প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৪২

অধ্যায় বিয়াল্লিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
বিধোরীর দুর্গ, কন্নোর, ভারতবর্ষ

গায়ের পোশাকটা বেশ শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে বিধুর গায়ে। অস্বস্তির সঙ্গে খানিকটা নড়ে-চড়ে উঠল সে। ভারী শরীরটা নড়ে ওঠার কারণে ছোটো ঘোড়ার গাড়িটাও কট-কট করে সামান্য নড়ে উঠল। সামনে থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কেউ একজন গাড়ির কাঠের শরীরে দুই-তিনটা থাবা মেরে চুপ থাকতে বলল।

‘আচ্ছা, আচ্ছা,’ বলে বিধু স্থির হয়ে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু স্থির হওয়াটা ওর জন্যে আরো কঠিন। কারণ একদিকে ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে জায়গা খুবই কম, তাতে আবার বসেছে দুজন মানুষ, সেইসঙ্গে ভেতরে রাখা হয়েছে এক বস্তা ধনুকের ছিলা। তাতেও তেমন একটা সমস্যা হতো না কিন্তু যে লিচ্ছবী সৈনিকের পোশাক বিধু গায়ে চড়িয়েছে লোকটা ছিল তারচেয়ে অনেক বেশি হ্যাংলা-পাতলা, এর ফলে বিরাট চওড়া শারীরিক আকৃতির বিধুর গায়ে একেবারে এঁটে বসেছে পোশাকটা ।

‘পোশাকটা গায়ে চেপে বসেছে, তাই না?’ বিধুর সামনে থেকে জাথুরিয়া মৃদু হেসে বলে উঠল

কিছু না বলে বিধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে যতটা সম্ভব না নড়ে-চড়ে পোশাকটাকে গায়ে ঢিলে করার চেষ্টা করছে।

‘বেশি টেনো না,’ জাথুরিয়া বলল। ‘তাতে অবার ছিঁড়ে যেতে পারে। আমার হয়েছে উল্টা, বলে সে নিজের গায়ে চড়ানো ঢলঢলে পোশাকটা দেখাল, ওটা অনেকখানি ঢিলে হয়ে আছে। ঢলঢলে পোশাকটা দেখিয়ে মৃদু হাসল সে।

‘এই শালারা এইগুলা কী গায়ে দেয়। আমি সিংহল রাজার ওইখানে কাম করছি, আসাম-ত্রিপুরার রাজার সেনাগো লগে কাম করছি এইরহম বাজে পোশাক আর দেহি নাই,’ বিধু রাগের সঙ্গে গজ গজ করে উঠল। ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে জাথুরিয়া ঘোড়ার গাড়ির কাঠের ফোকরে চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করছে কতটুকু অগ্রসর হলো ওরা।

‘কদ্দুর?’ বিধু জানতে চাইল।

‘এহনো দেরি আছে, ওই যে দুর্গ দেহা যায়, আমগো দল মাত্র খাড়াই বাইয়া উঠতে শুরু করছে,’ জাথুরায়া বাইরে দেখতে দেখতে জানাল। ছিলা প্রস্তুতকারীদের গ্রাম থেকে লিচ্ছবীদের দলটাকে ধরে আনার পর ওদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শামান আর রাজা বিক্রম মিলে পরিকল্পনা করেছে আজকের অভিযানের। সেই পকিল্পনার অংশ হিসেবেই ওরা তিনটে দলে ভাগ হয়ে হানা দেবে বিধোরীর দুর্গে। একটা দলের নেতৃত্বে থাকবে শামান, অন্যটার নেতৃত্বে কালন্তি আর সবশেষে মূল দলের নেতৃত্বে আছে রাজা বিক্রম নিজে। এই শেষ দলেই স্থান হয়েছে বিধুর।

এই দলটা সংখ্যায় কম কিন্তু এই একটা মাত্র দলই অপহৃত সৈন্যদের পোশাক গায়ে চড়িয়ে ছদ্মবেশে প্রবেশ করবে দুর্গের মূল ফটক দিয়ে। ওদের দলে আছে তিনটে ঘোড়া আর একটা ঘোড়ার গাড়ি। তিন ঘোড়ার একটায় রাজা বিক্রম লিচ্ছবী সৈন্যের ছদ্মবেশে, বাকি দুটো ঘোড়ায় আরো দুজন সৈনিক। ঘোড়ার গাড়িতে বিধু আর জাথুরিয়া।

জাথুরিয়া ফোকর থেকে চোখ সরিয়ে ফিরে তাকাল বিধুর দিকে। ‘বিধু, যদিও আমগো পরিচয় অল্প সময়ের কিন্তু তোমারে আমার একটা কথা বলার আছে,’ বলে সে যেন একটু অস্বস্তির সঙ্গে নড়ে উঠল। ‘আমি আসলে কুনোদিনই নিজের সেনার বাইরে কেউরেই বিশ্বাস করি নাই। আর এই কারণেই শুরু থাইক্কা থারুরা তো বটেই দলের বাকিগো লগেও আমার ব্যবহার খুব একটা ভালা ছিল না। কিন্তু ওই দিন মন্তলার হাটে আমার ভুল ভাঙছে। আমি বুঝতে পারছি আসলে মানুষের লগে মানুষে সম্পর্ক গোত্র-ধর্ম-জাতি দিয়া নির্ধারণ হয় না। ওই দিন মন্তলার হাটে তুমি আমারে প্রাণে না বাঁচাইলে আমার লাশ এতক্ষণে চিল কাউয়ায় খাইত। আমি, আমি—’ জাথুরিয়ার গলা বুজে এসেছে।

তার দিকে তাকিয়ে বিধু বড়ো করে একটা হাইম ছাড়ল। ‘আহ—’ হাইম ছেড়ে সে জিভের ওপরের অংশ আর তালুর সঙ্গে লাগিয়ে টক-টক করে অদ্ভুত এক শব্দ করল। ‘আমি আসলে বুঝতে পারতাছি তোমারে আমার এখন খুব ভালো কিছু কওয়া উচিত কিন্তু হাছা কথা অইলো আমি না এই গুলান ঠিক পারি না,’ বলে সে হেসে উঠল।

জাথুরিয়া একটু অবাক হয়ে তার দিয়ে তাকিয়ে আছে। বিধু হেসে ওঠার একটু পর সেও হেসে উঠল ।

বাইরে থেকে কারো শিসের শব্দ শোনা গেল, সেই সঙ্গে মৃদু কিন্তু গম্ভীর স্বরে সতর্ক করে দেয়া হলো ওদেরকে, সবাই যেন সাবধান থাকে, কারণ দুর্গের মূল ফটকের কাছে চলে এসেছে ওদের দল। এবারই প্রমাণ হয়ে যাবে এত সাবধানতা—এত পরিকল্পনা সব কাজে, লাগবে নাকি বিফলে যাবে।

ওরা আরেকটু এগোতেই মূল ফটকের সামনে থেকে একজন পাহারাদার হাঁক দিয়ে থামাল ওদেরকে। এবার ঘোড়ার গাড়ির ফোকরে চোখ লাগাল বিধু। রাতের আবছা অন্ধকার কেটে গিয়ে মশালের আলোয় উদ্ভাসিত ফটকের সামনের অংশ। সেখানে প্রহরারত দশ-পনেরোজন সৈনিক। তাদের ভেতর থেকে একজন ওদেরকে থামতে ইশারা করতেই রাজা বিক্রম এগিয়ে গেল সামনের দিকে। তার পরনে লিচ্ছবী সৈন্যদের পোশাক, মাথায় শিরণাস্ত্র আর কৃত্রিম তারের ঝুল দিয়ে মুখ প্ৰায় পুরোটাই ঢাকা।

সে সামনে এগিয়ে জোরের সঙ্গে বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার, পথ আটকানো হচ্ছে কেন, দেখতে পাচ্ছো, না রাজার মূল দলের সৈনিকদের জন্যে মালামাল আনা হয়েছে?’ রাজা বিক্রম স্থানীয় লিচ্ছবী ভাষায় কথা বলে উঠল। তার গলা একেবারেই অকম্পিত, ঠিক একজন বাহিনী প্রধান তার অধীনস্থদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলে সেও ঠিক সেভাবে কথা বলছে।

‘তা-তো বুঝলাম, কিন্তু এই রাতের বেলা কেন?’ পাহারাদারদের নেতা সামনের দিকে এগিয়ে এলো। ‘আর তোমাদের দলনেতা কোথায়?’

রাজা বিক্রম ঘোড়া থেকে না নেমে ঘোড়ার মুখ সামান্য সরিয়ে পাহারাদারদের নেতার মুখোমুখি হয় বলে উঠল, ‘আমাদের দেরি হয়েছে কারণ আমাদের সঙ্গের দুই সৈনিক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাদেরকে বৈদ্যখানায় নিয়ে সুস্থ হবার পর আসতে হয়েছে। আর নেতা গেছে তার,’ বলে রাজা বিক্রম পাহারাদারদের প্রধানের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। ‘দেরি হচ্ছে দেখে তার আর ভালো লাগছিল না, তাই গেছে আর কি, বোঝ না?’ সেনাপতির সহকারীর বিশেষ বিশেষ জায়গায় যাবার অভ্যেস আছে এটাও ওরা অপহৃত সৈনিকদের কাছ থেকেই ওরা জানতে পেরেছে।

পাহারাদারদের নেতা এক মুহূর্ত গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল রাজা বিক্রমের দিকে। তারপর হেসে উঠল সে, তার সঙ্গে গলা মেলাল দলের বাকিরা। ‘যাও যাও, যে-দেরি করেছো তাতে আইজ সেনাপতি তোমাদের গর্দান নেবে,’ বলে সে নিজের লোকদেরকে নির্দেশ দিল ফটক খুলে দেবার জন্যে।

রাজা বিক্রম একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তার দলের দিকে ফিরে ইশারা করল। ফোকরের ভেতর থেকে বিধু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ওদের দলের ঘোড়াগুলো ফটক দিয়ে প্রায় ঢুকে গেছে এমন সময় পাহারাদারদের প্রধান চিৎকার করে উঠল, ‘এই থামো।’

রাজা বিক্রমসহ বাকিরা এগিয়ে গেছিল বেশ খানিকটা, সেই সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িটাও, বহু কষ্টে রাশ টেনে থামিয়ে দেয়া হলো ওটাকে। রাজা বিক্রম নিজের দলের বাকিদের দিকে ফিরে তাকাল, ব্যাপার কি? ওদেরকে এভাবে থামানো হলো কেন, তবে কি ওরা সন্দেহ করেছে কিছু একটা!

***

কালো পানির বুক চিরে খুব ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে ততোধিক কালো একটা বস্তু। খুব কাছ থেকে পরখ করলে হয়তো এই কালো বস্তুটাকে একটা ভেলা বলে চালিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু যেভাবে ডালপালা আর কালো কাপড় দিয়ে ভেলাটাকে ওপর থেকে প্যাঁচানো হয়েছে তাতে আর দশটা ভাসমান কাঠের গুঁড়ির এলোমেলো টুকরো ছাড়া অন্যকিছু কোনোভাবেই বলা সম্ভব নয়।

তীব্র স্রোতের টানে জলধারা দিয়ে নানা ধরনের গাছের গুঁড়ি, ঝোপ-ঝাড়সহ আরো অনেক কিছু ভেসে চলেছে জলপ্রপাতের দিকে। এই ভাসমান জিনিসগুলোর ভেতরে খুবই সাধারণ দেখতে এলোমেলো গাছের গুঁড়ির ভেতরেই অবস্থান করছে কয়েকজন মানুষ।

জলধারাটা আসলে একটা বড়ো নদীর মতো হলেও এতে স্রোতের টান আর পানির উত্থান-পতন অনেক বেশি। তবে পানির বুক চিরে বয়ে চলা কালো বস্তুটার ভেতরে অবস্থানরত মানুষগুলোর জন্যে ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে। কারণ এই স্রোত আর পানির শব্দ না থাকলে কোনোভাবেই তারা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারত না।

যদিও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে তাদেরকে এখনো আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সেইসঙ্গে মোকাবেলো করতে হবে আরো বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা সমস্যার। তবুও একটা ভালো ব্যাপার হলো; শত্রুপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা জলধারার মূল স্রোতের উৎস থেকে রওনা দিয়ে এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। ভাসমান ভেলাটা বিশেষভাবে বানানোই হয়েছে আজকের অভিযানের জন্যে। একেবারে শুকনো এক ধরনের বিশেষ কাঠের গুঁড়ি পাশাপাশি বসিয়ে তাতে কাঠের তক্তা জোড়া লাগানো হয়েছে, আবার সেইসঙ্গে প্রতিটা গুঁড়ির মাঝামাঝি রাখা হয়েছে ফাঁক যাতে ভেলায় বসে থাকা লোকগুলো সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে বৈঠা চালিয়ে সামনে এগোতে পারে কিংবা স্রোতের বিপরীতে যেকোনো দিকে যেতে পারে।

ভেলায় অবস্থানরত মানুষগুলো এই মুহূর্তে তাই করছে। কিন্তু ওপরে গাছের ডাল-বাকল আর পাতা দিয়ে ঢেকে রাখাতে সেটার নিচে শুয়ে শক্তিশালী স্রোত ঠেলে নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে চলেছে মানুষগুলো। ভেলায় এই মুহূর্তে অবস্থান করছে কালন্তি, শংকরাদিত্য, ধোয়ী আর শংকরাদিত্যের বাহিনীর চারজন শাক্য সৈন্য। মূলত সৈন্যরাই নিজেদের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে ভেলাটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার।

‘আমরা কি সঠিক দিকে যাচ্ছি, নাকি ভুল পথে এগিয়ে—’ কালন্তি ওর ঘাড়ের ওপরে এসে পড়া শংকরাদিত্যের উদ্দেশে কথাগুলো বলার মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিল মানুষটা। তার ঠোঁটে এক আঙুল, আর দৃষ্টি ডালপালার ফাঁক দিয়ে সামনের দিকে। কথার জবাব না পেয়ে আবছা অন্ধকারের মধ্যেই ধোয়ীর দিকে ফিরে তাকাল কালন্তি। ধোয়ীর গোল মুখে কোনো ভাব নেই। গাছের গুঁড়ির মতো শক্তিশালী দুই হাতে ভেলার নিয়ন্ত্রক হাল ধরে আছে সে। কালন্তির দিকে তাকিয়ে একবার শংকরাদিত্যেকে দেখিয়ে শান্ত থাকতে ইশারা করল ধোয়ী।

কিন্তু কালন্তি অতটা শান্ত থাকতে পারছে না। রাজা বিক্রম আর শামানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা তিনটে দলে ভাগ হয়ে রওনা দিয়েছে বিধোরীর দুর্গের উদ্দেশে। তিনটে দলের ভেতরে ওদের দলটা দ্বিতীয়, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওদের দলটা বিধোরীর দুর্গসংলগ্ন জলধারা হয়ে দুর্গের নিচের গোপন পথে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। আর শামানরা আসবে পাহাড় বেয়ে অন্যপথে।

ওরা জলধারা বেয়ে রওনা দেয়ার সময়ে শুরুটা হয়েছিল বেশ চমৎকার কিন্তু কিছু দূরে এগোনোর পরেই স্রোতের টান শুরু হতেই ওরা বিপদে পড়ে যায়। কিছু দূর পর্যন্ত একেবারে টালমাতাল এগোতে থাকে, ওদেরকে ভেলা বাইতেও হচ্ছিল খুব সাবধানে, কারণ খুব বেশি নড়াচড়া করলে দুর্গের ওপর থেকে অস্বাভাবিক কিছু নড়তে দেখলে প্রহরারত সৈন্যদের টের পেয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই খুব সাবধানে ওরা নৌকা নিয়ন্ত্রণ করে এগোতে থাকে।

কিন্তু দুর্গের প্রায় কাছাকাছি এসেও দুর্গের ভেতরে গোপণে প্রবেশ করার সেই সুরঙ্গমুখ খুঁজে বের করতে পারেনি শংকরাদিত্য, তাই কালন্তি বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। কারণ একবার যদি ওরা গুহামুখটা খুঁজে না পেয়ে আরো এগিয়ে যায় তবে সমস্যা হবে। এমনকি বেশি এগিয়ে গেলে স্রোতের তীব্র টানে জলপ্রপাত দিয়ে গড়িয়ে পড়ে প্রাণটা হারানোরও সম্ভাবনা আছে।

‘কিছু পেলেন?’ আবারো শংরাদিত্যের দিকে ফিরে জানতে চাইল কালন্তি। ভেলার ওপরে ঝোপ-ঝাড়ের ভেতরে কেমন জানি দম বন্ধ লাগছে তার। ছোটোবেলায় কুয়োর ভেতরের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর থেকে যেকোনো বদ্ধ জায়গায় অনেক কষ্ট হয় ওর, দম বন্ধ লাগে। এই জায়গাটাও ব্যতিক্রম নয়। জবাব না পেয়ে অস্থির হয়ে সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই শংকরাদিত্য প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে, ওখানটাতে আছে মায়া-করণের গুহার মুখ,’ বলে সে কালন্তির দিকে ফিরে হেসে উঠল, তার হাসিতে গুহামুখ খুঁজে পাবার স্বস্তি।

শংকরাদিত্যের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বেশ সন্দিহান ভঙ্গিতে ফিরে তাকাল কালন্তি। ‘কোথায়? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না, কালন্তির দিকে খেয়াল নেই শংকরাদিত্যের, সে ভেলাবাহকদের নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত।’

শংকরাদিত্যের নির্দেশনা শেষ হতেই ধোয়ীসহ বাকিরা মিলে ভেলা ঘোরাতে শুরু করল। ভেলার এক প্রান্ত অনেকটাই ঘুরে গেছে, বাকি অংশটাও ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল।

শংকরের দিকে তাকিয়ে কালন্তি বলে উঠল, ‘সত্যি করে বলুন তো আপনি কি নিশ্চিত ছিলেন গুহাটা কোথায় আছে?’

কালন্তির কোঁচকানো ভ্রুর দিকে তাকিয়ে দুর্বল ভঙ্গিতে হেসে উঠল শংকরাদিত্য, ‘আরে, বলে কি! আমি বিক্রম দাদা, আমরা এসব গুহা-গলি ঘুপচিতে খেলতে খেলতেই বড়ো হয়েছি, চিনব না?’ শংকরের কথা মোটেও বিশ্বাস হলো না কালন্তির। সে রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই শক্তিশালী ধাক্কায় কেঁপে উঠল পুরো ভেলা। ভেলাটার পেছনে ভেসে আসছিল বিরাট একটা গাছের গুঁড়ি, ভেলাটাকে হঠাৎ ঘুরিয়ে দেয়াতে সেটা স্রোতের বেগের সঙ্গে পূর্ণ শক্তিতে ধেয়ে এসে বাড়ি মেরেছে ভেলার গায়ে। ধাক্কাটা এতই জোরে লেগেছে যে ভেলার ওপরে সাজানো ঝোপঝাড়ের একটা অংশ ছিটকে পড়ে গেল পানিতে। যে যেখানে ছিল প্রায় সবাই গড়িয়ে পড়েছে একে অন্যের গায়ের ওপরে।

কালন্তি শংকরাদিত্যের সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় ধাক্কা লাগাতে সে ছিটকে পড়ল ধোয়ীর গায়ে। ভেলায় ধাক্কা লাগায় ভারসাম্য টলে উঠলেও ভেলার হাল ছাড়েনি ধোয়ী কিন্তু কালন্তি প্রায় উড়ে এসে তার ওপরে পড়াতে হাত থেকে হালটা ছুটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল ভেলার মুখ, স্রোতের তীব্র টানে ওটা কোনাকুনি ছুটে গিয়ে মূল স্রোত থেকে সরে এগিয়ে চলল পাহাড়ি দেয়ালের দিকে। প্রায় কোনোরকম সাবধান হবার সুযোগ না দিয়ে ভেলাটা আছড়ে পড়ল পাহাড়ি দেয়ালে। শক্তিশালী স্রোতের ধাক্কায় প্রায় বোমা বিস্ফোরণের মতো ভেঙে টুকরো-টুকেরো হয়ে গেল ভেলাটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *