ব্লু সি.ডি নিয়ে একটি গল্প

ব্লু সি.ডি নিয়ে একটি গল্প

আমার সারের বিজনেস ছিল, তারপর ট্রাক্টর কিনিচি, ভাড়া খাটাই। আমার ট্রাক্টরটার রং লাল। হবে না। ও কিছু না। কন্ট্রাক্টরিও করি। একটা মারুতি ভ্যান গাড়ি আছে, লাল। হবে। ও কিছু না। একটা ছোটখাটো হলঘর মতো করিচি, ওখানে তিনটে শিক্ষিত বেকারকে চাকরি দিয়িচি। ওখানে ভিডিও সিনেমা দেখানো হয়-মাঝে মাঝে নীল, ও কিছু না।

এগুলোকে কেন যে নীল বলে, বুলু বলে, কে জানে? ওসব সিনেমায় তো সব রং থাকে। এখন যে সিডিটা দেখানো হচ্ছে ওটার নাম তো হট রেড। লাল স্টেজ, লাল পর্দা, লাল আলোর মধ্যে খেলা চলছে। এই সিডিটা আমি কিনেছিলাম পাটেয়াতে। থাইল্যাণ্ডের পাটেয়া। ওখানে যে এসব হয় আগে জানতাম না। জানার কোনো শেষ নাই।

গঙ্গায় পাথর ফেলার কাজটায় ঠাকুরের ইয়েতে কিছু হল। গঙ্গার ভাঙন আটকাতে পাথর ফেলাটা আর কি। জলে ফেলার সুবিধে অনেক। বিলটা পেয়ে হরিমন্দিরে একটা রাসমঞ্চ করে দিলাম পাথরের, শহিদবেদিটাও বাঁধিয়ে দিলাম পাথরে, স্কুল বাড়ির কুয়োতলটাও বাঁধিয়ে দিলাম, স্কুলটা গাঙের ধারে, কে জানে সামনের বার থাকবে, না কি নদী গর্ভে যাবে।

ইঞ্জিনিয়ারটি বলল আমি কিছু ক্যাশ-ট্যাশ চাই না। আমায় একটু ঘুরিয়ে দিন। চলুন বেড়িয়ে আসি ব্যাঙ্কক-পাটেয়া। আমি বললাম-আগ্রার তাজমহলই দেখিনি এখনো, ব্যাঙ্কক কী দরকার। ইঞ্জিনিয়ারটি বলল-দরকার, দরকার এখনই দরকার। তাজমহল-টাজমহল তো রইলই। কেউ সেটা নিয়ে যাচ্ছে না। বসন্ত চলিয়া গেলে আসিবে আবার, যৌবন চলিয়া গেলে আসিবে না আর। এরপর ওই ইঞ্জিনিয়ারটা পাটেয়ার গল্প বলল।

ওইসব গল্প শুনে কি বলব। আমার তো, ডিজেল ট্যাংকি গরম। ওই ইঞ্জিনিয়ারটার নাম সব্যসাচী। স্কুলে পড়েছিলাম যে দুই হাত সমান কাজ করতে পারে এককথায় তাকেই বলে সব্যসাচী। ছেলেটা কিন্তু ওর নামের ইজ্জত রেখেছে। ও খুব করিতকর্মা ছেলে। আমার পাসপোর্ট-টাসপোর্ট সব করিয়ে দিল। জীবনে প্রথম প্লেনে উঠলাম। মিসেসকে বললাম মন খারাপ কোরো না, দেখে টেখে আসি, তোমাকেও নিয়ে যাব। প্লেনে মাইরি কিছুই বোঝা যায়না-এটা যে এত জোরে চলেছে কে বলবে। গান শুনতে শুনতে আর স্কচ মারতে মারতে ব্যাংকক পৌঁছে গেলাম। ব্যাংককে এক রাত থেকে পর দিনই পাটেয়া।

পাটেয়া যে কী জায়গা, কি বলব। সমুদ্রের ধারে একটা রাস্তা, যার নাম ওয়াকার স্ট্রিট। ওখানে গাড়ি মানা, শুধু ওয়াক করতে হয়। ওয়াক করছি, দু পাশে নানা রকম দোকান। সেক্স শপ। কাচের শোকেসে কী বলব, ভ্যারাইটিস্ রকমের ফুর্তি সাটানো। ছবি, মূর্তি, সিডি, রবারের ধন, বড়ো বড়ো। তা ছাড়া রগড়ের খেলনা–ইন্টুপিন্টু করছে। মালের দোকান, দোকানের টুলে খালি গায়ে কটা ব্যাটাছেলে বসে আছে। সব্যসাচী বলল ওরা হ’ল ছেলে বেশ্যা। দাঁড়িয়ে আছি দেখব বলে কোনো মেয়ে ওখানে কিনা, ওমা, দেখি আমাদেরই ডাকছে। আর একটু সামনে দেখি একটা গোল মতো বেদি, আমাদের রাসতলার মতন,বেদিটা স্লো-স্লো ঘুরছে। বেদিটার উপর অনেকগুলো জাঙিয়া-বডিজ পরা গোপিনী। আমার এই বয়সেও মনটা বলছিল মাঝখানটায় কেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়।

মনটা আমার এখনো ইয়ং আছে, কিন্তু টু-ইন ওয়ান যন্তরটা, সুগার-ফুগার হয়ে গিয়ে একটু কমজোরি হয়ে আর টু-ইন-ওয়ান নেই। কিস্তু এখানে এসে দেখি ওটা কথা বলে। মেয়েগুলোর গলায় একটা করে নম্বর ঝোলানো। সব্যসাচী বলল কাউন্টারে গিয়ে পছন্দের নম্বরটা বলতে হয়। চোখের ইশারা করল আমায়। ওর তো বয়েস কম, সবটাতেই হুড়োহুড়ি। আমি বলি হবে খনে স্যার, গেলেই তো হয়ে গেল। সামনে ওয়াক করি। ওয়াকার স্ট্রিট। কত সাহেব-সুবো।

ওদের দেশে এইসব ফুর্তি কিনতে অনেক টাকা, এশিয়ায় সস্তা।ডলার ভাঙালে, পাউণ্ড ভাঙালে, ইয়োরো ভাঙালে এক গাদা এশিয়ান টাকা। একটা সুট পরা কালো রং-এর সাহেব ঘাড়ে করে একটা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েট৷ কালো সাহেবের কোঁকড়া চুল ধরে আছে, সাহেবের গলায় দুপাশ থেকে বেরিয়ে বুকের ঝুলে থাকা পা দুটোকে খাবলে ধরে আছে সাহেবের হাত। সাহেব চলেছে। ডান দিকে ওয়াটার গেমস, বাঁ দিকে ডল্‌স হাউস্। ডান দিকে সাম্বা সাম্বা বাঁ দিকে তাজমহল। ডানদিকে বুগি বগি শো তো বাঁ দিকে হট রেড শো। হট রেড শো-র বাইরে কিছু ছবি দেখে পছন্দ হ’ল। দুশো ভাট করে টিকিট।এমন কিছু না। একশো কুড়ি টাকায় একশো ভাট হয়। ঢুকে গেলাম। লাল কার্পেট, লালপর্দা, লাল আলো।

তারপর কী সব কাণ্ড রে ভাই, একটা মেয়ে ওর অসভ্য জায়গায় একটা বল ঢুকিয়ে দিচ্ছে, আবার সেই বল ফক্‌ করে বার করে দিচ্ছে। তারপর তিনটে মেয়ে চেয়ারে বসল, চেয়ারের হাতলে পা তুলে দিল, একটা লোক এসে ওদের অসভ্য জায়গায় পিচকিরি দিয়ে জল ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল, তারপর মিউজিক বেজে উঠল, আর মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ জায়গা থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরোতে লাগল, আর ওই জলে আলোক সম্পাত। তারপর পাঁচটা ল্যাংটো মেয়ে সারা গায়ে রিং ঘোরাতে লাগল। এরকম ধারা কয়েকটা শো-এর পর থপথপ করতে করতে একটা মোটা ছেলে এল। খালি গা। থলথল করছে গাদা গাদা চর্বি। গলা থেকে মাংস ঝুলে পড়েছে, চোখটাও বেরিয়ে পড়েছে। পরনে সিল্কের লুঙ্গি। আলোয় চকচক করছে। ছেলেটা হাত দুটো উপরে তুলে দিল, দাঁত বের করল, ফেং সুই-এর লাফিং বুদ্ধ যে রকম, ভুঁড়ি দোলাতে লাগল ঘুরে ঘুরে, আর হট করে লুঙ্গিটা খসে গেল। দেখি, যন্তরটা বিরাট বড়ো পিন মারা বইতে যেমন ড্রেসক্রাইব করা থাকে। ছেলেটা থপাস থপাস নাচছে। মিউজিকে মিলছে না। হাতে ধরে দণ্ডটা নাচাচ্ছে। দর্শকদের হই-হই। এবার চলে এল কয়েকটা মেয়ে। কত রকম রং ঢং করল, ছেলেটাকে বারবার জড়িয়ে ধরতে লাগল আর মুখ দিয়ে কত রকমের আওয়াজ করতে লাগল। যে যার পরনের বসন খসিয়ে ফেলল, তারপর ছেলেটার পুরুষ-অঙ্গটা নিয়ে টানাটানি করতে লাগল, টানাটানি হাতে হতে ঝং করে একটা মিউজিক বাজল আর দেখি ছেলেটার দেহ থেকে ওই পুরুষ অঙ্গ খসে গেছে।পুরো জিনিসটা একটা মেয়ের হাতে, ছেলেটা বাংলায়, চিৎকার করে উঠল, এক্কেবারে বাংলায় ও-মা… দেখদিকি আমারটা লিয়ে পলাই’ল…।

ছেলেটার তলপেটে তখন আলোর ফোকাস। ছেলেটার কিচ্ছু নেই, ছোট্ট একটুখানি, দুটো করমচার মতো অণ্ডকোষ। ছেলেটা আবার মাথা চাপড়াচ্ছে। ও মা…

এক্কেবারে আমার দেশের টান। আমার বাংলা। ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাই, কেমন চেনা লাগে কিন্তু পর্দা পড়ে যায়। এটাই ছিল শেষ আইটেম।

সব্যসাচী স্যারকে বললাম এই ছেলেটা আমার গাঁয়ের। ছোটবয়স থেকেই খুব বেশি খেত বলে ওর মা বেচে দিয়েছিল। একবার কি জিজ্ঞাসা করে আসা যায় ছেলেটার গাঁয়ের নাম চন্দন পিঁড়ি কিনা? সব্যসাচী ওধারে গেল, ফিরে এসে বলল এখন ঢোকা গেল না! এক্ষুনি আবার শো আছে। কাল আসা যাবে।

হল-এর বাইরে একটা ছোট্ট করে মালের দোকান।এসব ছোট দোকানকে পাব বলে। শিখেছি। ওখানে বসা হল। সব্যসাচী স্যার ওর এক বন্ধুর দেখা পেয়ে গেল। ডাক্তার। এই শো দেখেই বেরিয়েছে। একটা ওষুধ কোম্পানি কয়েকজন ডাক্তারকে ফুর্তি করাতে এখানে নিয়ে এসেছে–আমি যেমন সব্যসাচী স্যারকে। আমরা বসলাম। বিয়ার নিলাম। আমি বললাম ছেলেটাকে আমি চিনি। বাগদি ঘরের ছেলে। ওর মায়ের নাম বিমলি। বিমলি এক সময় আমাদের বাড়িতে কাজ করত। ছোটাবেলা থেকেই ছেলের খুব খাই খাই ছিল। ছেলের চেহারাটাও ছিল বড়ো। ছেলের যখন দু-বছর বয়েস, তখন বিমলির স্বামী ফুটে যায়। বিমলি তিন মাইল দূরের বলরাম গোঁসাইয়ের শ্রী পাটে গিয়ে ছেলেকে খিচুড়ি খাইয়ে আনত, আমাদের বাড়িতেও এনেছিল। তিন বছরের ছেলে আধ সের চালের ভাত সাবড়ে দিত। পালোয়ানের মতো চেহারা হচ্ছিল। দেখে কে বলবে মোটে তিন বছর। বিমলি ওই আশ্রমেই কাজ পায়। শুনেছিলাম কারা নাকি ওই খাই খাই ছেলেটাকে পছন্দ করে নিয়ে গিয়েছিল।

বিমলি তারপর বোষ্টমী হয়ে যায়। এ পাট সে পাট ঘুরে আবার এই এসেছে। ওর ভিটে দখল হয়ে গিয়েছিল, পঞ্চায়েতের চেষ্টায় ভিটে ফিরে পেয়েছে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে এটাই বিমলির সেই ছেলে।

কত বছর আগে বিমলির ছেলেটা হয়েছিল? ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করে। আমি হিসেব-টিসেব করে বলি-তা কুড়িবছর হয়ে যাবে।

ডাক্তার বলল-এসব ছেলেপিলেরা বেশি দিন বাঁচে না কিন্তু। কুড়ি বছর রেয়ার কেস। এর একটা ছবি পেলে ভালো হ’ত।ফুল বডি, উইথ গোনাড্স্।

মানে?

মানে ওর জনন যন্ত্র সমেত। এদের রিপ্রোডাকটিভ অরগান্স খুব ছোট হয়ে যায়। হাইপোগোনডিজম বলে একে। বিয়ারে চুমুক দেন ডাক্তার।

কী অদ্ভুত বলুন তো, এই এত্তবড়ো একটা পেনিস, দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ভাবছিলাম ওইতো জবুথবু চেহারা, তার এত দামি সম্পত্তি! আর আমার এই ডিগ্রি, ব্যাংক বাল্যান্স- কিচ্ছু না!–সব্যসাচী স্যার বললেন।

তারপর যখন দেখা গেল কিছু নেই, ওটা ফল্স, আনন্দ হ’ল তো?

–ডাক্তারবাবু বললেন।

সবাই হাসল। বিয়ার ঢালা হল। ফেনা।

সব্যসাচী স্যার বললেন–লোকমান কেসটা মনে আছে? খবর কাগজে খুব বেরিয়েছিল। ছেলেটার জন্য মায়া পড়ে গিয়েছিল।

ফালতু ফালতু মারা গেল ছেলেটা।

ওর মাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ডাক্তারবাবু বললেন।

আমার খুব জানার ইচ্ছা। আমার চোখ দেখেই ডাক্তারবাবু বুঝতে পেরে ছিলেন চোখের মধ্যে জিজ্ঞাসাচিহ্ন। ডাক্তার বললেন – মাথার হাইপো থ্যালামাসের ডিসফাংশনের জন্য বেশি পরিমাণে গ্রোথ হরমোন বেরোতে থাকে। ফলে দেহটা অস্বাভাবিক ভাবে বড়ো হয়ে যায়, আর বডির প্রয়োজনেই খাই খাই রোগ। খুব খায় এরা, আর বুদ্ধি হয় না এদের। সব হরমোনের খেলা,বুঝলেন?

হরমোনটা আমি বুঝি। সারের কারবার কিনা, বালির মধ্যে শেকড় ছেড়ে দেয় চন্দ্রমল্লিকার শুকনো ভাল শুধু দু-ফৌটা হরমোনে। শীতকালে জুঁই ফুটিয়ে দিচ্ছি, গ্রীষ্মে শেফালি। গন্ধটা অবিশ্যি হয় না। বিশাল বিশাল ভোসকা মূলো আর পানসে শালগম বানিয়ে দিতে পারি হরমোনে। সামনের টেবিলে একটা মেয়েছেলে। বিশাল বিশাল স্তন। হরমোন? এই যে পাটেয়া, ব্যাংকক থেকে গম্ফ হাইওয়ে, রাস্তা-পার্ক, স্পিডবোট, প্যারাসুট-পাব-এইসব ঝলমল, সব ঝিনচ্যাগ, সব হরমোন? বিয়ার খাই।

রাত মোটে আটটা। নাইট ইজ ইয়ং। কোথায় যাওয়া যায়? ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার যাবে ডল্‌স হাউস্-এ, আমি তবে ম্যাসাজ পার্লারে। ওরা বলল আপনিও ডল্‌স হাউস এ চলুন। আমি বললাম–না, ওখানে সুবিধে হবে না। সাতান্ন বছর চলছে। ডাক্তার বলল তাতে কী হয়েছে, একটু হরমোন নিয়ে নিতে পারতেন।

বিমলির ওই হরমোন ছানার সঙ্গে আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। সব্যসাচী খোঁজ নিয়ে জেনেছিল রোজ বিকেলে তিনটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত পেংল্যাড-এর দেখা পাওয়া যায়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফি কুড়ি ভাট, পাঁচ মিনিট সময়। ওরা ওই ছেলেটার নাম রেখেছে পেংল্যাড।

হোটেলে ফিরলাম রাত দেড়টা নাগাদ। পরদিন একটা কোরাল আইল্যাণ্ড গেলাম। স্পিডবোটে সাহেব, সাহেবের কোলে থাই কিশোরী। রঙিন ছাতার তলায় সাহেব, সাহেবের গা টিপে দিচ্ছে থাই কিশোরী। প্যারাসুটে উড়ছে সাহেব, স্পিডবোটে ঘুরছে সাহেব, টাকা উড়ছে-ডলার, ইয়োরো- ইয়েন। আমি সব্যসাচী স্যারকে ফুর্তি করাচ্ছি।

চারটের সময় গিয়ে বসে রইলাম। চারটে কুড়ি মিনিটে ডাকল। আমরাই শেষ ভিজিটার। লাল কার্পেট বিছানো ঘরে লাল সোফায় বসে আছে ছেলেটা। চোখের ভিতরে ধানকাটা মাঠ। মেশিনের মতো উঠে দাঁড়াল। খালি গা। কোমর থেকে খসিয়ে দিল আচ্ছাদন। দুই বিশাল থাইয়ের মাঝখানে দু’ ফোঁটা চোখের জলের মতো দুঃখী অণ্ডকোষ। সব্যসাচী ছবি তুলতে গেল। পাশে দাঁড়ানো একজন বলে উঠল নো ফোতো, নো ফোতো সিডি ইজ দেয়ার। পারচেজ প্লিজ।

ছেলেটার কোমরে আবার সিল্কের চাদরটা পরিয়ে দেয় লোকটা। বোঝা গেল ভিজিটাররা ওর উলঙ্গ শরীরটাকে সামনে থেকে দেখতে আসে। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ছেলেটা বলে, মাই নেম ইজ পেংলাদ। থ্যাং কিউ ফর ভিজিট, হ্যাভ ওয়ান্দারফুল ইভিনিং। বলেই চোখ বুজে ফেলে।

আমি ঝপ করে বলে ফেলি–এই শোন, তোর গায়ের নাম কি চন্দন পিঁড়ি, আর মায়ের নাম কি বিমলি?

ছেলেটা চোখ খোলে। চোখ থেকে যেন হঠাৎ বের হয় চার ব্যাটারির এভারেডি আলো। লক গেট খোলার মতো দু হাত খুলে দিল, বলল মা…হুড় হুড় জল বেরুচ্ছে শুকনো লালায়। মা…। ছেলেটা থপথপ করে এগিয়ে আসে। বলে দেশ। মা। গোরু।

বলো মা দেখেছ? মা গুড? মা ওকে? আমি বলি তোমার মা ভালো আছে। গুড, গুড, ভেরি গুড। তোমার মা খুশি হবে যদি তোমার ছবি দেখে। সব্যসাচীকে ফটো তুলতে বলি।

পাশে দাঁড়ানো লোকটা বলে–নো ফোতো, নো ফোতো। পারচেজ সি.ডি। হানদ্রেদ ভাট ইচ্।

আমি বলি তোমার মাকে তোমার কথা বলব। তুমি ভালো আছো তো?

নো-নো-নো। নট ভালো। নুতি ছাং।

–কী কষ্ট তোমার?

চোখ দিয়ে জল বের হয় ছেলেটার আর মাথা নাড়ে।

পাশের লোকটা বলে প্লিজ গো স্যার। টাইম ইজ ওভার।

ছেলেটা বলে নো গো। চিনগোতে। আরও কি সব বলল ওদের ভাষায়। ছেলেটা আমার দিকে কাতর তাকায়। তারপর বলে বাড়ি দাবো। কী সহজ সরল একটা প্রার্থনা। আমি চুপ। সব্যসাচীর দিকে তাকাই।

একটা লোক ঘরে। হাতে ট্রে।

লোকটা বলে–গো আউট স্যার। প্লিজ। নাও ইজ দি টাইম অফ ফুড।

ছেলেটার দু-হাতে নিষেধ। নো। চিন গোতে।

আমাদের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকতে চায়।

লোকটা আমাদের বলে–আই অ্যাম কেয়ারতেকার। আই কেয়ার। হি ইজ গুত।

পেংলাদ কিছু বলে। ওর গলকম্বলে ঢেউ ওঠে, মুখ থেকে থুথু ছিটোয়।

কেয়ারটেকারটি আমাদের বলে, স্টে হিয়ার সাম মোরটাইম। পেংলাদ টক্স উইথ ইউ। পেংলাদ বলে দল।

ওকি জল বলতে চাইছে? আমি মাথা নাড়ি,

ও বলে-ভাত।

মাথা নাড়ি।

আমি জানি ও ওর বাল্যবয়স বলতে চাইছে। পারছেনা। ও ওর পাঁচ কিংবা ছ বছর বয়সে দেশ ছাড়া হয়েছে। বাংলা ভুলে গেছে। কিন্তু কথা রয়ে গেছে।

কেয়ারটেকারটি খাবারের ট্রের ঢাকনাটা উঠিয়ে দেয়। বাটি ভরা জ্যাম, চিজ, মধু, ডিম…। পেংলাদ নিতদুম নিতদুম বলে চ্যাঁচিয়ে ওঠে। কেয়ারটেকার ওকে চিংকার করে কিছু বলে। আর একজন লোক এগিয়ে আসে। চামচ করে খাবার গেলায়, গলায় মধু ঢেলে দেয়। পেংলাদের সারা শরীরে নিষেধ। প্রতিবাদ। ও খাবে না। ওর আর খেতে ভালো লাগে না। তবু ওকে খেতেই হবে। ওকে চর্বি বানাতে হবে। লোক হাসাতে হবে। ওর থলথলে দুই উরুর ফাঁকের অন্ধকারটার গায়েই তো হাততালি আছাড় খায়। ওর দামের লেবেল ওখানেই সাঁটা।

ওর খাওয়া হয়ে যায়। সাদা ধপধপে ন্যাপকিনে মোছানো হয় ওর মুখ। ওকে পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। পোশাক পরানো হবে। পোশাক পরানো হলে ও আমাদের ওর নিজস্ব ঘরে ডাকে। ওর ঘরে যাই। ওর সাদা ধপধপে বিছানা দুপুরের গঙ্গার চরের মতো পড়ে আছে। দেয়ালে একটা বুদ্ধদেবের ছবি। টেবিলে ট্রের উপর একটা ধূপদানীতে ধূপকাঠি, তার পাশেই যত্নে রাখা দুটি রবারের পুংলিঙ্গ।

পেংলাদ একটি ডায়েরি বের করে। আমার দিকে চেয়ে হাসে। বলে আংকেল, আড্ডেস।

আমার অ্যাড্রেস? আমার?

মা। আমি মা-দাব।

তোমার মায়ের ঠিকানা চাও?

মাথা নাড়ে ও। হাসে।

আমি লিখি বিমলা বাগদি।

কেয়ারঅফ-এ আমার ঠিকানা।

খুব মন দিয়ে ঠিকানাটা দেখতে থাকে পেংলাদ, যেন ওই অক্ষরগুলির মধ্যে ওর মা লুকিয়ে আছে কোথাও।

সময় হয়ে গেছে। পাঁচটা বেজে গেছে। শো-তে যেতে হবে। তার আগে মেকআপ। একটা ছোট্ট ব্যাগ কাঁধে ঝোলে। ব্যাগের ভিতর থেকে থেকে উঁকি দিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে থাকে রক্তমুখ রবার শিশ্ন।

ওই হটরেড-এর একটা অফিসঘর ছিল। অফিসঘরে বসে ছিল রিমলেস্ চশমা পরা এক যুবক। ঠোঁটে লম্বা সিগারেট। ও খবর পেয়ে গেছে। আমরা ঢুকতেই বলল–সিট ডাউন প্লিজ কন্ট্রিমেন অফ পেংলাদ।

আমরা বসলাম।

হি ইজ এ ভেরি গুড গাই।

মাথা নাড়ি।

কী করে পেলেন ওকে? সব্যসাচী জিজ্ঞাসা করে। শুনেছি একটা সার্কাসে ছিল। আমার বাবা ওকে কালেক্ট করেছিল।

কিনে নিয়েছিল?

জানি না কী টার্মস অ্যাণ্ড কণ্ডিশন ছিল। আমার বাবা মারা গেছেন ছ’বছর হ’ল।

ও কি মাইনে পায়?

খাওয়া পায়, অ্যাকোমডেশন পায়। মেডিসিন পায়। এ ছাড়া ওর নামে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টও করে রেখেছি। কিন্তু ওর তো কোনো ওয়ারিশার নেই।

আমি বলি ওর মা কিন্তু বেঁচে আছে। উনি বলেন–ওর কাছে বেঁচে আছে তা বুঝি। ওর শো টা দেখেছেন তো, যখন ওর – জিনিসটা তলপেট থেকে খুলে নেয়া হয়, ও চিৎকার করে মাকেই তো কমপ্লেন করে। কিছু হারিয়ে গেলে মাকে ডাকে, এখনো। আমরা তো ওর ঠিকানা জানি না, জানলে ওর মাকে আনিয়ে নিতে পারতাম। ওকে জিজ্ঞাসা করেছি, ঠিকানাটা ঠিক করে বলতে পারে না।

আমি বললাম ঠিকানাতো দিয়ে গেলাম। কেমন থাকে জানাবেন। ফটো পাঠিয়ে দেবেন। বাইরের কাউন্টার থেকে সিডি কিনে নিলাম। নানান রকম সিডি বিক্রি হচ্ছে। ন্যুড নডিউল্‌স, ফান ফ্যান্টাসি, ক্রেজি গার্লস, এরকম কয়েকটা। বাইরে আলোর ফুলঝুরি, সমুদ্র কিনারে হই হল্লা। হাইওয়ে। সব ইঁট-পাথর-আলোর মধ্যে চুপিচুপি রয়ে গেছে ‘ওমা–নিয়ে যাচ্ছে…’।

ওই সিডি এখন চলছে। এখানে, আমার গ্রাম এ একেবারে অন্যরকমের জিনিস। এ জিনিস আগে দেখেনি। গ্রামের উন্নতি হচ্ছে। হরিসভায় মার্বেল বসেছে, পার্টি অফিস দোতলা হয়েছে, কাঁচা রাস্তায় মোরাম পড়েছে। বটার চায়ের দোকানে এখন চাউমিন পাওয়া যায়। নসুর ভাটিখানায় ব্ল্যাক হুইস্কির নিপ মেলে। গায়ের লোকজন জেনে গেছে–এ গায়ের ছেলে থাইল্যাণ্ড গিয়ে কামাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে কোনো কাজই খারাপ না। গায়ের লোকজনের মত কত পালটে গেছে। যাকে বলে প্রোগোতিশীল। নমোপাড়ার দুটি মেয়ে কলকাতায় বডি বেচে, সবাই জানে। ওরা মাঝে মাঝে গায়ে আসে হাতে ছানাবড়ার হাঁড়ি নিয়ে। বাপ মাকে নতুন জামা কাপড় দিয়ে যায়। খাসির মাংস কেনে। ভোটের সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে যায়।

ভিডিও হল থেকে কেউ কেউ বলে–আমি তো বুলু দেখতে আসিনি, গায়ের ছেলেটাকে দেখতে এসেছিলাম।

আমি ফিরে এসে বিমলির খোঁজ করতে ওদের পাড়ায় গিয়েছিলাম। বিমলি তখন শাক সেদ্ধ করছিল। একটা জায়গায় চাল, ডাল, এক প্যাকেট ট্রেনের বাদাম। ইটের উপরে বসে বিড়ি খাচ্ছে রোগা মতে একটা লোক। গলায় কণ্ঠি। বিমলির বোষ্টম।

আমি বলি–তোমার ছেলেকে দেখে এলাম গো। ভালোই আছে সে।

পেল্লাদ? আমার পেল্লাদ?

বলি হ্যাঁ। তোমার পেল্লাদ।

বড়ো আহ্লাদী হয়ে যায় বিমলি।

জয় হরি। সত্যি? নিজের চোখে?

–হ্যাঁ গো, নিজের চোখে। কথাও কয়ে এসেছি।

–কোথায় দেখা পেলে?

–বহুদূরে। ফরেন দেশে।

–কত বড়ো হল?

–অনেক বড়ো।

–ঠিক মতো খেতে পায়?

–ও নিয়ে ভেবো না। খাচ্ছে। নিজের রোজগারে খাচ্চে। মেলাই রোজগার ওর।

–আমার কথা মনে আচে ওর?

–আছে। তোমার কথা বলছিল যে।

–আর কী দেখলে বিতাং করে বল।

–খুব ভালো ঘরে থাকে। মাছ-মাংস-ফল-দুধ-মাখন সব খায়। খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে ওর। সার্কাসে জোকারি করে ও।

–সার্কেসে? বাব্বারে…। পারে?

–পারে।

ছোটবেলায় হাঁটতে দেরি করিছিল ও। ভারী শরীল, জুত করতি পারত না। ভালো করে কতাও তো ফটেনি মুকে। এখন কতাও ও বলল?

–একটু একটু বলল।

–কি কথা শুনালে, আহা। জয় হরি।

কিছুক্ষণ ছিলাম। বিমলি জিজ্ঞাসা করে দেশে কি ফিরে আসতে পারে? কত বড়ো হল, সঙ্গে কে থাকে…

বললাম, শুধু সার্কাসে কী খেলা দেখায় বললাম না।

বিমলি কত কথা বলল–প্রহ্লাদের ছোটবেলাকার কথা। ওর নাম তো প্রহ্লাদ ছিল না প্রথমে। ডিংলা বলে ডাকতো সব। কুমড়ার মতো চেহারা ছিল কিনা। আশ্রমে বাবাজিরা ওর নাম রাখল পেল্লাদ। কারণ পেল্লাদের কিছু হয় না। জলে ফেলে দিলে বেঁচে থাকে, পাহাড় থেকে ছুড়ে দিলেও কিছু হয় না। প্রহ্লাদ ভোগের খিচুড়ি খেত। বড়ো বেশি খেত। বিরক্ত হত। গাছের কলার কাদির দিকে তাকিয়ে বলত,খাবো। এক গোঁসাইয়ের সঙ্গে কণ্ঠীবদলের কথা হ’ল, কিন্তু গোঁসাই বলল পেল্লাদকে রাখা চলবেনা। গোঁসাইরা কেউ কেউ বলল এ ছেলের নাম পেল্লাদ হ’লে কি হবে, এ হ’ল দানো। চোখে-কু আছে। আশ্রমে গোরুর পালান শুকিয়ে গেছে ওর দৃষ্টিতে। বিজয় ডাক্তার বলল, এ এক বদরোগ। দিনে দিনে আরও খাবে সে। নররাক্ষস হয়ে যাবে। এমন সময় সেই লোক দুটো এল। বলল তোমাদের ওই দানো ছেলেটারে আমাদের দাও…।

সেই পেল্লাদ এখন পেংল্যাদ। পেংল্যাদ এখন পপুলার। খুব ভিড় হচ্ছে এখন। দূর থেকেও দেখতে আসছে লোকজন। বিমলিও খবর পেয়ে গেছে এখানে ভিজে হলে পেল্লাদের খেলা দেখা যায়। বিমলি দেখতে এসেছিল। আমার ছেলেরা ওকে ঢুকতে দেয়নি। ওরা জেনেছে পেংল্যাড বিমলির ছেলে। ছেলের ওই খেলা কী মাকে দেখানো যায়? বিমলি বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল।যারা দেখে ফিরছে, ওদের জিজ্ঞাসা করেছে বিমলি–পেল্লাদকে কেমন দেখলে?

হঠাৎ একদিন একটা চিঠি এল। খামে থাইল্যাণ্ডের স্টাম্প মারা। ইংরিজি চিঠি। আর একটা চেক। চিঠিটায় মৃত্যুসংবাদ আছে। ডলারের চেক। দু হাজার ডলার। চেকটা আমার নামে ভাঙিয়ে ফেলি? আমার নামেই তো চেক। কন্ট্রাকটারিতে দু-নস্বরি যে করিনি তা নয়, কিন্তু এই চেকটা নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দিতে খচখচ করতে লাগল। কী করা যায় ? কাউকে কিছু না বলে স্কুলের মিড ডে মিলে কয়েকদিন মুরগি খাইয়ে দি? হরিসভায় আসর বসিয়ে দি? বিমলির ঘরটায় নতুন করে টিন করে দি? বিমলিকে কি করে বলি ছেলের মৃত্যু কথা।

বিমলি আবার এল ভিডিও হল-এ। বলল আজ আমি দেখবই আমার পেল্লাদ। দেখবই। তোমরা দেখতে দাও না কেন শুনি? টিকিট কেটেই ঢুকব।

আমি বলি দেখাব। তোমায় আলাদা করে দ্যাখাব।

ওদের বলি দেখিয়ে দাও। শেষটা দেখিও না।

বুড়ি দেখল ওর পেল্লাদ। একটু দেখিয়েই অফ করে দেয়া হ’ল।

বিমলি যখন বেরিয়ে এল ওর মুখে বাজনা বাজছে। ইউরিয়া খাওয়া লাউগাছের মতো আঁকশি বাড়িয়ে আমার হাত ধরল!

বে-এ-শ দেখলাম আমার পেল্লাদকে। খুব আনন্দ পালাম। ও তবে বংশরক্ষাও করতে পারবে, বল?

ও কিছু না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *