অধ্যায় সতেরো – সময় : ২০০৭
খ্রিস্টাব্দ শাবিপ্রবি ক্যাম্পাস, সিলেট
রিকশাওয়ালার ভাব দেখে বিরক্তির সঙ্গে ডি বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে সরে এলো তানভীর।
মধ্যদুপুরের এই সময়টাতে ক্যাম্পাসে রিকশা-গাড়ি পাওয়াটা দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে দুপুরবেলার শেষ বাসটা ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবার পর হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দুয়েকটা রিকশা যাও থাকে তারা তখন প্রেসিডেন্ট বুশের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান।
হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে এসে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল তানভীর। এই সময়ে বাস মিস করলে মহাবিপদ। গেট পর্যন্ত যেতে হলে হেঁটেই যেতে হবে। ওর ব্যাকপ্যাকটা একদিকে আটকানো ছিল, সেটার ভেতরে দুই হাত গলিয়ে দিয়ে, কানে হেডফোন লাগিয়ে মনে মনে ভাবল হাঁটাই যখন নিয়তি তবে সেটা যত দ্রুত শুরু করা যায় ততই ভালো।
লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে গোল চত্বর পর্যন্ত এসে একটু হলেও খুশি হয়ে উঠল ও। কারণ দুপুরবেলা হলেও রোদের তাপ বলতে গেলে একেবারেই নেই। তবে আকাশ দেখে মনে হচ্ছে—বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। দ্রুত পা চালাতে শুরু করল ও। খানিকটা এগিয়ে ভিসি ভবন পার হয়ে শিক্ষকদের ডরমেটরির অংশটা পার হচ্ছে এমন সময় রাস্তার অন্যপাশে চোখে পড়ল লম্বা এক জোড়া পা।
শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে জিন্স আর শার্ট পরা মেয়ে বলতে গেলে খুবই কম, তাই এই বিশেষ পোশাকধারী মেয়েটাকে চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই-সেই র্যাগওয়ালি-ব্যান্ডের গায়িকা। পেছনে ব্যাকপ্যাক, খুলে দেয়া সিল্কি চুল ঝোড়ো বাতাসে উড়ছে আর কানে মোবাইল। তবে তানভীর বেশি অবাক হলো তাকে একা দেখে। মেয়েটাকে ক্যাম্পাসের এখানে-ওখানে যতদিন দেখেছে সর্বক্ষণই তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে একদল বান্ধবী। আজ একা কেন ঠিক বুঝতে পারল না ও।
মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে কথা বলছে। হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গেই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে জোরে পা চালাল তানভীর। খানিকটা এগিয়ে আড়চোখে একবার দেখে নেয়ার জন্যে চোখ ফেরাতেই ধরা পড়ে গেল সে। মেয়েটা রাস্তা পার হয়ে একেবারেই ওর পেছন পেছন হাঁটছিল। ও সামান্য ফিরে তাকাতেই হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে শাসনের ভঙ্গিতে কিছু একটা বলল, কিন্তু কানে হেডফোন থাকাতে শুনতে পেল না তানভীর।
‘সরি, কিছু বলছিলেন?’ তানভীর একটু দ্বিধান্বিত, আসলে কী বলবে বুঝতে পারছে না।
মেয়েটা কিছু না বলে লম্বা পা ফেলে আরেকটু এগিয়ে এলো ওর দিকে। ‘অবশ্যই বলছিলাম,’ বলে সে হেসে ফেলল। আর হাসিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তানভীর অনুভব করতে পারল, কেন এই মেয়ের জন্যে পুরো ক্যাম্পাস পাগল। ‘বলছিলাম, আড়চোখে আমাকে দেখা হচ্ছিল, তাই না?’
‘ক্বী, মানে…’ এভাবে ধরা পড়ে যাবে কল্পনাতেও অনুমান করতে পারেনি তানভীর। ‘আমি আপনাকে দেখব কেন?’ কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবার পরেও তানভীর অনুধাবন করল কতটা বোকার মতো হয়েছে সেটা।
ওর সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার মুখ মুহূর্তের ভেতরে গম্ভীর হয়ে গেল, পরমুহূর্তে গলা কাঁপিয়ে হেসে উঠল সে। ‘মানে কী বলতে চাচ্ছো, আমি দেখার যোগ্য না?’ হাসিটা শেষ করেই সে আবারো আগের মতো কৃত্রিম গম্ভীর হয়ে গেল। তার চোখ জোড়া এখনো হাসছে।
‘না না, আমি সেটা বলিনি,’ প্রায় আঁতকে ওঠার মতো বলে উঠল তানভীর। ‘আর বলতে হবে না, চলো হাঁটি, পেটের ভেতরে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে ক্ষুধায়, ‘ বলে হাঁটতে শুরু করে দিল। তানভীরও পা মেলাল তার সঙ্গে।
‘আজকে আপনি একা যে?’ তানভীর জানতে চাইল। ‘সবসময় তো দেখি…’ ‘তারমানে তুমি সবসময় আমাকে দেখো?’ দুষ্টামি ভরা তীব্র চোখে ফিরে তাকাল সে তানভীরের দিকে।
‘না মানে, আমি সেটা বলিনি, বলেছি…’ তানভীরের ভেতরে পুরনো অস্বস্তিটা ফিরে ফিরে আসছে। এই মেয়েটা এমন কেন, যেমন চোখের চাহনি, তেমনি কথার তেজ। ‘বলেছি, যখনি দেখি সবসময় আপনার সঙ্গে একদল বান্ধবী থাকে। আজ একা যে?’
‘ইয়া,’ বলে সে মাথার সিল্কি চুল দোলাল। ‘তুমি যদি দেখতে ভালো হও, তার ওপরে আবার নানাবিধ গুণসম্পন্ন হও তাহলে দেখবে তোমার চারপাশে মানুষজনের কোনো অভাব হচ্ছে না। তবে তাই বলে তারা সবাই তোমার শুভাকাঙ্ক্ষি না,’ বলেই সে চট করে একটু এগিয়ে এলো তানভীরের দিকে। ‘বাহ, তুমি কি সর্বক্ষণই গান শোনো নাকি?’ বলে সে তানভীরের এক কান থেকে খুলে রাখা হেডফোনটা নিজের কানে লাগাতে লাগাতে বলে উঠল।
‘আজ কী শুনছো? ওয়াও, স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন, লেড জ্যাপলিন,’ মেয়েটার কথার দিকে কোনো মনোযোগ নেই তানভীরের। এক কিলো পথের সবুজে ছাওয়া পথে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঝলকে মেয়েটার সিল্কি চুল এসে বাড়ি খেল ওর মুখে। ‘বাহ্, তোমার গানের চয়েজ সত্যি অসাধারণ,’ হেডফোন নামিয়ে রেখে আবারো হাঁটতে শুরু করল সে।
‘স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন!’ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে টিটকিরিসুলভ ভঙ্গিতে বলতে লাগল তানভীর। ‘একটা রিকশা পেলাম না গোল চত্বর টু গেট, ‘স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন’ শুনে কী হবে?’
প্রায় খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা। ‘তাতে তো ভালোই হলো, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, এই যে আমরা কথা বলতে বলতে যাচ্ছি,’ বলে মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আসলে হলে যেতে খুব বিরক্ত লাগছিল। হলের বিরক্তিকর খাবার খেয়ে খেয়ে অসহ্য হয়ে গেছি। তাই ভাবলাম গেটে গিয়ে ভিন্ন কিছু খাওয়া যায় কি না। ভালোই হয়েছে তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। আচ্ছা তুমি কি গান-টান করো নাকি? সর্বক্ষণ এত ভালো ভালো গান শোনো। কই তোমাকে তো সাস্টের দুটো ব্যান্ড ক্লাবের একটাতেও দেখলাম না।’
‘না না, আমি গান-টান পারি না, আমি গান গেলে মনে হয় মরচে পড়া লোহার ওপরে কেউ শিরিষ কাগজ ঘষছে—’ হেসে উঠল তানভীর।
তাহলে ভবিষ্যতে মিউজিক করার ইচ্ছে আছে নাকি?’ এক কিলো পথের মাতাল বাতাসে পাগলের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটার চুল। চোখ সরিয়ে নিল তানভীর। কিছু সৌন্দর্য আছে চোখে আরাম দেয়, আর কিছু সৌন্দর্য যেন আগুন ধরিয়ে দেয় চোখে। মায়াভরা এক কিলোতে এই জ্বালা ধরা সৌন্দর্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে বারবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে তানভীর।
‘নাহ, মিউজিকের মানুষ আমি না,’ বলে তানভীর একটু থেমে যোগ করল। ‘আমি লেখালেখির মানুষ। ভবিষ্যতে রাইটার হতে চাই। এইজন্যেই ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছি।’
‘ওহ রাইটার, না? কুল, আচ্ছা তুমি তাহলে ইংরেজিতে পড়ো,’ বলে মুখটাকে ভিন্ন একটা ভঙ্গি করে বলে উঠল, ‘দেখ তো অবস্থা, তোমার সঙ্গে সেই কখন থেকে কথা বলছি, তোমার নাম, ইয়ার কিছুই জানা হলো না।
‘তানভীর, এখন টু-টুতে আছি।’
‘সেকেন্ড ইয়ার, সেকেন্ড সেমিস্টার, এই ছেলে তুমি তাহলে আমার জুনিয়র। তুমি আমাকে আপু ডাকছো না কেন?’ বলে হেসে উঠল সে। তানভীরও হেসে উঠল।
‘আমি লায়লা, লায়লা ফেরদৌস,’ বলে সে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে যোগ করল। ‘এরিক ক্ল্যাপটনের ‘ল্যায়লা’ গানটা কেন এত প্রিয় এখন বুঝতে পারছো তো?’
তানভীর মৃদু হেসে রহস্যময় একটা ভঙ্গি করে বলে উঠল, ‘আপনি জানেন কি না জানি না, এরিক ক্ল্যাপটন যখন এই গানটার নাম ঠিক করে সে কিন্তু লায়লা- মজনুর সেই বিখ্যাত প্রেমকাহিনি দ্বারা ইন্সপায়ার্ড ছিল।’
‘তাই নাকি,’ অবাক চোখে লায়লা ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। ‘এটা তো জানতাম না। ওহ যাক, গেট এসেছে অবশেষে।
ওরা এক কিলো পথ পার হয়ে গেটের বাইরে চলে এসেছে। তানভীরের দিকে তাকিয়ে লায়লা বলে উঠল, ‘তুমি বয়সে ছোটো হলেও বহুত ট্যটনা। আরেকদিন সময় করে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে। আজকের মতো বিদায় নিই।’
হঠাৎ তানভীরের কী হলো কে জানে। ‘আজো আড্ডা দেয়া যায়,’ বলে ও কাঁধ ঝাঁকাল। ‘মানে যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে। আমিও এখনো লাঞ্চ করিনি। বাগবাড়িতে আমি দারুন একটা রেস্টুরেন্ট চিনি। চমৎকার টাকি মাছের ভর্তা আর পুদিনা পাতা দেয়া ডাল পাওয়া যায়। যদি আপনার দেশি খাবার ভালো লাগে আরকি।’
মুহূর্তখানেক তানভীরের দিকে তাকিয়ে রইল লায়লা ফেরদৌস। দুজনেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একে অপরের চোখের দিকে। ধীরে ধীরে লায়লার মুখে ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি। ‘সত্যি কথা হলো, হলের খাবারে বিরক্ত হয়ে দেশি খাবারের জন্যেই আমি বাইরে এসেছিলাম,’ বলে সে রিকশার দিকে ইশারা করল। ‘দারুণ হবে, বহুদিন টাকি মাছের ভর্তা খাই না। আচ্ছা তুমি তো আমাকে বললে না কী ধরনের লেখালেখি করো তুমি?
‘এখনো করি না, পরিকল্পনা করছি, নভেল লেখার,’ রিকশায় উঠতে উঠতে জবাব দিল তানভীর। মনে মনে অনুভব করতে পারছে ওর জীবনের সেরা রিকশা ভ্রমণ হতে যাচ্ছে এটা।
***
‘স্যার, আমরা চলে এসেছি,’ সামনে থেকে ইকবালের কথা শুনে সচকিত হয়ে উঠল তানভীর। ওদের মাইক্রো শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের গোলচত্বর ঘুরে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে অ্যাকাডেমিক ভবন ‘ডি’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। আনমনেই তানভীরের চোখ চলে গেল বহু বছর পর ফিরে আসা নিজের ক্যাম্পাসের চারপাশে।
কতদিন? প্রায় এক দশক পর ফিরে এলো সে নিজের প্রাণের ক্যাম্পাসে। কতকিছু বদলে গেছে, তবে অনেক কিছুই রয়ে গেছে একেবারে আগের মতো। আগের চেয়ে অনেক বেশি জমজমাট হয়েছে ক্যাম্পাস, চারপাশে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী দেখা যাচ্ছে। ওরা যখন পড়ত তখন দুপুরের সময়ে এত ছাত্র-ছাত্রী থাকত না, তবে সবচেয়ে বেশি অবাক করল ওকে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলতে থাকা প্রচুর অটোরিকশা বা টমটম। আগে ক্যম্পাসের ভেতরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কিছুই ঠিকমতো পাওয়া যেত না। এখন অটোরিকশায় করে হরদম যাতায়াত করছে লোকজন।
মাইক্রো ‘ডি’ বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামতেই মাইক্রো থেকে নেমে এলো ওরা। ড্রাইভার রসুল মিয়াকে মাইক্রো পার্ক করে অপেক্ষা করতে বলে তানভীর সুলতান আর ইকবালকে নিয়ে ‘ডি’ বিল্ডিংয়ের ভেতরের দিকে এগোল। লোকজন কৌতূহলী চোখ তাকাচ্ছে ওদের দিকে। বিশেষ করে পুলিশের পোশাক পরা সাব ইন্সপেক্টর ইকবালকে দেখে অনেকেই তাকিয়ে আছে। ‘ডি’ বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ওরা সোজা চলে এলো আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টে। ডিপার্টমেন্টের কেরানির সঙ্গে কথা বলে ওরা ডক্টর মিতায়নের রুমটা খুলে দিতে বলল।
তানভীর জানতে চাইল ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপারসন আছেন কি না। কারণ ওর কাছে মনে হচ্ছে তার সঙ্গে কথা বলা উচিত। কিন্তু সেটা আর করা হলো না। কারণ সে ছুটিতে আছে। ডিপার্টমেন্টের আর কোনো শিক্ষকও এই প্রজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না, তাই অন্য কারো সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। বরং ওরা চলে এলো ডক্টর মিতায়নের রুমে।
সাধারণ আর দশটা শিক্ষকদের কামরার মতোই। তবে একটু পার্থক্য আছে। কারণ এটাতে একপাশে বসার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সঙ্গে অন্যপাশে আলাদা একটা অংশ আছে সেখানে কয়েকজন বসে আলাদা করে আলাপ করার জন্যে কয়েকটা চেয়ার আর একটা ওয়ার্কিং টেবিল রাখা। সঙ্গে আলাদা দুটো কেবিনেট। ডিপার্টমেন্টের কেরানি এসে দেখিয়ে যেতেই ওরা কাজে নেমে পড়ল। সুলতান আর ইকবালকে ক্যাবিনেট থেকে ফাইলপত্র বের করতে বলে ও চলে এলো ডক্টর মিতায়নের ডেস্কের কাছে। টেবিলের ওপরে খুবই সাধারণ জিনিসপত্র। আর দশজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টেবিলে যেরকম থাকে ওরকমই। খাতা-পত্রের ফাইল, কলমদানিতে এক গাদা মার্কার, পেপারওয়েট। পাশের দেয়ালে লাগানো সাপ্তাহিক ক্লাসের রুটিন, পরীক্ষার শিডিউল।
টেবিলের ওপরে একদফা চোখ বুলিয়ে নিয়ে ও একটার পর একটা ড্রয়ার টেনে দেখতে লাগল, কিছুই নেই কোথাও। চলে আসতে যাবে হঠাৎ টেবিলের ওপরে একটা জিনিস চোখে পড়ল। পেপারওয়েট। হাতে তুলে নিয়ে দেখতে লাগল। কাচের একটা পেপারওয়েট, ভেতরে স্বচ্ছ তরলের ভেতরে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়, তার সামনে ছোটো একটা ফলকে লেখা ‘ওয়লকাম টু নেপাল’। জিনিসটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, কামরার অন্য প্রান্ত থেকে ইকবাল ডাক দিয়ে উঠল, ‘স্যার, এখানে সব কাগজ নামানো হয়েছে।’
‘আসছি,’ বলে জিনিসটা রেখে ও চলে এলো টেবিলের কাছে এসে একটু অবাক হয়ে গেল। ‘এই?’ ও ভেবেছিল টেবিলের ওপরে কাগজ আর ফাইলের স্তূপ দেখে মাথা ঘুরে যাবে! মাথা সত্যি ঘুরে গেছে তবে সেটা কাগজপত্রের পরিমাণের স্বল্পতা দেখে। ‘এত অল্প কাগজপত্র!’
‘স্যার, ক্যাবিনেটের চারটে ড্রয়ারের মধ্যে দুটো একেবারেই খালি একটাতে সব পরীক্ষার খাতা আর একটাতে এই কয়টা ফাইল পেলাম,’ সাব ইন্সপেক্টর ইকবাল অনেকটা অসহায়ের মতো বলে উঠল।
চিন্তিত মুখে কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল তানভীর। মনের ভেতরে ওর হিসেব মিলছে না। কোথাও কোনো ঝামেলা অবশ্যই আছে। ‘চেক করে দেখেন কাগজগুলো। যদিও আমার মনে হয় না এখানে কিছু আছে,’ বল ও একটা আঙুল তুলল। ‘এগুলো দেখে নিয়ে কেরানির কাছে জিজ্ঞেস করেন ডক্টর মিতায়নের ওয়াইফ কোনো রুমে বসে। শুনেছিলাম উনিও এখানকারই টিচার। সম্ভবত অ্যানথ্রপলজি ডিপার্টমেন্টের। ‘কাগজগুলো চেক করে উনাকে খুঁজে বের করেন। আমি উনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি বাইরেই আছি, আপনাদের কাজ শেষে উনাকে খুঁজে পেলে আমাকে টকিতে জানাবেন,’ বলে ও বাইরে চলে এলো।
‘ডি’ বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে নিশ্বাস নিল বুক ভরে। আহ্, কতদিন পর ক্যাম্পাসের বাতাস। একটা সময় ছিল যখন এই বাতাস প্রতিদিন না নিলে কেমন জানি দম বন্ধ লাগত। সপ্তাহে দুই দিন; শুক্রবার আর শনিবার ক্লাস হতো না। দুই দিন ক্যাম্পাসে যাব না, ভাবাই যেত না। আর এখন, দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর ফিরে এলো প্রাণের ক্যাম্পাসে।
সামনে হাঁটতে হাঁটতে ‘ডি’ বিল্ডিংয়ের রাস্তার বিপরীতে ‘এ’ বিল্ডিংয়ে যাবার পথে হঠাৎ অর্জুন তলাটা চোখে পড়ল ওর। বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা একটা বিট মিস করল যেন। তীব্র কষ্টের একটা স্রোত বুকের গভীর থেকে উঠে আসার চেষ্টা করতেই সেটাকে প্রাণপণে দমিয়ে অইদিকে তাকিয়ে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে চলে এলো ও। এই অর্জুনতলাতেই ঘটেছিল ওর জীবনের কুৎসিততম ঘটনা। মাস্টার্স ফার্স্ট সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন পেয়েছিল সেদিন, আজো পরিষ্কার মনে পড়ে। তারপরে, আবারো ভাবতেই সেই ভয়ংকর কষ্টের স্রোতটার সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল নিজের ভেতরে। হাঁটতে হাঁটতে কখন ফুডকোর্টের কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি ও।
ফুডকোর্টের সামনে পেতে রাখা একটা বেঞ্চের ওপরে বসে পড়ল ও। সজনে গাছের হালকা ছায়ার নিচে পেতে রাখা বেঞ্চে বসতেই খোলা ক্যাম্পাসের ঠান্ডা. বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। যদিও শীত লাগছে তবুও নিজের ক্যাম্পাসের বাতাস বলেই কি না কে জানে খুব শান্তি লাগছে ওর।
ওর উলটো দিকের একটা বেঞ্চে বসে আছে এক জোড়া ছেলে-মেয়ে। দুজন বসেছে বেঞ্চের দুই মাথায়। মাঝখানে একগাদা কাগজপত্র ছড়ানো। সেদিকে দুজনার কারোরই খেয়াল নেই। মহা আনন্দে সেলফি তুলছে দুজনে। ছেলে মেয়ে দুজনার দিকে তাকিয়ে আনমনেই একবার মাথা নাড়ল তানভীর।
এটাই ক্যাম্পাস জীবন। বন্ধু-আড্ডা-ক্লাস, ডিপার্টমেন্ট আর টিচারদেরকে অভিশম্পাত, সবশেষে প্রেম-পরিণতি আর ক্যারিয়ার। যে যতই চেষ্টা করুক এর হাত থেকে মুক্তি নেই। সবাইকেই চক্রের ভেতরে আসতে হবে, বৃহত্তর প্রক্রিয়ার অংশ হতেই হবে। যারা পারবে না, হয় তারা হবে জিনিয়াস আর না হয় ব্যর্থ।
সবুজ ক্যাম্পাসের দিকে একবার তাকিয়ে আনমনেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো তানভীরের বুক থেকে। আফসোস লাগে সেই সব হারানো দিনগুলোর জন্যে, যেগুলো আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না। একটা সময় ছিল যখন এই ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে ঢুকে ‘ই’ বিল্ডিংয়ের সামনে পর্যন্ত যেতে যেতে একটাও অপরিচিত চেহারা ছিল না। আর আজ কয়েক বছরের ব্যবধানে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে একটা পরিচিত মুখও চোখ পড়ল না। নিজেকে মনে হচ্ছে বহিরাগত। এই ক্যাম্পাসে এখনো হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, প্রেম-পরিণয়ের গল্প রচিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু ও নিজে আর সেই প্রক্রিয়ার অংশ নেই। নতুনদের জায়গা দিতে সরে পড়তে হয়েছে পুরনোদের। এসেছে হাজারো নতুন মুখ, রচিত হয়ে চলেছে নতুন নতুন সব গল্প। নতুনদের ভিড়ে পুরনোদের সরে পড়াই নিয়ম আনমনেই আরেকটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পকেট থেকে একটা মিন্ট ফ্লেভারের চিউয়িং গাম বের করল। বহুদিন পরে নিজের ক্যম্পাসে ফিরে এসে সিগারেটের নেশা যেন চেগিয়ে উঠেছে।
দুধের স্বাদ কি আর মিল্ক ক্যান্ডি দিয়ে মেটে রে পাগলা?’ হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা শুনে একটু চমকে উঠল তানভীর। ফিরে তাকাতেই হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখ দেখতে পেল।
‘তোর এখন এইটা দরকার,’ বলেই মানুষটা কিছু একটা ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। খপ করে জিনিসটা ধরে ফেলল তানভীর। একটা সিগারেট। একটু অবাক হয়েই ও ফিরে তাকাল মানুষটার দিকে। লম্বা দাড়িওয়ালা, ঢিলা প্যান্ট আর হাফ- হাতা শার্ট পরিহিত পান চিবুতে থাকা হাসিমুখের মানুষটাকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ওর।
‘সবুজ ভাই, তুমি!’ নিজের বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মানুষটাকে। মানুষটার গায়ে হালকা জর্দার গন্ধ। ‘তুমি এই সময়ে এখানে ক্যামনে? আর একি! তুমি তো দেখি পুরোপুরিই বদলে গেছো।’
‘হা হা, আগে ছাড়, দম বন্ধ হয়া যাইবে তো,’ সবুজ ভাই তানভীরের শক্ত আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাতে শক্ত করে ওর দুই কাঁধ চেপে ধরল।
‘সর্বনাশ! কত বছর পর, না,’ বলে সে মনে মনে হিসেব করল, ‘প্রায় এগারো বছর। তুই তো পুরা নায়ক হয়া গেছোস, হা হা।’
‘আমি কোনোদিন নায়কের চেয়ে কম ছিলাম দেখতে?’ বলে তানভীরও হেসে উঠল। ‘তোমার কথা বলো, তুমি তো পুরো বদলে গেছো। আর তুমি এই সময়ে এখানে?’ প্রশ্নটা করেই মনে পড়ল সবুজ ভাই সম্ভবত এখানেই অ্যাডমিনিসট্রেশন বিল্ডিংয়ে অফিসার হিসেবে কাজ করে।
‘ঠিকই ভাবছোস, আমি এইখানেই অ্যাসিসট্যান্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করতাছি,’ বলে হেসে উঠে যোগ করল, আমার লেবাজ নিয়া কিছু বলবি না? পেইন দিবি না?’ সবুজ ভাইয়ের চোখে-মুখে কৌতুক।
‘আরে, না ভাই। তবে এখনো ঠিক মেনে নিতে পারছি না, সর্বক্ষণ পিঠে গিটার ঝোলানো লম্বা চুলের সেই রকস্টার সবুজ ভাইকে এইরকম মেনে নেওয়াটা একটু কঠিন বটে,’ বলে ও সিগারেটটা সামনে তুলে ধরল।
‘কতদিন হয় ছাড়ছোস?’ সবুজ ভাই জানতে চাইল।
‘ক্যাম্পস ছাড়ার পর আর খাইনি,’ তানভীর আনমনেই বলে উঠল। জানে ধীরে ধীরে ওই প্রসঙ্গ আসবেই।
কিন্তু সবুজ ভাই সে নিয়ে কিছু বলল না, বরং ফুড কোর্টের একটা ছেলেকে ডাক দিয়ে ওকে ম্যাচ দিতে বলল। ‘এহনো রক্তের মধ্যে নিকোটিনের টান আগের মতোই অনুভব করোস, তাই না? তরে দেইখাই আমি বুঝছি।’
সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে হেসে উঠল তানভীর, ‘হা হা তুমি তো বুঝবাই। তোমারে দেইখাইতো মনে হইতাছে তুমি সিগারেট ছেড়ে পান ধরছো
তানভীরের কথা শুনে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে রইল সবুজ ভাই তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল সে। ‘হারামজাদা, তুই আগের মতোই বুদ্ধিমান আছিস,’ বলে সে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল। ‘সময় ক্যামনে যায় তাই না। কত সময় আমরা কাটাইছি এইসব জায়গাতে আড্ডা মেরে। কত দিন রুমমেট ছিলাম আমরা?’
‘প্রায় চার বছর ভাই,’ আনমনেই বলে উঠল তানভীর। ‘কী সর দিন ছিল, তাই না?’
সবুজ ভাই কিছু না বলে তাকিয়ে রইল। ‘তানভীর, তুই কি কাজটা ঠিক করেছিলি?’ বলে সবুজ ভাই উত্তেজিত হয়ে উঠল। ‘একটা…যাই হোক এইজন্যে তুই এইভাবে আমগো সবাইরে ছাইরা চইলা যাবি। গেলি তো গেলি আর….‘
ভাই, বাদ দাও না,’ তানভীর হেসে উঠে পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে চাইল। ভাবি কেমন আছে? বাচ্চারা?’
বাচ্চারা না গাধা ‘বাচ্চাটা’,’ বলে হেসে উঠল সবুজ ভাই। ‘একটাই মেয়ে আমার। তিন বছর বয়স। আন্টি কেমন আছে? আঙ্কেল তো…’
‘হ্যাঁ, আব্বু মারা গেছে বেশ কয়েক বছর প্রায় হয়ে গেছে। মা ভালো আছে কিন্তু বয়স বেড়েছে একা হয়ে গেছে, আর আমি তো সময় দিতেই পারি না, মার কথা মনে হতেই তানভীরের মনটা আবার একটু আর্দ্র হয়ে গেল।
‘হুম, যে একখান পোলা তার, আগে বইপত্র আর গান ছাড়া কিছুই বুঝতো না। আর এহন নিশ্চয়ই কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না,’ বলে সে হেসে উঠল। ‘তানভীর, তোর সব খবর আমার কাছে থাকে। তোর কাজে-তোর সাফল্যে আমি খুব খুশি। তা হঠাৎ সিলেটে?’
‘ভাই কাজে আসছি,’ তানভীর সিগারেটটা ধরালেও এখনো ঠিকমতো টান দেয়নি। এবার জোর একটা টান দিতেই কাশি চলে এলো। কতদিন পর টানছে। কাশি সামলে ও সবুজ ভাইয়ের দিকে ফিরে বলল, ‘ভাই, ঝামেলায় আছি। তুমি জানো কি না, আমি কাজ করি ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস সেকশনে কিন্তু এইবারই প্রথম আমাকে ফিল্ডে পাঠাল তাও অন্য অথরিটির আন্ডারে। আর্কিওলজির এক টিচার হারিয়ে গেছে।’
‘ডক্টর মিতায়ন?’ সবুজ ভাই চিন্তিত মুখে জানতে চাইল। ‘এই কেসের কামে তোরে পাঠাইছে?’ একটু অবাক হয়েই যেন প্রশ্ন করল সে।
‘হ্যাঁ, ভাই তুমি কিছু জানো নাকি?’ প্রশ্নটা করতেই সবুজ ভাইয়ের চেহারাটা যেন আরো অন্ধকার হয়ে গেল।
‘হুম্, কিছু ঝামেলা আছে এইটা জানি, কিন্তু সেইটা যে আসলে কি সেইটা জানি না। ডক্টর মিতায়ন এই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে শান্ত-শিষ্ট মানুষদের একজন,’ বলে সে দুই হাত তুলল, ‘মানে, আমি যতটুকু জানি আরকি। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। তার আন্তর্জাতিক কানেকশন নাকি সেইরকম। তবে…’ বলে সে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল। ওর কোমরে গুঁজে রাখা টকিতে খর খর করছে। তানভীর টকিতে সুলতানের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ফিরে তাকাল সবুজ ভাইয়ের দিকে। ‘ভাই তোমার নম্বর দাও,’ বলে দুজনে নিজেদের ভেতরে নম্বর বিনিময় করে নিয়ে তানভীর জড়িয়ে ধরল সবুজ ভাইকে।
‘যাক ভাই, তুমি থাকাতে অন্তত একজন পরিচিত মানুষকে তো দেখলাম। আমি কাজ শেষ করি, তারপর তোমার সঙ্গে দেখা করে আড্ডা দেবে। ভালো থাকো।
‘তানভীর, আমি তেমন কিছু জানি না, তবে তোরে একটা কথা বলতে চাই,’ সবুজ ভাইকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ‘তোর কি এই কেস থেকে সইরা যাবার কোনো উপায় আছে?’
মাথা নাড়ল তানভীর। ‘আর কোনো উপায় নেই ভাই, কোনো সমস্যা? তুমি কি কিছু জানো?’
সবুজ ভাই এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। ‘এইখানেই তো সমস্যা রে ছোটো ভাই। তেমন কিছু জানি না দেইখাই তো তোরে বলতাছি। যাই হোক, কাম কর এহন। ফ্রি হইলে আমারে একটা কল দিস। আমি সুবিদ বাজারে একটা ভাড়া বাসায় থাকি।’
সবুজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে টকিতে কথা বলতে বলতে ও লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দেখল ওরা মাইক্রো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার, কাজ হয়েছে?’
‘স্যার,’ সুলতান কথা বলার সময়ে আনমনেই তার মেরুদণ্ড আর মাথা সোজা হয়ে যায়। ‘ডক্টর মিতায়নের ক্যাবিনেটে পাওয়া ফাইলগুলোর ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছুই ছিল না। আর উনার স্ত্রী এখন ছুটিতে আছেন। তবে ভদ্রমহিলা সিলেটেই আছেন। উনারা আখালিয়া সুরমা এলাকায় একটা বাসায় ভাড়া থাকেন। আমাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে ঠিকানা দিয়ে জানানো হলো, মহিলা এখন তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ওই বাড়িতেই আছেন। স্যার আমরা উনার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ওখানে যেতে হবে।’
চলো, আমার মনে হয় না এখানে এরচেয়ে বেশি কাজের কিছু পাওয়া যাবে। তারচেয়ে মহিলার সঙ্গে কথা বলাটা বেশি জরুরি মনে হচ্ছে আমার কাছে। ওরা আবারো মাইক্রোতে উঠে বসতেই বয়স্ক ড্রাইভার মাইক্রো ছেড়ে দিল। ভার্সিটি থেকে সুরমা এলাকা একেবারেই কাছে। যেতে বেশিক্ষণ লাগল না। কিন্তু পুরোটা পথ তানভীর রীতিমতো চিন্তা ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। প্রথমেই মনে মনে গুছিয়ে নিল কোনো কোনো বিষয়ে ডক্টর মিতায়নের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
তারপর পুরো পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসল। ওকে সবচেয়ে বেশি অবাক করছে যে ব্যাপারটা, ডক্টর মিতায়ন এত বড়ো একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করত, এত বড়ো একটা প্রজেক্ট চালাচ্ছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে তাহলে সিলেট মিলেনিয়ামের অফিসে আর ভার্সিটির রুমে এ নিয়ে তেমন কোনো কাগজপত্র নেই কেন। এত বড়ো প্রজেক্ট, কিছু না হলেও অন্তত বস্তাভর্তি অ্যাকাডেমিক পেপার থাকার কথা। ডক্টর মিতায়ন আর টিম আসলে কী নিয়ে কাজ করছিল। নাকি ওরা আসার আগেই কেউ কাগজপত্র সব সরিয়ে ফেলেছে।
‘ইকবাল, আপনি তো এই কেসের শুরু থেকেই সঙ্গে ছিলেন। এদের অফিসে কি আর কোনো কাগজপত্র ছিল নাকি অন্য কেউ এসে সরিয়ে ফেলেনি তো?’
‘মনে হয় না স্যার। কারণ দুটো অফিসেই আমরাই প্রথম ঢুকেছি, এই এই রাখো,’ বলে সে জানলা দিয়ে মুখ বের করে এক দোকানদারের কাছে জানতে চাইল চারশ আটষট্টি নম্বর বাসাটা কোনো দিকে। ‘একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে মসজিদ থেকে বামে। ঠিক আছে। চলো,’ বলে সে তানভীরের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘স্যার, একেবারে শেষ মাথায় বাসাটা।’
আখালিয়া সুরমা এলাকাটা ছোটো তবে সিলেটের সুন্দরতম এলাকাগুলোর একটি। মূল রাস্তা থেকে বেরিয়ে সরু লম্বা পথ মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। দুই পাশে সমান্তরালে বেরিয়েছে ছোটো ছোটো রোড। বাড়িগুলো দেখার মতো সুন্দর।
ওদের মাইক্রো একটার পর একটা ছোটো ছোটো রোড পার হয়ে চলে এলো সুরমার একেবারে শেষ মাথায়। রাস্তাটার শেষ প্রান্তে মসজিদটাকে ডানে রেখে বামে একটা ইট বিছানো রাস্তায় নেমে এলো ওদের মাইক্রো। কিছুদূর এগিয়ে বাংলোমতো দেখতে একটা বাড়ির সামনে থেমে গেল গাড়ি। বাংলোর গেটের অন্যপাশে একটা কালো জিপ দাঁড়িয়ে আছে। তানভীর দেখল বাংলোর গেটের বাইরে ছোটো একটা প্লেটে বাড়ির নম্বর লেখা চারশ আটষট্টি। ‘এটাই,’ ঘোষণার সুরে বলে উঠল ও। ‘চলো।’
বাংলোমতো বাড়িটা সবুজ রঙের, একেবারেই ছায়াঘেরা জায়গাটা। মূল এলাকা থেকে বেশ দূরে। বাংলোর ওপরে লাল টালির ছাদ। ‘চমৎকার বাড়ি,’ তানভীর শুনতে পেল ওর পাশ থেকে সুলতান বলে উঠল। ওরা গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মূল বাড়িটার দিকে এগোল।
‘আপনারা কি আগে এখানে এসেছিলেন?’ হাঁটতে হাঁটতেই তানভীর প্রশ্ন করল ইকবালকে।
‘না স্যার,’ ইকবাল জবাব দিল। ‘ডক্টর মিতায়নের স্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পুলিশ এখানে এসেছিল তবে সেই টিমে আমি ছিলাম না।’ বাড়িটার সামনে তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে। একপাশে একটা ছাউনির নিচে আকাশি রঙের একটা গাড়ি রাখা। তানভীর অনুমান করল এটা ডক্টর মিতায়নের গাড়ি।
আশপাশ দেখে নিয়ে সুলতানের দিকে ফিরে ও বলল, কি ব্যাপার, নক করেন, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?’
‘জি, স্যার,’ বলে সে নক করার জন্যে দরজায় টোকা দিতেই সেটা হা হয়ে খুলে গেল। ‘স্যার, দরজা তো খোলা। আমি—’ সুলতান কথা শেষ করার আগেই বাজ পড়ার মতো তীক্ষ্ণ একটা শব্দ ভেসে এলো বাংলোর ভেতর থেকে। সেইসঙ্গে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল একটা নারী কণ্ঠ। মুহূর্তের মধ্যে তানভীর নিজের অস্ত্র বের করে আনল। ও দেখল সুলতানও তার পিস্তল বের করে ফেলেছে। ইকবাল তার পিস্তল বের করার জন্যে টানাটানি করছে। তিনজনেই একে অপরকে দেখল।
তিনজনেরই মনে একই ভাবনা, ভেতরে বিপদে পড়েছে কেউ।