অধ্যায় তেইশ – বর্তমান সময়
সুরমা আবাসিক এলাকা, আখালিয়া, সিলেট
শোবার ঘরের সামনে এসে বড়ো করে দম নিল তানভীর। শার্ট আর জ্যাকেট টেনে ঠিক করে নিল। একবার মোবাইল বের করে দেখল। বাস বা প্লেন জার্নির সময়ে অনেক সময় তীব্র বমি গলার কাছে এসে ঠেকে থাকলে যেরকম গা গুলাতে শুরু করে, অনেকটা সেরকম অনুভূতি হচ্ছে ওর। আনমনেই একবার ঢোক গিলে ভেতরে প্রবেশ করল ও। কিন্তু ভেতরে কেউই নেই।
বেশ অবাক হয়েই আশপাশে তাকাল ও, যদিও মানুষের গলার স্বর ভেসে আসছে কিন্তু বেডরুমে কেউ নেই। শব্দের উৎস অনুসন্ধান করার চেষ্টা করল ও। সম্ভবত বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় আছে কেউ। বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া সামনের দিকে একটা বারান্দা আছে সেটায় চলে এলো ও। বৈকালিক চা পানের জন্যে বারান্দায় টেবিল-চেয়ার পাতা। সেটাতে এই মুহূর্তে বসে আছে তিনজন মানুষ। একজন ডাক্তার, তার সঙ্গেই নার্স আর তাদের উলটো দিকে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বসে আছে মিসেস মিতায়ন ওরফে লায়লা।
বারান্দায় প্রবেশ করে ডক্টর আর নার্সের উদ্দেশে সামান্য মাথা নেড়ে একটা বেতের চেয়ার টেনে বসে পড়ল তানভীর। সরাসরি লায়লার চোখের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নেড়ে যথাসম্ভব ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠল, ‘মিসেস মিতায়ন, আপনি ঠিক আছেন?’
তানভীরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে বলে উঠল, ‘হ্যালো, তানভীর।’ একদৃষ্টিতে তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তানভীরও তার দিকে একইরকম ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। লায়লার চোখ দুটো গর্তে বসা, বেশ শুকনো লাগছে তাকে, চেহারা যেন খানিকটা লাল। সম্ভবত একটু আগের ধাক্কা এখনো পুরোপুরি সামলাতে পারেনি সে।
‘মিসেস মিতায়ন, আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, তানভীর নিজের মোবাইলের নোটপ্যাড বের করল। আমি তানভীর মালিক, ইমার্জেন্সি অ্যাকশন ফোর্সের মুখপাত্র হিসেবে ডক্টর মিতায়ন অন্তর্ধান কেসের তদন্ত কর্মকর্তা। আপনার হাজবেন্ড ডক্টর মিতায়ন….
‘কেমন আছো, তানভীর?’ লায়লা তার হাতে ধরা পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।
কোনো জবাব না দিয়ে তানভীর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লায়লার দিকে। যদিও তাকে এই মুহূর্তে বিধ্বস্ত লাগছে তবু এই বিধ্বস্ততার আড়ালে চাপা পড়া তার আগের সেই সৌন্দর্য এতটুকু মলিন হয়নি। মুহূর্তের জন্যে পুরনো সব স্মৃতি ওর মাথার ভেতরে তীব্র গরমে ঠান্ডা বাতাসের ঝলকের মতো বয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে তানভীর কঠিন গলায় বলে উঠল, ‘মিসেস মিতায়ন, আমি এখানে এসেছি আমার প্রফেশনাল কাজের সূত্রে। কাজেই সব ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারগুলো বাদ দিয়ে কাজের কথা…
‘কাট দ্য বুলশিট, তানভীর…’ ঝামটে উঠল লায়লা। ‘আমি জানি তুমি আমার ওপর কী পরিমাণ রেগে আছো। কাজেই…’
‘কোনো রাগারাগি নেই,’ তানভীরও সমান ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিল। মানুষ রাগ করে মানুষের ওপরে। অমানুষের সঙ্গে আবার রাগ কিসের?’ বলে ও লায়লাকে দেখল। রাগে লাল দেখাচ্ছে তার চোখ-মুখ। ডাক্তার আর নার্স পরস্পরের মধ্যে অবাক দৃষ্টি বিনিময় করছে। ওরা মনে হয় বুঝতে পারছে না আসলে কী ঘটছে এখানে।
‘প্রয়োজন শেষ তো প্রিয়জন শেষ, এইতো তোমার পলিসি ছিল তাই না?’ তানভীর চেয়ার টেনে এক ধাপ এগিয়ে গেল ওর দিকে। ‘আমি, একটা বেকার ছেলে, নিজের পড়ালেখার ঠিক নেই, আর তখন তুমি বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক হতে চলেছো। আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা তোমার জন্যে ছিল ডিসক্রেডিট, ইমেজের ব্যাপার তাই না?’ বলে ও ঝট করে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়ানো অবস্থায় দুইহাত টেবিলের ওপরে রেখে খানিকটা ঝুঁকে এলো লায়লার দিকে। ‘একবারও ভেবে দেখেছিলে তোমার বেঈমানি মানুষ হিসেবে আমার ওপরে কতটা…কতটা বাজে প্রভাব ফেলতে পারে…’
তানভীর তুমি একবারও কি…’ লায়লা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল।
কিন্তু তাকে কথা শেষ করতে দিল না তানভীর। ‘তুমি আমাকে স্রেফ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলে লায়লা-ময়লা-আবর্জনার মতো। আমি এক বছর ঘুমাতে পারিনি। আমার নিজেকে স্রেফ এক টুকরো আবর্জনা বাতিল জিনিস ছাড়া আর কিছু মনে হতো না। কখনো ভেবে দেখেছো, নিজেকে এক টুকরো আবর্জনা মনে হলে কেমন লাগে? নিজেকে এক টুকরো ময়লা ন্যাকড়ার চেয়ে মূল্যহীন মনে হতো আমার কাছে, স্রেফ ব্যবহার করে ফেলে দেয়া এক টুকরো ময়লা ন্যাকড়া…’ তানভীর উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার গ্রিলের কাছে চলে এসেছে। ‘কোনো মানুষের এতটা নিচে নামা উচিত না, কোনো মানুষের উচিত না কাউকে এতটা নিচু করা…’ আবেগে গলা বুজে আসছে তানভীরের। ক্ষোভ আর আবেগের জমাটবাঁধা এক বোমা মনে হচ্ছে নিজেকে। যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে এমন এক বোমা। ।
‘তানভীর তুমি কি কখনো আমার দিকটা ভেবে দেখেছো, কখনো কি মনে হয়েছে আমাকেও আত্মপক্ষ…’ তানভীর ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল লায়লার চোখে পানি ডাক্তার আর নার্স বারান্দার দুজনেই অবাক চোখে দেখছে ওদের এই ইমোশনাল যুদ্ধ, সুলতান অর টমিকেও ও দেখতে পেল বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
‘কোনোই প্রয়োজন নেই,’ তানভীর বলে উঠল। ‘কোনো দরকার নেই পুরনো বিষয় ঘাঁটাঘাঁটি করার। আমরা এখানে কাজে এসেছি, আর সেটাই করা উচিত আমাদের। আমি দুঃখিত,’ বলে ও হাতের ইশারায় সুলতান আর টমিকে ভেতরে আসতে বলল। সুলতান ভেতরে এসে ডাক্তার আর নার্সকে পাশের রুমে অপেক্ষা করতে বলে দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়।
ওদের দিকে তাকিয়ে তানভীর বলে উঠল, ‘আমি মিসেস মিতায়নের ডিটেইল ইন্টারভিউ চাই। টমি নোট রাখবে,’ বলে আগের মতোই কঠিন চোখে ফিরে তাকাল লায়লার দিকে। তার ভেজা চোখদুটো ওর ভেতরে আবেগের এক ঝড় তৈরি করার চেষ্টা করতেই সেটাকে ঠেলে নিজের ভেতরে চাপিয়ে কাজে মনোযোগ দিল ও। মিসেস মিতায়ন-’
‘লায়লা আহমেদ। ওটাই আমার নাম, আর সেটা ব্যবহার করাটাই বেটার হবে,’ লায়লাও নিজেকে যথাসম্ভব আবেগহীন করার চেষ্টা করছে। টেবিলের ওপরে রাখা টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ-মুখ মুছে নিল সে।
‘আমরা আপনার হাজবেন্ডের ব্যাপারে জানতে চাই,’ তানভীরের পাশে বসা সুলতান প্রশ্ন করল। ‘একেবারে ডিটেইল বললে ভালো হয়। আপনাদের পরিচয় সম্পর্ক এসব থেকে শুরু করে উনি কেমন মানুষ, কী কাজ করতেন সেইসঙ্গে অবশ্যই উনার অন্তর্ধানের ব্যাপারে যতটা বিস্তারিত বলা সম্ভব।’
‘আজ থেকে তিন বছরের কিছু সময় আগে এই ক্যাম্পাসেই মিতায়নের সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন সাস্টে আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট মাত্র খুলেছে। ডিপার্টমেন্ট খোলার কিছুদিন পরেই ডক্টর মিতায়ন এসে জয়েন করে ডিপার্টমেন্টে। নতুন খোলা ডিপার্টমেন্ট হিসেবে আর্কিওলজি তখন অনেক ব্যাপারেই কোলাবোরেটলি কাজ করত অ্যানথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে। আর সেই কোলাবোরেশনের দায়িত্বে ছিলাম আমি। ডক্টর মিতায়নের সঙ্গে ওভাবেই আমার পরিচয়। বয়সে আমার থেকে বেশ বড়ো হলেও তার ব্যক্তিত্ব, সফলতা, অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি দেখে আমিই প্রথম মুগ্ধ হই বলতে দ্বিধা নেই। তার সঙ্গে পরিচয়ের ছয় মাস পরে আমরা বিয়ে করি, সেটা আজ থেকে বছর তিনেকের কিছু কম সময় আগে হবে,’ লায়লা বলে চলেছে।
লায়লার কথা শুনছিল আর একটু একটু করে কুঁচকে উঠছিল তানভীরের ভ্রু। ‘এরপর আপনারা…’
সুলতান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে দিল তানভীর। ‘এটা আপনার দ্বিতীয় বিয়ে?’ আচমকাই প্রশ্ন করল তানভীর।
হঠাৎ করে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল লায়লা, কিছু একটা যেন ধরতে পারছে সে, কোথায় যেন বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে। একটু চুপ থেকে অন্যদিকে ফিরে অনেকটা যেন আনমনেই বলে উঠল, ‘না, এইটাই আমার প্রথম বিয়ে।’
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তানভীরের ভেতরে। সময় যেন খানিকটা স্লো-মোশনের মতো বয়ে যেতে লাগল কিছুক্ষণ, তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়াল ও। এতটাই জোরে যে ওর পায়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বেতের চেয়ারটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেল, থর থর করে কেঁপে উঠল ওর সামনের টেবিলটা। সবাই তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু লায়লার কোনো বিকার নেই, সে তাকিয়ে আছে বারান্দার বাইরে।
তানভীর যখন কথা বলে উঠল, ওর কণ্ঠস্বর শোনাল প্রায় ফিসফিসে। ‘তারমানে আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে যখন তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি ছুটির সময় বাড়িতে গিয়ে বিয়ে করে এসেছো, সেটা মিথ্যে ছিল!’
লায়লা ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে, তার দুই চোখের মণি দু-টুকরো ঘোলাটে শ্যাওলা পড়া পাথরের মতো। সেই পাথর থেকে গড়িয়ে পড়ল পানির ধারা। কিছু না বলে সে তাকিয়ে রইল তানভীরের দিকে।
‘তুমি কাজটা ইচ্ছে করে করেছিলে, কারণ তুমি আমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছিলে না, চট করে সামনে এগিয়ে এলো ও। ‘তুমি আমাকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে মিথ্যে বিয়ের ছবি দেখিয়েছিলে, চট করে এগিয়ে এসে টেবিলের ওপরে রাখা পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে সেটা বারান্দার দেয়ালে সর্বশক্তিতে ছুড়ে মারল তানভীর।