অধ্যায় সাতাশ – বর্তমান সময়
আখালিয়া সুরমা, সিলেট
লাক্কাতুরার জঙ্গুলে এলাকা পুরো চষে ফেলেও কিছু পাচ্ছে না তানভীরের টিম।
‘ব্যাপার কি, ওটা গুগল ম্যাপেও নেই, আমাদের নিজেদের ম্যাপেও নেই,‘ তানভীর একটু অবাক হয়েই বলে উঠল।
‘হতে পারে,’ লায়লা আনমনেই মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল। ‘কারণ আমার যতটুকু মনে পড়ে মিতায়ন বলেছিল জায়গাটা বনাঞ্চল হলেও ওটা একটা প্রাইভেট প্রপার্টি। আর ওখানে যে বাংলোতে ওদের অফিস সেই বাংলোটাও সম্ভবত একই মালিকের।’
‘হতে পারে, স্যার,’ লায়রার কথার সঙ্গে ইকবাল যোগ করল। কারণ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রপার্টি অনেক সময় ম্যাপে থাকে না। বিশেষ করে জায়গাটা ছোটো হলে।’
‘প্রশ্ন সেটা না,’ ঘড়ি দেখতে দেখতে তানভীর বলে উঠল। ‘আমার প্রশ্ন হলো, যদি সঠিক ঠিকানাটা না পাই তবে আমরা সেখানে যাব কিভাবে?’ ঘড়িতে তিনটার ওপরে বাজে। তানভীর হিসেব করে দেখল, যদি এখান থেকে বাংলোতে যাবার জন্যে ওরা রওনা দেয় তবুও চারটা বেজে যাবে। একে তো শীতের সময়, তার ওপরে পাহাড়ি এলাকায় সন্ধে নামে খুবই দ্রুত। আর বাংলোটা পরীক্ষা করা খুবই জরুরি মনে হচ্ছে ওর কাছে। কারণ ওটাই যদি ডক্টরের মূল অফিস হয়ে থাকে তবে ডক্টরের আসাম অভিযানের বিস্তারিত তথ্য ওখানেই পাওয়া যাবে। এমনকি ডক্টরের অন্তর্ধানের ব্যাপারেও জরুরি কিছু না কিছু অবশ্যই জানা যাবে।
‘আমি আপনাদের ওখানে নিয়ে যেতে পারি,’ সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশেষ করে তানভীরতে অবাক করে দিয়ে লায়লা বলে উঠল।
‘আপনি আমাদের নিয়ে যাবেন মানে?’ তানভীর অবাক হয়ে বলে উঠল ‘আপনি তো আমাদের সঠিক অবস্থানটাই জানাতে পারছেন না, নিয়ে যাবেন কী করে?’
‘বাংলোর অবস্থান জানাতে না পারি দেখাতে তো পারব,’ লায়লাকে মনে হলো সে একটু খুশি হয়ে উঠেছে।
‘আপনি সেখানে গেছেন নাকি এর আগে?’ সুলতান জানতে চাইল।
‘একেবারে বাংলো পর্যন্ত গেছি বললে ভুল হবে, তবে ওটার কাছাকাছি গেছি,’ বলে সে যোগ করল। ‘আজ থেকে বছর দেড়েক আগে লাক্কাতুরার কাছেই ওয়ান্ডারল্যান্ডে আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে পিকনিকে গেছিল। তো আমি পিকনিকের গাড়ি মিস করি। মিতায়ন আমাকে বলে, সে ওদিকেই যাচ্ছে কাজেই চাইলে সে আমাকে নামিয়ে দিতে পারে। ও আমাকে নিয়ে কাতিয়ার মূল রাস্তা পর্যন্ত যায়, এরপরে ওখান থেকে ডিপার্টমেন্টের গাড়ি এসে আমাকে পিক করে নেয়। আর মিতায়ন ওর অফিসে চয়ে যায়। কাজেই আমি খুব সহজেই আপনাদের দেখাতে পারব জায়গাটা।’
‘ভালোই তো হলো তাহলে, আপনি—’ টমি খুশি হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তানভীর গভীর আপত্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘না না সেটা হয় না, এটা একটা পুলিশি ইনভেস্টিগেশন, আর উনি একজন সিভিলিয়ান। ওখানে যদি কোনো বিপদ হয় তবে কী হবে, তারচেয়ে-’ তানভীর কথা শেষ করার আগেই বাইরে চেঁচামেচি শোনা গেল। বারান্দায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা।
বয়স্ক মহিলা পলকে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়েই ছুটে গেল লায়লার দিকে। ‘মা—’ বলে চেঁচিয়ে উঠে সে এত জোরে লায়লাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল, আরেকটু হলে লায়লা চেয়ার উল্টে পড়ে যেত মাটিতে।
তানভীর উঠে দাঁড়াল, এখন পারিবারিক কাহিনি হবে, এগুলো না দেখে ওর বরং ওর কাজ করা উচিত। সুলতানের দিকে ইশারা করে ও উঠে দাঁড়িয়ে ডায়নিং রুমে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে আরেকটু হলেই ওর সঙ্গে ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিল একজন মানুষের। নিজেকে সামলে নিয়ে সরি বলতে যাবে দেখতে পেল মানুষটা ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘তানভীর ভাই, তুমি?’ আক্ষরিক অর্থেই মানুষটার মুখ হা হয়ে গেছে তানভীরকে দেখে। ‘তুমি এখানে!’
মানুষটাকে চিনতে মুহূর্তখানেক লাগল তানভীরের, যদিও বহু বছর পরে দেখা, মেয়েটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে তবুও চিনতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তানভীরের। ‘শায়লা তুই?’
লায়লার ছোটো বোন শায়লা। তানভীরের চেয়ে দুই বছরের ছোটো ছিল তখন। লায়লা আর তানভীরের প্রেম নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত থাকত শায়লা। আবার সবচেয়ে বেশি দুষ্টমিও করত সেই। লায়লার সঙ্গে তানভীরের প্রেম ভেঙে যাবার পর শায়লা বহুবার ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তানভীর কোনোভাবেই হতে দেয়নি সেটা। অনেকদিন চেষ্টা করতে করতে অবশেষে ক্ষান্ত দেয় সে। ‘তুই এখানে?’ তানভীর কী বলবে বুঝতে না পেরে বলে উঠল।
‘আমার বড়ো বোনের হাজবেন্ড মিসিং, আমি এখানে থাকব না তো কে থাকবে,’ শায়লা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তানভীরকে। ‘কিন্তু তুমি এখানে কেন?’
কিছু বলার আগে এমনিতেই হেসে ফেলল তানভীর। ‘আমি ডক্টর মিতায়ন আহমেদ মিসিং কেসের তদন্তকারী অফিসার।’
‘তারমানে ঢাকা থেকে বিশেষ ফোর্সের একজন অফিসার আসার কথা, সেটা তাহলে তুমি?’ শায়লার গলার বিস্ময়টা চাইলেও সে কোনোভাবেই লুকাতে পারছে না। মাই গড! তাই বলে শেষ পর্যন্ত তুমি?’
‘কপালের লিখন, না যায় খণ্ডন,’ কী বলবে ভেবে না পেয়ে বহু আগে কোনো একটা বইতে পড়া ডায়লগ ঝেড়ে দিল তানভীর। ‘তুই কেমন আছিস, কী করছিস এখন?’ তানভীর জানতে চাইল, কিন্তু শায়লা জবাব দেয়ার আগেই ভেতর থেকে উত্তেজিত চেঁচামেচি ভেসে এলো। তানভীর আর শায়লা দুজনেই ফিরে তাকাল সেদিকে।
‘আপার ওপরে নাকি হামলা হয়েছিল? ব্যাপারটা কি, আমরা একটু জিন্দাবাজার গেছিলাম। খবর পেয়ে একরকম ছুটে এলাম,’ শায়লা উদ্বিগ্ন মুখে বলে উঠল।
তানভীর চোখ তুলে তাকাল শায়লার দিকে, কিছু না বলে খানিকটা এগিয়ে ভগ্নদশা ডায়নিং রুমের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ‘তোর বোন সুস্থ আছে,’ বলে একটু হেসে যোগ করল। ‘ভয় পেয়েছে আরকি, যেটা এতদিন অন্য মানুষকে পাওয়াতো।’
তানভীরের কথা শুনে হেসে উঠল শায়লা। তার হাতে কয়েকটা ব্যাগ ছিল সেগুলো নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপরে। সেও বসে পড়ল একটা চেয়ার টেনে। বারান্দার দিকে ইশারা করে বলল। ‘ওখানে কে কে আছে?’
তোর মা, লায়লা আর আমার একজন মহিলা এজেন্ট আছে। তোর বোন বরাবরের মতোই অনেক লাকি, কারণ আমরা একেবারে সময়মতো পৌঁছে গেছিলাম। না হলে আজ খারাপ কিছু হতে পারত,’ শায়লার স্থির দৃষ্টির সামনে একুট বিব্রত বোধ করছে তানভীর।
‘তানভীর ভাই, আসলে হচ্ছেটা কি বলো তো। আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রথমে এভাবে জিজু হারিয়ে গেল এরপর আপার ওপরে হামলা,’ বলে সে তার আঙুলে পরে থাকা বড়ো বড়ো আংটিগুলোর একটা ধরে মোচড়াতে লাগল। ‘আমরা পরিবারের লোকজন খুব অসহায় বোধ করছি।’
‘শোন, তোকে যে আমি বিস্তারিত বলব, আমি নিজেই তো সবকিছু এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম দুইদিন আগেও। হঠাৎ জরুরি তলবে আমাকে ডেকে আনা হলো। এরপর আজ অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম এই কেসের ব্যাপারে। আমারও তো একটু সময় দরকার বুঝে ওঠার জন্যে,’ বলে একটু থেমে ও যোগ করল। ‘তোর দেখি আগের মতোই আংটি পরার অভ্যাস আছে এখনো।’
নিজের ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছিল শায়লা হঠাৎ তানভীরের কথা শুনে সে একটু অবাক হয়েই ফিরে তাকাল। তারপর নিজের হাতের আংটিগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। ‘আমি, এখনো অনেকটা আগের মতোই আছি। তুমি কেমন আছো?’
তানভীর একটু উদাস গলাতেই উত্তর দিল। ‘তুই যেমন আগের মতোই আছিস, আমি ঠিক তার উলটো। আমার ভেতরে আগের সেই তানভীরের ছিটে- ফোঁটাও আর নেই ‘
‘বললে হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না তানভীর ভাই, তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করার কত যে চেষ্টা করেছি,’ বলে একটু থেমে যোগ করল। ‘আপা তোমার সঙ্গে যা করেছে সেটা…সেটা অনেক অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছিল আমাকে। তুমি হয়তো মানবে না কিন্তু বাবাও অনেক কষ্ট পেয়েছিল। এমনকি বাবা এক বছর কথা বলেনি আপার সঙ্গে,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল, ‘কিন্তু আপাকে তো তুমি চেনোই। কারো কথা শোনার মতো মানুষ সে কখনোই ছিল না। সে…’
তানভীর একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল ওকে। ‘বাদ দে না, এসব পুরনো কথা আর ঘেঁটে লাভ নেই। আমি বলতে গেলে সব ভুলেই গেছি। এই উদ্ভট কেসে আমাকে না পাঠালে ওগুলো আর মনে করারও দরকার পড়ত না। এসব বাদ দিয়ে বরং বল তুই কি করছিস এখন?’
‘আমি তো জাহাঙ্গীরনগর থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে এখন একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। এইতো, কয়েক বছর হলো।’
‘তোর ওই ভ্যাবলা মার্কা’ বয়ফ্রেন্ডাটা আছে এখনো?’ তানভীর হেসে উঠে জানতে চাইল। ‘সরি, কিছু মনে করিস না।’
শায়লাও হেসে উঠল। ‘আলিফকে তুমি কখনোই পছন্দ করতে না, আমি জানতাম। আছে, ভালোই আছে,’ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল শায়লা। ‘সংসার করছে সুখে।’
‘বাহ, তোদের বিয়েও হয়ে গেছে বুঝি, কনগ্র্যাটজ।’
‘আরে, তানভীর ভাই!’ বলে শায়লা একরকম মুখ ঝামটা দিল। ‘বলেছি সে সংসার করছে, আমার সঙ্গে সংসার করছে সেটা তো বলিনি। ওকে ঝেটিয়ে বিদেয় করে বেঁচেছি। গাধাটা এত ক্যারিয়ারিস্ট, সারাক্ষণ চাকরি-বস-অফিস, উফ্, আল্লাহ বাঁচিয়েছে বলদটাকে-বিয়ে করিনি।’
একমুহূর্ত তানভীর তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল আবার। ‘আচ্ছা, তুই বললি লায়লা আমাকে ডিচ করার পর, মানে ওই ঘটনার পর আঙ্কেল অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আন্টি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছিলেন। উনি তো আমাকে…‘
‘এখন আর মিথ্যে বলব না,’ শায়লার চোখে দুষ্টামির হাসি। ‘মা আসলেও অনেক খুশি হয়েছিল। মা…’
শায়লা কথা শেষ করার আগেই বারান্দার দিক থেকে চেঁচামেচি ভেসে এলো। প্রায় ঝড়ের বেগে ডায়নিং রুমে প্রবেশ করল ঢোলা পালাজ্জো আর গোলাপি রঙের ঢোলা শার্ট পরা বয়স্ক একজন মহিলা। তানভীর আর শায়লা দুজনেই ফিরে তাকাল তার দিকে।
শায়লা-লায়লার মা। মহিলাকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তানভীর বুঝতে পারল মহিলা এখনো পুরোপুরি আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি। সেই উগ্র সাজগোজ, বেমানান কড়া লিপস্টিক। এখনো সে তার দুই মেয়ের চেয়ে বেশি সাজগোজ করে।
বয়স্ক মহিলা ঝড়ের বেগে ডায়নিং রুমে প্রবেশ করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি জানতে চাচ্ছি এখানে অথরিটি কে? আমার মেয়ের এত বড়ো বিপদ, কেউ কিছু তো করছেই না, আবার ওকে নিয়ে নাকি তারা কোথায় যেতে চায়। এত বড়ো সাহস কার? আমি একটু দেখতে চাই।’
‘এই যে আন্টি, আমি এখানকার দায়িত্বরত অফিসার,’ তানভীর বসা অবস্থাতেই বলে উঠল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে। কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারেন।’
মহিলা বিশাল দেহ নিয়ে বলতে গেলে প্রায় লাফিয়ে এগিয়ে এলো তানভীরের দিকে। একেবারে তানভীরের সামনে এসে মুখের সামনে আঙুল তুলে শাসিয়ে শাসিয়ে কথা বলতে শুরু করল। ‘আপনি কি পুলিশ? আপনার ইউনিফর্ম কোথায়? আপানাদের এত বড়ো সাহস…’
‘মা কী হয়েছে?’ তানভীরের পাশ থেকে শায়লা বলে উঠল। ‘এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন?’
‘উত্তেজিত হবো না,’ মহিলা তার মেয়ের দিকে ফিরে উছলে উঠল। ‘আমার মেয়ের জামাই নিখোঁজ, আমার মেয়ের ওপরে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। পুলিশ কিংবা অন্য কেউ তো কিছু করছেই না বরং উলটো এখন তারা আমার মেয়ের কাছ থেকে সাহায্য চায়। কত বড়ো সাহস,’ বলে মহিলা আবার ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। তানভীর এখনো শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে। ‘এ্যাই আপনি এখানকার নাকি দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, আপনি বলুন। ঢাকা থেকে আপনাদের না কে আসার কথা, সে আসছে না কেন?’
‘আমিই সেই ঢাকা থেকে আসা অফিসার,’ বলে তানভীর উঠে দাঁড়িয়ে একেবারে মহিলার মুখোমুখি দাঁড়াল।
মহিলা তানভীরের একেবারে মুখের সামনে আঙুল তুলে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল হঠাৎ সে থেমে গেল। চূড়ান্ত অবাক হয়ে সে বলে উঠল, ‘তানভীর! তুমি?’ বহু বছরের পরিবর্তনে অনেকটাই বদলে যাওয়া তানভীরকে প্রথমে চিনতে পারেনি সে। হঠাৎ চিনতে পেরে একেবারে থমকে গেল।
‘জি, আমি। আমিই ঢাকা থেকে আসা সেই অফিসার। ডক্টর মিতায়ন আহমেদ অন্তর্ধান কেসের দায়িত্ব এই মুহূর্তে আমার ওপরেই ন্যস্ত,’ তানভীর বেপরোয়া দৃষ্টিতে সরাসরি মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
মহিলা কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থেকে একেবারে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল, ‘হাউ ডেয়ার দে, হাউ ডেয়ার দে সেন্ড ইউ ফর দিস কেস। তুমি তো জীবনেও মিতায়নকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে না উলটো পারলে আমার মেয়েকে…’ বলে মহিলা থেমে গেল। ‘আচ্ছা, এইজন্যেই তুমি তাহলে আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছো বাংলো খুঁজে বের করতে। আমি কি বুঝি না…’
‘মা তুমি কী শুরু করলে?’ শায়লা বলে উঠল। বাইরে থেকে ফরেনসিকের সবাই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ভেতরের রুম থেকে টমি আর সুলতানও বেরিয়ে এসেছে। ‘তুমি জানো এখানে কী ঘটেছে? তুমি অকারণে—’
‘এই, তুই চুপ থাক…’ মহিলা একবাক্যে চুপ করিয়ে দিল শায়লাকে। ‘ওদের এত বড়ো সাহস, ওরা ভেবেছে কি? আমরা অসহায়? আমার পারিবারিক কানেকশন কতটুক, ওদের কোনো ধারণা আছে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার আপন চাচাতো ভাই। আমি চাইলে…’
‘খুঁজে বের করেন,’ তানভীর মহিলার কথার মাঝেই খুব শান্তভাবে বলে উঠল। ‘আপনার তো অনেক কানেকশন, তো আপনার কানেকশনের জোরে খুঁজে বের করেন আপনার মেয়ের জামাইকে। ‘
‘মানে,’ মহিলা একটু থমকে গেছে। ‘কী বলতে চাইছো তুমি?’
‘খুব সহজ কথা, আপনি তো বলছেন আমি কিছুই করব না, আমার উদ্দেশ্য খারাপ, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আপনি আপনার কানেকশনের জোরে মেয়ের জামাইকে খুঁজে বের করেন,’ তানভীর একটু এগিয়ে এলো মহিলার দিকে। সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমার প্রশ্ন হলো, এরই মধ্যে কয়েকদিন পার হয়ে গেছে, আপনি কিছু করেননি কেন?’
মহিলা একটু পিছিয়ে গিয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে। ‘এই ছেলে কী বলছে, ও কি পাগল হয়ে গেছে নাকি?’
‘পারেননি, তাই না?’ তানভীর বলে উঠল। শুনুন, আপনার কানেকশন আছে কি নেই, আমি আপনার শত্রু না বন্ধু এসব ব্যাপারের অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছে এই ঘটনা। মানেন আর না মানেন, সত্যি কথা হলো আমি তানভীর মালিকই এখন আপনাদের একমাত্র ভরসা। কাজেই নিজের ভালোর জন্যে হলেও মুরুব্বি হিসেবে দোয়া করেন যেন অমি সফল হই।’
‘দেখো, তাই বলে তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে এভাবে মাঠে নামতে পারো না, তুমি যদি…’
‘মা তুমি চুপ করবে?’ বারান্দার দরজার কাছ থেকে নতুন কণ্ঠস্বর শুনে সবাই সেদিকে ফিরে তাকাল। লায়লা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ‘তুমি সবসময় বেশি কথা বলো। তোমাকে কে বলেছে, উনারা আমাকে নিয়ে কাজে নামতে চাইছে। আমি উনাদেরকে বলেছি মিতায়নকে খুঁজে বের করতে যেকোনো সাহায্য করতে চাই। বাংলো খুঁজে বের করার ব্যাপারটাও তাই।’
‘তাই বলে এই ছেলে,’ বলে সে তানভীরের দিকে দেখাল। ‘এই ছেলে তো তোর জানের শত্রু। এ তো তোকে মেরে ফেলবে।’
‘মা, তুমি না কি যে সব বলো মাঝেমধ্যে,’ বলে সে তানভীরের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘অফিসার আপনারা গাড়িতে গিয়ে বসুন আমি রেডি হয়ে আসছি।’
একবার লায়লার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ওর মা আর শায়লার দিকে দেখল তানভীর, তারপর কিছু না বলে নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে ইশারা করে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে এলো।
দুপুরের সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। বিকেল না হলেও সময়টা যেন দুপুর আর বিকেলের দড়ি টানাটানির মাঝে পড়ে থমকে গেছে।
বাইরে বেরিয়ে তানভীর বুক ভরে নিশ্বাস নিল। এক দিনের ব্যবধানে জীবনটা হঠাৎ খুব কঠিন মনে হচ্ছে ওর কাছে। বাংলোর বারান্দা থেকে নেমে পায়ে চলার পথটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর কাছে এসে থেমে গেল। পেটের ভেতরে পাকস্থলী মোচড় দিয়ে জানান দিচ্ছে সকালের নাশতায় একটা স্যন্ডউইচ আর এক কাপ কফি ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়নি। মজার ব্যাপার হলো পেটের ভেতরে পাকস্থলী মোচড় দিচ্ছে কিন্তু কিছু খাবার কথা মনে হচ্ছে না বরং মনে হচ্ছে আরো সিগারেট টানতে পারলে ভালো হতো।
রক্তের ভেতরে নিকোটিনের নেশা যেন অনেকদিন বন্দি থাকার পর লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে। কোকের বোতলের মুখ চেপে ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিলে যেভাবে গল গল করে বেরুতে শুরু করে, প্রায় আট বছর পরে সিগারেটে টান দেয়াতে রক্তের ভেতরে নিকোটিনের নেশার যেন ঝড় শুরু হয়েছে।
‘বস, বলেন। নির্দেশনা কি?’ ও পেছন ফিরে দেখেল টমি, সুলতান আর ইকবাল এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। টমি জানতে চাইছে এবার ওদের করণীয় কি।
কিন্তু টমির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং ওর দিকে ফিরে জানতে চাইল, টমি, তুই কি সিগারেট খাস?’ ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে টমিকে তানভীর আপনি থেকে তুমি, এখন তুমি থেকে তুই ডাকতে শুরু করেছে।
কিন্তু টমির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বিগলিত গলায় বলে উঠল, ‘না, বস। কেন?’
এবারও টমির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ও ইকবালের দিকে ফিরে ভ্রু নাচিয়ে একই প্রশ্ন করল। সুদর্শন সাব ইন্সপেক্টর হাসি দিয়ে দুই হাত তুলে নিজের অপারগতা প্রকাশ করল।
‘বস,’ সুলতানেরে ডাক শুনে সেদিকে ফিরে ও দেখতে পেল একটা গোল্ডলিফের প্যাকেট আর একটা লাইটার ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সুলতান। ‘কিছু মনে করবেন না, ছোটোবেলার অভ্যাস।’
মৃদু হাসি দিয়ে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে টান দিল ও। গোল্ডলিফের কড়া স্বাদের কারণে চোখে পানি চলে এলো প্রায়। ‘ইকবাল, যা যা বলেছিলাম করা হয়েছে?’
‘জি, বস, পাহারা বসানো হয়েছে, সতর্ক করে দেয়া হয়েছে সমস্ত পুলিশ চৌকিকে। বাকি যা যা বলেছেন সেগুলোও ব্যবস্থা করা হচ্ছে,’ ইকবাল মাথা নেড়ে বলে উঠল। ।
টমি, তুই ফরেনসিকের ওদেরকে নিয়ে ল্যাবে চলে যা। আমি ইকবাল, সুলতান আর লায়লাকে নিয়ে সেই বাংলোর অনুসন্ধানে যাব। আমার ধারণা ওখানে গেলে অবশ্যই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে কারণ ডক্টর মিতায়নের অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিষ্কার না,’ বলে ও সিগারেটটাকে টমির দিকে পিস্তলের মতো তাক করল। ‘বিশেষ করে তার আসাম অপারেশনের ব্যাপারে বিশদ জানতে পারলে অবশ্যই আমরা কোনো না কোনো ক্লু পাবো তার অন্তর্ধানের ব্যাপারে। তুই ল্যাবে গিয়ে আগে যা যা বলেছি সেগুলো খতিয়ে দেখবি, বিশেষ করে ভাড়া করা প্লেনের ব্যাপারটা, আর সুলতানের বলা অস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজ নিবি। আর সেইসঙ্গে এখানকার ফরেনসিক রিপোর্ট চাই আমি, একেবারে বিস্তারিত,’ ওই পর্যন্ত বলে ও একে একে টমি-সুলতান আর ইকবালকে দেখল।
‘সবাইকে একটা ব্যাপারে সচেতন করে দিই,’ বলে ও সিগারেটে জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ওপরের দিকে। ‘আপনারা হয়তো জানেন বা বুঝতে পেরেছেন এই কেসের সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার জড়িয়ে যাওয়াতে কেসটা আমাদের জন্যে আরো জটিল হয়ে গেছে। একদিকে, আমরা সরাসরি পুলিশ বা পিবিআইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না, অন্যদিকে আমি সুলতান টমি আবার এই কেসে এসেছি ইএএফের সঙ্গে কোলাবোরেশনে কাজ করতে। পুলিশ বলেন পিবিআই বলেন আর ইএএফ বলেন আমাদের সফলতার ভাগ সবাই চাইবে, কিন্তু ব্যর্থ হলে আমাদের কল্লা নিতে এক বিন্দু দ্বিধা করবে না কেউ। তার ওপরে আছে লায়লার মা। আমি যতটুক জানি মহিলার পারিবারিক কানেকশন আসলেই খুব ভালো। বাংলাদেশে এসব কানেকশনের জোরে কোনো কাজ না হলেও প্রচুর অকাজ ঠিকই হয়। কাজেই আমরা যদি কোনোভাবে ব্যর্থ হই, বা লায়লার কোনো ক্ষতি হয়, কিংবা আমাদের কারণে ডক্টর মিতায়নের কোনো ক্ষতি হয়, এই মহিলা আমাদের বিশেষ করে আমার কল্লা চিবিয়ে খাবে,’ বলে ও একটু থামল।
‘কাজেই আমাদের সবাইকে খুব সাবধানে সর্বোচ্চ শ্রম-মেধা দিয়ে এই কেসের পেছনে লাগতে হবে। আমি কথাগুলো বললাম আপনাদের ভয় দেখানোর জন্যে না, বরং যাতে কাজটাকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্যে। সবাই বুঝতে পেরেছেন?’
সবাই এক যোগে মাথা নাড়ল। সন্তুষ্টির সঙ্গে মাথা নাড়ল তানভীর। ‘ইকবাল, আপনি এই বাংলোতে পুলিশ পাহারা বসানোর ব্যবস্থা করে আমাদের মাইক্রোর ড্রাইভারকে গাড়ি প্রস্তুত করতে বলেন। আর টমি তুই ফরেনসিক নিয়ে ল্যাবে গিয়ে কাজ শুরু কর।’
দুজনেই প্রস্থান করতেই সুলতান বলে উঠল, ‘বস, একটা কথা বলি, যদি কিছু মনে না করেন।
‘বলো, সমস্যা নেই,’ বলেই ও মৃদু হেসে উঠল। ‘যে অবস্থার মধ্যে আছি এরচেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে।’
সুলতানও হেসে উঠল। ‘বস, আপনার আর মিসেস লায়লার পুরনো ব্যক্তিগত ব্যাপারটা যেভাবে সবার সামনে চলে এসেছে তাতে এই পরিস্থিতিতে উনাকে নিয়ে বাংলো খুঁজতে যাওয়াটা কতটুক ঠিক হচ্ছে?’ বলেই সে ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘বাই এনি চান্স, উনার কিছু হলে সব কিন্তু দোষ আপনার ওপরে এসে পড়বে।’
কোনো জবাব না দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজের দাড়িতে হাত বুলাতে লাগল তানভীর। মনের ভেতরে প্রশ্ন,
ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে না তো?