ব্ল্যাক উইডো – দেবার্চন বসু
এখন আমি মধ্যরাতে এই পার্কে এসে বসি। কখনও ঘুরে বেড়াই পার্কের এখানে—সেখানে। অথচ একটা সময় ছিল যখন আমি আমার কোয়ার্টারে বিছানায় শুয়ে ঘুমোতাম আর স্বপ্ন দেখতাম। প্রতি মাসের তেরো তারিখেই স্বপ্নটা দেখতাম। দেখতাম এক নারীকে, যদিও তার মুখ দেখতে পেতাম না।
সেই নারীর হাতে থাকত একটা লম্বা ছুরি। ধারালো এবং তীক্ষ্ন। সে তাই দিয়ে আমার হৃৎপিণ্ডের একটা অংশ কেটে নিচ্ছে। তারপর মুখে পুরে নিচ্ছে হৃৎপিণ্ডের সেই টুকরোটা। টসটস করে রক্ত গড়িয়ে পড়ত তার ঠোঁট থেকে। আর সে যখন চিবোতে থাকত আমার হৃৎপিণ্ডের অংশটিকে, আমার মনে হত আমার বুকে ভীষণ ব্যথা—আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। কোনও এক নাম—না—জানা পাখির অস্পষ্ট ডাকে প্রতিবার আমার ঘুম ভেঙে যেত। খাটের পাশে মাথার কাছে একটা টেবিল। তার উপর একটি ডিজিটাল ক্লক। তা জানান দিত—সময় ভোর সাড়ে চারটে—শনিবার—১৩ ফেব্রুয়ারি —২০১৩ সাল।
কবে থেকে আমার এই স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল?
যেদিন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল…।
আমি তখন ঝাড়গ্রামে একটা কলেজে অ্যানথ্রপোলজি পড়াতাম। তুমিও সেগুনী একই কলেজে পড়াতে। একই বিষয়। আমাদের দেখা হয়েছিল কলেজ লাইব্রেরিতে। মনে আছে সেগুনী?
প্রথমবারেই তোমাকে দেখে মনে হল, তুমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। তোমার শরীরে কালিদাসীয় স্পেসিফিকেশানস। গুরু বক্ষ। গুরু নিতম্ব। ক্ষীণ কটি। আর অদ্ভুত সুন্দর তোমার দুটি চোখ। চোখের মণি সবুজাভ।
সুতরাং আমি প্রেমে পড়লাম।
একটা বই—এর মধ্যে মুখ গুঁজে ছিলে তুমি। হঠাৎই মুখ তুলে আমার দিকে তাকালে। হাসলে। বললে, ‘তুমি আমায় ভালবাসতে চাও? আমার রূপমুগ্ধ তুমি?’
আমার মনের মধ্যে তখন অতলসাগর। আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। তবু আমার মনের মধ্যে অযাচিত এক আততিবিততি—আমি কি তাহলে স্কিজোফ্রেনিক হয়ে যাচ্ছি?
পরে আর একটা প্রশ্ন যোগ হল মনের মধ্যে।
প্রেমে কি শুধু আমি পড়েছিলাম সেদিন? তুমি পড়োনি?
পড়েছিলে। না—হলে এত সহজে শরীর দিয়েছিলে কীভাবে?
শাল—সেগুনের বাগানের মধ্যে আমার কোয়ার্টার। সেখানেই দেখা হত আমাদের। মিলিত হতাম বারংবার। কোয়ার্টারটা ছিল তোমার খুব প্রিয়। তুমি বলতে, এ তোমার গোপন স্বর্গ।
আমি ছিলাম খুব অগোছালো। কোনও কিছুই ঠিকঠাক জায়গায় রাখতে পারতাম না। ঘরে ঢুকেই একটা টেবিল। তার ওপর একটা কম্পিউটার মনিটর। তারপর দেওয়াল ঘেঁষে কাঠের একটা নিচু ডিভান— তার ওপর ধূসর রঙের জমিতে বড় বড় সোনালি ফুলের বেডকভার। ঘরের মেঝেতে এদিকে—ওদিকে বই আর নানান ম্যাগাজিন ছড়ানো। দেওয়ালে আদিবাসী পুরুষ ও মহিলার মুখোশ।
ওই ঘরে দুটো জানলা। সেখানে হলুদ—রঙা পরদা।
আমি আর তুমি যতবার পরস্পরকে পরস্পরের শরীরে নিয়েছিলাম, সবদিনই সেটা ঘটেছে কোয়ার্টারের ওই বেডরুমে। কোয়ার্টারটা যেন নির্জন এক দ্বীপ। গোটা ঝাড়গ্রাম শহর খুঁজেও এরকম নিরিবিলি বাসস্থান হয়তো আর পাওয়া যাবে না, বা হয়তো যাবে, কিন্তু তাতে আমার বা তোমার কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না। আমরা নিজেদেরটা নিয়েই খুশি।
সেই দিনটার কথা তোমার মনে আছে সেগুনী—এক বৃষ্টিস্নাত ছুটির দিনের দুপুর! তখন দিগন্তে বিষণ্ণতা। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল তোমাকে দিয়েই। সচরাচর তুমিই তো অগ্রবর্তিনী হয়ে আমার নিরাবরণ শরীরটাকে অধিকার করতে। আসলে তোমার অন্য একটা উদ্দেশ্যও থাকত।
তখন সে—রস বুঝিনি; কিন্তু আজ বুঝি। আমি তখন শখ করে ‘জান্নাতুল ফিরদৌস নাইন্টিসিক্স’ আতর মাখা শুরু করেছি— আমার রোমশ বুকের জঙ্গলে তুমি খুঁজে বেড়াতে সেই সুগন্ধ। কী, তাই না?
সুতরাং তোমার সামনে আমার আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনও উপায় থাকত না। পূর্ণমাত্রায় সাড়া দিতে আমার সময় লাগে। অথবা এমনটাও হতে পারে যে আমি হয়তো তোমাকে ‘অ্যাকটিভ’ দেখতে চাইতাম আর, নিজেকে ‘প্যাসিভ’। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল—আজও জানি না। কিন্তু চরম মুহূর্তে আমি যে ক্রমশই লক্ষ্যভেদী, তা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। মনে পড়ে, সম্পূর্ণ তৃপ্ত ও শান্ত হওয়ার পর ফুল ফুল বেডকভার গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম আমরা? যেন নিস্তেজ সাপ!
মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে আমি জিজ্ঞেস করতাম—অ্যাই, ঘুমোলে নাকি? আর প্রতিবারই তা শুনে তোমার খিল খিল করে হেসে ওঠা…।
আচ্ছা, তোমার এ—সব কথা মনে পড়ে না? বড় নিষ্ঠুর তুমি!
.
তুমি যেদিন বাছুরডোবায় তোমার বাবা’র সঙ্গে আমাকে দেখা করাতে নিয়ে যাবে বললে, বড় অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। কারণ, তোমার পরিবার সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত আমি খুব কমই। জানতাম শুধু জানতাম, তোমাদের হর্টিকালচারের ব্যবসা আছে। অথচ আমার মুখ দিয়ে কলকাতায় আমার পরিবার সম্পর্কে কত কিছু জেনে নিয়েছিলে। সে—সব কথা তুমি জানো, তবু বলি, কেন না বললে বুকটা হালকা হয়।
আমি মামার বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছি। মা অনেক কষ্টে করে বড় করেছিলেন আমাকে। এর জন্য দায়ী অংশত আমার বাবা, বাকিটা তাঁর পারিবারিক কালচার। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির ছেলে ছিলেন তিনি। অয়েল সেক্টরে বড় চাকরি করতেন। অফিসে দাপট থাকলেও বাড়িতে নিজের মায়ের কাছে একদম কেঁচো। ঠাকুমা ছিলেন দাপুটে এবং ষোলো আনা সেকেলে। আধুনিকতার কোনও হাওয়া ওই বাড়িতে বইত কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্যদিকে আমার মা দক্ষিণ কলকাতার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি থেকে উঠে এসেছিলেন। বাড়িতে গান—বাজনা, ছবি আঁকাআঁকি ইত্যাদির রেওয়াজ ছিল। আমার মা বিয়ের আগে আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টস—এ গ্র্যাজুয়েশান করেছিলেন।
আমার বাবা খুব সুপুরুষ ছিলেন। তার ওপর ওইরকম চাকরি। বিয়ের আগে কোথায় ওঁদের আলাপ হয়েছিল জানি না, কিন্তু পরে মায়ের মুখেই শুনেছি বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বিন্দুমাত্র খোঁজখবর না করে তিনি বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠলেন। ঠাকুমার সঙ্গে প্রথম মনোমালিন্য গয়না পরা নিয়ে। প্রথম কথা, মা খুব বেশি গয়না বাপের বাড়ি থেকে আনতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, তিনি গয়না পরা খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু ঠাকুমার সেই এক কথা, বাড়িতে আরও তিনটে বউ আছে (আমার বাবা ছিলেন বাড়ির ছোট ছেলে। তাঁর উপরে তিন ভাই), তারা যখন পরে, তুমি পরবে না কেন? আর তুমি এমন মুখে মুখে তর্কই বা করছ কেন? আমি তোমাকে গয়না পরে থাকতে বলেছি, তুমি পরবে—ব্যস মিটে গেল ঝামেলা।
কিন্তু মা বাড়ির নতুন বউ হওয়া সত্ত্বেও ঠাকুমার কথায় কর্ণপাত করেননি। এই ইগনোর করার ব্যাপারটা ঠাকুমা সহজে ভোলেননি। রাগ পুষে রেখেছিলেন। তাই দ্বিতীয় মনোমালিন্য বা অশান্তি হতে বেশি দেরি হল না।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এইভাবে—আমার মা যে একজন পেইন্টার তা ঠাকুমা শুনেছিলেন অনেক পরে। যখন শুনলেন, ডেকে পাঠালেন মা—কে। নিজের শোওয়ার ঘরের একটা ফাঁকা দেওয়াল দেখিয়ে বললেন, একটা বড় ছবি এঁকে দিতে হবে। মা কালীর ছবি। ছবিতে বিগ্রহের পায়ের দু—ধারে বসে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদা। মায়ের কাছে একটা চার ফুট বাই তিন ফুট ক্যানভাসে এই ছবি এঁকে দেওয়া কোনও কঠিন কাজ ছিল না। এঁকেও ছিলেন তিনি। ঠাকুমা খুব খুশি হয়েছিলেন। সুতরাং বাড়ির অন্য তিন বউমা অ—খুশি। তাঁরা ঈর্ষার চোখে তাকাতেন মায়ের দিকে।
কিন্তু মা এইসব ঠাকুর—দেবতার ছবি আঁকা পছন্দ করতেন না। তাঁর আগ্রহ ছিল অন্য রকমের কাজে। তিনি নিজস্ব একটা পেইন্টিং স্টাইল খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন—ভারতীয় অঙ্কনশৈলীর সঙ্গে আধুনিক ইউরোপিয়ান শৈলী মিশিয়ে।
একদিন কী একটা কাজে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন। দুপুর নাগাদ কাজ মিটিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছেন, দেখলেন, ফুটপাথের একদল ছেলে—মেয়ে রাস্তার ওপর ছুটোছুটি করে খেলছে। খাতা—পেনসিল সঙ্গেই ছিল, ব্যস, মা ফুটপাথেই বসে পড়লেন স্কেচ করতে। আমার মেজোজ্যাঠা ধারেকাছেই ছিলেন। পড়বি তো পড়, এ দৃশ্য তাঁর নজরে পড়ে গেল।
বাড়িতে সেদিন তুমুল হল্লা। অশান্তি। সন্ধেবেলা ঠাকুমা ডেকে পাঠালেন মা—কে। রুক্ষস্বরে বললেন, ‘তুমি ফুটপাথে বসে কী করছিলে?’
মা সিন্থেটিক গলায় উত্তর দিলেন, ‘আঁকছিলাম।’
‘তোমার লজ্জা করে না, মিত্রবাড়ির বউ হয়ে ফুটপাথে বসতে? সত্যি সত্যি বলোতো, তুমি সুস্থ না অসুস্থ?’
‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আর মিত্রবাড়ির বউ হওয়া সত্ত্বেও আমার আর একটা পরিচয় আছে জানবেন। সেই পরিচয় আমি পরিবার থেকে পাইনি। নিজের ক্ষমতায় অর্জন করেছি। আমি আর্ট কলেজের গ্র্যাজুয়েট। একজন পেইন্টার।’
‘শোনো মেয়ে, বাড়িতে বসে ঠাকুর—দেবতার ছবি আঁকলে আঁকো। না হলে এ বাড়িতে তোমার কোনও জায়গা নেই। বুঝলে?’
মা এরপর মাস দুই—তিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। তাঁর ওপর এই মানসিক অত্যাচার সত্ত্বেও তাঁর স্বামী, মানে, আমার বাবা, মেনিমুখো নিরুত্তর ছিলেন—এ উনি মেনে নিতে পারেননি। ততদিনে উনি আমাকে কনসিভ করেছেন। ইজেল, ক্যানভাস, রং—তুলি আর আমাকে গর্ভে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাপের বাড়িতে। আর ফিরে যাননি। আশ্চর্য, বাবা নাকি এরপর কোনওদিন আসেননি আমাদের দেখতে। এমনটাও হয়?
যাই হোক, উত্তর কলকাতার এঁদোগলির মিত্রবাড়ির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘুচে যায় এরপর থেকে…।
জীবন চড়াই আর উতরাই—এর যোগফল। কী একটা কথা সেগুনী বলতে গিয়ে মায়ের কথা বলে ফেললাম। পৃথিবীর সমস্ত মা উতরাই—এর কথা বলে। আজ যখন পুরোনো কথা ভাবি, মনে হয় মায়ের কথা মানে, উতরাই—এর কথা। আ স্টোরি অফ ইউনিভার্সাল মাদারহুড। আসলে এত কথা বুকের মধ্যে জমে ছিল! জানবে, উতরাই মানে গা ছমছমে রাত অথবা, গভীর সন্ধে।
সেগুনী, তোমাকে বুক খালি করে এ—সব কথা বলছি কেন কে জানে! তাহলে আমি কি তোমার সমীপে নিঃস্ব হতে চাই? যাক সে যাক, এখন অন্য কথা বলি সেগুনী?
তুমি যে দুপুরে নিস্তব্ধ কলেজ লাইব্রেরিতে আমাকে প্রোপোজাল দিলে বাছুরডোবায় তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে, সে রাতে আমি এক স্বপ্ন দেখেছিলাম। দুর্বোধ এবং ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দেখার কথা তোমাকে কোনওদিন বলিনি। আজ বলব।
তবে, তার আগে অন্য কথা। এক জীবন জিজ্ঞাসা। তাই প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আচ্ছা, মায়ের কথা বলতে গিয়ে উতরাইয়ের কথা এল কীভাবে? তাহলে কি উতরাই মানে সমস্ত সংযোগ—ছিন্ন—জীবনের কথা? কিছু হারানোর কথা? কিন্তু মন তো হারানোকে হারাতে চায় না। ‘নেই’ কথাটা মেনে নিতে পারে না। শুধু বিশ্বাস—অবিশ্বাসের দোলনায় দুলতে থাকে। এরই মধ্যে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা শুধু স্বপ্নে ঘটে। কল্পনায় ঘটে। অবিশ্বাস্যভাবে সে—সব ঘটনা ঘটে যায় একের পর এক। তাদের অস্বীকার করা দায়।
কী দেখেছিলাম সেই স্বপ্নে? শুনবে? শোনো তাহলে—
আকাশের নিকষ কালো অন্ধকার তখন লুটিয়ে পড়েছে ডাঙ্গাল জমির বুকে। আর সেই অন্ধকারে যেন চলছে তাণ্ডব নৃত্য। হিংস্র পশুদের উন্মত্ত উল্লাস। সেই হানাহানির যন্ত্রণা কী বীভৎস!
অথচ আমার মনে পড়ছিল, একটু আগেই আমি বিছানায় চিত হয়ে শুয়েছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকতে পারলাম না। চারপাশের গভীর আঁধার থেকে তখন দুটো কালো হাত এগিয়ে আসছে আমার দিকে। রক্তজবার আভা সেখানে স্পষ্ট, তীব্র এবং স্থায়ী। ভয়ঙ্কর পশুদের আর দেখা যাচ্ছে না। সহসা তারা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পশুকুল যেন শান্ত হয়েছে এবার।
কিন্তু তারপরেও চতুর্দিকে মহানিশার গাঢ় নিশুতি। কেউ কোথাও জেগে নেই। স্বর্গের পরিরাও যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পাশ ফিরে। আর ঠিক তখনই তিনদিক থেকে তিনটি আলোর রশ্মিরেখা ফুটে উঠল অন্ধকারে। তলস্থ জমিতে সর্বস্ব গোপন করে রাখা সুন্দর আলো। এক—একটি আলোর শরীরে পরিপূর্ণ রূপ পেল এক—একটি মানুষের অবয়ব। তিনটি মানুষ। তারা হাসছে।
মধ্যিখানের মানুষটি বলছে—মনের অন্ধকার প্রবৃত্তির ছায়ায় ঢাকা। সেখানে দিনে রাতে পশুজগতের উৎপাত। বাইরের হিংস্র পশু ভিতরেই তো বাসা বেঁধে রয়েছে। নিধনযজ্ঞে বাইরের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব কিন্তু ভিতরের পশু থেকে উদ্ধার পাওয়া প্রায় অসম্ভব! তখন প্রয়োজন কনট্রোলড পাওয়ার…।
ডানপাশের আলোর মানুষটি কিছু বলছিল, কিন্তু তা ভালোভাবে কানে এল না— তাই বোধগম্য হল না।
এরপরই কয়েক পা আমি হাঁটলাম জঙ্গুলে ঝোপ সরিয়ে সরিয়ে। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে চড়াই পথ ভাঙতে হচ্ছে—এইরকম বড়ই অসম্ভব অন্ধকার আমি আগে কখনও দেখিনি। এটা কি আমারই কোয়ার্টার? তাহলে কি আমি যখন অতল নিদ্রায় দ্রবীভূত হয়েছিলাম তখন কারেন্ট চলে গিয়েছিল? আজকাল তো এ—সব এলাকায় সেভাবে কারেন্ট যায় না! তাহলে?
কোথা থেকে একটা মৃদু আওয়াজ আসছে না? নাকি কেউ মৃদু স্বরে মন্ত্র পড়ছে!
সর্বে চ পশবঃ সন্তি তলবদ ভূতলে নরাঃ।
তেষাং জ্ঞান—প্রকাশায়ঃ বীরভাবঃ প্রকাশিতঃ।
সামনেই শ্মশান। সেখানে চিতা জ্বালানো হয়েছে। লকলকে আগুনের শিখা আকাশ ছুঁই—ছুঁই করছে। ধোঁয়া পাক খেতে খেতে উপরে উঠছে, তারপর ভেঙে খান খান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে সর্বত্র। শিমুল অশ্বত্থের মাঝখানে অনেকটা ফাঁক, সেখান থেকে চিতার আগুন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আগুনের সে কী ভয়ানক দাপাদাপি! একটা মানুষকেও দেখা যাচ্ছে। তিনি লালচেলি পরে উত্তরমুখো হয়ে মন্ত্র পড়ছেন। কী যেন একটা পৈশাচিক কাণ্ড ঘটতে চলেছে…।
কীসের একটা শব্দে ঘুমটা পাতলা হয়ে এল, আর স্বপ্নটা ভেঙে যেতে ধড়মড়িয়ে বিছানার ওপর উঠে বসলাম আমি। সারা শরীর ঘামছিল। দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে বেসিন খুলে চোখে—মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতে শরীর শান্ত হল যেন। মন হল স্থির।
বুঝলাম, এখন আর চট করে ঘুম আসবে না। তবু ঘরের আলো জ্বাললাম না আমি। খাটের মাথার কাছে টেবিলে সিগারেট আর দেশলাই রাখা ছিল। অন্ধকার হাতড়ে সেগুলো হাতে নিলাম। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম খোলা জানলার সামনে। গরমের রাত। আকাশে কুসুমরঙা চাঁদ। চারপাশ অসম্ভব রকমের গুমোট। তবু একটা ফুলের বুনো গন্ধ উড়ে এসে উতলা করছে রাতের মৃদু বাতাসকে। দূরে, অনেক দূরে, একটা নাম—না—জানা পাখি অবিরত করে চলেছে টকটক শব্দ।
এই ছিল স্বপ্ন ও তার পরবর্তী অংশ। আশ্চর্য! সেদিনও ছিল ১৩ তারিখ—১৩ মে—২০১৩…
.
বাছুরডোবায় তোমাদের বাড়িতে প্রথম যাওয়ার দিন এক অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলে তুমি। তারপর শুনিয়েছিলে অদ্ভুত এক গল্প—
কেন? কেন শুনিয়েছিলে?
তুমি বলোনি কোনওদিন আমাকে।
প্রশ্নটা করার আগে এক অবাক করা আলো খেলে বেড়াচ্ছিল তোমার চোখের সবুজাভ মণিতে।
আমার কানের কাছে মুখ এনে অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলে— ‘তাহলে তাড়াতাড়ি বলো, আমি, না আমার ভালবাসা?’
‘মানে?’
‘মানে আমি, না আমার প্রেম, কাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না?’
‘কেন দুটোই একসঙ্গে পাওয়া যায় না?’
তুমি উত্তর দাওনি। দাওনি, আমার প্রশ্নের উত্তর তুমি সেদিন দাওনি!
বাছুরডোবার পথে গাড়িটা নিজেই ড্রাইভ করছিলাম। তুমি বসেছিলে পাশে। প্রথমে সামান্য অন্তরঙ্গ হলে, তারপর শুরু করলে তোমার সেই গল্প…
কিস্কুরা সাঁওতাল জাতির মধ্যে রাজবংশ। মান্ডিরা জমিদার বংশ। মান্ডিজাতির এক যুবকের চেহারা ভালো ছিল না। কিন্তু তার চুলগুলি ছিল খুবই লম্বা এবং চিক্কন কৃষ্ণ বর্ণ। এই যুবকের মাথার একটি চুল হঠাৎ করে খসে পড়ল। তাতে সমস্যার পর সমস্যা। যুবকটি ভাবল, সে যদি তার এতবড় চুলটি ডাঙায় রেখে দেয় তবে এই চুলে জড়িয়ে অনেক পাখপাখালির প্রাণহানি হবে। আবার, যদি সে এই চুলটি জলে ফেলে দেয় তবে এতে জড়িয়ে বহু মাছের প্রাণনাশ হবে।
অকারণে বহু প্রাণী হত্যার পাপ এড়ানোর জন্য যুবকটি চুলটিকে একটি শালপাতার মধ্যে মুড়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল।
নদী ক্রমশ বয়ে চলে নিম্নদিকে। কিস্কু পরিবারের এক রাজকুমারী সেই নিম্নগামী বহতায় স্নান করতে গেল। দেখতে পেল শালপাতার সেই পুঁটলিকে। তখন সে তার সইকে পুঁটলিটা তুলতে বলল। পুঁটলি খুলে রাজকুমারী দেখল একটি চিক্কণ কৃষ্ণবর্ণ বারো হাত লম্বা চুল। এত বড় আর এত সুন্দর চুল দেখে রাজকুমারী বলল, সই, এই চুল যদি কোনও মেয়ের হয় তবে আমি তার সাথে সই পাতাব, আর, যদি কোনও ছেলের হয় তবে তাকে আমি বিয়ে করব।
ঘরে ফিরে রাজকুমারী তার বাবা—মায়ের কাছে সব কথা খুলে বলল। তখন রাজকুমারীর প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে দিকে দিকে লোক পাঠানো হল এবং পরিশেষে মান্ডি পরিবারের সেই কুৎসিত যুবকটির সন্ধান পাওয়া গেল। রাজকন্যার সঙ্গে যুবকটির বিয়ে হল ঠিকই, কিন্তু বনিবনা হল না। কন্যার বাবা—মা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে রাজি হলেন না।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিস্কুদের সঙ্গে মান্ডিদের বিবাদ শুরু হয়েছিল এবং তা নাকি টিকে ছিল বহুদিন।
কিন্তু জনশ্রুতি অন্য কথা বলে। জনশ্রুতি বলে, ওই বিয়ের পর থেকে মান্ডি যুবকটি কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তাকে আর কেউ কোনওদিন দেখেনি।
এই ছিল তোমার বলা গল্পটি। কিন্তু সেগুনী, এই গল্প তুমি আমায় বলেছিলে কেন? কী ছিল তোমার অভিপ্রায়?
.
আর রক্ত!
আমার রক্ত দেখলে তুমি অপ্রত্যাশিতভাবে উতলা হয়ে উঠতে সেগুনী। বাছুরডোবায় তোমাদের বাড়ির সামনে গিয়ে আমার গাড়িটা থামল। কিন্তু অসাবধানে গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে আমার বাঁ—হাতের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে যায়। রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে। তখন তোমার চোখ বিস্ফারিত। ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তুমি তাকিয়েছিলে চুঁইয়ে পড়া রক্তের দিকে। যন্ত্রণায় তখন আমার ভিতরটা তীব্রভাবে মোচড়াচ্ছে। আমার কষে ঝুলে পড়া জিভ মুখগহ্বরে ঢুকে স্থিত হচ্ছিল না। শরীরের কাঠামোয় বল ফিরে আসছিল না। অথচ তখনও তুমি যেন সম্ভোগ—পাগল ক্ষুধার্ত! আমার কষ্টের কথা বুঝতে চাইছিলে না।
তখন বুঝিনি। আজ বুঝি—তুমি কেন আমার রক্ত দেখে শীৎকৃত হয়ে উঠতে…
উঁচু ডাঙ্গাল জমিতে তোমাদের ঘর। তারপর থাকে—থাকে নীচে নেমে গেছে উদ্ভিদ—সবুজ জমি। সেখানে ফুলের চাষ হয়। তোমাদের শস্যাগার আছে। তার পাশে প্রশস্ত ভূমি। সেখানে গাড়িটাকে নিয়ে গিয়ে পার্ক করলাম।
শস্যাগার থেকে আদিম বুনো গন্ধ ভেসে আসছিল। আমার গা গুলিয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওখানে কী আছে?’
‘কুকুর’, তুমি বলেছিলে।
‘ওদেরকে ওখানে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে কেন?’
‘কেননা ওরা হিংস্র’, তুমি নিভৃত কণ্ঠে বললে।
তারপর তোমার বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি যুধিষ্ঠির কিস্কু।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাঁর ডান হাতটা কাঠের। সেখানে অনেক ছিদ্র।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাতটা কাঠের কেন?’
‘এক দুর্ঘটনায় হাতটা কাটা যায়।’
‘আর ছিদ্রগুলো কীসের জন্য?’
একটু পরে মনে হল, আমার এমনধারা প্রশ্ন শুনে যুধিষ্ঠির কিস্কু যেন অবাক হলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন তোমার দিকে। তারপর অভিশপ্ত স্বরে বললেন, ‘তুমি আমাদের পারিবারিক ইতিহাস এই ছোকরাকে বলোনি?’
‘না, বলা হয়ে ওঠেনি।’ তুমি বলেছিলে।
‘বাহ! চমৎকার! ও—সব কথা না বলেই বন্ধুত্ব করা হয়ে গেছে?’
.
সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ির ছাদে বসে গল্প হচ্ছিল। যুধিষ্ঠির কিস্কুও ছিলেন সেখানে। তখনই কথায় কথায় জানতে পারলাম পুরো ঘটনাটা—
তোমার একটা ছোট বোন ছিল। নাম—বেদিনি। পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে গিয়ে একদিন ডুবে মরে সে। তারপর কিছুদিন বাদে বেদিনি এসে হাজির হয় তোমার বাবার কাছে। বলে, ‘আমি একা একা আর ঘুরে বেড়াতে পারছি না। আমার আশ্রয় চাই।’
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে আশ্রয় দেব?’
‘তোমার কাঠের হাতে আশ্রয় দেবে। ওখানে অনেকগুলো ছিদ্র তৈরি করো, যাতে আমি ঢুকতে—বেরোতে পারি। এইভাবে আমি তোমার শরীরে আশ্রয় নেব।’
অনেক রাত অবধি ছাদে বসেই গল্প হল। যুধিষ্ঠির কিস্কু চলে গেছেন অনেকক্ষাণ। আকাশে তখন শুভ্র পূর্ণশশী। তুমি কাঁদছিলে সেগুনী। রাত ক্রমশ গভীর হয়। তুমি আমার কানের কাছে মুখ এনে অর্ধস্ফুটে আবার জিজ্ঞেস করলে—
‘তাহলে তাড়াতাড়ি বলো, আমি, না আমার ভালবাসা?’
‘মানে?’ আমি আবার শুধোলাম। ‘মানে, আমি, না আমার প্রেম, কাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না?’ ‘কেন দুটোই একসঙ্গে পাওয়া যায় না?’ যথারীতি তুমি আমার এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দাওনি।
অথচ তুমি ক্রমাগত প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ছিলে। বলছিলে, ‘এ আমি কী ভুল করলাম সবিতাব্রত! ভুল! ভুল! সবই ভুল!’
‘কেন? কেন এ—কথা বলছ?’ আমি কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলাম।
‘তোমার সঙ্গে আমার কোনও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে না, মানে বিয়ে হবে না!’
‘কেন?’
‘আমার বাবার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। আমার বোন, বেদিনি, তাকে আর ক্যারি করতে পারছেন না। এখন আমাকে সেই দায়িত্ব নিতে বলছেন। তাই আমাকে এখন এগিয়ে আসতে হবে… আমার বোনের দায়িত্ব নিতে হবে…’
‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’
‘একটা অ্যাক্সিডেন্ট হবে। আমার একটা হাত বা পা কাটা যাবে। তারপর সেই প্রত্যঙ্গের কাঠের অবিকল নকল তৈরি হবে। যেমন আমার বাবার কাঠের ডান হাত। সেখানে অনেকগুলো ছিদ্র থাকবে। আর তখনই আমার বোন বেদিনি এসে আশ্রয় নেবে সেখানে। বুঝলে?’
‘বুঝলাম।’
‘না বোঝোনি।’
‘কেন?’
‘আমি তোমার স্ত্রী হতে পারলাম না। কিন্তু ভেবো না অন্য কোনও নারীকে তোমার স্ত্রী হতে দেব…’
‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’
‘দেখতে পাবে, সবিতাব্রত…দেখতে পাবে…’
ঘটনার অপ্রত্যাশিত অবাক করা পীড়নে আমার চোখে জল এসে পড়তে চাইছিল…।
পরের দিন ঝাড়গ্রামে ফিরে এলাম।
তারপর অনেকদিন…অনেক মাস কেটে গেল…
নভেম্বর মাসের তেরো তারিখে তোমার জন্মদিন। তোমার জন্য বার্থ—ডে কেক কিনে আনলাম সেলিব্রেট করব বলে। সঙ্গে তিরিশখানা মোমবাতি।
কিন্তু কেক কাটার ছুরিটাকে সামলাতে পারলাম না।
মনের উচ্ছলিত তরঙ্গের কারণে শরীরটা কুঁকড়ে গেল। আরে অপরিমেয় সংকোচে ভার হয়ে ছুরিটা ছোবল মারল আমার ঠোঁটে। ঠোঁট কাটল। রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল সেখান থেকে।
তুমি তখন আমার কোয়ার্টারের কিচেন আর ডাইনিং রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। দেখে এনজয় করছিলে আমার রক্তাক্ত ঠোঁট।
তারপর মিলন হল আমাদের।
তীব্র মিলন…
আমার রক্তাক্ত ঠোঁটে তোমার ঠোঁট প্রতিষ্ঠিত হল। আর তারপর…
ব্ল্যাক উইডোর মতো…শেষ যৌন সংসর্গের পর…আমার শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে তুমি খুন করেছিলে আমাকে…
আচ্ছা, মান্ডিদের সেই কুৎসিত ছেলেটিও কি খুন হয়েছিল এই ভাবে?