অধ্যায় ষোল – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ
হাতের লাল হয়ে ওঠা জায়গাটা ডলতে ডলতে শামান ভাবছে, কাহিনি কি এদের ভেতরে?
কি দড়ি দিয়ে বেঁধেছিল ব্যাটারা কে জানে জায়গাটা কেমন জানি চুলকাচ্ছে ওর। পাশ ফিরে তাকাল বিধুর দিকে। ও ভেবেছিল বিধুও মনে হয় বিরক্ত হয়েছে ওরই মতো কিন্তু অবাক হয়ে দেখল এসব বিরক্তি-ব্যথা কোনোদিকেই বিধুর খেয়াল নেই, সে বরং পরম মমতার সঙ্গে হাত বুলাচ্ছে নিজের ধনুকের গায়ে। শামান হাতটা ডলে সামনে ছোটো একটা চারপায়ার ওপরে রাখা নিজের তলোয়ার আর ছুরিটা তুলে নিয়ে সেটা নিজের পিঠে চড়িয়ে দিয়ে রাগের সঙ্গে সপাটে টেনে লাগিয়ে নিল ওটার বন্ধনী। জোড়া তলোয়ারটা পিঠের ওপরে আর ছুরিটা কোমরে গুঁজে নিতেই নিজেরে পুরনো বল যেন ফিরে এলো আগের মতো।
ওরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে থারু রাজা মানরুর বাড়ির সামনে সেই তৃণভূমির কিনারে বেশ সুন্দর একটা সাজানো বাগানের ভেতরে। একদিকে থারু রাজা বসেছে, তার সঙ্গেই অবস্থান করছে তার বাহিনীর লোকজন। সেই ধূসর চোখের সুন্দরীও দাঁড়িয়ে আছে ওদের সঙ্গেই, শামান আড়চোখে রাগের সঙ্গে একবার দেখল তাকে।
ওদের বিপরীত দিকে বসেছে শাক্যদের রাজা শংকরাদিত্য, তার সঙ্গেও অবস্থান করছে তার বাহিনীর ছোটো একটা দল। আর দুই দলেরই একরকম বলতে গেলে মধ্যমণি হয়ে অবস্থান করছে শামান আর বিধু।
একটু আগে ওদেরকে এখানে নিয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শামান যখন থারু আর শাক্যদের ব্যাপারে কথা বলে ওঠে সেই ধূসর চোখের সুন্দরী রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সাদা পোশাক পরা বয়স্ক থারু রাজা হেসে উঠে ওদেরকে অভিবাদন জানায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার নির্দেশে ওদের বাঁধন খুলে দিয়ে ওদের সবাইকে এনে বসানো হয় সেই তৃণভূমি আর রাজার বাসভবনসংলগ্ন বাগানে। ওরা বসার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের অস্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হয়। অস্ত্রটা তুলে নিয়েই শামান প্রশ্ন করে জানতে চায় তাদের সঙ্গে এমনটা কেন করা হলো। ‘কি ব্যাপার সবাই চুপ কেন? জবাব দিন, মেহমানদের সঙ্গে কি আপনারা সবসময়ই এমন ব্যবহার করেন নাকি?’
‘মেহমান যে আদৌ মেহমান সেটা তো আগে বুঝতে হবে নাকি?’ অন্য কেউ শামানের জবাব দেয়ার আগেই কড়া গলায় কথা বলে উঠল ধূসর সুন্দরী। শামান মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে। ‘মেহমানকে যথাযথ সম্মান দিতে না পারলে তাকে আমন্ত্রণ জানানোই উচিত নয়, কি বলেন? আর আপনারা…’
‘কিসের মেহমান কিসের প্রয়োজন, আপনারা নিজেদের এলাকা ছেড়ে আমাদের এখানে পাড়ি জমিয়েছেন নিজেদের প্রয়োজনে, মোটেই…’
‘সবাই চুপ,’ বেশ জোরেই দুই হাত তুলে ধমকে উঠল থারু রাজা মানক। মানুষটা ছোটোখাটো হলেও তার গলায় বেশ জোর, কথা বলার ধরনও খুবই কৃর্তত্বপরায়ণ। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে সে বলে উঠল, ‘আমরা সবাই এখানে যার যার প্রয়োজনেই এসেছি, তবে,’ বলে সে আবারো একটা হাত তুলল। ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অন্যদের সাহায্য করা,’ বলেই সে একটু থেমে যোগ করল, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হবে যত দ্রুত সম্ভব এই এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনা।
‘বাবা, আমরা চিরকাল সে চেষ্টাই করেছি, কিন্তু সবাই আসলে শান্তি চায় না,’ ধূসর সুন্দরীর কথা শুনে একটু অবাক হয়েই তার দিকে ফিরে তাকাল শামান। সে ভেবেছিল এই মেয়েটা রাজা মানরুর যোদ্ধা বাহিনীর অংশ তবে সে যে রাজার মেয়ে হতে পারে সেটা ওর চিন্তা-ভাবনায় একবারও আসেনি। ধূসর সুন্দরী একইরকম ঝাঁঝের সঙ্গে বলে চলেছে। ‘কিছু মানুষ আছে যারা আসলে শান্তির ধর্ম পালন করলেও বাস্তব জীবনে শান্তির পথে চলতে একেবারেই নারাজ। এসব মানুষেরা শান্তিকে ভয় পায়। আর তাই—’
‘কালন্তি, চুপ। মেহমানদের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই,’ রাজা মানরু ধমকে উঠল ধূসর সুন্দরীকে। ‘অন্যরা যা খুশি করুক আমরা শান্তি চাই, সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। আর এই জনপদে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে যা যা করা প্রয়োজন আমি সেটা করতে চাই, এবং করবই।’
‘রাজা মানরু,’ অন্যপাশ থেকে খুব ভারী গলায় বলে উঠল সেই তিরন্দাজ বাহিনীর প্রধান। ‘আমরা আপনার সাহায্য প্রার্থী সেটা ঠিক আছে কিন্তু এভাবে কথায় কথায় যদি আমাদের পুরনো ইতিহাস টেনে এনে আমাদের হেনস্তা করা হয় তবে ব্যাপারটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়,’ বলে সে একটা আঙুল তুলল। ‘রাজা মানরু, আপনি ও আপনার গোত্রের লোকদেরকে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে যে আমাদের ভেতরে একটা চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তির সম্মান যদি আমরা বা আপনারা ভঙ্গ করি—’
‘কিসের চুক্তি?’ হঠাৎ নিজের অবস্থান থেকে সামনে এগিয়ে এসে কোমর বন্ধনীর সঙ্গে আটকানো চাবুকটা খুলে শূন্যের ওপরে দুইবার সাঁইসাঁই করে চালিয়ে দিল সেই ধূসর সুন্দরী। তার চাবুকের ডগাটা আরেকটু হলে শাক্য রাজার মুখে গিয়ে লাগত। ‘খুনিদের সঙ্গে আবার চুক্তি কিসের। আমরা চুক্তি করলেই সেটা যে তোমাদের মতো খুনির দল ভঙ্গ করবে না—’ বলে সে আবারো চাবুক চালাতে যাচ্ছিল তার আগেই শামান ধমকে উঠল।
‘সবাই চুপ,’ নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে শামান। ‘একদম চুপ। যার যার জায়গায় বসুন। যদি নিজের অতিথিদের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান থেকে থাকে তবে এইবারের মতো অন্তত আমার কথা শুনুন। আপনারা যাই বলেন এখন পর্যন্ত বহু রাজার অধীনে যুদ্ধ করেছি আমি ও আমার বাহিনী। আজ পর্যন্ত শুধু তাদেরকেই বিজয়ী হতে দেখেছি যারা নিজেদের সহযাত্রীদের সঙ্গে একমত ছিল। বিভক্ত মানুষেরা কখনোই বিজয়ী হতে পারে না। বিশ্বাস করুন কথাটা আমি জেনে বুঝে বলছি। যদিও আমি এখনো পরিষ্কার জানি না এখানে আসলে কী হয়েছে আর কী হচ্ছে, তবে এটা বলে দিতে পারি; সঠিক পরিকল্পনা আর দক্ষ পরিচালনা দ্বারা অসম্ভব কোনো কাজ নেই পৃথিবীতে। কাজেই আগে আমাকে বলুন এখানে আসলে কী হয়েছে। তবে তার আগে আমার মনে হয় আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের পরিচয় বিনিময় করা উচিত।’
বলে শামান একটু থেমে যোগ করল, ‘আমি শামান, তিব্বতের লাপাঙ গোত্রের যোদ্ধা, যদিও এখন আমি নিজের দল পরিচালনা করি, তবে আমার প্রাথমিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা লাপাঙদের সঙ্গেই ছিল। আর ও বিধু, দক্ষ তিরন্দাজ, আসাম-ত্রিপুরা আর সিংহল রাজার সেনাবাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে ওর। তবে এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে আছে ও। আমরা দুজনেই তিব্বতের শান্তির মঠের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শ্রমণ লামা নোরবুর অনুরোধে ডুকপা লামাকে খুঁজতে এসেছি।’
‘আপনাদের পরিচয় নিয়ে আমাদের আর কোনো সংশয় নেই, বিশেষ করে আপনার ওই লাল চুলই আপনার পরিচয় প্রকাশ করছে। লাল চুলের তিব্বতি যোদ্ধা আর তার দলের নাম শোনেনি এমন কেউ নেই এই অঞ্চলে। তবে আমার প্রশ্ন
হলো, স্রেফ আপনারা দুজন এসেছেন?’ রাজা মানরু সরু চোখে প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, আমরা দুজনেই এসেছি। কিন্তু একটা ব্যাপারে প্রশ্ন না করলে আমার মনের অস্বস্তি দূর হচ্ছে না, আপনারা যদি আমাদের পরিচয়ের ব্যাপারে এতই নিশ্চিত হন তবে আমাদেরকে এভাবে ফাঁদ পেতে ধরলেন কেন? অতিথিদের সঙ্গে এ কেমন ব্যবহার, তাও আবার যে অতিথি আপনাদেরকে সাহায্য করতে এসেছে।’
‘সত্যি কথা হলো, আপনারা সমতলে অবগাহন করার পর পরই আমরা আপনাদের ওপরে নজর রাখতে শুরু করি কিন্তু এমনকি আপনার লাল চুল দেখার পরও আমরা আপনাদের পরিচয় নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। কারণ লামা নোরবু আমাদেরকে যে খবর পাঠিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল দক্ষ ও সুসজ্জিত যোদ্ধাদের একটি দল আসবে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে, যার নেতৃত্বে থাকবে লাল চুলের এক যোদ্ধা। কিন্তু আপনারা সমতলে নামার পর স্রেফ দুজনকে দেখে আমরা খুবই অবাক হয়ে যাই। সে কারণেই আপনাদের পরিচয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হবার প্রয়োজন ছিল।’
‘এ কেমন ব্যাখ্যা হলো! আমি বুঝলাম না। তবে আপনাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী এই কারণে যে আমার পক্ষে আসলে পুরো দল নিয়ে এখানে আসাটা সম্ভব ছিল না। কারণ লামা নোরবু আমাকে যখন খবর পাঠায় তখন শুধু আমাকে দেখা করার নির্দেশ দিয়েছিল সে। আর নোরবুর নির্দেশে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আমার পক্ষে দলকে খবর পাঠিয়ে নিয়ে আসাটা সম্ভব ছিল না। কারণ তাতে অনেক দেরি হয়ে যেত। আমি যত দ্রুত সম্ভব এখানে পৌঁছে পরিস্থিতি বুঝতে চাচ্ছিলাম। যেটা আপনারা এখনো আমাকে ব্যাখ্যা করেননি।’
রাজা মানরু একবার তার মেয়ের দিকে তাকাল। ধূসর সুন্দরী কাঁধ ঝাঁকাল একবার। রাজা ফিরে তাকাল শাক্য বাহিনীর প্রধানের দিকে। শাক্যদের প্রধান ও তার দিকে সামান্য মাথা নাড়ল। তারপর সেই প্রথম শুরু করল। ‘আমার নাম শংকরাদিত্য, বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাক্য গোত্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান আমি। ও জাথুরিয়া, বলে সে তার তিরন্দাজ বাহিনীর অগ্রভাগে থাকা শুকনো লম্বা কালো পোশাক পরা একজনকে দেখাল। ‘জাথুরিয়া, শাক্যদের প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্মরত আছে এই মুহূর্তে।’
‘আমি তো নিজের পরিচয় আগেই দিয়েছি এক দফা, তাও বলছি, আমি রাজা মানরু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী থারু গোত্রের প্রধান। আমার দ্বিতীয় সেনাপতি কালন্তি, পারিবারিক সম্পর্কে ও আমার মেয়ে,’ বলে সে ধূসর চোখের সুন্দরী কালন্তির দিকে ইশারা করে দেখাল। কালন্তি কিছুই বলল না, সে ঠিক যেভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শামান আর বিধুর দিকে, সেভাবেই তাকিয়ে রইল।
‘আমি একটা ব্যাপার এখনো বুঝতে পারছি না, থারু আর শাক্যরা বংশ পরম্পরায় জাত শত্রু। তবে তারা এখানে একসঙ্গে হলো কিভাবে?’ বলে মাঠের অন্য প্রান্তে খাটানো সারি সারি তাঁবুগুলো দেখাল! ‘আর এগুলোরই বা ব্যাখ্যা কি?’
‘সবই ব্যাখ্যা করা হবে, তবে তার আগে আপনাকে পুরো পরিস্থিতি খুলে বলতে হবে। গত কয়েকদিনে আসলে কি ঘটেছে সেটা ব্যাখ্যা করে বললেই আপনি বুঝতে পারবেন আসলে এখানে হচ্ছেটা কি,’ বলে থারু রাজা মানরু শাক্য প্রধানের দিকে ইশারা করল। ‘আমার মনে হয়, শংকরাদিত্য আপনি সেটা বিশদ বললেই সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ কাহিনির একটা অংশ আমরা জানি কিন্তু একমাত্র আপনি আর আপনার লোকেরাই পুরো ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছেন। কাজেই আপনিই শুরু করুন।’
শাক্য প্রধান শংকরাদিত্য একবার চারপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে তার দৃষ্টি এসে স্থির হলো শামানের ওপরে। মনে মনে সে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে তার চোখের নিচে চুলকাতে লাগল। শামান ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল মানুষটার চোখের নিচে লম্বা একটা কাটা দাগ। সেই দাগটা চুলকে নিয়ে সে শুরু করল।
‘আগেই বলেছি আমার নাম শংকরাদিত্য, এই মুহূর্তে আমিই শাক্যদের গোত্র প্রধানের ভূমিকা পালন করলেও, প্রকৃতপক্ষে শাক্য গোত্র ও এই অত্র এলাকার রাজা আসলে আমার বড়ো ভাই বিক্রমাদিত্য। আমরা প্রায় শতবর্ষ ধরে এই কন্নোর এলাকা শাসন করে আসছি,’ শংকরাদিত্য এই পর্যন্ত বলতেই কালন্তি চট করে বলে বসল, ‘ধোঁকাবাজি, অন্যায় আর খুন-জখমের মাধ্যমে, তাই না?’
দেখা হবার পর থেকে প্রতিটি মানুষকে অত্যন্ত ভালোভাবে খেয়াল করে আসছিল শামান। শংকরাদিত্যকে তার মনে হয়েছে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মানুষ কিন্তু কথার মাঝখানে কালন্তির ফোড়ন শুনে হঠাৎ সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। চট করে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ‘রাজা মানরু, আমি আগেও বলেছি…’
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রাজা মানরুও উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল তার কাছে, ‘আমি দুঃখিত, শংকরাদিত্য,’ বলেই সে ফিরে তাকাল নিজের মেয়ের দিকে। একটা হাত তুলে পরিষ্কার নির্দেশ করল কালন্তিকে ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে। কালন্তি আরো তেজের সঙ্গে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই রাজা আবারো ধমকে উঠল। ক্ষমা তো চাইলই না উলটো কালন্তি তেজের সঙ্গে বিড়বিড় করতে করতে প্রস্থান করল সেখান থেকে।