অধ্যায় পঁচিশ – বর্তমান সময়
সুরমা আবাসিক এলাকা, আখালিয়া, সিলেট
রাগের সঙ্গে গট গট করে হেঁটে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো তানভীর। সোজা হেঁটে একটু আগের বিধ্বস্ত সেই ড্রইংরুমের সোফায় এসে ধপ করে বসে পড়ল।
চিন্তা-ভাবনা সব এলোমেলো লাগছে। কিছুক্ষণ দুই হাতে মুখ চেপে বসে রইল। মন মস্তিষ্ক কোনোকিছুই ঠিক ঠাক মতো কাজ করছে না। মুখ ঢেকে চুপ চাপ বসে কিছুক্ষণ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করল ও। নিজেকে শান্ত করার জন্যে এরচেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। কিছুক্ষণ পর অনেকটাই শান্ত হয়ে এলো উত্তপ্ত মস্তিষ্ক। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই নিজেকে ধমক লাগাল ও এরকম পাগলামি করার জন্যে। সেইসঙ্গে নিজের ভেতরের সত্ত্বা ওকে ভর্ৎসনা করল এতগুলো বছর এরকম একটা স্বার্থপর একটা অমানুষের জন্যে নিজেকে কষ্ট দেয়ার কারণে।
‘স্যার, আপনি ঠিক আছেন?’ ওর পাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কোমল। ‘স্যার, মিসেস মিতায়নই আপনার সেই পুরনো প্রেমিকা তাই না?’ সুলতানের প্রশ্ন শুনে তার দিকে চোখ তুলে তাকাল তানভীর। বসা অবস্থাতেই তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল ও।
উঠে দাঁড়িয়ে সুলতানের কাঁধে একটা হাত রাখল, তারপর আরেকটু হেসে যোগ করল, ‘হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু এখন সেটা আর কোনো ব্যাপার না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, চলো কাজে নামি,’ বলে ও এগোতে গিয়েও থেমে গেল। ‘আচ্ছা আমি অনেকক্ষণ ধরেই মনে হয় তোমাকে আর টমিকে তুমি বলে ডাকছি তোমাদের কোনো সমস্যা নেই তো?’
সুলতানের পাথরের মতো চেহারায় যেন একটু ফাটল দেখা দিল, অনেকে সেটাকে হাসি বলে ধরে নিতে পারে। ‘না, স্যার। আমার কোনো সমস্যা নেই আর আমার মনে হয় না টমিরও কোনো সমস্যা আছে। কারণ আমিও তাকে টমি স্যার বাদ দিয়ে টমি ডাকি।’
মৃদু হেসেই ওকে নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করল তানভীর। কেউ একজন পানির গ্লাসের ভাঙা টুকরো আর পানি পরিষ্কার করেছে। টমি আর লায়লা বসে কথা বলছিল, ওকে দেখে থেমে গেল। দুজনেই ফিরে তাকাল ওর দিকে। টমির চোখে মুখে কৌতূহল। আর লায়লার চোখে যেন আবেগে সঙ্গে খানিকটা ভয়ও দেখতে পেল তানভীর।
দুজনার দিকে তাকিয়েই মৃদু হেসে ও জানাল। ‘আমি এক্সট্রিমলি সরি ফর মাই বিহেভিওর। আমার মনে হয় আমরা কাজে ফিরে যেতে পারি। মিসেস লায়লা আপনি আবার শুরু করুন প্লিজ, টমি তুমি নোট নাও।’
লায়লা একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। তানভীরের হঠাৎ এই অতি স্বাভাবিক আচরণ তার কাছে খুবই অস্বাভাবিক লাগছে। ‘মিতায়নের সঙ্গে আমার পরিচয় ইত্যাদি তো বললাম, আপনারা নির্দিষ্টভাবে আর কী জানতে চাচ্ছেন একটু হিন্টস দিলে আমার জন্যে বলতে সুবিধে হবে,’ লায়লা এখনো তানভীরের দিকেই তাকিয়ে আছে। সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছে ওর মানসিক অবস্থা।
‘আসামে উনাদের প্রজেক্ট নিয়ে বলুন প্লিজ, সেইসঙ্গে উনার হারিয়ে যাবার সময়টার ব্যাপারে যদি…’ টমি নির্দিষ্ট পয়েন্টের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই তানভীর একটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল।
‘তার আগে আমি আপনাদের ব্যাপারে জানতে চাই, আপনাদের ভেতরে কেমন সম্পর্ক ছিল, ব্যক্তি হিসেবে ডক্টর মিতায়ন কেমন ছিলেন, এসব ব্যাপারে আমার মনে হয় একটু ধারণা থাকা উচিত, কারণ আপনি উনার স্ত্রী, আপনিই তাকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন,’ বলে ও যোগ করল। ‘আমি যতটুকু শুনেছি আপনার সঙ্গে বিয়ে হবার আগে উনি অন্য ধর্ম থেকে কনভার্ট করেন।’
লায়লা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি। ও আমাকে বিয়ে করার আগে অন্য ধর্ম থেকে কনভার্ট করে। আমাদের ভেতরে সম্পর্ক হবার পর বিয়ের আগে এটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো বাধা। মিতায়ন অবশ্য ধর্ম-টর্ম ইত্যাদি নিয়ে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না কিন্তু আমি একেবারে গোঁ ধরে ছিলাম ও কনভার্ট না করলে বিয়ে করব না। কাজেই আমাকে বিয়ে করতে হলে ওর জন্যে এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
‘একটা প্রশ্ন,’ বলে তানভীর টমির দিকে তাকিয়ে নোট নিতে বলল। ‘তারমানে আপনি বলতে চাইছেন ডক্টর মিতায়ন কনভার্ট করেন ঠিকই কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা সুখী ছিলেন না?’
‘মোটেই আমি সেটা বলিনি,’ লায়লার চোখ একটু বড়ো হয়ে গেছে। ‘আমি বলেছি আমিই বিয়ের আগে ওকে শর্ত দিয়েছিলাম আমাকে বিয়ে করতে হলে ওকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে,’ বলে সে একটু যেন আনমনা হয়ে উঠল। ‘আর সত্যি কথা হলো, এই ব্যাপারটা নিয়ে সুখী দুঃখী তো পরে, এটা নিয়ে আমার মনে হয় মিতায়ন কোনোদিন ভাবেওনি। স্বামী হিসেবে মিতায়ন খুবই কর্তব্যপরায়ণ, কোনো ব্যাপারেই আমাকে কখনো বাধা দেয়নি, আমার কোনো চাহিদাই অপূর্ণ রাখেনি, আর তা ছাড়া ওর টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই, কাজেই সেদিক থেকে আমাদের কখনোই সমস্যা হয়নি কিন্তু,’ বলে সে একটু থেমে গেল। কথা বলতে যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছে। সম্ভবত পারিবারিক ব্যাপার বলেই কি না, হয়তো বলার আগে ভাবছে। ভাবারই কথা, বিশেষ করে পুরনো প্রেমিকের সামনে বর্তমান স্বামীর কোনো নেতিবাচক দিক আলোচনা করতে গেলে যে কেউ দ্বিধা করবে।
‘কিন্তু কি. মিসেস মিতায়ন?’ তানভীর জানতে চাইল। ‘শুনুন, আমরা এখানে এসেছি একেবারেই প্রফেশনাল কাজে, সে মহিলার চোখের একেবারে গভীরে তাকাল সেই পুরনো দিনের মতো। মানুষ একই আছে, চাহনিও একই আছে, বদলে গেছে শুধু দুই চাহনির অন্তর্নিহিতি অর্থ। ‘আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি আপনি আমাদের সঙ্গে যা শেয়ার করবেন সেটা পুরোপুরি গোপন রাখা হবে। আর সেইসঙ্গে এটাও জানিয়ে দিচ্ছি আপনার দেয়া কোনো তথ্য ব্যক্তিগত কোনো কাজে বা কোনো কারণে আপনার বা আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন আমার কথা?’
লায়লা মাথা নাড়ল। ‘বুঝতে পেরেছি। না, আমি যা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা খুব গোপন বা ব্যক্তিগত কিছু না। আসলে,’ বলে সে একবার অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘মিতায়ন, মানে আমার হাজবেন্ড একেবারেই ভিন্ন ধরনের মানুষ। আমি আর কী বলব, এটা এখন পুরো সাস্ট ক্যাম্পাস জানে। বিয়ের আগে ওকে আমার যেমন মনে হতো বিয়ের পরে আমি দেখলাম ও একেবারেই ভিন্ন একজন মানুষ,’ বলে সে খানিকটা হাসল। তানভীরের মনে হলো যেন তার হাসিতে অল্প হলেও অভিমানের ক্লেশ মিশে আছে।
‘আপনি একটু আগে বললেন না আমি তার স্ত্রী আমি তাকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি, আসলে ব্যাপারটা উলটো। আমার মনে হয় আমার চেয়ে তার কাজের লোকজন তাকে আরো অনেক বেশি কাছ থেকে দেখেছে। বিয়ের পর থেকে আমি দেখে আসছি পারিবারিক দায়িত্ব সব পালন করলেও সে পরিবারের চেয়ে তার প্রজেক্ট, তার গবেষণা এসব নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে।
‘বুঝতে পেরেছি,’ তানভীর আনমনেই মাথা নাড়ল। ‘এই চিত্র কি গত তিন বছর ধরে একই রকম?’
‘নাহ,’ মাথা নাড়ল লায়লা। ‘আমাদের বিয়ের প্রথম বছরে ও এতটা ব্যস্ত ছিল না। কিন্তু দিন গেছে ওর আসামের প্রজেক্টে ব্যস্ততা বেড়েছে। আর গত এক বছর ধরে তো বলতে গেলে ও প্রায় বাসাতেই থাকত না। বেশির ভাগ সময় ভারতেই ছিল। আর যতদিন দেশে থাকত তার বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকত কাজের জায়গায়।’
তানভীর আপনাতেই একবার সুলতানের দিকে তাকাল। সুলতানও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের মধ্যে চোখে চোখে কথা হলো। তানভীর নিজের মোবাইলের টেক্সট বক্সে একটা কথা লিখে এগিয়ে দিল সুলতানের দিকে। সুলতান সেটা পড়ে নিয়ে একবার মাথা নেড়ে লায়লার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, ‘আমরা মনে হয় ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছি। আপনি বলতে চাইছেন ডক্টর মিতায়ন নিজের পরিবারের চেয়ে সবসময় নিজের কাজকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন, তাইতো?’
‘ব্যাপারটা আসলে ঠিক তেমনও নয়। মিতায়ন এতটাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকত যে আমি ওর স্ত্রী হবার পরও আমাদের মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য একটা দেয়াল দাঁড় করানো ছিল। আমি চাইলেও মিতায়নের সেই বলয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পারতাম না,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘কিন্তু ও চাইলেও আমার যেকোনো ব্যাপার নিজের মতো করে নিতে পারত। দিন দিন এই ব্যাপারটা যেন বাড়ছিল।’
‘আচ্ছা, ওই সময়ের ব্যাপারটা বলেন,’ এবার তানভীর প্রশ্ন করল। ‘মানে উনি যখন থেকে হারিয়ে গেলেন আরকি,’ বলে ও আবারো ফিরে তাকাল সুলতানের দিকে। ‘কি ঘটেছিল, কিভাবে ঘটেছিল, বিস্তারিত জানালে খুব ভালো হয়।’
‘আশা করি আপনারা পুলিশকে দেয়া আমার বয়ান পড়েছেন বা জেনেছেন’ – লায়লার কথা শেষ করার আগেই টমি যোগ করল, ‘হ্যাঁ, সেটা রেকর্ডে আছে। আপনি যা যা বলেছেন সবই খতিয়ে দেখা হয়েছে, তবে আমার মনে হয় আরেকবার আমাদের সামনে বললে আমাদের জন্যে সুবিধে হবে। সেইসঙ্গে আরেকটু বিস্তারিত যদি বলা যায় তাহলে আরো ভালো হয় কারণ পুলিশকে আপনি কী বলেছিলেন সেটা আমি জানি না কিন্তু বয়ানে যেটা লেখা আছে সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত।’
‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আমি আবারো বিস্তারিত বলছি। আপনাদেরকে আগেই বলেছি মিতায়ন গত এক বছর ধরেই বেশ ব্যস্ত ছিল আসামের ওই প্রজেক্ট নিয়ে। আমাকেও বেশিকিছু বলত না ওই ব্যাপারে। তবে আমি এটুকু জানতাম যে এই প্রজেক্টের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সংস্থা জড়িত সেইসঙ্গে এর পেছনে প্রচুর ফান্ডিংও হয়ে গেছে। ওরা যে কাজের পেছনে ছুটছিল সেটা হলে সম্ভবত বেশ বড়ো কোনো আবিষ্কার হতো। যাই হোক, আমি মিতায়নের কাজের ধরন দেখে এটা বুঝতে পারছিলাম, ওরা সম্ভবত কাজের একেবারে শেষ দিকে চলে গেছে। এর আগে প্রায় দুই মাস আসামে থেকে এসে পনেরো দিনের মতো দেশে ছিল। এরপরই আবার এক মাসের জন্যে ওরা চলে যায় ভারতে। ভারতে গেলে ওরা সাধারণত কবে থেকে কবে পর্যন্ত থাকবে এরকম একটা সময় বা তারিখ আমাকে মিতায়ন জানিয়ে যেত। গত কয়েকবারের অভিযানেই এই ডেট বারবার ডিলে হয়েছে। কাজেই এবার যখন ওর ফিরে আসার তারিখ পার হয়ে গেল—আমি খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না।
তাহলে কখন বুঝতে পারলেন যে ডক্টর আসলে হারিয়ে গেছেন বা উনার কোনো ক্ষতি হয়েছে?’ তানভীর জানতে চাইল।
প্রতিবারই তানভীর যখন কোনো প্রশ্ন করছে লায়লা একবারও সরাসরি ওর দিকে তাকাচ্ছে না, এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। তানভীর প্রশ্ন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে আনমনে একবার অন্যদিকে তাকিয়ে দেখল একবার তারপর তানভীর আর সুলতানের মাঝামাঝি তাকিয়ে বলতে শুরু করল। ‘হ্যাঁ, সত্যি কথা যে মিতায়নের ফিরে আসার তারিখ পার হয়ে যাবার পরেও খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না আমি। তবে যেদিন ও হারিয়ে গেল সেদিন প্রায় মাঝরাতে আমি একটা ফোন কল পাই। কলটা করেছিল মিতায়ন। যদিও ওটা মিতায়নের নম্বর ছিল না।’
‘এই কলটা কি ট্রেস করা হয়েছে?’ টমির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল তানভীর।
টমি ল্যাপটপে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করে ওর দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘না, স্যার আমি ব্যবস্থা করছি।’
‘আচ্ছা, আপনি বলুন প্লিজ,’ লায়লার দিকে ফিরে বলে উঠল তানভীর।
‘কলটা পেয়ে আমি একটু অবাক হই। অবাক হয়েছিলাম কারণ মিতায়ন সাধারণত কখনোই এই সময়ে দেশে ফেরে না। আর দেশে ফিরলেও এভাবে কল করে না। তো যাই হোক, ও জানায় ওরা তামাবিল বর্ডার দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। এটাও একটু ব্যতিক্রম। কারণ এই রুটে আমি কখনো ওদেরকে যাতায়াত করতে শুনিনি। আরো অবাক হই ও আমাকে অনুরোধ করে যেন আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রাখি। কারণ ও আমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাবে,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘আমাকে যদি কেউ বলত ভূমিকম্পে পুরো সিলেট ধ্বংস হয়ে গেছে তাও বোধহয় আমি এতটা অবাক হতাম না। কারণ বিয়ের পর মিতায়ন আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া তো দূরে থাক এমনকি হানিমুনেও যাইনি আমরা। সেই ও কি না নিজে থেকে আমাকে বলছে বেড়াতে যাবে, অবাক করার মতোই। আসলে তখন এত খুশি লাগছিল তাই এতকিছু ভাবিনি।
‘ফোনে কথা বলার সময়ে আপনার কাছে ডক্টর মিতায়নকে কি খুশি লাগছিল নাকি অন্যরকম? মানে আপনার কি কিছু মনে পড়ে?’ তানভীর প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছিল ওকে। ও হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার, ও আমাকে বলেছিল ওদের আসামের প্রজেক্ট ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে।’
তানভীর ব্যাপারটা নোট প্যাডে টুকে নিল। ‘এরপর কি হলো? আপনি কখন বুঝতে পারলেন যে ডক্টরের কোনো ক্ষতি বা সমস্যা হয়েছে?’
‘কথোপকথনের ওই পর্যায়ে আমাকে ব্যাগ-ট্যাগ রেডি করতে বলে ও জানাল, ওরা তামাবিল থেকে সোজা এয়ারপোর্টে যাবে, সেখানে বিদেশি অতিথিদের জন্যে চার্টার করা প্লেন রেডি করা আছে, সেখানে গিয়ে তাদেরকে প্লেনে উঠিয়ে ও একবার নিজের অফিসে যাবে, সেখান থেকে বাসায় এসে সকালের নাশতা করার কথা দুজনের একসঙ্গে। আমি সকালে উঠে সব রেডি করে ব্যাগ পর্যন্ত গুছিয়ে রাখলাম, কিন্তু বেলা গড়াতে থাকল ওর খবর নেই। ভোর থেকে সকাল, সকাল থেকে দুপুর কিন্তু কোনো খবর এলো না। দুপুরের পর দিয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠি, ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করি, ওর অফিসে যোগোযোগ করার চেষ্টা করেও ওকে পাইনি। আর হ্যাঁ, বারবার ওর মোবাইলে চেষ্টা করেও পাইনি। মোবাইল নম্বর বন্ধ ছিল। এরপরে আরো বেলা বাড়লে বিকেলের দিকে আমি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলে ভার্সিটির প্রক্টরের সঙ্গে কথা বলি, উনিই আমাকে পরামর্শ দেন থানায় যোগাযোগ করতে। এর পরেরটুকু তো আপনারা জানেন। ওই দিন রাতেই আমার পরিবারের লোকেরা ঢাকা থেকে আমার সঙ্গে এসে থাকতে শুরু করে, আজ একটু আগে বেরিয়ে যাবার পরেই তো,’ এইপর্যন্ত বলে লায়লা শিউড়ে উঠল।
‘আচ্ছা, তো বিষয় এখন পর্যন্ত দাঁড়াল। ডক্টর মিতায়ন আর তার টিম সফলভাবে আসামের প্রজেক্ট সমাপ্ত করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর তারা যা যা করার কথা ছিল সেগুলোর কোনোটাই করেনি বরং তারা মাঝপথেই হারিয়ে যায়,’ এইটুকু বলে তানভীর টমির দিকে ফিরে বলে উঠল। টমি, তুমি আমার সঙ্গে নোট মেলাও,’ বলে ও নোট প্যাড থেকে পড়তে শুরু করল। ‘প্রথমেই তামাবিল বর্ডারের ব্যাপারটা কনফার্ম করা দরকার, ডক্টর মিতায়ন আর তার টিম ওইদিক দিয়ে ওই সময়ে প্রবেশ করেছিলেন কি না?’
‘স্যার, এটা চেক করা হয়েছে, ভোর তিনটার একটু সময় পরে তামাবিল দিয়ে প্রবেশ করে তারা,’ দরজার কাছ থেকে ইকবাল বলে উঠল। তাকে ইশারায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বলল তানভীর। ইকবাল ভালো হয়েছে আপনি এসেছেন। টমির সঙ্গে সঙ্গে আপনিও মেলাবেন আমার নোটগুলো। মিসেস মিতায়নের কাছে যে কল এসেছিল সেটা কি ট্রেস করা হয়েছে?’
টমি আর ইকবাল দুজনেই মাথা নাড়ল। করা হয়নি।
‘এটার ব্যবস্থা করেন। মিসেস মিতায়নের কথা থেকে বুঝলাম বিদেশি অতিথিদের বিদায় দেয়ার জন্যে সিলেট এয়ারেপোর্টে একটা ভাড়া করা প্লেন থাকার কথা ছিল। সেটার ব্যাপারে কোনো খোঁজ নেয়া হয়েছে?’
ইকবালকে দেখে মনে হলো এইমাত্র সে এই ব্যাপারে জানতে পারল। অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করল তানভীর। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার কেউই ধরতে পারল না, এ কেমন কথা। ‘ওটার ব্যাপারে জলদি খোঁজ নেয়ার ব্যবস্থা করেন,’ বলে ও আরেকটু ভেবে যোগ করল। ‘খোঁজ নেবেন, ওই প্লেন কোনো কোম্পানি থেকে ভাড়া করা হয়েছিল, ওটাতে কেউ ফ্লাই করেছে কি না। বলে ও লায়লার দিকে ফিরে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা লায়লা,’ বলেই ও আনমনে জিভ কাটল। ‘মিসেস মিতায়ন, আপনি বললেন, ডক্টর মিতায়ন আপনাকে বলেছিল উনি বিদেশি মেহমানদের বিদায় দিয়ে উনার অফিসে যাবেন, সেখান থেকে কিছু কাজ সেরে বাসায় ফিরবেন, উনি কি নির্দিষ্ট করে বলেছিলেন কোনো অফিসে যাবেন? মানে ডিপার্টমেন্টের অফিসে নাকি সিলেট মিলেনিয়ামে যে অফিস ছিল সেটাতে?’
লায়লাকে দেখে বেশ অবাক মনে হলো। ‘দুটোর একটাতেও না। ইনফ্যাক্ট সিলেট মিলেনিয়ামে তাদের যে একটা অফিস আছে সেটাই তো আমি জানতাম না। ওদের এই প্রজেক্টের মূল অফিস বলতে তো আমি জানতাম লাক্কাতুরা টি-এস্টেটে যে অফিস আছে সেটার কথা। আমি তো জানি লাক্কাতুরার বাংলোতে ওরা যে অফিস বসিয়েছে সেটাই ওদের এই কাজের মূল অফিস। আর বিদেশি গেস্টরা এলেও মূলত সেখানেই অবস্থান করত।’
টমি ইকবাল আর তানভীর তিনজনেই প্রায় একই সময়ে লায়লার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর অনেকটা রোবটের মতোই একে অপরকে দেখল। সবারই চোখে জিজ্ঞাসা।
‘মানে কি?’ তানভীর অবাক হয়ে লায়লার দিকে ফিরে জানতে চাইল। ‘লাক্কাতুরার অফিস মানে? ডক্টর মিতায়নের সমস্ত কাগজপত্র আর ডিপার্টমেন্টে তো এন্ট্রি দেয়া আছে ডিপার্টমেন্টের অফিস আর সিলেট মিলেনিয়াম মার্কেটের চতুর্থ তলায় একটা ডাবল রুমের অফিসের, লাক্কাতুরার কোনো অফিসের কথা তো কোথাও বলা হয়নি।’
এবার লায়লার অবাক হবার পালা। ‘কি বলছেন এসব! আমি তো জানতাম লাক্কাতুরার অফিসটাই ওদের মূল অফিস।’
‘মিসেস মিতায়ন, আপনি নিশ্চিত এই ব্যাপারে?’ টমি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল। ‘কারণ আমি ডক্টরের প্রজেক্টের সমস্ত কাগজ ঘেঁটেও কোথাও এই ব্যাপারে কোনো উল্লেখ পাইনি।’
‘অবশ্যই আমি নিশ্চিত। আমি এমনকি গেছিও ওখানে একবার,’ লায়লা জোর গলায় বলে উঠল। ‘আমার মনে হয় আপনারা কোথাও ভুল করছেন,’ লায়লা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ‘আপনারা আমার হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে খুঁজে বের করার জন্যে কাজ করছেন আর এখনো তার মূল অফিসটা কোথায় সেটাই জানেন না, এ কেমন কথা?’
তানভীর ফিরে তাকাল টমি আর ইকবালের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে টমি মাথা নাড়ল, সে কিছু জানে না। ইকবালকে একটু বোকা বোকা দেখাচ্ছে। ‘স্যার, আমি নিশ্চিত এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো ডকুমেন্টে কিংবা কারো মুখে এই কথা শুনিনি আমরা কেউই।’
‘আমি ইকবালের বক্তব্য সমর্থন করি,’ টমি তার ল্যাপটপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলে উঠল। ‘কারণ কোনো ডক্যুমেন্টেই এই অফিসের কথা লেখা নেই।’
‘এমনকি ডিপার্টমেন্টেরও কেউই এই অফিসের কথা জানে না,’ টমির সমর্থন পেয়ে ইকবাল একটু ভরসা পেয়েছে, তাই তার গলার জোরও বেড়েছে খানিকটা।
‘ঠিক আছে,’ তানভীর বলে উঠল। ‘মিসেস মিতায়ন, আপনি আমাদের বলতে পারবেন ডক্টর মিতায়নের এই অফিসটা কোথায়?’
তানভীরের প্রশ্নটা শুনে লায়লা আনমনেই একটু মাথা নাড়ল। আমি সঠিকভাবে আপনাদের বলতে পারব না। তবে, ওটা লাক্কাতুরা টি-এস্টেটের আশপাশে,’ লায়লা মনে মনে জায়গাটা সঠিক অবস্থান মনে করার চেষ্টা করছে।
‘মানে, কি এয়ারপোর্ট রোডে?’ তানভীর লায়লার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সঙ্গে সঙ্গে তানভীর টমির দিকে তাকিয়ে ইশারা করল ম্যাপে ওটার অবস্থার বের করার জন্যে।
‘এয়ারপোর্ট রোডেই,’ লায়লা বলে চলেছে। সম্ভবত সিলেট স্টেডিয়াম পার হয়ে লাক্কাতুরা টি-এস্টেট যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই কোথাও,’ বলেই সে একটু ভেবেই প্রায় চিৎকার করে উঠল। ‘মনে পড়েছে। জায়গাটা লাক্কাতুরা টি- এস্টেট আর আর মালিনীছড়া টি-এস্টেটের মাঝামাঝি কাতিয়া নামক একটা জায়গায়।
টমি বেশ দ্রুতই তার ল্যাপটপ ঘেঁটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর সে তানভীরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘বস, কাজ হলো না। লাক্কাতুরা আর মালিনীছড়ার এন্ট্রি দেয়া আছে কিন্তু কাতিয়া নামক কোনো জায়গা এখানে শো করছে না। না গুগল ম্যাপে, না আমাদের নিজস্ব ম্যাপে।’
তানভীর অবাক হয়ে একবার টমিকে দেখল, এরপর ফিরে তাকাল লায়লার দিকে, নিজেদের ম্যাপ, গুগল ম্যাপ কোথাও উল্লেখ নেই জায়গাটার, এ কেমন কথা!