ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৫৭

অধ্যায় সাতান্ন – বর্তমান সময়
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ, সিলেট

মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ থেমে গেলে যেমন ধাক্কা খায় তানভীরের কথা শুনে বাবুল আহমেদ অনেকটা সেরকম ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। ‘হোয়াট! কী বললে তুমি কমান্ডার?’

‘জি স্যার, আপনি ঠিকই শুনেছেন,’ তানভীর দিগন্তের কাছে আবছাভাবে ফুটে ওঠা মেঘালয়ের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘একেবারে সঠিকভাবে না জানলেও আমি এটা অনুমান করতে পারি ব্ল্যাক বুদ্ধা ও জেড মাস্টার কোথায় আছে।’

‘কমান্ডার, তুমি ঠিক বলছো তো?’ বাবুল আহমেদ খুব সতর্ক গলায় কথা বলছে। ‘যদি তুমি ঠিক হও তবে ভালো কিন্তু যদি উলটোপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করো তবে তোমার ক্যারিয়ার তো যাবেই তুমি নিজেকেও বাঁচাতে পারব না। মনে রেখো তুমি জেড মাস্টারের ব্যাপারে কথা বলছো, একজন আন্তর্জাতিক অপরাধী, যাকে এতদিন পর্যন্ত কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি। সে তোমার পাঞ্জার ভেতরে বসে তোমাকে নিয়ে খেলেছে, তারপর তোমাকে ব্যবহার করে জিনিসটা উদ্ধার করিয়ে তোমার হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।’

তানভীর মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেল বাবুল আহমেদের দিকে। ‘স্যার, একটা ব্যাপার চিন্তা করে দেখেন। আজ ভোরের ব্যাপারটা তো সব আপনি জানেনই। তাহলে বুঝে দেখেন, হতে পারে সে জেড মাস্টার। হতে পারে সে অনেক বড়ো কিছু কিন্তু সে এখানে যখন আসে সে খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। তার নিজের লোকেরা তার সঙ্গে বেঈমানি করেছে-তার শরীর আহত ছিল। হঠাৎ সে এতটা ক্ষমতা কোথায় পেল যে সে আমাদের সুরক্ষিত ল্যাবের ভেতরে নিজের লোক ঢুকিয়ে তাদেরকে দিয়ে আমাদের মতো ট্রেইনড এজেন্টদের কবজা করে সে ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে পালাল,’ তানভীর তাকিয়ে আছে বাবুল আহমেদের দিকে।

‘স্যার, অবশ্যই সে এখানকার ভেতরের কারো সাহায্য পেয়েছে। সেই লোকটা কে আমি জানি। অন্তত আমি অ্যানালিসিস করে বের করতে পেরেছি। সেইসঙ্গে আরেকটা ব্যাপারও আমি অ্যানালিসিস করেছি জেড মাস্টার ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে কোথায় যেতে পারে।

বুঝতে পারলাম না তোমার কথা। এটা বুঝলাম যে এখানে ভেতরের কেউ জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু এটা তুমি কিভাবে বলতে পারো সে মূর্তি নিয়ে কোথায়

গেছে।’

‘স্যার, এই শহরের ভেতরেই আছে সে,’ তানভীর এখনো মরিয়া হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে বাবুল আহমেদকে। ‘একটা ব্যাপার ভেবে দেখুন স্যার। জেড মাস্টার মূর্তি নিয়ে আজ সকালে বেরিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সব জায়গায় স্থল, জল-আকাশপথ মানে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সবখানে আমাদের পাহারা আছে। আমি এটা বলছি না যে সে বেরুতে পারবে না ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে। কিন্তু আমার অ্যানালিসিস বলে সে বেরুনোর চেষ্টাই করবে না। কারণ সেটা অনেক বেশি ঝুঁকি হবে। তারচেয়ে আপাতত এই শহরেই অনেক নিরাপদ জায়গা আছে, যেখানে সে নিজের লোকদেরকেসহ মূর্তি নিয়ে লুকিয়ে থাকবে। এমন জায়গা যেখানে তাকে খোঁজার কথা কেউ কল্পনাও করবে না।’

‘কোন সেই জায়গা?’

‘স্যার, আমার অ্যানালিসিস বলে দুটো সম্ভাব্য জায়গাতে সে লুকাতে পারে। এক, লাক্কাতুরার সেই বাংলো যেখান থেকে আমরা তাকে উদ্ধার করে এনেছিলাম। দুই, সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় হেকমত আবদুল্লার বাসা। তবে আমার অ্যাসালিসিস যদি ঠিক হয় তবে আমাদেরকে রাফ গেস করার প্রয়োজনই হবে না। কারণ,’ বলে তানভীর নিজের একটা আঙুল তুলল। ‘আমাদের মাঝেই এমন কেউ একজন আছে যে জেড মাস্টারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে সাহায্য করেছে।’

‘আর সেটা কে হতে পারে, যে এভাবে ল্যাবের ভেতরে লোক ঢুকতে দিতে পেরেছে?’ বাবুল অহমেদ তানভীরের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন এতক্ষণে।

স্যার, ঊর্ধ্বতন কেউ। যার কাছ এই ল্যাবের সমস্ত অ্যাকসেস আছে। আর এমন মানুষ একজনই আছে এই ল্যাবে। ডক্টর প্রবীর।’

বাবুল আহমেদ ঝট করে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল। ‘আর ইউ ইনসেন কামান্ডার! ডক্টর প্রবীর কত পুরন আর বিশ্বস্ত লোক তুমি জানো? তুমি তার বিরুদ্ধে আঙুল তুলছো।’

‘স্যার, এক মিনিট,’ সত্যি সত্যি তানভীর একটা আঙুল তুলে বাবুল আহমেদকে থামাল। ‘স্যার, আমি কারো বিরুদ্ধেই আঙুল তুলছি না, আমি আপনাকে কোনো ব্যাপার অনুমান করতেও বলছি না। আমি ফ্যাক্ট অ্যানালিসিস করছি। আমি টমিকে নির্দেশ দিয়েছি এই ল্যাব থেকে বের হওয়া প্রতিটা টকি ডিভাইসের, প্রতিটা সেল ফোনের ইনপুট ও আউটপুট ডেটা অ্যানালিসিস করতে। যদি এই ল্যাব থেকে সন্দেহজনক কোনো কল বের হয় আর সেটা কোথায় যায়— সেটা ট্রেস করতে পারলেই আমরা আমাদের বেঈমান কে-সেটা যেমন জানতে পারব তেমনি শত্রুর লোকেশনও পেয়ে যাব। তারপর আপনি সেই ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেবেন স্যার।’

বাবুল আহমেদ কিছু না বলে আপত্তির দৃষ্টিতে মাথা নাড়ল। ‘কমান্ডার, তুমি অথটিরির সিদ্ধান্ত ছাড়া এভাবে আর কখনো কোনো কাজ করবে না। এখন টমিকে ডেকে পাঠাও আমাকে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

কিন্তু টমিকে ডাকতে হলো না, তার আগেই ল্যাবের এক লোক এসে জানাল কনফারেন্স রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে টমি। ডেকে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই টমি এসে ঢুকল। তার পরনে আয়রন মেইডেনের টি-শার্ট, গলায় মোটা একটা হেডফোন, এক হাতে ল্যাপটপ, অন্যহাতে একটা মডেমের মতো জিনিস।

‘টমি কিছু পেয়েছো?’ তানভীর উদগ্রীব গলায় জানতে চাইল।

‘মনে হচ্ছে কিছু একটা পেয়েছি স্যার। এখন থেকে মিনিট সাতেক আগে আমাদের ল্যাবের ওয়াশরুম থেকে একটা আননোন নম্বর থেকে কল বেরিয়ে গেছে। আমি প্রথমবার ট্রেস করতে পারিনি। মনে হয় কলটা কেটে গিয়ে আবারো কল করা হয় তখন সেটা ট্রেস করতে পারি। কলটা বেরিয়েছে আমাদের ল্যাবের এই ফ্লোরের ওয়াশরুম থেকে। এখন থেকে ঠিক সাত মিনিট আগে,’ নিজের ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল টমি ।

‘মানে স্যার আমি যখন আপনার সঙ্গে একা কথা বলার জন্যে ল্যাব খালি করতে বলি তার একটু পরেই,’ তানভীর খুশি হয়ে বলে উঠল।

‘তাহলে সে সময়ের ওই করিডরের সিসিটিভি চেক করো,’ বাবুল আহমেদ নির্দেশের গলায় বলে উঠল।

‘করেছি স্যার, এই যে মানুষটা,’ বলে টমি তার ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দেখাল। তিনজনেই তাকিয়ে দেখেল একমাথা ঝাঁকড়া এলোমেলো চুলের ডক্টর প্রবীর ওয়াশরুমে ঢুকলেন। পরেই এদিক-সেদিক তাকিয়ে বেরিয়ে এলেন।

‘বাস্টার্ড,’ বাবুল আহমেদ গলায় রাগের হলকা।

‘আরো মজা আছে স্যার, যে নম্বর থেকে কলটা করা হয়েছে সেটা একটা স্যাটেলাইট ফোন,’ বলে টমি আরো কিছু বলার পাঁয়তারা করছিল। তার আগেই তানভীর তাকে ধমকে উঠে বলল। ‘টমি, কথা সংক্ষেপ। কলটার ডেস্টিনেশন কোথায় ছিল?’

‘গেস হোয়াট স্যার?’ বলে সে আবারো ল্যাপটপ ঘুরিয়ে লোকেশন দেখাল। ‘লাক্কাতুরার সেই বাংলোতে যেখান থেকে আপনারা ডক্টর মিতায়ন মানে জেড মাস্টারকে উদ্ধার করে এনেছিলেন।’

তানভীর বাবুল আহমেদের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘স্যার, আমার মনে হয় একটা কমান্ডো অপারেশন চালানোর জন্যে প্রস্তুতি শুরু করা উচিত আমাদের। জেড মাস্টার আর ব্ল্যাক বুদ্ধা দুটোই কোথায় আছে সেটা সম্ভবত বের করতে পেরেছি আমরা। এখন উদ্ধারের পালা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *