অধ্যায় ছেচল্লিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
বিধোরী দুর্গ, কন্নোর, ভারতবর্ষ
পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাসম্ভব সাবধান থাকার চেষ্টা করছে রাজা বিক্রম।
তবে খুব বেশি সাবধান থেকে কোনো লাভ নেই, এটা সে খুব ভালোই জানে। এ কারণেই সে সাবধানতার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে জায়গামতো পৌঁছানোর ব্যাপারটা। তা ছাড়া যেহেতু তারা লিচ্ছবী সৈন্যদের পোশাক পরে আছে কাজেই কোনো সাবধানতার ধার না ধরে বরং বেশ বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
বিধোরীর দুর্গের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করার পর দুর্গের মূল ফটকের প্রহরীরা ওদেরকে পেছন থেকে ডেকে রাত হবার কারণে শব্দ কম করতে সচেতন করে দেয়। ওরা কাউকে বিরক্ত করবে না এই প্রতিজ্ঞা করে দুর্গে প্রবেশ করে বেশ খানিকটা ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়িতে করে এগিয়েছে। তারপর নিয়মমাফিক সেগুলোকে আস্তাবলে রেখে এখন বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। যদিও দুর্গে প্রায় সবাই ঘুমন্ত তবুও রাজা বিক্রম, বিধু, জাথুরিয়া আর দলের বাকিরা তাদের অভিনয়ে কোনো খুঁত রাখতে চাইছে না। তারা একইরকম বীরদর্পে এগিয়ে সোজা চলে এলো রাজা হেমচন্দের থাকার জায়গার দিকে। দুর্গের মূল আঙিনা থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে তিনটে বুরুজ। সামনে এগিয়ে একটা বুরুজের একেবারে নিচে চলে এলো ওরা।
স্বাভাবিক নিয়মে এখানে রাজার বাসস্থানের নিচে বেশ কিছু প্রহরী থাকার কথা, কিন্তু একজনকেও দেখা গেল না। রাজা বিক্রম বেশ অবাক হয়ে আশপাশে ফিরে তাকাল, দুয়েকবার এদিক-সেদিক দেখে নিয়ে যখন নিশ্চিত হলো কেউই নেই অবাক হয়ে ফিরে তাকাল নিজের লোকদের দিকে।
‘ব্যাপার কি হুজুর? পাহারাদাররা সব গেল কই?’ বিধু বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইল একটু হালকা হবার সুযোগ পেয়েই সে নিজের পোশাক টেনে আলগা করার চেষ্টা করছে। রাজা বিক্রম তার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে একবার তাকে দেখে নিয়ে আরেকবার জাথুরিয়ার দিকে ফিরে ওপরের দিকে তাকাল। ওপর থেকে হালকা আলো ভেসে আসছে।
‘চলো সবাই,’ বলে সে সামনে হাঁটতে শুরু করল। বিধু একবার জাথুরিয়ার দিকে তাকিয়ে সবাইকে ইশারা করল ওপরের দিকে ওঠার জন্য। পুরো দুর্গের তিনটে সুউচ্চ বুরুজের দুটোতে মূলত বাসভবন। একটাতে রাজা থাকত আগে, অন্যটাতে উচ্চপদস্থ অফিসাররা। আর শেষটাতে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ক আলোচনা হয়-মানে দরবারের কাজ চলে। রাজা বিক্রম আগেই অপহৃত সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত করেছিল যে রাজা হেমচন্দ্র তার পুরো পরিবার নিয়ে এখনো চলে না এলেও সে নিজে উত্তরের বুরুজটাতে বসবাস করছে আর তাই বিক্রমের পরিকল্পনা ছিল সর্ব উত্তরের বরুজে ছদ্মবেশে প্রবেশ করে রাজা হেমচন্দ্রকে বন্দি করে তারপর রওনা দেবে গুহার দিকে, যেখানে মূর্তি নির্মাণ চলছে। এরই মধ্যে জলপথে গুহা দিয়ে আর পাহাড়ি পথে বাকিরা চলে এলে সবাই মিলে সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করে মূর্তি আর বন্দি রাজাকে নিয়ে সরে পড়বে।
রাজা বিক্রম আর তার বাহিনী সাবধানে ওপরে ওঠার রাস্তা ধরে একে একে তিনধাপ ওপরে উঠে এলো। এবার সবশেষ ধাপে উঠতে হবে, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু ওপরে উঠে এসে ওরা কারো ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেল না।
‘কাহিনি কি? রাজার কামরার বাইরেও কেউ নাইকা,’ বিধুর কথাকে পাত্তা না দিয়ে রাজা বিক্রম এক টানে খাপ থেকে বের করে আনল নিজের তলোয়ার, তারপর এক ধাক্কায় খুলে ফেলল কামরার দরজা। দরজাটা খুলেই সে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তার ঠিক পেছনে-পেছনে ঢুকল জাথুরিয়া আর বিধু।
ভেতরের কামরা একবারে খালি, বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে, পাশেই তশতরির ওপরে রাখা মদের পানপাত্র। রাজা বিক্রম কিছু একটা দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। পানপাত্রের পাশেই সিলমোহর ভাঙা গোল মতো কিছু একটা রাখা। সেটা পড়ে রাজা বিক্রম রাগে প্রায় লাফিয়ে উঠল ।
‘ব্যাপার কি হুজুর?’ বিধু জানতে চাইল। কিন্তু তার আগেই দ্রুততার সঙ্গে রাজা বিক্রম সবাইকে বেরুনোর নির্দেশ দিল। ‘জলদি চলো, আপাতত পরিকল্পনা মাঠে মারা গেছে, রাজা হেমচন্দ্র বিশেষ সন্দেশ পেয়ে গুহা পরিদর্শনে গেছে। জলদি আমাদের সেখানে যেতে হবে। সাবধান করে দিতে হবে অন্যদেরকে। কে জানে এরই মধ্যে তারা পৌঁছে গেছে কি না,’ বলেই সে দৌড়াতে শুরু করল, বাকিরা অনুসরণ করল তাকে।
***
গুহার ভেতরে প্রবেশ করে জলাধারটা বেশ কিছুদূর পর্যন্ত বেশ স্রোতঃস্বিনীর মতোই এগিয়েছে কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে কমে এসেছে ওটার বেগ। জলধারার যেখানে একেবারে সরু হয়ে এসেছে সেখানে পৌঁছে লাফিয়ে পার হয়ে এলো ধোয়ী আর কালন্তি।
অন্যপাড়ে অপেক্ষা করছিল শংকরাদিত্য আর তার সঙ্গে দুজন। তারাও সবাই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলেও এখন অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। তবে কালন্তি ওদেরকে দেখে একটু অবাক হয়েই জানতে চাইল, ‘আপনাদের সঙ্গের আরেকজন কোথায়?
শংকরাদিত্য মাথা নাড়ল। ‘ও গুহা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি, তার আগেই ভেসে গেছে স্রোতের টানে, ও সাঁতার জানত না খুব একটা,’ বলে সে আফসোসের সঙ্গে একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘আমাদের ভেতর থেকে একজন হারিয়ে গেছে। তার জন্যে আমরা প্রার্থনা করব, কিন্তু পরে। এখন আমাদেরকে এগোতে হবে রাজা বিক্রমের পরিকল্পনা অনুয়ায়ী। প্রথমেই সবাই নিজের পোশাক আর অস্ত্র ঠিকঠাক করে নাও।’
শংকরাদিত্যের কথামতো সবাই যার যার অস্ত্র পরীক্ষা করে নিল। সবার অস্ত্র পরীক্ষা শেষ হতেই সে বলতে লাগল, ‘সবার কি আমাদের পরিকল্পনার কথা মনে আছে, নাকি আবারো আমাকে বলতে হবে?’
কালন্তি একবার মাথা নেড়ে বলে উঠল, ‘আমার মনে হয় কালক্ষেপণ না করে আমাদের বরং সামনে এগোনো উচিত। এখান থেকে আমরা কোনোদিকে যাব?’
শংকরাদিত্য তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে জবাব দিল, ‘উত্তম কথা। এখান থেকে আমাদেরকে ওপরের দিকে উঠতে হবে। প্রথমত আমরা দুর্গের যেদিক দিয়ে প্রবেশ করেছি সেটা পূর্ব দিকে, আর আমাদের যেতে হবে উত্তর-পূর্ব দিকে। যতই ওপরের দিকে উঠতে থাকব ততই আমরা মূল গুহার দিকে এগোতে থাকব, কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের ঝুঁকির মাত্রাও বাড়তে থাকবে কারণ ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লোক সমাগমও বাড়বে। আমার ধারণা লিচ্ছবীরা এখনো জানেই না যে এদিক দিয়ে দুর্গের সঙ্গে মূল জলপ্রপাতের সংযোগ আছে। তবে এই জায়গাটায় আমরা ছোটোবেলা প্রায় খেলতে আসতাম। তবে এরপরে এমনকি আমরাও আর বহু বছর এদিকটাতে আসিনি। কাজেই সদ্য দুর্গ দখল করা লিচ্ছবীদের জন্যে এদিকটার ব্যাপারে জানাটা অসম্ভব। চলো চলো,’ বলে সে সবাই তাড়া দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগল। সবার সামনে সে, তার পেছনে কালন্তি, সঙ্গেই ধোয়ী, আর ধোয়ীর পেছনে বাকি তিনজন।
ওরা জলধারার সঙ্গে সংযুক্ত গুহা থেকে ভেতরের দিকে চলে এলো। ভেতরের দিকে এগোনোর সঙ্গে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। দ্রুতই চারপাশের প্রাকৃতিক চুনাপাথর বদলে গিয়ে মানুষের হাতের কাজ বাড়তে লাগল। টানা অনেকখানি এগিয়ে শংকরাদিত্য ওদের থামতে বলল। একটু আগে পর্যন্ত গুহা থেকে অদ্ভুত এক ধরনের আলো আসছিল কিন্তু এখন প্রায় অন্ধকার। শংকরাদিত্য সামনে থেমে গলা বাড়িয়ে কিছু একটা দেখল, তারপর মাথা নেড়ে সবাইকে সতর্ক করে দিল, সামনেই একটা বড়ো খাদ আছে-সবাই যেন সাবধানে পার হয় ওটা।
শংকরাদিত্য সেটা পার হতেই, কালন্তি দেখল খাদটা বেশি চওড়া না, দুই কি তিন ফিটের মতো হবে, অন্ধকার গুহার ভেতরে ততোধিক অন্ধকার একটা মুখ হা করে আছে। সে কান পেতে অনুমান করল ওটার নিচ থেকে কুল কুল পানির শব্দ ভেসে আসছে। একে একে সবাই লাফিয়ে পেরিয়ে এলো ওটা। খাদটা পার হতেই সামনে সরু কার্নিশের মতো দেখা গেল। আবারও সবাইকে সাবধানে পার হবার নির্দেশ দিল শংকরাদিত্য। ওরা আগে থেকেই এই অন্ধকারের কথা মাথায় রেখে চকমকি পাথর আর হাতে বানানো মশাল নিয়ে এসেছিল কিন্তু ভেলা ভেঙে ওগুলো সব গেছে। এখন অন্ধকারের ভেতরে চোখ সওয়ানো আলোই ভরসা।
গুহার ভেতরের সরু কার্নিশটা পার হতেই সামনের দিকে যেতে লাগল, পথও চওড়া হয়ে আসতে লাগল সেইসঙ্গে সামনে দেখা গেল মানুষের হাতে কেটে বসানো পাথরের পথ। সবাই পথটা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, কারণ হাতে বানানো পথ মানেই হলো দুর্গের মোটামুটি ভেতরে চলে এসেছে ওরা।
শংকরাদিত্যের দিকে তাকিয়ে কালন্তি দেখল তার চোখে-মুখেও স্বস্তির ছায়া। সামনে পথটার শেষ মাথা থেকে হলদে এক ধরনের আলো ভেসে আসছে। ‘মনে হচ্ছে পৌঁছে গেছি,’ বলে সে সামনের দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ দৌড়াতে লাগল। বাকিরাও দ্রুত এগিয়ে দেখল শংকরাদিত্য সামনে পৌঁছে হতাশার সঙ্গে শব্দ করে উঠল।
‘কি ব্যাপার, হলো কি?’ প্রশ্নটা করেই শংকরাদিত্যের পরে কালন্তিই প্রথম দেখতে পেল জিনিসটা। পথটার শেষ মাথায় গোলমতো একটা প্রবেশ দরজা, সেটার অন্যপাশে দেয়ালে ঝোলানো একটা মশাল থেকে ভেসে আসছে হলদে আলো। ওটাই দুর্গের মূল অংশ। ওদিকে দিয়ে প্রবেশ করেই মূল দুৰ্গসংলগ্ন গুহায় পৌঁছাতে হবে কিন্তু সেটা করতে হলে আগে ওদেরকে মূল অংশে প্রবেশ করতে হবে।
ওরা আগে যা ভেবেছিল সেটা এখন ভুল মনে হচ্ছে। সম্প্রতি দুর্গ দখল করলেও লিচ্ছবীরা ঠিকই বের করতে পেরেছে দুর্গের নিচের জলধারার সঙ্গে দুর্গের মূল অংশের সংযোগ আছে। আরে সে কারণেই প্রবেশ পথের ওখানে মোটা মোটা লোহার শিক লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে পথটা।
শংকরাদিত্য অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে লোহার শিকগুলোর দিকে, তার দিকে ফিরে কালন্তি বলে উঠল, ‘এবার কি করব আমরা?’ শংকরাদিত্য কোনো জবাব না দিয়ে সামনের লোহার দরজার মতো জিনিসটা পরীক্ষা করছে। লোহার শিকগুলো পরীক্ষা করে সে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল, ‘অসম্ভব, এগুলো উপযুক্ত যন্ত্রপাতি পেলেও একদল মানুষের এক হপ্তা লাগবে ভাঙতে। আর আমাদের কাছে তো তির-ধনুক আর তরবারি ছাড়া কিছুই নেই।’
‘তাই বলে, তাই বলে…এতদূর পর্যন্ত এসে আমরা থেমে যাব?’ কালন্তির নিজের কাছে নিজেকেই অত্যন্ত অসহায় লাগছে। সে পাগলের মতো হাতড়াচ্ছে লোহার শিকগুলোতে।
‘উপায় আছে,’ বলে সামনে দিকে এগিয়ে এলো সদাশান্ত ধোয়ী। সামনের দিকে এসে সে নিজের গাছের গুঁড়ির মতো মোটামোটা হাতগুলো দিয়ে লোহার শিকের ওপরে হাত বুলাতে লাগল। পুরো দরজার মতো জিনিসটা পরীক্ষা করে সে সন্তুষ্টির হাসি দিল ওদের দিকে তাকিয়ে। কালন্তি খুব অবাক হয়ে গেল ধোয়ীর হাসি দেখে, এই জীবনে সে কোনোদিন ধোয়ীকে হাসতে দেখেছে বলে মনে পড়ল না। ‘আসলেই উপায় আছে?’ সে কৌতূহলের সঙ্গে জানতে চাইল।
কচুপাতার ওপরে পানির ফোঁটা পড়লে ঠিক যেভাবে পানি মুহূর্তের জন্যে স্থির থেকে লহমার ভেতরে গড়িয়ে পড়ে যায় তেমনি মুহূর্তের জন্যে হাসিটা ধোয়ীর মুখে স্থির থেকে চট করে নেই হয়ে গেল। ‘উপায় আছে, আমার বাবা ছিল লোহার কারবারি, আমি ছোটোবেলা থেইক্কা হের লগে কাম করতাম। হেয় এই সব দরজা বানানির ওস্তাদ আছিল। এই দরজাগুলা কুনোভাবেই ভাঙা সম্ভব না,’ বলে সে সবাইকে দেখল।
‘তাহলে তুমি না এইমাত্র না বললে উপায় আছে, এখন আবার বলছো উপায় নেই, তাহলে কিভাবে সম্ভব?’
‘দরজা ভাঙা সম্ভব না,’ ধোয়ী শান্ত স্বরে জবাব দিল। ‘কিন্তু কবজা ভাঙা সম্ভব, কারণ এই দরজাগুলা একটা চার কোনার ওপরে বসায়া পাথরের ভেতরে গজাল দিয়া লাগায়া দেয়া হয়। আমরা যদি দরজার হেই গজালগুলা বাইর করতে পারি তয় না ভাঙতে পারলেও হেইগুলা কেমনে বাইর কইরা আনা যাবে আমি জানি, আর হেইগুলা খুললেই ‘
‘দরজা খুলে আসবে,’ বলেই শংকরাদিত্য এগিয়ে গেল দরজাটা দিকে সবাই খোঁজ, কিছুক্ষণের ভেতরেই দরজার দু পাশে দুটো করে চারটা এরকম কবজা আবিষ্কার হলো। আরো আধাঘণ্টার ভেতরে নির্দিষ্ট জায়গাগুলো থেকে নিজের বড়ো চুড়ি দিয়ে দক্ষ হাতে বহু কষ্টে গজালগুলো খুলে আনতেই দরজাটা একপাশে হেলে পড়ল। এরপরে সবাই মিলে দরজাটা টেনে ধরতেই ধীরে ধীরে একপাশে বেঁকে যেতে শুরু করল সেটা। বাকিরা টেনে ধরে রাখল আর এক একে অন্যরা পার হয়ে এলো। সবার শেষে পার হলো ধোয়ী।
টানা কাজ করতে করতে তার চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। সে কাজ সেরে অন্যদিকে আসতেই খুশির চোটে তাকে জড়িয়ে ধরল কালন্তি, ‘শাবাশ ধোয়ী, তুমি না থাকলে…’ সে কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে বিজাতীয় ভাষায় ওদেরকে ধমকে উঠল কেউ। সবাই ফিরে তাকাল সেদিকে।
চারজনের একটা সশস্ত্র সৈনিক দল। কালন্তি চট করে ফিরে তাকাল শংকরাদিত্যের দিকে। দুর্গে প্রবেশ করার খুশিতে কেউই খেয়াল করেনি কিন্তু লিচ্ছবী সৈনিকদের টহলরত দলের সামনে পড়ে গেছে ওরা।
***
কালন্তিদের দুর্গে প্রবেশ করতে যে-পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে সেই তুলনায় বলতে গেলে শামান আর ঘোষিতরা খুব সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছে দুর্গের ভেতরে। সেই শৈলশিলাতে লাফিয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ আগুন পোহাতে থাকা প্রহরারত সৈনিকদের সঙ্গে লড়াইয়ের পর ওরা তেমন একটা বাঁধার সম্মুখীন হয়নি। জীবিত সৈনিককে ওখানেই বেঁধে রেখে ওরা সাবধানে শৈলশিলার ওদিক দিয়ে ভেতরের দিকে প্রবেশ করে।
‘ঘোষিত, তুমি ভালোভাবে চেনো তো জায়গাটা?’ গুহা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর কেন জানি ঘোষিতের চেহারা দেখে শামানের মনে হলো সে জায়গাটা ঠিকমতো চিনতে পারছে না। কিছুদূরে প্রবেশ করে থেমে গেছে ওরা, কারণ ওদের দলে সবার সামনে ছিল ঘোষিত, তার পেছনে শামান আর শামানের পেছনে দলের বাকিরা। শৈলশিলার প্রবেশ পথের ওখান দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই প্রথমে ওরা দেখতে পায় ভেতরটা একেবারেই প্রাকৃতিক চুনাপাথরে নির্মিত। কিন্তু ওরা যতই ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে মানুষের হাতের কাজ বাড়তে থাকে। মূল দুর্গে প্রবেশ করার পথের কাছেই এসে থেমে গেছে ঘোষিত, আর সেটা দেখে কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে শামানের ঘোষিত আদৌ দুর্গের ভেতরটা ঠিকমতো চেনে কি না।
‘ঘোষিত,’ মৃদু স্বরে ধমকে উঠল শামান। থেমে দাঁড়িয়ে দেয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে বিড়বিড় করে কী কী সব যেন বলছিল ঘোষিত। ‘বলছি তুমি চিনতে পারছো তো?’
ঘোষিত কিছু না বলে সোজা ফিরে তাকাল শামানের দিকে। ‘আরে ওস্তাদ,’ বিধুর কাছে শুনে সেও শামানকে ওস্তাদ ডাকতে শুরু করেছে। ‘কী যে কও চিনবাম না। এই সব জাগাত কত স্মৃতি,’ বলে সে আবারো দেয়ালে হাত বোলাতে লাগল। শামান দেখল ঘোষিতের চোখে পানি
ঘোষিতের কাঁধে একটা হাত রাখল শামান। ‘আমি বুঝতে পারছি তোমার খারাপ লাগছে। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের এখন যেতে হবে। তুমি ঠিকমতো চিনতে পারবে তো?’ ঘোষিত হাতের উলটোপিঠ দিয়ে নিজের চোখ মুছে শামানের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। সেই পুরনো দুষ্ট হাসি। হাসি দিয়ে সে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর মধ্যমা দিয়ে তুড়ি বাজাল। ‘চুটকির মধ্যে লয়া যাব গুহাত, কারণ এইহান থিইক্কা ওইহানে যাওনের গুপন রাস্তা আছে, চলো চলো, ‘ বলে সে প্রবেশ পথটা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই চট করে থেমে গেল।
শামানও ঠিক পেছনেই ছিল, ঘোষিত থেমে যেতেই প্রায় ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিল তার সঙ্গে, তাকে এক হাতে থামিয়ে দিল ঘোষিত, অন্যহাতে একটা আঙুল মুখের সামনে তুলে ধরে চুপ থাকতে বলল। জায়গাটা খুব একটু অন্ধকার না আবার একেবারে পরিষ্কারও নয়। দূর থেকে মশালের আবছা আলো আসছে। সেই আলোতে দেখা গেল ওদের সামনে দিয়ে টহলরত সৈনিকদের ছোটো একটা দল কথা বলতে বলতে চলে গেল।
‘সাবধানে,’ সৈনিকরা চলে যেতেই ওরা চট করে বেরিয়ে এলো মূল পথটাতে। ওটা ধরে সাবধানে এগোতে লাগল সামনের দিকে। বেশ অনেকটা এগোনোর পর ঘোষিত বলে উঠল, যদি আমার ভুল না অয় এইহানে একটা গুদাম ঘর থাকুনের কথা,’ বলে সে একটা পাথরের দরজার সামনে থেমে গেল। দরজাটা খানিকটা ঠেলে সরিয়ে দিতেই খুশি হয়ে সে বলে উঠল, ‘আছে, বলে সে ভেতরে পা রাখতে গিয়েই, ‘ও মাগো,’ বলেই ভেতরের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
ঘোষিতের পেছনেই ছিল শামান, সে হঠাৎ সামনে হারিয়ে যেতে দেখল ঘোষিতকে। ‘এই ঘোষিত, ঘোষিত?’ কোনো সাড়া নেই। শামান এদিক সেদিক তাকাল লোকটা মুহূর্তের ভেতরে স্রেফ হারিয়ে গেল নাকি ভেতরে। ‘এই ঘোষিত?’ শামান ভয় পাচ্ছে ওরা যেভাবে খোলা জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে, আবারো যেকোনো সময় টহলদার সৈনিকরা চলে আসলে মহা বিপদ হবে। যা আছে কপালে ভেবে পাথরের দরজাটা ঠেলে সরিয়ে দিতেই নিচ থেকে ঘোষিতের মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ‘ওস্তাদ সাবধানে। জায়গাটা অনেক নিচা, তয় একটা মই আছে, ওইটা ধইরা নাইম্মো।’
মই বেয়ে নিচে নেমে দেখতে পেল ঘোষিত গাই-গুঁই করতে করতে উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘তুমি ঠিক আছো?’ শামান জানতে চাইল।
মাথা নেড়ে সে বলে উঠল, ‘এক্কেরেই না, হাড্ডি ভাঙে নাই তয়, মাংস সব থেঁতলাইয়া গেছে।’
‘মাংস জাহান্নামে যাক, আপাতত হাড্ডি না ভাঙলেই চলবে,’ ঘোষিতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে সামনে এগোতে বলল শামান। ঘোষিত মুখে কপট রাগের একটা ভঙ্গি করে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণের ভেতরেই প্রাচীন গোলাঘরটা পার হয়ে ওরা অন্যদিকে চলে এলো। এখানে আগের মতোই ছোটো একটা পাথরের দরজা সরিয়ে ওরা একটা প্যাচানো সিঁড়িঘরের মতো জায়গায় এসে থামল।
‘এইহান থাইক্কা প্রথমে ওপরে উঠতে অইবো,’ বলে ঘোষিত আঙুলের ইশারায় ওদেরকে নিয়ে ওপর দিকে চলে এলো। শামানের একটা হাত কাতানার বাটে প্রস্তুত, কারণ যেকোনো সময় ওরা টহলরত সৈনিকদের সামনে পড়ে যেতে পারে। ওরা খানিকটা ওপরে উঠতেই দেখল লম্বা পথের দুই পাশে সারি সারি কামরা।
‘এইগুলাতে আগে চাকর-বাকরেরা থাকত। এহন মনে অয় লিচ্ছবী সৈনিকেরা থাকে। সবাই সাবধানে একেবারে শব্দ না কইরা এইটা পার হইতে হবে, হাতের ইশারায় সাবধান করে দিয়ে পার হতে লাগল ওরা পথটা। প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছে, এমন সময় অর্ধনগ্ন এক সৈনিক হাইম ছাড়তে ছাড়তে একেবারে ওদের সামনে পড়ে গেল।
মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল সবাই। সবার আগে ছিল শামান সেই নড়ে উঠল। সৈনিকটা একহাতে নিজের নিম্নবস্ত্র সামলে নিয়ে মুখ খুলল চিৎকার দেয়ার উদ্দেশ্যে-কিন্তু তার আগেই শামান পৌঁছে গেছে তার কাছে। তলোয়ার বের করার সময় নেই, তাই সামনে এগিয়েই এক হাতে খপ করে সৈনিকের খোলা মুখটা ধরে ফেলল এক হাতে, অন্য হাতে চট করে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ঘুরিয়ে দিল, হাঁটুর পেছনে লাথি মারতেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল লোকটা। শামান লোকটার জড়িয়ে ধরা কাঁধ থেকে হাত ছুটিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরল। লোকটা নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে জোরাজুরি করছে, গলা ধরা হাতে চাপ বাড়াল শামান। লোকটা যতই জোরাজুরি করে শামান ততই চাপ বাড়াতে লাগল, সবশেষে কনুইয়ের উলটো অংশ দিয়ে জোরে চাপ দিতেই কট করে একটা শব্দ হলো। সেই সঙ্গে ঢলে পড়ল মানুষটা। লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল শামান।
‘মেরে ফেললাম কি না কে জানে,’ বলে ও জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে আশপাশে দেখে নিল। ‘একে জলদি বেঁধে ফেল, যেকোনো মুহূর্তে আবার কেউ চলে আসতে পারে,’ বলে শামান জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল, মনে মনে ভাবছে, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে। এই লোকটা একবার চিৎকার করতে পারলে আর দেখতে হতো না। ‘এখান থেকে গুহাটা আর কত দূরে?’ শেষ প্রশ্নটা ও উচ্চারণ করল ঘোষিতকে উদ্দেশ্য করে।
‘কাছেই হউনের কথা,’ ওদের সঙ্গে আসা সৈনিকরা লোকটাকে বেঁধে ফেলেছে।
এহন কি করতাম এরে?’ একজন জানতে চাইল। শামান দ্রুত ভাবছে। ওরা সৈনিকদের বসবাসের জায়গার একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ‘একে এখানে রাখা যাবে না, তুলে নাও। দেখি,’ বলে সে সামনে এগোতে লাগল পথের শেষ প্রান্তে একটা বড়ো পিপের মতো দেখে নির্দেশ দিল অজ্ঞান সৈনিকটাকে ওটার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলতে। ওরা জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসছে হঠাৎ ঘোষিত থেমে গেল।
‘ওস্তাদ, বলে সে পাশে দেখাল। সৈনিকদের বসবাসের জায়গাটার একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে পথটা শেষ হয়েছে সেখানে একটা বড়ো লোহার দরজা ভেজানো অবস্থায় আছে। ‘এইটারে আটকায়া দেব নাকি?’
শামান ভেবে দেখল বুদ্ধিটা খারাপ না, এটাকে ঠিকমতো আটকাতে পারলে ঘুমন্ত সৈনিকরা জেগে উঠলেও ওরা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে যেতে পারবে না। ‘আটকাও,’ শামান নির্দেশ দিতেই তিনজনে মিলে লোহার শিকের মতো দেখতে দরজাটা টেনে আটকে দিল। ওটা টানার সময় কচ কচ শব্দ হলেও কেউ এলো না। দরজাটা আটকে দিয়ে লোহার শিকল দিয়ে পেঁচিয়ে বড়ো দেখে একটা গজাল মেরে দিল ওরা বিপরীত দিক দিয়ে। সম্ভবত এভাবেই দরজাটা আটকানো হয়, কিন্তু ওরা কাজটা এমনভাবে করল যাতে ভেতর থেকে ওটা সহজে খোলা না যায়।
দরজা আটকে দিয়ে ওরা সোজা রওনা দিল ঘোষিতের দেখানো পথে। আরো বেশ অনেকটা এগোনোর পর পথটা ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। যতই নিচের দিকে নামছে ততই একদিকে পানির কুল কুল শব্দ বাড়ছে আর অন্যদিকে কিসের যেন একটা হুম হুম শব্দ ভেসে আসছে।
দেয়ালের গায়ে জায়গায় জায়গায় মশাল লাগানো, সেই আলোতে পথ দেখে এগোতে লাগল ওরা। আরেকটু নিচের দিকে নামার পর দেয়ালের রং ধীর ধীরে লালচে থেকে সাদা হতে শুরু করল। শামান হাত দিয়ে দেখল দেয়াল থেকে সাদা মতো কী যেন হাতে উঠে আসছে, সম্ভবত প্রাকৃতিক চুনা।
‘ওস্তাদ, জলাধারের গুহাটা সামনেই,’ ঘোষিতে ফিসফিসে গলা ভেসে এলো শামানের পেছন থেকে। অবশ্য সে না বললেও চলত, কারণ সামনেই মানুষের হাতে গড়া পথ শেষ হয়ে প্রাকৃতিক কাঠামো প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। পথটার ঠিক শেষ প্রান্তে বড়ো একটা দরজার মতো। ওটার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পিপেসহ নানা ধরনের জিনিস।
ওরা দেয়ালের ধার ঘেঁষে আরেকটু এগোনোর পর দেখতে পেল পথের শেষ মাথায় যেটা দেখা যাচ্ছে ওটা আসলে কোনো দরজা নয়, বরং অনেকটা বড়ো আকারের ফোকরের মতো, ফোকরটার সামনে কোমরে কৌপিন জড়ানো মুখে সাদা আর লালচে রং মাখানো, মাথায় অদ্ভুত সাপের মতো দেখতে মস্তকাবরন পরা কয়েকজর প্রহরী স্থির পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
‘উরগ,’ শামানের ঠিক পেছনে থেকে আবারো ঘোষিতের ফিসফিসে গলা ভেসে এলো। ‘এহন কী করুম? গুহায় ঢুকতে অইলে তো এগো সামলাইতে অবো, কিন্তু শব্দ না কইরা তো হেইটা সম্ভব না।’
শামান ঘোষিতের কথা শুনছে কিন্তু তার দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। সবশেষে ওর দৃষ্টি এসে স্থির হলো ওদের সামনে সারি দিয়ে সাজানো পিপের ওপরে। মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। ‘ব্যবস্থা পেয়েছি।’
***
অস্ত্রধারী সৈনিকদের দলটার সামনে পড়ে যেতেই প্রাথমিকভাবে একটু চমকে উঠলেও শংকরাদিত্যের মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি, ঠিক এমনটাই চেয়েছিল ওরা। কিন্তু তার মুখের হাসি মুছে গেল কারণ সে তলোয়ার বের করার আগেই তার দিকে এগিয়ে এসেছে প্রথম সৈনিক।
শংকরাদিত্য নিজের তলোয়ারটা প্রায় বের করে এনেছে, তার আগেই খোলা তলোয়ারটাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আনমনেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। কিন্তু শপাং করে একটা শব্দের সঙ্গে প্রহরীদের দলনেতার তলোয়ার ধরা হাতটা থেমে গেল শংকরাদিত্যের মুখের কাছাকাছি এসে। কালন্তি চাবুক ছুড়ে দলনেতার হাতটা আটকে দিয়েছে।
কালন্তি দলনেতার হাতটা আটকে দিয়ে ধোয়ীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল। ‘ধোয়ী, এক্ষুণি।’
গোলগাল চেহারার ধোয়ী মুহূর্তের মধ্যে সামনের দিকে এগিয়ে এলো। সে এমনকি তার তলোয়ারে হাতও দেয়নি। প্রহরীদের দলনেতার তলোয়ার ধরা হাতটা বন্দি হয়ে ছিল কালন্তির চাবুকের মাথায়। টানাটানি করেও সে ওটা খুলতে পারছিল না। ধোয়ী এগিয়ে এসে নিজের থামের মতো মোটা একটা হাত দিয়ে খপ করে দলনেতার হাতটা ধরে নিজের দিকে নিয়ে এলো। চাবুক থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে একটানে তুলে ফেলল মাথার ওপরে। সোজা ছুড়ে দিল এগিয়ে আসতে থাকা বাকি তিন প্রহরীর দিকে।
দলনেতা লোকটা উড়ে গিয়ে দুজনকেসহ গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। বাকি এক প্রহরী এগিয়ে আসছিল ওদের দিকে, সে চট করে থেমে গেল। ধোয়ী বের করে আনল নিজের তলোয়ার।
ওর ঠিক পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল শংকরাদিত্য, ‘কোনো রক্তপাত নয়।’
ধোয়ীর মুখে ফুটে উঠল সামান্য হাসি, এগিয়ে আসা প্রহরী লোকটা তলোয়ার বাগিয়ে ধরে দুই পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল বাকি প্রহরীদের একজন। দুজনেই এবার সাহস পেয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করল ধোয়ীর দিকে। দু পাশ থেকে দুজনে ঘিরে ধরল তাকে। কালন্তি এগিয়ে যাচ্ছিল তার দিকে, একটা হাত তুলে ধোয়ী মানা করল।
একদিকে দুজন সৈনিক পড়ে আছে মাটিতে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছে শংকরাদিত্য, কালন্তি আর ওদের দলের বাকিরা। আর অন্যদিকে ধোয়ীকে ঘিরে আছে দুই সৈনিক। দুই সৈনিক কিছু করার আগেই তাদের একজনের দিকে ধেয়ে গেল সে, লোকটা আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে একটু পিছিয়ে যেতেই একপাশে কাত হয়ে খানিকটা সরে গেল সে। অন্যদিকে পেছনের প্রহরী এগিয়ে এলো এই সুযোগে, এগোতে থাকা লোকটার পেটের নিচের অংশে উলটো পায়ে লাথি মারল সে, লোকটা লাথি খেয়ে বাঁকা হয়ে যেতেই তার তলোয়ারের হাতল বসিয়ে দিল লোকটার কপালে, কাটা গাছের গুঁড়ির মতো ধাম করে পড়ে গেল লোকটা।
নিজের সঙ্গীকে ধোয়ীর সঙ্গে মারামারি করতে দেখে, চট করে এগিয়ে এলো দ্বিতীয় প্রহরী। ধোয়ী তখনো প্রথম প্রহরীকে আঘাত করে সোজা হতে পারেনি তার আগেই প্রথম প্রহরী এগিয়ে এসে তলোয়ার চালাল ধোয়ীকে উদ্দেশ্য করে, মাথাটাকে একপাশে কাত করে সেই আঘাত এড়িয়ে গেল সে, কোপটা বিফলে যেতেই অন্য লোকটা শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল, এই সুযোগে চট করে তার কোমরের কাছটা ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে লোকটাকে দেয়ালের ওপরে আছড়ে ফেলল সে।
দলনেতা আর এক প্রহরী টক্কর খেয়ে আগেই অজ্ঞান হয়ে গেছিল, এবার বাকি দুজনকে কাত করে শংকরাদিত্যের দিকে ফিরে ভাবলেশহীন কণ্ঠে ধোয়ী বলে উঠল, ‘রক্ত পড়ে নাই মনে হয়, আর দুই-চাইর ফোঁটা পড়লে আমার কিছু করার নাই।’
শংকরাদিত্য একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের লোকদের দিকে ফিরে নির্দেশ দিল, যার যার কাজে লেগে পড়তে। ধোয়ীর সামনে এসে কালন্তি খানিকটা রাগের সঙ্গেই বলে উঠল। ‘খুব বাহাদুরি দেখানো হলো, না? কি দরকার ছিল একা সবগুলারে সামলানোর?’
ধোয়ী কিছু না বলে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল কালন্তির দিকে, একটু পরে ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। কালন্তি ফিরে তাকিয়ে দেখল শংকরাদিত্য তার কাজে লেগে গেছে। তাকে উদ্দেশ্য করে কালন্তি বলে উঠল, আমাদের জলদি করা উচিত।’
‘হ্যাঁ,’ নিজের হাতের কাজ করতে করতে শংকরাদিত্য জবাব দিল। ‘আমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে বাকিরা কী করছে?’ বলেই সে নিজের কাজ সেরে সোজা হয়ে চট করে একটা দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিল কালন্তির হাতে।