অধ্যায় একচল্লিশ – বর্তমান সময়
কিনব্রিজ এলাকা, সিলেট
তানভীরের পরিকল্পনার বারোটা বেজে গেছে। ওর হিসেব অনুযায়ী কানা মাতবর আর তার লোকেরা ফ্যাক্টরি এলাকার ভেতরে ঢোকার কিছুক্ষণের ভেতরেই বেরিয়ে আসার কথা কিন্তু প্রায় চলিশ মিনিট বসে থেকেও কারো কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
‘স্যার, আর কতক্ষণ বসে থাকব?’ ইকবাল একটু অধৈর্য হয়ে বলে উঠল। তানভীর জবাব না দিয়ে ঘড়ি দেখল।
‘আমি বেরুচ্ছি,’ বলে জালাল এক হাতে মাইক্রোর দরজা খুলে ফেলল। ‘কানা মাতবর সম্ভবত আমাদের মাইক্রোকে অনুসরণ করতে দেখেছে। সে যদি অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায় আমরা টেরও পাব না।’
জালালকে বাধা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তানভীর কিন্তু জালালের শেষ কথাটা শুনে থেমে গেল ও। ভুল বলেনি জালাল। কারণ হাজার হলেও এটা ওই লোকগুলোর এলাকা। এখানে আরো লম্বা সময় বসে থাকাটা ওর কাছেও বোকামি মনে হচ্ছে।
‘চলো, বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে। কিন্তু সবাই সাবধান। সুলতান আর জালাল, আপনারা দুজনেই মনে রাখবেন আমাদের উদ্দেশ্য হলো তথ্য বের করা, কাজেই প্রয়োজন না হলে যেকোনো ধরনের গণ্ডগোল আমরা এড়িয়ে যাব। মনে থাকবে?’
দুজনেই মাথা নেড়ে সায় জানাতেই ওরা বেরিয়ে এলো মাইক্রোর বাইরে। তানভীর সবার সামনে, ওকে কভার করে সুলতান, আর তাকে কভার করে জালাল আর ইকবাল। বাউন্ডারির ধার ঘেঁষে সামনের দিকে এগোতে লাগল ওরা। প্রায় গেটের কাছে পৌঁছে গেছে এমন সময় লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া গেল। অসহায়ের মতো এদিক-সেদিক তাকিয়ে ও সবাইকে আড়াল নেয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে লুকিয়ে গেল একটা ঝোপের আড়ালে।
একদমই নিরাপদ নয় জায়গাটা। ও আর সুলতান দুজন লুকানোর জন্যে যথেষ্টও নয়। তার ওপরে ঝোপের অন্যপাশেই বড়ো ড্রেন। একটু অসাবধান হলেই পা হড়কে ড্রেনে পড়ে যাবে। ঝোপের আড়ালে লুকিয়েই ইশারায় শান্ত থাকতে বলল ও সুলতানকে। সেইসঙ্গে দেখে নিল জালাল আর ইকবাল দুজনে দুটো গাছের আড়ালে লুকিয়েছে। এভাবে বোকার মতো মাইক্রো থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে নিজেকে মনে মনে গালি দিল ও। এখন যদি কানা মাতবরেরা গাড়িতে উঠে চলে যায় তবে ওদেরকে হয়তো চোখে পড়বে না, তবে মাইক্রোটা চোখে পড়ে যাবে, আর যদি এখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করে তাহলেও ওরা ধরা পড়ে যাবে।
এতকিছু চিন্তা না করে লোকগুলোর দিকে মনোযোগ দিল তানভীর। পাঁচ- ছয়জনকে দেখা যাচ্ছে সামনে। কানা মাতবরকে দেখা গেল একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। আর তার সামনে দাঁড়ানো জালেম মোস্তফা, আর অন্য লোকটাকে দেখা না গেলেও তানভীর পরিষ্কার শুনতে পেল, ইংরেজিতে কথা বলছে তারা দুজনে। ব্যাপার কি? ইংরেজিতে কথা বলছে কেন। মাথাটা একটু উঠিয়ে সামনে দেখতে যাবে মৃদু বুম বুম শব্দে পকেট চেপে ধরল ও। মোবাইলে কল এসেছে। সাবধানে শরীর সামলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল টমির কল। এখন কথা বলার প্রশ্নই আসে না। কলটা কেটে দিল ও।
‘স্যার লাল পিঁপড়া, কামড়ে একেবারে…’ রাগের সঙ্গে সুলতানের দিকে ফিরে তাকে চুপ করার জন্যে আঙুল তুলতেই তারস্বরে মোবাইল বেজে উঠল সুলতানের। দুজনেই চমকে উঠল। তবে তাদের চেয়ে বেশি চমকে উঠেছে সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো।
তানভীর বুঝল লুকিয়ে থেকে আর লাভ নেই, ঝট করে উঠে দাঁড়াল ও, সেইসঙ্গে হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে। ওকে দেখে কানা মাতবরের মুখ থেকে টুপ করে সিগারেটটা পড়ে গেল মাটিতে, তার পাশে দাঁড়ানো জালেম মোস্তফাও চমকে উঠেছে। তবে ওদের চেয়ে বেশি চমকে উঠেছে তানভীর, কারণ কানা মাতবর আর জালেম মোস্তফার ঠিক সামনেই সাদা চামড়ার বিশালদেহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অন্তত সাদা চামড়ার কাউকে আশা করেনি তানভীর।
ও যেমন চমকে গেছে ওকে দেখে একইরকম চমকে উঠেছে লোকটাও। কিন্তু ও নড়ে ওঠার আগে লোকটাই নড়ে উঠল। তানভীর টান দিয়ে নিজের পিস্তলটা বের করে আনছে লোকটা দুই পা এগিয়ে এসে খপ করে ধরে ফেলল ওর হাত। অন্যহাতে একটা ঘুসি মারল ওকে। দক্ষতার সঙ্গে একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘুসিটা এড়িয়ে গেল তানভীর। লোকটা শরীরের ভারসাম্য একটু হারিয়ে ফেলতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মানুষটার গলা লক্ষ্য করে একটা কারাতে চপ মারল ও। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল খুব সহজেই ওর হাতটা ধরে ফেলল মানুষটা, তারপর অবলীলায় শূন্যে তুলে ফেলল ওকে।
কোনো মানুষের শরীরে এরকম অবিশ্বাস জোর থাকতে পারে বললে হয়তো বিশ্বাস করত না ও। এমনকি নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করেও ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। অসহায়ের মতো হাত-পা নাড়তে নাড়তে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সাদা লোকটাকে গুলি করল সুলতান। গুলির ধাক্কায় ওকে মাটিতে ফেলে দিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল প্রায় সাড়ে ছয় ফুটি মানুষটা। মাটিতে পড়ে মুহূর্তের জন্যে ব্যথার চোটে তানভীরের মনে হলো, ওর মেরুদণ্ড দুই ভাগ হয়ে গেছে। সমস্ত মনের জোর এক করে এক ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। গুলি খেয়েও লোকটার প্রায় কিছুই হয়নি। নিশ্চয়ই বুলেট প্রুফ ভেস্ট বা এরকম কিছু পরে আছে সে। জ্যাকেটের আড়াল থেকে নিজের পিস্তল বের করে আনছে মানুষটা।
অন্যদিকে কানা মাতবরের সঙ্গের লোকেরাও যার যার অস্ত্র বের করে আনছে। পেছন থেকে গুলির শব্দে চমকে উঠল ও। ইকবাল আর জালাল গুলি করতে শুরু করেছে। মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হলো এই ক্রশ ফায়ারের মধ্যে পড়ে মরতে হবে। কিন্তু সেই বিশালদেহী লোকটাকে সুলতানের দিকে অস্ত্র তাক করতে দেখে সোজা সুলতানকে লক্ষ্য করে লাফ দিল ও। তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল ঝোপঝাড়ের ওপরে। সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ল দেয়ালের পাশের শুকনো ড্রেনে।
‘সুলতান, ঠিক আছো?’ সুলতান মাথা নেড়ে সায় জানাতেই তানভীর সোজা হলো। ওপর থেকে সমানে গুলির শব্দ ভেসে আসছে। ও মাথা তুলতেই দেখল সেই লাল গাড়িটা ঘুরতে শুরু করেছে। ‘জালাল,’ চিৎকার করলেও কোনো কাজ হলো না। সমানে গুলি করে চলেছে জালাল। সুলতানকে প্রথমে নালার ভেতর থেকে ঠেলে ওপরে উঠিয়ে দিল ও। তারপর নিজে উঠে এসে সোজা হতেই ওদের সামনে দিয়ে হুঁশ করে বেরিয়ে গেল লাল গাড়িটা। পিস্তল তুলেও নামিয়ে নিল ও। এই অ্যাঙ্গেল থেকে তীব্র বেগে ছুটতে থাকা গাড়িতে গুলি লাগাতে পারবে না। তারচেয়ে সুলতানের দিকে ইশারা করে পিস্তল বাগিয়ে সামনে এগোল ও।
জালাল আর ইকবালও বেরিয়ে এসেছে গাছের আড়াল থেকে। একটু আগে যেখানে কানা মাতবর আর তার লোকেরা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এসে দেখল গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে আছে কানা মাতবর আর তার দুই সঙ্গী। আরেকজন আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। দৌড়ে এগিয়ে আসা ইকবালকে বলল ড্রাইভার রসুল মিয়াকে মাইক্রো নিয়ে আসতে। লাল গাড়িটার পিছু নিতে হবে, সেইসঙ্গে সাবধান করে দিতে বলল অত্র এলাকার ফোর্সদের।
লোকজনের গলার আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখল নীল গেটটা দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারছে শ্রমিক গোছের লোকজন। সুলতানকে বলল ওদেরকে সামলাতে। আর নিজে এসে হাঁটু গেড়ে বসে গেল কানা মাতবরের পাশে।
উলটোপাল্টা গুলি চলার সময়ে অন্তত তিনটে গুলি লেগেছে লোকটার গায়ে। মুখের কশা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। বেশিক্ষণ বাঁচবে না। লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, ‘মাতবর, এরা কারা? কি হচ্ছিল এখানে?’ জানে বৃথা প্রশ্ন কিন্তু তবুও পানিতে ভেসে যাওয়া লোকজনের মতোই খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা তানভীরের। কানা মাতবর ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাত তুলল। তানভীর হাতটা বাড়িয়ে দিতেই সেটা ধরে ফেলল সে।
‘স্যার, ওরা যাবার সময়ে আমাদের মাইক্রোর চাকা পাংচার করে দিয়ে গেছে, পেছন থেকে ইকবাল এসে জানাল। কিন্তু সেটা কানে ঢুকল না ওর। কানা মাতবর কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, লোকটার একেবারে মুখের কছে কান নিয়ে এলো ও। অস্ফুট হলেও পরিষ্কার শুনতে পেল একটা শব্দ, টাই…টাই…টাইটানিক’ কানা মাতবরের মুখ দিয়ে এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে আসতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। ।
‘লোকটা কি টাইটানিক বলল?’ ওর পেছনে এসে দাঁড়ানো জালাল বলে উঠল ‘তাই তো মনে হলো, তানভীর কানা মাতবরের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। রক্তাক্ত হাতে নিজের মুখ মুছে ইকবাল আর জালালের দিকে তাকিয়ে ও চিন্তিত মুখে জানতে চাইল, ‘টাইটানিক আবার কি?’