ব্ল্যাক ফ্রাইডে

শুক্রবার মুসলমানদের জন্য পবিত্র একটি দিন। খ্রিষ্টানদের রোববার, ইহুদিদের শনিবার। সপ্তাহের তিন দিন, তিন ধর্মাবলম্বীরা নিয়ে বসে আছে।
শুক্রবার মুসলমানদের পবিত্র দিন বলেই কি আমেরিকানরা ‘কালো শুক্রবার’ আবিষ্কার করল? থ্যাংকস গিভিংয়ের রাত থেকেই শুরু এই কালো শুক্রবার। একটি দিনের জন্য কম দামে জিনিসপত্র বিক্রির মহোৎসব। ৪০ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন, যার দাম এক হাজার ডলার, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কালো শুক্রবারে তা বিক্রি হয় ২০০ ডলারে। আমেরিকানরা বড় বড় দোকানের সামনে প্রচণ্ড শীত অগ্রাহ্য করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। কখন রাত ১০টা বাজবে, কখন শুরু হবে কালো শুক্রবার?
গত বছরের কালো শুক্রবারে দোকানে ঢোকার ধাক্কাধাক্কিতেই নাকি মারা গেছে পাঁচজন। ‘সেল’ শুনলেই আমেরিকানদের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। জীবন বাজি রেখে হলেও ‘সেলে’ জিনিস কিনতে হবে। সেই জিনিস কাজে লাগুক বা না লাগুক। আমেরিকা পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে অকারণ শপিং করে দেউলিয়া হওয়া যায়। ব্যাংক বাড়িঘর নিয়ে নেয়। এমনও হয়, গৃহত্যাগীরা পথে হাঁটাহাঁটি শুরু করে। টিভির খবরে দেখলাম, এই ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে সারা আমেরিকায় ৫৫ বিলিয়ন ডলারের জিনিসপত্র বিক্রি হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এ বছরের বাংলাদেশের বাজেটের দ্বিগুণ এক ব্ল্যাক ফ্রাইডের বিক্রি।
এ বছরের কালো শুক্রবারটা আমার দেখার শখ ছিল। শরীরে কুলোয়নি বলে যাওয়া হয়নি। একটি লাভ অবশ্যি হয়েছে, টেলিফোনে আমার এক প্রিয় কবির সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁর প্রথম কথা, ‘হুমায়ূন! তোমার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি কেন?’
কবির কণ্ঠস্বর তেজি। গলা শুনে বোঝার উপায় নেই, উনি শারীরিকভাবে অচল হয়ে গেছেন। খুব মন খারাপ হলো যখন উনি বললেন, হুমায়ূন! আমার জীবন হুইলচেয়ারে আটকে গেছে।

আমি এক মিনিটের বেশি হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে পারি না। আমার কিডনি নষ্ট। ছয় বছর বেঁচে আছি ডায়ালাইসিসের ওপর। ডায়ালাইসিস নিয়ে পাঁচ বছরের বেশি কেউ বাঁচে না। আমি এক বছর বেশি বেঁচে আছি। সেটাই বা খারাপ কী? হুমায়ূন! বয়সে আমি বড় বলে তোমাকে তুমি করে বলছি। সমস্যা আছে?
আমি বললাম, আপনার ক্ষেত্রে নেই।
কবির নাম শহীদ কাদরী।
‘রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে স্বাধীনতা দিবসের
সাঁজোয়া বাহিনী,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,
কারফিউ, ১৪৪ ধারা,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে ধাবমান খাকি
জিপের পেছনে মন্ত্রীর কালো গাড়ি,
কাঠগড়া গরাদের সারি সারি খোপ
কাতারে কাতারে রাজবন্দী’
(রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট; শহীদ কাদরী)
আমি কবিকে বললাম, আপনার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি, কিন্তু আপনার অনেক গল্প আমি জানি।
কবি বললেন, কী গল্প জানো?
আমি বললাম, আপনি একদিন দুর্বল এক কবির বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছেন। দুর্বল কবির বিশাল বাড়ি দেখে বিস্মিত হয়ে হিন্দিতে বললেন, ‘এতনা ছোটা কবি কা এতনা বড় মোকাম!’
কবি হো হো করে হেসে ফেলে বললেন, হুমায়ূন, একদিনের কথা বলি। আমি শামসুর রাহমানকে নিয়ে বের হয়েছি। কারও পকেটেই টাকা-পয়সা নেই। রাস্তার পাশের দোকান থেকে দুই কাপ চা কিনে চুমুক দিচ্ছি, হঠাৎ দেখি, কালো মরিস মাইনর গাড়িতে করে বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী যাচ্ছেন। শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘দেখো, আমরা দুই প্রধান কবি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি, রিকশায় ওঠার সামর্থ্যও নেই, আর একজন ফোক সিঙ্গার গাড়িতে চড়ে ঘুরছে। কোনো মানে হয়?’
আসাদুজ্জামান নূর এই কবির সঙ্গে চাকরি করতেন। মনে হয় সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্যকেন্দ্রে চাকরি। শহীদ কাদরী ছিলেন নূরের বস। নূরের কাছে শুনেছি, একদিন কবি অফিসে এসে ফাইলপত্র ছুড়ে ফেলে বললেন, হিন্দি চুলের চাকরি শহীদ কাদরী করে না। বলেই যে বের হলেন, আর কোনো দিন অফিসে ফিরলেন না।
এই মুহূর্তে দেশের একজন প্রধান কবি পড়ে আছেন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। কোনো মানে হয়? তিনি কি তাঁর দেশের অপূর্ব জোছনা দেখবেন না? তাঁর গায়ে কি বর্ষার প্রথম জলধারা পড়বে না? তিনি কি আর কোনো দিনও হাতে নেবেন না বাংলাদেশের বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল?

‘ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে তোমাকে প্রিয়তমা!
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করব
কত বাঙ্কার ডিঙিয়ে
কাঁটাতার, ব্যারিকেড পার হয়ে অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মিদের কারগুলি এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা’
(তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা; শহীদ কাদরী।)

কবি! আপনাকে অভিবাদন!

পাদটীকা
হুমায়ূন! আমি নাস্তিক মানুষ। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রার্থনায় বিশ্বাস করা শুরু করেছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমেরিকার সব হাসপাতালে রোগীদের জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। স্ট্যাটিসটিকসে দেখা গেছে, যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
আমি আমার স্ত্রীকে আপনার জন্য প্রার্থনা করতে বলেছি।
শহীদ কাদরী
ব্ল্যাক ফ্রাইডে ২০১১
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক
পুনশ্চ
দুর্বল কবি এবং ফোক সিঙ্গারের নাম আমার লেখায় ছিল। শহীদ কাদরীর অনুরোধে দুটি নাম বাদ রাখলাম। পাঠকদের কাছে ধাঁধা—নাম দুটি কী? সঠিক উত্তরদাতার কাছে প্রথম আলোর এক কপি ডাকযোগে পৌঁছে যাবে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *