অধ্যায় ছাব্বিশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
যজ্ঞবাবার ডেরা, কন্নোর, ভারতবর্ষ
‘আমাগো এইখানে অপেক্ষা করা এক্কেরেই ঠিক হবো না,’ জাথুরিয়া কথাটা বলে সে অন্যদিকে ফিরে তাকাল সমর্থনের আশায়। প্রায় সবাই নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
বিধু, ঘোষিত আর ধোয়ী অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা যজ্ঞবাবার বাড়িটার দিকে। আমি ওস্তাদরে না নিয়া যাব না,’ গোয়াড়ের মতোই বলে উঠল সে। ‘যা খুশি তাই হোউক, যার মন চায় যা…’ তার কথা শেষ হবার আগেই খর মর শব্দ তুলে বাড়িটা ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। ছিটকে উঠল আগুনের ফুলকি, আগুনে বাতাসের ঝাপটা এসে ধাক্কা দিল সবাইকে।
‘এইখানে আর এক পলকও থাকুন যাইবে না। যেকোনো সময় লিচ্ছবী রাজা হেমচন্দ্রের লোকেরা আইসলে কচুকাটা অইতে হবে। তারচেয়ে যা জানছি আমরা সেইটা রাজা মানরু আর শংকরের কানে পৌছাইতে হবে,’ জাথুরিয়া আবারো বলে উঠল। ‘তা না হলে দুজনার মৃত্যুই বৃথা যাবে।’
কথাটা বলে সে আর অপেক্ষা করল না, ঘোড়া ঘুড়িয়ে টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করল। বাকিরাও ধীরে ধীরে অনুসরণ করতে শুরু করল তাকে। শুধু বিধু ঘোষিত আর তলোয়ারবাজ ধোয়ী তাকিয়ে আছে ধসে পড়া বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ পরে ধোয়ী বলে উঠল, ‘ওরা ঠিকই কইছে। আমাগো ফিরে যাওয়া উচিত, এইখানে থাকলে বিপদ হবে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনজনেই ঘোড়া নিয়ে রওনা দিল উলটো দিকে।
***
বেশ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল ও। একেবারে সবুজ একটা পাহাড়ি উপত্যকা অদ্ভুত সুন্দর একটা নদী বয়ে চলেছে উপত্যকার ঠিক মাঝ বরাবর। নদীর একপাশের তীরে বিরাট একটা গাছ, কী গাছ ঠিক বুঝতে পারল না ও কিন্তু গাছটাতে একেবারেই অন্যরকম এক গোলাপি ফুল ফুটে আছে। সেই গাছটাকে ঘিরে ছোটো ছোটো অনেকগুলো অদ্ভুত দেখতে বাড়ি। এরকম বাড়ি এর আগে
কখনো দেখেনি ও। সেই গাছের নিচে সবুজ ঘাসের ওপরে বসে আছে ও, ওর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো মানুষ। ছোটো ছোটো বাচ্চারা খেলছে, মহিলারা ঘর-কন্না করছে। পুরুষেরা কাঁধে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে কাজে চলেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, প্রতিটি মানুষ ওর মতো দেখতে, প্রত্যেকের মাথায় মরচে পড়া লোহার মতো লালচে চুল, প্রতিটি নারী-পুরুষ হালকা-পাতলা লম্বা আর সুন্দর দেখতে। হঠাৎ লম্বা লাল চুলের একজন মহিলা ওর দিকে ফিরে ডেকে উঠল, ‘শামান, শামান’।
‘যোদ্ধা, যোদ্ধা…’
কানের কাছে একটানা শব্দ আর সঙ্গে কড়া রোদ চোখের ওপরে পড়াতে চোখ খুলতে বাধ্য হলো শামান। তারপর ঝট করে উঠে বসার চেষ্টা করল ও। বসার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই ওর একটা হাত চলে গেল শরীরের মাঝ বরাবর। কারণ ওখানে ভারী কিছু একটা আটকানো মনে হচ্ছে ওর কাছে।
চোখ খুলতেই একটা নারীমূর্তি চোখে পড়ল, ওর ওপরে ঝুঁকে আছে। প্ৰথমে শামানের মনে হলো ও এখনো স্বপ্নের ভেতরেই আছে, তাই আবার শুয়ে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার চোখ খুলল, কারণ বিসদৃশ কিছু একটা ধরা পড়েছে ওর চোখে। স্বপ্নের নারীমূর্তির চুল ছিল ওর মতো লালচে, আর চোখ নীল। কিন্তু এই নারীমূর্তির চুল কালো আর চোখ ধূসর রঙের। ও চোখ খুলে উঠে বসল।
‘উফ্, যোদ্ধা তুমি ভারী চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে,’ বলে কালন্তি একেবারে কাছ থেকে ওকে একবার পরখ করে নিয়ে ওর পাশেই একটা পাথরের ওপরে গিয়ে বসে পড়ল।
‘তুমি, তুমি, এখানে কিভাবে এলে? আর আমরাই বা কোথায়?’ বলেই ও আশপাশে চোখ বুলাল। ওরা নদীর পাড়ে সবুজে ছাওয়া ছোটো এক টুকরো জমিতে অবস্থান করছে এই মুহূর্তে। ত্রিভুজ আকৃতির জায়গাটার একদিকে উঠে গেছে একটা টিলা, অন্যদিকে জঙ্গল আর ওটাকে একপাশে রেখে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। ‘আ…আমরা এখানে এলাম কিভাবে?’ জ্ঞান হারাবার আগে শেষবারের স্মৃতি মনে পড়ল, শক্ত কিছু একটা পেঁচিয়ে গেছিল হাতে, আর পানিতে ডুবতে শুরু করেছিল ও। তুমি আমার কাপড় কী করেছো?’ শামান আতঙ্কিত হয়ে জানতে চাইল। ওর গায়ে একটা সুতোও নেই, শুধু লোহার জালটা ওর শরীরের মাঝামাঝি প্যাচানো।
‘এত চিন্তার কিছু নেই,’ কালন্তি হালকা চালে বলে উঠল। সে ছুরি দিয়ে একটা গাছের মোটা ডালের মাথা চোখা করতে ব্যস্ত। ‘তোমার কাপড় ভিজে একাকার হয়ে গেছিল, আর তুমিও ঠান্ডায় জমে একেবারে নীল হয়ে গেছিলে, তাই তোমার কাপড় আর তোমাকেও রোদে দিতে হয়েছে। অন্য বিপদ আপাতত কেটে গেছে, তবে তোমার জ্ঞান ফিরে না আসাতে আমি বেশ ভয় পাচ্ছিলাম।’
শামান দেখল পাশেই একটা বড়ো পাথরের ওপরে ওর কাপড় সব রোদে দেয়া। বাম হাতের কবজিতে আর শরীরের কয়েক জায়গায় পাতার মতো কী যেন লাগানো। আনমনেই গলার কাছে একটা হাত চলে এলো। কণ্ঠার হাড়টা আরেকটু হলেই ভেঙে দিয়েছিল ব্যাটা উরগের বাচ্চা। গলায় হাত লাগতেই জ্বলে উঠল জায়গাটা। শামান কালন্তির দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘তুমি এখানে কিভাবে এলে? ওদের সঙ্গে বের হওনি কেন?’
‘নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যোদ্ধা, যে আমি ওদের সঙ্গে বের হইনি,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আসলে বের হতে পারিনি। তুমি আগুন ধরিয়ে সবাইকে বের হতে বললে আমি দেখতে পাই বিধু-ধোয়ী ওরা সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি ছিলাম বেদির পেছনে তাই একটু সময় লাগে আমার বেরুতে, আমি যখন বের হই ততক্ষণে ওরা তো বেরিয়ে গেছে, আমি দরজার কাছে পৌঁছে দেখি আগুনে পুড়ে চৌকাঠসহ ওটা ভেঙে পড়েছে। ওদিক দিয়ে বেরুনো যাবে না দেখে আমি বারান্দা দিয়ে জলাধারের কাছে নেমে পড়ি। দেখতে পাই তুমি উরগদের সঙ্গে মারামারি করছো।’
‘এক উরগকে মেরে অন্যটাকে ঘায়েল করে একটাকে নিয়ে পানিতে পড়ে গেলে। আমি দৌড়ে নদী তীরের কাছে গিয়ে দেখি তোমার একটা তলোয়ার পড়ে আছে, ওটা তুলে নিয়ে আহত উরগকে নিকেশ করে আমি নদীর তীর ধরে দৌড়াতে থাকি। একসময় দেখি তুমি ওকে মেরে একটা পাথরের ওপরে পড়ে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছো। তখন আমার চাবুক ছুড়ে তোমার কবজিতে আটকে ফেলে বহু কষ্টে তোমাকে টেনে তুলি এখানে,’ বলে সে যোগ করল। ‘তোমাকে ধন্যবাদ।’
কালন্তির কথা শুনে কবজি ডলতে লাগল শামান। হাতে পিচ্ছিল যে জিনিসটা জড়িয়ে ধরেছিল, ওটা তাহলে সাপ ছিল না, চাবুক ছিল। এটার কারণেই বেঁচে গেছে ও আজ। ‘বুঝলাম না,’ বলে ও তারের জালটা একহাতে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করল। ‘প্রাণে বাঁচালে তুমি আমাকে, আর তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছো।’
ডালটা চোখা করার কাজ শেষ করে সে ছুরিটা একটা পাতা দিয়ে দুবার ঘসে নিয়ে কোমরের খাপে রেখে দিল। ‘তুমি তখন ওরকম প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে উরগদের ওপরে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আজ সবাইকে মরতে হতো। আমি এর আগে কখনো উরগদের মোকাবেলা করিনি কিন্তু আমার বাবার মুখে শুনেছি ওরা কী ভয়ংকর হিংস্র হতে পারে। সত্যি কথা হলো, তুমি আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছো আজ।’
শামান তারের জালটাকে সাবধানে ধরে উঠে বসল, দাঁড়াতে গিয়ে আরেকটু হলে মাথা ঘুরিয়ে পড়েই যাচ্ছিল, হাত থেকেও ছুটে যাচ্ছিল জালটা, সেটাকে সামলে নিয়ে সোজা হলো ও। ‘ব্যাপার না, এইটাই আমার কাজ। তবে তুমি ওভাবে না বাঁচালে আমিও আজ শেষ হতাম, কপাল ভালো যে গলায় প্যাচানো সাপটা আমাকে না কামড়ে ওই ব্যাটাকে কামড়েছিল, না হলে তো,’ বলে ও চলে এলো পাথরের ওপরে রাখা নিজের পোশাকের কাছে। প্রায় শুকিয়ে এসেছে। তুমি একটু অন্যদিকে ঘুরবে?’
শামানের প্রশ্ন শুনে কালন্তি মাথা উঁচু করে তাকাল, তারপর ওর প্রশ্নটা বুঝতে পেরে নিমিষে ফিরে তাকাল অন্যদিকে। শামান ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন জায়গার ব্যথা অগ্রাহ্য করে পোশাকগুলো পরে নিতে শুরু করল।
কালন্তি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে চলেছে, ‘একটা ব্যাপার বুঝলাম না, লিচ্ছবী আর উরগরা এক হলো কিভাবে?’
‘কেন এক হতে সমস্যা কোথায়?’ শামান পোশাক পরে নিতে নিতে শরীরের ক্ষতগুলো পরীক্ষা করে নিল। কোনোটাই মারাত্মক নয়। তবে সবগুলো মিলিয়ে অনেক কাহিল লাগছে ওর। লোহার জালের ফতুয়ার মতো জিনিসটা গায়ে চাপিয়ে নিয়ে তার ওপরে পোশাক পরে নিয়ে পিঠে তলোয়ার চাপাতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। উরগদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে একটা কাতানা হারিয়ে এসেছে। বিশেষ এই জিনিসটা হারানোর চেয়ে নিজের একটা চোখ হারালেও এতটা কষ্ট লাগত না ওর। বিরক্ত মুখে কালন্তির সামনে এসে দাঁড়াল ও, ‘উরগদের সঙ্গে এক হতে লিচ্ছবীদের সমস্যা কি?’ আবারো জানতে চাইল।
‘সমস্যা আছে,’ কালন্তি মুখ তুলে তাকাল শামানের দিকে। ‘উরগরা ভয়ংকর, ওরা মূলত এক ধরনের বেদে জাতীয় গোত্র। এই মুলুকে ওদেরকে সবাই চেনে কালো জাদু আর সাপের পুজো করার জন্যে। ওদের ভয়ংকর এক ওঝা আছে সে নাকি মৃতদেরকেও জীবিত করতে পারে। উরগরা হলো কালো জাদুর ওস্তাদ। তাই ওদেরকে কেউ ঘাঁটায় না আবার ওদের সঙ্গে কেউ খুব বেশি লাগতেও যায় না। মূলত ওদেরকে সবাই এড়িয়ে চলে। লিচ্ছবীরা যদি উরগদের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকে তবে পুরো ব্যাপারটাতে বিরাট কোনো ঘাপলা আছে।’
‘হুম, বুঝেছি,’ বলে শামান কোনোমতে পা সামলে নিয়ে কালন্তির সামনে একটা পাথরের ওপরে হাত পা ছাড়িয়ে বসল। ‘আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, কিছু মনে করো না, হাজার হলেও তুমি রাজকুমারী।’
কালন্তি হেসে উঠল। আমি রাজার মেয়ে হলেও রাজকুমারী নই,’ বলে সে বেশ রহস্য করে হেসে উঠল। এই প্রথম শামান খেয়াল করল, হাসলে মেয়েটাকে অসম্ভব রহস্যময়ী লাগে। ও বিভিন্ন ধরনের মানুষের নানা ধরনের হাসি দেখেছে-কিন্তু হাসলে কোনো মানুষকে এতটা রহস্যময় লাগতে পারে কখনো ভাবেনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ও, তবে মেয়েটা খেয়াল করছে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
‘মনটা খারাপ লাগছে, আমার জোড়া তলোয়ারটা আমার জন্যে বিশেষ কিছু ছিল, ওটা হারিয়ে…’
‘হারায়নি তো,’ বলে কালন্তি যে পাথরের ওপরে বসে ছিল সেটার পাশে ঘাসের ওপর থেকে কাতানা তুলে শামানের দিকে বাড়িয়ে দিল। রক্ত আর কাদা লেগে আছে ওটাতে। জিনিসটা দেখে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠল শামান।
‘তুমি এটা কোথায় পেলে?’ জিনিসটাকে পরিষ্কার করতে করতে আনন্দের সঙ্গে জানতে চাইল ও।
‘উরগদের সঙ্গে যেখানে তোমার মারামারি হয়েছিল সেখানেই মাটির ওপরে পড়ে ছিল। এটা দিয়েই আমি আহত দ্বিতীয় উরগকে নিকেশ করেছি। ছোটো বাচ্চারা মিষ্টির দলা পেলে যেরকম খুশি হয়ে ওঠে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এটা পেয়ে তুমি তারচেয়ে বেশি খুশি হয়ে গেছ,’ কালন্তিকে দেখে মনে হচ্ছে শামানের খুশি তার ভেতরেও খানিকটা প্রবাহিত হচ্ছে।
‘তুমি জানো না এটা আমার জন্যে কি?’ জিনিসটা পরিষ্কার করে কালন্তির দিকে বাড়িয়ে ধরল। ‘দেখো,’ বলে কালো রঙের কাতানাটার সোনালি রঙের কিনারায় একটা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
‘বাহ, জিনিসটা দেখি রং পরিবর্তন হয়।’
‘হ্যাঁ, এই তলোয়ার পৃথিবীতে খুব কমই আছে। বিশেষ একটা উল্কাপিণ্ড থেকে সংগ্রহ করা ধাতু থেকে বানানো তলোয়ারটাতে নাকি স্বয়ং বুদ্ধের আর্শীবাদ আছে।’
‘তাই নাকি?’ কালন্তি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল। ‘আচ্ছা যোদ্ধা, তোমার ব্যাপারটা আসলে কি বলো তো? তুমি এতটা ঝুঁকি নিয়ে এই অচেনা অজানা দেশে চলে এলে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে, নিশ্চয়ই অনেক কিছু পাচ্ছো এর বিনিময়ে?’
তলোয়ারটাকে খাপে ঢুকিয়ে পিঠের ওপরে ভালোভাবে বসিয়ে নিল ও। ‘একটা মুদ্রাও না,’ বলে ও কালন্তির দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘আমি ভাড়ার টাকায় যুদ্ধ করার জন্যে এখানে আসিনি।’
‘কিন্তু আমি তো জানতাম লাল চুলের যোদ্ধা আর তার দল স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া একটা পা ও ফেলে না,’ বলে সে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শামানের দিকে
কালন্তির দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে উঠল শামান। ঠিকই শুনেছো তোমরা। তবে সব ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নয়। ডুকপা লামা আমার পরিবারের মতো। আমাকে দেখে হয়তো বুঝতে পেরেছো, আমি একেবারেই অন্যরকম দেখতে। আমি আসলে জানি না আমি এমন কেন, আমার পরিবার কারা, আমি কোত্থেকে এসেছি। ছোটোবেলায় ডুকপা লামা আমাকে এক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উদ্ধার করেন। উনিই আমাকে শান্তির মঠে নিয়ে শ্রমণ হবার জন্যে দীক্ষা দিতে শুরু করেন। উনিই আমাকে একটা পরিবার দেন। তবে আমি সেটা রক্ষা করতে পারিনি, শ্ৰমণ না হয়ে আমি হয়েছি যোদ্ধা। কিন্তু তার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুক কমেনি। তাই তার এই বিপদে এগিয়ে আসাটা আমার কর্তব্য। তবে এখানে আরো একটা ব্যাপার আছে,’ বলে শামান একটা ছোটো পাথর তুলে নিয়ে পানিতে ছুড়ে দিল।
‘শান্তির মঠের বর্তমান দায়িত্ব প্রাপ্ত শ্রমণ লামা নোরবু আমাকে এই অভিযানে আসার আগে একটা কথা জানান, যেটা আমি আগে জানতাম না। ডুকপা লামা আমাকে উদ্ধার করার সময়ে আমার গলায় নাকি একটা চামড়ার তঞ্জুরের মতো ছিল। সেটার ভেতরে বিচিত্র এক ভাষায় লেখা অনেকগুলো দস্তাবেজ ছিল। ডুকপা লামা নিজে বহু বছর সেগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন, কিন্তু ওগুলোর কোনো মানে উদ্ধার করতে পারেননি। হয়তো ওগুলোতে লেখা আছে আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, আমার পরিবার আমার নিজের লোকদের কথা। ওই দস্তাবেজগুলো কোথায় আছে একমাত্র ডুকপা লামা জানেন, কাজেই তাঁকে আমার খুঁজে বের করতে হবেই, যদি উনি বেঁচে থাকেন। কারণ হয়তো ওগুলোতেই আমি খুঁজে পাবো আমার নিজের পরিচয়, আমার জাতির সন্ধান।’
‘চলো যোদ্ধা, বেলা পড়তে শুরু করেছে। আমাদের অনেক পথ হাঁটতে হবে, তার ওপরে তুমি যেভাবে আহত হয়েছো,’ বলে কালন্তি উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিল শামানের দিকে। তার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াল।
‘আমরা এখান থেকে তোমাদের ডেরায় ফিরব কিভাবে?’ শামান জানতে চাইল।
কালন্তি হাত তুলে সামনে দেখাল। ‘আমরা এখান থেকে মাইলখানেক পর্যন্ত নদীর তীর ধরে এগোব। যেখানে নদীটা ডানে বাঁক নেয়ার কথা সেখান থেকে আমরা বাঁকের উলটো দিকের জঙ্গলে ঢুকে সামনে এগোতে থাকব। আমার ধারণা যদি সঠিক হয় তবে জঙ্গলের ভেতরে একটা পথ পাবো আমরা। সেটা ধরে মাইল পাঁচেক গেলে একটা হাট পাওয়া যাবে, আমরা ওই পথটা ধরে এগোব কিন্তু হাট পর্যন্ত যাব না, তার আগেই আবারো জঙ্গলে ঢুকে আরো মাইল দুয়েক হাঁটলেই আমরা ডেরার কাছাকাছি পৌঁছে যাব।’
কালন্তির বর্ণনা শুনে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল শামান। ওর ভঙ্গি দেখে হেসে উঠল কালন্তি। ‘চলো শুরু করি, যত দ্রুত রওনা দেয়া যাবে ততই তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে। কাজেই চলো।’
ওরা নদীর কিনারা ধরে হাঁটতে লাগল। ‘রাজকুমারী, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি। মানে, সত্যি কথা বলতে কি-তোমার মতো রাজার মেয়ে আমি এর আগে দেখিনি। এমন বিশেষ করে এমন যুদ্ধবাজ রাজকুমারী। হা হা,’ শামানের সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল কালন্তি।
যুদ্ধবাজির তো কিছু দেখোইনি এখনো,’ বলে কালন্তি হাঁটতে হাঁটতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আমি আসলে বাবা মানে থারু রাজা মানরুর পালক কন্যা। এ কারণেই তখন বলছিলাম যে আমি রাজার মেয়ে হলেও রাজকুমারী নই।’
শাক্যদের ওপরে তোমার এত রাগ কেন? কিছু মনে করো না, ওদের সঙ্গে তোমার কথোপকথন দেখে এমনটাই মনে হয়েছে আমার,’ শামানের শরীর দুর্বল লাগলেও হাঁটতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না।
কালন্তি কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে শামান তার দিকে ফিরে দেখল কালন্তির চোখ জোড়া যেন জ্বলছে। ‘শাক্যরা হলো বেঈমানের জাত। বাবা ওদেরকে আশ্রয় দিয়ে বিরাট ভুল করেছে, দেখো তুমি। ওরা সবসময় উপকারীর অপকার করতে পারঙ্গম।’
‘কিন্তু তোমার বাবা যেটা ভাবছে সেটাও তো ভুল নয়। বিশ বছরের শত্রুতা ভুলে উনি এই উপত্যকায় শান্তি স্থাপন করতে চাইছেন সেটা আমি সমর্থন করি। কারণ…’
‘শোন যোদ্ধা, শামানকে কথা শেষ করতে দিল না কালন্তি। ‘তুমি এই এলাকার ইতিহাস জানো না। এ কারণেই এ কথা বলছো কিন্তু সত্যিটা হলো; বাবা যা চাইছে সেটা কোনোদিনই হবে না। কারণ শাক্যরা হলো শয়তান আর কাপুরুষ। তোমাকে ইতিহাস বলি, আমি আর আমার যমজ বোন তখন আমাদের বয়স ছয়- সাত বছর। আমরা থারু গোত্রের ছোটো একটা অংশ ছিলাম। রাজা মানরুর শাসনের অন্তর্ভুক্ত হলেও আমরা দূরবর্তী এক জায়গায় বাস করতাম। আমার মনে পড়ে আমার বাবা চর্মকার ছিল, সুখের সংসার ছিল আমাদের। তখন সবেমাত্র রাজা মানরু শাসক হয়েছেন, শাক্য আর থারুদের ভেতরে তখন ব্যাপক যুদ্ধ চলছিল। সদ্য তরুণ রাজা মানরুর ওপর শাসন ভার আসতেই শাক্যরা তার ওপরে সমানে আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু বয়সে তরুণ হলেও রাজা বেশ ভালোভাবেই সামলাতে থাকেন পরিস্থিতি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উভয় গোত্রেরই ক্ষতি হতে থাকে। রাজা মানরু চিন্তা করেন এভাবে যুদ্ধ জিতেই বা কি হবে—তাই উনি শাক্যদের কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠান। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শাক্যরা তা মেনে নেয়। দুই দল যখন
আলোচনায় বসেছে এমন সময় বাবাকে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে ওরা একে একে তার সামরিক শক্তি ধ্বংস করতে থাকে, সেইসঙ্গে দখল করে নেয় রাজা মানরুর রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ। রাজা মানরু বাধ্য হয়ে তাঁর গোত্রের লোকজন নিয়ে পালিয়ে আসেন এই জঙ্গলে,’ ওরা নদীর বাঁকের কাছে এসে নদীকে ডানেই রেখে
বাম পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।
‘যা বললাম এসব বোঝার মতো বয়স তো আমার তখন ছিল না, এসব আমি পরে জেনেছি। কিন্তু সেদিনের কথা আমার পরিষ্কার মনে পড়ে, এসব যুদ্ধ থেকে আমাদের গোত্রের অংশটা বেশ দূরেই ছিল কিন্তু শাসনযন্ত্রের চাকা যখন ঘুরতে শুরু করে সবাইকেই সেই বৃহত্তর চক্রের অংশ হতেই হয়। আমরাও সেটার বাইরে থাকতে পারিনি। আমি আর আমার ছোটো বোন সেদিন বাড়ির বাইরে খেলছিলাম, মা ঘর কন্না করছিল, বাবা তার নতুন সংগ্রহ করা চমড়াগুলো শুকাতে দিচ্ছিল এমন সময় আমাদের গ্রামে প্রায় কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়ে শাক্যদের সৈন্যবাহিনী। আমার পরিবারসহ আমাদের গ্রামের সবাইকে খুন করে ওরা। আমার চোখের সামনে আমার মাকে, বোনকে…’ কালন্তির চোখের দৃষ্টি চলে গেছে বহুদূরে, যেন সেই বিভৎস সময়টাকে দেখতে পাচ্ছে সে চোখের সামনে।
‘ওরা সবাইকে মারে, সবাইকে, একে একে,’ বলে সে শামানের দিকে ফিরে তাকাল। ‘আমি জানি তুমি কী ভাবছো যোদ্ধা, আমি কিভাবে বেঁচে গেলাম। আমার দাদির কারণে। গ্রামে শাক্যদের আক্রমণ হতেই আমার দাদি আমাকে গ্রামের একমাত্র ইদারার ভেতরে ফেলে দেন। ইদারা চেনো তো কুয়া। পানি তোলার জন্যে মাটিতে গভীর গর্ত করে কিনারা বাঁধিয়ে রেখে দেয়া হয়, যাতে যেকোনো সময় যেকেউ দড়িতে বেঁধে কোনো পাত্র ফেলে পানি তুলতে পারে।’
‘তুমি মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ির গল্প করছো, রাজকুমারী। আমি পাহাড়ি এলাকার লোক, মাইলকে মাইল ধূসর পাহাড়ের অনেক জায়গাতে কুয়োই পানির একমাত্র ভরসা।’
‘দাদি আমাকে কুয়োয় ফেলে দেন, ওই অন্ধকার গর্তের ভেতরে শ্যওলা আর জলজ গাছের দঙ্গলের ভেতরে বসে আমি শুনতে পাই আমার গ্রামের মানুষদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের সেই মরণ আর্তনাদ আমি আজো পরিষ্কার শুনতে পাই আমি। সবচেয়ে বিভৎস ব্যাপার শুরু হয় সবাইকে খুন করার পর। শাক্যরা গ্রামের মানুষদের মেরে ফেলে দেয় কুয়োর ভেতরে, বাকিদেরকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আমার বাপ-মা-বোন-দাদিসহ আরো কয়েকজনের লাশের সঙ্গে আমি ওই অন্ধকার কুয়োর ভেতরে তিন দিন-চার রাত পড়ে থাকি। আজো আমি রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠি পচা লাশের গন্ধ পেয়ে, নিজের বাবা- মায়ের অর্ধগলিত লাশের চেহারা দুঃস্বপ্নে ভেসে ওঠে আমার।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে শামান ফিরে তাকাল মেয়েটার দিকে। মেয়েটার মনের গভীরে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে অনুভব করে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ‘এরপর?’
‘অন্ধকার কুয়োর ভেতরে পচা লাশের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি যখন মৃত্যুর অপেক্ষা করছি তখন ওপরে পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই। শত্রু-মিত্র জানা নেই, কিন্তু আর কোনো রাস্তাও নেই। তাই যতটুক শক্তি অবশিষ্ট ছিল সেটা দিয়ে চিৎকার করতে থাকি। রাজা মানরুর লোকেরা আমাকে দড়ি বেঁধে কুয়ো থেকে টেনে তোলে। রাজা আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। রাজা মানরুর নিঃসন্তান স্ত্রী মানে আমার মা আমাকে নিজের সন্তান হিসেবে ঘোষণা করেন। এ নিয়ে তাদেরকেও নিজের গোত্রের ভেতরে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি, তবুও তারা অটল ছিলেন,’ বলে কালন্তি ফিরে তাকাল শামানের দিকে। ‘সেই ছোটোবেলা থেকে আমার একটাই নিয়তি ছিল। আমি যোদ্ধা হবো, জীবনে যতজন পারি শাক্যদেরকে খুন করব। এখন তুমি বলো সেই শাক্যদেরকে যদি আমার বাঁচাতে হয় তবে আমি সেটা কিভাবে সহ্য করব?’
শামান আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি,’ বলেই সে নিজেকে সংশোধন করল। ‘মানে অনুধাবন করতে পারছি। কিন্তু কখনো সকলের ভালোর জন্যে হলেও কিছু ব্যাপার মেনে নিতেই হয়।’
শামান ভেবেছিল এই কথা শুনে কালন্তি রেগে উঠবে কিন্তু হলো বরং উলটো। সে একেবারেই শান্তভাবে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমারও সেটাই কথা। কিন্তু আমাকে আগে ভালোটা বুঝতে হবে তো নাকি? আজ আমি সকলের ভালোর কথা চিন্তা করে শাক্যদেরকে মাথায় তুলে নিচ্ছি, কিন্তু কাল যদি মাথায় তুলে নেয়া এই লোকগুলো আমার নিজের মানুষগুলোর ক্ষতি করে তবে সে দায়ভার কে নেবে। কারণ শাক্যদেরকে আমি একবিন্দু বিশ্বাস করি না।’
শামান দেখল, ওরা নদীর বাঁক থেকে অনেকক্ষণ হলো একটা জঙ্গলে হাঁটছে, এখন সেটা একটা পথের কিনারায় এসে থেমে গেল। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ডানে মোড় নিয়ে রাস্তাটা উলটো দিকে চলে গেছে।
‘এটাই কি সেই পথ নাকি?’ শামান হাঁটুর ওপরে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ, দেখে তো তাই মনে হচ্ছে,’ বলে ওই মোড়ের অন্যদিকে দেখে কালন্তি বলে উঠল, ‘দাঁড়াও একটু নিশ্চিত হয়ে নেই। আমরা…’ কালন্তি কথা শেষ করার আগেই রাস্তার বাঁকের অন্যপাশে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। সেইসঙ্গে ঘোড়াকে ধমক দিচ্ছে এরকম একটা গলা। সঙ্গে সঙ্গে শামানের একটা হাত চলে গেল শরীরের পেছন দিকে। তলোয়ারের বাটের ওপরে চেপে বসল আঙুল। শামান দেখল কালন্তিও এক হাতে চেপে ধরেছে কোমরে পেঁচিয়ে রাখা চাবুকের বাট।
জঙ্গলের ওপাশ থেকে কে আসছে জানা নেই। যেই আসুক মোকাবেলা করতে হবে, কারণ পালাবার সময় নেই।