ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা – আর্থার কনান ডয়েল
১৯০৮ সালে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সাউথ কেনসিংটনের ৩৬ নং আপার কভেন্ট্রি ফ্ল্যাটে যক্ষ্মা রোগে ডাঃ জেমস হার্ডকাস্লের মৃত্যুর পর, তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে নিম্নলিখিত কাহিনীটি পাওয়া যায়। যাঁরা হার্ডকাস্লকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন, তাঁরা এ-কাহিনী সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করলেও, অন্তত এটুকু একবাক্যে স্বীকার করেন, যে হার্ডকাস্ল একজন সুস্থমস্তিষ্ক বৈজ্ঞানিক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিলেন; তাঁর পক্ষে নিছক মনগড়া কতগুলো আজগুবি ঘটনাকে বাস্তব বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা খুবই অস্বাভাবিক ছিল।
লেখাটা পাওয়া যায় একটা খামের মধ্যে। তার শিরোনামায় বলা হয়েছে—‘গত চৈত্র মাসে উত্তর-পশ্চিম ডার্বিশিয়ারে অ্যালারটনদের ফার্মের নিকটবর্তী স্থানের একটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।’ বন্ধ খামের পিছনে ছিল পেনসিলে লেখা এই চিঠি—
প্রিয় সীটন,
শুনে আঘাত পাবে কিনা জানি না—আমার কাহিনী তুমি অবিশ্বাস করার ফলে আমি সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত আর কারুর কাছে কোন উল্লেখ করিনি। হয়ত বা আমার মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত কোন অপরিচিত ব্যক্তি এই কাহিনীর উপযুক্ত মর্যাদা দেবে, যে মর্যাদা থেকে আমার বন্ধু আমায় বঞ্চিত করেছিল।
এই সীটন ব্যক্তিটি যে কে সেটা অনুসন্ধান করেও জানা যায়নি। ইতিমধ্যে, মৃতব্যক্তি যে অ্যালারটনদের ফার্মে সত্যিই গিয়েছিলেন, এবং তাঁর থাকাকালীন যে ভয়াবহ ঘটনা সেখানে ঘটেছিল, এবং সেই ঘটনার যে আনুমানিক কারণ তিনি তাঁর লেখায় ব্যক্ত করেছেন, সে সবই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই সামান্য ভূমিকাটুকু দিয়ে, ডায়ারির আকারে বর্ণিত হার্ডকাস্লের বিচিত্র কাহিনীটি অবিকল ভাবে নীচে উদ্ধৃত করা হল।
১৭ এপ্রিল
এই জায়গাটির জলবায়ুর গুণ এর মধ্যেই বেশ অনুভব করছি। অ্যালারটনদের ফার্মের উচ্চতা ১৪২০ ফুট, সুতরাং এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর হওয়াই স্বাভাবিক। সকালে সেই কাশির ভাবটা ছাড়া অন্য কোন অসোয়াস্তি নেই, আর টাট্কা দুধ ও মাংস খাওয়ার ফলে ওজন বৃদ্ধির সম্ভাবনাও সুস্পষ্ট। স্যান্ডারসন আমার অবস্থা শুনলে খুশিই হবে।
অ্যালারটন ভগিনীদ্বয় দুজনেই বেশ মজার ও অমায়িক প্রকৃতির মহিলা। দুজনেই অবিবাহিতা। ফলে, স্বামী ও সন্তানের অভাবে দুজনেরই স্নেহের শেষ কণাটুকু বর্ষিত হচ্ছে এই রুগ্ন ব্যক্তিটির উপর। অবিবাহিতা মহিলারা সংসারে অপ্রয়োজনীয় এ ধরনের একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে বলে জানি; কিন্তু আমি ভাবি, এদের অভাবে আমাদের মত অকৃতদার অপ্রয়োজনীয় পুরুষদের দশা কী হত। স্যান্ডরসন যে কেন আমায় এখানে আসতে বলেছিল, তার কারণটা দুই বোনের কথাবার্তায় প্রকাশ পেয়ে গেছে। আসলে, আজ অধ্যাপকের আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেও, স্যাণ্ডারসনের জীবনের শুরু হয়েছিল এই গ্রাম্য পরিবেশেই। হয়ত ছেলেবেলায় সে এই খামারেরই আশেপাশে কাগ চড়ুই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
অসমতল উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত এই গ্রামটি ভারী নির্জন, নিস্তব্ধ। এর পথঘাটগুলি ছবির মত সুন্দর। দুপাশে খাড়াই উঠে গেছে লাইমস্টোনের পাহাড়। এই পাহাড়ের পাথর এতই নরম যে হাতের চাপে আলগা হয়ে খসে আসে। এখানকার জমির ভিতরটা মনে হল ফাঁপা। একটা অতিকায় হাতুড়ি নিয়ে যদি এই জমির উপর ঘা দেওয়া হয়, তাহলে বোধহয় তা থেকে গুরুগম্ভীর জয় ঢাকের মত শব্দ বেরোবে। তেমন জোরে ঘা দিলে হয়ত বা জমি ধ্বসে গিয়ে ভূগর্ভস্থিত কোন বিশাল সমুদ্রের সন্ধান মিলবে। এসব পাহাড়ের ভিতর জলাশয়ের অস্তিত্ব মোটেই অসম্ভব নয়—কারণ বাইরে থেকে পরিষ্কার দেখা যায়, অজস্র জলধারা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে নানান ফাটলের মধ্যে দিয়ে আবার পাহাড়েরই ভিতর গিয়ে ঢুকেছে। এমন বড় বড় ফাটলও কিছু রয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলে মনে হয় যেন আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে তারা সোজা একেবারে পৃথিবীর অন্তঃস্তলে গিয়ে পৌঁছেছে। আমার সাইক্লের ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে এসব গহ্বরের আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা ক’রে আমি গভীর আনন্দ পাই। গহ্বরের ছাতে আলো ফেললে দেখা যায় স্ট্যাল্যাক্টাইটের কালোর ফাঁকে ফাঁকে রূপালির ঝলমলানি। আলো নেবালে দুর্ভেদ্য অন্ধকার, জ্বালালে আরব্যোপন্যাসের মায়াপুরীর বর্ণচ্ছটা।
এই সব ফাটলের মধ্যে একটির বিশেষত্ব হল এই যে সেটা মানুষের কীর্তি, প্রকৃতির নয়। ব্লু-জনের কথা আমি এখানে আসার আগে শুনিনি। এক জাতীয় নীল রং-এর খনিজ পদার্থের নাম হল ব্লু-জন। এই ধাতু এতই দুষ্প্রাপ্য যে এর তৈরি একটা ফুলদানিই বিক্রী হয় আগুনের দামে। আশ্চর্য অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন রোম্যানরাই প্রথম এই অঞ্চলে ব্লু-জনের অস্তিত্ব অনুমান ক’রে পাহাড়ের গায়ে একটা গভীর সুড়ঙ্গ খনন করে। আগাছার জঙ্গলে আবৃত এই সুড়ঙ্গের মুখটাকেই বলা হয় ব্লু-জন গ্যাপ। রোম্যানদের এই কীর্তির তারিফ না করে উপায় নেই। নোনাধরা অনেক গহ্বর ভেদ করে চলে গেছে এই সুড়ঙ্গ। অতি সন্তর্পণে, অনেক মোমবাতি হাতে মজুত রেখে এই সুড়ঙ্গে প্রবেশ না করলে, এর অন্ধকার জগৎ থেকে আবার বাইরের আলোয় বেরিয়ে আসা একেবারে অসম্ভব। আমি এখন পর্যন্ত বেশি দূর এগোইনি, তবে আজই সকালে এর মুখটায় দাঁড়িয়ে গহ্বরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, যে আমার স্বাস্থ্য ফিরে পেলে কোনো এক ছুটির দিনে এসে, রোম্যানরা ডার্বিশিয়ারের পাহাড় ভেদ করে কত দূর ঢুকতে পেরেছিল সেটা যাচাই করে দেখব।
এখানকার লোকেরা যে কী পরিমাণ কুসংস্কারে বিশ্বাসী তা ভাবলে অবাক লাগে। এমনকি আর্মিটেজ ছোক্রাটিও দেখলাম বাদ যায় না। অথচ সে তো বেশ সুস্থ সবল শিক্ষিত লোক, আর মানুষ হিসেবেও চমৎকার। আমি গহ্বরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় দেখি সে সামনের মাঠ পেরিয়ে আমারই দিকে আসছে। এসে বলল, ‘ডাক্তারবাবুর দেখছি এ ব্যাপারে তেমন ভয় ডর নেই।’
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, ‘ভয়? কিসের ভয়?’
আর্মিটেজ গহ্বরের অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওই যিনি থাকেন ওর ভেতরে—তাঁর।’
এই সব পাণ্ডববর্জিত গ্রামদেশে উদ্ভট সব কিংবদন্তী গড়ে ওঠা বোধহয় খুব সহজ, আমি আর্মিটেজকে জেরা করে তার এই অদ্ভুত ধারণার কারণ জানলাম। সে বলল প্রায়ই নাকি গ্রামের এখন সেখান থেকে একটি আধটি করে ভেড়া উধাও হয়ে যায়। আর্মিটেজের মতে নাকি সেগুলোকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা যে আপনা থেকেই ভুল পথে চলে গিয়ে পাহাড়ের খাদেখন্দে হারিয়ে যেতে পারে, সে কথা বলতে আর্মিটেজ বলল, একবার নাকি এক চাপ রক্ত ও একগোছা ভেড়ার লোম পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। এই ঘটনারও যে একটা অত্যন্ত সাধারণ কারণ থাকতে পারে, সেটা বলতে আর্মিটেজ পাল্টা জবাব দিল যে ভেড়াগুলো উধাও হয় নাকি কেবলমাত্র অমাবস্যার রাত্রে। তাতে আমি বললাম যে এসব অঞ্চলে যদি ভেড়াচোর থেকে থাকে, তাহলে তারা তাদের কাজের জন্য যে অমাবস্যার রাতটাই বেছে নেবে তাতে আর আশ্চর্য কী? জবাবে আর্মিটেজ বলল একবার নাকি দেখা গিয়েছিল গ্রামের একটা পাঁচিলের গা থেকে কে জানি বড় বড় পাথরের ইঁট সরিয়ে সেগুলোকে বহুদূরে ছড়িয়ে ফেলে রেখে এসেছে। আমার মতে একাজও অবিশ্যি মানুষের অসাধ্য নয়। কিন্তু সব শেষে আর্মিটেজ এক তুরুপ মেরে বসল। সে বলল সে নাকি এই অদৃশ্য প্রাণীটির গর্জন শুনতে পেয়েছে। গহ্বরের মুখে একটানা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই নাকি সে-শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। আর বহুদূর থেকে এলেও সে-শব্দের জোর নাকি সহজেই অনুমান করা যায়। কথাটা শুনে আমি না হেসে পারলাম না। আমি জানতাম যে পাহাড়ের ভিতর যদি জল চলাচল করে, তাহলে লাইমস্টোনের ফাঁকে ফাঁকে সেই জলপ্রবাহের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে বাইরে থেকে গর্জনের মত শোনানো কিছুই আশ্চর্য নয়। এভাবে বার বার তার কথার প্রতিবাদ করায় আর্মিটেজ শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমায় ছেড়ে চলে গেল।
আর তার পরমুহুর্তে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। আমি গহ্বরের মুখটায় দাঁড়িয়ে, আর্মিটেজের কথাগুলো কত সহজে হেসে উড়িয়ে দেওয়া গেল তাই ভাবছি, এমন সময় সত্যিই গহ্বরের ভিতর থেকে এলো এক অদ্ভুত শব্দ। সে-শব্দের সঠিক বর্ণনা দেবো কী করে? প্রথমত, শুনে মনে হল সেটা আসছে বহুদূর থেকে—যেন পৃথিবীর একেবারে গভীরে অবস্থিত কোন জায়গা থেকে। কিন্তু দূর থেকে এলেও শব্দটা রীতিমত জোরে। জলধারা বা পাথর গড়িয়ে পড়া থেকে যে শব্দ হয়, এটা সে জাতের নয়। এ-যেন এক তীব্র, তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনির মত। এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ফলে কিছুক্ষণের জন্য আর্মিটেজের কথাগুলো আমাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলল। আমি আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সে-শব্দ শোনা গেল না। বাড়ি ফিরলাম মনে গভীর বিস্ময়ের ভাব নিয়ে। আর্মিটেজের কথায় আমল দেবার কোন প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু এটা অস্বীকার করা চলে না যে, যে-শব্দটা আমি নিজের কানে শুনেছি সেটা ভারী অদ্ভুত। এখনও লিখতে লিখতে যেন কানে সে-শব্দটা শুনতে পাচ্ছি।
এপ্রিল ২০
গত তিন দিনে আমি বার কয়েক ব্লু-জন গ্যাপের দিকে গিয়েছি। এমন কি সুড়ঙ্গের ভিতরও কিছুদূর অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু আমার ল্যাম্পের আলো যথেষ্ট জোরালো না হওয়ায় বেশিদূর যেতে সাহস পাইনি। এবারে আরো আঁটঘাট বেঁধে যেতে হবে। শব্দটা আর দ্বিতীয়বার শোনার সৌভাগ্য হয়নি। এক একবার মনে হয়েছে যে প্রথমবারের শোনাটা হয়ত আমার আর্মিটেজের সঙ্গে কথাবার্তার ফলে আমার কল্পনাপ্রসূত। সমস্ত ব্যাপারটাই যে আজগুবি সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, যদিও এটা না বলে পারছি না যে গ্যাপের মুখে ঝোপঝাড়ের অবস্থা দেখে এক এক সময় মনে হয়েছে যে কোন অতিকায় জীব হয়ত তার মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে যাতায়াত করছে। মোট কথা, আমার মনে একটা তীব্র কৌতূহল জেগে উঠেছে। অ্যালারটনদের আমি এখনও কিছু বলিনি, কারণ এঁরাও কুসংস্কার থেকে মুক্ত নন। কিন্তু আমি নিজে আরো অনুসন্ধান করব, আর তার জন্য কিছু মোমবাতিও কিনে রেখেছি।
আজ সকালে গ্যাপের কাছাকাছি ঝোপের আশেপাশে কিছু ভেড়ার লোম পড়ে থাকতে দেখলাম। একটা লোমের গোছায় দেখি রক্ত লেগে রয়েছে। বেশ বুঝতে পারি যে পাথুরে জায়গায় চ’রে বেড়ালে ভেড়াগুলো আপনা থেকেই জখম হতে পারে, কিন্তু তাও হঠাৎ ওই লালের ছোপ চোখে পড়াতে কেমন জানি চমকে উঠলাম। রোমানদের কারুকার্যে শোভিত গহ্বরের ওই প্রবেশদ্বার মনের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্কের সঞ্চার করল। গহ্বরের অন্ধকারের ভেতর থেকে যেন আদ্যিকালের একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে। সত্যিই কি কোন নাম-না-জানা প্রাণী ওই অন্ধকারের মধ্যে বাস করে? সুস্থ অবস্থায় হয়ত এসব চিন্তা মাথায় আসত না। অসুখে মানুষের স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তাই তার মনে নানান অসম্ভব কল্পনা দানা বাঁধতে পারে।
এই সব ভীতিজনক চিন্তা আমার সঙ্কল্পকে শিথিল করে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম, গহ্বরের রহস্য রহস্যই থাক, এ নিয়ে আর মাথা ঘামাবো না। কিন্তু আজ রাত্রে আবার নতুন করে উৎসাহ জেগে উঠেছে, আর মনেও অনেকটা জোর পাচ্ছি। আশা করি কাল এ ব্যাপারে আরো কিছুদূর অগ্রসর হতে পারব।
এপ্রিল ২২
আমি যথাসাধ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কালকের অদ্ভুত অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। কাল যখন আমি ব্লু-জন গ্যাপের উদ্দেশে রওনা দিই, তখন বিকেল। বলতে দ্বিধা নেই, সেখানে পৌঁছে গহ্বরের দুর্ভেদ্য অন্ধকারের দিকে চাইতেই আবার যেন সেই আশঙ্কার ভাবটা আমার মনে জেগে উঠল। মনে হল, একা না এসে একজন সঙ্গী আনা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হত। যাই হোক্, শেষ পর্যন্ত মনে সাহস ফিরিয়ে এনে মোমবাতি জ্বেলে কাঁটা ঝোপের জঙ্গল ভেদ করে গহ্বরের ভিতর ঢুকলাম।
আল্গা পাথরে ঢাকা জমির উপর দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নামার পর একটা রাস্তা পেলাম যেটা একেবারে পাহাড় ভেদ করে সোজা সামনের দিকে চলে গেছে। যদিও আমি জিওলজিস্ট নই, তবু এটুকু বুঝতে পারলাম যে এ পাথর লাইমস্টোনের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত জাতের কোন পাথর, কারণ এর গায়ে প্রাচীন শাবলের দাগ রয়েছে। দেখলে মনে হয় যেন এই সবেমাত্র খোঁড়া হয়েছে। আমি কোনমতে হোঁচট খেতে খেতে এই প্রাচীন পাথরের সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম। আমার হাতের মোমবাতি আমাকে ঘিরে একটা ক্ষুদ্র আলোর গণ্ডী রচনা করেছে। তার ফলে সামনের অন্ধকারটা যেন আরো দুর্ভেদ্য ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অবশেষে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখি সেটা গিয়ে পড়েছে একটা বিশাল নোনা-ধরা পাথরের গহ্বরে, যার ছাত থেকে ঝুলে আছে চুনে ঢাকা অসংখ্য লম্বালম্বা আইসিক্লূ। আবছা আলোয় আরো লক্ষ করলাম যে গহ্বরের দেওয়াল ভেদ করে চারিদিক দিয়ে আরো অনেকগুলো জলে-ক্ষয়ে-যাওয়া রাস্তা এঁকেবেঁকে কোথায় জানি গিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো এগোব না ফিরে যাব তাই ভাবছি, এমন সময় আমার পায়ের কাছে একটা জিনিস প্রবলভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
গহ্বরের মেঝের অধিকাংশটাই হয় পাথর না হয় চুণের আবরণে ঢাকা; কিন্তু একটা জায়গায় বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে ছাত থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে কাদা হয়ে আছে। সেই কাদার ঠিক মাঝখানে দেখলাম একটা প্রকাণ্ড ছাপ, অস্পষ্ট অথচ গভীর। উপর থেকে পাথরের চাঁই পড়লে যেরকম হয় অনেকটা সেই রকম। কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে কোন আল্গা পাথর বা এমন কিছু লক্ষ্য করলাম না, যাকে ওই ছাপের জন্য দায়ী করা চলে। অথচ কোন পরিচিত জন্তুর পায়ের এত বড় ছাপ পড়া সম্ভব নয়। আর জন্তুই যদি হয়, তাহলে মাত্র একটা পায়ের ছাপ কেন? যতখানি জায়গা জুড়ে কাদা হয়েছে, কোন চেনা জন্তু অন্তত আরেকটা ছাপ না ফেলে অতখানি জায়গা পেরোতে পারে না। যাই হোক্, আমি ওই আশ্চর্য ছাপটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে, চারিদিকে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম আমার বুকের ভিতরে একটা দুরু দুরু কাঁপুনি শুরু হয়েছে, আর তার সঙ্গে আমার হাতের মোমবাতিটাও কিছুতেই স্থির রাখতে পারছি না।
অবশেষে নিজের মনকে বোঝালাম যে অত বড় ছাপ যখন কোন পরিচিত জানোয়ারের হতে পারে না—এমন কি হাতিরও নয়, তখন এ ধরনের অমুলক কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আরো এগোনর আগে আমি একবার যে সুড়ঙ্গটা দিয়ে গহ্বরে এসে পৌঁছেছি, তার মুখের চেহারাটা ভালো করে দেখে চিনে রাখলাম। এ কাজটা খুবই দরকারী, কারণ এটা ছাড়া আরো অনেকগুলো রাস্তা গহ্বর থেকে বেরিয়েছে। কোথায় ফিরতে হবে সেটা জেনে নিয়ে, অবশিষ্ট মোমবাতি ও দেশলাই-এর কাঠিগুলো একবার পরীক্ষা করে, আমি অসমতল পাথরের উপর দিয়ে গহ্বরের ভিতর এগিয়ে চললাম।
রওনা হবার কয়েকমুহুর্তের মধ্যেই আচমকা এক চরম বিপদের সামনে পড়তে হল। আমার সামনে দিয়েই বয়ে চলেছিল প্রায় বিশ ফুট চওড়া একটা নালা। সেটাকে পা না ভিজিয়ে টপ্কে পার হওয়া যায় কোনখান দিয়ে সেটা দেখবার জন্য আমি জলের ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি, এমন সময় নালার উপর একটা পাথরের ঢিপি চোখে পড়ল। আন্দাজে মনে হল এক লাফে সেই টিপিটার উপর পৌঁছান যায়। কিন্তু পাথরের তলার দিকটা জলে ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে সেটার উপর লাফ দিয়ে পড়তেই পাথরটা কাত হয়ে আমায় ফেলে দিল একেবারে বরফের মত ঠাণ্ডা নালার জলে। মোমবাতিটা নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গেই, আর আমি ঘুটঘুটে অন্ধকারে জলের মধ্যে পড়ে অসহায়ভাবে এদিক ওদিক হাতড়াতে লাগলাম।
শেষটায় কোনরকমে দাঁড়িয়ে উঠে নিজের গোঁয়ার্তুমির কথা ভেবে ভয়ের চেয়ে হাসিই পেল বেশি। জ্বলন্ত মোমবাতিটা অবশ্যই জলে পড়ে খোয়া গেছে, কিন্তু আমার পকেটে রয়েছে আরো দুটো, কাজেই চিন্তা নেই। একটা মোমবাতি বার করে সেটা জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম বিপদটা কোথায় : জলে পড়ার ফলে আমার দেশলাই-এর বাক্সটা ভিজে একেবারে সপ্সপে হয়ে গিয়েছে, ফলে সেটাতে আর কোনই কাজ হবে না।
এবার সত্যি করেই আমার রক্ত হিম হয়ে এলো। অন্ধকারের নমুনাটাও এবার বেশ বুঝতে পারলাম। চারিদিক থেকে সে অন্ধকার যেন আমায় ঘিরে চেপে ধরেছে; হাত দিয়ে যেন সে অন্ধকারের ঘনত্ব অনুভব করা যায়। আমি কোনরকমে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। গহ্বরের কোনদিকে কী আছে সেটা প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে চেষ্টাও বৃথা—কারণ চিনে রাখার মত যা কিছু দেখে রেখেছিলাম, তা সবই দেয়ালের উপর দিকে—সুতরাং মেঝে হাতড়ে কোন ফলই হবে না। তাও, হয়ত দেয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে সাবধানে এগোলে পর আবার রোমান সুড়ঙ্গর মুখটায় পৌঁছন যেতে পারে, এই মনে করে আমি এক পা দু পা ক’রে দেয়ালের দিক আন্দাজ করে এগোতে লাগলাম। অচিরেই বুঝতে পারলাম এ চেষ্টায় কোন ফল হবে না। ওই বেয়াড়া অন্ধকারে দশ বারো পা হাঁটার পরেই বুঝলাম যে এ অবস্থায় দিক্বিদিক্জ্ঞান বজায় রাখা অসম্ভব। নালার কুলকুল শব্দ থেকে অবশ্য বুঝতে পারছিলাম সেটা কোনখান দিয়ে বইছে—কিন্তু সেটা থেকে সামান্য দূরে গেলেই নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে হচ্ছিল। বুঝলাম এ অবস্থায় গহ্বর থেকে বেরোনর কোন উপায় নেই।
আমি আবার সেই পাথরটার উপর বসে আমার শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধে ভাবতে আরম্ভ করলাম। আমি যে ব্লু-জন গহ্বরে অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল সেকথা আমি কাউকে বলিনি। সুতরাং আমি হারিয়ে গেলেও আমাকে খুঁজতে কোন সার্চপার্টি যে এদিকে আসবে এমন কোন আশা নেই। একমাত্র নিজের উপস্থিত বুদ্ধি ছাড়া আমার আর কোন অবলম্বন নেই। মুক্তির উপায় যেটা রয়েছে, সেটা হল কোনো একটা পন্থা বার করে দেশলাইগুলোকে শুকিয়ে নেওয়া। আমি যখন জলে পড়েছিলাম, তখন আমার শরীরের একটা দিকই ভিজেছিল। বাঁ দিকের কাঁধটা জলের উপরে ছিল। আমি দেশলাইয়ের বাক্সটা বার করে সেটাকে আমার বাঁ বগলের তলায় চেপে বসে রইলাম। শরীরের উত্তাপ সেটাকে শুকোনর কাজে নিশ্চয়ই কিছুটা সাহায্য করবে। তবে কমপক্ষে ঘণ্টাখানেকের আগে মোমবাতি জ্বালানোর কোন সম্ভাবনা নেই—এবং এই ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
আসবার সময় কিছু বিস্কুট পকেটে পুরে এনেছিলাম, তারই একটা মুখে পুরে চিবোতে লাগলাম। বিস্কুটের শুক্নো ভাবটা কাটানোর জন্য যে নালায় আমার পতন হয়েছিল, তারই খানিকটা জল আঁজলা করে তুলে মুখে ঢেলে দিলাম।
খাওয়া শেষ হলে পর নিজের শরীরটাকে ঢিপির উপর একটু এদিক ওদিক নেড়ে ঠেস দেওয়ার একটা জায়গা বার করে, পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। গহ্বরের স্যাঁৎস্যাঁতে ঠাণ্ডাটা বেশ তীব্র ভাবেই অনুভব করছিলাম, কিন্তু মনকে বোঝালাম যে আধুনিক চিকিৎসকদের মতে আমার যে রোগ, তাতে জানালা খুলে শোওয়া, এবং শীতগ্ৰীষ্ম নির্বিশেষে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ—এ দুটোয় কোনটাই নিষিদ্ধ নয়। ক্রমে গহ্বরের দুর্ভেদ্য অন্ধকার ও নালার একঘেঁয়ে কুলকুলুনি আমায় তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলল।
কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। ঘণ্টাখানেক কিম্বা তারও হয়ত কিছু বেশি হবে। এমন সময় হঠাৎ আমাকে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে ঢিপির উপর সোজা হয়ে উঠে বসতে হল। আমার কানে একটা শব্দ এসেছে সেটা নালার শব্দর চেয়ে একেবারে আলাদা। শব্দটা এখন আর নেই, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি এখনো আমার কানে বাজছে। এটা কি মানুষের পায়ের শব্দ? আমাকে খুঁজতে এসেছে কি কোন দল? কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে ত তারা আমার নাম ধরে ডাকবে। যা শুনেছি তা ত মানুষের গলার শব্দ নয়। আমি দুরু দুরু বক্ষে দম প্রায় বন্ধ করে বসে রইলাম। ওই যে—আবার সেই শব্দ! ওই—আবার! এবার আর থামা নেই। একটানা শব্দ আসছে—কোন জানোয়ারের পদক্ষেপের শব্দ—দুম্ দুম্ দুম্ দুম্! কী বিশাল এই পদধ্বনি! জানোয়ার যে আয়তনে বিরাট তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে হয় পায়ের তেলোগুলো নরম হওয়ার ফলে শব্দটা খানিকটা চাপা। এই অন্ধকারেও সেই পদক্ষেপে বিন্দুমাত্র ইতস্ততভাব নেই। আর এতেও কোন সন্দেহ নেই যে সেটা আমার দিকেই আসছে।
পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে এলো। কোনো অজ্ঞাত প্রাণী অন্ধকারের বাধা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে আসছে। আমি পাথরের উপর সটান শুয়ে পড়ে নিজেকে যথাসম্ভব অদৃশ্য করে ফেলার চেষ্টা করলাম। শব্দটা এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর শুরু হল একটা সপাৎ সপাৎ আওয়াজ। জন্তুটা নালার জল খাচ্ছে। তারপর একটুক্ষণ চুপচাপ, কেবল মধ্যে মধ্যে প্রচণ্ড নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ, ও নাক টেনে গন্ধ শোঁকার শব্দ। জন্তুটা কি আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে গেল নাকি? আমার নিজের নাক তখন একটা বিশ্রী বুনো গন্ধে ভরে আছে। তারপর আবার শুরু হল পায়ের শব্দ, আর সেটা যেন নালার এদিকে—আমার কাছেই। আমার হাত কয়েকের মধ্যে কিছু আলগা পাথর খড়বড় করে উঠল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে পাথরের উপর ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। তারপর শুনলাম পায়ের শব্দ পিছিয়ে যাচ্ছে। জলের ছপ্ছপানি শুনে বুঝলাম জন্তুটা নালা পেরিয়ে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে। ক্রমে যেদিক দিয়ে শব্দটা এসেছিল সেই দিকেই আবার সেটা মিলিয়ে গেল।
আমি বেশ কিছুক্ষণ পাথরের উপর পড়ে রইলাম। ভয়ে নড়বার শক্তি ছিল না। শব্দটার কথা বারবার মনে পড়তে লাগল, আর আর্মিটেজের আতঙ্কের কথা, আর নরম কাদার উপর সেই বিরাট পায়ের ছাপের কথা।
এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে পাহাড়ের এই গহ্বরে কোন এক নাম-না-জানা, ভয়াবহ, অতিকায় প্রাণী বাস করছে। সেটা যে কেমন দেখতে তা এখনো অনুমান করতে পারিনি, তবে এটুকু জানি যে সেটা আয়তনে বিরাট এবং আশ্চর্য দ্রুতগতি। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে এমন জানোয়ার অসম্ভব, কিন্তু আমার আজকের অভিজ্ঞতা এর বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই দুই-এর দ্বন্দ্ব আমার মনকে অস্থির করে তুলল। অবশেষে মনকে বোঝালাম যে আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছি। আমার রুগ্ণ অবস্থাই আমার মনে এক কাল্পনিক বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, এবার যে ঘটনাটা ঘটল তাতে আমার মনে আর সন্দেহের কোন কারণই রইল না।
আমার দেশলাই এতক্ষণে শুকিয়েছে মনে করে আমি বগল থেকে সেটা বার করে একটা কাঠি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। গহ্বরের ফাটলে হাত ঢুকিয়ে বাক্সের গায়ে কাঠি ঘষতেই সেটা ফস্ করে জ্বলে উঠল। মোমবাতি জ্বালিয়ে, যেদিকে জানোয়ার গেছে সেদিকে একবার ভয়ে ভয়ে দেখে নিয়ে রোম্যান সুড়ঙ্গের দিকে রওনা দিলাম। যাবার পথে জমির নরম অংশটাতে চোখ পড়তেই দেখলাম, আগের ছাপের মত আরো তিনটে টাটকা ছাপ সেখানে পড়েছে, সেইরকমই গভীর আর সেইরকমই বিরাট। এ-দৃশ্যে আবার নতুন করে যেন ভয়ে আমার হৃৎকম্প শুরু হল। আমি মোমবাতির শিখাটাকে হাত দিয়ে আড়াল করে প্রাণপণে সুড়ঙ্গপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে এক নিশ্বাসে দরজার মুখ দিয়ে বেরিয়ে কাঁটা ঝোপ ভেদ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরের ঘাসের উপর হুমড়ি দিয়ে পড়লাম। মাথার উপর আকাশে তখন অজস্র তারা ঝলমল করছে।
বাড়ি পৌঁছলাম রাত তিনটায়। আজ এখন পর্যন্ত আমার স্নায়ুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আতঙ্ক ও উত্তেজনার শিহরণ রয়েছে। কিন্তু এখনো আমি কাউকে কিছু বলিনি। এ-ব্যাপারে খুব সাবধানে এগোতে হবে। এখানকার সরল গ্রাম্য অধিবাসীরা, বা নিরীহ অ্যালারটন ভগিনীদ্বয়, আমার এ ঘটনা শুনলে কী মনে করবে জানি না। আমার এখন এমন কারুর কাছে যাওয়া উচিত যাকে ঘটনাটা বললে সে একটা উপায় বাতলাতে পারবে।
এপ্রিল ২৫
গহ্বরের অভিজ্ঞতার পর দুদিন আমি শয্যাশায়ী ছিলাম। গত ক’দিনের মধ্যে আমার এমন আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে যাতে অন্যটার চেয়ে কিছু কম ধাক্কা খাইনি। আগেই বলেছি, আমি এমন একজনের অনুসন্ধান করছিলাম যে আমাকে কিছুটা পরামর্শ দিতে পারবে। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে মার্ক জনসন বলে এক ডাক্তার থাকেন। প্রফেসর স্যাণ্ডারসন এই ডাক্তারটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে একটা চিঠি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি একটু সুস্থ হয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললাম। তিনি মনোযোগ সহকারে সব কিছু শোনার পর আমার স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া ও আমার চোখের মণি খুব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখা শেষ হলে পর তিনি কোনো আলোচনরা দিকে না গিয়ে সোজাসুজি বললেন যে আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তাঁর আওতার বাইরে। তবে কাস্লটনে মিঃ পিক্টন বলে এক ভদ্রলোক থাকেন, তাঁর সঙ্গে দেখা ক’রে আমার ঘটনাটা তাঁকে আদ্যোপান্ত জানানো দরকার। তিনিই নাকি একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।
অগত্যা, স্টেশন থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট্ট শহরে গিয়ে হাজির হতে হল। শহরের এক প্রান্তে একটা সম্ভ্রান্ত অট্টালিকার সামনে গেটের গায়ে পিতলের ফলকে পিক্টনের নাম দেখে বুঝলাম তিনি এখানকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। দরজায় বেল-টা টেপার সময় মনে কেমন জানি একটা খট্কা লাগল। কাছাকাছি একটা দোকানে গিয়ে মালিককে পিক্টন সাহেব সম্বন্ধে জিগ্যেস করায় তিনি এক গাল হেসে বললেন, ‘সে কি, জানেন না? উনি যে এ-তল্লাটে সবচেয়ে নামকরা মাথার-ব্যামোর ডাক্তার! ওই ত ওর পাগলা গারদ।’ বলা বাহুল্য আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে না থেকে সোজা আমার গ্রামে ফিরে এলাম। চুলোয় যাক্ এই সব পণ্ডিত লোক। এঁরা যেন এদের জ্ঞানের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরে কোন কিছুই স্বীকার করতে চান না। অবিশ্যি, এখন ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে পারছি যে আমি আর্মিটেজের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, জনসনও আমার সঙ্গে ঠিক সেই একই ব্যবহার করেছেন।
এপ্রিল ২৭
ছাত্রাবস্থায় সাহস ও উদ্যমের জন্য আমার বেশ খ্যাতি ছিল। একবার কোল্টব্রিজের এক হানাবাড়িতে রাত কাটাবার কথা উঠলে আমিই প্রথম এগিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। তাহলে কি বয়স বাড়ার ফলেই আমার সাহস কমেছে, নাকি আমার রোগই এর কারণ। গহ্বর আর তার অধিবাসীর কথা ভাবলে এখনো আমার মনে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। এ অবস্থায় কী করা যায়, এ প্রশ্ন প্রতি মুহুর্তেই আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। কাউকে কিছু না বলে যদি চুপচাপ বসে থাকি তাহলে হয়ত গহ্বরের রহস্য চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে। আবার যদি সকলের কাছে সব কিছু প্রকাশ করে ফেলি, তাহলে হয়ত সারা গ্রাম জুড়ে একেবারে আতঙ্কের বন্যা বয়ে যাবে। আর না হয় ত এরা আমাকে পাগল ভেবে সেই গারদেই চালান দেবে। সবচেয়ে ভালো পন্থা বোধহয় আরো কিছু দিন অপেক্ষা ক’রে আরো ভালোভাবে আঁটঘাট বেঁধে আরেকবার গহ্বরে অভিযান। আমি এর মধ্যেই কাস্লটনে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে এনেছি। তার মধ্যে প্রধান হল একটা অ্যাসিটিলিন ল্যাম্প ও একটা দোনলা বন্দুক। দ্বিতীয়টা অবশ্য ধার করতে হয়েছে, কিন্তু এক ডজন ভালো কার্তুজ আমি নিজে পয়সা খরচ করে কিনেছি। যা আছে তাতে একটা আস্ত গণ্ডার অনায়াসে ধরাশায়ী করা চলে। মোট কথা, আমার গুহাবাসী বন্ধুটির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমি প্রস্তুত। কিছুটা স্বাস্থ্যোন্নতি ও আরো খানিকটা মনের জোর পেলেই আমি যুদ্ধং দেহি বলে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু আপাততঃ, এই জানোয়ারটি ঠিক কোন জাতের সে প্রশ্নে আমার ঘুম নষ্ট হতে চলেছে। একের পর এক নানান জবাব আমি নিজেই বাতিল করে দিয়েছি। ভেবে ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না। এটা যে একটা রক্তমাংসের জ্যান্ত জানোয়ার সেটা ত তার চীৎকার আর তার পায়ের ছাপ থেকেই প্রমাণ হয়। তাহলে কি হিংস্র ড্রাগন জাতীয় যে-সব প্রাণীর কথা আমরা রূপকথায় পড়েছি, সেগুলো আসলে কাল্পনিক নয়? তাদের খানিকটা অংশ কি আসলে সত্যি, এবং সেই সত্যটুকু প্রমাণ করার ভার কি শেষটায় আমার উপর পড়ল?
৩রা মে
কদিন যাবৎ এখানের বসন্তকালের খামখেয়ালি আবহাওয়াটা আমাকে বেশ কাবু করেছে। আর এই কদিনের ভিতরই এমন কিছু উদ্ভট ঘটনা ঘটেছে যার তাৎপর্য কেবল আমিই বুঝি। রাতগুলো মেঘলা হওয়ায় তিনদিন চাঁদের আলো ছিল না। এর আগে ঠিক এমন রাত্রেই একটি ভেড়া উধাও হয়েছে। গত কয়েক রাত্রেও ভেড়া লোপ পেয়েছে—অ্যালারটনদের দু’টি, ক্যাটওয়াকের বুড়ো পিয়ার্সনের একটি ও মিসেস্ মুলটনের একটি। তিন রাত্রে চারটি ভেড়া উধাও। কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি, সেগুলোর, ফলে চতুর্দিকে নানারকম গুজব রটছে। কেউ বলে এটা ভেড়া চোরের কাজ, কেউ বলে আশেপাশে নাকি বেদেরা আস্তানা গেড়েছে—এ হল তাদেরই কীর্তি।
কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর একটা ঘটনা ঘটেছে গত কদিনের মধ্যে; আর্মিটেজ নিখোঁজ। গত বুধবার রাত্রে সে নাকি তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল; তারপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর্মিটেজের আত্মীয়স্বজন নেই, তাই তার অন্তর্ধান তেমন একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেনি। লোকে বলছে সে নাকি অনেক টাকা ধারত, তাই অন্য কোন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে—সেখান থেকে ক’দিনের মধ্যেই হয়ত তার জিনিসপত্র চেয়ে পাঠাবে। আমার নিজের কিন্তু অন্য রকম আশঙ্কা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস ভেড়া-চুরির ব্যাপারটার কোনো একটা বিহিত করতে গিয়েই সে প্রাণ হারিয়েছে। হয়ত সে ওই অজ্ঞাত জীবটির অপেক্ষায় ওত পেতে বসেছিল, আর সেটা উল্টে তাকেই আক্রমণ করে তার গহ্বরের ডেরায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। বিংশ শতব্দীতে ইংলণ্ডের মত সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনা ভাবতেও অবাক লাগে, যদিও আমার মতে এটা মোটেই অসম্ভব নয়। আর সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে কি আমার এ ব্যাপারে একটা দায়িত্ব নেই? আমি যখন এত দূরই জেনেছি, তখন আমার কর্তব্য এটার একটা প্রতিকারের চেষ্টা করা—সম্ভব হলে নিজেই। আজকের একটা ঘটনার পর আমি স্থির করেছি নিজেই এ ব্যাপারে একটা কিছু করব। সকালে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলাম। ইন্স্পেক্টর সাহেব গম্ভীর ভাবে আমার বক্তব্য একটা মোটা খাতায় তুলে নিয়ে আমাকে নমস্কার করে বিদায় দিলেন। বাইরে বেরোতে না বেরোতে শুনতে পেলাম তাঁর অট্টহাসি। বুঝতে পারলাম তিনি তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে আমার কাহিনীটা বেশ রসিয়ে পুনরাবৃত্তি করছেন।
ঠিক দেড় মাস পর আমার খাটে বালিশের উপর পিঠ দিয়ে বসে আমি আবার ডায়রি লিখছি। শরীর ও মন বিপর্যস্ত বিহ্বল হয়ে আছে। যে সংকটের সামনে পড়তে হয়েছিল, আর কোন মানুষের ভাগ্যে তেমন হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ব্লু-জন গ্যাপের বিভীষিকা চিরকালের মত বিদায় হয়েছে, জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য আমার মত রুগ্ণ ব্যক্তির পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয়েছে। এইবারে যথাসম্ভব পরিষ্কার ভাবে যা ঘটেছিল তার বিবরণ দিই।
৩রা মে-র রাতটা ছিল অন্ধকার ও মেঘাচ্ছন্ন—ঠিক যেমন-রাত্রে নাম-না-জানা জানোয়ারটা হানা দিতে বেরোয়। রাত এগারোটায় হাতে লণ্ঠন ও বন্দুক নিয়ে আমি বাড়ি থেকে রওয়ানা দিলাম। যাবার আগে টেবিলের উপর একটা কাগজে লিখে গেলাম, যে আমি যদি না ফিরি, তাহলে যেন ব্লু-জন গ্যাপের আশেপাশে আমার অনুসন্ধান করা হয়। রোম্যান সুড়ঙ্গের মুখটাতে পৌঁছে, কাছাকাছি একটা পাথরের ঢিপি বেছে নিয়ে লণ্ঠনের ঢাকনাটা বন্ধ করে হাতে বন্দুক নিয়ে টিপিটার উপর ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।
এই বসে থাকার যেন আর শেষ নেই। উপত্যকার চারিদিকে টিমটিম করছে কৃষকদের বাড়ির বাতিগুলো। দূর থেকে ঘণ্টায় ঘন্টায় ভেসে আসছে চ্যাপ্ল্-লি-ডেল গির্জার ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ। আশেপাশে অন্য লোকজন যে রয়েছে, তার চিহ্নগুলো যেন আমার একাকিত্বকে আরো করুণ ও দুর্বিষহ করে তুলছিল। এক এক সময় মনে হচ্ছিল আমার অভিযানে জলাঞ্জলি দিয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু মানুষের মনে আত্মসম্মান বোধটা এত গভীর ও বদ্ধমূল, যে একটা কোন সঙ্কল্প নিয়ে একবার অগ্রসর হলে মাঝপথে ফিরে আসা ভারী মুশকিল।
সেই কারণেই সেদিন আমি গহ্বরের মুখ থেকে ফিরে আসতে পারিনি। আর যাই হোক্, আমি কাপুরুষ এ অপবাদ আমাকে কেউ দিতে পারবে না।
দূরের গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজল। তারপর একটা, তারপর দুটো। এই সময়টা অন্ধকার সবচেয়ে গভীর। তারাহীন আকাশের নীচ দিয়ে মেঘ ভেসে চলেছে। পাহাড়ের ফাটলে কোথায় যেন একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। এ ছাড়া এক শুধু ঝিরঝিরে হাওয়ার শব্দ। আর সব চুপ। এমন সময় হঠাৎ কানে এলো এক পরিচিত আওয়াজ—দুম্ দুম্ দুম্ দুম্ দুম্ দুম্—আর তার সঙ্গে পায়ের ধাক্কায় পাথর গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। ক্রমে এদিকে আসছে শব্দটা। কাছে—আরো কাছে। এবার সুড়ঙ্গের মুখের ঝোপঝাড় খচমচ করে উঠল। পরমুহূর্তেই আবছা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে সৃষ্টিছাড়া নাম না জানা অতিকায় কী যেন একটা প্রায় নিঃশব্দ দ্রুতপদে গুহা থেকে বেরিয়ে আমার ঠিক পাশ দিয়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভয়ে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। বুঝতে পারলাম, কতক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও, আমার মনটা এই অপ্রত্যাশিত ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার জন্য মোটেও প্রস্তুতি ছিল না।
এবার আমার সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে জানোয়ারটার ফেরার অপেক্ষায় বসে রইলাম। গহ্বরের বাইরের শান্তিময় নিরুদ্বেগ পরিবেশ থেকে বোঝবার কোন উপায় নেই যে এক বিপুল বিদ্ঘুটে প্রাণী এই সবেমাত্র সেখানে হানা দিতে বেরিয়েছে। সেটা কতদূর যাবে, কী মতলবে গেছে, কখন ফিরবে, সে সব জানার কোন উপায় নেই। পাথরের উপর বন্দুকের নলটাকে বসিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যে দ্বিতীয়বার আর সংকটমুহূর্তে সাহস হারাব না। যত বড় দুষমনই হোক্ না কেন, এবার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
সজাগ থাকা সত্ত্বেও জানোয়ারটা যে কখন ফিরে এলো সেটা টেরই পাইনি। হঠাৎ সামনে চেয়ে দেখি—আবার সেই অতিকায় জানোয়ার—ঘাসের উপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে ব্লু-জন সুড়ঙ্গের দিকে আসছে। আবার অনুভব করলাম বন্দুকের ঘোড়ার উপর রাখা আমার ডান হাতের তর্জনীটা অবশ হয়ে আসছে। প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনরকমে আমার জড় ভাবটাকে কাটিয়ে উঠলাম। ঝোপঝাড় ভেদ করে জানোয়ারটা গুহার ভিতর ঢুকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছে, এমন সময় আমি বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলাম। বারুদের ঝলসানিতে মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম এক প্রকাণ্ড, লোমশ ছাই রংয়ের জানোয়ার, নীচের দিকে রংটা ফিকে হয়ে এসেছে—বেঁটে বেঁটে বাঁকানো পায়ের উপর তার আলিসান শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এক ঝলকের দেখা—আর তার পরেই শুনলাম খড়বড় শব্দ। আল্গা পাথরের উপর দিয়ে নেমে জানোয়ারটা চলেছে তার গর্তের দিকে। আমার মাথায় হঠাৎ যেন খুন চাপল। ভয়ডর সব দূর করে দিয়ে এক লাফে পাথরের উপর থেকে নেমে বন্দুক ও লণ্ঠন হাতে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে ছুটে চললাম জানোয়ারটার উদ্দেশে।
আমার লণ্ঠনের উজ্জ্বল রশ্মি সামনের অন্ধকার ভেদ করে চলেছে। এ সেই দু’সপ্তাহ আগের টিমটিমে মোমবাতির আলো নয়। কিছুটা পথ দৌড়ানোর পরই জানোয়াটাকে দেখতে পেলাম—সুড়ঙ্গের এপাশ ওপাশ জুড়ে থপ্থপিয়ে এগিয়ে চলেছে, তার পায়ের লম্বা ও রুক্ষ লোম চলার সঙ্গে সঙ্গে দুলছে। লোম দেখে যদিও ভেড়ার কথা মনে হয়, আয়তনে জানোয়ারটা সবচেয়ে বড় হাতির চেয়েও বেশ খানিকটা বড় আর যত লম্বা, ততই যেন চওড়া। পাহাড়ের সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে এই বিরাট বীভৎস জানোয়ারের পিছনে ধাওয়া করার সাহস আমি কোথা থেকে পেলাম জানি না। আদিম শিকারের নেশা যখন মানুষকে পেয়ে বসে, আর সেই শিকার যদি চোখের সামনে পালায়, তাহলে মানুষ যেন দিগ্বিদিগ্ জ্ঞানশূন্য হয়ে তার পিছনে ছোটে। দোনালা বন্দুক হাতে তাই আমি ছুটে চলেছি এই দানবের পিছনে।
জানোয়ারটা যে রীতিমত দ্রুতগতি সেটা আমি আগে লক্ষ্য করেছিলাম। এবারে বুঝলাম যে তার আরেকটি মারাত্মক গুণ আছে…সেটা হল শয়তানি বুদ্ধি। হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল সে বুঝি প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। সে যে আবার উল্টোমুখে ঘুরে রুখে দাঁড়াতে পারে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আগেই বলেছি সুড়ঙ্গটা গিয়ে পড়েছে একটা বিরাট গহ্বরে। কিছুক্ষণ দৌড়াবার পর সেই গহ্বরটাতে পৌঁছতে হঠাৎ জানোয়ারটা থমকে থেমে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
লণ্ঠনের সাদা আলোতে তার যা চেহারা দেখলাম তা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। ভাল্লুকের মত হিংস্র ভঙ্গীতে সামনের দু’পা শূন্যে তুলে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতপ্রমাণ জানোয়ারটা, আয়তনে ভাল্লুকের দশগুণ, উঁচানো দুই পায়ের থাবায় লম্বা তীক্ষ্ণ বাঁকানো নখ, বীভৎস বিকৃত হাঁ করা লাল মুখে ধারালো দাঁতের সারি। ভাল্লুকের সঙ্গে পার্থক্য কেবল একটা ব্যাপারে—যে ব্যাপারে এটার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোন জানোয়ারের কোন মিল নেই—সেটা হল জানোয়ারটার ঠিক্রে বেরিয়ে আসা, দৃষ্টিহীন, মণিহীন, জ্বলন্ত বলের মত দুটো চোখ। কী দেখলাম সেটা ভালো করে বোঝার আগেই জানোয়ারটা থাবা উঁচিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর পরে আমার হাত থেকে লণ্ঠনটা ছিট্কে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল, তখন দেখি আমি অ্যালারটনদের বাড়িতে আমার খাটের উপর শুয়ে আছি। ব্লু-জন গ্যাপের ঘটনাটার পর দুদিন কেটে গেছে। মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে, বাঁ পায়ের হাড় ও পাঁজরের দুটো হাড় ভাঙা অবস্থায় আমি সারারাত ওই গুহার মধ্যে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে আমার লেখা চিঠি পেয়ে জনা দশেক চাষা দল করে গিয়ে আমায় খুঁজে বার করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই থেকে সমানে নাকি আমি প্রলাপ বকেছি। জানোয়ার জাতীয় কিছুই নাকি এদের চোখে পড়েনি। আমার বন্দুকের গুলি যে কোন প্রাণীকে জখম করেছে তার প্রমাণ হিসাবে কোন রক্তের চিহ্নও নাকি এরা দেখতে পায়নি। আমার নিজের অবস্থা, এবং জমিতে কিছু অস্পষ্ট দাগ ছাড়া আমার কাহিনীর সত্যতা প্রমাণ করার মত কিছুই নাকি পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার পর দেড়মাস কেটে গেছে। আমি এখন বাইরের বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছি। আমার ঠিক সামনেই খাড়া পাহাড়—তার পাংশুটে পাথরের গায়ে ওই যে দেখা যাচ্ছে ব্লু-জন সুড়ঙ্গের মুখ। কিন্তু ওটা আর আমার মনে ভীতিসঞ্চার করে না। আর কোনদিনও ওই সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে কোন ভয়ঙ্কর প্রাণী মনুষ্যজগতে হানা দিতে বেরোবে না। বিজ্ঞানবিদ্ অথবা বিদ্যাদিগগজ অনেক সম্ভ্রান্ত বাবুরা হয়ত আমার কাহিনীকে হেসে উড়িয়ে দেবেন—কিন্তু এখানকার দরিদ্র সরল গ্রামবাসীরা আমার কথা এক মুহূর্তের জন্যেও অবিশ্বাস করেনি। এ সম্পর্কে কাস্লটন কুরিয়ার পত্রিকার মন্তব্য তুলে দিলাম—
‘আমাদের পত্রিকার, অথবা ম্যাট্লক, বাক্সটন ইত্যাদি অঞ্চলের যে সব পত্রিকার সংবাদদাতা উক্ত ঘটনার তদন্ত করিতে আসিয়াছেন, তাহাদের কাহারও পক্ষে গহ্বরে প্রবেশ করিয়া ডাঃ জেমস হার্ডকাস্লের বিচিত্র কাহিনীর সত্যমিথ্যা বিচার করিবার কোন উপায় ছিল না। উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কী করণীয় তাহা স্থানীয় অধিবাসীগণ নিজেরাই স্থির করিয়া প্রত্যেকেই গুহার প্রবেশদ্বারটি প্রস্তর দ্বারা বন্ধ করিতে তৎপর হইয়াছিল। গহ্বরের সম্মুখস্থ ঢালু রাস্তা দিয়া বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড গড়াইয়া লইয়া সুড়ঙ্গ দ্বারটি তাহারা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটে এই ভাবেই। স্থানীয় বাসিন্দাগণ ঘটনাটি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। কেহ কেহ বলেন, রুগ্ণ অবস্থাই ডাঃ হার্ডকাস্লের মস্তিষ্কবিকৃতি ও তজ্জনিত উদ্ভট কল্পনাদির কারণ। ইহাদের মতে, কোন ভ্রান্ত অথচ দৃঢ় বিশ্বাস তাঁহাকে গহ্বরে প্রবেশ করিতে বাধ্য করিয়াছিল, এবং গহ্বরের প্রস্তর ভূমিতে পদস্খলন হেতু তিনি আহত হইয়াছিলেন। গহ্বরের ভিতর যে এক অদ্ভুত জীব বাস করে এরূপ একটা জনপ্রবাদ বহুকাল হইতে এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। স্থানীয় কৃষকদিগের বিশ্বাস যে ডাঃ হার্ডকাস্লের বিবরণ ও তাঁহার দেহের ক্ষত এই প্রবাদকে বাস্তবে পরিণত করিয়াছে। উক্ত ঘটনা সম্পর্কে ইহার অধিক কিছু মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ইহার সমর্থন আদৌ সম্ভবপর বলিয়া আমরা মনে করি না।’
‘কুরিয়া’র পত্রিকা এই মন্তব্যটি প্রকাশ করার আগে একবার আমার সঙ্গে আলাপ করলে বুদ্ধিমানের কাজ করত। আমি অনেক ভেবে ঘটনাটার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ অনুমান ক’রে এর অবিশ্বাস্যতা খানিকটা দূর করেছি। অন্তত আমার নিজের অভিজ্ঞতার একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসাবে আমি এখানে সেটা পেশ করছি।
আমার মতে (যে মত আমি ঘটনাটা ঘটবার আগেই ডায়রিতে ইঙ্গিত করেছি) ইংলণ্ডের এই সব অঞ্চলে ভূগর্ভে বিস্তীর্ণ জলাশয় রয়েছে। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বাইরের জলস্রোত ভিতরে ঢুকেই এই সব জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। জলাশয় থাকলেই বাষ্পের উদ্ভব হয়, এবং বাষ্প থেকে বৃষ্টি ও বৃষ্টি থেকে উদ্ভিদের জন্ম সম্ভব। পৃথিবীর আদিযুগে হয়ত বা এই ভূগর্ভজগতের সঙ্গে বাইরের জগতের একটা যোগাযোগ ছিল, এবং সেই অবস্থায় হয়ত বাইরের জগতের গাছপালার কিছু বীজ ও তার সঙ্গে কোন কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী এই ভূগর্ভজগতে এসে পড়েছিল। এই সব প্রাণীদেরই একটির বংশধর হয়ত এই জানোয়ার—যাকে দেখে মনে হয় আদিম ভালুকের এক বর্ধিত সংস্করণ। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হয়ত এই ভূগর্ভজগৎ আমাদের পরিচিত জগতের পাশাপাশি একই সঙ্গে অবস্থান করেছে। রোম্যান সুড়ঙ্গটি খোঁড়ার সময় হয়ত এই ভূগর্ভজগতের কোনো প্রাণী বাইরের জগতের সন্ধান পায়। অন্ধকারবাসী অন্য সব প্রাণীর মতই এও দৃষ্টিশক্তিহীন জীব। অথচ অন্য সব ইন্দ্রিয় এতই সজাগ যে চোখের অভাব পূরণ হয়ে যায়। নাহলে সে ভেড়ার সন্ধান পাবে কী করে? এরা যে কেবল অন্ধকার রাত্রে চলাফেরা করে, তার কারণ বোধহয়, মণির অভাবে আলো সহ্য হয় না। আমার লণ্ঠনই হয়ত চরম সংকটের মুহুর্তে আমার প্রাণরক্ষা করেছিল। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। এসব তথ্য আমি লিখে গেলাম আপনাদের বিবেচনার জন্য। একে সমর্থন করা সম্ভব কিনা তা আপনারা বিচার করে দেখবেন। যদি মনে হয় সবটাই অবিশ্বাস্য, তাহলেও আমার কিছু বলার নেই। মূল ঘটনা আপনাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের অনেক ঊর্ধ্বে। আর আমার ব্যক্তিগত মতামতের প্রশ্ন যদি তোলেন, তাহলে বলব যে তারও আর বিশেষ কোন মূল্য নেই, কারণ আমার কাজ ফুরিয়ে এলো।
ডাক্তার জেম্স হার্ডকাস্লের ডায়রির শেষ এখানেই।