অধ্যায় ত্রিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
মন্তলার হাট, কন্নোর, ভারতবর্ষ
শামান ঠান্ডা মাথায় সব হিসেব করে রেখেছে, কাজেই ওর বিশ্বাস গরমিল হবার কোনো কারণ নেই।
তবে মুখের ওপরের মোটা কাপড়ের আবরণটার কারণে বারবার হাঁচি আসছে। ওটা একটু টেনে আলগা করে দেয়ার চেষ্টা করতেই যেন আরো বেশি চেপে বসল মুখের ওপরে। মাথার চুলগুলো টাইট করে পাতলা কাপড় দিয়ে বাঁধা, তার ওপরে আবার চড়িয়েছে একটা মস্তকাবরণ, সেটার নিচে মুখোশের মতো এই জিনিসটা। সব মিলিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর, মুখের ওপর থেকে টান দিয়ে মুখাবরণটা খুলে বড়ো বড়ো করে দম নিতে লাগল ও।
মুখোশের মতো জিনিসটার কারণে অসহ্য লাগছিল। ওটা খোলাতে একটু স্বস্তি লাগছে, তবে ওটা খুলে ফেললেও মাথার ওপরে ঘোমটার মতো মস্তকাবরণটা আরেকটু টেনে দিল ও। আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ খেয়াল করছে কি না ওদেরকে।
শামান আর কালন্তি এই মুহূর্তে অবস্থান করছে মন্তলার হাট নামের সেই জায়গাতে যেখানে আজ বৌদ্ধ শ্রমণদের মস্তক ছিন্ন করা হবে। গতকালের আগের দিন এই ঘটনার ব্যাপারে জানতে পারার পর থেকেই বহু কষ্টে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে অবশেষে ঘণ্টাখানেক আগে এই বাজারে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়েছে ওরা। শামান চোখ তুলে পুরো বাজারটার যে অংশে ওরা আছে সেদিকে চোখ বুলিয়ে নিল একবার।
বাজারটা বেশ চমৎকার একটা জায়গাতে অবস্থিত। দুদিকে ঘন জঙ্গল, একদিকে খোলা সমতল ভূমি, আর অন্যদিকে বড়ো একটা পাহাড়ি টিলার পাদদেশে খোলা মাঠের মতো জায়গাটায় ছোটো একটা গ্রামের মতো বসতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বাজারটা, একপাশ দিয়ে ছোটো একটা শাখা নদী বয়ে যাওয়াতে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়েছে ব্যবসায়ীদের জন্যে। বাজারের নিয়মিত বিক্রেতারা সবাই বাজারসংলগ্ন এই গ্রামেই বাস করে, আবার বৃহত্তর এলাকা তো বটেই বিভিন্ন মৌসুমে বহু দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন আসে এখানে বিক্রি-বাট্টা ও কেনাকাটা করার জন্যে। স্থানীয় লোকজনের জন্যে এই বাজার তাদের পণ্যসামগ্রী বিক্রি আর খরিদ করার জন্যে সবচেয়ে ভালো জায়গা।
শামান ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল পুরো বাজার এলাকা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মোড়কে মোড়ানো হয়েছে। ওই বুড়োর সঙ্গে দেখা অতো অতো কঠের গুঁড়ির রহস্যটাও পরিষ্কার হয়েছে এখানে আসার পর।
পুরো বাজার এলাকাকেই ছোটো ছোটো কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ঘিরে বেড়া দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে বাজারের একপাশে খোলা মাঠে যেখানে শ্রমণদের মস্তক ছিন্ন করার আয়োজন করা হয়েছে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষ বেদি। বাজার এলাকা থেকে শুরু করে সেই মাঠের মতো জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে লিচ্ছবী রাজার বিশেষ বাহিনী।
গতকালের আগের দিন ওরা বিষয়টা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। প্রথমেই লোক লাগিয়ে খবর নিয়ে জানা যায়, দুইদিন ধরে বাজার এলাকায় সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাজার লোকদের ঘের দেয়া আর বেদি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সকলের প্রবেশ নিষেধ। তাই আগেভাগে বাজারে প্রবেশ করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখার ধারণাটা বাতিল করতে হয়। পরে ওরা জানতে পারে নির্দিষ্ট দিনেও বাজার এলাকায় লোকজনকে একেবারে নিখুঁতভাবে পরীক্ষা না করে প্রবেশ করানো হবে না, সেইসঙ্গে সকল ধরনের অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরে ওদের পরিকল্পনা আবারো পরিবর্তন করতে হয়।
শামানের পরিকল্পনা খুব সহজ, একটু আগে চারটা দলে ভাগ হয়ে ওরা ষোলজন প্রবেশ করেছে বাজার এলাকায়। কেউ ফল বিক্রেতা, কেউ ঝালাইকার, কেউ চর্মকার সেজে। এই চার দলকে চার রকম দায়িত্ব দিয়ে বাজার এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যে-যার যার কাজ ঠিকমতো সম্পন্ন করতে পারলেই ওরা প্রস্তুতি নিয়ে গ্যাট হয়ে অবস্থান নেবে যার-যার জায়গায়। এরপরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে, কারণ কোথায় কী করতে হবে সেটা আগে থেকে যেহেতু জানার উপায় নেই কাজেই আগে থেকে পরিকল্পনা করেও লাভ নেই। বরং এখানে আসার পর থেকে এক গাড়ি ফল নিয়ে বিক্রি করতে করতে মনে-মনে নিজের পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিচ্ছে শামান।
সামনের গাড়িতে রাখা বেগুনি রঙের একটা ফল হাতে তুলে নিয়ে ওটাতে কামড় বসাল ও। নিজের অজান্তেই ফলের তেতো স্বাদে মুখ বিকৃত হয়ে গেল। কচ্চ নামের অদ্ভুত দেখতে এই স্থানীয় ফল এর আগে কোনোদিন দেখেনি শামান। খাওয়া তো দূরে থাক।
‘তুমি তো খুব বাজে বিক্রেতা হে,’ বলে ওর পাশে থেকে মৃদু টিটকিরির হাসি হাসল কালন্তি। ‘নিজের বিক্রির জিনিস নিজেই খেতে শুরু করেছো।’ কৃত্রিম রাগের সঙ্গে তার দিকে ফিরে তাকাল শামান। আগাগোড়া ছেলেদের পোশাক পরা কালন্তিকে দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই সে মেয়ে। ‘এই এলাকার মানুষজনের মতো দেখি এখানকার ফলও একই রকম বাজে। এরকম তিতকুটে ফল আমি জীবনেও খাইনি।’
‘শোন যোদ্ধা, একটু অপেক্ষা করো, দেখবে মুখের ভেতরে মিষ্টি একটা স্বাদের আভাস টের পাচ্ছো, বলে কালন্তি একেবারে শামানের কাছাকাছি এসে নিজের ধূসর দৃষ্টি স্থির করল শামানের চোখে। তারপর রহস্যে মোড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কন্নোর এলাকার মানুষ বলো আর ফল, এর প্রকৃত রস আস্বাদন করতে হলে তোমাকে ধৈর্য সহকারে এর গভীরে যেতে হবে। ধৈর্য হারালেই সর্বনাশ, কোনো স্বাদই টের পাবে না।
কালন্তির দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে আনমনেই একবার ঢোক গিলল শামান। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সকালের সূর্য জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে ধীরে-ধীরে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। ওদের জানামতে সূর্য মাথার ওপরে উঠলেই বৌদ্ধ শ্রমণদের মস্তক ছিন্ন করা হবে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে শামান প্রশ্ন করে উঠল কালন্তিকে, ‘তোমার কি মনে হয়, বিধু-ঘোষিত- জাথুরিয়া নিজেদের কাজ ঠিক সময়মতো করতে পারবে?
‘ওদেরকে পারতেই হবে। তা-না হলে সর্বনাশ, বলে কালন্তি ওর মুখের আবরণটা টেনে দিল। মুখের আবরণ সরানোটা কি ঠিক হয়েছে তোমার? একে তো তালগাছের মতো লম্বা তুমি, পুরো বাজারে সবার মাথা থেকে এক হাত ওপরে তোমার মাথা। তার ওপরে নীল চোখ, লোকে ভালোভাবে দেখলেই বুঝে ফেলবে তুমি এই এলাকার কেউ নও।
মুখের আবরণটা আবারো টেনে দিতে-দিতে শামান বলে উঠল, ‘ওটার ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।’
‘শোন, কখনো কখনো নিশ্বাস নিতে পারার চেয়ে নিশ্বাসকে স্রেফ প্রবাহিত হতে দেয়াটাই সমীচীন—’ সে আরো কিছু বলতে যচ্ছিল তার আগেই জঙ্গলের দিক থেকে অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের শব্দ আর গাড়ি টেনে আনার শব্দ শোনা গেল সেইসঙ্গে ঢোলের ভারি আওয়াজ।
‘লিচ্ছবী রাজার লোকেরা চলে এসেছে,’ আনমনেই বলে উঠল কালন্তি। ‘এখন বাকিদের ওপরে নির্ভর করছে সবকিছু।’
***
বিধু আর ধোয়ী অবশ্য শামানদের মতো এত চিন্তিত নয়। বরং তারা বেশ স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে রাস্তা ধরে হাঁটছে। ধোয়ীকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে কোনো ভয়ংকর উদ্দেশ্য নিয়ে শত্রু এলাকায় প্রবেশ করেছে বরং সে তার গোল মুখে একেবারেই নিরাসক্ত ভঙ্গি নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।
আর এ-ব্যাপারটাই বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে বিধুকে। ঠিক যন্ত্রণা দিচ্ছে বললে ভুল হবে, তার বিরক্ত লাগছে। বারবার আড়চোখে দেখছে সে ধোয়ীকে। এরকম অদ্ভুত চেহারার মানুষ সে জীবনেও দেখেনি। মানুষটা তার চেয়ে বেশ অনেকখানি লম্বা, মুখটা একেবারে গোল, বাচ্চাদের মতো টুপটুপে গাল। তবে তার শরীরটা যেকোনো কুস্তিগীরের চেয়েও বেশি পেশিবহুল আর শক্তিশালী। মনে মনে একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে দলের বাকিদের দিকে দেখল।
দলে ওরা মোট চারজন, সে নিজে, ধোয়ী আর দুজন। ওরা থারু না শাক্য জানে না কিন্তু দুজনেই দক্ষ যোদ্ধা, থারু রাজা মানরু আর শাক্যপ্রধান শংকরাদিত্য নিজের সেরা যোদ্ধাদেরকেই পাঠিয়েছে ওদের সঙ্গে। কারণ এই বৌদ্ধ শ্রমণদের মৃত্যু তো ঠেকাতেই হবে সেইসঙ্গে তাদেরকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। তাহলেই একমাত্র বিক্রমাদিত্য আর ডুকপা লামার খোঁজ বের করা সম্ভব হবে। এখানে আসার ব্যাপারে বিধু চেয়েছিল ঘোষিতের সঙ্গে থাকতে আর না হয় শামানের দলে থাকতে, কিন্তু শামানই দলগুলো অন্যভাবে সাজিয়েছে। কারণ ঘোষিতের সঙ্গে বিধুকে একই দলে দিলে ওরা দুজনে গল্প করতে এত ব্যস্ত হয়ে যেত কাজের বারোটা বাজত। আর নিজের সঙ্গে ও নেয়নি কারণ অন্য দলগুলোতে কর্মতৎপরতা বজায় রাখার জন্যে শামান নিজের লোক রাখতে চেয়েছিল। সবমিলিয়ে অবশেষে বিধুর স্থান হয়েছে ধোয়ীর সঙ্গে।
কাল থেকে চেষ্টা করার পর অবশেষে আধ ঘণ্টা আগে ওরা বাজারে প্রবেশকারীদের সঙ্গে চর্মকারের ছদ্মবেশে ঢুকতে পেরেছে। ওদের সঙ্গে বহন করা শুকনো চামড়ার বোঝা বাকি দুজনের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বিধু আর ধোয়ী আগে- আগে হাঁটছে। নিজের কাছে নিজেকে কেমন জানি ন্যাংটো মনে হচ্ছে বিধুর। এর কারণ হলো ওর সঙ্গে কোনো অস্ত্র নেই। শেষবার কবে অস্ত্র ছাড়া কোথাও গেছে মনেই নেই বিধুর। দীর্ঘদিনের যোদ্ধা জীবনে অস্ত্র সঙ্গে রাখতে রাখতে এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, অস্ত্র যেন শরীরের একটা অঙ্গ হয়ে গেছে। শরীরের সঙ্গে একটা হাত না থাকলে যেরকম লাগবে ওর কাছে এই মুহূর্তে সেরকমই লাগছে। তবে সে অবাক হয়ে বেশ কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করল ওর সঙ্গের এই ধোয়ী লোকটার অবস্থাও অনেকটা সেরকম, কারণ সেও একটু পর-পর আনমনেই পিঠের দিকে হাত বুলাচ্ছে। ওখানেই তার বর্শাটা রাখে সে। এই লোক নাকি এই অঞ্চলের সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণা আর তলোয়ার যোদ্ধা।
‘সামনে গিয়ে আমরা ডাইনে বাঁক নেব। ওখান থেকে খানিকটা সোজা এগিয়ে পথের শেষ মাথায় মদারু অস্ত্রকারের বাড়ি, বিধুর কাছাকাছি এসে আস্তে-আস্তে বলে উঠল ধোয়ী। মানুষটার কণ্ঠস্বরও তার শরীরের সঙ্গে একেবারেই যায় না, কেমন জানি মেয়েলি কণ্ঠস্বর। এইরকম মুশকো জোয়ানের গলা থেকে এরকম মেয়েলি গলা বেরুচ্ছে সামনাসামনি না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।
‘ঠিক আছে,’ বলে বিধু একবার চারপাশে দেখে নিল। ওরা বাজার এলাকায় প্রবেশ করার পর কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করেছে এরপর সোজা রওনা দিয়েছে কাজের উদ্দেশ্যে। বাজার এলাকায় প্রবেশ করা চার দলের ভেতরে ওদের কাজটার গুরুত্ব অপরিসীম। ওদের ওপরে দায়িত্ব পড়েছে বাজার এলাকা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার। যেহেতু বাজার এলাকায় কোনোভাবেই অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয় তাই ঘোষিতরাম ওদেরকে একটা ভালো বুদ্ধি দেয়। বাজার এলাকায় থারুদের সহমর্মী একজন অস্ত্রকার আছে। অত্র এলাকার সবচেয়ে নামকরা অস্ত্র নির্মাতা সে। ধোয়ীর সঙ্গে তার বেশ ভালো সম্পর্ক। তাই ঘোষিতের পরামর্শ অনুযায়ী ওদের দলটা বাজারে প্রবেশ করে অস্ত্রকারের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে মস্তক কর্তনের বেদির কাছে দুটো দলের কাছে পৌঁছে দিবে। যাতে সময়মতো তারা সেটা ঠেকাতে পারে।
হাঁটতে হাঁটতে ধোয়ীর নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলল ওরা। সামনের বাঁকটা পার হয়ে চলে এলো মূল গলিতে, যেটার শেষ মাথায় চর্মকারের বাড়ি। পথের শেষ মাথায় ছোটো একটা ডোবার মতো দেখা যাচ্ছে, সেটার সঙ্গে লাগোয়া বাঁশের তল্লির বেড়া দেয়া একটা ঝুপড়িঘর। ‘ওই তো, ওটাই মদারুর বাড়ি।’
শুনে বিধু মনে মনে খুশি হয়ে উঠল। কারণ মনে হচ্ছে তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই মদারুর কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে গেল তার। বাড়িটার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় তল্লীর বেড়ার মুখে লাগল ছোটো দরজা ফাঁক করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দুজন সুসজ্জিত সৈনিক। দেখার সঙ্গে-সঙ্গে বিধু বুঝতে পারল এরা লিচ্ছবীদের লোক। সৈন্য দুজন বেরিয়ে এসে নিজেদের ভেতরে কথা বলতে শুরু করল।
আর ফেঁসে গেল ওরা। রাস্তায় আর কোনো লোক নেই যে ভিড়ের সুযোগে মিশে যাবে, আবার থেমে গেলেও সন্দেহ করবে ওরা। আর এগিয়েও লাভ নেই, কারণ পথের শেষে মদারুর বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িও নেই।
দলে সবার সামনে ছিল ধোয়ী, সৈন্যদেরকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গে গতি কমিয়ে ফেলেছিল সে। ধীরে-ধীরে একেবারেই থেমে গেল, আরেকটু হলে বিধু তার গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেত, কোনোমতে সামলে নিয়ে ধোয়ীর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল সে। ধোয়ীও অসহায়ভবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। দুজনার কেউই বুঝতে পারছে না ওরা কী করবে।
***
ওদিকে বাজারে আসা তৃতীয় দলটা পড়েছে আরেক বিপদে। এই দলের নেতৃত্বে আছে ঘোষিতরাম আর জাথুরিয়া।
মুখে-মুখে যতই বলা হোক না কেন থারু আর শাক্যরা বন্ধু হয়ে গেছে, বাস্তব চিত্রটা অত সহজ নয়। কারণ জন্মের পর থেকে একে অপরকে শত্রু জেনে আসা দুটো জাতি যারা পূর্বপুরুষের সময় থেকে একে-অপরের হাতে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত আর নিগৃহীত হয়েছে তাদেরকে যত যুক্তি-তর্ক আর ভালোবাসার কথাই বলা হোক না কেন, মনের ভেতর থেকে তাদের একত্রিত হওয়া এতটা সহজ নয়।
ঠিক এই ব্যাপারটাই এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে ঘোষিত আর জাথুরিয়ার ভেতরে। আজ থেকে বিশ বছর আগে থারু আর শাক্যদের ভেতরকার যুদ্ধের সময়ে ঘোষিত তখন দশ-বারো বছরের বালক, সেই যুদ্ধে শাক্যদের হাতে তার বাবা নিহত হয়েছিল। থারুদের একটা দল যারা শাক্যদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির ব্যাপারে কথা বলতে গেছিল তাদের সবাইকে গলা কেটে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছিল শাক্যরা। সেই দলের নেতৃস্থানে ছিল ঘোষিতের বাবা। জঙ্গলের প্রান্তে গাছের সঙ্গে ঝুলানো লাশ মৃত্যুর তিন দিন পর যখন তাদের বাড়িতে আনা হয় কাক-শকুনে খেয়ে সেই লাশের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। যতবার শাক্যদের ওপরে দৃষ্টি পড়ে ঘোষিতের, নিজের বাবার ঠুকরে খাওয়া অর্ধগলিত লাশটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শুধু একটা কারণেই সে ওদেরকে মেনে নিয়েছে সেটা হলো থারু রাজা মানরু।
ঘোষিতের বাপ ছিল রাজা মানরুর একনিষ্ঠদের একজন। তার বাপের মৃত্যুর পর ঘোষিতের পরিবারকে একরকম রাজা মানরু নিজের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালনা করেছেন, যতদিন না ঘোষিত নিজে পরিবারের হাল ধরতে পেরেছে। রাজা মানরু ঘোষিতের জন্যে শুধু রাজা নয়, তার কাছে নিজের খোদার চেয়েও বড়ো। সেই মানরু যখন বলল লাল চুলের যোদ্ধার বিশেষ বাহিনীতে তাকে কাজ করতে হবে, এক বাক্যে রাজি হয়ে গেছে সে। ছোটোবেলা থেকে কঠোর সংগ্রাম করে বড়ো হতে-হতে সে একটা ব্যাপার শিখেছে, নিজের মন যেভাবে বলে দুনিয়া সেভাবে চলে না। তাই রাজা মানরুর মতো মনের গভীরে সেও চায় শত্রুরা যত বড়ো হোক তাদের উপকার করতে পারলে এই উপত্যকায় শান্তি ফিরে আসতে পারে।
সেই হিসেবে আজকের অভিযানটা ওদের জন্যে সবদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। চারটে দলের তৃতীয় ভাগে তাদের দলের কাজও অনেকটা বিধু আর ধোয়ীদের মতোই। তাদের ওপরও দায়িত্ব পড়েছে মূল দলের জন্যে বাজার এলাকার ভেতর থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার। তবে বিধুদের মতো কোনো অস্ত্রকারের কাছ থেকে নয় বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পদ্ধতিতে। এই ধারণাটা ছিল শাক্য যোদ্ধা জাথুরিয়ার।
ওরা যখন জানতে পারে বাজার এলাকায় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না তখন এই এলাকায় জন্ম থেকে বিচরণ করা জাথুরিয়া বাজারের ভেতরে প্রবেশের পর ভেতর থেকে কিভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করা যেতে পারে সে-ব্যাপারে বেশ ভালো একটা পরামর্শ দেয়।
জাথুরিয়ার পরামর্শটা অনেকটা এরকম; মন্তলার হাট এলাকাসংলগ্ন একটা নদী আছে। নদীটা সরাসরি হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলেও এর একটা শাখা বাজারের গ্রাম এলাকার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে, সেটা আবার হাট এলাকার বেশ কাছাকাছি। নদীর মূল উৎস থেকে যদি ভেলার মতো বানিয়ে তাতে কিছু অস্ত্র চাপিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তবে সেটা হাট এলাকার কাছাকাছি চলে এলে ওরা হাটের ভেতর থেকে সেগুলো সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এতে ঝুঁকি আছে।
কারণ ছোটো ভেলার মতো বানিয়ে সেটা ছাড়লেও ছাড়তে হবে একেবারে সঠিক জায়গা থেকে—যেখান থেকে স্রোত বাজার এলাকার নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়, তাও সেটা করতে হবে সঠিক জোয়ারের সময়ে যাতে জিনিসটা ঠিকমতো আসতে পারে। তার ওপরে আবার যদি একটা দুটো ভেলাতে অস্ত্র চাপিয়ে পাঠানোও হয় সেগুলো যে কারো চোখে পড়ে যাবে না সেটাও একটা ব্যাপার। তবে যাই হোক, বহু বছর এ এলাকায় নৌকা চালায় এরকম একজন মাঝিকে নিয়ে গতকাল ভোরে ছোটো ভেলার মতো বানিয়ে তাতে অস্ত্র চাপিয়ে সেগুলোর ওপরে ঝোপ-ঝাপ আগাছা দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখন বাকিটা ওদেরকে করতে হবে।
‘আর কতদূরে জায়গাটা?’ জাথুরিয়ার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় জানতে চাইল ঘোষিত। পিঠের ওপরে ঝালাইয়ের জিনিসপত্র ভারী লাগছে ওর। ওরা বাজারে প্রবেশ করেছে ঝালাইকার হিসেবে। দলে আছে মোট চারজন।
জাথুরিয়াও একইরকম কড়া দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকাল তার দিকে। ‘সময় হলেই জানতে পারবে।’
জাথুরিয়ার কথা শুনে ঘোষিত রেগে আগুন হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ওরা বাজার এলাকার শেষ প্রান্তে পৌঁছে পানির কুল-কুল শব্দ শুনতে পেল। মনে হয় চলে এসেছি,’ জাথুরিয়া ঘোষিতের দিকে তাকিয়ে টিটকিরির হাসি দিন।
ঘোষিত মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করল; সময় হলে এই ব্যাটার দাঁতগুলো একটা- একটা করে তুলে নেবে। ওরা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে শেষপ্রান্তে চলে এলো। বাজারের যাবতীয় আবর্জনার স্তূপ এখানে। নদীর শাখা অংশটা পাশ দিয়ে চলে গেছে কিন্তু ময়লা-আবর্জনা আর গাছপালার কারণে পানির প্রবাহ আটকে আছে এখানে। ওরা জায়গামতো পৌছে ময়লার স্তূপের ওপরে উঠে এলো। এত-এত হাবিজাবি জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে ডাঙ্গায় আর পানিতে যে সেদিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে উঠল ঘোষিত, ‘এই ব্যাটা, শাক্যুরিয়া,’ জাথুরিয়ার নামটা ইচ্ছে করেই বিকৃত করে বলল সে। ‘এখানে আসল জিনিস খুঁজে পাব কিভাবে?
জাথুরিয়াও চিন্তিত মুখে এদিক-সেদিক দেখছে। সে পরিস্থিতি দেখে এতটাই বিহ্বল হয়ে গেছে যে ঘোষিতের কটু কথাও কানে গেল না তার। ‘কোনো উপায় নেই, সবাই ছড়িয়ে পড়ে খোঁজ লাগাতে হবে,’ বলেই সে মাথার ওপরে তাপ ছড়াতে থাকা সূর্যটার দিকে ফিরে তাকাল। শত্রুর মতো দ্রুত গতিতে ওটা মাথার ওপরের দিকে রওনা দিয়েছে। সময় এখন সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
***
মাথার ওপরের সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকাল আরেকজন মানুষ। শামান। অস্থির হয়ে একবার ও বাজারের প্রবেশ পথের দিকে ফিরে তাকাল। সেদিক দিয়ে প্রবেশ করছে লিচ্ছবী আর উরগদের যৌথ বাহিনী। এখনো ওরা পুরোপুরি দৃষ্টিসীমার ভেতরে প্রবেশ করেনি কিন্তু শামান দূর থেকে দেখে যা বুঝতে পারছে কমপক্ষে তিন-চারটে ঘোড়ার গাড়ি, ত্রিশ-চল্লিশটা ঘোড়া আর বেশ কিছু পদাতিক সৈন্যও আছে। কিন্তু উরগদের কাউকে চোখে পড়ল না।
‘ব্যাপার কি, উরগদের কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না,’ ওর পাশ থেকে কালন্তি বলে উঠল ।
‘উরগ হোক আর মোরগ হোক, সবই আমাদের জন্যে সমান,’ শামান ভেতরে- ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে, যে-অস্থিরতাকে ও যুদ্ধের ময়দানে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। আর এটাও ওর জন্যে এই মুহূর্তে যুদ্ধের ময়দানই বটে।
শামান আড়চোখে সবজি আর মাছ বিক্রি করতে থাকা ওর অন্য দলটাকে একবার দেখে নিল। ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে সবাই প্রস্তুত আছে ওর নির্দেশের অপেক্ষায়। কিন্তু প্রস্তুত থেকে লাভ কি যদি সময়মতো অস্ত্রই হাতে এসে না পৌছায়।
‘যোদ্ধা, অস্থির হয়ো না,’ কালন্তি বলে উঠল। ‘আমার বিশ্বাস তুমি কোনো না কোনো উপায় বের করবেই। বিশ্বাস করো নদীর পাড়ে যেভাবে তুমি তিনটে উরগের মোকাবেলা করেছো, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ছিল।’
‘আমি ভাগ্যবান ছিলাম,’ বলে ও কালন্তির দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আর তুমি এই ‘যোদ্ধা যোদ্ধা’ বলা বন্ধ করবে, শামান ডাকতে পারো না?’ বলেই ও সামনে ফিরে তাকাল। শত্রু বাহিনী এখন বাজারের প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে বেদির কাছের ফাঁকা জায়গাটাতে এসে জড়ো হয়েছে। শামান মনোযোগ দিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে ওদের সংখ্যা, যোদ্বাদের অস্ত্র-সস্ত্র আর ওদের সৈন্যদের দক্ষতা।
ওরা বেদির কাছে গিয়ে থামতেই আশ্বারোহীরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলল। আর তিনটে ঘোড়ার গাড়ি থেমে গেল ঠিক বেদির সামনে। গাড়িগুলো থামতেই ধাম করে খুলে গেল একটা গাড়ির দরজা, সেটার ভেতর থেকে টেনে নামানো হলো ন্যাড়া মাথা তিনজন মানুষকে।
সঙ্গে সঙ্গে শামানের বুকের ভেতরটা ধক ধক করে উঠল ডুকপা লামার কথা চিন্তা করে। বাজারের বেশির ভাগ মানুষ ধীরে ধীরে বেদির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেই বেদির সামনে জমে ওঠা ভিড়ের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে।
শামানরা যেখানে আছে সেটা বেদি থেকে একটু দূরে হলেও ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যেখানে গাড়িগুলো থেকে টেনে নামানো হেেছ বৌদ্ধ শ্রমণদের। তিনজনের ভেতরে হন্যে হয়ে খুঁজেও ডুকপা লামাকে দেখতে পেল না ও। একই সঙ্গে স্বস্তি আর অস্বস্তি দুটোই আচ্ছন্ন করে ফেলল ওকে। এদের ভেতরে ডুকপা লামা নেই, তারমানে কি তাকে এরই মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে?
ছাগলদের টেনে যেভাবে খোঁয়ারে ওঠানো হয় অনেকটা সেই ভাঙ্গিতে শ্রমণদের টেনে নিয়ে যাওয়া হলো বেদির ওপরে। বেদির অন্যপাশ থেকে মোটামতন দেখতে একজন মানুষ এগিয়ে গেল তাদের দিকে। জল্লাদ।
ভুলে যাও অস্ত্র, আমি এগোচ্ছি,’ বলে শামান ওদের দিকে যাবার জন্যে উদ্যত হতেই কালন্তি একটা হাত চেপে ধরল ওর। দাঁড়াও, দেখো,’ বলে সে দ্বিতীয় ঘোড়ার গাড়ির দিকে দেখাল সেটার ভেতর থেকে নেমে এসেছে আগাগোড়া লাল পোশাক পরা ছোটোখাটো একজন মানুষ। লিচ্ছবীদের রাজা, হেমচন্দ্ৰ।’
সে নিচে নেমেই তৃতীয় ঘোড়ার গাড়ির দিকে ইশারা করতেই সেটার দরজা খুলে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলো একজন মানুষ সে নিজ থেকে বেরিয়ে এলো না তাকে গাড়ির ভেতর থেকে ছুড়ে ফেলা হলো বাইরে, ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু মানুষটাকে দেখে আনমনেই কালন্তি বলে উঠল, ‘রাজা বিক্রমাদিত্য।’
ঝট করে কালন্তির দিকে ফিরল শামান। ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল কালন্তি। ‘তারমানে এখানে শুধু বৌদ্ধ শ্রমণদের কতল করা হবে না বরং শাক্য রাজা বিক্রমাদিত্যকেও হত্যা করা হবে।’
***
মুহূর্তের জন্যে থেমে দাঁড়ালেও বিধু ইশারা করতেই আবার হাঁটতে শুরু করল ধোয়ী। কিন্তু একবার থেমে দাঁড়ানো তারপর আবার হাঁটতে শুরু করতেই ওদের দিকে ফিরে তাকাল মদারুর দরজার বাইরে দাঁড়ানো দুই সৈন্যের একজন। ‘এই, এদিক দিয়া কই যাস, তোরা?’
প্রথমজনের কথা শুনে ওদের দিকে দেখল দ্বিতীয়জন। মাটিতে এক দলা থুতু ফেলে প্রশ্ন করল। ‘তগো পিডে এইগুলান কি, মরা ইন্দুর নাকি?’
ওরা কেউ কোনো উত্তর দেয়ার আগেই প্রথমজন ধমকে উঠল। ‘এই কতা কানে যায় না? উত্তর দেস না ক্যান?’
‘হুজুর আমরা চামড়ার কারবারি, এইদিগে…’ বিধু মুখে বোকা বোকা হাসি ফুটিয়ে তুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই প্রথম সৈন্য বলে উঠল, ‘এইদিগে কিছু নাই, সামনে রাস্তা বন্ধ… ব্যাক্কলের মতো কই যাইতাছোস, গাধার জাত,’ বলে দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠল।
‘ও হুজুর ভুল হই গেছে,’ বলে সে পেছন ফিরে সবাইকে ফিরে যাবার জন্যে ইশারা করতেই হঠাৎ প্রথমজন বলে উঠল। ‘এই তোর কথা এমুন ক্যারে, তুই কোনোথাই আইছোস?’
বিধু জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করতেই তার সন্দেহের পারদ চড়ে গেল। ‘অ্যাই খাড়া,’ বলে সে বিধুর দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে তীব্র চিৎকার ভেসে এলো। দুই সৈন্য তো থেমে গেলই ওরাও ফিরে তাকাল বাড়ির দিকে। এই সুযোগটাই নিল ধোয়ী।
বিধু দেখতে পেল ওর পাশ থেকে হঠাৎ ছায়ার মতো সরে গেল কিছু একটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেল ধোয়ী পৌছে গেছে একজন সৈন্যের কাছাকাছি। সৈন্যের কাছাকাছি পৌঁছে এক হাতে ঘাড় চেপে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল সে। এমনকি অন্য হাত না লাগিয়েই তাকে ছুঁড়ে মারল দ্বিতীয় সৈন্যের দিকে। দুজনেই পড়ে যেতে প্রথমজনের তলোয়ারের খাপ থেকে তলোয়ার বের করে এক কোপে তার মাথা নামিয়ে দিল। দ্বিতীয় জনের দিকে এগোতে যাবে একটা তির এসে লাগল ধোয়ীর হাতে ধরা তলোয়ারে। ওটা হাত থেকে ছুটে যেতেই সবাই দেখল মদারুর বাড়ির ভেতর থেকে আরো দুজন সৈন্য বেরিয়ে এসেছে। ধোয়ী কিছু করার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠল বিধু, তার পাশের লোকটার চামড়ার গাটটা তুলে নিয়ে ছুড়ে মারল দুজনার দিকে।
ওরা সেটা সামলানোর চেষ্টা করতে করতে সে আর ধোয়ী দুজনেই দুই সৈন্যের তলোয়ার তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি দুজনার ওপরে। ওদেরকে নিষ্ক্রিয় করে চারজনে মিলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল বাড়ির দাওয়ার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে একজন মানুষকে।
ধোয়ী এগিয়ে প্রথম তার মুখের বাঁধন খুলে দিল। তারপর হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল। ‘কি ব্যাপার, মদারু তোর এই অবস্থা?’
‘আরে, আমার অবস্থা রাখ, তোরা এহানে কি করস?’
‘আমরা… আমাগো কিছু অস্ত্র লাগব, আর—’
ধোয়ী কথা শেষ করার আগেই বিধু বলে উঠল। ‘বাজারে আইজ যাগো মারবো হেগো ফিরাইতে আইছি।’
মদারু নিজের হাত-পা ডলছিল বিধুর কথা শুনে থেমে গেল সে। হাতের তাল দিয়ে কপালে চাপড় মারল। ‘গাধার দল। তগো কি মনে অয় হেরা আমারে বাইন্দা রাখছিল কেরে?’
‘মানে?’ ধোয়ী খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মদারুকে।
‘মানে, হেরা আমার পুরা অস্ত্র গুদাম খালি কইরা আমারে বাইন্দা রাখছিল কারণ হেরা আগেই অনুমান করছে আমার অস্ত্র গুদাম থাইক্কা অস্ত্র নিয়া কেউ ঝামেলা পাকাইতে পারে। আরে বলদের পোতারা, আইজকা এইখানে বিরাট ঘটনা ঘটতে যাইতেছে।’
‘সেইডা তো আমরা জানিই, বুদ্ধগরে…’
‘আরে!’ মদারুকে দেখে মনে হচ্ছে সে অস্থিরতায় মারাই যাবে। ‘বুকারা খালি কয়ডা বুদ্ধ মারুনের লাইগগা এত আয়োজন দেইখা তগো মাতায় কিছু ডুকলো না। আইজ এইহানে রাজা বিক্রমের কল্লা কাড়বো হেরা।’
‘এই মদারু,’ ধোয়ী তার দিকে দুই পা এগিয়ে গেল। ‘ঠিক কইরা ক, তুই সকাল বেলা মদ খাস নাইতো?’
‘খাইলে তো বালাই আছিল,’ বলে সে আশপাশে দেখে মনে হয় হতাশ হয়ে ওদের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘হেরা আইজ বিক্রমের কল্লা তো কাডবোই আরেকটা কারণে এই এলাকায় এত মজবুত পাহারা লাগাইছে। এই এলাকায় নাকি লাল চুলের এক যুদ্ধার বাহিনী আইছে, হেরে ফান্দে ফেলানির লাইগগাই এত আয়োজন। বাইরে যা সৈন্য দেখছোস তার চাইয়া অনেক বেশি সৈনিক বিভিন্ন জায়গায় লুকায়া আছে।’
মদারুর শেষ কথাটা শুনে বিধু ঝট করে ধোয়ীর দিকে ফিরল। দুজনের মনে একই ভাবনা, শামানের দলটাকে সাবধান করে দিতে হবে, সেইসঙ্গে সাবধান করে দিতে হবে ঘোষিত আর জাথুরিয়ার দলটাকে, যারা অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে বাজার সংলগ্ন খালের দিকে গেছে।
সবাইকে সাবধান করে দিতে না পারলে সর্বনাশ হবে আজ।