অধ্যায় তেরো – বর্তমান সময়
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ, সিলেট
‘এর মানে কি?’ তানভীর আবাক হয়ে একবার ইন্সপেক্টর ইকবালকে দেখল, তারপর ফিরে তাকাল সুলতান আর টমির দিকে। ‘আমি প্রথম থেকে শুনে আসছি কেসটা হলো একজন শিক্ষকের মিসিং কেস। এখন সেটা পুরো দলের মিসিং কেস কিভাবে হলো? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সুদর্শন ইন্সপেক্টর ইকবালও একটু অবাক হয়ে গেছে তানভীরের কথা শুনে। নার্ভাস ভঙ্গিতে সে দুই ভ্রুর মাঝের তিলটা ঘষতে ঘষতে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনাকে কী ইনফর্ম করা হয়েছে সেটা তো আমি বলতে পারব না, তবে এই কেসটা শুরু থেকেই পুরো দলের মিসিং কেস। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক দুয়েকটা ব্যাপারও জড়িত আছে, এ কারণেই কেসটা পুলিশ থেকে ইএএফের অধীনে ট্রান্সফার করা হয়। ব্যপারটা যদি শুধুই একজন শিক্ষকের মিসিং কেস হতো তবে সেটা ইএএফকে হস্তান্তর করার কোনো কারণ ছিল না।’
‘আশ্চর্য ইএএফ থেকে কেসটা নিয়ে ডিল করার জন্যে অ্যানালিসিস উইংকে অনুরোধ করা হলো, অথচ মূল ব্যাপারটাই চেপে গেল ওরা, এ কেমন কথা?’ বলেই তানভীরের মনে পড়ল পাশা স্যার ওকে বলেছিল ডক্টর মিতায়নের সঙ্গে টেড চ্যাঙ ছিল, হয়তো পাশা স্যার সব জানত কিন্তু ওকে বিস্তারিত বলেনি। অথবা হতে পারে ওর বোঝার ভুল। ঘটনা যাই ঘটে থাকুক মনে মনে ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, একবার যেহেতু কাজে নেমেছে কাজেই এ থেকে পেছানোর কোনো ইচ্ছে ওর নেই। বরং এই কেসে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ঢেলে দেবে ও। কারণ ট্রেনিংয়ে যা শিখে এসেছে সেটাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার এরচেয়ে ভালো সুযোগ আসলেই আর হবে না, আর তা ছাড়া এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যানালিসিস উইং আর পাশা স্যারের ইমেজ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ও ফিরে তাকাল ইকবালের দিকে। যাই হোক, এরপর কী হলো বলে যান, প্লিজ।’
তানভীরের অনুমতি পেয়ে ইকবাল আবারো শুরু করল। ‘ডক্টর মিতায়ন আর তার পুরো টিমই গায়েব হয়ে গেছে এটা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়ি আমরা। প্রথমেই তামাবিল বর্ডারে যোগাযোগ করে তাদের এন্ট্রির সময়টা কনফার্ম করা হয়। ওখানে যোগাযোগ করে জানা যায় ভোর তিনটার দিকে তামাবিল বর্ডার দিয়ে তাদের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যদি অন্যান্য অফিসিয়াল ও ডক্টর মিতায়নের স্ত্রীর ভাষ্য মেলানো হয় তবে সেখান থেকে তাদের সোজা চলে যাবার কথা এয়ারপোর্টে, কিন্তু ভোর হয়ে যাবার পরও তারা এয়ারপোর্টে পৌছায়নি। কিংবা অন্য কোথাও তাদের পাওয়া যায়নি।’
‘তারমানে তামাবিল বর্ডার থেকে এয়ারপোর্টে যাবার পথেই কোনো একটা জায়গায় গায়েব হয়ে গেছে ডক্টর মিতায়ন আর তার টিম,’ তানভীর ছোটো ছোটো নোট লিখে রাখছে ওর মোবাইলের নোট অপশনে। ‘আচ্ছা, এরপর কী হলো?’
‘স্যার, আমরা উনাদের টিমের মিসিং হবার ব্যাপারটা কনফার্ম হওয়া মাত্রই এয়ারপোর্ট, সিলেট রেলস্টেশন, নদীপথ এমনকি প্রতিটি প্রধান সড়ক পথে ডক্টর মিতায়নসহ তার টিমের সবার ছবিসহ সতর্ক পাহারা বসিয়ে দিই।’
‘তাদের মিসিং হবার সময় থেকে কতক্ষণের ভেতরে এই পাহারা বসানো হয়?’ তানভীর জানতে চাইল।
‘স্যার, আমার ধারণা তারা মিসিং হবার আট থেকে দশ ঘণ্টার ভেতরে,’ ইকবালের জবাবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা টুকে নিল তানভীর।
‘আচ্ছা, এরপর কী করলেন আপনারা?’
‘স্যার, এরপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলি আমরা, সেইসঙ্গে এই আর্কিওলজির দলটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের হদিস বের করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুই পাইনি আমরা। এরই মধ্যে একদিন পার হয়ে গেছে এমন সময় ওপর মহল থেকে আমাদের জানানো হয় কেস পুলিশ থেকে ইএএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে জানানো হয় ইএএফের প্রতিনিধিকে সিলেট পাঠানো হচ্ছে, এরপরেই আপনি আসেন স্যার,’ বলে ইকবাল মাথা নেড়ে তার কথা শেষ করল।
‘বুঝতে পেরেছি,’ বলে তানভীর এক মুহূর্ত চিন্তা করল। ‘আচ্ছা ডক্টর মিতায়ন আর তার টিমের ব্যাপারে আমি সব জানতে চাই। সেইসঙ্গে তারা যে আর্কিওলজিক্যাল এক্সপিডিশন চালাচ্ছিল সেটার ব্যাপারেও।’
তানভীরের কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্কুলের বাচ্চাদের মতো একটা হাত তুলল টমি পোদ্দার। ‘বস, অনুমতি পেলে এখান থেকে আমি আলোচনা শুরু করতে চাই,’ পাপেটের মতো মেয়েলি ঢঙে বলে উঠল সে। তানভীর মাথা নেড়ে অনুমতি দিতেই পুরনো আমলের টুপিটা খুলে সে শিস দিতে দিতে এগিয়ে গেল টেবিলের ওপরে রাখা ল্যাপটপের দিকে।
‘হুম্,’ মৃদু কাশি দিয়ে শুরু করল টমি, ‘গুড মর্নিং, সরি গুড আফটার নুন, ‘ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘আমি টমি, এখন আমি আপনাদেরকে ব্রিফ করতে যাচ্ছি ডক্টর মিতায়ন, তার টিম আর তাদের আর্কিওলজিক্যাল এক্সপিডিশন মিশনের ব্যাপারে,’ বলে সে মাউজটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করল। আর তার কথা বলার ধরন দেখে তানভীরের মনে পড়ে গেল ছোটোবেলায় বিটিভিতে দেখা নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানের কথা। সেখানে ছোটো ছোটো উপস্থাপকরা এইভাবে টেনে টেনে শিশুতোষ ভঙ্গিতে উপস্থাপনা করত। নতুন কুঁড়ির পর এভাবে কাউকে কথা বলতে শুনেছে বলে মনে পড়ে না তানভীরের।
টমির ল্যাপটপে একটা পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড ওপেন করতেই সেখানে একজন মানুষের ছবি দেখা গেল। হালকা মঙ্গলয়েড ধাঁচের চেহারা, বাংলাদেশে সাধারণত এই ধরনের চেহারা দেখা যায় ট্রাইবাল কমিউনিটির লোকজনের। মাথায় ঘন চুল, একটু গোলগাল মুখমণ্ডল, ডান চোখের নিচে একটা ছোটো কাটা দাগ। কালো চশমা আর ধূসর স্যুট পরা হাসি-খুশি একজন মানুষ।
‘ডক্টর মিতায়ন আহমেদ। বয়স প্রায় চল্লিশ, জন্ম, বাংলাদেশেরই বৃহত্তর সিলেটের একটি ট্রাইবাল কমিউনিটিতে। খুব ছোটোবেলায় পরিবারের সঙ্গে সে লন্ডনে মাইগ্রেট করে,’ বলে সে পরের স্লাইডে চলে গেল। সেখানে ডক্টর মিতায়নের ব্যাপারে প্রথমিক সব তথ্য বুলেট পয়েন্ট আকারে লেখা আছে। শাবিপ্রবির ডাটাবেইজের তথ্য মতে, সেখানেই সে পড়ালেখা করে, স্কুল-কলেজ শেষে গ্র্যাজুয়েশন এরপর ডক্টরেট ও পোস্ট ডক্টরেট। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। পোস্ট ডক করার পর একটা আন্তর্জাতিক আর্কিওলজিক্যাল সংস্থায় কাজ করত। আজ থেকে বছর চারেক আগে শাবিপ্রবিতে আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট খোলার বছরখানেকের মাথায় সে সেখানে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে আবেদন করলে তার মতো প্রোফাইলের একজন মানুষকে একরকম লুফে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে জয়েন করার কিছুদিনের ভেতরেই সে একটা প্রজেক্ট নিয়ে আসে। সেটার অধীনেই ভারত বাংলাদেশ মিলে আসামে যৌথ অভিযান চালানো শুরু হয়।’
‘তার এই প্রজেক্টের সঙ্গে কি ডিপার্টমেন্টের অন্য কেউ বা কোনো শিক্ষক সংযুক্ত ছিল?’ তানভীর জানতে চাইল।
‘না, সরাসরি কেউই সংযুক্ত ছিল না। মানে ফিল্ড লেভেলে না। তবে হ্যাঁ, দেশের দুয়েকজন নামকরা আর্কিওলজিস্ট এই প্রজেক্টের উপদেষ্টা ছিল, শাবিপ্রবি আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপারসনও তাদের একজন। ‘
তানভীর একটা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল কথাটা। ‘এসব উপদেষ্টাদের কোনো দাম নেই। এরা কিছু জানেও না। এই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী লোকজনকে এসব প্রজেক্ট রাখতে হয় একরকম বাধ্য হয়ে। এদেরকে না রাখলে প্রজেক্টর ভ্যালু বাড়ে না, সেইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অনুমতি পেতেও সমস্যা হয়।’
‘তবে ফিল্ড লেভেলে তার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ডক্টর মিতায়নের পূর্ববর্তী কাজের ক্ষেত্র-সাউথ এশিয়ান জোনের প্রধান ডক্টর টেড চ্যাঙ,’ বলে টমি পোদ্দার আরেকটা স্লাইড ওপেন করল। সেখানে চায়নিজ মতো দেখতে একজন মানুষের ছবি দেখা গেল। পরনে নীল টি-শার্ট, ন্যাড়া মাথা, মুখে সাদা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। চোখে কালো সানগ্লাস। ‘মূলত টেড চ্যাঙ আর ডক্টর মিতায়ন মিলেই এই এক্সপিডিশনটা চালাচ্ছিল গত দুই বছর ধরে।’
‘এক্সপিডিশনটা ছিল কী নিয়ে?’
‘ডক্টর মিতায়ন আর তার টিম গায়েব হয়ে যাবার পর তাদের অফিস থেকে পাওয়া নথি থেকে, তাদের ব্লগ থেকে আর সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমরা যা বুঝতে পেরেছি সেটা অনেকটা এরকম; তারা সম্ভবত বৃহত্তর এশিয়ার মেজর কোনো ধর্মসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। খুব বিস্তারিত না হলেও এটুকু জানা গেছে তারা বহু পুরনো কোনো এক নথি থেকে এই ব্যাপারে সন্ধান পেয়ে একেবারে নেপাল থেকে শুরু করে এই গোত্রের সন্ধান করে আসামে এসে এদের ট্রেস করার চেষ্টা করছিলেন। যদি তারা এই কাজে সফল হতে পারত তবে নাকি এই অঞ্চলের ধর্মীয় ইতিহাসের ব্যাপারটা একেবারেই নতুন একটা সংযোগ হবার সম্ভাবনা ছিল। এমনকি তাদের এই আবিষ্কারের ফলে নাকি এশিয়ার এই জোনের রিলিজিয়াস অ্যানথ্রোপলজিক্যাল এভুলুশনের ইতিহাস যেভাবে বর্ণিত আছে তার অনেকটাই বদলে যেতে পারত।’
‘তারমানে তাদের এক্সপিডিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের যে খোঁজ বা আবিষ্কার সেটার কতটুকু গভীরে যেতে পেরেছিল?’
‘এটা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না,’ টমি পোদ্দার মাথা নাড়ল। ‘প্রফেসরদের যে একাডেমিক লগ, সেটা আমরা তাদের অফিসিয়াল নথিতে পাইনি। সেটা না পেলে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে এটা বুঝতে পেরেছি তারা গত দুই বছর ধরে টুকরো টুকরো অভিযান চালালেও গত একবছরে তাদের টুকরো অভিযানের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছিল, সেইসঙ্গে এটাও যোগ করা চলে, এইবারের অভিযান ছিল তাদের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড়ো অভিযান। গত দেড় মাস ধরেই তারা আসামে অবস্থান করছিল। এর আগে এত লম্বা সময় ধরে তারা কখনো অভিযান পরিচালনা করেনি।’
‘তারমানে এমনটা হতেই পারে এবারের অভিযানে তারা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে প্রবেশের পর কেন তারা এভাবে গায়েব হয়ে যাবে, তাও কোনো ট্রেস না রেখেই?’ তানভীরের মনে অন্য একটা সন্দেহ উঁকি দিতে শুরু করেছে। ‘আচ্ছা, ডক্টর মিতায়ন আর টেড চ্যাঙের দলে আর কে কে ছিল?’
তানভীরের প্রশ্ন শোনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টমি ল্যাটপটের বাটন চাপল, ‘রঘুবীর, তাদের ট্রান্সপোর্টের ড্রাইভার,’ বলে সে স্লাইডে একজন মোচওয়ালা লাল শার্ট পরা লোকের ছবি দেখাল, এই প্রজেক্টের জন্যেই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়, আর দুজন গার্ড ও একজন সেক্রেটারি,’ বলে সে একে একে তিনজনের ছবি দেখাল। ‘এই তিনজনের ভেতরে দুজন ছিল প্রফেশনাল মার্সেনারি, এদেরকে সেই আন্তর্জাতিক সংস্থা সিকিউরিটি পারপাসে নিয়োগ দিয়েছিল। আর শেষজন বাংলাদেশি একজন ইন্টার্ন, সে জাহাঙ্গীরনগরের আর্কিওলজির ছাত্র। সে মূলত লগ মেন্টেইন করা থেকে শুরু করে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক কাজে দুই প্রফেসরকে সাহায্য করত। তবে এবারের অভিযানে সে যেতে পারেনি অসুস্থতার কারণে।’
‘ব্যাস, এই কজন?’ তানভীর একটু অবাক। কারণ এত গুরুত্বপূর্ণ একটা এক্সপিডিশন আর তাতে মাত্র এই কজন-ব্যাপারটা খুব অবাক করছে ওকে। ‘তাদের সঙ্গে আর কোনো ছাত্র-ছাত্রী বা ইন্টার্ন ছিল না? এত ছোটো ছিল তাদের টিম?’
‘অবশ্যই না,’ বলে টমি মৃদু হেসে উঠল। ‘তাদের টিম আকারে প্রায় এর দ্বিগুণ ছিল, কিন্তু টিমের বাকি সদস্যরা ছিল আসাম ইউনিভিার্সিটির লোকজন। তাদের ব্যাপারে আমরা খুব বিশদ কিছু জানি না। তবে তাদের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে ভারতের কাছে,’ বলে টমি একবার মাথা নাড়ল।
‘এখানে আমার মনে হয়, হঠাৎ কথা বলে উঠল সাব-ইন্সপেক্টর ইকবাল ভারতের কাছে তথ্য চেয়ে যতটা না কাজ হবে তারচেয়ে বেশি কাজ হবে সেই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে তথ্য চাইলে। কারণ ভারতীয় বাংলাদেশি যারাই কাজ করুক না কেন সবাই নিশ্চয়ই তাদের অধীনেই কাজ করেছে,’ বলে সে তানভীরের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।
‘অবশ্যই, তানভীর খুশি হয়ে উঠল সাব ইন্সপেক্টরের সাজেশনে, লোকটার বুদ্ধি আছে মনে হচ্ছে। ডক্টর টেড চ্যাঙ যে সংস্থায় কাজ করত সেটার নাম কি?’
সাইথ এশিয়ান আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে ‘সায়া’ নামে পরিচিত সংস্থাটি।’
‘হ্যাঁ, তাদের কাছে সবার ব্যাপারে আরো বিস্তারিত তথ্য চেয়ে পাঠান আরেকটা ব্যাপার, ডক্টর মিতায়নের টিমে যারাই ছিল সবার পরিবার বাড়ি-ঘরে খবর নেয়া হয়েছে?’ শেষ প্রশ্নটা তানভীর জানতে চাইল। মানে, তারা কেউই বাড়িতে বা অন্য কোথাও পৌঁছেছে কি না, অথবা বাড়ির লোকজন বা অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কি না?’
‘সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কেউই ফিরেও যায়নি, কেউই কারো সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। ডক্টর মিতায়ন বা তার টিম তাদের পরিবার কিংবা বন্ধু- বান্ধব কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা মাত্রই আমরা জানতে পারব। সেরকমই ব্যবস্থা করা আছে।’
‘আচ্ছা, ডক্টর মিতায়নের পরিবারে কে কে আছে?’ তানভীর তার মোবাইলের নোট প্যাডে নেয়া ছোটো ছোটো নোটগুলো মিলিয়ে ওয়ার্কপ্ল্যান বানানোর চেষ্টা করছে।
টমি পোদ্দার তার সামনে রাখা ফাইলে মিলিয়ে দেখল, ‘শুধু তার স্ত্রী। মিসেস মিতায়ন। উনিও শাবিপ্রবির শিক্ষক, অ্যানথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টের। উনি শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসেই আছেন।’
অ্যানথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্ট শুব্দটা শুনে তানভীরের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা একটা লাফ দিল। একটু চুপ থেকে সে যোগ করল, ‘উনার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে। আচ্ছা উনাদের এই প্রজেক্টের কোনো অফিস ছিল?’
‘জ্বি, জিন্দাবাজার সিলেট মিলেনিয়ামে ‘সায়া’র মানে সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটা টেম্পোরারি অফিস আছে। আর শাবিপ্রবি ‘ডি’ বিল্ডিংয়েও ওদের একটা শাখা অফিস আছে, মানে ওখানে ডক্টর মিতায়নের রুমটাকেই টেম্পোরারি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হতো।’
‘আপনারা কি এই দুটো অফিস চেক করে দেখেছেন?’ তানভীর জানতে চাইল।
‘অবশ্যই, সিলেট মিলেনিয়ামে যে অফিসটা আছে সেখান থেকেই মূলত আমরা আজকের আলোচনা করা তথ্যগুলো পেয়েছি। ওখানে আর কিছুই নেই। ওই অফিস পুলিশ সিল করে দিয়েছে। তবে ডক্টর মিতায়নের অফিসটা সেভাবে চেক করে দেখা সম্ভব হয়নি।’
‘তাহলে আমরা কাজ শুরু করে দিই। কেসের প্রাথমিক ব্যাপারগুলো খুব ভালোভাবেই বোঝা গেছে। আমার বিশ্বাস এই রুমে অবস্থিত সবাই সেটা বুঝতে পেরেছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, আমার সঙ্গে ফিল্ডে কে কে থাকছে?’ প্রশ্নটা করেই সে প্রথমে ফিরে তাকাল সাব-ইন্সপেক্টর ইকবালের দিকে। ‘আপনি কি আমার টিমে থাকছেন?’
‘জি, স্যার। আমার ওপরে সে নির্দেশনাই আছে,’ ইকবাল মাথা নেড়ে উত্তর দিল।
‘স্যার, আমি আপনার সঙ্গে থাকছি অপারেশনের স্ট্রাইকিং আর ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে,’ সুলতান আবারো সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তানভীর তার দিকে ফিরে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে টমির দিকে ফিরে তাকাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে।
টমি আবারো তার যথাযথ ভঙ্গিতে দুই হাত তুলল ওপরের দিকে। ‘আমি হলাম আলফ্রেড,’ বলে সে হেসে উঠল।
প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পরেই তানভীর ধরতে পারল টমি আসলে কী বলছে।
মৃদু হেসে ও বলে উঠল। ‘ব্যাটম্যানের আলফ্রেড, ‘ম্যান অন দ্য চেয়ার’। ঠিক আছে আপনি তাহলে আমাদের সব ধরনের আইটি সাপোর্ট, সাইবার ম্যাটেরিয়ালের ব্যাকআপ দেবেন।’
‘আমি যদিও আপনাদের কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না, তবুও যেকোনো ব্যাপারে আপনারা আমার সহায়তা পাবেন,’ বলে কাঁচা-পাকা, চুল-দাড়ির ডক্টর প্রবীর মৃদু হেসে যোগ করল। ‘অবশ্যই আনঅফিসিয়ালি।’
‘তাহলে, আমাদের টিমে থাকছি আমি, কমান্ডার অব দ্য অপারেশন, সাব- ইন্সপেক্টর ইকবাল ও সুলতান,’ বলে একটু থেমে যোগ করল, ‘আমাদের কার সঙ্গে কী ধরনের ইক্যুইপমেন্ট থাকছে, আমার জানা দরকার।’
‘আমার সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু রিভলবার, আর আমার অফিসিয়াল ওয়াকিটকি, ‘ ইকবাল বলল।
‘আমার সঙ্গে এগুলো,’ বলে সুলতান তার ব্লেজারের ভেতর থেকে বের করে আনল বিরাট আকারের নল লম্বা দুটো পিস্তল। তানভীর অবাক হয়ে পিস্তুল দুটো দেখল এক মুহূর্ত। ‘ঠিক আছে, চলবে। আমাদের সবাইকে মোবাইল নম্বর এক্সচেঞ্জ করতে হবে, আর কমন কোনো কমিউনিকেটিং ডিভাইস দরকার আমাদের,’ শেষ কথাটা ও বলেছে টমিকে উদ্দেশ করে।
‘অবশ্যই, আমি এরই মধ্যে ব্যবস্থা করে রেখেছি,’ বলে সে চেয়ারের ওপরে রাখা তার ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে আনল একটা গয়নার বাক্সের মতো দেখতে চকোলেট রঙের বাক্স। সেটার ভেতর থেকে সে সবাইকে একটা ছোটো এয়ার পিস বের করে দিল। তানভীরের নির্দেশে সবাই সেগুলো পরে নিল যার যার কানে। তানভীরের এয়ার পিসটা টমি নিজেই তার কানে পরিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘বেস্ট অব লাক, স্যার।’
তার দিকে একবার নড করে বাকিদের দিকে তাকিয়ে তানভীর বলল, চলুন, কাজ শুরু করা যাক। দেখা যাক ভাগ্য আমাদের জন্যে কী অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে।’