অধ্যায় একত্রিশ – বর্তমান সময়
লাক্কাতুরা টি-এস্টেট, সিলেট
বাংলোর সামনে বেরিয়ে আসা দোনলা বন্দুক ধরে থাকা লোকটা নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনল।
যেভাবে হিসেবে ভুল করে তানভীর বেশি এগিয়ে গেছিল লোকটার দিকে, ঠিক একইভাবে বন্দুক ধরে থাকা নাক বোঁচা চেহারার লোকটাও আনন্দের অতিশয্যে হিসেবে ভুল করে ফেলল। তানভীরকে বেকায়দা অবস্থায় পেয়ে বন্দুক হাতে অনেক বেশি সামনে চলে এলো সে।
মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে বন্দুকের কালো নলের দিকে যেন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে ছিল তানভীর। গুলি না করে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে ধ্যান ভাঙল ওর। মরিয়া হয়ে হাতের নাগালে চলে আসা মানুষটার বন্দুকের নল চেপে ধরল ও। চেপে ধরেই নলটাকে মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল মাথার অন্যপাশে, সেইসঙ্গে শরীরের নিচের অংশ বাঁকা করে পা-টাকে একটু দৈর্ঘ্যে ছোটো করে ফেলল লাথি মারার জন্যে কিন্তু লোকটা এরই মধ্যে ট্রিগার টিপে দিয়েছে।
পুরনো দিনের দোনলা বন্দুকের গুলির শব্দ যারা শুনেছে তারাই একমাত্র জানে এর শব্দ কতটা বিভৎস হতে পারে। তানভীরের মনে হলো ওর হাতে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, আর কানের কাছে যেন কয়েক লক্ষ কাচের গ্লাস একসঙ্গে ভেঙেছে কেউ, সেইসঙ্গে বন্দুকের নল থেকে বেরুনো ধোঁয়ায় চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে এলো।
সেকেন্ডের জন্যে কিছুই দেখতে-শুনতে-বুঝতে পারল না তানভীর কিন্তু ধোঁয়াটা একটু পাতলা হতেই লোকটাকে ব্যস্ত হাতে বন্দুকের দ্বিতীয় নলটা লোড করার চেষ্টা করতে দেখে নিচের দিকে পা ছুঁড়তেই লোকটার হাঁটুতে লাথি লেগে খানিকটা সরে গেল সে। লোকটা শরীরের ব্যালেন্স ফিরে পেয়ে বন্দুকের নলটা তানভীরের দিকে তাক করতে যাচ্ছিল। তার আগেই একহাতে নলটা ধরে শরীর বাঁকিয়ে মানুষটার পাশে চলে এলো।
মিক্সড মার্শাল আর্টে এই ভঙ্গিতে বলে ব্যাক হিপ থ্রো, তানভীরের ইচ্ছে ছিল লোকটার হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাক হিপ থ্রো করে তাকে উল্টে মাটিতে ফেলে দেবে, কিন্তু মানুষটাকে ছাড়িয়ে দৃষ্টিটা আরেকটু সামনে যেতেই ও দেখল মানুষটার দ্বিতীয় সঙ্গী একটা শটগানের মতো দেখতে অস্ত্র তাক করেছে ওর দিকে। মুহূর্তেই মানুষটাকে একটানে নিজের সামনে নিয়ে এলো। দ্বিতীয় ব্যক্তির গুলিটা কোথায় লাগল বুঝতে পারল না কিন্তু তার আগেই ওর হাতে ধরে থাকা মানুষটার বন্দুকের নলটা সামান্য ঘুরিয়ে গুলি করল ও নিজেই। যাকে গুলি করেছে সে আর ও নিজে দুজনেই ছিটকে পড়ল দুদিকে। যে লোকটাকে গুলি করেছে সে ছিটকে পড়েছে গুলি খেয়ে আর ও নিজে ছিটকে পড়েছে পুরনো বন্দুকের তীব্র রিকয়েলের ধাক্কায়।
মাটিতে গড়ান দিয়ে সোজা হবার আগেই চারপাশে একাধিক গুলিতে মাটি ছিটকে উঠল।
আধ-বসা অবস্থাতেই মাটিতে একটা ডাইভ দিয়ে গড়িয়ে খানিকটা সরে এসে সেই খোঁয়াড়ের মতো দেখতে জায়গাটার আড়ালে চলে এলো ও।
ওটার আড়ালেই এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল লায়লা আর ইকবাল। ওকে দেখে চেঁচিয়ে ইকবাল বলে উঠল, ‘স্যার, কী করব কিছুই তো বুঝতে পারছি না,’ ইকবাল এক হাতে নিজের পিস্তল চেপে ধরে রেখেছে, অন্য হাতে সামলে রেখেছে লায়লাকে। ইকবালের হাতের চাপে একেবারে মাটিতে যেন মিশে আছে লায়লা। ভয়ে বাচ্চা মুরগির মতো কাঁপছে।
আনমনেই একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল ও। সুলতান সেই দোলনার আড়ালে মাথা নিচু করে আছে, ওরা লুকিয়ে আছে খোঁয়ারের মতো দেখতে সেই ছোটো ঘরটার আড়ালে। বাংলো থেকে বেরিয়ে এসেছে একাধিক লোক আর বাংলোর বাইরে থেকে গেটের অন্যপাশে প্রায় তিনজনকে শনাক্ত করতে পারল ও। ওদেরকে ঘিরে ধরেছে বললেও কম বলা হয়। একেবারে কারেন্ট জালে বেড় দিয়ে মাছ ধরার মতো করে আটকে ফেলেছে।
তানভীর সুলতানের দিকে ফিরে ইশারা করল, কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার ওপরে নিজের পিস্তল হারিয়ে হাত-পাবিহীন মানুষের মতো অসহায় লাগছে ওর। সুলতান ওকে আস্বস্ত করে কিছু একটা বলল ইশারায়, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না ও। হঠাৎই সুলতান নিজের জ্যাকেটের পকেট থেকে কিছু একটা বের করে ছুড়ে দিল তানভীরের দিকে।
গোল মতো জিনিসটা উড়ে এসে পড়ল তানভীরের হাতে। খপ করে জিনিসটা ধরেই আবার নিচু হয়ে গেল ও। একেবারে নিখুঁত গোল জিনিসটার ওপরে ছোটো একটা বোতামের মতো আছে। সুলতানের দিকে তাকিয়ে দেখল ওকে বারান্দার দিকে ওটা ছুঁড়ে মারার জন্যে ইশারা করছে সে।
তানভীর সঙ্গে সঙ্গেই বোতামটা চেপে ধরে জিনিসটা ছুঁড়ে দিল বাংলোর বারান্দার দিকে। জিনিসটার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে জানা নেই, তাই ওটা ছুঁড়ে দিয়েই ইকবাল আর লায়লাকে চেপে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়ল ও। প্রথম কয়েক সেকেন্ডে কিছুই হলো না, তারপরেই যেন হাজারখানের বাজ একসঙ্গে ফেটে পড়ল বাংলোর বারান্দায়। সেইসঙ্গে বাংলোর গেটের দিকে। কান চেপে ধরার পরেও তানভীরের মনে হলো কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ও। একটু আগে কানের কাছে বন্দুকের গুলি আর এখন সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে কানের বারোটা বেজেছে ওর। এরই মধ্যে মুখ তুলে সুলতানের দিকে তাকাল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেল সেই দোলনার আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতে দুই জোড়া পিস্তল বের করে এনেছে মেয়েটা। এই প্রথমবারের মতো তানভীর বিরাট আকারের পিস্তল দুটো দেখতে পেল। একেকটার সাইজ বারো ইঞ্চির কম নয়। পিস্তলের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর নজর চলে গেল পিস্তলের পেছনে থাকা মানুষটার দিকে।
ঘটনাটা ও চোখের সামনে না দেখে যদি কোনো বইতে পড়ত কিংবা কেন সান্ধকালীন আড্ডায় শুনত, স্রেফ হেসেই উড়িয়ে দিত। এমনকি কেস স্টাডির ফাইলে পড়লেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো ওর। কিন্তু জলজ্যান্ত ঘটনাটা নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ও।
সুলতান তার জোড়া পিস্তল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে একটা পিস্তল দিয়ে অন্যটার হ্যামার টেনে লোড করে নিল। তার অবস্থান থেকে বাংলোটার দূরত্ব হবে আশি গজের ওপরে, সাধারণত পঞ্চাশ গজের বেশি হলেই পিস্তলের নিশানা ঠিক রাখা এমনকি যেকোনো মার্কসম্যানের জন্যেও কঠিন। তানভীর তাকিয়ে দেখল, সুলতানের ডান হাতের পিস্তলটা আগুন উগড়ে দিতেই বাংলোর একেবারে বারান্দার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের মাথা বিস্ফোরিত হলো ফাটা তরমুজের মতো।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুলতান গুলি করল তার থেকে গজ দশেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজনকে, গুলিটা সরাসরি কাঁধে গিয়ে লাগতেই তার অস্ত্র ধরা হাতটা সোজা হয়ে সমানে গুলি উগড়ে দিতে লাগল মাটির দিকে। নিখুঁত লক্ষ্যে আরেকটা গুলি উড়ে গেল তার দিকে, তানভীর দেখল একাধিক গুলিতে মানুষটার অস্ত্র ধরা হাতটা আলগা হয়ে গেল কনুইয়ের কাছ থেকে।
দুজনকে একসঙ্গে পড়ে যেতে দেখে তৃতীয় আরেকজন লাফিয়ে বারান্দায় উঠে রেলিংয়ের পেছনে বসে পড়ল। এরই মধ্যে সুলতান এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা। ডান হাতটা নিচে নামতেই বাম হাতের পিস্তল তুলে টানা কয়েকটা বুলেট উগড়ে দিল সে বারান্দার দিকে তাক করে, তারও গুলি থামল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রেলিংয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোকটা রেলিং ভেঙে পড়ে গেল মাটিতে। আহত অবস্থাতেই এক হাতে অস্ত্র তুলল সে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার অস্ত্র ধরা হাতের কবজি উড়ে গেল, সেইসঙ্গে মাথার একাংশ হারিয়ে স্থির হয়ে গেল লোকটা।
‘এই বেডি মানুষ না আজরাইল!’ হতভম্ভ ইকবালের গলা দিয়ে আঞ্চলিক ভাষা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
বারান্দার ওদিকটা শান্ত হয়ে যেতেই সুলতান হাসিমুখে ফিরে তাকাল তানভীরদের দিকে, আর সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র গুলির ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপরে। ‘নো,’ প্রায় চিৎকার করে গেটের দিকে ফিরে তাকাল তানভীর। গেটের অন্যপাশে থাকা অস্ত্রধারীদের কয়েকজন ঢুকে পড়েছে গেটের ভেতরে আর বাকিরাও রেলিংয়ের অন্যপাশ থেকে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে গুলি করতে শুরু করেছে। তানভীর চিৎকার করে উঠতেই একজন অস্ত্র তুলল ওদের দিকে। আনমনেই লায়লা আর ইকবালকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে ইকবালের পিস্তলটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল ও নিজের হাতে।
গেটের এপাশে চলে আসা দুই অস্ত্রধারী প্রায় একইসঙ্গে অস্ত্র তাক করেছে ওদের দিকে। তানভীরও ইকবালের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া পিস্তলটা তাদের দিকে তাক করল। দুই পক্ষই একে অপরকে গুলি করার আগেই তানভীর দেখল ওদেরকে বহন করে নিয়ে আসা সেই সাদা মাইক্রোর ধাক্কায় বাংলোর কাঠের গেটটা ভেঙে পড়ল।
গেটটার ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী প্রথমে মাইক্রোর বাম্পারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল তারপর সোজা চলে গেল গাড়ির চাকার নিচে। বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে ড্রাইভার মাইক্রো চালিয়ে দিল লোকটার ওপর দিয়ে। অস্ত্রধারীকে পিষে দিয়ে মাইক্রো স্কিড করে এগিয়ে এলো বেশ খানিকটা। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নেমে এলো পুলিশের পোশাক পরা হালকা-পাতলা একজন মানুষ। বেরিয়েই সে সোজা গুলি করল গেটের ডান দিকে থাকা মানুষটাকে। তানভীরও একবার বাংলোর দিকে চোখ বুলিয়ে দেখল সুলতান এখনো মাটিতে পড়ে আছে কিন্তু ওদিকে কোনো শত্রু নেই। বরং ধুপ-ধাপ গুলি ছুটে আসছে গেট আর কাঠের বেড়ার দিক থেকে।
দৃষ্টি ফিরিয়েই দেখতে পেল মাইক্রো থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটা দুই হাতে দুটো পিস্তল তুলে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে টানা গুলি করছে। কোন দিক থেকে গুলি আসছে, শত্রুরা কয়জন, কোনো পরোয়া নেই তার। টানা দুটো পিস্তলের সিলিন্ডার – খালি করেই মাইক্রোর আড়ালে বসে পড়ল সে, খালি হয়ে যাওয়া পিস্তল দুটো মাটিতে রেখে হাঁপাচ্ছে, তানভীর অনুমান করল লোকটা গুলি ভরবে পিস্তলে কিন্তু তার আগে ঠান্ডা হবার জন্যে মাটিতে রেখেছে ও দুটো। তানভীরকে দেখে ঝট করে ফিরল সে ওর দিকে, এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে একবার মাথা নেড়ে মাটি থেকে পিস্তল তুলে নিয়ে গুলি ভরতে শুরু করল।
তানভীর দেখল লোকটা গুলি ভরছে আর এই সুযোগে তিনজন অস্ত্রধারী কাঠের বেড়া টপকে বাংলোর আঙিনায় প্রবেশ করেছে। মাটিতে বসা অবস্থায়ই হাঁটু গেড়ে বসে ইকবালের পিস্তলটা দিয়ে গুলি করতে শুরু করল ও। একে তো অনভ্যস্ত হাত তার ওপরে অচেনা পিস্তল, নিশানার অবস্থা খুবই খারাপ ওর। কয়েকটা গুলি করতেই ও অবাক হয়ে দেখল একজন পড়ে গেল মাটিতে, নিজের পারফরমেন্সে খুশি হবার আগেই দেখল আসলে ওর গুলি লাগেনি শত্রুর, বরং সেই পুলিশ লোকটা গুলি করেছে। আবারো আনমনেই একবার মাথা নেড়ে আবার পিস্তল তুলল কিন্তু জমে গেল, গুলি থামিয়ে দিল পুলিশ লোকটাও।
আঙিনায় প্রবেশ করা সেই তিনজনের দুজন মাটিতে পড়ে গেছে গুলি খেয়ে কিন্তু তৃতীয় লোকটা নিজের অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখেছে লায়লার মাথার পাশে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে ইকবাল। পুলিশ লোকটা আর তানভীর যখন বাকি দুজনকে নিকেশ করতে ব্যস্ত এই সুযোগে তৃতীয়জন কাঠের বেড়া টপকে চলে এসেছে বেশ ভেতরে, আর কিছুটা ভেতরে আসতেই তার মোলাকাত হয়েছে খোঁয়াড়ের পাশে লুকিয়ে থাকা লায়লা আর নিরস্ত্র ইকবালের সঙ্গে।
‘তানভীর,’ ভয়ের চোটে চিকন সুরে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল লায়লা। কেন জানি এইরকম ভয়ংকর অবস্থাতেও তার নাকি চিৎকার শুনে হাসি পেল তানভীরের। কিন্তু কিছু ভাবার আগেই তাকে ধরে রাখা লোকটা অচেনা এক ভাষায় চিৎকার করে উঠল। অস্ত্র নেড়ে কিছু একটা বলছে সে। তানভীর চেঁচিয়ে উঠে তাকে শান্ত থাকতে বলল।
‘কী কয় এই ছাতাটা?’ বলে ওর পাশ থেকে সেই পুলিশ লোকটা এগিয়ে গেল ওদের দুজনার দিকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্রধারী লোকটা তড় বড়ো করে কিছু একটা বলে উঠে অস্ত্র চেপে ধরল লায়লার মাথার পাশে, চেঁচিয়ে উঠল লায়লা।
‘এই যে মিস্টার সাবধানে, দেখুন—’ তানভীর লোকটাকে সাবধান করার আগেই পুলিশ লোকটা সোজা গুলি করল লায়লাকে ধরে থাকা লোকটাকে। কথা বলতে বলতে সে এগিয়ে গেছিল ওদের দিকে। আর লোকটা হঠাৎ অস্ত্র চেপে ধরাতে লায়লার পেছন থেকে পাশে চলে এসেছিল অনেকটা, এক মুহূর্ত দেরি না করে নিখুঁত নিশানায় তার খুলি উড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ লোকটা।
মুহূর্তখানেক হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দিকে দৌড়ে গেল তানভীর। অস্ত্রধারী মাথার খুলির বেশ অনেকখানি অংশ হারিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। লায়লার দিকে তাকিয়ে তার হা করা মুখের ভেতরে আলাজিহ্বাটা পরিষ্কার দেখতে পেল তানভীর। ইকবালের দিকে ফিরে ওকে সামলানোর জন্যে ইশারা করে সে ফিরে তাকাল পুলিশ লোকটার দিকে।
‘আপনি কে বলুন তো? এভাবে…’
‘ধন্যবাদ পরে দিলেও চলবে,’ তানভীরকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে উঠল। সিগারেটে আগুন দিয়ে মুখের একপাশ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলে উঠল, ‘আপনাদের সবার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে,’ বলে সে সরকারি অফিসের দলিল লেখকদের মতো শুষ্ক একটা হাসি দিয়ে যোগ করল, ‘বাই দ্য ওয়ে, আমি ওসি জালাল, জালাল উদ্দিন। আপনি নিশ্চয়ই এই অপারেশনের কমান্ডার, তানভীর মালিক?’
তানভীর তাকে কিছু না বলে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করার খানিকটা চেষ্টা করে ও দৌড়ে এগিয়ে গেল বাংলোর রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা সুলতানের দিকে। খানিকটা এগিয়েই দেখতে পেল সুলতান উঠে বসেছে। তার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে উঠতে সহায়তা করল তানভীর। ‘তুমি ঠিক আছো?’
‘জি, বস, গুলি লাগেনি, কিন্তু বুলেটপ্রুফ ভেস্টের ওপরে পুরনো দিনের বন্দুকের গুলি এত জোর আঘাত করেছিল জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম,’ বলে সে তানভীরের হাত ধরে উঠে বসল। তার গ্যাবার্ডিন জ্যাকেটের পেটের কাছে বিরাট ফুটো হয়ে তুলো বেরিয়ে পড়েছে। ‘আপনারা কিভাবে…’
‘ওই পুলিশ লোকটা সময়মতো এসে বাঁচিয়ে দিয়েছে,’ বলতে বলতেই তানভীর সুলতানকে এক হাতে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।
‘লোকটা কে, স্যার?’ সুলতান পোশাক ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল।
‘এখনো জানি না,’ বলতেই হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল পাশা স্যার একজনকে পাঠানোর কথা ছিল, এ নিশ্চয়ই সেই লোক। মানুষটা সিগারেট টানতে টানতে এগিয়ে আসছে বাংলোর রাস্তা ধরে। তার নাক-মুখ দেখে মনে হচ্ছে ইটের ভাটার চিমনি। কারণ ঠিক চিমনির মতোই ধোঁয়া উগড়ে দিচ্ছে সে নাক মুখ দিয়ে।
‘আপনাকে কি পাশা স্যার পাঠিয়েছে?’ তানভীর জানতে চাইল।
—জে আজ্ঞে, বস। বুঝতে পারার জন্যে ধন্যবাদ,’ তার কথা বলার ভঙ্গিটাই কেমন জানি বাঁকা। মুখের প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা দিয়ে পকেট থেকে বের করে আরেকটা সিগারেট ধরাল সে। সুপিরিয়রের সামনে এরকম অবলীলায় সিগারেট টানতে এর আগে কাউকে দেখেনি তানভীর।
‘আপনি এখানে এলেন কিভাবে?’ ও জানতে চাইল।
‘গাজীপুর থেকে সিলেট পৌঁছেছি আজ দুপুরে, কদমতলী থেকে আম্বরখানা, ল্যাবে গিয়ে জানতে পারলাম-আপনারা ভার্সিটিতে গেছেন, সেখানে গিয়ে জানলাম আপনারা সুরমা, সুরমা গিয়ে ওই ভদ্র মহিলার,’ বলে সে মাইক্রোর খোলা দরজায় বসে পানি খেতে থাকা লায়লাকে দেখাল। ইকবাল আর ড্রাইভার রসুল মিয়া দুজনে লায়লার সেবায় রত।
‘ওই মহিলার পরিবারের লোকজন জানাল, আপনারা লাক্কাতুরা এসেছেন এখানে এসে বাংলো খুঁজছি মূল রাস্তা থেকে গুলির ঠুস-ঠাস আওয়াজ শুনে এগিয়ে দেখি এখানে তুমুল গোলাগুলি চলছে। দূর থেকে দেখেই বুঝলাম আপনারা বড়োজোড় আর মিনিট পাঁচেক টিকবেন। তাই ড্রাইভারকে নিয়ে সোজা গেট ভেঙে ঢুকে গেলাম, বাকিটা আপনারা জানেন,’ বলে সে আবারো চিমনির মতো ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
তানভীর আর সুলতান দৃষ্টি বিনিময় করল। সুলতান একটা আঙুল তুলে তানভীরকে ইশারা করল, এর মাথায় সমস্যা আছে।
ঠিক আছে শার্লক হোমস, এখন আমাদের বাংলোর ভেতরটা চেক করতে হবে,’ বলে তানভীর পায়ে চলা পথটার ডান দিকে দেখল। ওখানেই হাতাহাতির সময়ে ডেজার্ট ঈগলটা পড়ে গেছিল। আছে ওটা।
‘এক মিনিট,’ বলে ও ঘাসের ওপর থেকে পিস্তলটা নিয়ে ওটা পরিষ্কার করতে করতে ওদের কাছে এসে দেখল, ওসি জালাল কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর হাতে ধরা ডেজার্ট ঈগলের দিকে। ‘বস কি পিস্তলটা ফেলে দিয়েছিলেন নাকি?’ বলে সে মুখ দিয়ে টিটকিরির হাসি আর সিগারেটের ধোঁয়া একসঙ্গে উগড়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘ছোটোবেলায় প্রথম যখন মেয়েরা শাড়ি পরে…’ তানভীরের কড়া দৃষ্টি দেখে সে থেমে গিয়ে দুই হাত তুলল ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে।
সুলতান তোমরা রেডি হও, আমি ইকবাল আর রসুল মিয়াকে নির্দেশনা দিতে হবে,’ বলে তানভীর চলে এলো মাইক্রোর কাছে। লায়লার চেহারায় রং কিছুটা ফিরেছে এখন। ‘তুমি ঠিক আছো?’ বলে সে উত্তরের অপেক্ষা না করে ইকবালকে নির্দেশনা দিল ফোর্সে খবর দিতে, আর লায়লার দিকে খেয়াল রাখতে বলে চলে এলো বাংলোর সামনে। ‘এই বাংলোতে এত পাহারা ছিল যেহেতু কাজেই অবশ্যই এতে কিছু না কিছু আছে।’ নিজের ডেজার্ট ঈগল বাগিয়ে ধরে সুলতান আর ওসি জালালকে অনুসরণ করতে বলে উঠে এলো বাংলোর বারান্দায়।
পুরো বাংলোর সামনেটা জুড়ে লম্বা বারান্দা। তিনটে দরজা দেখা যাচ্ছে। মাঝের দরজাটার সামনে এসে একপাশে সরে মৃদু ঠেলা দিল। ‘ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হয় না,’ ওসি জালাল বলে উঠল। ‘থাকলে এতক্ষণে হয় পালিয়েছে আর না হয় গোলাগুলিতে মরেছে বা আহত হয়েছে।’
তাকে চুপ থাকতে ইশারা করল সুলতান। ‘আমাকে কভার করো,’ বলে তানভীর দরজায় ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাংলোর বাইরেটা দেখতে রিসোর্টের মতো দেখালেও ভেতরেটা একেবারেই অফিসের আদলে সাজানো। ভেতরে এলোমেলো টেবিল চেয়ার আর ছড়ানো কাগজপত্র দেখেই বোঝা যায় ঝড় বয়ে গেছে এখানে। কিন্তু কারো টিকিও নেই। ভেতরে প্রবেশ করে বসার ঘর আর রিসিপশনের মতো দেখতে জায়গাটা পার হয়ে ওরা চলে এলো ভেতরে।
ডায়নিং রুমের অবস্থা ভয়াবহ। শুধু খাবার টেবিলের সেটটা বাদে আর কিছুই ঠিক নেই। কিচেনে এসে দেখল পেছনের দিকের একটা দরজা খোলা। তানভীর উঁকি দিয়ে দেখল, ওটা দিয়ে বাংলোর পেছনে নামা যায়, আর পথটা টিলা বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে।
মনে হয় কেউ একজন ভেতরে ছিল, সে বাকিদের অবস্থা খারাপ বুঝে এদিক দিয়ে পালিয়েছে,’ ওর পেছন থেকে ওসি জালাল বলে উঠল। হঠাৎ অন্য রুম থেকে সুলতানের চিৎকার শুনে দুজনেই দৌড়ে সেদিকে এগোল। ডায়নিংয়ের ঠিক লাগোয়া পাশাপাশি দুটো রুম। ওরা অনুমান করল, সম্ভবত শোবার ঘর। একটা রুমের দরজা হাট করে খোলা। অন্যটা বন্ধ।
‘এটার ভেতরে কেউ আছে,’ সুলতান পিস্তল ধরে বলে উঠল। ।
তানভীর এগিয়ে গিয়ে সাবধানে রুমটার দরজার নব ধরে মোচড় দিল। ‘লক, ‘ ওদের দুজনার দিকে ফিরে বলে উঠল।
‘দেখি,’ বলে ওসি জালাল পিস্তল তাক করতে যাচ্ছিল দরজার তালার দিকে, তাকে হাতের ইশারায় মানা করল তানভীর। ‘ভেতরে কেউ থাকলে ক্ষতি হতে পারে,’ বলে সে নিজের পিস্তল হোলস্টারে রেখে দুই পা পিছিয়ে গেল।
‘বস, তালাটা কিন্তু শক্ত আছে, আর দরজাও মোটা,’ সুলতান সাবধান করল।
তানভীর তাকিয়ে আছে ওসি জালালের দিকে। ছোটো বাচ্চারা যখন বড়োদের সামনে শক্তি প্রদর্শন করতে যায় বড়োরা তাদের দিকে যেভাবে তাকায় অনেকটা সেরকম ভঙ্গিতে তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে ওসি জালাল।
জালালকে দেখতে ইশারা করে দুই পা এগিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লকটা থেকে এক ফুট ডানে লাথি মারল তানভীর। আবার, আবার, ফাইটার ব্র্যান্ডের বুটের চতুর্থ লাথিতে লকের অংশটুকু মূল দরজা থেকে ভেঙে আলগা হয়ে গেল। একহাতে পিস্তল বের করে অন্য হাতে কাঠের টুকরোর সঙ্গে সামান্য আটকে থাকা দরজাটা এক ধাক্কায় মেলে ধরে ওসি জালালের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢোকার ইশারা করল ও।
এই রুমটাও অন্যগুলোর থেকে ব্যতিক্রম নয়। তবে এতে একটা কাপড় রাখার কাঠের আলমিরা আছে, একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা বড়ো খাট আছে। রুমের অন্যান্য দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাটের ওপরে দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠল ওরা। সেখানে একজন মানুষ শুয়ে আছে।
জালাল আর সুলতান এরই মধ্যেই খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তানভীর, এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল খাটের পাশে। খাটে শুয়ে থাকা মানুষটার পরনে বহু পকেটওয়ালা একটা কমব্যাট ধরনের প্যান্ট, সাদা টি-শার্টটা ময়লা হয়ে হলদে হয়ে গেছে। অন্যদিকে মুখ দিয়ে শুয়ে থাকা মানুষটাকে এক হাতে ধরে এদিকে ফেরাতেই চমকে উঠল তানভীর আর সুলতান।
জালাল তাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু ওরা পেরেছে। মাথায় এলোমেলো চুল আর মুখে কয়েকদিনের না-কাটা দাড়ি থাকা সত্ত্বেও বহু ছবিতে দেখা ডক্টর মিতায়নকে চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই।
মানুষটাকে সোজা করে শুইয়ে তার পালস চেক করল তানভীর। ক্ষীণ, তবে অবশ্যই বেঁচে আছে। তাকে একহাতে ধরে মৃদু ঝাঁকি দিল তানভীর। ‘ডক্টর, ডক্টর মিতায়ন,’ সুলতানের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘জলদি, ইকবালকে বলো অ্যাম্বুলেন্স খবর দিতে, আর লায়লাকে নিয়ে এসো এখানে,’ বলেই ও ফিরে তাকাল ডক্টর মিতায়নের দিকে। আবারো মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলে উঠল, ‘ডক্টর, ডক্টর।’
ওর ঝাঁকির সঙ্গে সঙ্গে যেন সামান্য নড়ে উঠল ডক্টর। বিড় বিড় করে কিছু বলতে লাগল সে। ‘ডক্টর কিছু বলছেন?’ বলে তানভীর ওর কান দিয়ে এলো ডক্টরের একবারে মুখের কাছে। ডক্টর মিতায়নের বিড় বিড় করে বলা কথাগুলো এবার একেবারে পরিষ্কার ধরা পড়ল ওর কানে।
বিড় বিড় করে হলেও মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে ডক্টর বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক… ব্ল্যাক বুদ্ধা।’