অধ্যায় পঁয়তাল্লিশ – বর্তমান সময়
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ, সিলেট
সিকিউরিটির লোকটা যখন দৌড়ে এসে জানাল টমি ওকে আর জালালকে জরুরি ভিত্তিতে কনফারেন্স রুমে যেতে বলেছে তখনো তানভীর ডক্টর মিতায়নের চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিল।
ডক্টরের চোখের করুণ আকুতির কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছে না তানভীর। ‘ডক্টর, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব,’ বলে ও এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না, জালালকে বের হবার জন্যে ইশারা করে দ্রুত পদক্ষেপে চলে এলো রুমের বাইরে। রুমের বাইরে এসে সোজা হেঁটে চলে এলো কনফারেন্স রুমে। সেখানে, সবাই অপেক্ষা করছিল ওদের দুজনার জন্যে, দুজনেই রুমে প্রবেশ করে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
‘কি ব্যাপার, টমি? আপডেট জানাও।’
স্যার, গরম খবর আছে,’ বলে সে উত্তেজনার সঙ্গে আবারো সেই প্রজেক্টরের স্ক্রিন ওপেন করল। ‘জেড মাস্টারের ব্যাপারে ইন্টারপোলের কাছে তথ্য চেয়েছিলাম আমরা। ওদের পাঠানো ইনফো আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে পাশা স্যারের মাধ্যমে। জেড মাস্টারকে অ্যান্টিক চোরাচালানির জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি বলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে এশিয়ান অ্যান্টিকের জগতে তার সমকক্ষ নাকি কেউই নেই। লাউস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও চায়নার কিছুটা অংশ তিব্বতসহ ভারতের কিছুটা অংশের আন্তর্জাতিক চোরাচালানের একচ্ছত্র অধিপতি। এশিয়ান মাফিয়া, দুর্নীতিবাজ পুলিশ, এমনকি অনেক দেশের সরকারের ভেতরেও নাকি তার লোক আছে। আন্তর্জাতিক অ্যান্টিক চোরাচালানির মার্কেটে এশিয়ার এই অংশটাকে বলা হয়ে থাকে করিডর আর এই করিডরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারী সে।’
টমি, তুমি কি এখানে জেড মাস্টারের গুণকীর্তন শোনানোর জন্যে আমাদেরকে ডেকে এনেছো?’ ধমকে উঠল তানভীর।
‘না, বস। এই তথ্যগুলো দিলাম কারণ জেড মাস্টারকে বুঝতে হলে এটা জানতে হবে। আমি সংক্ষেপ করব, তবে জেড মাস্টারের ব্যাপারে আরেকটা তথ্য না বললেই নয়, জেড মাস্টার আসলে কে, সে দেখতে কেমন, কী তার ব্যাকগ্রাউন্ড কেউই জানে না। এমনকি ইন্টারপোলের কাছেও তার কোনো পরিচয় নেই। শুধু একবারই সে ইন্টারপোলের কাছে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, সেবারই তার একান্ত সহকারী শেখারভকে দেখতে পেয়েছিল ইন্টারপোল। অত্যন্ত ক্ষমতাধারী, ভয়ংকর হিংস্র আর চতুর এই জেড মাস্টার। সবসময় সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে। কথিত আছে, সে যতবার যতজনের সঙ্গে কাজ করেছে, কাজ শেষে কাউকেই বাঁচিয়ে রাখেনি। এমনকি এদের ভেতরে কয়েকজনকে পরিবারসহ গায়েব করে দিয়েছে।’
টমির শেষ কথাটা শুনে তানভীরের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল জালাল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দুজনেই সুলতানের পরবর্তী প্রশ্নে সামনের দিকে মনোযোগ দিল।
‘আচ্ছা, তুমি অনেকগুলো দেশের নাম বললে, বাংলাদেশের নাম তো বললে না?’ সুলতান জানতে চাইল।
‘কারণ এতদিন পর্যন্ত জেড মাস্টারকে কখনো বাংলাদেশে অপারেট করতে শোনা যায়নি। এইবারই সম্ভবত সে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অপারেট করছে। কারণ বিখ্যাত ব্ল্যাক বুদ্ধার পেছনে লেগেছে সে।’
‘শুধু লাগেইনি, সম্ভবত সে ভারত আর বাংলাদেশের মতো দুটো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একেবারে নাকের ডগায় বসে ডক্টর মিতায়নকে ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করেছে সে। এরপরে কী হয়েছে সেটা আমরা জানি না তবে যে-তথ্য আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এবং,’ বলে একটা আঙুল তুলল তানভীর। ‘সম্ভবত আমরাই প্রথমবারের মতো যেভাবেই হোক জেড মাস্টারের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি। আমরাই মনে হয় জানি জেড মাস্টার আসলে কে।’
‘টেড চ্যাঙ,’ আনমনেই বলে উঠল জালাল।
‘একদম ঠিক, ডক্টর মিতায়নের ভাষ্য যদি সঠিক হয় তবে, টেড চ্যাঙই হলো জেড মাস্টার। টেড চ্যাঙ তার আসল পরিচয় কি না কে জানে-তবে এই নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটাই সম্ভবত জেড মাস্টার। তার জ্ঞান, তার প্রজ্ঞা তার আন্তর্জাতিক কানেকশন, অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড মেলালে এটাই মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। আশ্চর্য! এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো আর্কিওলজিক্যাল সংস্থার প্রধানের ছদ্মবেশে সে কতদিন এই কুকাজ করে বেড়াচ্ছিল। টমি তুমি, পাশা স্যারসহ ইএএফের প্রধান বাবুল আহমেদ স্যারকে জানাও ব্যাপারটা। উনাদেরকে বলো ইন্টারপোলকে এই ব্যাপারে জানাতে। সেইসঙ্গে পুরো সিলেট শহরে টেড চ্যাঙ মানে জেড মাস্টার আর তার সহকারী শেখারভের ছবি সার্কুলেট করো। ডক্টর হারিয়ে যাবার কিছু সময় পর থেকেই পুরো শহর ব্লকেডের আন্ডারে আছে। কাজেই তারা এখনো এই শহর ছেড়ে যেতে পারেনি। আমি জেড মাস্টারকে চাই।’
‘বস,’ বলে টমি একটা হাত তুলল। ‘তুমি যা যা নির্দেশ দিলে সেগুলোর প্রথম অংশটা অবশ্যই করব। কিন্তু দ্বিতীয় অংশটার প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। তবে সেটাতে আমি পরে আসছি-আগে বলে নেই কানা মাতবরের ফ্যাক্টরির লোকদেরকে জেরা করে আমরা জানতে পেরেছি, ফ্যাক্টরির ভেতরের বাংলোটাতে কয়েকদিন ধরে বেশকিছু বিদেশি অবস্থান করছিল। কানা মাতবরের লোকেরাই তাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখত। ওরা গত তিনদিন ধরে ওখানে অবস্থান করছিল। সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জেড মাস্টার কোথায় আছে না জানলেও সে আজ সন্ধ্যার পরে কোথায় থাকতে পারে সে ব্যাপারে একটা ধারণা আমরা বের করতে পেরেছি।’
‘মানে?’ তানভীর উত্তেজনার চোটে একবার জালালের দিকে তাকিয়ে আরেকবার সুলতানকে দেখল ও। সুলতান মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল ওকে। টমি ভুল বলেনি।
ওদিকে তানভীরের উত্তেজনা টমি খেয়াল করেনি, সে তার মতোই বলে চলেছে। ‘এই ব্যাপারে অবশ্য আমার নিজের খুব বেশি ক্রেডিট নেই। প্রায় পুরো ক্রেডিটটাই ইন্সপেক্টর ইকবালের। আপনারও খানিকটা আছে,’ বলে সে তানভীরকে দেখাল।
‘টমি, নাটকীয়তা বাদি দিয়ে কাজের কথা বল,’ তানভীরের নিজেকে একটু অধৈর্য লাগছে। ‘এর মানে কি?’
‘মানে হলো ‘টাইটানিক’,’ বলে টমি একটু সাসপেন্স আনার জন্যে একটু থামল। থেমে মৃদু হাসিমুখে সবাইকে একবার করে দেখে নিয়ে সে তানভীরের দিকে তাকাতেই জলদি পারবর্তী স্লাইডে চাপ দিল। ‘কানা মাতবর মারা যাবার আগে আপনাদের বলে গেছিল ‘টাইটানিক’। আপনাদের মধ্যে যেখানে গোলাগুলি হয়েছে সেখানে পরবর্তীতে খুঁজে দেখার সময়ে ওখানে আমরা একটা কার্ড পাই। সেই কার্ডটার পেছনেও হাতে লেখা ছিল টাইটানিক শব্দটা। সম্ভবত এই কার্ডটাই কানা মাতবর দিতে যাচ্ছিল শেখারভদেরকে।’
টাইটানিক ছাতাটা আসলে কি, সেইটা কও,’ টমির লেকচার আর সহ্য করতে না পেরে জালাল রাগের সঙ্গে ধমকে উঠল ।
টাইটানিক হলো একটা লঞ্চ। লঞ্চ বললে আসলে ভুল বলা হয়, জিনিসটা একটা লঞ্চ, রিভারক্রুজ টাইপের একটা লঞ্চ। অনেকটা ভাসমান কমিউনিটি সেন্টারের মতো। সাধারণ একটা লঞ্চকেই এক স্থানীয় ব্যবসায়ী খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। ওটাতে একটা রেস্টুরেন্ট আছে ডেকের ওপরে, গান-বাজনা হয়, আবার খাবার ব্যবস্থাও আছে। তবে ওটা লঞ্চের মূল জিনিস না। লঞ্চটাতে বিভিন্ন ধরনের পার্টি আয়োজন করা হয়। বিয়ের জন্যে একটু ছোটো কিন্তু জন্মদিন, গায়ে হলুদ ইত্যাদি নানা ধরনের ছোটোখাটো পার্টির জন্যে ঠিক আছে। কিন ব্রিজের নিচ থেকে ছাড়ে ওটা। পার্টির লোকজন উঠলে পরে লঞ্চটা মূল নদীতে চলে যায়। সেখানে পার্টি চলে, পরে আবার তাদের এনে নামিয়ে দেয়া হয় শহরের কাছে বন্দর এলাকার আশপাশে। এই লঞ্চটাকেই নাম দেয়া হয়েছে টাইটানিক।’
‘ব্ল্যাক বুদ্ধা আর জেড মাস্টারের সঙ্গে এই টাইটানিকের সম্পর্ক কি?’ সুলতান জানতে চাইল।
‘বুঝতে পারছো না,’ টমি উত্তর দেয়ার আগেই তানভীর বলে উঠল। যদি আমরা গল্পটা এভাবে সাজাই, টেড চ্যাঙ মানে জেড মাস্টার বাংলাদেশ আর আসামের অথরিটিকে ধোঁকা দিয়ে ডক্টর মিতায়নকে ব্যবহার করে ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করে দেশে ঢুকল, তাদেরকে আবার সাহায্য করছিল হেকমত আবদুল্লাহ। তো ওরা দেশে ঢোকার পরে সম্ভবত হেকমত আবদুল্লার লোকেরা ওদেরকে ধোঁকা দিয়ে মূর্তিটা কেড়ে নিতে চাইছিল। তখন শেখারভেরা তাকে খুন করে ব্ল্যাক বুদ্ধা হাতিয়ে নেয়। এরপরে সম্ভবত কানা মাতবরের সঙ্গে ওদের একটা চুক্তি হয় যে, সে ওদেরকে প্রটেকশন দেবে সেইসঙ্গে সম্ভবত টাইটানিকে করে কোনো একটা অনুষ্ঠানের সুযোগে ওদেরকে শহরের বাইরে বের করে দিয়ে আসবে। ওই সময়ে আমরা গিয়ে পড়ি অন স্পটে। খানিকটা গোল বেঁধে যায় আর কানা মাতবর মারা পড়ে। এখন প্রশ্ন হলো, কানা মাতবর মারা পরার পরেও ওরা টাইটানিকের পরিকল্পনা ঠিক রাখবে কি না?’ কথাগুলো অনেকটা আনমনেই বলে উঠল তানভীর। বলেই টমির দিকে ফিরে জানতে চাইল, ‘টমি, তুই খোঁজ লাগা টাইটানিক এখন কোথায়, আর তাতে আজ কোনো অনুষ্ঠান আছে কি না?’
‘আছে বস, এরই মধ্যেই খোঁজও লাগানো হয়েছে সেইসঙ্গে লোকও লাগানো আছে। ওরা টাইটানিকের ওপরে নজর রাখছে। টাইটানিক এখন কিন ব্রিজের নিচেই আছে! ওটা সাজানো হয়েছে বেশ চমৎকার করে কারণ আজ নাকি ওতে সিলেটের কোনো ব্যবসায়ীর মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আছে,’ বলে সে একটু দ্বিধার সঙ্গে যোগ করল।
‘বস, যদি কিছু মনে না করো তবে ছোটো মুখে একটা বড়ো কথা বলি, যদি আমার ধারণা ভুল না হয় তবে কানা মাতবর মারা যাবার পরেও অবশ্যই আজকে টাইটানিকটা শেখারভরা ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। কারণ টাইটানিকের মালিক কানা মাতবর ছিল না। সে সম্ভবত টাইটানিকের মালিকের সঙ্গে ওদেরকে একটা চুক্তি করে দিয়েছিল। কাজেই কানা মাতবর মারা গেলেও ওরা টাইটানিকের পরিকল্পনা বাদ দেবে না, কারণ জবরজং ধরনের একটা অনুষ্ঠান আছে টাইটানিকে। মানে ওটা শহর ছেড়ে বেরুবে। অনুষ্ঠানের আড়াল নিয়ে টাইটানিকে উঠে ওরা মাঝ নদীতে অন্য কোনো মাধ্যমে সরে পড়ার চেষ্টা করবে ওখান থেকে। আর টাইটানিকের ব্যাপারটা যে কানা মাতবর মারা যাবার আগে আমাদের বলে গেছে ওটাও ওদের জানার কোনো কারণ নেই—কাজেই আমার বিশ্বাস আজ টাইটানিকে কিছু একটা ঘটবেই।’
তানভীর একটু চিন্তা করে ফিরে তাকাল জালালের দিকে। একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে সে। জালাল ভাই, আপনার কি মনে হয়?’
‘টাইটানিকের মালিকরে ধইরা প্যাদানি দেয়া যায় না আগে ভাগে?’
‘না, সেই উপায় নেই। প্রমাণ কি আমাদের হাতে? মালিক যেই হোক স্রেফ অস্বীকার করবে সে। সেইসঙ্গে ওদেরকে সাবধান করে দেয়ার একটা সম্ভাবনাও আছে। কাজেই এটা বাদ,’ এবার সুলতান যোগ করল।
‘তাইলে আর কি টাইটানিক যেমন ডুবছিল এক শ বছর আগে, ওই জেড মাস্টার না কি ছাতার মাথা, ওগোরে ধইরাও ওমনে চুবাইতে হবে সুরমার পানিতে, তাইলেই জড মাস্টারগিরি ছুইট্টা যাবে,’ বলেই তার মুখে ফুটে উঠল সেই বিখ্যাত হাসি।
তানভীরও মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘তাহলে, চলেন পরিকল্পনাটা ঠিক করে ফেলি।’