অধ্যায় বায়ান্ন – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
বিধোরী দুর্গ, কন্নোর, ভারতবর্ষ
জলগুহার একদিকে যখন শামান ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত, অন্যদিকে তখন চলছে ভিন্ন নাটক।
শংকরাদিত্য দেখল রাজা হেমচন্দ্রকে প্রহরীদের দল ঘিরে ধরে দ্রুত তাকে সরিয়ে ফেলছে জলগুহার প্রবেশ পথের দিকে। শংকরাদিত্য পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে একবার দেখে নিল চারপাশ। শামান এগিয়ে চলেছে ডুকপা লামার দিকে, কালন্তি আর ধোয়ীসহ দলের বাকিরা লড়াই করছে উরগ আর লিচ্ছবী সৈন্যদের সঙ্গে। এই সুযোগে একবার যদি রাজা হেমচন্দ্র বাইরে চলে যেতে পারে তবে সব শেষ হয়ে যাবে। শংকরাদিত্য ইশারায় কালন্তিসহ আরো দুজনকে বলল তাকে অনুসরণ করতে। তারা পাঁচজনে মিলে সোজা গিয়ে অবস্থান নিল জলগুহার মুখের কাছে। রাজা হেমচন্দ্রের বাহিনী তাকে নিয়ে জলগুহার মুখের কাছে পৌঁছাতেই দেখতে পেল সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে আছে ওরা। রাজার প্রহরীদের প্রথম আংশটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপরে। সংখ্যায় বেশি হওয়াতে তারা সহজেই একপাশে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে নিয়ে গেল রাজা হেমচন্দ্রকে নিয়ে।
নিজের ওপরে এসে পড়া এক সৈনিককে শেষ করে দিয়ে তাকে সরিয়ে রাগের সঙ্গে কালন্তির দিকে ফিরে ইশারা করল শংকর। কিন্তু কালন্তি আরেকজনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত। শংকরাদিত্য দুই সৈনিকের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বেরিয়ে এলো জলগুহা দিয়ে। বাইরে এসে সে ভেবেছিল দেখতে পাবে জলগুহা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে রাজা হেমচন্দ্রের বাহিনী কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল সেখানে ঘটছে আরেক কাণ্ড। রাজা হেমচন্দ্রের বাহিনী জলগুহা থেকে বেরুতেই রাজা বিক্রম আর বিধুদের দলের সামনে পড়ে গেছে।
রাজাবিক্রমের দল একপাশ থেকে বিক্রমের সঙ্গে আক্রমণ চালাল হেমচন্দ্রের বাহিনীর ওপরে, অন্যদিকে পেছন থেকে শংকরাদিত্য আর কালন্তিদের দলের আক্রমণে দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণের ভেতরেই রাজা হেমচন্দ্র দলের বাকিদের সঙ্গে আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে বন্দি হলো রাজা বিক্রমের হাতে।
শংকরাদিত্য তাকে চেপে ধরে নিয়ে এলো রাজা বিক্রমের সামনে। ‘এখনো পুরা বিধোরী আমার লোকজনে ভরা। তোমরা…’
রাজা হেমচন্দ্রের মুখের ওপরে হেসে উঠল বিধু। ‘বন্দি হইয়াও তেজ কমে না,’ বলে সে জাথুরিয়ার দিকে ফিরে সামান্য মাথা নোয়াল। একটু এগিয়ে এসে রাজা হেমচন্দ্রের হাত থেকে শামানের তলোয়ারটা নিয়ে নিল জাথুরিয়া। ওটাকে ধরিয়ে দিল রাজা বিক্রমের হাতে।
‘হেমচন্দ্র, কন্নরের রাজা হিসেবে এই এলাকাতে অনুপ্রবেশ ও সকল হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী করে আমি তোমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছি,’ রাজা বিক্রম শামানের কাতানাটা তুলে কোপ মারল রাজা হেমচন্দ্রের গর্দানে। কালন্তি বাঁধা দেয়ার জন্যে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু ওরা সবাই থেমে গেল গুহার ভেতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদের শব্দে।
‘ওস্তাদের গলা না?’ বলে বিধু একবার কালন্তিকে দেখে আরেকবার জাথুরিয়ার দিকে ফিরে দৌড় দিল জলগুহার দিকে।
ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল ভেতরে ছোটো ছোটো খণ্ডযুদ্ধগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শামান ডুকপা লামার মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসে আছে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। শামান ডুকপা লামার মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে বসেই আছে। বিধুর পাশে এসে দাঁড়াল রাজা বিক্রম, কালন্তি, শংকরাদিত্য, জাথুরিয়া আর ঘোষিত
‘এমনটা তো হবার কথা ছিল না,’ রাজা বিক্রম বেশ শান্ত স্বরে বলে উঠল তার দুই হাতে দুটো কাতানা। একটা সে পেয়েছিল হেমচন্দ্রের হাত থেকে, অন্যটা জলগুহার প্রবেশ পথের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছে। দুই কাতানার একটা দিয়ে অন্যটার মাথায় বাড়ি মারতেই আগুনের ফুলকি উঠল। নিজের লোকদের দিকে, বিশেষ করে শংকরাদিত্যের দিকে ইশারা করে সে এগিয়ে যেতে লাগল শামানের দিকে।
ডুকপা লামার মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে ধরে একটা হাত তুলে থামতে বলল তাকে। ডুকপা লামাকে সম্মানের সঙ্গে মাটিতে শুয়িয়ে দিয়ে সোজা ফিরে তাকাল রাজা বিক্রমের দিকে। ‘এমনটা হবার কথা ছিল না, তাই না?’ বলে সে দুই পা এগিয়ে এলো রাজা বিক্রমের দিকে। ‘কিন্তু আসলে এমনটাই তো হবার কথা ছিল, তাই না?’ রাজা বিক্রমের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
রাজা বিক্রম মুহূর্তের জন্যে হতবিহ্বল ভাব ধরতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। হেসে উঠল শামানের দিকে তাকিয়ে। ‘ওই বুড়োটা,’ সে মাটিতে থাকা ডুকপা লামার মৃতদেহটা দেখালে। ‘মরার আগে সব বলে গেছে তোমাকে তাই না?’ কথাটা বলে সে হাতের কাতানা তুলতেই সক্রিয় হয়ে উঠল তার লোকেরা। রাজা বিক্রম ইশারা করতেই তারা ঘিরে ধরল বিধু, ঘোষিত, জাথুরিয়া আর কালন্তিকে। শংকরাদিত্য একেবারে অসতর্ক অবস্থায় পেছন থেকে নিজের তলোয়ার চেপে ধরল কালন্তির ঘাড়ে।
শামান এগোতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ এখন ও এগোলেই ওর লোকদের ক্ষতি করা হবে। কিন্তু রাজা বিক্রম থামল না। সে এগিয়ে এসে শামানের কাতানাটাই ওর বুকে ঠেকাল, যেটা সে হেমচন্দ্রের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। এটা দিয়ে হেমচন্দ্রের মস্তক ছিন্ন করেছে। ঠিক ধরেছো যোদ্ধা, তুমি বুদ্ধিমান। তুমি এখন এগোনোর চেষ্টা করলেই মেরে ফেলা হবে তোমার লোকদের। বুকে ঠেকানো কাতানাটা দিয়ে চাপ দিয়ে শামানকে মাটিতে বসিয়ে দিল সে।
‘শুরু থেকেই পুরো ব্যাপারটার পেছনে আসলে তুমিই ছিলে, তাই না?’ শামান জানতে চাইল।
‘মৃত্যুগামী মানুষের শেষ ইচ্ছে যদি এটাই হয়, তবে সত্যিই বলব। আমিই ছিলাম এসব শুরুর পেছনে,’ বলে সে বাকিদের দিকে দেখে নিয়ে শামানের দিকে ফিরল একবার। ‘তবে সব কিছুই শুরুর পেছনে দায়ী এই ধাতু,’ বলে সে শমানের জোড়া কাতানা দিয়ে আবারো আরেকদফা আগুনে ফুলকি ছোটাল। ‘আর ওই মূর্তি,’ বলে সে বাক্সটা দেখাল।
‘মৌর্য রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করে শুঙ্গ সেনাপতি পুশ্যমিত্র যখন ভারতবর্ষ দখল করে নিল তখনই আমি জানতাম যতই পরে হোক শুঙ্গরা নিজেদের থাবা এই কন্নোর পর্যন্ত বিস্তার করবেই। কাজেই আগে থেকেই আমি ভাবছিলাম কিছু একটা করব যাতে শুঙ্গদের সঙ্গে একটা মিত্রতে আসা যায়। এমন সময় আমার উপদেষ্টা আমাকে জানায় পৃথিবীতে বিলুপ্ত প্রায় এক ধাতু আছে যেটা দ্বারা নির্মিত কিছু অস্ত্র আছে তিব্বতের শান্তির মঠে, আর সেটার কিছুটা অংশ আছে উরগদের কাছে। আর তাই আমিই সিদ্ধান্ত নিই পুরনো শত্রু লিচ্ছবী আর উরগদের সঙ্গে মিলে বুদ্ধের অন্ধকারের অবতারের কাহিনিটাকে ফিরিয়ে আনব। আর সেটা ভেট হিসেবে পাঠাব শুঙ্গ রাজাকে,’ এই পর্যন্ত বলে সে ফিরে তাকাল কালন্তির দিকে। ‘সেইসঙ্গে বৌদ্ধ থারু জাতির প্রত্যেকের কর্তিত মস্তক উপহার দেব এই অন্ধকারের অবতারের সঙ্গে।’
‘কিন্তু ঘটে উলটোটা। ঠিক?’ শামান বলে উঠল ।
‘হ্যাঁ, আমি সব ঠিক করার আগেই লিচ্ছবী আর উরগরা মিলে শুঙ্গদের সঙ্গে চুক্তি করে আমাকেই উৎখাত করে দেয়। আর কপালের এমন ফের যে থারুদের সবাইকে খুন করার কথা ছিল সেই থারুদেরই আশ্রয় গ্রহণ করতে হয় আমার লোকদের।’
‘খুনি,’ হিস হিস করে বলে উঠল কালন্তি। ‘এ কারণেই আমি বাবাকে বলেছিলাম তোদেরকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য না করে বরং সব কটাকে ধরে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিতে। তোরা এখনো মরবি। মরার আগে হেমচন্দ্র ভুল বলেনি। বিধোরী এখনো লিচ্ছবী সৈন্যে ভরা। ওরা তোদের কচুকাটা করবে।’
‘কিছুই করতে পারবে না,’ বলে রাজা বিক্রম হেসে উঠল। ‘কারণ জলগুহায় ঢোকার পথ আমরা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। সেইসঙ্গে দুর্গের বন্দিশালা খুলে বের করে দেয়া হয়েছে সব শাক্য সৈন্যদেরকে ওরা এতক্ষণে অবশিষ্ট লিচ্ছবী সৈন্যদের কচুকাটা করছে। আর একটা ব্যাপার তোমাদেরকে জানাই, এখানে আসার আগে শুঙ্গদের সঙ্গে আমার পুরনো চুক্তি ফেরত নেয়া হয়েছে। আমার রাজ্যের একটা অংশ থারুদের কর্তিত মস্তক, আর বুদ্ধের অন্ধকারের অবতারের বিনিময়ে ওরা আবার আমাকে সাহায্য করবে কারণ লিচ্ছবী আর উরগদের সঙ্গে ওদের বনছিল না। কাজেই-’ বলে সে কাতানা তুলে শামানের গলায় ঠেকাল। ‘এবার বিদায় বেলা, যোদ্ধা। তুমি না থাকলে এসবের কিছুই হতো না, রাজা বিক্রম বলতেই শামান তাকে থামিয়ে দিল।
‘একটা কথা, যে বুদ্ধের অন্ধকারের অবতারের জন্যে এত কিছু আমি সেটা একবার দেখতে চাই,’ শামান তাকিয়ে আছে রাজা বিক্রমের চোখের দিকে।
রাজা বিক্রম একবার শামানকে দেখে নিয়ে আরেকবার ফিরে তাকাল শংকরাদিত্যের দিকে। শংকরাদিত্য মানা করছে। কিন্তু সেটা না শুনে সে ফিরে তাকাল শামানের দিকে। ‘ঠিক আছে,’ বলে সে নিজের লোকদের দিকে ফিরে ইশারা করল বাক্সটাকে নিয়ে আসার। কয়েকজন শাক্য সৈন্য মিলে বাক্সটা এনে রাখল ওদের মাঝেখানে। বাক্সটার ডালা তুলে ভেতর থেকে খড় সরাতে শুরু করল দুজনে। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—বিধু হঠাৎ প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল। সবাই তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই তাকে ধরে রাখা সৈন্যের থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে দৌড় দিল শামানের দিকে। রাজা বিক্রমসহ সবাই তাকিয়েছিল কাঠের বাক্সটার দিকে, হঠাৎ বিধু নড়ে ওঠাতে কেউ কিছু করে ওঠার আগেই নিজের ভারী শরীরটা নিয়ে দৌড়ে এগোল সে শামানের দিকে।
প্রায় ওদের কাছে পৌঁছে গেছে রাজা বিক্রম কাতানা তুলল তাকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু সেটা নামিয়ে আনার আগেই দৌড়াতে দৌড়াতে এক ঝটকায় তাকে ফেলে দিয়ে শামানের দিকে লাফ দিল সে।
আধবসা শামানকে জড়িয়ে ধরে ছিটকে পড়ল জলপ্রপাতের পানিতে। কেউ ওদেরকে আটকানোর আগেই জলপ্রপাতের তীব্র পানির স্রোতে ভেসে ওরা সাদা ফেনার সঙ্গে মিশে গিয়ে হাজার ফিট নিচে শূন্যতার মাঝে ছিটকে পড়ল দুজনেই।