অধ্যায় চৌদ্দ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পৃথুরা বনভূমি, কন্নোর, ভারতবর্ষ
ভাগ্যের ফেরে কি তবে দাস ব্যবসায়ীদের খপ্পরে এসে পড়ল ওরা?
কথাটা মনে হতেই যতটা না চমকে উঠল শামান তারচেয়ে অনেক বেশি আতঙ্ক গ্রাস করল ওকে। সর্বনাশ! ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে এসে শেষ পর্যন্ত না নিজেদের স্বাধীনতা হারাতে হয়। ও বিধুকে ডাক দেয়ার জন্যে পাশ ফিরতেই হঠাৎ থেমে গেল দলটা।
শামান সামনে তাকিয়ে দেখল দলের অগ্রভাগে থাকা মুখ ঢাকা মহিলা একটা হাত তুলে থামতে বলেছে দলটাকে। দলটা থেমে যেতেই অনুচ্চ স্বরে একটা শিস বাজাল মহিলা। শিসের শব্দটা অনেকটা পাখির ডাক আর সম্বর হরিণের ডাকের মাঝামাঝি। মহিলা শিস বাজানোর একটু পরেই অপর দিক থেকেও একইরকম শিসের আওয়াজ ভেসে এলো।
ওরা এখন যেখানে অবস্থান করছে জায়গাটা একেবারেই ঘন জঙ্গল বললেও কম বলা হয়। চারপাশে বড়ো বড়ো গাছপালা উঠে গেছে মাথার ওপরে। সেইসঙ্গে বড়ো বড়ো কাষ্ঠল গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘন ঝোপ-ঝাড়ের জঙ্গল। অপর পক্ষ থেকে শিসের শব্দ ভেসে আসতেই ঘন জঙ্গলের একটা অংশ যেন হা হয়ে খুলে গেল। শামান অবাক হয়ে খেয়াল করল ঝোপঝাড়ের একটা অংশ আলগা হয়ে গেছে, সেইসঙ্গে ওগুলোর ভেতর দিয়ে বেশ চওড়া একটা ফোকরের মতো তৈরি হয়েছে।
‘ওরে মারে, এইহাত কিলা দেখলাম, জাদু নি?’ তাজ্জব হয়ে বলে উঠল বিধু। শামান নিজেও কম অবাক হয়নি। পাহাড়ি যোদ্ধা ও, পাহাড়ের খোলা-রুক্ষ উপত্যকায় লড়াই করে অভ্যাস ওর। সমতলের এই সব পথ-জঙ্গলের কাজ- কারবার খুবই অবাক লাগছে ওর কাছে।
দলের অগ্রভাগে থাকা মহিলা দলের বাকিদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে নিজে ঢুকে গেল সেই ফোঁকরের ভেতরে। একে একে বাকিরা অনুসরণ করল ওদেরকে। শামান আর বিধুকে পোষা গরু-ছাগলের মতো টেনে নিয়ে ঢোকানো হলো ওটার ভেতরে। ফোঁকরের অন্যপাশেও একইরকম ঘন জঙ্গল। তবে খানিকটা এগোতেই একটা খালের মতো পানির ধারা দেখতে পেল ওরা। সেই পানির ধারার অন্যপাশে যেন ভিন্ন এক জগৎ। অবাক হয়ে দেখতে লাগল শামান আর বিধু
‘মায়েরে মা, এ কই আইলা?’ বিস্ময় প্রকাশ করতে গিয়ে বিধুর গলা দিয়ে মাতৃভাষা বেরিয়ে আসছে।
‘অদ্ভুত,’ শামানও কম অবাক হয়নি।
সরু খালের মতো জায়গাটার অন্যপাশে জঙ্গল অনেকটাই হালকা, এদিকের মতো এত ঘন নয়। সেটা কি প্রাকৃতিকভাবে নাকি মনুষ্যনির্মিত সেটা ঠিক বুঝতে পারল না দূর থেকে, তবে এটা বুঝতে পারল খালের অন্যপাশেই বিরাট একটা বসতি গড়ে উঠেছে খালের কিনারা ধরে। এর কারণটাও বোঝা যায় খুব সহজেই, পানির চাহিদা পূরণের সহজতম উপায়।
খালের অন্যপাশটা বিরাট আকারের তৃণভূমিতে ছাওয়া। খালের এই পাশে যেমন ঝোপঝাড়ে ছাওয়া জঙ্গল, অন্যপাশটাতে একেবারেই সেরকম নয়। অদ্ভুত এক ধরনের লালচে সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে পুরো তৃণভূমি। এর মাঝেই একেবারে মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে বিরাট বিরাট গাছ। সেই গাছের ফাঁকে ছোটো ছোটো কুটিরের মতো। ওগুলো নিশ্চয়ই ওদের বাসস্থান।
কুটিরগুলোও গড়ে উঠেছে একটা নির্দিষ্ট আদলে, মোটেই এলোমেলো নয়। কয়েকটা কুটির থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখল শামান। বড়ো বড়ো খয়েরি কাষ্ঠল গাছের ফাঁকে ফাঁকে ধূসর কুঠির, নিচে লালচে সবুজ তৃণভূমি, আর মাথার ওপরে বড়ো বড়ো গাছের সবুজে ছাওয়া অঞ্চল-সবমিলিয়ে মনে হয় না সত্যিকারের কিছু। বরং শামানের চোখে মনে হলো কাপড়ের ওপরে সুতো দিয়ে সেলাই করা ছবির মতো। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল ও।
‘প্রকৃতি মাতার আশীর্বাদ,’ আনমনেই বলে উঠল ও।
‘শুধু প্রকৃতি মাতার আশীর্বাদ নয়, মানুষের অপরিসীম পরিশ্রমও বটে,’ বলে উঠে পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল ঘোড়ায় বসা সেই মহিলা। একটু অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকাল শামান। এতক্ষণ ধরে ওরা বিজাতীয় এক ভাষায় কথা বলছিল। এবারই প্রথম বিশুদ্ধ তিব্বতি ভাষায় কথা বলে উঠেছে মহিলা। মহিলা কথাটা বলে উঠেই খাল পাড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
আর আনমনেই গালি দিয়ে উঠল বিধু, ‘মাতারির মাতারি, এ দেখি হামারি ভাষায় কথা কয়। তাইলে এতক্ষণ ইতায় কথা কইলি ক্যান?’
কোনো জবাব না দিয়ে ওদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সামনের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে যাবে তার আগেই তিরন্দাজদের একজন কিছু একটা বলে উঠল। কঠিন গলায় জবাব দিল মহিলা। দূর থেকে পরিষ্কার বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারল শামান যে দুজনের ভেতরে বেশ উত্তেজিত বাক্য বিনিময় হচ্ছে। এক পর্যায়ে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল মহিলা। তারপর খালের দিকে ফিরে ইশারা করল অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘড় ঘড় একটা শব্দ হতেই চমকে উঠল বিধু আর শামান।
দুজনেই অবাক হয়ে দেখল ঘড় ঘড় শব্দটা শুরু হতেই ভেজা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটা পাটাতনের মতো উঠে এলো পানির নিচ থেকে। ঘোড়াসহ ওদের দলের লোকজন সেই পাটাতনের ওপরে উঠে পাড় হয়ে এলো খালটা। অন্যপাশে আসতেই শামান আরো ভালোভাবে দেখতে পেল এপাশের বসতি।
জায়গাটা ছোটোখাটো একটা গ্রামের মতো। তবে গ্রাম বললে বাড়িয়ে বলা হবে, শামানের কাছে মনে হলো জায়গাটা কোনো বিশেষ একটা গোত্রের বড়ো কোনো পল্লি হবে। ওর ভাবনাটা আরো দৃঢ় হলো মানুষজনের চেহারা দেখে। বসতির বেশির ভাগ লোকজনই দেখতে কাছাকাছি। কালো গায়ের রং, মাথায় হালকা কোঁকড়ানো চুল, আকৃতিতে ছোটোখাটো তবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই শক্ত সমর্থ। শামান অবাক হয়ে খেয়াল করল মানুষগুলো দেখতে কালো হলেও কোথায় যেন তাদের চেহারায় পাহাড়ি এলাকার রুক্ষতা নেই, বরং বেশ মায়াময়।
একটা ব্যাপার শামানকে বেশ অবাক করল, ওদেরকে ধরে নিয়ে এসেছে যে দল সেই দলে দু ধরনের চেহারা মানুষ দেখেছিল ও। সেই দুই দলের লোকজনের চেহারা এই বসতির লোকদের সঙ্গে বেশ মিলে, বিশেষ করে সেই দলের তলোয়ারধারীদের সঙ্গে, আর দলের অন্য অংশটার সঙ্গে, বিশেষ করে তিরন্দাজদের দলটার সঙ্গে এদের চেহারার কোনো মিল নেই।
ওদের দলটা খালের অন্যপাড়ে এসে বসতিকে একপাশে রেখে হাঁটতে লাগল। বসতির লোকজর ওদেরকে বেশ অবাক হয়ে দেখছে, পুরুষের সংখ্যা খুবই কম। নিশ্চয়ই দিনের এই সময়ে তারা কাজে বেরিয়েছে। বেশির ভাগই মহিলা আর বাচ্চারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে শুরু করেছে ওদেরকে।
বিশেষ করে বাচ্চাদের দেখে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে বিধু, সে হাসি মুখে হাত নাড়ছে অবাক হয়ে থাকা বাচ্চাদের দিকে। শামান হাত বাঁধা অবস্থাতেই নিজের মাথার পেছন থেকে কাপড়ের আলগা অংশটা মাথার ওপরে তুলে দিল, এমনিতেই এই এলাকার লোকজনের তুলনায় অস্বাভাবিক লম্বা ও, তার ওপরে নিজের অদ্ভুত লাল রঙের চুলের কারণে অযাচিত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে না। এমনিতেই কোনো বিপদে পড়েছে, আসলে কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছে না, তবে যতই চারপাশটা দেখছে ও, একটা ধারণা মাথায় পোক্ত হচ্ছে। দেখা যাক সামনে কী অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।
ওদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া দলটা বসতিকে একপাশে রেখে খালের পাড় ধরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। লোকজনের বসবাসের বাড়ি-ঘর পার হয়ে ওরা চলে এলো একটা ফাঁকা মাঠের মতো জায়গায়। তার সামনে বিরাট একটা তৃণভূমির মাঠ, মাঠের পর ছোটো একটা সবুজ টিলা। টিলার অন্যপাশ থেকে আবার শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। বসতির প্রান্তে মাঠের শুরুতেই একটা বিরাট বাড়ি, এতক্ষণ বসতিতে দেখে আসা বাঁশ কিংবা কাঠের তৈরি ঝুপড়িঘরের মতো না এই বাড়িটা, আকারে বিরাট এটা। বাড়িটার সামনেই সবুজ তৃণভূমির মাঠ। শামান অবাক হয়ে দেখল মাঠের অন্যপ্রান্তে জঙ্গলের কিনারায় সারি-সারি কাপড়ের তৈরি ঘর, নিশ্চয়ই এগুলো স্থায়ীভাবে বসবাসের ঘর না। ওরা পাহাড়ে জঙ্গলে সাময়িকভাবে বসবাস করতে গেলে যে-ধরনের অস্থায়ী চামড়ার ঘর বানিয়ে থাকে, অনেকটা সেরকমই দেখতে ওগুলো, তবে ওরা পাহাড়ে বসবাসের জন্যে ব্যবহার করে চামড়া অথবা চামড়ার ফালি দিয়ে তৈরি খোলের মতো ঘর, আর এদের তৈরি আকৃতিগুলো কাপড়ের তৈরি আর আকারেও ওদের অস্থায়ী নির্মাণের চেয়ে বড়ো।
ওদের দলটা সেই বিরাট বাড়ি আর সারিসারি কাপড়ের ঘরের সামনে এসে থেমে গেল। দলের অগ্রভাগে থাকা মহিলা প্রথমেই তিরন্দাজদের একজনকে ডেকে পাঠিয়ে দিল কাপড়ের ঘরগুলোর দিকে, তারপর তলোয়ারবাজদের দলের একজনকে পাঠিয়ে দিল সেই বিরাট বাড়িটার দিকে।
‘অইতাছেডা কি, কিছুই তো বুজতাছি না,’ বিধুকে দেখে মনে হচ্ছে এই প্রথমবারের মতো সে একটু চিন্তিত বোধ করছে। তাই তার মুখ দিয়ে সিংহলি আর তিব্বতি ভাষার মিশ্রিত এক রূপ বেরিয়ে আসছে। ‘এরা আমগোরে এ্যামনে ধইরাই আনল ক্যান, আর কি করতে চাইচ্ছে?’
‘শান্ত থাকো বিধু, অস্থির হবার কিছু নেই,’ শামানের মুখে ফুটে উঠেছে মৃদু হাসি। বিধু ওর হাসিমুখের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। শামানের অবস্থা হয়েছে ঠিক উলটো। এতক্ষণ সে মনে-মনে অনেক কিছুই হিসেব করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু এই প্রথমবারের মতো কোথায় যেন ও নিজের হিসেবে একটা গরমিল দেখতে পাচ্ছে। বিশেষ করে এই মাঠের কিনারায় আসার পর থেকে ওর মনের একটা অংশ ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিধুকে খানিকটা অভয় দেয়ার জন্যেই ও বিধুর দিকে ফিরে তাকিয়ে সামান্য হেসে উঠল, ‘আমার মনে হয়…’ ওর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল তার আগেই কেউ একজন ধমকে উঠল চুপ থাকার জন্যে। শামান মুখ তুলে দেখল সেই কালো মুশকো, ঘুসি খেয়ে যার নিচের ঠোঁট ফেটে গেছে। ‘এই চুপ থাক, রাজা মশাই আইছে,’ বলে সে ওদেরকে টেনে দলের একেবারে অগ্রভাগে নিয়ে এলো।
১. শামান তাকিয়ে দেখতে পেল সেই বিরাট বাড়িটার ভেতর থেকে ছোটো-খাটো একটা সৈন্যবাহিনীর মতো দল বেরিয়ে এসেছে। তাদের অগ্রভাগে সাদা কাপড়ের ঘের দেয়া পোশাক পরা কালো দেখতে একজন ছোটো-খাটো মানুষ। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই দলের নেতা সে। মানুষটার গায়ের রং কালো কিন্তু তার বাকি সবকিছু একেবারেই সাদা, পরনের পোশাক, মাথার চুল, মুখের ছাগুলে দাড়ি সব। আর ক্রমাগত হাসতে থাকার কারণে তার মুক্তার মতো সাদা দাঁতও চোখে পড়ছে।
মানুষটা মাঝখানে হাঁটছে, তার সঙ্গে আরো দুয়েকজনকে দেখা গেল কাছাকাছি পোশাক পরনে তারই সঙ্গে হাঁটতে, অন্যদিকে তাদেরকে দুই পাশ থেকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছে দুই সারিতে সুসজ্জিত তলোয়ারধারী সৈন্যদের দল। মানুষটা আরেকটু এগিয়ে আসতেই ওদের দলের অগ্রভাগে থাকা সেই মহিলা ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে গেল তার দিকে, মুখ থেকে মুখাবরণ সরিয়ে রাজার সামনে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে আভিবাদন করল। শামান অবাক হয়ে খেয়াল করল রাজা দুই হাত বাড়িয়ে সেই মহিলার মুখটা ধরে ফেলল। তার বেশ স্নেহের সঙ্গে তার কপালে চুমু খেল। আর তখুনি মহিলা শামানের দিকে ফিরে তাকিয়ে কিছু একটা বলে উঠল রাজাকে। দূরে থাকায় সেটা শুনতে পেল না শামান। তবে এই প্রথমবারের মতো মহিলার মুখের দিকে তাকাতেই বেশ খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ও।
সেই জঙ্গলের পথে সাজানো ডাকাতির ঘটনার সময় থেকেই মহিলার মুখ কাপড়ের আবরণে ঢাকা ছিল তাই তার চেহারা দেখতে পায়নি ওরা কেউই। শুধু তার গলার স্বর আর ভয়ংকর আগ্রাসী নেতৃত্বই দেখে এসেছে এতক্ষণ, তাই প্রথমবারের মতো মুখটা দেখতে পেয়ে খুব অবাক হলো শামান।
প্রথমেই মনে হলো, ওর সামনে থাকা মেয়েটার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না কোনোভাবেই। আগের দিনের সন্ধের রান্না করার চুলার ধূসর ছাইয়ের মতো হালকা শ্যামবর্ণের একটা মুখ, তাকে যেন শিল্পীর দক্ষতা নিয়ে বসানো নিখুঁত একটা তিলফুলের মতো নাক, তার দুই পাশে ধবধবে সাদা জমিনে অপূর্ব সুন্দর দু-টুকরো ধূসর চোখের মণিতে যেন প্রকৃতির সমস্ত মায়া আর কাঠিন্য একসঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। শামানের মুগ্ধ দৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থির রাখতে পারল না তার চোখ-মুখের দিকে, তার আগেই মাঠের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসা চিৎকার চেঁচামেচির কারণে সেদিকে ফিরে তাকাল ওরা সবাই।
মাঠের অন্য দিকের সেই সারি সারি কাপড়ের ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে একদল লোক। হইহল্লা করতে করতে তারা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। লোকগুলোকে দেখে শামানের মুখে পুরনো হাসিটা ফিরে এলো। মনে মনে ও এতক্ষণ যা হিসেব করছিল সেটা এবার পুরোপুরি মিলতে শুরু করেছে।
অন্যদিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকা লোকগুলোর চেহারা-আকৃতি-গায়ের রং সবই আগের মানুষদের থেকে একেবারেই ভিন্ন। এরা লম্বা, গায়ের রং ঠিক যতটা পরিষ্কার এদের পোশাক-আশাক ঠিক ততটাই নোংরা। যারা এগিয়ে আসছে তাদের নেতৃত্বে আছে, লম্বা অল্প বয়স্ক এক লোক, তার সঙ্গে বিশ-পঁচিশজনের একটা দল। প্রত্যেকের হাতে তির-ধনুক। হইহল্লা করতে করতে করতে ওরা এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ওদের দলের অগ্রভাবে অবস্থানরত সেই সাদা পোশাকের কালো রাজার সামনে এসে থেমে গেল দলটা। দুই দলের ভেতরে অভিবাদন বিনিময় হতে দেখল শামান। সামান্য কথোপকথনের পর দুই দলের লোকজনই ফিরে তাকাল ওদের দিকে।
বহুক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এতক্ষণে নিজের ধৈর্য হারাল শামান। জোর কদমে এগিয়ে যেতে শুরু করল সামনের দিকে। ওকে বেঁধে রাখা দড়িটা যার হাতে ছিল, সে ওটা টেনে ধরতেই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চপেটাঘাত বসিয়ে দিল তার মুখে, চড় খেয়ে তাজ্জব হয়ে থাকা লোকটার হাত থেকে দড়িটা ছুটিয়ে নিয়ে ও এগিয়ে গেল সামনের দিকে। দুই বাহিনীর লোকজনই সচকিত হয়ে উঠতেই সেই ধূসর সুন্দরী একটা হাত তুলে থামতে বলল সবাইকে।
ওদের সামনে গিয়ে একবার মাথা নেড়ে ও রাজাকে উদ্দেশ্য করে। হ্যাঁ, ওদের থামতে বলাই সবার জন্যে ভালো হবে, কারণ যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছি আমি। আপনাদের এলাকায় মেহমানকে এভাবেই আপ্যায়ন করেন নাকি আপনারা?’ বলে ও একে-একে দুই বাহিনীর প্রধানের দিকে দেখল তারপর ফিরে তাকাল সেই ধূসর সুন্দরীর দিকে।
মেয়েটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল, ‘তুমি মেহমান! কে বলেছে—’
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কথা বলে উঠল শামান, ‘আমার যদি ভুল না হয় তবে আপনি,’ বলে ও সেই সাদা রাজাকে দেখাল, ‘থারু বংশীয় গোত্রের প্রধান, আর আপনি,’ বলে সে দ্বিতীয় বাহিনীর প্রধান লম্বা লোকটাকে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘আপনি হলেন বৌদ্ধ বংশদ্ভূত শাক্য গোত্রের প্রধান। আপনাদের খোঁজেই আমি আর বিধু,’ বলে সে বিধুকে দেখাল। ‘আমরা লামা নোরবুর নির্দেশে ডুকপা লামাকে খুঁজে বের করতে এসেছি। ঠিক কি না?’
ওর প্রশ্নের জবাব দিল না কেউই। শামানই বলতে লাগল আবারো, ‘কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা এসেছি আপনাদের সাহায্য করতে তবে এই ছল-চাতুরীর কী দরকার ছিল? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, থারু আর শাক্য দুই শত্রু গোত্র একসঙ্গে হলো কিভাবে?’
দুই দলের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শামানের দিকে। আর শামান মনে-মনে আশা করছে ওর অনুমান ঠিক হলেই হয়। মুহূর্তের জন্যে সব স্থবির হয়ে রইল। তারপর সেই সাদা রাজা হেসে উঠল, একবার ধূসর সুন্দরী আর তিরন্দাজ বাহিনীর প্রধানের দিকে তাকিয়ে সে ফিরে তাকাল শামানের দিকে। ‘আমার ধারণা আমাদের অনেক কিছু আলোচনা করতে হবে। তাই যত দ্রুত শুরু করব আমরা ততই ভালো,’ বলে সে মুক্তোর মতো সাদা দাঁত দেখিয়ে আবারো হেসে উঠল কিন্তু তার হাসিতে যোগ দিতে পারল না শামান।