলা। শামান অনুভব করল মূর্তির ভেতর থেকে বাইরের প্রায় সব ধরনের শব্দই পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই এটার পেছনে কারিগরদের দক্ষতার অবদান আছে। শামান পরিষ্কার বুঝতে পারল ভারী গলাটা রাজা বিক্রমের।

একটু পরেই গাড়ির ভেতরে দুজন লোক উঠে এলো। দুজনেই বিড়-বিড় করে রাজাকে গালি দিচ্ছে সেটাও পরিষ্কার শুনতে পেল শামান। ‘এই ভারী মূর্তি এখন নামিয়ে আমাদের দুজনকেই বহন করতে হবে,’ রাগে গজ গজ করতে করতে বলতে লাগল একজন। অপরজন তার কথার জবাবে বলে উঠল, ‘কী আর করা রাজার ইচ্ছে। আচ্ছা, ওপরের এই ফোকরটা কিসের?’ লোকটার গলা শুনে শামানের বুকের ভেতরটা ধরাস করে উঠল। তাড়াহুড়োয় এই ব্যাপারটা একেবারেই মাথায় আসেনি।

‘বাদ দে,’ অন্য লোকটা জবাব দিল। ‘জলদি কর, দেরি করলে আবার রাজা বিক্রম গর্দান নেবে,’ দুজনে মিলে মূর্তিটাকে তুলে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে শামানের মধ্যে আবারো সেই ভাসমান অনুভূতিটা ফিরে এলো। কারণ মূর্তিটাকে কাত করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে মূর্তিটাকে কাঠের গাড়ির বাইরে বের করতেই মানুষের বিস্মিত গুঞ্জন ভেসে আসতে লাগল চারপাশ থেকে।

শামান অনুভব করল ভাসতে ভাসতে একটা মঞ্চের ওপরে এনে তোলা হলো ওকে। মঞ্চের ওপরে মূর্তিটাকে দাঁড় করিয়ে দিতেই আবারো পরিষ্কার চোখে পড়ল সব। মঞ্চের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। সবাই বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, মানে মূর্তিটার দিকে। রাজা বিক্রমকে দেখতে পেল ধীরে ধীরে মঞ্চের ওপরে উঠছে সে। সে মঞ্চের ওপরে এসে উঠে ঠিক মূর্তির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সে মঞ্চের ওপরে এসে উঠতেই সামনের দিকে তাকিয়ে শামানের বুকটা আবারো ধরাস করে উঠল।

কারণ মঞ্চের সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বন্দিদের। শামান দেখল কালন্তি-ধোয়ী-ঘোষিত এমনকি জাথুরিয়াকেও হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চের সামনে দিয়ে। নিশ্চয়ই ওদেরকে মঞ্চের পাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মস্তক ছিন্ন করার জন্যে। শামানের বুকের ভেতরটা ধরাস ধরাস করতে লাগল। এখন সময়ের ওপরে নির্ভর করছে অনেক কিছু। যে-খেলা ও খেলতে যাচ্ছে তাতে সময়ের একটু এদিক- সেদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিধুরা এতক্ষণে জায়গামতো পৌঁছে অবস্থান নিতে পেরেছে কি না কে জানে। যদি না পেরে থাকে তবে… এত ভেবে লাভ নেই।

শামানের মনের ভাবনা শেষ হবার আগেই সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে কথা বলে উঠল রাজা বিক্রম। সে একে একে জনতার উদ্দেশ্যে গত কিছুদিনের ঘটনা ব্যাখ্যা করল। তারপর সে জানাল কিভাবে এই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে সে দিনের পর দিন লিচ্ছবীদের হাতে বন্দি থেকে নির্যাতন সহ্য করে গেছে। তারপর ব্যাখ্যা করল-কিভাবে সে এখন থারু বেঈমানদের মস্তক ছিন্ন করে সেই মস্তক ভেট হিসেবে পাঠাবে ভারতবর্ষের বর্তমান সম্রাট শুঙ্গ রাজাকে।

সেইসঙ্গে সে রাজাকে ভেট হিসেবে পাঠাতে চায় বুদ্ধের এই অবতারকে। আজকের এই ময়দানে সে যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চায় তারা যে সত্যিকারে পাপী এটা সে প্রমাণ করে দেবে। কারণ এদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করবে স্বয়ং বুদ্ধের অবতার। কথাটা বলে সে আরো ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। শামানের দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে ময়দানে। একটা পরিচিত মুখ যদি ও দেখতে পায়। একবার যদি নিশ্চিত হতে পারে বিধুরা চলে এসেছে তবেই-ময়দানে ভিড়ের ভেতরে লম্বা দাড়িকে দেখে আত্মপ্রসাদে ভরে উঠল ওর মন।

মূর্তির ভেতর থেকে জোর গলায় ও বলে উঠল, ‘না।’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সব থেমে গেল চারপাশে। পুরো মন্তলার হাটে উপস্থিত হাজারো মানুষের গুঞ্জন সব থেমে গেল। শুধু দূরের জঙ্গলে রাত জাগা কোনো পাখির কড়-কড় শব্দ শোনা গেল। এ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। শামান অবাক হয়ে খেয়াল করল ও যা বলেছে সেই আওয়াজটাই আরো জোরালো হয়ে বাতাসে ভেসে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেছে সব কোলাহল।

রাজা বিক্রম জনতার উদ্দেশ্যে তড়-বড়ো করে কিছু একটা বলছিল, মূর্তির ভেতর থেকে ‘না’ শব্দটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে-সঙ্গে সে চমকে উঠে থেমে গেছে। রাগের সঙ্গে সে ফিরে তাকাল মূর্তির দিকে। বিড়-বিড় করে কিছু একটা বলতে লাগল সে কারো নাম ধরে। সম্ভবত যে-লোকটার মূর্তির ভেতরে ঢুকে কথা বলার কথা ছিল তাকে নির্দেশনা দিচ্ছে সে। শামান আবারো তীব্র গলায় বলে উঠল, ‘না।’

এবার প্রতিক্রিয়া হলো একেবারে বিপরীত। সমবেত জনতাকে যেন এক বাক্যে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল এবার প্রায় সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সবাই রাজা বিক্রমের বাহিনীর অবস্থান আর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।

রাজা বিক্রম রাগের সঙ্গে এগিয়ে এলো মূর্তির দিকে। শামান মূর্তির ভেতর থেকে একপাশ খুলে একটা হাত বের করে রাজা বিক্রমের কাঁধ চেপে ধরে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। সেইসঙ্গে ও মূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এলো মঞ্চের ওপরে। মূর্তির ভেতর থেকে আওয়াজ শুনতে পেয়ে সমবেত জনতা এমনিতেই দ্বিধান্বিত-ভীত হয়ে উঠেছিল, এবার মূর্তিটাকে নড়ে উঠতে দেখে রাজা বিক্রমকে আঘাত করতে দেখে ভয়ের চোটে দিগবিদিক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল সবাই। সমবেত জনতার আরেকটা অংশ স্রোতের মতো ভাসিয়ে দিল মঞ্চের আশপাশে অবস্থানরত প্রহরীদের।

মঞ্চের ওপরে নেমেই শামান মুখের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে বিশেষ শব্দ করে উঠল। অন্যপাশ থেকে একই শব্দ ভেসে এলো। মঞ্চের ওপর নেমেই ও একহাতে ছুরি আর অন্যহাতে তলোয়ার বের করে এনেছিল, একপাশে দেখতে পেল বন্দিদেরকে সৈনিকরা ঘিরে ফেলে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মঞ্চের ওপর থেকে সেদিকে লাফিয়ে নামল ও। শামানকে এগোতে দেখে একজন সৈনিক এগিয়ে আসতে শুরু করল শামান আঘাত ঠেকানোর প্রস্তুতি নিতে যাবার আগেই তিরের আঘাতে সৈনিক লুটিয়ে পড়ল। বিধুর দল আক্রমণ করেছে।

শামান জোরকদমে এগিয়ে গেল বন্দিদের দিকে। দুজন সৈনিককে নিকেশ করে মাটি থেকে দুটো তলোয়ার উঠিয়ে ছুড়ে দিল কালন্তি আর ধোয়ীর দিকে। তলোয়ার হাতে পেয়ে ওরা নিজেরাই নিজেদেরকে মুক্ত করে ফেলতে বেশিক্ষণ লাগল না। বন্দিদের মুক্ত করছে এমন সময় পেছন থেকে কাঁধের কাছে আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে গেল ও। দেখল রাগের সঙ্গে ওর দিকে তাকিয়ে ফুঁসছে শংকরাদিত্য। খুশি হয়ে উঠল শামান। যদিও ওর কাঁধ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে তবুও এই লোকটাকেই মনে-প্রাণে খুঁজছিল ও। ও শংকরাদিত্যের দিকে এগোতে যাবে কালন্তির ডাকে থেমে গেল।

‘শামান, ওকে শিক্ষা দেয়ার অধিকার আমার বেশি,’ কালন্তি বলে উঠল ওর পাশে থেকে। ওর দিকে একবার দেখে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে তলোয়ার বাগিয়ে অন্যদিকে রওনা দিল শামান। কারণ ও জানে যতই প্রাথমিকভাবে চমকে দেয়ার সুযোগে ওদেরকে খানিকটা কাবু করে ফেলা গেছে কিন্তু রাজা বিক্রমের বাহিনী অনেক বড়ো। একবার ওরা নিজেদেরকে গুছিয়ে উঠতে পারলে শামানদের দলটাকে ওরা স্রেফ পিষে ফেলবে। কাজেই সাপকে কাবু করতে হলে সাপের মাথা কাটতে হবে। ওকে খুঁজে বের করতে হবে রাজা বিক্রমকে। একবার তাকে নিকেশ করতে পারলেই পূর্ণ বিজয় সম্ভব।

শামান দৌড়ে এসে আবারো মঞ্চের ওপরে উঠে দাঁড়াল। একদিকে জনতা দিগ্‌বদিক হয়ে ছুটছে, তার মাঝে বিধু আর লম্বা দাড়ির সঙ্গে খণ্ড-খণ্ড লড়াই চলছে শাক্য সৈন্যদের। আরেকদিকে এতক্ষণ যারা বন্দি ছিল তারাও এখন অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শাক্যদের ওপরে। বিশেষ করে কালন্তি আর শংকরাদিত্যের লড়াই তুঙ্গে উঠেছে। কিন্তু রাজা বিক্রমকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও। কাপুরুষটা কি পালাল তবে।

‘যোদ্ধা, তুমি মনে হয় আমাকেই খুঁজছো?’ পেছন থেকে রাজা বিক্রমের গলা শুনে মৃদু হাসি ফুটে উঠল শামানের মুখে। খুব ধীরে ধীরে ফিরে তাকাল ও রাজা বিক্রমের দিকে। মঞ্চ ফেলে দেয়াতে তার পরিধেয় আর মুখ-চুল বালিতে ভরে গেছে। কিন্তু তার ভেতর থেকেও ক্রুর হাসি হেসে তাকিয়ে আছে সে শামানের দিকে। তুমি হয়তো ভাবছিল আমি কাপুরুষের মতো পালিয়েছি। কিন্তু যতক্ষণ আমি তোমার মৃত আত্মার দখল না নিচ্ছি পালাই কী করে?’ বলে সে মূর্তিটা দেখাল। ‘যোদ্ধা তুমি জানো না আজ এখানে কী করেছো। কত বড়ো সর্বনাশের বীজ বপন করেছো। আজকের ঘটনা ওরা হাজারো বছর ধরে বলতে থাকবে,’ বলে সে নিজের পেছন থেকে অস্ত্র বের করে আনল। শামানের দৃষ্টি আটকে গেল ওদিকে। ওর জোড়া কাতানা-হিম্বা।

‘কথিত আছে এই হিম্বা নাকি একমাত্র সেরা যোদ্ধার হাতেই শোভা পায়,’ বলে রাজা বিক্রম মৃদু হেসে উঠল। ‘আজ প্রমাণ হয়ে যাবে হিমালয়ের উপত্যকায় কে সর্বকালের সেরা যোদ্ধা,’ বলেই সে আক্রমণ চালাল শামানের ওপরে।

বর্তমান
এয়ারপোর্ট রোড, সিলেট

কেমন জানি অদ্ভুত এক দুলুনির সঙ্গে তানভীরের ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট শরীরের বাঁ হাতের গোড়ায় তীব্র ব্যথার চোটে দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। কাশির দমকে শরীর বাঁকা হয়ে এলো। মুখ খুলে বড়ো বড়ো করে দম নিতে লাগল।

‘আহ, যাক জ্ঞান ফিরল তাহলে কমান্ডার সাহেবের, কেউ একজন আমুদে সুরে বলে উঠল।

তানভীর চোখ মেলে দেখল ও একটা বড়ো কাভার্ড ভ্যানটাইপের বাহনের পেছনে আধশোয়া হয়ে আছে। আধশোয়া হয়ে থাকার কারণ ওর দুই হাত পেছনে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে স্ট্রিপ দিয়ে। দুই পায়েরও একই অবস্থা। ওর ঠিক সামনেই একটা বেঞ্চির মতো দেখতে আসনে বসে আছে বাবুল আহমেদ, আর তার সঙ্গে মোটা গোঁফ ফারুক। ভ্যানের ভেতরে জ্বলতে থাকা ঘোলাটে বাল্বের আলোতে দেখা গেল ওদের একপাশে ভ্যানের মেঝেতে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রাখা আছে মূর্তিটা, জিনিসটা যাতে নড়াচড়া না করে সেজন্যে হালকা দড়ি দিয়ে একপাশে হুকের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ওটাকে।

‘এইজন্যেই,’ তানভীর কোনোমতে দম নিয়ে বলে উঠল। ‘শুরু থেকে আমার মনে বারবার যে-প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটার জবাব তাহলে এই,’ কথাটা তানভীর বাবুল আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল।

‘কি প্রশ্ন, অফিসার?’ বাবুল আহমেদকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে এই মুহূর্তে।

‘আমি কেন? এত-এত অভিজ্ঞ অফিসার থাকতে আমি কেন,’ তানভীর রাগের সঙ্গে বলে উঠল। ‘কারণ আমার জন্যে ভুল করা সহজ হবে আর আমাকে নিয়ন্ত্রণ করা আপনাদের জন্যে সহজ হবে, সেইসঙ্গে এখন যা ঘটছে সেটাও,’ তানভীর একটু থেমে যোগ করল। ‘আপনারা শুরু থেকেই জানতেন ব্ল্যাক বুদ্ধার ব্যাপারে তাই না? আর শুরু থেকেই আপনাদের পরিকল্পনা ছিল এই মূর্তিটা হাসিল করা। বাকি পুরো অপারেশন, ডক্টর মিতায়নকে উদ্ধার-সবই আসলে ছিল ভুয়া নাটক তাই না?’

‘আরে নাহ অফিসার, কী বলো তুমি,’ বাবুল আহমেদ সহাস্যে কথাটা বলে ফারুকের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘কী বলে এই ছেলে!’ আবারো তানভীরের দিকে ফিরে জবাব দিল। ‘হ্যাঁ, আমরা শুরু থেকেই সব জানতাম। ডক্টর মিতায়ন যখন থেকে সরকারি অনুমতির জন্যে আবেদন করে তখন থেকেই তার ওপরে নজর ছিল আমাদের। তবে সে যে জেড মাস্টার এটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আর এত দ্রুত সে ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করে ফেলবে এটাও আমরা ভাবতে পারিনি!’

‘তাই সে ওটা উদ্ধার করে আনার পর আমাদের হিসেবে একটু গরমিল হয়ে যায়। আর তাই তোমাকে পাঠানো হয় সিলেটে। আমি আমার ফোর্সের কাউকে সরাসরি ইনভলভ করতে চাচ্ছিলাম না। কারণ আমার ফোর্সের কারো ট্র্যাক গায়েব করাটা অনেক কঠিন হতো। আর তা ছাড়া আমার ফোর্সের সেরা অফিসারটারও সেই অ্যানসালিটিক্যাল স্কিল ছিল না যেটা তোমার আছে। তাই আমি যখন ভাবছি কিভাবে কী করা যায় তখনই তোমার গর্দভ বস অতি-সৎ হাবিব আনোয়ার পাশা নিজ থেকেই আমার কাছে আমার কাজের সমাধান নিয়ে আসে। সে-ই জানায় তার এক এজেন্টের ট্রেনিং প্রায় শেষ করে সে দেশে ফিরবে, তাকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো যায়। তার মোটিভ ছিল ভিন্ন আর আমার মোটিভ ছিল ভিন্ন।’

‘সে নিজের একটা উইং খোলার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। ভেবেছে আজ আমাকে সহায়তা করলে এই ব্যাপারে পরে আমার কাছ থেকে হেল্প পাবে। প্লাস সে নিজেও তোমাকে জাজ করতে চাইছিল। আর আমি ওর প্রস্তাব পেয়ে তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তুমি সিঙ্গেল পরিবারের ছেলে, মা বাদে তোমার পরিবারে আর কেউ নেই। তার ওপরে কোলাবোরেটিভ অপারেশনে এক অফিসারকে হ্যান্ডেল করে কাজ উদ্ধার করা আমার জন্যে যতটা সহজ হবে অন্যক্ষেত্রে ততটা হবে না,’ বলে সে হেসে উঠে যোগ করল। আর তাই তোমাকে এখানে পাঠানো হয়। তবে, সে এই পর্যন্ত বলে একটা আঙুল তুলল। তুমি এত দ্রুত এতকিছু করে ফেলবে এটা আমি ভাবতে পারিনি। বিশেষ করে এত দ্রুত সূত্র মিলিয়ে ডক্টর মিতায়নকে উদ্ধার, তারপরে আবার মূর্তি হারিয়ে জেড মাস্টারের সন্ধান বের করা। আমি ইমপ্রেসড। আহা, তোমাকে কাজে লাগাতে পারলে বড্ড ভালো হতো।’

‘আপনার কি ধারণা পাশা স্যার আপনাকে ছেড়ে দেবে?’ তানভীর ব্যথার চোটে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে উঠল। ‘আর ব্ল্যাক বুদ্ধার মতো একটা আন্তর্জাতিক সেনসেশন আপনি এভাবে নিজের ফায়দার জন্যে ব্যবহার করতে পারবেন? এতই সহজ?’ তানভীরের মুখে উঠে আসা রক্তাক্ত থুতু ফেলল গাড়ির মেঝেতে। শরীরের পেছনে বাঁধা হাতের স্ট্রিপটা নাড়াচাড়া করছে ও।

‘সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, তুমি নিজেও জানো না কত বড়ো বড়ো মাথা আছে এসবের পেছনে। পাশা কিছু ঝামেলা পাকাবে। তবে সেটা সামলানো সম্ভব। এসব কোনো বিষয় না যখন তোমার হাতে মিলিয়ন কিংবা বিলিয়ন ডলারের একটা ঐতিহাসিক অ্যান্টিক আছে। কত দাম হতে পারে এই জিনিসটার! এরকম একটা জিনিস আমাদের হাত গলে সরকারি হাতে চলে যাবে ভাবলে কী করে তুমি? লাইফ টাইমের অর্জন এরকম একটা জিনিস। সেটার জন্যে অনেক কিছুই বিসর্জন দেয়া সম্ভব,’ বলে সে তানভীরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘এর চেয়ে অনেক কম মূল্যের জিনিসের জন্যে আরো কত খারাপ কাজ করতে হয়েছে জীবনে, আর এটা তো অনেক বড়ো কিছু।’

‘এখন আমাকে আর ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে কী করবেন?’

‘সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। অন্যান্য কমান্ডোদের বাংলোতে রেখে একটা সাজানো রিপোর্ট বানানো হয়েছে। ওটাই পেশ করা হবে। তাতে একটা অংশে বলা হবে আমরা পৌছানোর আগেই জেড মাস্টার মূর্তি নিয়ে পালিয়ে গেছে। আর জোর করে তার পিছু নিতে গিয়ে তুমিও মারা পড়েছো। আমরা এখন যাচ্ছি এয়ারেপোর্টে ওখানে বিশেষ প্লেন রেডি আছে। ব্ল্যাক বুদ্ধা ওতে তুলে বিশেষ জায়গাতে সরিয়ে ফেলা হবে আপাতত। পরে যা করার করব,’ বলে সে হেসে উঠে যোগ করল। ‘আর হ্যাঁ, পথে যাবার সময়ে তোমাকে কোথাও গুলি করে রাস্তার ধারে ফেলে দেয়া হবে তোমারই মিসিং ডেজার্ট ঈগল পিস্তল দিয়ে,’ বলে সে পিস্তলটা দেখাল ফারুকের হাতে। ‘আর তাতে দোষ হবে জেড মাস্টারের। কাজেই কোনো চিন্তা নেই।’

তানভীর যদিও ব্যথার চোটে অন্ধকার দেখছে তবুও ও শরীরের পেছনে চাপা পড়া হাত আর কবজি বাঁকিয়ে হাতটাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। এই জিনিসটা ও শিখেছিল ইংল্যান্ডে ট্রেনিংয়ের সময়ে, ওর আইরিশ ফ্রেন্ড ওকে শিখিয়েছিল কিভাবে স্ট্রিপ দিয়ে আটকানো থাকলেও হাত ছোটানো যায়। তবে সমস্যা হয়েছে বাঁ হাতের বগলের নিচে গুলি লাগাতে। ওই হাতটা প্রায় অকেজো, যে-কারণে ওই হাতটাকে কাজে লাগাতেই পারছে না ও। আর এই ছাগলগুলোকে কী করবেন? বলে তানভীর মোটা গোঁফ ফারুককে দেখাল। ‘এই ছাগলগুলোকেও তো মনে হয় বখরা দিতে হবে।’

‘এই ব্যাটা, কী বললি তুই?’ রাগের সঙ্গে ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। ‘গতকাল থেকে সহ্য করছি তোর মতো একটা আবালের মাতব্বরি, ফারুক উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাবুল আহমেদ ধমকে উঠে তাকে নিরস্ত্র করতে গেল। কিন্তু ফারুক রাগে অন্ধ হয়ে গেছে। সে এগিয়ে এসে তানভীরের গায়ে লাথি মারল। তানভীর লাথি খেয়ে বাঁকা হয়ে গেল। ব্যথার চোটে মনে হলো জ্ঞান হারাবে কিন্তু কবজির কাছটাতে স্ট্রিপটা যতটুক আটকে ছিল মাটিতে পড়াতে ধাক্কা লেগে সেটা ছুটে গেল। ফারুক এগিয়ে এসে আবারো ওকে লাথি মারার আগেই চট করে ফারুকের একটা পা ধরে ফেলল ও।

যদিও আহত শরীর তার ওপরে পা বাঁধা তবুও মরিয়া হয়ে পা-টাকে ওপরের দিকে ঠেলে দিল ও। ফারুক ছিটকে গিয়ে গিয়ে পড়ল বাবুল আহমেদের ওপরে। কিন্তু তানভীরের হিসেবে ভুল হয়ে গেল। ও ভেবেছিল পা-টাকে মুক্ত করে প্যান্টের নিচে বাঁধা ছুরিটা নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। কিন্তু ও নড়ার আগে দুজনেই সোজা হয়ে গেল। ফারুকের হাতে ওর ডেজার্ট ঈগলটা আগে থেকেই ছিল, বাবুল আহমেদও নিজের অস্ত্র বের করে দুজনেই যার যার অস্ত্র তাক করল ওর দিকে।

‘শুভ কাজে দেরি করে লাভ নেই, কি বলেন বস?’ ফারুক অনুমতি প্ৰাৰ্থনা করতেই বাবুল আহমেদ মাথা নেড়ে সায় জানাল।

অতীত
মন্তলার হাট, কন্নোর

রাজা বিক্রমকে ছুটে আসতে দেখে মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল শামান। ওর এই থেমে যাওয়াতেই খানিকটা অস্বস্তি তৈরি হলো বিক্রমের মাঝে। সে আক্রমণ চালাতে গিয়েও মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল, এই সুযোগে শামানই প্রথম তলোয়ার চালাল। রাজা বিক্রমের কোমরের বন্ধনী দু-টুকরো করে দিয়ে সামান্য রক্তপাত ঘটিয়ে তলোয়ারের ফলাটা অন্যদিকে ছুটে গেল।

রাগের সঙ্গে চিৎকার করে উঠে বিক্রম পাল্টা আক্রমণ চালাল। শামান যথাসম্ভব চেষ্টা করছে হিম্বার আয়ত্তের মাঝে না থাকতে, কারণ তাতে নিজের পুরনো তলোয়ারটা দু-টুকরো হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু রাজা বিক্রমের আক্রমণের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পেরে ঠিকই এক পর্যায়ে ও বাধ্য হলো হিম্বার আঘাত ঠেকাতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর তলোয়ারটার মাঝপথে ফাটল দেখা দিল।

একপাশে সরে এসে হাত থেকে ওটা ফেলে দিল শামান। রাজা বিক্রমের দুই হাতে জোড়া হিম্বা, শামানের দুই হাতই খালি। রাজা বিক্রম মুখে মৃদু হাসি নিয়ে শেষ আক্রমণ চালাল।

শামান বিক্রমকে ছুটে আসতে দেখে মাটিতে গড়ান দিল। পর পর দুই গড়ান দিয়ে রাজা বিক্রম আক্রমণের আগেই শক্ত দুই হাতে ধরে ফেলল তার দুই কবজি। অবিশ্বাসের সঙ্গে রাজা বিক্রম তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ‘রাজা মশাই আমার তলেয়ারগুলো আপনি চুরি করেছেন, ওগুলো অমার ফেরত চাই,’ বলে হাসতে হাসতে রাজার এক কবজি দিয়ে অন্য কবজিতে বাড়ি মারল। জোড়া হিম্বার একটা মাটিতে পড়ে গেল অন্যটা মাটিতে পড়ার আগেই বিক্রমের হাত ছেড়ে দিয়ে এক হাতে ধরে এক ধাক্কায় সেটা ঢুকিয়ে দিল রাজা বিক্রমের গলায়।

শামানকে তলোয়ারটা গলার দিকে তাক করতে দেখে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠেছিল রাজা বিক্রম। কিন্তু তলোয়ারের ফলা গলার হাড় ভেদ করতেই আচমকা চিৎকার থেমে গিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করে উঠল বিক্রম। বাতাসের জায়গা দখল করল রক্ত। গলগল করে বেরিয়ে আসা রাজা বিক্রমের রক্ত ভাসিয়ে দিল শামানকে। চোখ খোলা অর্ধমৃত রাজা বিক্রমের দেহটা মঞ্চ থেকে এক লাথিতে নিচে ফেলে দিল শামান।

রাজা বিক্রমের দেহটা মাটি স্পর্শ করার আগেই প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল শামান। সমস্ত রাগ-ক্রোধ-ভালোবাসা-মনের যন্ত্রণা একাকার করে চিৎকার করে উঠল ও। রাজা বিক্রমের দেহটা মঞ্চের নিচে গিয়ে পড়াতে এমনিতেই থেমে যাচ্ছিল সব, তার ওপরে শামানের ভয়ংকর চিৎকার শুনে চারপাশ থেকে সবাই ফিরে তাকাল মঞ্চের দিকে।

চিৎকার করতে করতে থেমে গিয়ে আবারো চেঁচিয়ে উঠল ও। তারপর আহত পশুর মতো সবার দিকে ফিরে তাকাল। মঞ্চের চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ও একপাশে তাকিয়ে দেখল আহত শংকরাদিত্যকে বন্দি করেছে ঘোষিত আর ধোয়ী, ওদের সামনেই রক্তাক্ত তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে কালন্তি। সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

কালন্তির দিকে তাকিয়ে রক্তাক্ত মুখে সামান্য হেসে উঠল শামান, বিজয়ী হয়েছে ওরা।

বর্তমান
এয়ারপোর্ট রোড, সিলেট

ফারুকের অস্ত্রের কালো নলের দিকে তাকিয়ে আছে তানভীর হঠাৎ ওর মুখ হা হয়ে গেল একটা দৃশ্য দেখে। ফারুক আর বাবুল আহমেদের পেছনে থাকা মূর্তিটা নড়ে উঠছে। প্রথমেই ওটার গায়ে জড়ানো দড়িটা খুলে পড়ে গেল। ধীরে ধীরে ওটার একটা পাশ খুলে গিয়ে একটা ছুরি বেরিয়ে এসে সোজা ঢুকে গেল ফরুকের ঘাড়ে। চরম অবিশ্বাসের সঙ্গে ঘুরে তাকাল ফারুক, মূর্তিটা তাকে ছুরি মেরেছে! কিন্তু ওর অবিশ্বাসের আরো বাকি ছিল। ছুরিটা তার ঘাড় থেকে খুলে সোজা সেটা ঢুকে গেলে বাবুল আহমেদের হা হয়ে থাকা মুখে

তানভীর অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকিয়ে আছে সামনের ভৌতিক দৃশ্যটার দিকে। মূর্তি কী করে দুজন অস্ত্রধারী মানুষকে কাবু করে ফেলল ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না ওর। ফারুক ছুরি খেয়ে পড়ে যেতেই ও দেখতে পেল মূর্তিটা পুরোপুরি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল আর সেটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছোটোখাটো একজন মানুষ। বেরিয়ে এসেই সে বাবুল আহমেদের মুখ থেকে ছুরিটা বের করে নিয়ে খঁচ করে সেটা ঢুকিয়ে দিল বাবুল আহমেদেরই গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতেই ছুরিটা খুলে নিয়ে সে তানভীরের দিকে ফিরে একেবারে শান্ত গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো কমান্ডার।’

তানভীরের মস্তিষ্ক এখনো মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। কিন্তু মূর্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটাকে চিনতে পেরে সে বলে উঠল, ‘ডক্টর মিতায়ন, ওরফে জেড মাস্টার।’

‘ইয়েস কমান্ডার,’ ছুরিটা মুছতে মুছতে ওটা দেখিয়ে সে বলে উঠল। ‘চমৎকার জিনিস, তোমার কাছ থেকেই ধার নিয়েছিলাম। এবার তোমারই প্রাণ বাঁচাল জিনিসটা। মনে আছে?’

তানভীরের মনে পড়ে গেল এই স্টিলেটোটাই পাটোয়ারী ওকে দিয়েছিল। এটাই ও হাঁটুর নিচে রাখত, জালালকে গুলি করার পর ওটা নিয়ে গেছিল জেড মাস্টার।

ছুরিটা মোছা শেষ করে সে বলে উঠল, ‘আবর্জনা সাফ করতে আমার কখনোই ভালো লাগে না,’ বলে সে ইশারায় মাটিতে পড়ে থাকা মৃত বাবুল আহমেদ আর ফারুকের দিকে দেখাল। তারপর একেবারে ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তানভীরের সামনে। ‘কিন্তু তুমি কমান্ডার, তুমি কিন্তু সেই মাল। যেভাবে তুমি ব্ল্যাক বুদ্ধাটা খুঁজে বের করলে, উদ্ধার করলে, আর আমি একটা জিনিসও অনুমান করতে পারি আমি যে এই লাক্কাতুরার বাংলোতে থাকব এটাও সম্ভবত তুমিই বের করেছো। কিভাবে করলে কমান্ডার—ওই গাধা প্রবীরের মাধ্যমে নাকি—’ কথা বলতে বলতে সে ছুরিটা চেপে ধরল তানভীরের গলায়।

যদিও গলায় ছুরি চেপে ধরা তবুও তানভীর একবার মূর্তিটা দেখল আরেকবার জেড মাস্টারকে দেখল। কোনোমতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল, ‘এই তাহলে হাজার বছরের পুরনো মূর্তির রহস্য।’

তানভীর কথাটা বলতেই হা-হা করে হেসে উঠল সে। ‘ তোমার এলেম আছে কমান্ডার। মৃত্যুর মুখে বসেও রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো,’ সে হাসতে হাসতেই তানভীরের গলা থেকে ছুরিটা সরিয়ে খানিকটা দূরে সরে গেল। ‘হ্যাঁ, কমান্ডার। ঠিকই বলেছো তুমি। এই সেই বিখ্যাত রহস্য। যত কঠিন রহস্য, তত সহজ সমাধান। বহু পুরনো এক চালবাজি এটা; যে-চালবাজি কাজে লাগিয়ে হাজারো বছর ধরে জাদুকরেরা জাদু দেখিয়ে আসছে। তবে শুধু জাদুকরেরা নয় ধর্মগুরুরাও এসব ট্রিক্স কাজে লাগিয়েছে। প্রাচীন মিথরা ধর্ম থেকে শুরু করে প্রাচীন ইটালির পম্পেই নগরীতেও ফাঁপা মূর্তির ভেতর মানুষ ঢুকে স্রষ্টার অবতার নামে মানুষকে বোকা বানিয়ে এসেছে। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।’

‘আপনি তাহলে বাংলোতে—’

‘ঠিক,’ তানভীরকে প্রশ্ন শেষ করতে দিল না সে। ‘বাংলোতে যখন টের পেলাম যে আক্রমণ হচ্ছে এতই দেরিতে টের পেয়েছি পালাবার উপায় ছিল না। তাই আমিও তাই করলাম যা পুরনো ধর্মগুরুরা করত। ঢুকে বসে রইলাম মূর্তির ভেতরে। ওমা ঢুকে দেখি শুরু হয়ে গেছে আরেক নাটক। যাই হোক, তারপর তো তুমি জানোই, ভালোই এক দফা বিনোদন হলো, কি বলো?’

‘এখন আমাকে নিয়ে-

‘হা-হা,’ আবারো তানভীর প্রশ্ন শেষ করার আগেই হেসে উঠল সে। ‘আহারে কমান্ডার কি অবস্থা তোমার? জীবনের ভার এসে দাঁড়িয়েছে অন্যের হাতে। একটু আগে যে-প্রশ্ন করেছো বাবুলকে এখন একই প্রশ্ন করতে হচ্ছে আমাকে,’ মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করতে করতে সে ছুরিটা বোলাতে লাগল তানভীরের মুখে। ‘কমান্ডার, আমি তোমাকে কিছু করব না। কারণ যদিও বহুত ঝামেলা করেছো তুমি কিন্তু ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করে এনে দিয়েছো তুমিই, এখন আবার তোমার কারণেই আমি ওটা হাতে পেলাম, কাজেই কেন জানি তোমাকে ভালো লেগে গেছে আমার। আর তা ছাড়া, তুমিও আমাকে একবার প্রাণে বাঁচিয়েছো বাংলো থেকে উদ্ধার করে। কাজেই তোমাকে আমি মারব না,’ বলে সে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে চলন্ত ভ্যানের পেছন থেকে ড্রাইভার যেখানে বসে তার পেছনে ছুরির বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা দিয়ে গাড়ি থামাতে বলল। তানভীরের দিকে ফিরে মৃদু হেসে বলল। ‘আমি মূর্তির ভেতরে থাকা অবস্থায় বাবুল আহমেদকে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতে শুনেছি, এরকম শব্দ করলে গাড়ি থেমে যায়।’

সত্যি সত্যি গাড়িটা থেমে যেতেই ধাম করে ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলে ফেলল সে। ‘আদিওস কমান্ডার। ড্রাইভারকে নিকেশ করে এই গাড়িটা নিয়ে এয়ারেপোর্ট যেতে হবে আমার। তারপর সেখান থেকে বাবুল আহমেদের ঠিক করা প্লেনটা খুঁজে বের করতে হবে। আর তোমাকে এখানেই বিদায় জানাব,’ বলে সে লাফিয়ে নামতে গেল গাড়ির পেছন থেকে কিন্তু তার আগেই তানভীর দেখল মানুষটার পুরো শরীর কেমন জানি নীলচে হয়ে গেল সেকেন্ডের জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে শুরু করল সে মৃগী রোগীর মতো। মুহূর্তের জন্যে কেঁপে উঠেই সে গাড়ি থেকে সোজা পড়ে গেল রাস্তার ওপরে।

‘ড্যাম! মারাত্মক জিনিস তো,’ ভ্যানের পেছন থেকে হাবিব আনোয়ার পাশার অকৃত্রিম গলা ভেসে এলো। শালারা দারুণ জিনিস বানিয়েছে,’ তার হাতে ধরা সাবমেশিনগানের মতো দেখতে অদ্ভুত একটা অস্ত্র। এই জিনিসটাই তানভীর তাকে এনে দিয়েছিল স্কটল্যান্ড থেকে। ‘এই কারণেই বুঝেছো আমি ফিল্ডে কাজ করাটাকে খুব মিস করি,’ কথাটা যদিও সে পাশ ফিরে সুলতানের উদ্দেশ্যে বলেছে কিন্তু সুলতান তার কথা শোনার মুডে নেই। সে লাফিয়ে উঠে পড়ল ভ্যানের ভেতরে।

হাবিব আনোয়ার পাশা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা অজ্ঞান জেড মাস্টারের পাশে, ‘জেড মাস্টার না?’ বলে সে পেছন ফিরে ইকবাল আর নিজের সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘খবর পাঠাও। গাড়ি লাগবে, লোক লাগবে। আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। মাল ওঠাতে হবে,’ বলতে বলতে সে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল।

গাড়িতে উঠে তানভীরের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘ভাগ্যিস তোমার হাতে পাটোয়ারীর বসানো ট্র্যাকারটা ছিল না হলে এতটা সঠিকভাবে তোমাদের লোকেট করা সম্ভবই হতো না।’

তানভীর অবশ্য এতকিছু শুনতে পাচ্ছে না, তেমন কিছু দেখতেও পাচ্ছে না পরিষ্কার। তার মনের কোণে জমা হয়ে আছে অনেক প্রশ্ন, কিন্তু এগুলোর কোনোটাই সে ভাবতে চাইছে না। বরং ঘোলাটে হয়ে আসতে থাকা দৃষ্টির সামনে সুলতানের পরিচিত মুখটা দেখতে পেয়ে তার খুশিতে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, ওদেরকে দেখে কতটা খুশি হয়েছে সে। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই না করে সুলতানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইল চুপচাপ, মুখে ফুঁটে উঠল প্রশান্তির মৃদু হাসি।

শেষ কথা
সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ কন্নোর, ভারতবর্ষ

‘তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি, ওই দিন ওভাবে চিৎকার দেয়ার পেছনে কারণ কী ছিল?’ কালন্তি বেশ গম্ভীর মুখে জানতে চাইল শামানের কাছে। কালন্তির মুখে প্রশ্নটা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল শামান, আরেকটু হলে খাবারের শেষ টুকরোটা ওর গলায় আটকে যেতে বসেছিল। খাবার পাত্রটা নামিয়ে রেখে পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিল ও। কালন্তির দিকে এগিয়ে দুই হাত রাখল ওর কাঁধে। শামানের মুখটা মুছে দিল কালন্তি।

‘যাওয়াটা কি খুব জরুরি?’ খানিকটা বিষণ্ণ সুরেই জানতে চাইল কালন্তি। ‘নতুন রাজ্য, নতুন মানুষ, এতগুলো গোত্র আর সেনাবাহিনী, সবকিছুর দায়িত্ব এখন আমার ওপরে। আমি কি একা পারব এসব সামলাতে?’ কালন্তির গলায় না যাবার আবেদন।

শামান এখনো তাকিয়েই আছে কালন্তির ধূসর চোখে। ‘চিৎকারটা ছিল স্বস্তির- অস্বস্তির, দুঃখের-আনন্দের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া,’ শামান কালন্তির পরের প্রশ্নগুলোর জবাব না দিয়ে বরং আগের কথার জের ধরে বলে উঠল ও।

‘সত্যি কথা হলো, রাজা বিক্রম যখন তোমাদের বন্দি করল এরপরে গুটিকয় লোক নিয়ে আমি অভিযান চালাতে গেলাম আমি মোটেই ভাবিনি বিজয়ী হতে পারব। তাই যখন সেই বিজয়ের ক্ষণটা চলে এলো আমার পক্ষে সেটার ধাক্কা সামলানোটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মানুষ শুধু অনেক কষ্টের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খায় না, কখনো কখনো অনেক বেশি আনন্দের ধাক্কা সামলাতেও তাকে বেগ পেতে হয়। ওই চিৎকারটা ছিল ওরকমই একটা প্রতিক্রিয়া,’ বলে শামান কালন্তির দুই কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে ওর দুই হাত ধরল। ওকে এনে বসিয়ে দিল বসার ঘরের দস্তরখানার ওপরে।

সেই দিন মন্তলার হাটের ওই ঘটনার পর কেটে গেছে পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সেই দিন মন্তলার হাটে রাজা বিক্রমকে শামান হত্যা করার পর ওদের সম্মিলিত আক্রমণের সামনে এমনিতেই দিশেহারা হয়ে গেছিল শাক্য বাহিনী, তার ওপরে রাজা বিক্রম মারা যাবার ও শংকরাদিত্য বন্দি হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আত্মসমর্পণ করে। ওরা সেখান থেকে রাজা বিক্রমের মৃতদেহ নিয়ে বিধোরীর দিকে রওনা দেয়। বিধোরীতে খুব কমই শাক্য সৈন্য ছিল। তারা রাজা বিক্রমের মৃতদেহ দেখার পর প্রথমে ওদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু জাথুরিয়া ওদেরকে বোঝানোর পর তারা জাথুরয়িার নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু থারুরা দুর্গ দখল না করে বরং বন্দি শংকরাদিত্য আর বিধোরীর দুর্গের দায়িত্ব জাথুরিয়ার ওপরে ন্যস্ত করে ফিরে আসে নিজেদের গ্রামে। সঙ্গে নিয়ে আসা বুদ্ধমূর্তিটাও লুকিয়ে ফেলা হয় ওদেরই গ্রামে।

এরপর থারুদের প্রতিনিধি হিসেবে কালন্তির নেতৃত্বে পরের দিন থারু-শাক্য- উরগ-লিচ্ছবীসহ কন্নোর উপত্যকায় যত ছোটোখাটো গোত্র আছে সবাইকে নিয়ে আলোচনা আহ্বান করা হয়। সেই আলোচনা সভাতেই তারা কিছু বিষয়ে একমত পোষণ করে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নিজেদের অবস্থান ও করণীর নিয়ে কিছু সিদ্ধান্তে আসে। প্রথমত, তারা নিজেদের জন্যে বরাদ্দ এলাকাতেই বাস করবে। যত ধৰ্ম বিদ্বেষ আর যাই থাক না কেন, একে অন্যের ওপরে আক্রমণ চালাবে না। আর সেইসঙ্গে সব গোত্রের প্রধানকে একসঙ্গে করে একটা জোট গঠন করা হবে। সবার সম্মিলিত বয়ানে সেই জোটের প্রধান ঘোষণা করা হয় মৃত থারু রাজার একমাত্র কন্যা ও বর্তমান থারু গোত্রের প্রধান কালন্তিকে। কালন্তি প্রথমে এই দায়িত্ব নিতে না চাইলেও শামানের ভরসাতেই সে এই দায়িত্ব নিতে রাজি হয়। কিন্তু সে কিছু কিছু শর্ত আরোপ করে।

সেই সব শর্ত অনুযায়ী পরের দিন তাকে কন্নোর এলাকার সকল গোত্র প্রধানদের প্রতিনিধি হিসেবে শপথ নেয়ার কার্যকম সম্পন্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে কন্নোর এলাকায় সকল গোত্রদেরকে একসঙ্গে হবার খবর শুনে কেন্দ্রীয় শাসন থেকে শুঙ্গ সৈন্যদের রওনা দেয়া বাহিনী ফেরত চলে যায়। তবে গুজব রটেছে শুঙ্গ বাহিনী ফেরত যাবার প্রকৃত কারণ হলো, শুঙ্গ সম্রাট নাকি অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোল মেটানোর চেয়ে উত্তর থেকে গ্রিক আক্রমণ ঠেকাতে বেশি ব্যস্ত এইমুহূর্তে। তবে গোত্রদের প্রধান হবার পর কালন্তি নিজ থেকে তাদের কাছে একটা শান্তি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। যদিও ওটার কোনো জবাব এখনো আসেনি, তবু কালন্তি আশাবাদী।

সবশেষে ওই বুদ্ধমূর্তিটার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা শামানই নিয়েছে। ভারতের অন্যপ্রান্তে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের অন্যপাশে সাত রাজ্যের সম্মিলিত এক ভূমি আছে। সেখানকার ত্রিপুরা আর আসাম রাজার অধীনে বিধু দীর্ঘদিন কাজ করেছে। বিধুর পরামর্শে শামানই প্রস্তাব করেছে মূর্তিটা ওরা আসামে নিয়ে যাবে। ওদের দুজনারই অভিমত হলো, এই মূর্তি শুধু অমঙ্গলই বয়ে আনবে। বিশেষ করে এই এলাকাতে থাকলে। কারণ এখানে মূর্তিটাকে নিয়ে এত বেশি জলঘোলা হয়েছে অত্র এলাকাতে থাকলে কোনো না কোনো গোত্র এটাকে দখল করতে চাইবেই। ফলে এই মূর্তির কারণে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে কন্নোর ভূমি। তারচেয়ে এলাকায় শান্তি বজায় রাখার জন্যেই ওটাকে আসাম নিয়ে লোকচক্ষুর আন্তরালে সরিয়ে ফেলা হবে। কালন্তি প্রথমে মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু পরে মেনে নিয়েছে শামানের পরামর্শে। আজ শামানের বিদায় নেবার দিন।

কালন্তিকে ওর পাশে বসিয়ে শামান ওর ধূসর চোখ জোড়ার গভীরে তাকাল। ‘শোন, আমি না থাকলেও তোমার সমস্যা হবে না। কারণ মূল যে সমস্যাগুলো ছিল সেটার অনেকটাই সমাধান হয়ে এসেছে। প্রতিটা গোত্রই অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে, অন্যের ধর্মের ওপরে আরোপ বসাতে গিয়ে নিজেদের ক্ষতি করেছে। এটা তারা অনেকটাই বুঝতে পেরেছে এখন। কাজেই সবাই চেষ্টা করবে তোমাকে সহায়তা করতে, আর যদি তাও না হয় বিশ্বস্ত সঙ্গীরা আছে তোমার সঙ্গে। ওরা দেখবে তোমাকে। ঘোষিত, ধোয়ী, জাথুরিয়া এদের মতো বন্ধু ও সহকারী আর হয় না।

‘আমি তো শুধু বন্ধু কিংবা সহকারী চাই না, আরেকটু বেশি কিছু চাই,’ কালন্তিও শামানের নীল চোখের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘আর সে যদি আমার থেকে দূরে সরে যায় তবে এরচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে?’

‘আরে,’ হেসে উঠল শামান। ‘আমি তো দূরে যাচ্ছি ফিরে আসার জন্যেই,’ বলে শামান একটু গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, ‘তুমি তো জানোই এই উপত্যকায় আমাকে ফিরে আসতেই হবে। আমি যার সন্ধানে এখানে এসেছিলাম ডুকপা লামা মারা যাবার আগে সেটার সন্ধান আমাকে বলে গেছে। কাজেই আমাকে আমার পরিবারে খোঁজ করতে হবে। আমাকে খুঁজে বের করতে হবে, আমি কে, কেন আমি অন্যদের থেকে আলাদা।’

ডুকপা লামা সেই জলগুহাতে মারা যাবার আগে শামানকে বলে গেছেন সে যখন শামানকে খুঁজে পায় তখন তার গলায় যে চামড়ার বটুয়াটার ভেতরে এক গাদা অচেনা ভাষায় লেখা তঞ্জুর ছিল সেগুলো শান্তির মঠের মূল্যবান তথ্য সংরক্ষণাগারের বিশেষ একটা জায়গায় রাখা আছে। সেই জায়গার নির্দেশনাও ডুকপা লামা জানিয়ে গেছে মারা যাবার আগে। আরো জানিয়ে গেছে, যদিও উনি অচেনা সেই ভাষা পুরোপুরি কখনোই বুঝতে পারেনি তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছিল তাতে এটা পরিষ্কার যে ওই চামড়ার বটুয়ার ভেতরে লেখাগুলো আসলে হিমালয়ের অচেনা এক অঞ্চল থেকে স্থানান্তরিত হওয়া শামানিক নামে এক গোত্রের ইতিহাস। আর সেই গোত্রের নামেই উনি শামানের নাম রেখেছিলেন।

‘আমি এতসব কিছু বুঝি না। তুমি ওই বুদ্ধমূর্তি আসাম রাজার রাজ্যে গোপন করার ব্যবস্থা করে ফিরে আসবে আমার কাছে। এরপরে যেখানে খুশি যাবে যা খুশি করবে,’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে কালন্তি তশতারির একপাশে রাখা শামানের কাতানা জোড়ার চামড়ার খাপটা উঠিয়ে এনে বেঁধে দিল ওর পিঠে। পূর্ণ সাজে সজ্জিত হয়ে শামান আর কালন্তি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল সবাই অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।

ওদের যাত্রার সব আয়োজন প্রস্তুত আছে কি না বিধুর কাছে জেনে নিয়ে একে একে ভাবলেশহীন ধোয়ী, সদা চঞ্চল ঘোষিতসহ সেই লম্বা দাড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়ায় উঠল শামান। ঘোষিত আর বিধু এমনভাবে কান্নাকাটি করছে যেন কেউ মারা গেছে। বিধুকেও তাড়া দিয়ে ঘোড়ায় উঠিয়ে লোক-লস্কর আর সেই মূর্তিটা রাখা বাক্সসহ রওনা দিল ওরা।

খালের ওপরে সেই কাঠের সেতুটা মেরামত করা হয়েছে। ওটা পার হয়ে এসে থারুদের গ্রামের দিকে ফিরে তাকাল শামান। ওদের নতুন নেত্রী কালন্তির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কালন্তির ধূসর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। শামান যত শক্ত মানুষই হোক ও জানে নিজের হৃদয়ের একটুখানি অংশ রেখে যাচ্ছে ও এই কন্নোর এলাকায়। এই ধূসর চোখের মায়া কাটানো ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। যতই নীল চোখের মানুষদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করুক না কেন এই ধূসর চোখের টানে একদিন ওকে ঠিকই ফিরে আসতে হবে এখানে।

বর্তমান সময়
শাহী ঈদগাহ, সিলেট

তানভীরের হিসেবে সময়টা এখন সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি হওয়া উচিত, তাহলে ওর কামরাটা এমন অন্ধকার লাগছে কেন। হাতে-পায়ে শরীরের এখানে ওখানে ব্যান্ডেজ। একটা হাত স্লিংয়ে ঝুলছে, অন্যহাতে সেলাইনের সুচ। কিন্তু চোখ মেলতে তো কোনো সমস্যা নেই। চোখ মেলে আধো অন্ধকার দেখে কেন জানি বেশি অস্বস্তি বোধ হলো তানভীরের। রুমের ভেতরে কিছু একটা ঠিক নেই।

ওর মনের ভাবনাটা প্রমাণ করার জন্যেই একেবারে মাথার পাশ থেকে কথা বলে উঠল একজন মানুষ।

‘শেষ পর্যন্ত তাহলে ‘বিদায়’ বলতেই হলো, তাই না?’ তানভীর আস্তে-ধীরে উলটো দিকে ফিরে তাকাল। ওর মাথার কাছেই চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা আর কেউ নয়, স্বয়ং ওর ইউনিটের প্রধান হাবিব আনোয়ার পাশা। আনোয়ার পাশার হাতে এক টুকরো কাগজ। কাগজটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল তানভীর। একটু লজ্জাও পেল ওটা পাশা স্যারের হাতে দেখে। কাল বিকেলে এই কাগজটাই সে চেয়ে নিয়েছিল এক নার্সের কাছ থেকে। কাগজটার উলটোপিটে কী লেখা আছে খুব ভালোভাবেই জানে ও।

ওই দিন লাক্কাতুরা আর এয়ারেপোর্ট রোড থেকে জেড মাস্টারকে বন্দি করে তানভীরকে উদ্ধার করে আনার পর এক দিন পার হয়েছে। এই একদিন এক রাতে বাইরে কী ঘটেছে তানভীর খুব বেশি কিছু জানে না। কারণ ওকে যখন সিলেট সম্মিলিত পুলিশ হাসপাতালে আনা হয় বেশ আহত ছিল ও। একই সঙ্গে গুলির আঘাত ও রক্তক্ষরণে অবস্থা খারাপ ছিল ওর। আর তাই ওই দিন রাতেই অপারেশনের পর থেকে পুলিশ হাসপাতালের এই কেবিনেই রাখা হয়েছে ওকে। কারো সঙ্গে দেখা করার তেমন সুযোগ পায়নি। তবে এরই মধ্যে একবার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে মোবাইলে। মা খুব বেশি কিছু না জানলেও অনুমান করতে পেরেছে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তাই এক গাদা প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল কিন্তু বেশি কথা বলেনি তানভীর। যত বেশি কথা বলতে যাবে ততই মায়ের কাছে ধরা পড়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। তাই কম কথা বলে মাকে কোনোমতে এটা-সেটা বুঝিয়ে অবার কল করবে বলে বিদায় নিয়েছে। এই এক দিন শুয়ে থেকে আরেকটা ব্যাপার অবশ্য ঘটেছে; বাইরে থেকে বারবার একজন মহিলা নাকি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল। মহিলাটা কে হতে পারে খুব সহজেই অনুমান করতে পারছিল তানভীর, লায়লা। কিন্তু ওর লায়লার সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। তাই এক নার্সকে অনুরোধ করে ওই চিঠিটা লিখে পাঠিয়েছিল লায়লাকে। কিন্তু ওটা পাশা স্যারের হাতে গেল কিভাবে কে জানে।

ওকে একটু চমকাতে দেখে যেন মজাই পেল আনোয়ার পাশা। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে গেল সে। একটানে জানালার ভারী পর্দাটা সরিয়ে দিতেই ঝলমলে রোদে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কামরাটা। সেই চিরকুটটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রাখতে-রাখতে সে বলে উঠল, ‘এই বিদায়টা আরো অনেক আগে জানানো উচিত ছিল তোমার।’

‘জালালভাই কেমন আছে?’ পাশা স্যারের কথার জবাব না দিয়ে বরং প্রসঙ্গ এড়ানো জন্যে তানভীর জানতে চাইল।

তানভীরের প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে উঠল আনোয়ার পাশা। ‘জালাল ভালো আছে, প্রাথমিক বিপদ কেটে গেছে। বেচারার এখন একটাই সমস্যা, হাসপাতালের বেডে শুয়ে তো আর সিগারেট খেতে পারবে না। তাকে কয়দিন শাস্তি পেতে হবে বিছানায় শুয়ে।’

তানভীরও সামান্য হেসে উঠল পাশা স্যারের কথায়। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল জালাল রাগের সঙ্গে বিছানায় শুয়ে সিগারেট খাবার জন্যে ছটফট করছে কিন্তু কোনো উপায় নেই। ‘স্যার, হয়েছিল কী আসলে?’

পাশা স্যার মাথা নাড়ল। ‘তুমি তো কমবেশি সবই জানো। তারপরও বলছি। প্রফেসর টেড চ্যাঙ বহু বছর ধরে ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে গবেষণা করছিল। সে-ই প্রথম লন্ডনে এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে জেড মাস্টার মানে মিতায়নের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কথা প্রসঙ্গে ব্ল্যাক বুদ্ধার কথা তাকে জানায়। জেড মাস্টার তখনই বুঝে ফেলে এর মধ্যে বড়ো কিছু আছে। সে তখন থেকেই পরিকল্পনা করে নিজের একটা আলাদা আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠা করতে লেগে যায়। সব ঠিক হবার পর তারা গবেষণা করে বের করে ব্ল্যাক বুদ্ধা যদি আদৌ থেকে থাকে তবে সেটা আছে আসামের কোথাও। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি আজ থেকে দুই হাজারেরও বেশি সময় আগে মৌর্য আর শুঙ্গদের গণ্ডগোলের সময়ে বানানো হয়েছিল এই মূর্তি। কারা বানিয়েছিল-কেন বানিয়েছিল এসব কিছুই ঠিকমতো জানা যায়নি। তবে ইতিহাসের পাতায় নাকি এক লাল চুলের তিব্বতি যোদ্ধার কথা উল্লেখ আছে। সে নাকি বিভিন্ন গোত্রের ভেতরে বিবাদ মেটানোর জন্যে এই ব্ল্যাক বুদ্ধাকে তৎকালীন আসামের রাজার সহায়তায় গোপনে দাফন করেছিল। কিন্তু জিনিসটা কোথায় আছে এটার একটা ব্লু সেই যোদ্ধা রেখে গেছিল তার ব্যবহৃত জোড়া কাতানার হাতলে। এই তিব্বতি যোদ্ধার রেখে যাওয়া নোট থেকেই তারা ব্যাপারটা খুঁজে বের করে।’

‘জেড মাস্টার যখন জানতে পারে জিনিসটা আসামে আছে তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশের সিলেটে থেকে সে আসামে অপারেশন চালাবে। কারণ ভারতে সে চাইলেও নিজের ভুয়া পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে পারত না। অন্তত বাংলাদেশে সাস্টের শিক্ষক সেজে যেভাবে করেছিল অতটা ভালোভাবে করতে পারত না। তো এরপরে জেড মাস্টার তার সেই নকল আইডেন্টিটির মাধ্যমে সিলেট এসে আস্তানা গেড়ে কাজ শুরু করে। ওদের এই প্রজেক্টের ওপরে চোখ ছিল সরকারের একটা মহলের। এই মহলটার উদ্দেশ্যই ছিল ওরা কিছু পেলেই সেটা হাতিয়ে নেবে। তো যাই হোক, ওরা যখন আসামে মোটামুটি সফলতার দিকে যেতে থাকে তখন প্রফেসর টেড চ্যাঙ ধীরে ধীরে অনুমান করতে থাকে আসলে ভুল লোকের সঙ্গে সে কাজ করছে। সে ভেবেছিল বাংলাদেশে এসে এটা নিয়ে সে কিছু একটা করবে। অন্যদিকে তারা যখন আসামে ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করছে তখন বাংলাদেশে জেড মাস্টারের ডান হাত শেখারভ আর প্রজেক্ট স্পন্সর হেকমত আবদুল্লাহ দুজনে মিলে জেড মাস্টারের সঙ্গে বেঈমানির সিদ্ধান্ত নেয়।’

‘তাদের ব্যাপারটা বুঝলাম কিন্তু টেড চ্যাঙ তো একজন সম্মানিত প্রফেসর, চাইলেই তো সে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে পারত,’ তানভীর বলে উঠল। ‘পরবর্তীতে শেখারভের সঙ্গে সে কেন যোগ দিতে গেল?’

‘এটাই তো কথা। আসলে সে কেন এমন করেছিল এখন তো আর পুরোপুরি জানা সম্ভব নয় তবে আমি অনুমান করতে পারি, সে প্রজেক্টের এত ভেতরে জড়িয়ে গেছিল যে ভয় পাচ্ছিল পুলিশ বা সরকারের লোকজন তার কথা বিশ্বাস করবে না।’

‘কিংবা এমনও হতে পারে সে হয়তো ভয় পাচ্ছিল বাংলাদেশ বা ভারত সরকারকে সব জানালে আরো বেশি বিপদ হবে তার… কে জানে!’ তানভীর আনমনেই বলে উঠল। ‘তার মৃতদেহ কি পাওয়া গেছে?

‘হ্যাঁ, সুরমা নদীর তীর ধরে বেশ কিছুদূরে এক মোহনার কাছে ভেসে ওঠা দেহটা উদ্ধার করা হয়েছে গতকাল,’ বলে আনোয়ার পাশা কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তুমি যা বললে সেটাও হতে পারে। হয়তো সে ভয় পেয়ে গেছিল। তো যাই হোক বেঈমানির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর শেখারভ আর ওদের প্রজেক্টের ফাইনেন্সিয়ার হেকমত মিলে মিতায়নরা মূর্তি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওদের ওপরে হামলা চালায়। জেড মাস্টারকে বন্দি করে রাখে লাক্কাতুরার বাংলোতে।’

‘এই ব্যাপারটাও পরিষ্কার নয় আমার কাছে,’ তানভীর একটু উঠে বসল। ওরা জেড মাস্টারকে ওই বাংলোতেই রাখল কেন?’

‘কারণ ওরা জানত যে ওই বাংলোর কথা কেউ জানে না। কিন্তু ডক্টর মিতায়ন যে ওটার কথা তার স্ত্রীকে বলেছে, এটাও ওরা জানত না। কিন্তু অনুমান করেছিল। যে-কারণে তাকে ধরে আনার জন্যে লোক পাঠায়। আর তখুনি তোমরা সেখানে গিয়ে হাজির হও,’ বলে পাশা স্যার একটু থেমে আবারো বলতে লাগল।

‘তো যাই হোক, জেড মাস্টারকে বাংলোতে বন্দি করে ওরা অবস্থান নেয় হেকমতের ওখানে। ওখানে সম্ভবত হেকমত ওদেরকে ব্ল্যাকমেল বা কিছু একটা করার চেষ্টা করে। শেখারভ তখন হেকমতসহ তার লোকদেরকে মেরে স্থানীয় গডফাদার কানা মাতবরের আশ্রয়ে সিলেট থেকে পালানোর পরিকল্পনা করে। তার সঙ্গে এরই মধ্যে যোগ দিয়েছে প্রফেসর টেড চ্যাঙ। এরই মধ্যে সরকারি দুনীতিবাজ মহল দেখে ওদের এতদিনের সাধের পরিকল্পনা মাঠে মারা যাচ্ছে,’ বলে পাশা স্যার হেসে উঠে বলে চলল।

‘তখনই কাহিনিতে যুক্ত হয় বাবুল আহমেদ। বাবুল এটা বুঝতে পারে যে নিজের এজেন্টদেরকে সে সরাসরি বলি দিতে পারবে না। তাই সে আমার কাছে সাহায্য চায়। সে জানত আমি আমার এজেন্টদের দক্ষতা মাঠ পর্যায়ে যাচাইয়ের জন্যে অস্থির হয়ে আছি। এইবার কাহিনিতে এন্ট্রি ঘটে তোমার। কিন্তু হেকমত, শেখারভ কিংবা বাবুল কেউই ভাবতে পারেনি তুমি মাঠে নেমেই এত দ্রুত ডক্টর মিতায়নকে উদ্ধার করে ফেলবে। মিতায়নকে উদ্ধার করার পর শুরু হয় নতুন খেলা। এবার মিতায়ন তোমাদের ব্যবহার করতে শুরু করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে। সেটা হবার পর সে যখন পালাল, বাবুলের তখন মাথা খারাপ। কিন্তু এবারো ফিল্ডে অনভিজ্ঞ তানভীর আর আইটি এক্সপার্ট টমির কাজের সামনে মাথা নোয়াতে হয় সবাইকে। এবারও কেউই ভাবতে পারেনি এত দ্রুত জেড মাস্টারকে বের করে ফেলতে পারবে তুমি। এরপরে তো সব তুমি জানো।’

‘স্যার, এই তাহলে সেই মূর্তির রহস্য। ওটা আসলে ফাঁপা, ওটার ভেতরে মানুষ ঢুকে কথা বলতে পারে,’ বলে হেসে উঠল তানভীর। ‘মূর্তিটা কোথায় স্যার? আর জেড মাস্টার?’

দুটোই এখন আমাদের জিম্মায় আছে,’ বলে আনোয়ার পাশা একটু ভেবে বলে উঠল। ‘তানভীর এই ঘটনার ভেতরে আরো অনেক ব্যাপার আছে, যেগুলো এখনো পরিষ্কার না। প্রথমত, সরকারি মহলের ভেতর থেকে কেউ বাবুল আহমেদকে ব্যাকআপ করছিল। দ্বিতীয়ত, একটা ব্যাপার কেউই খেয়াল করেনি, এমনকি তুমিও খেয়াল করোনি। জেড মাস্টার হাসপাতালে থাকার সময় সে অসহায় দুর্বল ছিল হঠাৎ সে লোকবল, অস্ত্র এসব পেল কোথায়। ডক্টর প্রবীর তাকে শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করছিল কিন্তু বাকিগুলো সে কোথায় পেয়েছে?’

তানভীর চুপ, এই ব্যাপারগুলো আসলেই সে ভেবে দেখেনি।

‘তানভীর তুমি রেলিক নামে কোনো সংস্থার নাম শুনেছো?’ পাশা স্যারের প্রশ্নের জবাবে তানভীর চুপ করে রইল। ‘কিংবা নেক্রপলিস?’ এবারও তানভীর চুপ। পাশা স্যার বলে চলেছে, ‘এই দুটোই আন্তর্জাতিক অ্যান্টিক চোরাচালান সংস্থা। প্রথমটা এশিয়াতে অ্যাকটিভ আর দ্বিতীয়টা সারা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর অ্যান্টিক চোরাচালানি সংস্থাগুলোর একটা। এতদিন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশে কখনো রেলিক কিংবা নেক্রপলিসের কোনো অ্যাক্টিভিটি টের পাইনি। কিন্তু জেড মাস্টার যেহেতু বাংলাদেশে কাজ করছিল কাজেই অবশ্যই এই দুটো সংস্থা এখন বাংলাদেশে অ্যাকটিভ। জেড মাস্টার সম্ভবত এই দুটো সংস্থার কারো কাছ থেকেই সাহায্য পাচ্ছিল। সেইসঙ্গে আমাদের সরকারি সংস্থার ভেতরে একটা দুর্নীতিগ্রস্থ সুডো অর্গানাইজেশনের অস্তিত্বও টের পাচ্ছি আমরা-আনঅফিসিয়ালি আমরা ওটার নাম দিয়েছি ‘পরজীবী’। এরা কারা-কিভাবে অপারেট করে এখনো কিছুই জানি না আমরা। তবে এদেরকে খুঁজে বের করতে আমি বদ্ধপরিকর,’ এই পর্যন্ত বলে একটু ভেবে খানিকটা উদাস কিন্তু গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ‘সব মিলিয়ে আমাদের সামনে অনেক বড়ো একটা ঝড় আসছে,’ পাশা স্যার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে তানভীর, ঝড় সমলানোর মতো প্রস্তুতি।’

তানভীর চুপ, কিছু বলছে না।

পাশা স্যার বলেই চলেছে, ‘কখনো ভেবে দেখেছো তানভীর, এক সময় তুমি সাংবাদিক হতে চাইতে, এরপরে লেখক হতে চেয়েছো, কিন্তু তোমার নিয়তি তোমার জন্যে অন্যকিছু ঠিক করে রেখেছিল। আর তাই তুমি আজকে এখানে,’ বলে সে একটা খাম দেখাল তানভীরকে। ‘আমার হাতে এটা কি দেখতে পাচ্ছো?’ খামটা সামান্য নেড়ে বলে উঠল সে, ‘তোমার নিয়তি,’ বলে আরো যোগ করল, ‘তুমি হয়তো জানো না শারিয়ার দেশে ফিরেছে।’

শারিয়ারের কথা শুনে চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তানভীরের। ‘কবে স্যার?’ ‘গত পরশু দিন। আমি আগামী দুয়েকদিনের ভেতরে ওকে আমি চট্টগ্রাম পাঠাচ্ছি একটা জরুরি কাজে। আমাদের সোর্স অনুমান করছে মগ জলদস্যুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস নিয়ে বেশ রহস্যময় কিছু ঘটনা ঘটছে ওখানে। ওই ব্যাপারটা দেখার জন্যে আমি চট্টগ্রাম পাঠাচ্ছি ওকে। ও যদি সফলভাবে চট্টগ্রামের মগ জলদস্যুদের কেসটা সমাধান করে ফিরে আসতে পারে-তবে আমি চাই তুমি ওকে নিয়ে একটা দল গঠন করো। আমার ধারণা যদি ভুল না হয় এরই মধ্যে সুলতান, জালাল, ইকবাল এদের সঙ্গে তোমার একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তুমি এদেরসহ শারিয়ারকে নিয়ে একটা দল গঠন করবে। ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইংয়ের পাশাপাশি একেবারে স্বতন্ত্র আর স্বাধীন একটা অপারেটিভ দল। আমি তোমার দলটার জন্যে একটা নামও ঠিক করে ফেলেছি। দুয়েকদিনের ভেতরেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে এটার প্রাথমিক প্রস্তাব পেশ করা হবে,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল,

‘তানভীর তুমি সারাটা জীবন কাটিয়েছো খুঁজে বের করতে যে-তুমি আসলে কী চাও। আমি তোমাকে একটা সুযোগ করে দিচ্ছি। বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত,’ বলে আনোয়ার পাশা একবার ছোটো করে মাথা ঝাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

তানভীর ওর মাথার কাছে রাখা খামটা নিয়ে খুলে দেখল বেশ কয়েকটা প্রিন্টেড কাগজ ভাঁজ করে রাখা ওটার ভেতরে। ওটার সর্বাগ্রে লেখা ‘প্রপোজাল ফর টিম আলফা’, শিরোনামের ঠিক নিচের ধাপেই লেখা প্রপোজড কমান্ডার; তানভীর মালিক। কাগজগুলো খামে ঢুকিয়ে রেখে দিল ও বালিশের পাশে।

বালিশটার ঠিক পাশেই রাখা চিরকুটটা, যেটা ও লায়লাকে পাঠিয়েছিল।

লায়লা ওটা পড়েছে কি না কে জানে। ওটাতে তানভীর খুবই সহজ-সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলেছে, ও লায়লার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়, কিংবা কোনো ধরনের যোগাযোগও রক্ষা করতে চায় না। তবে তার ওপরে তানভীরের কোনো রাগ নেই। তানভীরে সঙ্গে লায়লা যা করেছিল সেটার শাস্তি সে পেয়েছে মিতায়নের কাছ থেকে। সবশেষে ওকে ভালো থাকার উইশ করে বিদায় জানিয়েছে তানভীর। নার্সকে ডেকে আবারো চিরকুটটা লায়লার কাছে পাঠাতে হবে।

তবে মনের কোণে ও এটাও জানে ওকে আরেকটা চিরকুট পাঠাতে হবে লায়লার ছোটো বোন শায়লার কাছে। কারণ শায়লাকে একটা ব্যাপারে ধন্যবাদ জানাতে হবে ওর। সুস্থ হতে হবে ওকে, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে, সুলতান- জালাল-ইকবালের সঙ্গে মিটিং করতে হবে। প্রচুর কাজ পড়ে আছে। শারিয়ার চট্টগ্রাম থেকে মগ জলদস্যুদের কেসটা সামলে ঢাকা এলে ওর সঙ্গে বসতে হবে, তবে এই মুহূর্তে এগুলোর কোনোটাই ভাবতে ইচ্ছে করছে না ওর।

বিছানার পাশে রাখা মোবাইলটা তুলে নিয়ে ওটাতে হেডফোন লাগাল। অডিও ফোল্ডারে ঢুকে একটা বিশেষ গান খুঁজে পেতেই মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। কানে হেডফোন লাগিয়ে গানটা ছেড়ে দিয়ে প্রশান্তির সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিজের ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল ও।

মোবাইলের সঙ্গে সংযুক্ত হেডফোনের ক্ষুদে স্পিকারের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা সুরলহরিতে জন ডেনভার তার মায়াবি গলায় গেয়ে চলেছে,

‘কান্ট্রি রোডস টেইক মি হোম…’ শুনতে-শুনতে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল তানভীরের। ওকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে, মায়ের কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *