অধ্যায় পনেরো – বর্তমান সময়
সুনামগঞ্জ রোড, আখালিয়া, সিলেট
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পথে পুরনো স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে করতে আনমনেই হেসে উঠছিল তানভীর।
তবে স্মৃতিকাতরতার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে; তিক্ত-মিষ্টি-গভীর-হালকা। কিন্তু তানভীরের কাছে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ওর স্মৃতিকাতরতা অত্যন্ত মিশ্ৰ প্রকৃতির। ওদের গাড়িটা আম্বরখানা থেকে রওনা দিয়ে এখন আখালিয়া বিডিআর ক্যাম্প পার হচ্ছে।
মাইক্রোর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তানভীরের বারবার শুধু স্মৃতির ঝাঁপি উপচে উঠতে চাইছে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় আম্বরখানা থেকে ভার্সিটি গেট পর্যন্ত কত অসংখ্যবার যাতায়াত করতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কত অসংখ্য স্মৃতির পসরা সাজানো আছে এই রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে। সুবিদ বাজার, মদিনা মার্কেট, সুরমা এসব এলাকাগুলোতে কখনো আড্ডা কখনো ক্লাসের প্রয়োজনে ছুটতে থাকা, কখনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া কত কত স্মৃতি। একেকটা এলাকা পার হচ্ছে আর একেক ধরনের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যাচ্ছে।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই ও আনমনে হেসে উঠল। ও যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন কোনো এক সিনিয়র ভাই বলেছিল; বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হলো রাজার জীবন। পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে যদি কোনো রাজার জীবন থেকে থাকে তবে সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। এই জীবনের মতো এরকম আনলিমিটেড স্বাধীনতা আর কোথাও নেই। চাইলে এ থেকে একজন মানুষের পক্ষে পৃথিবীর সর্বোচ্চ লেভেলে যাওয়া যেমন সম্ভব, আবার চাইলে সর্বনিম্ন লেভেলেও নামা সম্ভব। কে কোনোটা বেছে নেবে, সেই সিদ্ধান্ত তার কথাটা মনে পড়তেই তানভীর মৃদু হেসে উঠল। ও কোথায় গেছে আর কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। মাঝে মাঝে ভাবলে মনে হয় কোনো এক তাড়নার স্রোতে যেন অসীমের পানে ছুটে চলেছে প্রতিনিয়ত। তিক্ত এক ঘটনায় সেই যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ল তারপর থেকেই যেন শুরু হয়েছে সেই দাবড়ানি। এর শেষ কোথায় কে জানে। মিষ্টি-মধুর স্মৃতিগুলোকে হটিয়ে দিয়ে সেই তিক্ত স্মৃতি যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে ওর ওপরে। পাশ ফিরে তাকাল তানভীর।
লম্বা সিল্কি চুলগুলো টেনে পেছনে বেঁধে সেগুলোর ওপরে একটা কালো সানগ্লাস চাপিয়েছে সুলতান। গাঢ় সানগ্লাসের ভেতরে তার চোখ যে আসলে কোন দিকে তাকিয়ে আছে, আর কী ভাবছে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। ঠিক আগের মতোই মেরুদণ্ড সোজা আর মাথা উঁচু করে বসে আছে সে।
নিজের তিক্ত স্মৃতিগুলোকে দূর করার জন্যেই হঠাৎ কথা বলে উঠল তানভীর। ‘সুলতান, কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।’
‘স্যার, আপনি আমার অথরিটি। অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন,’ চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তানভীরের দিকে ফিরে তাকাল। মেয়েটার চোখের রং হালকা পিঙ্গল—এই প্রথমবারের মতো খেয়াল করল তানভীর। তার চোখের দিকে তাকিয়েই ও জানতে চাইল, ‘না মানে, ঠিক প্রফেশনাল কোনো প্রশ্ন নয়।’
‘বলুন স্যার। কোনো সমস্যা নেই।’
‘আপনি, মানে আপনার নাম সুলতান। একজন মেয়ের জন্যে খুবই অদ্ভুত নাম এটা। তার ওপরে আপনি ফোর্সের একজন প্রফেশনাল শ্যুটার। এই ব্যাপারটাও খুবই আনইউজুয়াল, মানে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে,’ তানভীর একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল কথাগুলো।
‘স্যার, আপনার প্রশ্নটা?’ সুলতানের চোখে কোনো ভাব নেই। কোনো অস্বস্তিও নেই। সে খুবই স্বাভাবিক গলায় তার পয়েন্টে ফোকাস করার চেষ্টা করছে।
‘না মানে, আপনি এই লাইনে এলেন কিভাবে?’ সুলতানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তানভীরের মনে হলো ও যেন দু-টুকরো পিঙ্গল রঙের পাথরের দিকে তাকিয়ে আছে।
একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন বলেই কি না কে জানে—সুলতান একবার কাঁধ ঝাঁকাল উত্তর দেয়ার আগে। কিন্তু সে যখন কথা বলতে শুরু করল গলায় কোনো ভাব নেই।
‘স্যার, আমার নামটা পাশা স্যারের দেয়া। আমার পুরো নাম আসলে ফারজানা বিনতে সুলতান। আমার বাবা আর মায়ের মধ্যে প্রেম ছিল। তারা দুজনে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে। মূলত আমার মা-ই বাবার ডাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে এনে বিয়ে করে কিছুদিন সংসার করে আমার বাবা,’ বাক্যের শেষ শব্দটা উচ্চারণের সময়ে তার গলা শক্ত শোনাল। ‘তারপর একদিন আমার মাকে দেশের সবচেয়ে বড়ো পতিতাপল্লি টানবাজারে বিক্রি করে দেয়। আসলে এটাই ছিল আমার বাবার পেশা। বিভিন্ন জায়গা থেকে সহজ-সরল মেয়েদেরকে ফুঁসলিয়ে এনে পতিতাপল্লিতে বিক্রি করত সে। টানবাজারের পতিতাপল্লিতেই আমার জন্ম, ওখানেই বেড়ে ওঠা। আমার বয়স যখন দশ তখন পতিতাপল্লিতে একদিন নিজের দল নিয়ে রেইড দিতে আসেন এক পুলিশ অফিসার। আমি তাকে বলি আমি এই নরকে থাকতে চাই না। আমাকে ওখান থেকে বের করার জন্যে হাতে-পায়ে ধরি তার। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম অরেকটু বড়ো হলেই আমাকেও দেহ ব্যবসায় নামতে হবে,’ সুলতান একেবারেই আবেগহীন গলায় বলে চলেছে।
এই পর্যন্ত বলে সুলতান একবার মাথা নাড়ল। ‘কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেই অফিসার আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে যান। ওখান থেকে নিয়ে আমাকে নতুন নাম- নতুন পরিচয় দিয়ে নিজের বাসাতেই আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন,’ সুলতান মৃদু হাসল। ‘জন্মের পর থেকে আমি মানুষের কদর্য চেহারাটাই শুধু দেখেছি। এই মানুষটার সংস্পর্শে এসে জানতে পারলাম, মানুষের আদলে দেবতারা আসলে এই মর্ত্যের পৃথিবীতেই বাস করে। কিছুদিন পর সেই মানুষটা আমাকে একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আমার সব খরচও উনিই চালাতেন।’
‘তবে আমি পড়ালেখায় মোটেই ভালো ছিলাম না। খুবই খারাপ রেজাল্ট নিয়ে কোনোমতে এইচএসপি পাস করার পর এই মানুষটাই আমাকে পুলিশে ঢুকিয়ে দেন। সেখানে ঢুকে আমি এক নতুন নিজেকে আবিষ্কার করি। পিস্তল আর বন্দুক হাতে পেলে আমি যেন পাগল হয়ে যাই। গুলি চালানোতে আমার প্রতিভা অপরিসীম। এই প্রতিভাকে অনুশীলন করতে করতে আমি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাই। ওখান থেকেই আমার প্রমোশন হয়। বিদেশে শ্যুটিংয়ের ওপরে ট্রেনিং নেই কয়েক দফা। সেই অফিসার যিনি আমাকে ওই নর্দমা থেকে তুলে এনেছিলেন উনার সঙ্গে একবার এক অপারেশনে গেলে উনি খুব আহত হন। আমরা ভেবেছিলাম উনি মারাই গেছেন। তীব্র আহত অবস্থায় আমরা যখন তাকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন উনিই আমাকে জানান, কেন উনি সেদিন আমাকে সেই নরক থেকে তুলে এনেছিলেন। উনার আপন বড়ো ভাই আর ভাতিজি ছিল। যারা বিদেশে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। আমি নাকি দেখতে অনেকটা উনার ভাতিজির মতো। উনার ভাতিজির নাম ছিল ফারজানা আর উনার ভাইয়ের নাম ছিল সুলতান। তাই উনি সেদিন ওখান থেকে আমাকে তুলে এনে উনার ভাই আর ভাতিজির নাম দিয়ে আমাকে এক নতুন জীবন দিয়েছিলেন। উনার কারণেই আমি আজ এখানে,’ সুলতানের শুষ্ক গলায় কি খানিকটা আবেগের আভাস কি না ঠিক বুঝতে পারল না তানভীর।
‘মানুষটা নিশ্চয়ই পাশা স্যার?’ তানভীর বলে উঠল। ‘মানে সেই অফিসার?’ সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল সুলতান।
‘আপনি আর ওখানে কখনো ফিরে যাননি, মানে আপনার মায়ের কাছে? ইচ্ছে করেই জায়গাটার নাম উহ্য রাখল তানভীর।
‘আপনি টানবাজারের কথা বলছেন?’ সুলতান সরাসরি তানভীরের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল। তানভীর আলতো মাথা নাড়ল।
‘পুলিশ হবার পর প্রথমেই আমি ওখানে গিয়েছিলাম, আমার মায়ের খোঁজ করতে। গিয়ে জানতে পারি এর আগের বছর উনি জরায়ুর ক্যান্সারে মারা গেছে তবে ওখানে গিয়ে বিরাট একটা উপকার হয়েছে। আমার তথাকথিত বাবার একটা পুরনো ছবি খুঁজে পেয়েছি। এখন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। কোনোদিন খুঁজে পেলে আমার এই দুই ঘোড়া পিস্তল দিয়ে,’ বলে সে নিজের হোলস্টারে রাখা বিরাট আকারের পিস্তল দুটো দেখাল। ‘ব্যাটার মাথাটাই উড়িয়ে দেব,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘সরি স্যার, বাজে ভাষা ব্যবহার করার জন্যে। কিছু মনে করবেন না, ব্যক্তিগত কথা বলতে বলতে অনেক বেশি বলে ফেলেছি,’ কথা শেষ করে সে আবারো সানগ্লাস চোখে পরে নিয়ে সামনে ফিরে তাকাল।
তানভীর হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সামনে ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে সাব-ইন্সপেক্টর ইকবাল বলে উঠল, ‘স্যার ভার্সিটি গেটের কাছাকাছি চলে এসেছি। আমরা কি সোজা ভার্সিটির ভেতরে চলে যাব?’
তানভীর জানালার কাচ নামিয়ে দিল। সেই ভার্সিটি গেট; কত আন্দোলন, কত ঝগড়া, ভালোবাসা আর আড্ডার পসরা। ও মনোযোগ দিয়ে দেখল ভার্সিটি গেটে ওর জুনিয়রেরা মিলে একটা ক্যাফে দিয়েছিল। নাম ছিল ‘জাহাজি’। শিরোনামহীনের বিখ্যাত গান ‘জাহাজি’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ক্যাফেটার নাম দিয়েছিল ওরা। এখনো ওটা আছে কি না, দেখার জন্যে জায়গাটার দিকে ফিরে তাকাল ও। কোনো ক্যাফে চোখে পড়ল না বরং আর দশটা ভাতের হোটেলের আদলে একটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল। তবে জাহাজি লেখা সেই সাইনবোর্ডটা এখনো আছে।
সময়ের স্রোত বড়োই খারাপ জিনিস। এই স্রোতে পড়ে জাহাজিরা হয়ে যায় কর্পোরেট অফিসার, আর ক্যাফে হয়ে যায় ভাতের হোটেল। সাপ্লাই আর ডিমান্ডের এই পৃথিবীতে ‘জাহাজি’দের আবেগের স্থান নেই কোথাও। ‘গাড়ি ভার্সিটির ভেতরে নিয়ে যাও। আমরা সোজা ডি বিল্ডিংয়ে যাব। আগে ডক্টর মিতায়নের অফিসটা সার্চ করতে হবে।’
গাড়ি ভার্সিটি গেটের কাছে স্লো করেছিল, ও নির্দেশনা দিতেই ওটাকে ঘুরিয়ে ভার্সিটি গেটের ভেতর দিয়ে এক কিলো পথে প্রবেশ করল ওদের মাইক্রো।
শাবিপ্রবি গেট থেকে ভার্সিটির ভেতরের গোল চত্বর পর্যন্ত রাস্তাটা ঠিক এক কিলোমিটার। আর এ কারণেই এটাকে বলে ‘এক কিলো পথ।
বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটা কালচারাল অ্যাসেট থাকে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদী। ঠিক তেমন শাবিপ্রবির অন্যতম অ্যাসেট এই এক কিলো পথ। শাবি ক্যাম্পাসে প্রতি মুহূর্তে হাজারো গল্প রচিত হয়ে চলেছে সবুজে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর এই এক কিলো পথে। সুখের গল্প, দুঃখের গল্প, বন্ধুত্বের গল্প, হাজারো ভালোলাগা-মন্দ লাগা আর প্রেমের গল্প। আজ থেকে বেশ কবছর আগে এই এক কিলো পথেই তেমনি একটা গল্প রচিত হয়েছিল তানভীরের জীবনে।