অধ্যায় চুয়ান্ন – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ
নিজেকে শামানের পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বোকা মনে হচ্ছে।
তার মতো যোদ্ধার জন্যে শারীরিক আঘাত যতটা না প্রাণঘাতী, তারচেয়ে অনেক বেশ প্রাণঘাতী মানসিক আঘাত। একটার পর একটা মানসিক আঘাত শামানকে একেবারে কাবু করে ফেলছিল। বিশেষ করে ডুকপা লামার মৃত্যু ওকে কেমন জানি ভাবলেশহীন করে ফেলছিল। রাজা বিক্রম যখন-যখন ওর মৃত্যু ঘোষণা করল ব্যাপারটা আমলেই না নিয়ে অনেকটা যেন ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছিল শামান। আর তাই বিধুকে নিজের দিকে ছুটে আসতে দেখেও কোনো গা করেনি ও।
বিধু সোজা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে পানিতে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই জলগুহার প্রপাতের স্রোতের টানে অনেকখানি সরে আসে। বিধু এক হাতে শক্ত করে ধরে রাখে শামানকে। অপর হাতটা প্রথমে পানিতে নাড়ানোর চেষ্টা করে বুঝল কোনো লাভ হবে না। সেইসঙ্গে সাঁইসাঁই শব্দের সঙ্গে পানিতে ছোটো ছোটো মাছের লেজ নাড়ানোর মতো চুপচুপ শব্দ শুনতেই বুঝতে পারল ওদের চারপাশে তির এসে লাগছে। পানিতে সাঁতার কাটার চেষ্টা না করে বরং নিজেকে স্রোতের হাতে ছেড়ে দিল। দুজনেই খড়কুটোর মতো ভেসে চলল প্রপাতের দিকে। প্রপাতের প্রায় কিনারায় পৌঁছে বিধুর মনে হলো ওর শরীরটা শূন্যে ঝুলে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিচে পড়তে শুরু করল।
একে তো অন্ধকার, তার ওপরে পানির ঝাপটা, সেইসঙ্গে পতনের বেগ সব মিলিয়ে ওর মনে হতে লাগল নিজের ওপরে নরক নেমে এসেছে। পড়তে পড়তেই একবার আশপাশে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু শামানের চিহ্নও দেখতে পেল না। একটু পরেই তীব্র ধাক্কার সঙ্গে সে অনুভব করল পানি একেবারে গিলে নিল ওকে। পানির অনেকটা গভীরে ডুবে গিয়ে আবারো ভেসে উঠল সে। ভেসে উঠতেই পানির ওপরে মাথা তুলে স্রোতে ভেসে যেতে যেতে প্রাণপণে দম নিতে লাগল। একইসঙ্গে স্বস্তি আর ব্যথার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন পুরো শরীর।
স্বস্তির কারণ প্রাণে বেঁচে গেছে, প্রপাতের নিচে লাফিয়ে পড়ে কোনো পাথরে লেগে ভর্তা হয়নি বা পানির আঘাতে ফুসফুস ফেটে মরেনি এতেই খুশি ও। পানির স্রোতে ভেসে যেতে যেতে আশপাশে তাকাল কিন্তু কোনো মানুষের আকৃতি চোখে পড়ল না।
না আছে, ওর থেকে বেশ অনেকটা দূরে ওরই মতো স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে লম্বা একটা মানব আকৃতি। শামান কি না ঠিক বুঝতে পারল না বিধু। ওটা আদৌ মানুষ কি না সেটাও ঠিক পরিষ্কার হলো না ওর কাছে।
একইভাবে আরো বেশ খানিকটা ভেসে যাবার পর স্রোতের টান কিছুটা কমে এলে নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো বিধু। শরীরের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেই সে ধীরে ধীরে সাঁতরাতে শুরু করল লম্বা আকৃতিটার দিকে। একটু একটু করে বেশ কিছুক্ষণ সাঁতরে অবশেষে কাছাকাছি পৌঁছাতে পারল ও। ওটা শামান নিশ্চিত হবার পর বুঝতে পারল দেহটা যেভাবে স্রোতের টানে এগিয়ে চলেছে তাতে মনে হয় না তার হুঁশ আছে। আরেকটু এগিয়ে একটা পাথরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়ে খপ করে সে ধরে ফেলল শামানের কাঁধের কাছটায়। একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে অল্প অল্প করে সাঁতরে অবশেষে যখন তীরে এসে উঠতে পারল শরীরের বল আর ফুসফুসের দম দুটোই শেষ। কোনোমতে প্রথমে শামানকে তীরের ঘাসের বিছানার ওপরে শুইয়ে দিয়ে অন্ধকার খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দম নিতে নিতে বিধুর মনে হলো আসলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না।
নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে একটু বল ফিরে পেতেই সে হাঁটু গেড়ে বসে হামাগুঁড়ি দিয়ে চলে এলো শামানের কাছে। বুকে কোনো ওঠা-নামা নেই শামানের। নাকের কাছে আঙুল ধরেও সে বুঝতে পারল না নিশ্বাস বইছে কি না। মাথার সামনের দিকের কোনো একটা ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে মুখ ঢেকে গেছে।
‘ওস্তাদ,’ বলে প্রায় চিৎকার করে উঠে বিধু শামানের বুকের ওপরে মাথা ঠেকিয়ে কান পাতল বুকের শব্দ শোনার জন্যে। প্রথমে কিছুই শুনতে পেল না সে, তবে মনোযোগ দিয়ে শোনাতে মৃদু ধুক পুক কানে এলো তার। সোজা হয়ে বসে বুকের ওপরে দুই হাতে চাপ দিতে শুরু করলে বিধু। একবার, দুইবার, তিনবার চাপ দেয়ার পর তৃতীয়বারের সময়ে মুখ থেকে একগাদা পানি উগড়ে দিয়ে খক খক করে কেশে উঠল শামান।
‘ওস্তাদ, ওস্তাদ,’ বলে ডেকে উঠল বিধু। শামান তখনো কেশে চলেছে। আনমনেই তার একটা হাত চলে গেল মাথার ক্ষতের কাছে। চোখ মেলে আশপাশে দেখল সে, পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। ‘ওস্তাদ,’ আবারো ডেকে উঠল বিধু। বিধুর ডাক শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শামান। মুখ তুলে বিধুকে দেখে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে তার গলা চেপে ধরল। বিধু হারামজাদা, কেন পালালি ওখান থেকে, কেন?’ রাগ আর ক্ষোভের সঙ্গে চিৎকার করে উঠে আরো জোরে বিধুর গলা চেপে ধরল ও। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু তফাতে সরে গেল বিধু।
‘কি দরকার ছিল পালানোর?’ শামানের গলায় হাহাকার। ‘বাকি সবাইকে বিপদে ফেলে, কি দরকার ছিল আমাকে বাঁচানোর?’ বলেই দুই হাতে মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল শামান। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশার সঙ্গে চিৎকার করে উঠল ও।
বিধু ওর দিকে এগিয়ে যেতেই এক হাত তুলে তাকে থামতে বলল শামান। ‘এই সব আমার কৃতকর্মের ফল। এই সব ঘটেছে আমার কারণে,’ শামান কান্না থামিয়ে বলে উঠল। ‘আমি না পেরেছি ডুকপা লামাকে বাঁচাতে, না পেরেছি থারুদের সাহায্য করতে, না পেরেছি বুদ্ধের অন্ধকারের অবতারকে নষ্ট করতে। উলটো আমার কারণেই আজ এতগুলো মানুষের সব শেষ হলো, আমার কারণেই এই সব সর্বনাশের সূত্রপাত,’ বলেই আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ল শামান
বিধু এগিয়ে এসে পাশে বসে একটা হাত রাখল শামানের কাঁধে ‘ওস্তাদ, নিজেরে দোষ দিও না। তুমি তো চাইছিলা সব ঠিক করতে,’ বলে ও থেমে গিয়ে যোগ করল। ‘দোষ যদি কারো থাকে তয় সেইটা আমারো আছে, আমগো সবারই আছে। তয় এইগুলা কোনো কথা না। সব দোষ ওই ব্যাটা বিক্রমের। ওই হারামজাদাই এই সব ঘটনার সূত্রপাত করছে। ওই হারামজাদাই বুদ্ধের অবতার বানানির চিন্তা করছে, ওই হারামজাদই ডুকপা লামারে বন্দি করছে, এরপরে নিজে বিপদে পইড়া তোমারে দিয়ে কাম উদ্ধার করাইছে,’ বলে সে আবারো থেমে যোগ করল, ‘খালি তুমারে দিয়া না আমগোরেও সবাইরে হেয় ব্যবহার করছে।’
চট করে বিধুর দিকে ফিরে তাকাল শামান। রক্ত পানি আর অশ্রুতে ভিজে একাকার ওর চেহারা। ‘ডুকপা লামা আমার হাতে, আমার সামনে মারা গেছে, আমি কিছু করতে পারিনি এইটা নিয়ে আমি বাকি জীবন কিভাবে কাটাব, এরচেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল,’ শামান আবারো ভেঙে পড়তে যাচ্ছে।
‘না ওস্তাদ, এইটা ভুল কইলা,’ সে শামানের কাঁধে রাখা হাতটা ধরে মৃদু চাপড় দিল। ‘তোমার এহনো বাঁচার মতো বড়ো কারণ আছে,’ বলে সে শক্ত করে একটা ঝাঁকি দিল শামানকে। ‘তুমি ভুইলা গেছো ওই হারামজাদা রাজা বিক্রম তোমারে কী করছে। হেয়ই ডুকপা লামার মৃত্যুর কারণ। হের হাতেই কালন্তি, ধোয়ী, ঘোষিত বন্দি আছে। বুদ্ধর অবতারও হের হাতে। তুমি যদি কিছু না করো হেরা সবাই মরব। বুদ্ধের অন্ধকারের অবতার শুঙ্গদের হাতে পৌঁছায়া যাব। আর সবচেয়ে বড়ো কথা তুমি যদি কিছু না করো তয় আবারো এই উপত্যকায় রক্তগঙ্গা বইবো, থারুরা সবাই মারা পড়ব।’
‘আমাদের এক্ষুণি থারুদের গ্রামে পৌঁছানো উচিত,’ বিধু থামতেই শামান বলে উঠল। এক হাতে চোখ-মুখের রক্ত মুছে নিয়ে বলে উঠল। রাজা মানরুকে সাবধান না করলে থারুরা সবাই নিঃশেষ হবে,’ বলে সে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও টলে পড়ে গেল। বিধু তাকে একহাতে ধরে ওঠাল।
‘থারুদের গ্রাম এখান থেকে কোনোদিকে হতে পারে?’ শামান প্রশ্ন করল বিধুকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু সেটার উত্তর না দিয়ে বিধু নিজের কোমরবন্ধনী খুলে নিয়ে সেটা পানিতে ভিজিয়ে শামানের মুখ মুছে দিয়ে ওটা বেঁধে দিলে শামানের মাথার ক্ষতের ওপরে।
‘এখন ঠিক লাগছে?’ বিধু জানতে চাইল। শামান জিনিসটাকে মাথার ওপরে নেড়েচেড়ে বসিয়ে দিয়ে পানিতে হাত ডুবিয়ে আজলা ভর্তি পানি নিয়ে মুখে ছিটিয়ে ঢক ঢক করে গিলে নিল বেশ অনেকটা। সে পরিচ্ছন্ন হয়ে বিধুর দিকে তাকাতেই, সে কথা বলে উঠল।
‘আমরা এখন যেখানে আছি এই জায়গাটা জঙ্গলের কিনারায় নদীর পাড় থেইক্কা কিছুড়া দূরে। মনে অয় এই জায়গাডার কাছাকাছি কোনোখান থাইক্কাই কালন্তি আর ধোয়ীরা শংকরাদিত্যের লগে বিধোরীতে ঢুকছিল। কাজেই আমার মনে অয় আমরা এহন আছি থারুগর গ্রাম থাইক্কা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। তারমানে,’ বলে সে আবারো হাত উঠিয়ে মাপ-জোখ করে বলে উঠল, ‘আমরা যদি থারুগর গ্রামে পৌছাইতে চাই তাইলে আমগোর এর উল্টাদিকে যাইতে অইব। মানে এহান থেইক্কে উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর, মানে ওইদিকে,’ বলে জঙ্গলের দিকে দেখাল। ‘ওস্তাদ তুমি ঠিক আছো? হাঁটতে পারবা?’
শামান একটা ঝোপের ভেতর থেকে একটা ডাল টেনে বের করে ওটার পাতা আর ছোটো ডাল টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বলে উঠল, ‘আমি ঠিক নাই, তবে হাঁটতে পারব। হাঁটতে হবে,’ বলে সে বিধুর দিকে ফিরে জানতে চাইল। ‘তোর শরীরের অবস্থা কি?’
বিধু আড়মোড় ভেঙে বলে উঠল, ‘আমার তো মনে অয় শরীরের একটা আড্ডিও আস্তা নাই, তয় আমিও হাঁটতে পারাম। চলো, দেরি করলেই দেরি,’ বলে সে আবারো চোখের সামনে হাত উঠিয়ে মাপজোখ করতে শুরু করল। আর শামান সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তির সঙ্গে মাথা নেড়ে হাঁটতে লাগল। শামানকে এগোতে দেখে মাপজোখ বাদ দিয়ে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করল বিধু।
কিন্তু বিধুর নির্দেশিত পথে মাইলের পর মাইল এগিয়েও কোনো কাজ হলো না। জঙ্গলের পথে অন্ধকারের ভেতরে অচেনা জায়গায় ওরা পথ হারিয়ে ফেলল নাকি অন্য কোনো ভুল হয়েছে ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না শামানের কাছে। একে তো আহত অসুস্থ শরীর, তার ওপরে আবার মানসিক যাতনা, সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে থারুদের গ্রামে পৌছানোর তাড়া, সব মিলিয়ে শামানের কাছে মনে হতে লাগল ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের শিকড়ের ওপরে বসে পড়ল সে। একটা হাত তুলে বিধুকেও থামার জন্যে ইশারা করল।
‘আমার মনে হয় কিছু একটা ভুল হয়েছে,’ শামান হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল। হিসেব বলে এতক্ষণ তো থারুদের গ্রামে পৌঁছে যাবার কথা কিন্তু এখনো পরিচিত এলাকা চোখেই পড়ল না,’ শামান দুই হাত ধরে মাথা থেকে পট্টিটা খুলে নিয়ে এলো। ওটাকে আবারো চিপে নিয়ে বেঁধে ফেলল মাথায়। ক্ষতটা ঠিক কোথায় হয়েছে বুঝতে পারলেও খালি হাতে ওটাকে ধরার সাহস করল না। যদিও পট্টিটা লাগানোতে রক্ত বন্ধ হয়েছে কিন্তু মাথার ভেতরে একটা দপদপে যন্ত্রণার মাত্রা বেড়েই চলেছে।
‘আমার তো হিসাবে ভুল অওনের কথা না,’ বিধুও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে উৎসুক নয়নে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক দেখার চেষ্টা করছে। যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না আশপাশে কোথাও। ‘ওস্তাদ, রাত প্রায় শেষের দিকে। আমার মনে অয় আমরা এহন এইহানেই বিশ্রাম নেই। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলেই পথ খুঁইজা বাইর করন অনেক সহজ অয়া যাবে
শামান বিধুর কথার সঙ্গে একমত হলেও ওর মন মানছে না। কারণ ওর মনে হচ্ছে রাজা বিক্রমের লোকদের বিধোরীর দুর্গের দখল নেয়া হয়ে যেতেই প্রথমেই ওরা আক্রমণ চালাবে থারুদের গ্রামে। আর সেটা হবার আগেই ওদেরকে সাবধান করে দিতে না পারলে সমূহ বিপদ। কিন্তু প্রতিবাদ করার জন্যে হাত তুলেও নামিয়ে নিল সে। বরং গাছের বিস্তৃত শিকড়ের ওপরে শরীরটাকে আরো ছেড়ে দিয়ে চোখ মুদল। এইটুকু বিশ্রামই এখন অনেক প্রাণ রক্ষাকারী মনে হচ্ছে ওর কাছে। শামান চোখ বন্ধ করে শরীরটাকে ছেড়ে দিল।
বেশ কিছুক্ষণ পড়ে থেকে তন্দ্রামতো এসেছে, এমন সময় বিধুর গলা শুনে তন্দ্রা ছুটে গেল ওর। ‘ওস্তাদ দিনের আলো ফুটতে শুরু করছে।’
শামান চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল শিকড়ের ওপরে। কিন্তু ওর কাছে অন্ধকারই মনে হচ্ছে। উঠে বসে ও দেখতে পেল বিধু হাতের ইশারায় পশ্চিম দিকে দেখাচ্ছে। সেদিকে দিগন্তের কাছটায় লালচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। শামান অলোটা দেখা মাত্রই চট করে উঠে বসল, তার ঘুম একেবারে ভেঙে গেছে। আলোটাকে আরো ভালোভাবে দেখার জন্যে গাছের শিকড়ের ওপরে উঠে দাঁড়াল ও।
‘এইবার আর পথ চিনতে সমস্যা অইবে না,’ বিধু আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই শামান চট করে গাছের শিকড় থেকে নেমে তার একটা হাত ধরে প্রায় টানতে শুরু করল।
‘জলদি চল, বিধু আমাদের ওদিকে এগোতে হবে,’ সে বিধুকে প্রায় টেনে নিয়ে চলেছে।
‘কি ব্যাপার, ওস্তাদ?’ বিধু শামানের এই হঠাৎ পাগলামিতে অবাক হয়ে গেছে। ‘এত তাড়াহুড়ার কী হইলো? ভালো কইরা দিনের আলো ফুটতে দেও…’
‘গাধা, ওইটা দিনের আলো না,’ শামান হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল। সূর্যরে কোনো দিন পশ্চিম দিক দিয়া উঠতে দেখছোস?’ শামানের পিছু পিছু আসতে আসতে বিধু আবারো ফিরে তাকাল পশ্চিম দিকে, যেদিক থেকে লালচে আলোটা চোখে পড়েছে। ‘তাইলে ওইটা যে-’
‘ওইটা আগুনের লালচে আলো, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে ওটা থারুদের গ্রাম থেকে আসছে,’ বলে শামান এগোতে এগোতেও থেমে গেল। বিধুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘ঠিকই আছে, আমাদের হিসেবে ভুল হইছিল। আমরা থারুগর গ্রামের দিকে আগাইতে গিয়া কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আগায়া গেছিলাম পথের ভুলে। এহন যতটা জলদি পারা যায় থারুগর গ্রামে পৌঁছাতে হবে। ওরা বিপদে আছে।’
‘হ, তুমি ঠিকই বলছো,’ বলে বিধু আবারো সেই পশ্চিম দিগন্তে ফিরে তাকাল। ‘এহন ধুঁয়াও দেখতাছি হালকা-পাতলা, জলদি চলো।’
কিন্তু শত চেষ্টা করেও ওরা খুব দ্রুত এগোতে পারল না। একে তো আহত- ক্লান্ত শরীর, তার ওপরে অচেনা পথ। তারপরও প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরে ওরা যখন থারুদের গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছাল তখন দিনের আলো ফুটে উঠেছে।
থারুদের গ্রাম থেকে আধ মাইলের মতো দূরত্বে থাকতেই একেবারে পরিষ্কার দেখতে পেল জঙ্গলের ভেতরে যেখানে থারু গ্রাম থাকার কথা সেখান থেকে বলকে বলকে কালো ধোঁয়া আর আগুনের লেলিহান শিখা আকাশের পানে ধেয়ে চলেছে। ‘সর্বনাশ,’ বলে উঠল বিধু। কিন্তু শামান তার কথা শোনার জন্যে বসে নেই। সে বরং দ্রুত এগিয়ে গেল জঙ্গলের পথে যেখানে থারুদের গোপন আস্তানার মতো জঙ্গলের গাছপালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়ে সেখানটা হা হয়ে খুলে আছে। গাছের চাদোয়ার মতো আবরণটা একেবারে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
জঙ্গলের পথটা ধরে আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল থারু পাহারাদার কয়েকজন মাটিতে পড়ে আছে মৃত অবস্থায়, দুয়েকজনকে গেঁথে রাখা হয়েছে গাছের সঙ্গে। থারুদের গ্রামের সেই খালটার কাছে এসেই দেখল সেই কাঠের সেতুটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পানিতে ভাসছে।
এক বিন্দু দ্বিধা না করে শামান লাফিয়ে পড়ল পানিতে, ওকে অনুসরণ করল বিধু। কয়েকবার হাত-পা নেড়ে মিনিটখানেকের মধ্যে সরু জলাটার অন্য পাড়ে উঠে এলো ওরা। থারুদের গোছানো সুন্দর গ্রামটার আগের সৌন্দর্যের ছিটেফোটাও নেই। পুরো গ্রামে আগুন জ্বলছে, বিক্ষিপ্তভাবে ছোটোছুটি করতে থাকা আগুনের শিখা, গবাদি পশু আর ভাঙাচোরা জিনিসপত্রের ভেতরে এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে মানুষের লাশ।
থারুদের গ্রামের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে শামান ছুট লাগাল থারু রাজা মানরুর বাড়ির দিকে। ধ্বংস, মৃত্যু আর যুদ্ধের মাঝেই বেড়ে উঠেছে শামান, কিন্তু এরকম বিনা বিচারে চালানো ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যু এর আগে কখনো দেখেনি শামান। থারু রাজা মানরুর বাড়ির সামনে পৌঁছে দুই হাঁটু মাটিতে গেড়ে বসে পড়ল শামান।
‘এসবের জন্যে আমি দায়ী,’ আগুনের লেলিহান শিখা পুড়তে থাকা থারু রাজা মানরুর বাড়ির সামনেই একটা গাছ থেকে ঝুলছে শান্ত-শিষ্ট সৌম্য মানুষটার লাশ। অন্যের ভালো করতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা মানুষটার ঝুলন্ত লাশের পা চেপে ধরে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ল শামান।
‘এসবের জন্যে আমি দায়ী, সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে উঠল। ‘কালন্তি আমাকে বারবার সাবধান করেছিল শাক্যদেরকে বিশ্বাস না করতে কিন্তু আমি শুনিনি।’
‘শোনেনি তো তার বাপুও, শামানের পাশ থেকে বিধু বলে উঠে সে এগিয়ে গেল ঝুলন্ত লাশটাকে গাছ থেকে নামানোর জন্যে। ওরা রাজা মানরুর লাশটাকে গাছ থেকে নামিয়ে এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। ওরা লাশটাকে সম্মান জানানোর জন্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল ওদের পেছন থেকে। ঝট করে সেদিকে ফিরেই দেখতে পেল কয়েকজন থারু সৈনিক হাতে তলোয়ার আর তির-ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওদেরকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে সাবধান করে দিল। বিধু আর শামান নিজেদের দুই হাত তুলে দেখাল ওদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। থারু সৈনিকেরা ওদের দিকে এগিয়ে আসতেই ওদের ভেতরে দুয়েকজন চিনতে পারল ওদেরকে। ‘এরা সেই তিব্বতি যোদ্ধা, এরা আমগো শত্রু না,’ একজন বলে উঠল
শামান দেখল মোট পাঁচজন সৈনিক, তিনজনের হাতে তির-ধনুক আর বাকি দুজনের হাতে তলোয়ার। ‘আমরা শত্রু নই। এখানে কী হয়েছিল। আর তোমরাই বা কোথা থেকে এলে?’
ওদেরকে উঠে দাঁড়ানোর জন্যে ইশারা করে নিজেদের তির-ধনুক নামিয়ে নিল থারু সৈনিকেরা। ওদের ভেতরে দলনেতা গোছের একজন এগিয়ে। এলো শামানের দিকে। ‘আমি আপনার সঙ্গে মন্তলার হাটে ছিলাম রাজা বিক্রমরে উদ্ধার করার সময়ে।’
‘এখানে আসলে হয়েছে কি, সেটা বলো,’ শামান প্রায় ধমকে উঠল।
লোকটা একবার শামানকে দেখে নিয়ে আরেকবার বিধুকে দেখল তারপর নিজের সঙ্গীদের দেখিয়ে বলে উঠল। ‘আমি মাতুরা, রাজা মানরুর সেনাবাহিনীতে ছিলাম। এরা আমার দলের লোক। গতকাল রাতে আপনেরা বিধোরীতে যাওনের লাইগ্গা রওনা দিয়োনের পরে সব স্বাভাবিকই ছিল। আজ ভোরের দিকে হঠাৎ আগুনের তাপে ঘুম ভাঙে আমগোর। উইঠা দেহি পুরা গ্রাম জ্বলতাছে। আমরা আগুন নিভাইতে যাইতেই আমগো গ্রামে যেই সব শাক্যরা আশ্রয় নিছিল হেগোর একটা দল আমগোর ওপরে আক্রমণ করে। আমরা হেগো লগে মারামারি করতে করতেই বাইরে থাইক্কা সৈনিকের দল আইসা পুরা গ্রাম ঘিইরা সমানে সবাইরে মারতে থাহে। রাজা মানরু হের দলে কিছু সৈনিক লয়া ছোটোখাটো একটা প্রতিরোধ কইরা গ্রামের মহিলা বাচ্চা আর যাগো পারছে প্রথমেই গ্রামের পেছন দিয়া জঙ্গলে ঢুকায়া দিছে। আমরা সেই দলেই ছিলাম। এরপরে কি অইছে আমরা জানি না। আমরা পলায়া জঙ্গলের অনেক ভেতরে চইলা যাই। জঙ্গলের একেবারে ভেতরে থারুগর ফসল মজুদের একটা গুদাম আছে। সেইহানে পৌঁছায়া যারা বাইচা আছে হেগোরে রাইখা গ্রামে কী আইলো সেইটা খোঁজখবর করার জন্যে ফিইরা আইসা আপণেগো পাইলাম।’
‘শালারা কাপুরুষের দল, রাতের অন্ধকারে নিরীহ লোকগুলোকে খুন করেছে, গ্রাম জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়েছে,’ শামান বাকিদের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘এরা জঙ্গলে ঢোকার পর কী হয়েছিল কে জানে।’ ‘আমি জানি, নতুন কণ্ঠস্বর শুনে সবাই ফিরে তাকাল।
মানুষটা আর কেউ না শাক্য রাজা বিক্রমের খাস লোক জাথুরিয়া। সে একটা ঘোড়ায় বসে আছে। মানুষটাকে দেখা মাত্রই রাগের সঙ্গে ঘোড়া থেকে নামিয়ে তাকে চেপে ধরল গাছের সঙ্গে।
‘শালা বেঈমানের বাচ্চা, তোর সাহস কী করে হলো এখানে আসার? জাথুরিয়া তলোয়ারের ফলাটা থেকে নিজের গলা বাঁচানোর চেষ্টা করছে ওদের পেছন থেকে বিধু কথা বলে উঠল।
‘ওস্তাদ জাথুরিয়া বেঈমান না,’ বলে সে পেছন থেকে শামানের একটা হাত টেনে ধরে সরিয়ে দিল জাথুরিয়ার গলা থেকে। ‘মানে?’ শামান পেছন ফিরে বিধুর দিকে ফিরে প্রায় ধমকে উঠল। ‘এই ব্যাটা একটা শাক্য, এই শাক্যদের কারণেই—’
‘জাথুরিয়া শাক্য হতে পারে কিন্তু হেয় বেঈমান না, কারণ বিধারীর জলগুহায় হে-ই আমারে পলাইতে সাহায্য করছে,’ এই পর্যন্ত বলে বিধু থেমে আবারো যোগ করল। ‘ওস্তাদ তুমি জানো না, জলগুহায় শাক্যরা আমগোরে বন্দি করার পর রাজা বিক্রম যখন তোমারে মারার কতা কইতেছিল তখন জাথুরিয়া ছিল আমার পাশে। হেই আমার হাত বান্ধে নাই উল্টা আমারে সুযোগ কইরা দিছিল যাতে আমি তোমারে নিয়া ঝাঁপায়া পড়তে পারি। হেয় তোমারে বাঁচাইছে, আমারে বাঁচাইছে, আসল বন্ধুর কাম করছে হেয়।
শামান নতুন দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল জাথুরিয়ার দিকে। একটা হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে তুলল বসা থেকে।
‘প্রকৃত বন্ধুর কাজ তুমি করছো বিধু, আগে আমারে প্রাণে বাঁচায়, জলগুহায় যা ঘটছে ওইটা স্রেফ প্রতিদান আছিল। আমি শাক্য হইতে পারি কিন্তু ওরা যা করছে হের ভাগিদার আমি হইতে পারুম না। জলগুহা থাইক্কা তোমরা পালানোর পরে রাজা বিক্রম বন্দি শাক্য সৈন্যগরে মুক্ত কইরা হেগোরে নিয়া পুরো বিধোরী দখল কইরা নেয়। লিচ্ছবী রাজা হেমচন্দ্রের যত লোক আছিল বেশির ভাগই মারছে। বাকি সবাইরে বন্দি কইরা রাখছে। উরগ যারা বাকি ছিল হেগোরেও মারছে। এরপরে হেরা ওইখান থাইক্কা রওনা দেয় থারুগর গ্রামের দিকে।
‘থারুগর গ্রামে একদিকে ভেতর থাইক্কা শাক্য যারা ভেতরে অছিল হেরা আক্রমণ চালায়, লগে বাইরে থাইক্কা যোগ দেয় রাজা বিক্রমের লোকেরা। হেরাই রাজা মানরুরে মারছে, বাকিগরে যারে পাইছে মারছে। যারা জঙ্গলে পলাইছে হেরা বাইচ্চা গেছে।’
‘কালন্তি, ধোয়ী, ঘোষিত ওদের কী খবর?’ বলতে গিয়ে শামানের গলা কেঁপে উঠল। ‘ওরা কি বেঁচে আছে?’
‘ওরা বাইচ্চা আছে, তয় রাজা বিক্রমের বন্দিশালায় বন্দি। হেগোরে নিয়া রাজা বিক্রমের পরিকল্পনা আছে,’ বলে সে শামানের চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘হেগো কথা জিগাইলা ওস্তাদ, বুদ্ধের অন্ধকারের অবতারের কথা জিগাইলা না? তুমি জানো না রাজা বিক্রম ওইডা দিয়া কী করব?’
জাথুরিয়ার কথা শুনলেও কোনো জবাব দিল না শামান। কী বলবে।
‘রাজা বিক্রম আইজকার মধ্যে পুরা কন্নরের দহল নিয়া শুঙ্গগরে খবর পাঠাইছে। হেয় এই রাজ্য থেকে সব থারু, সব লিচ্ছবী আর সব উরগরে যেহানে পাওয়া যাবে মারার ঘোষণা দিছে। সেইসঙ্গে দুই তিব্বতি যোদ্ধার কাটা মাথার জন্যে হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করা অইছে। তয় এইগুলাও কোনোডাই বড়ো খবর না বড়ো খবর অইলো আইজ রাইতেই বুদ্ধের অবতার শুঙ্গগর হাতে তুইল্লা দেয়া অইবে। তাও কেমনে জানো,’ বলে সে সবার কৌতূহলী দৃষ্টি পরখ করে বলে উঠল। ‘আজ সন্ধায় বিধোরী থেইক্কা মূর্তি মন্তলার হাটে আনা অইবে। সেইহানে নাকি রাজ্যের সব প্রজাগর সামনে স্বয়ং বুদ্ধের অন্ধকার অবতার নামায়া আনা হবে।’
জাথুরিয়া এই পর্যন্ত বলতেই হেসে উঠল শামান। ‘এরকম কিছুই হবে না, কারণ এর আগেই আমরা সেটা প্রতিরোধ করব।’
‘কেমনে ওস্তাদ, আমগো লোক নাই, কোনো অস্ত্র নাই,’ বিধু কথা বলে উঠল। ‘কালন্তি-ধোয়ী-ঘোষিত তার হাতে বন্দি। একটা সেনাবাহিনীর লগে আমরা কী করতে পারমু?’
‘আমাদের এগুলোর কোনোটাই না থাকতে পারে কিন্তু বিরাট একটা শক্তি আছে,’ বলে সে একে একে সবাইকে দেখে নিয়ে বলে উঠল। ‘তোমরা যদি আমাকে সহায়তা করো তবে আমি এটা তো প্রতিরোধ করতে পারবই, সেইসঙ্গে কালন্তি-ঘোষিত-ধোয়ীকেও ফিরিয়ে আনব, আর সেইসঙ্গে থারুদের সঙ্গে এই জঘন্য অনাচারের জন্যে চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেব রাজা বিক্রমের ওপরে।’
‘কিন্তু কেমনে সম্ভব সেইটা?’ বিধু কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইল।
‘সম্ভব, কারণ আমার হাতে বিরাট একটা শক্তি আছে। ডুকপা লামা মারা যাবার আগে আমাকে অনেককিছুই বলে গেছে,’ বলে শামান যোগ করল। ‘আমি বুদ্ধের অন্ধকার অবতারের রহস্য জানি।’