ব্ল্যাক উইডো বনাম সিংহ

ব্ল্যাক উইডো বনাম সিংহ 

টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে মাঠে ছোটাছুটি করা ছেলেমেয়েদের দেখছিল। সে নিজেও মাঝে মাঝে তাদের সাথে ছোটাছুটি করে খেলে কিন্তু তার বেশি ভালো লাগে সবাইকে দেখতে। প্রত্যেকটা ছেলে না হয় মেয়ে একজন আরেকজন থেকে আলাদা, প্রত্যেকের নিজের একটা ভাবভঙ্গি আছে। খেলার মাঝে কখনও উত্তেজনা, কখনো আনন্দ, কখনো কৌতুক, কখনও দুষ্টুমি, কখনও ঝগড়াঝাঁটি—টুনির মনে হয় সে ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখেই একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। 

হঠাৎ করে সে একটা রেগে যাওয়া গলার স্বর শুনতে পেল, একটি মেয়ের গলা, কী বলছে বোঝা গেল না কিন্তু সে যে খুব রেগে গিয়ে কিছু একটা বলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। টুনি মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, একটা মেয়ে কোমরে হাত দিয়ে একটা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবারে ছেলেটা মুখ ভেংচে কিছু একটা বলল, কী বলেছে বোঝা গেল না কিন্তু শুনে মেয়েটা যে প্রচণ্ড রেগে উঠেছে তাতে সন্দেহ নেই। মেয়েটা এবারে চিৎকার করে ছেলেটাকে একটা ধাক্কা দিল এবং কিছু বোঝার আগেই ছেলেটাও মেয়েটাকে এত জোরে ধাক্কা দিল যে, মেয়েটা পড়তে পড়তে কোনোভাবে সামলে নিল। 

টুনি ততক্ষণে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, সে জানে ধাক্কাধাক্কির পরের ধাপই হচ্ছে মারামারি। মারামারিটি সাধারণত ছেলে এবং ছেলের মাঝে হয়—খুবই কম হয় মেয়ে এবং মেয়ের মাঝে। ছেলে এবং মেয়ের মাঝে মারামারি একেবারেই হয় না—খুব ছোট ক্লাসের বাচ্চারা যারা এখনও জানেই না কে ছেলে আর কে মেয়ে, তারা মাঝে মাঝে করে থাকে, কিন্তু যারা একটু বড় হয়ে কিশোর কিশোরী হয়ে গেছে তারা একেবারেই মারামারি করে না। টুনি ছুটে গিয়ে ছেলে আর মেয়েটার কাছে যেতে যেতে মেয়েটা বাঘিনীর মত ছেলেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং কিছু বোঝার আগে একেবারে সিনেমার কায়দায় ছেলেটার নাকে একটা ঘুষি মেরে দিয়েছে। 

ছেলেটা নিজের নাক চেপে ধরে একটা চিৎকার করে মেয়েটাকে পালটা ঘুষি মেরে বসল, কিন্তু এর মাঝে টুনি লাফ দিয়ে দুজনের মাঝখানে হাজির হয়েছে এবং ঘুষিটা এসে লাগল টুনির মাথায়, তার চশমাটা ছিটকে পড়ে যায় এবং এক সেকেন্ডের জন্য টুনি তার চোখে অন্ধকার দেখে। ততক্ষণে আরও অনেকে হাজির হয়েছে, বেশ কয়েকজন মেয়েটাকে ধরে রেখেছে এবং অন্য কয়েকজন ছেলেটাকে ধরে রেখেছে এবং কয়েকজন এসে টুনিকে ধরেছে—ছোট একটি মেয়ে টুনির চশমাটা কুড়িয়ে এনে তার হাতে দিল। সবাই মিলে কথা বলছে, চিৎকার হইচই চেঁচামেচি, তাই কেউ কারো শুনতে পাচ্ছে না। 

একটা স্কুলের এই বয়সি ছেলেমেয়েদের মাঝে এরকম ঘটনা কম ঘটলেও একেবারে ঘটে না তা নয়, কিন্তু ছেলেমেয়েরা নিজেরা চেষ্টা করে সেটা খুবই তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলার, চেষ্টা করে যেন কোনোভাবেই সেটা স্যার ম্যাডামের কাছে না পৌঁছায়। কাজেই সবাই মিলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু তখন ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেল। সবাই তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গলার স্বর শুনতে পেল, খুবই ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কী হচ্ছে?” 

কেউ স্বপ্নেও চিন্তা করে নাই এরকম একটা ঘটনার মাঝে হঠাৎ করে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এসে হাজির হবেন। নিশ্চয়ই কোনো কাজে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দাঁড়িয়ে গেছেন। 

এক মুহূর্তে সমস্ত চিৎকার চেঁচামেচি থেমে গেল এবং ছেলেমেয়েরা দুই পাশে সরে গিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে এগিয়ে আসার জায়গা করে দিল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কখনও কোনোকিছু দেখে রাগেন না কিংবা অবাক হন না। আজকেও রাগলেন না এবং অবাক হলেন না, খুবই শান্ত গলায় প্রায় হাসিহাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?” 

যারা একটু বড় তারা ‘কিছু হয় নাই’ জাতীয় কথা বলে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে রিনরিনে গলায় বলল, “এই ভাইয়া টুনি আপাকে ঘুষি মেরেছে।” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম টুনিকে চিনেন এবং তাকে বেশ স্নেহ করেন, কাজেই তাকে একটা ভাইয়া ঘুষি মেরেছে সেটা তার জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ খবর। ভুরু দুইটা একটু উপরে তুলে বললেন, “টুনিকে ঘুষি মেরেছে?” 

টুনি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, বলল, “না, না আমাকে কেউ ঘুষি মারে নাই। একটু ধাক্কাধাক্কি হচ্ছিল—আমি মাঝখানে ছিলাম তাই—” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “ধাক্কাধাক্কিটা কী নিয়ে হচ্ছিল?” 

সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়, কেউই ঠিক ভালো করে জানে না। যে ছেলে এবং মেয়ে ঘুষোঘুষি করছিল তারা মুখ গোঁজ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। টুনি বলল, “আমার মনে হয় ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, তারা নিজেরা নিজেরা মিটিয়ে নিতে পারবে।” 

“ঠিক আছে। নিজেরা নিজেরা মিটিয়ে নিতে পারলে ভালো—” বলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন, তখন হঠাৎ নাকে ঘুষি খাওয়া ছেলেটা বলে ফেলল, “ঝিনু ছেলেদের নিয়ে খুব খারাপ কথা বলেছে।” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম দাঁড়িয়ে গেলেন, মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, “ঝিনু খারাপ কথা বলেছে?” 

ঝিনু নামের মেয়েটা বলল, “বলি নাই।“

ছেলেটা বলল, “বলেছে।” 

ঝিনু বলল, “কী বলেছি বল।” 

ছেলেটা বলল, “খুব খারাপ কথা, সবার সামনে বলা যাবে না। “ ঝিনু বলল, “একশবার বলা যাবে। তুই বল।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “শুনি কী খারাপ কথা। আমার ছেলেমেয়েরা ভালো কথা খারাপ কথা কী বলে সব আমার জানা দরকার।” 

ছেলেটা বলল, “ঝিনু বলেছে, রঞ্জু তুই হচ্ছিস ছেলে। ছেলেদের ওয়াই ক্রোমোজম ছোট, একটুখানি কেনি আঙুলের মত বিন্দি সাইজ। মেয়েদের এক্স ক্রোমোজম ইয়া লম্বা—” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “এটা তো খারাপ কথা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা বৈজ্ঞানিক কথা।” 

টুনিদের ক্লাসের রাজু পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, “জি ম্যাডাম এটা একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। মানুষের কোষের নিউক্লিয়াসে যে তেইশ জোড়া ক্রোমোজম থাকে তার এক জোড়া ছেলেমেয়েদের বেলায় আলাদা, মেয়েদের দুইটা লম্বা এক্স ক্রোমোজম। ছেলেদের একটা এক্সের বদলে আছে ওয়াই। ওয়াইটা অনেক ছোট ক্রোমোজম।” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা তো খারাপ কথা না—সত্যি কথা।”

রঞ্জু একটু থতমত খেয়ে বলল, “ম্যাডাম, ঝিনু বলেছে খুব খারাপভাবে, কেনি আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে, খারাপ কথার মত।” 

প্রিন্সিপাল বললেন, “হুম। বুঝতে পারছি।” 

রঞ্জু বলল, “আরও বলেছে ম্যাডাম।” 

“আর কী বলেছে?” 

“পৃথিবীর সব কবিরা ছেলেদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছে। বলেছে ছেলেরা অপদার্থ, কোনোকিছু পারে না, শুধু বড় বড় কথা বলে সেইজন্য কবিতা লিখেছে।” 

“সেটা কোন কবিতা?” 

রঞ্জু বলল, “আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে, যারা কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে—” 

“ইন্টারেস্টিং।” 

“ঝিনু বলেছে, কবিরা কখনও মেয়ে নিয়ে বলে না, আমাদের দেশে সেই মেয়ে হবে কবে—”

“বুঝতে পারছি। বেচারি কুসুমকুমারী যদি জানতেন তার লেখা এরকম সুইট একটা কবিতাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, বেচারির নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।” 

ঝিনু বলল, “ম্যাডাম, রঞ্জু খালি আমার দোষ দিচ্ছে। সে নিজে কী করেছে একবারও বলছে না। আপনি জানেন ম্যাডাম সে মেয়েদের নিয়ে কী কবিতা বানিয়েছে?” 

রঞ্জু একটু নড়াচড়া করল, দুর্বল গলায় বলল, “ঠাট্টা করে—”

ঝিনু বলল, “মোটেও ঠাট্টা না। সত্যি সত্যি বলেছে।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “কী কবিতা বলেছে?”

ঝিনু বলল, “বলেছে, মাইয়া রে মাইয়া 
মোটা হইছে খাইয়া 
দেখ দেখি চাইয়া—”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব সাবধানে হাসি গোপন করে রঞ্জুর দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কে লিখেছে এই কবিতা?” 

রঞ্জু মিনমিন করে বলল, “আমি।” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “কোথাও ছাপানোর জন্য পাঠিয়েছ?” 

“না ম্যাডাম।” 

“না পাঠানোই ভালো। ছন্দ ঠিক আছে কিন্তু বক্তব্য বিতর্কিত মনে হতে পারে।” 

ঝিনু ফোঁস ফোঁস করে বলল, “খালি কবিতাটা খারাপ তা না, সে সেটা বলে আরও খারাপভাবে। তার ইয়েটা এইভাবে নাড়ায়।” ঝিনু তার ইয়েটা নাড়িয়ে দেখাল। 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “মনে হচ্ছে একটা খুবই জটিল সমস্যা। ছেলে নাকি মেয়েকে ভালো।” 

কেউ কোনো কথা বলল না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, ‘আমার মনে হয় প্রশ্নটাকে জিইয়ে না রেখে নিষ্পত্তি করে ফেলা ভালো। কী বল তোমরা?” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন কেউ বুঝতে পারল না। তারপরেও সবাই মাথা নাড়ল। টুনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে নিষ্পত্তি করবেন ম্যাডাম।” 

“আলোচনার মাধ্যমে।” 

“আলোচনা? কে আলোচনা করবে?” 

“ছেলেদের এবং মেয়েদের প্রতিনিধিরা।” 

“কে ছেলেদের প্রতিনিধি আর কে মেয়েদের প্রতিনিধি হবে ম্যাডাম?” 

“সেটা এই স্কুলের ছেলেরা এবং মেয়েরা ঠিক করবে। আমি এক সপ্তাহ সময় দিব। এক সপ্তাহ পর একটা ডিবেট হবে, ছেলে না মেয়ে কে সর্বশ্রেষ্ঠ। সেই ডিবেটে নিষ্পত্তি হবে।” 

টুনি শুকনো মুখে বলল, “ম্যাডাম তাহলে তো ছেলে আর মেয়েরা আরও বেশি ভাগাভাগি হয়ে যাবে!” 

“সেটা যেন না হয় সেই দায়িত্ব এই স্কুলের ছেলে এবং মেয়েদের।” প্রিন্সিপাল ম্যাডাম গম্ভীর মুখে বললেন, “আমি এই স্কুলের ছেলে আর মেয়েদের উপর বিশ্বাস করে একটা দায়িত্ব দিতে চাই। আশা করছি তারা এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে।” 

টুনি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু  ম্যাডাম-ম্যাডাম—” 

টুনির মনে হল প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তার দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তার চোখ টিপলেন! টুনি তার কথা শেষ না করে থেমে গেল। কিন্তু এটা কি সম্ভব? প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মত এরকম একজন গম্ভীর বড় মানুষ তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপছেন? 

শুধু যে চোখ টিপেছেন তা নয়, মনে হল মুখ টিপে একটু হেসে হাসি গোপন করেছেন! কিন্তু এটা কি সম্ভব? সে কি ভুল দেখেছে? 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হেঁটে চলে গেলেন এবং ছেলেরা আর মেয়েরা উত্তেজিতভাবে কথা বলতে লাগল। কয়েকজন রঞ্জুকে এবং অন্যরা ঝিনুকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেল। টুনি আবার বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে চিন্তা করতে লাগল। 

.

রাতে টুনি তার আম্মুর সাথে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছে, আম্মু সবকিছু শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “তুই ঠিকই বলেছিস। ডিবেট করে ছেলেমেয়ের সমস্যা মিটানো যাবে না। বরং উল্টোটা না হয়।” 

“উল্টো কী হবে?” 

“ছেলেরা আরো বেশি বিশ্বাস করবে যে, ছেলেরাই ভালো আর মেয়েরা ভাববে মেয়েরাই ভালো।” 

“কিন্তু—”

“কিন্তু কী?” 

“আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কি এটা বুঝতে পারছেন না?” 

“মনে হয় তার অন্য কোনো প্ল্যান আছে।” 

টুনি বলল, “অন্য আর কী প্ল্যান থাকবে? নোটিশ করা হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার স্কুলের ছেলে আর মেয়েদের মাঝে ডিবেট। ডিবেটের বিষয়বস্তু, কে সর্বশ্রেষ্ঠ, ছেলে না মেয়ে।” 

টুনির আম্মু বললেন, “দেখা যাক কী হয়।” 

.

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সারা স্কুলে উত্তেজনা। পুরো সপ্তাহটি ছেলেদের আর মেয়েদের মাঝে এক ধরনের রেষারেষিতে কেটেছে। ছেলেরা তাদের সবচেয়ে ভালো ডিবেটরদের রেডি করেছে। ঠিক একইভাবে মেয়েরাও তাদের টিম রেডি করেছে। বইপত্র ইন্টারনেট গুগল ঘেঁটে তারা সব রকম তথ্য ডাউনলোড করেছে। সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে এবং টিমের কোন জন কী বলবে সেটা ঠিক করেছে। দুই দলই অনুমান করার চেষ্টা করছে বিপক্ষ দল কী বলবে এবং তাদের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য তারা পাল্টা কী বলবে সেটা নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা চলছে। শুধু তাই নয়, ডিবেটে কথা বলার সময় ছেলেরা এবং মেয়েরা তাদের দলের জন্য যেন ঠিক জায়গায় হাততালি দিতে পারে সেইজন্য তাদেরকে রেডি করে রাখা হয়েছে। শুধু হাততালি দিয়ে থেমে গেলে হবে না, দরকার হলে বিপক্ষ দলকে যেন দুয়ো দিতে পারে, ভুয়া ভুয়া বলে চেঁচাতে পারে সেটা পর্যন্ত ঠিক করে রাখা আছে। সহজ কথায় বলা যায় একেবারে টানটান উত্তেজনা। 

প্রথম চার পিরিয়ড হওয়ার পর সবাই স্কুলের অডিটরিয়ামে হাজির হল। অডিটরিয়ামে ছেলেমেয়েরা মিলেমিশে বসে, আজকে কী হয়েছে কে জানে, ছেলেরা এবং মেয়েরা আলাদা আলাদা বসেছে। শুধু তাই না, মাঝে মাঝেই ছেলেরা একসাথে “ছেলে ছেলে ছেলে” বলে চিৎকার করছে। ঠিক তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়েরা “মেয়ে মেয়ে মেয়ে” বলে চিৎকার করছে। 

একটু পরে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এসে অডিটরিয়ামে ঢুকলেন, তখন ছেলেমেয়েরা একটু চুপ করল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্টেজে উঠে বসলেন, তার ডান পাশে আর বাম পাশে আলাদাভাবে ছেলেদের আর মেয়েদের বসায় জায়গা আছে। স্টেজে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে নার্গিস ম্যাডামও আছেন। অন্য আরও কয়েকজন স্যার ম্যাডাম এসেছেন, তারা সবাই নিচে দর্শকদের সাথে বসেছেন। 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “ছেলেদের টিম আর মেয়েদের টিম এসে তোমাদের জায়গায় বসে যাও। টিমের মেম্বারদের নামগুলো আমাকে দাও।” 

খুবই গম্ভীর মুখে ডিবেটররা তাদের জায়গায় বসে। দুই দলের দলপতি তাদের টিমের মেম্বারদের নাম লেখা কাগজ প্রিন্সিপাল ম্যাডামের হাতে দিল। ছেলেরা এবং মেয়েরা চিৎকার করে যাচ্ছে, তার মাঝে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বললেন, “এক্ষুণি আমাদের ডিবেট শুরু হয়ে যাবে। ডিবেট শুরু করার জন্য আমাদের একজন সঞ্চালক দরকার। কে হবে সঞ্চালক?” 

কেউ নিজ থেকে সঞ্চালক হওয়ার আগ্রহ দেখাল না, তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “টুনি? টুনি কি আছ?” 

টুনি মাঝামাঝি জায়গায় বসে ছিল, সে চমকে উঠল। স্কুলের অনুষ্ঠানে সে সবসময় ভলান্টিয়ার হয়ে কাজ করে কিন্তু কখনোই স্টেজে উঠে না। সে গান, আবৃত্তি, ডিবেট, অভিনয় কিছুই করতে পারে না, অনুষ্ঠান সঞ্চালনার প্রশ্নই ওঠে না। 

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখে নিজের নাম শুনে টুনি ঘাবড়ে গেল, দাঁড়িয়ে বলল, “জি ম্যাডাম। আমি আছি।” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “তুমি চলে এসো স্টেজে।” 

টুনি চিঁচিঁ করে বলল, “ম্যাডাম, আমি জীবনে স্টেজে উঠি নাই। জীবনে সঞ্চালনা করি নাই। আর কাউকে নেন ম্যাডাম।” 

“না, না তুমিই আস। তোমার মত একজন দরকার। আস।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকলে তো আর সে না করতে পারে না। কাজেই টুনি যথেষ্ট নার্ভাস হয়ে ছেলেমেয়েদের ভিড় ঠেলে স্টেজের দিকে যেতে থাকে। টুনি স্টেজে ওঠার পর সামনে শত শত ছেলেমেয়েকে দেখে তার গলা শুকিয়ে যায়। ছেলেমেয়েদেরও আজ সবকিছু নিয়ে উত্তেজনা, তাই তারাও টেবিল চাপড়ে শব্দ করতে থাকে। 

স্টেজে পৌঁছানোর পর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাকে দুই দলের টিম মেম্বারদের দুটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন, বললেন, “নাও টিম মেম্বারদের নাম ঘোষণা কর।” 

টুনি কাগজগুলো নিয়ে দেখল, ছেলেদের টিমের উপরে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম লাল কালি দিয়ে লিখে রেখেছেন, “এই ছেলেরা বলবে মেয়েদের পক্ষে।” আর মেয়েদের টিমের উপর লাল কালি দিয়ে লিখে রেখেছেন, “এই মেয়েরা বলবে ছেলেদের পক্ষে”! টুনি অবাক হয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকাল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সেদিনের মত আবার চোখ টিপলেন! মুখে একটা চাপা হাসি—পরিষ্কার দুষ্টুমির হাসি! 

হঠাৎ করে অনেক কিছু টুনির কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ছেলেমেয়ে নিয়ে বিতর্ক করলে তো এভাবেই করতে হবে! ছেলেরা বলবে মেয়েদের পক্ষে আর মেয়েরা বলবে ছেলেদের পক্ষে! 

একটু আগে শত শত উত্তেজিত ছেলেমেয়েদের দেখে টুনির যেরকম নার্ভাস লাগছিল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে সব দূর হয়ে সে নিজের ভেতর একটা অন্যরকম আনন্দ টের পেতে থাকে। সবগুলো দাঁত বের করে হেসে সে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, “আমার প্রিয় ভাইবোনেরা। আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা—এক্ষুণি শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের বিতর্ক প্রতিযোগিতা—কে সর্বশ্রেষ্ঠ: ছেলে না মেয়ে?” 

ছেলেরা চিৎকার করে বলল, “ছেলে ছেলে”—মেয়েরা চিৎকার করে বলল, “মেয়ে মেয়ে”, কাজেই অডিটরিয়ামে একটা বিকট হট্টগোল ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না। টুনি হট্টগোলটা থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করল, তারপর মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে নিয়ে বলল, “এবারে আমি টিম মেম্বারদের নাম ঘোষণা করছি। এই যে ডানদিকে ছেলেরা বসে আছে তারা বলবে—” টুনি এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “তারা বলবে মেয়েদের পক্ষে। অর্থাৎ তারা বলবে মেয়েরাই শ্রেষ্ঠ!” 

হঠাৎ করে পুরো হলঘরের সবাই একেবারে নীরব হয়ে যায়। টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “না, আমি ভুল বলি নাই, তোমরাও ভুল শুনো নাই। ছেলেরা বলবে, মেয়েরাই শ্রেষ্ঠ! আর মেয়েরা বলবে, ছেলেরাই শ্রেষ্ঠ! আমরা দেখি কে বিজয়ী হয়। ছেলেরা না মেয়েরা।” 

কিছুক্ষণ পুরো হলঘর নীরব হয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, টেবিলে থাবা দিতে থাকে, হাততালি দিতে থাকে, মুখে বিচিত্র শব্দ করতে থাকে। শুধু স্টেজে বসে থাকা ছেলে এবং মেয়ে ডিবেটররা ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। তাদের মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ছেলেদের দলের টিম লিডার দাঁড়িয়ে দুর্বলভাবে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বলল, “কিন্তু ম্যাডাম সেটা তো আগে বলা হয় নাই—আমরা তো স্ক্রিপ্ট রেডি করেছি ছেলেদের পক্ষে!” 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “কেন করেছ? আমি বলেছি ছেলে আর মেয়ে নিয়ে ডিবেট হবে, কে পক্ষে কে বিপক্ষে সেটা তো বলি নাই। তোমরা জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হও নাই কেন?” 

“কিন্তু ম্যাডাম –” দলনেতা মাথা চুলকায়। মেয়ে দলের মেম্বারদেরও একই অবস্থা, তারাও চিঁচিঁ করে বলল, “ম্যাডাম এটা আমরা কেমন করে বলব? আমরা তো রেডি না।” 

নার্গিস ম্যাডাম এতক্ষণ চুপ করে মিটিমিটি হাসছিলেন, এবারে বললেন, “দোষ তোমাদের! তোমরা কেমন করে ভাবলে আমরা তোমাদের এরকম নিজেদের নিয়ে বড়াই করার সুযোগ করে দেব? আর স্ক্রিপ্ট আবার কীরকম কথা? স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলবে—” 

ছেলেরা এবং মেয়েরা মাথা চুলকাতে থাকে, নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “ঠিক আছে তোমরা একটু সময় নাও। আর টুনি এই সময়টাতে তুমি কথা বলে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখ।” 

টুনি আঁতকে উঠল, বলল, “আমি? আমি কেমন করে ব্যস্ত রাখব?” 

“পারবে, পারবে। শুরু কর।” 

ঠিক তখন টুনির মাথায় চিড়িক করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে মাইক্রোফোন নিয়ে বলল, “আমাদের দুর্ধর্ষ টিমদের রেডি হতে একটু সময় লাগবে, ততক্ষণ আমরা নিজেরা একটু কথা বলি! আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা, তোমাদের মাঝে কে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাও? ছেলেরা শ্রেষ্ঠ না মেয়েরা শ্রেষ্ঠ? ছেলেদের বলতে হবে মেয়েরা শ্রেষ্ঠ। আর মেয়েদের বলতে হবে ছেলেরা শ্রেষ্ঠ! কে আছ?” 

সামনে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের মাঝ থেকে অসংখ্য হাত উঠে গেল। সবাই চিৎকার করতে থাকল, “আমি-আমি-আমি-” 

টুনি সামনের দিকে বসে থাকা একটা ছোট ছেলেকে ডাকল, সে গম্ভীর হয়ে স্টেজে উঠে আসে। টুনি বাচ্চাটিকে মনে করিয়ে দিল, তোমাকে কিন্তু মেয়েদের পক্ষে কথা বলতে হবে।” ছেলেটি মাথা নাড়ল, বলল, “সেইটাই বলতে এসেছি।” 

টুনি তার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয়, সে মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “আমার আব্বুর মাথায় ইয়া বড় টাক, আমার আম্মুর মাথায় কোনো টাক নাই। আব্বু বলেছে, মেয়েদের মাথায় টাক পড়ে না, শুধু ছেলেদের মাথায় টাক পড়ে—” 

ছেলেটি কথা শেষ করার আগেই সবাই মিলে চিৎকার করে হাততালি দিতে থাকে। ছেলেটি আর একটা কথা না বলে টুনির হাতে মাইক্রোফোনটা দিয়ে হেঁটে স্টেজ থেকে নেমে গেল। সামনে কয়েকজন স্যার ম্যাডাম বসে আছেন, তার মাঝে জলীল স্যারের মাথায় টাক। স্যার খুবই বিমর্ষভাবে তার টাক মাথায় হাত বুলালেন। 

অসংখ্য বাচ্চা কথা বলার জন্য হাত তুলে চেঁচামেচি করছে। টুনি এবারে ডাকল একটা ছোট মেয়েকে। মেয়েটিকে টুনি আবার মনে করিয়ে দিল তাকে ছেলেদের পক্ষে বলতে হবে। সে মাথা নেড়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, “আমাদের বাসায় আমরা যখন কোথাও বেড়াতে যাই তখন আমার আম্মুর শাড়ি পছন্দ হলে ব্লাউজ পছন্দ হয় না। ব্লাউজ পছন্দ হলে শাড়ি পছন্দ হয় না। শেষ পর্যন্ত যখন দুইটাই পছন্দ হয় তখন জুতা পছন্দ হয় না। শেষ পর্যন্ত যখন পছন্দ করা শেষ হয় তখন সেগুলো পরেন। তারপর চুল আঁচড়াতে বসেন, তারপর ম্যাচিং কানের দুল খুঁজে বের করতে হয়, তারপর ম্যাচিং টিপ লাগাতে হয়, তারপর ম্যাচিং লিপস্টিক সবকিছু শেষ করতে করতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। আর আমার আব্বুর রেডি হতে লাগে এক মিনিট। আব্বু শার্ট পরেন আর স্যান্ডেল পরেন—ব্যস রেডি। আমার আব্বু খুবই ভালো, আম্মু সাজগোজ করতে এত সময় নিলেও আব্বু একটুকুও বিরক্ত হন না। চুপচাপ বসে থাকেন।” 

ছেলেমেয়ে চিৎকার করে হাততালি দিল। শুধু ছেলেমেয়েরা না, স্টেজে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আর নার্গিস ম্যাডাম একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কুটকুট করে হাসলেন। 

টুনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কে বলবে?” 

ছোট ছোট বাচ্চারা হাত তুলে চিৎকার করতে লাগল, “আমি, আমি, আমি!” একজন ছেলে প্রায় পাগল হয়ে গেল, নিজের জায়গায় দুই হাত নাড়িয়ে সে লাফাতে লাগল। মনে হল তাকে কথা বলার সুযোগ না দিলে সে পাগল হয়ে যাবে। তাই টুনি তাকে ডাকল। 

ছেলেটা প্রায় দৌড়ে স্টেজে এসে মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “আমার আম্মুও সাজগোজ করতে এক ঘণ্টার বেশি সময় নেন—” টুনি তাড়াতাড়ি তাকে থামাল, বলল, “তুমি ছেলে। তোমাকে মেয়েদের পক্ষে বলতে হবে। তোমার আম্মুর পক্ষে কথা বলতে হবে।” 

ছেলেটা বলল, “আমি তো আম্মুর পক্ষেই বলব।“

টুনি একটু অবাক হয়ে বলল, “ও! ঠিক আছে, বল।” 

ছেলেটা বলল, “আমার আব্বুও দুই মিনিটে রেডি হয়ে যান আর আমার আম্মুর এক ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর যখন দুইজন বাসা থেকে বের হয় তখন আমার আম্মুকে দেখলে মনে হয় সিনেমার নায়িকা, এত সুন্দর! আর আব্বুকে দেখলে মনে হয় ডাকাত!” 

ছেলেটার কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আর নার্গিস ম্যাডামও হাসলেন। এরপরে যে মেয়েটি এসেছে তার মাথাভর্তি চুল। সে বলল, “আমার মাথায় এত চুল, যখন গোসল করি তখন আমার চুল মুছে মুছে টায়ার্ড হয়ে যাই! তাও চুল শুকায় না। আর আমার ভাইয়ার মাথায় ছোট ছোট চুল, ঝট করে সব চুল শুকিয়ে যায়! আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে সব চুল কেটে মাথা ন্যাড়া করে ফেলতাম। ছেলে হওয়া কত মজা! তারা কত মজা করে। আমার কত হিংসা হয়।” 

মেয়েটার কথা শেষ হওয়ার পর অনেক মেয়ে মাথা নাড়ল। এরপরে যে ছেলেটি বলতে এসেছে, সে মুখ শুকনো করে বলল, “তোমরা ছেলেদের এত হিংসা করো না। ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ হয়—যখন তাদের দাড়ি-গোঁফ গজাতে শুরু করে, তখন তাদের দেখতে একেবারে ছাগলের মত লাগে। বড় হয়ে কেউ কেউ আবার গোঁফ রাখে। তাদের হয় সবচেয়ে বিপদ। সর্দি হলে ঠিক করে নাক ঝাড়তে পারে না, আইসক্রিম খেলে গোঁফের মাঝে আইসক্রিম লেগে থাকে।” 

ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই গোঁফের যন্ত্রণার কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। 

এরপরে যে মেয়েটা এসেছে সে বলল, “তার বাসায় যেতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে তার মা তাকে বকাবকি করে। মেয়েদের জীবনে কোনো আনন্দ নাই, মায়েরা মেয়েদের কঠিন শাসন করে।” 

তারপর যে ছেলেটা এসেছে সে বলল যে, “তার বাবা তার নাম জানে না। পরীক্ষার রেজাল্ট কার্ড দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, এটা কার পরীক্ষার কার্ড? ছেলেটা যখন বলেছে তার, তখন অবাক হয়ে বলেছে, তাই নাকি? তার আব্বু শুধু তার ডাকনাম জানে, ভালো নাম জানে না!”

এভাবে মনে হয় চলতেই থাকত, কিন্তু এরকম সময়ে ছেলেদের টিম আর মেয়েদের টিমের দলনেতারা এসে বলল, তারা ডিবেট করার জন্য রেডি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে শুরু কর।’ তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলছেন, “টুনি তুমি বক্তার নাম ঘোষণা কর। প্রথমে ছেলেদের দল থেকে একজন।” 

টুনি ছেলেদের দল থেকে প্রথম জনের নাম ঘোষণা করল, চশমা পরা জ্ঞানী টাইপের একজন ছেলে। সে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, “মহামান্য বিচারকমণ্ডলী এবং উপস্থিত দর্শকবৃন্দ। আজকে এখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি বলি হে পৃথিবী দ্বিধা হও–আমি সেখানে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আমার পাপ মোচন করি। যে নারী জাতির গর্ভে আমি জন্ম নিয়েছি, সেই জন্মদাত্রী মাতার জাতির সাথে আমি বিতর্ক করার মত দুঃসাহস দেখাচ্ছি? যাদের পদতলে আমাদের মাথা রাখার কথা, আমরা তাদের সাথে বিতর্ক করছি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তোমরা আমাদের ক্ষমা কর। আমি কেমন করে বিতর্ক করব, যে নারী আমাকে জন্ম দিয়েছে, সেই নারী জাতির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আমি সন্দেহ পোষণ করব? না—না—না—আমি পৃথিবীর বুকে কুলাঙ্গার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই না—” 

ছেলেটার বক্তৃতার ভাষা এবং আবেগ শুনে সবাই ভুলে গেল যে একটু আগেই সে তার দলকে নিয়ে নারী জাতিকে ধোলাই দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। অথচ এখানে দাঁড়িয়ে নারী জাতির অবদানের কথা বলতে গিয়ে তার গলা বন্ধ হয়ে যায়, চোখে প্রায় পানি আসে আসে অবস্থা। ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে শুনে, একটু পরপর তালি দিতে থাকে। 

মেয়েরা ছেলেদের থেকে কোনো অংশে কম যায় না। তারা বলল, “এটি সত্যি নারী জাতি মায়ের জাতি, তারা গর্ভে সন্তান ধারণ করে কিন্তু সেটি তো হতেই হবে কারণ প্রকৃতি এটার ব্যবস্থা। কিন্তু পুরুষ জাতি যেটি করে সেটি তাদের মহত্ত্ব। নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার পর পুরুষ জাতি শুধু সেই সন্তানকে রক্ষা করে না, তার মাকেও বুক আগলে রক্ষা করে। কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে বহু অপদার্থ পুরুষ আছে তাই তারা এই যুক্তিটির পিছনে বেশি সময় নষ্ট করল না। পুরুষ নারী থেকে শ্ৰেষ্ঠ প্ৰমাণ করার জন্য তারা পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীদের কথা বলতে শুরু করল! আইনস্টাইন, নিউটন, গ্যালেলিও সবাই পুরুষ সেটা মনে করিয়ে দিল।” 

ছেলেরা তখন গণিতবিদ হাইপেশিয়ার কথা নিয়ে এলো। ধর্মান্ধ পুরুষ মানুষ কীভাবে মহিলা গণিতবিদকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল তার একটা ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে নারী জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, “পুরুষ মানুষ সুযোগ দিচ্ছে না বলেই নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম। এখন যে মেয়েরা বেশি লেখাপড়া করছে সেটা বলে তারা ঘোষণা দিল, কিছুদিনের ভিতরেই নারী বিজ্ঞানী এবং নারী গণিতবিদে দেশ ভরে যাবে।”

মেয়েরা বলল : ছেলেরা লম্বা চওড়া এবং সুদর্শন। (হাততালি হাততালি) 

ছেলেরা বলল : ছেলেরা সুদর্শন নয়, তারা দেখতে রাক্ষসের মত। (হাততালি এবং টেবিল থাবা) 

মেয়েরা বলল : নারী জাতি ভয়ংকর। তার প্রমাণ ব্ল্যাক উইডো মাকড়শা, নারী মাকড়শা পুরুষ মাকড়শাকে খেয়ে ফেলে (আতঙ্ক এবং চিৎকার) 

ছেলেরা বলল : পুরুষ জাতি আরও বেশি ভয়ংকর। পুরুষ সিংহ তার সন্তানদের হত্যা করে (আতঙ্ক এবং চিৎকার) 

মেয়েরা বলল : ছেলেরা শক্তিশালী এবং সাইজে বড় (হাততালি ও চিৎকার) 

ছেলেরা বলল : পুরুষ মোটা এবং থলথলে (টেবিলে থাবা ও চিৎকার) 

.

কিছুক্ষণের মাঝেই দুই দলই বিতর্কের সব নিয়মকানুন ভেঙে বানিয়ে বানিয়ে একে অন্যকে মহান হিসেবে বলতে শুরু করল। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছাল যে, কারোই বুঝতে বাকি থাকল না তারা বানিয়ে বানিয়ে নানা গল্প বলতে শুরু করেছে! 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বাধা দিলেন না—তারা যদি একে অন্যকে মহৎ বলে বলতে শুরু করে খারাপ কী! 

টুনিও স্টেজে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের পিছনে দাঁড়িয়ে হেসে কুটিকুটি হল। ডিবেটটা নিয়ে শুধু শুধু সে ভয় পাচ্ছিল! 

যেটা ভয় পাচ্ছিল, ঠিক তার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *