ব্রেসসায় উড়োজাহাজ

ব্রেসসায় উড়োজাহাজ

৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৯ তারিখে লা সেন্টিনেল্লা ব্রেসিয়ানা পত্রিকা আনন্দের সঙ্গে লিখছে : ‘ব্রেসসায় এত মানুষের সমাবেশ আগে আর কখনোই দেখা যায়নি, বিখ্যাত মোটরগাড়ির রেসের সময়গুলোতেও না; দর্শনার্থীরা ভিড় করেছে ভেনেসিয়া, লিগুরিয়া, পিয়েমন্তে, টোসকানা, রোম, এমনকি সেই নেপলস্ থেকেও; বিশিষ্টজনেরা এসেছেন ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা থেকে; সবাই ধাক্কাধাক্কি করছেন আমাদের স্কোয়ারগুলোতে, আমাদের হোটেলগুলোয়, আমাদের ব্যক্তিগত বাসাবাড়ির প্রতিটা বাড়তি কোনায়; সবকিছুর দাম জাঁকালোভাবে বেড়ে চলেছে; এত মানুষকে প্রদর্শনীয় মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা অপ্রতুল; এয়ারফিল্ডের উপরে অবস্থিত রেস্টুরেন্টগুলো দুহাজার মানুষকে ভালোভাবেই সেবা দিতে সক্ষম, কিন্তু এরকম হাজার হাজার মানুষ হলে তাদের করার কীই-বা থাকে; বুফেগুলো রক্ষা করার জন্য ফৌজ মোতায়েনের প্রয়োজন পড়বে; এয়ারফিল্ডের সস্তা জায়গাগুলোতে দিনভর দাঁড়িয়ে থাকছে ৫০ হাজার দর্শক।

এই খবর পড়ে আমার দুই বন্ধু ও আমার একই সঙ্গে আস্থা ও ভীতির অনুভূতি হলো। আস্থা : যেখানেই এরকম মারাত্মক ভিড় হয়, দেখা যায় সবকিছু মোটামুটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে চলতে থাকে; আর যেখানে কোনো ফাঁকা জায়গাই নেই, সেখানে জায়গা খোঁজার দরকারও পড়ে না। ভীতি : এ ধরনের সাহসী উদ্যোগ সফলভাবে আয়োজনের ইতালীয় পদ্ধতি নিয়ে ভীতি, আমাদের দেখভালের জন্য যেসব কমিটি নিয়োজিত থাকবে তাদের নিয়ে ভীতি, ট্রেন পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে ভীতি, এ ব্যাপারে সেন্টিনেল্লা এরই মধ্যে চার ঘণ্টা দেরির কথা ঘোষণা করে রেখেছে।

সব প্রত্যাশা মিথ্যা হয়ে যায়; কীভাবে যেন সব ইতালিয়ান স্মৃতিই ঘরে ফিরে আসার পর গোলমেলে হয়ে যায়; ওগুলো স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে, এগুলোর ওপর আর ভরসা রাখা যায় না।

আমাদের ট্রেন ব্রেসসা স্টেশনের অন্ধকার গহ্বরে ঢুকতেই আমরা দেখলাম মানুষজন এমনভাবে চিৎকার করছে যেন তাদের পায়ের নিচের মাটি জ্বলছে, আমরা তখনো ভাবগম্ভীরভাবে একে অন্যকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি যে, যা-ই ঘটুক না কেন একসঙ্গে দল বেঁধে থাকতে হবে। আমরা কি একধরনের বৈরিতা নিয়েই ব্রেসসায় পৌঁছলাম না?

সবাই ট্রেন থেকে নামলাম; চাকার উপরে নড়বড়ে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন একটা ভাড়া-করা ঘোড়ার গাড়ি আমাদের অর্ভ্যথনা জানাল; গাড়ির চালক মহা খোশমেজাজে আছেন; প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আমরা গিয়ে হাজির হলাম ‘প্যালেস অব দি কমিটিতে, ওখানে পৌঁছে আমাদের ভেতরকার বিদ্বেষের ভাবটা এমনভাবে দূর হয়ে গেল, যেন ওটার কোনো অস্তিত্ব আদতে ছিল না; যা যা দরকার সব বলা হলো আমাদের। যে পান্থশালায় আমাদের যেতে বলা হলো সেটা প্রথম দেখাতে লাগল যে আমরা এরকম নোংরা কিছু আগে কোনো দিন দেখিনি, কিন্তু একটু সময় যেতেই ওটা ততটা ভয়াবহ খারাপ বলে আর মনে হলো না। একটা ময়লা যা কিনা ধরুন পড়ে আছে ওখানটায়, যেটা নিয়ে আর কেউ কোনো কথা বলছে না, এমন একটা ময়লা যা কখনোই বদলায় না, যেটার কিনা শিকড় গজিয়ে গেছে, যা মানুষের জীবনকে কোনো-না-কোনোভাবে আরো দৃঢ় ও পার্থিব করে তোলে, একটা ময়লা যার ভেতর থেকে আমাদের আমন্ত্রণকর্তা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির হলেন, নিজেকে নিয়ে গর্বিত তিনি, আমাদের প্রতি বিনয়, তার কনুইগুলো বিরামহীন নড়াচড়ার মধ্যে আছে আর তার হাত দুটো (প্রতিটা আঙুল একটা করে শুভেচ্ছার বাণী) তার মুখের উপরে ফেলছে নিয়ত বদলাতে থাকা ছায়া, তিনি হাজির হলেন কোমর থেকে অনবরত কুর্নিশ করতে করতে, যে কুর্নিশটা আমরা পরে দেখেই চিনে ফেলতাম গ্যাব্রিয়েল দানুনৎসিও এয়ারপোর্টে, বিমান ওড়ার এয়ারফিল্ডে; কে আছে। যার এরকম একটা ময়লা নিয়ে কোনো আপত্তি থাকবে?

এয়ারফিল্ডটা মনটিকিয়ারিতে, মাতুয়া যাওয়ার লোকাল রেলে চাপলে ওখানে এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছানো যায়। এই লোকাল রেলওয়ে জনসাধারণের হাইওয়ের উপর নিজের জন্য একটা ট্র্যাক বানিয়ে রেখেছে, ওটার উপর দিয়ে সে তার ট্রেনগুলো চালায় পরিমিত গতিতে, বাকি যানবাহনগুলোর চাইতে জোরেও না, আস্তেও না; ট্রেনগুলো ওভাবেই চলে বাইসাইকেল চালকদের মাঝখান দিয়ে, ওরা প্রায় চোখ বুজে সাইকেলের প্যাডেল মারতে থাকে ধুলোর মধ্যে সারা প্রদেশের একেবারে বাতিল হয়ে। যাওয়া চার-চাকার ঘোড়ার গাড়িগুলোর (ওগুলোতে ওঠানো হয় যত খুশি তত লোক, তার পরও কীভাবে যে ওগুলো ওরকম জোরে ছোটে তা মাথায় আসে না) মাঝখান দিয়ে চলে ওরা, আরো চলে বিশাল আকারের মোটরগাড়িগুলোর মধ্যে দিয়েও; গাড়িগুলো দেখেই মনে হয় যেন একদম গোঁ ধরে আছে ছাড়া মাত্রই উল্টে যাবে, ওগুলোর অসংখ্য ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ কীরকম ঝটিতেই সব মিলে একটা উচ্চনাদে চিল্কারের মতো শোনায়।

কখনো কখনো মনে হয় এই শোচনীয় ট্রেনে করে বিমান-প্রদশর্নীর মাঠে পৌঁছানোর আর কোনো আশা নেই। কিন্তু আমাদের চারপাশে ট্রেনে লোকজন হো-হো করে হাসছে, আর ডান ও বাঁ দিকে প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্যরাও হাসছে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা শেষ প্ল্যাটফর্মে, এক বিশালদেহী লোকের গায়ে হেলান দিয়ে, তিনি দুটো রেলবগির দুদিকে দুই পা রেখে, রেল ইঞ্জিনের সংঘর্ষ ঠেকানোর যন্ত্রের উপরে দাঁড়িয়ে আছেন, রেলবগিগুলোর হালকা দুলতে থাকা ছাদের থেকে বৃষ্টির মতো ধোয়ার কালির গুঁড়া আর ধুলো পড়ছে তার গায়ে। দুইবার ট্রেনটা থামল স্টেশনের দিকে আসতে থাকা একটা ট্রেনের জন্য, এত ধৈর্য নিয়ে এত লম্বা সময় দাঁড়াল যে মনে হচ্ছে ওটা কোনো দৈবাৎ সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছে। জানালার বাইরে কয়েকটা গ্রাম ধীরে চলে গেল, এখানে ওখানে দেয়ালে গতবারের মোটরগাড়ির রেসিংয়ের পোস্টারগুলো যেন চেঁচাচ্ছে, রাস্তার পাশের গাছগাছড়াগুলো চেনাই যাচ্ছে না সাদা ধুলোয় ঢেকে জলপাই পাতার রঙের চেহারা নেওয়ার কারণে।

যেহেতু আর সামনে যাওয়ার পথ নেই, ট্রেন অবশেষে থেমে দাঁড়াল। এক দল মোটরগাড়ি ব্রেক কষল একই সঙ্গে ঘুরপাক খেয়ে উপরে ওঠা ধুলোর মধ্যে দিয়ে আমরা দেখলাম অনেক ছোট ছোট পতাকা উড়ছে, বেশি দূরে নয়; আমরা তখনো আটকা পড়ে আছি একদল গবাদিপশুর কারণে, ওগুলো বুনো উত্তেজনায় সামান্য উঁচু পাহাড়ি পথ বেয়ে নামছে আর উঠছে, সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ছে মোটরগাড়িগুলোর উপরে।

আমরা পৌঁছালাম। বিমানঘাঁটির সামনে একটা বড় ভোলা জায়গায় ছোট ছোট সন্দেহজনক চেহারার কাঠের চালাঘর, ওগুলোর গায়ে যেসব নাম লেখা –গ্যারেজ, গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল বুফে, ইত্যাদি– সেগুলো আমরা আশা করিনি। বড় শরীরের অনেক ভিক্ষুক, ওরা ওদের পলকা ঠেলাগাড়িতে থেকে থেকে মোটা হয়েছে, আমাদের পথের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, তড়িঘড়ির কারণে ওদেরকে দেখে ইচ্ছে হচ্ছে লাফ দিয়ে পেরিয়ে যাই। অনেক মানুষ পেছনে ফেলে আমরা এগোলাম, অনেক মানুষ আমাদের পিছনে ফেলল। আমরা আকাশের দিকে তাকালাম, এখানে ওটাই সত্যিকারের চিন্তার বিষয়। খোদাকে ধন্যবাদ যে কেউ এখনো মনে হচ্ছে আকাশে ওড়েনি! কারোর জন্যই আমরা সরে গিয়ে পথ করে দিইনি, তবু এখনো কেউ আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়নি। হাজার হাজার যানবাহনের মাঝখানে আর পেছনদিকে, উল্টোদিক দিয়ে দুলে দুলে আসছে ইতালিয়ান অশ্বারোহী সেনাদল। তার মানে দুর্ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগ নেই –সেই সঙ্গে শৃঙ্খলারও সম্ভাবনা নেই বিশেষ একটা।

সন্ধ্যার অনেক পরে ব্রেসসায় ফিরে আমরা চাচ্ছিলাম জলদি একটা নির্দিষ্ট রাস্তায় পৌঁছাতে, আমাদের সবারই মতে সেটা বেশ দূরের পথ। একটা ঘোড়ার গাড়ি দাম হাঁকল তিন লিরা, আমরা বললাম দুই। গাড়ির চালক আমাদের নিতে রাজি হলেন না, কিন্তু স্রেফ দয়ার কারণেই আমাদের শোনালেন যে ঐ রাস্তাটা কত ভয়াবহ দূরে। আমাদের লজ্জা হতে লাগল আগের দরাদরির কারণে। ঠিক আছে তাহলে, তিন লিরা। আমরা গাড়িতে চড়লাম, অল্প পথের তিনটে বাঁক নিল গাড়ি, আমরা পৌঁছে গেলাম কাক্ষিত গন্তব্যে। ওটো, আমাদের বাকি দুজনের থেকে ওর শক্তি বেশি, জানাল যে এই এক মিনিটের মাত্র পথের জন্য তিন লিরা দেওয়ার ওর সামান্যতম ইচ্ছাও নেই। এক লিরাই বরং বেশি হয়ে যায়। এই যে, এক লিরা। এরই মধ্যে রাত নেমে এসেছে, ছোট রাস্তাটা ফাঁকা, ঘোড়াগাড়ির চালক বেশ শক্তপোক্ত গড়নের। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এমন খেপে উঠলেন যেন আমরা তর্কটা করছি এক ঘণ্টা ধরে : কী? –আমরা তো তাকে ঠকাচ্ছি।– আমরা ভাবছি কী নিজেদের।– তিন লিরার কথা হয়েছিল, তিন লিরাই দিতে হবে, এক্ষুনি তিন লিরা বের করতে হবে নতুবা আমাদের বিস্মিত হওয়ার বেশি বাকি নেই। ওটো : ‘ভাড়ার তালিকা দেখাবেন নাকি পুলিশ ডাকব!’ ভাড়ার তালিকা? এসব কোনো তালিকা-টালিকা নেই।– ভাড়ার আবার তালিকা থাকে নাকি?– রাতের গাড়ির চুক্তি করেছেন আপনারা, কিন্তু ঠিক আছে যদি দুই লিরা দিই, তিনি আমাদের যেতে দেবেন। ওটো, এতক্ষণে ভয়ংকর রকমের একগুঁয়ে : ‘ভাড়ার তালিকা নাকি পুলিশ!’ এরপর আরো কিছু চিত্তার আর খোঁজাখুঁজি, শেষে বের হলো একটা ভাড়ার তালিকা, ওটাতে ধুলো ছাড়া দেখা যাচ্ছে না আর কিছুই। শেষে আমরা রাজি হলাম দেড় লিরায়, গাড়িচালক সরু গলিপথ ধরে সামনে চলতে লেগেছে, এত সরু যে তার পক্ষে গাড়ি ঘোরানো সম্ভব নয়; আমার মনে হলো তিনি শুধু প্রচণ্ড রেগেই যাননি, দুঃখও পেয়েছেন। কারণ আমাদের ব্যবহার, দুঃখজনকভাবে, ঠিক ছিল না; ইতালিতে এরকম ব্যবহার করা যায় না; অন্য কোথাও হয়তো এমনটা করা ঠিক আছে, কিন্তু এখানে না। ঠিক আছে, কিন্তু উত্তেজনার সময়ে কার মনে থাকে সে কথা! এ নিয়ে বিলাপ করার কিছু নেই, স্রেফ এক সপ্তাহের এই বিমান-প্রদর্শনীর জন্য কেউ তো আর ইতালিয়ান হয়ে যেতে পারে না।

কিন্তু আমরা চাই না বিবেক-যন্ত্রণা আমাদের বিমান ওড়ার মাঠের আনন্দকে নষ্ট করুক, ওতে স্রেফ আরো নতুন বিবেক-যন্ত্রণাই জন্ম নেবে; আর তারপর বিমানঘাঁটিতে আমরা হাঁটি না, ছুটে যাই, আমাদের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সেই মহা উৎসাহ নিয়ে যা হঠাৎ আমাদের ঘিরে ধরে এই সূর্যের নিচে, আমরা হ্যাঙারগুলো পেরিয়ে আসি, ভ্রাম্যমাণ অভিনেতাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া মঞ্চের মতো ওগুলো দাঁড়িয়ে আছে পর্দা নামিয়ে। ওদের সামনের উপরের দিকে তিন কোনা জায়গায় বৈমানিকদের নাম লেখা, যাদের বিমান আছে ঐ পর্দার পেছনে, আর উপরে উড়ছে তাদের যার যার দেশের পতাকা। আমরা নামগুলো পড়ি– কোবিয়ানচি, কাগৃনো, কালদেরারা, রুঝে, কার্টিস, মচের (ইনি ট্রেনটো থেকে আসা একজন টাইরোলিয়ান মানুষ, উড়ছেন ইতালিয়ান পতাকা নিয়ে, স্পষ্ট যে উনি আমাদের চেয়ে ইতালিয়ানদের ওপর বেশি আস্থা রাখেন), আজানি, রোমান বৈমানিক ক্লাব। আর ব্লেরিও? আমরা জিজ্ঞাসা করি। ব্লেরিও, যার কথা আমরা সারাক্ষণ ভাবছি, কোথায় সেই ব্লেরিও?

তার হ্যাঙ্গারের সামনের বেড়া দেওয়া ছোট জায়গাটায় রুঝে শুধু একটা জামা পরে এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছেন, খাটো একটা মানুষ, চোখে পড়ার মতো বড় নাক। হিংস্র অঙ্গভঙ্গি করে তিনি তাঁর হাত ছুড়ছেন সামনের দিকে, চলতে চলতে নিজের সারা গায়ে সমানে চাটি মারছেন, তার মেকানিকদের হ্যাঙ্গারের পর্দার পেছনে পাঠাচ্ছেন, আবার ডাকছেন ওদের, নিজে ভেতরে গিয়ে ঢুকছেন, সামনে তাড়িয়ে নিচ্ছেন সবাইকে, আর ওনার স্ত্রী সে সময় এক পাশে একটা আঁটোসাঁটো সাদা পোশাক পরে, চুলের মধ্যে শক্ত করে একটা ছোট কালো হ্যাট চেপে বসিয়ে, ছোট স্কার্ট পরা পা দুটো পরিমিত ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন শূন্য গরম বাতাসের দিকে, ব্যবসায়ী মহিলা তিনি– তাই তার ছোট মাথার মধ্যে যত ব্যবসার চিন্তা।

পরের হ্যাঙ্গারের সামনে বসে আছেন কার্টিস, একদম একা। অল্প উঁচু করে পর্দার ফাঁক দিয়ে তার বিমানটা দেখা যাচ্ছে; লোকজন যা বলছে তার চেয়ে আকারে বড় সেটা। আমরা যখন হেঁটে পার হচ্ছি, কার্টিস তার হাতে ধরে আছেন নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড পত্রিকা, একটা পাতার উপরের দিকে কোনো লাইন পড়ছেন; আধা ঘণ্টা পরে আমরা আবার একই জায়গা দিয়ে গেলাম, তিনি এরই মধ্যে ঐ পাতাটার মাঝ-বরাবর পৌঁছেছেন; আরো আধা ঘণ্টা পরে পাতাটা তিনি পড়া শেষ করলেন, এবার অন্য নতুন একটা নিলেন হাতে। এটা পরিষ্কার, আজ তিনি আকাশে উড়বেন না।

আমরা ঘুরলাম, তাকিয়ে থাকলাম এয়ারফিল্ডের বিশাল ফাঁকা জায়গাটার দিকে। এটা এত বড় যে এর উপরের সবকিছু মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত, ফেলে রাখা : আমাদের কাছের জয়সূচক খুঁটিটা, দূরে সিগন্যালের লম্বা খুঁটি, একটু ডান দিকে বিমান ওড়া শুরুর গুলতির মতো যন্ত্রটা। কমিটির একটা মোটরগাড়ি মাঠ জুড়ে বাঁক নিয়ে চলেছে, ওটা থেকে উড়ছে বাতাসে টান টান একটা ছোট হলুদ পতাকা, গাড়িটা নিজের ওড়ানো ধুলোর মধ্যেই থামল একবার, আবার চলতে লাগল।

এখানে প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই অঞ্চলে এরা কৃত্রিম বিরানভূমি বানিয়েছে একটা, আর ইতালির কুলীন সম্প্রদায়, প্যারিসের ঝলমলে রমণীকুল এবং অন্য আরো হাজারো জন এখানে ভিড় করেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ ছোট করে এই রোদে ভরা বিরান শূন্যতার দিকে বেতাকিয়ে থাকতে। খেলার মাঠে সাধারণত বৈচিত্র্য আনে এরকম কোনোকিছুর এখানে। দেখা মিলবে না। রেসিং ট্র্যাকের সুন্দর এই বাধাগুলো কিংবা টেনিস কোর্টের চারপাশে সাদা দাগ, কিংবা ফুটবল মাঠের তাজা ঘাসের চাপড়া, মোটরগাড়ির ও বাইসাইকেল রেসিং ট্র্যাকের নুড়ি পাথর বসানো উধ্ব আর নিম্নগামী বক্রিমা– কিছুই না। বিকেলে শুধু দুই কি তিন বার দেখা যাবে সামনের সমতলভূমিতে বর্ণিল পোশাকে ছোট অশ্বারোহী সেনাদল দুলকি চালে চলছে। ঘোড়াগুলোর খুর চোখে পড়বে না ধুলোর কারণে, আর সূর্যের মসৃণ আলো প্রায় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একই রকম থাকবে। আর কিছুতেই যেন আমাদের মনোযোগের বিঘ্ন না ঘটে তাই এই খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকার পুরোটা সময় এখানে কোনো গানবাজনারও ব্যবস্থা নেই, শুধু সস্তা টিকিটের দাঁড়িয়ে-দেখার-জায়গাগুলো থেকে লোকজনের শিস শুনেই কোনোমতে আমাদের মেটাতে হবে কানের চাহিদা, পাস করতে হবে ধৈর্যের পরীক্ষায়। তবে ধরুন, আমাদের পেছনের আরো দামি স্ট্যান্ডে বসে আপনি দেখছেন, তখন তা শিস্ বাজানো ওই লোকের দলকে নিশ্চিত মনে হবে যে বিরানভূমির সঙ্গে তারা মিলিয়েই গেছে।

কাঠের রেলিংয়ের এক জায়গায় বেশ অনেক লোকের একটা ভিড় জমেছে। ‘কী ছোট!’ ফরাসিদের একটা দল মনে হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। হচ্ছেটা কী? আমরা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে কাছে গেলাম। দেখলাম ঐখানে মাঠে, আমাদের একেবারে কাছেই, একটা ছোট হলুদ উড়োজাহাজ, ওটা ওড়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এবার আমাদের চোখে পড়ল ব্লেরিওর হ্যাঙার, তার পাশে তার ছাত্র লা ব্লা-র হ্যাঙার; একেবারে মাঠের উপর বসানো হয়েছে এই হ্যাঙার দুটো। উড়োজাহাজের দুই ডানার একটার গায়ে হেলান দিয়ে আছেন, দেখেই চেনা যাচ্ছে, স্বয়ং ব্লেরিও, তিনি তার দুই কাঁধ কানের কাছে কুঁজের মতো উঁচু করে নিবিড়ভাবে দেখছেন উড়োজাহাজের ইঞ্জিনে তাঁর মেকানিকদের কাজকর্ম।

এই তুচ্ছ জিনিসটা নিয়ে কি তিনি আকাশে উড়তে চাইছেন নাকি? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পানিতে মানুষের জন্য বিষয়টা কত সহজ। প্রথমে অনুশীলন করে নেওয়া যায় কোনো পানি ভর্তি ডোবায়, তারপর কোনো পুকুরে, তারপর নদীতে, আর তার অনেক দিন পরে আপনার সাহস আসবে মহাসাগরে নামার; আর আকাশের বেলায়? এই লোকগুলোর জন্য সোজা এক মহাসমুদ্র ছাড়া আর কিছু নেই।

ব্লেরিও এরই মধ্যে বসে গেছেন তার আসনে, হাত রেখেছেন একটা লেভার না যেন। কিসের উপরে; তারপর তাঁর মেকানিকেরা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ওরা সব অতি-উৎসাহী ছেলেপেলে। তিনি ধীরে আমাদের দিকে চোখ ফেরালেন, আবার এদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন, অন্য কোনো দিকে তাকালেন, কিন্তু যা-ই করুন তার সত্যিকারের দৃষ্টি সব সময় নিজের দিকেই নিবদ্ধ। এবার উনি ওড়া শুরু করবেন, এর চেয়ে সরল-স্বাভাবিক আর কিছু হয় না। ওড়া নিয়ে স্বাভাবিকের এই বোধ, এর পাশাপাশি চারপাশে সবার মধ্যে অস্বাভাবিকতার এক অনুভূতি যা তিনি এড়াতে পারছেন না, এই দুয়ে মিলেই ওনার মধ্যে দিয়েছে ওরকম ভাবসাব।

একজন সহকারী প্রপেলারটা চালানোর জন্য ওটার একটা ব্লেড ধরলেন, তিনি ওটাতে একটা হেঁচকা টান মারতেই ওটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল, আওয়াজ উঠল কোনো শক্ত-সবল মানুষের ঘনঘন শ্বাস টানার মতো; কিন্তু প্রপেলারটা তার পরও প্রাণহীন। তিনি আবার চেষ্টা করলেন, দশ বার চেষ্টা করলেন, কোনো কোনো বার প্রপেলার তক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর কোনোবার কয়েকটা ঘুরান দেওয়ার চেয়ে বেশি আর কিছু করতে চাইছে না। সমস্যা ইঞ্জিনে। আবার নতুন করে কাজ শুরু হলো, দর্শকেরা যারা কাজটা করছে তাদের চাইতেও বেশি ক্লান্ত। ইঞ্জিনকে প্রত্যেকটা কোনা থেকে তেল মাখানো হচ্ছে; লুকানো ক্রুগুলো ঢিলা করে ফের টাইট করা হচ্ছে; একজন লোক হ্যাঙারে দৌড়ে গেল, একটা খুচরা যন্ত্রাংশ নিয়ে এল; দেখা গেল ওটা মিলছে না; আবার সে ফেরত গেল, তারপর হ্যাঙারের মেঝেতে উবু হয়ে বসে দুই হাঁটুর মাঝখানে ওটাতে হাতুড়ি দিয়ে মারতে লাগল। ব্লেরিও একজন মেকানিকের সঙ্গে আসন বদল করলেন, মেকানিক লা ব্লা-র সঙ্গে। এই কেউ একজন প্রপেলার ধরে আবার টান মারছে, এই অন্য কেউ। কিন্তু ইঞ্জিনটা কৃপাহীন; ঠিক একটা স্কুলছাত্রের মতো যাকে সব সময় সবাই সাহায্য করছে, পুরো ক্লাস তাকে উত্তরটা ধরিয়ে দিচ্ছে, না, তা-ও সে পারছে না, আবার এবং আবার সে আটকে যাচ্ছে, আবার আবার আটকে যাচ্ছে। সেই একই জায়গায়, তারপর শেষমেশ হাল ছেড়ে দিচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের জন্য ব্লেরিও চুপচাপ বসে থাকলেন তাঁর আসনে, তাঁর ছয় সহকারী নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে তাঁকে ঘিরে; সবাই মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে।

দর্শকেরা কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস ফেলার একটু সময় পেল, তাকাল তাদের চারপাশে। ব্রেরিওর অল্পবয়সী স্ত্রী, তার চেহারায় মা ভাব, হাজির হলেন, তার পেছনে দুটো বাচ্চা। তার স্বামী যদি উড়তে না পারেন, তাহলে তিনি মন খারাপ করবেন, আর যদি ওড়েনই, তাহলে তিনি ভয়ে থাকবেন; এর ওপরে তার সুন্দর পোশাকটা এই আবহাওয়ার হিসেবে একটু বেশি ভারী।

আরো একবার প্রপেলার ঘোরানো হলো, হয়তো আগের চেয়ে এবারে ভালো অবস্থা, হয়তো না; ইঞ্জিন চালু হলো প্রচণ্ড শব্দ করে, যেন এটা অন্য কোনো ইঞ্জিন; চারজন মানুষ উড়োজাহাজটা ধরে থাকল পেছনের দিকে, আর চারপাশের নিঃসাড় অবস্থার মধ্যে ওই ঘুরতে থাকা প্রপেলার থেকে হাওয়ার দমক এসে লোকগুলোর গায়ের আসল জামাকাপড়ের উপর পরা লম্বা ঢিলে কাপড়গুলো নাড়িয়ে কাঁপিয়ে যেতে লাগল। একটা কথাও বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে শুধু প্রপেলারের আওয়াজই এখানকার রাজা; আটটা হাত এবার উড়োজাহাজটা ছেড়ে দিল, ওটা মাটি-কাদার উপর দিয়ে অনেক দূর দৌড়ে গেল নাচের উঠানে কোনো আনাড়ি শিল্পীর মতো।

কতবার যে এরকম চেষ্টা চালানো হলো, কিন্তু প্রতিটা চেষ্টাই শেষ হলো হতাশায়। প্রত্যেকবারই লোকজন পায়ের উপর উঠে দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়িয়ে পড়ছে তাদের খড়ের জাজিম দেওয়া চেয়ারের উপর, শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করছে দুই হাত দুপাশে বাড়িয়ে আর একই সঙ্গে এভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছে তাদের আশা, উদ্বেগ ও আনন্দ। বিরতির সময়গুলোতে ইতালির কুলীন সম্প্রদায়ের ওনারা স্ট্যান্ডগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুভেচ্ছা আর কুর্নিশ বিনিময় হচ্ছে, লোকজন একে অন্যকে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরছে, স্ট্যান্ডের সিঁড়ির ধাপগুলোয় তারা ওঠানামা করেই চলেছে। লোকজন একে অন্যকে দেখাচ্ছে ঐ যে প্রিন্সেস ল্যাটিসিয়া সাভোইয়া বোনাপার্ত, ঐ যে প্রিন্সেস বোরগেসে, আর ঐ যে বয়স্কা মহিলা যার মুখ কালো হলদে আঙুলের মতো– কাউন্টেস মোরেসিনি। মার্চেল্লো বোরগেসে একই সঙ্গে সব ভদ্রমহিলার দেখাশোনা করছেন, আবার কারোরই করছেন না, দূর থেকে তার চেহারাটার একটা মানে দাঁড়াচ্ছে বটে, কিন্তু কাছ থেকে দেখলে যেভাবে তার গাল দুটো তার মুখের দুই কিনার ঘিরে রেখেছে, তা দেখতে লাগছে বেশ অদ্ভুত। গ্যাব্রিয়েল দানুনসিও, ছোটখাটো ও দুর্বল, মনে হচ্ছে নেচে চলেছেন কাউন্ট ওদোফ্রেদির সামনে দিয়ে, এই কাউন্ট কমিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণদের একজন। দেখা যাচ্ছে উপরে স্ট্যান্ডের রেলিং থেকে নিচে তাকিয়ে আছে পুচ্চিনির কঠিন মুখ, তার নাকটা দেখতে কোনো মাতালের নাকের মতো।

তবে এইসব মানুষকে আপনার কেবল তখনই চোখে পড়বে যখন আপনি তাদের খুঁজছেন। তা যদি না হয় তাহলে আপনি শুধু চারপাশে দেখবেন হালফ্যাশনের দীর্ঘদেহী রমণীদের, তাদের উপস্থিতি বাকি সবকিছু ছায়ায় ঢেকে দিয়েছে। তারা বসার চেয়ে হাঁটাই বেশি পছন্দ করে, কারণ তাদের পোশাকগুলো বসার জন্য ঠিক জুতসই না। এশীয় ধাঁচের নেকাবে ঢাকা তাদের মুখগুলো কেমন মৃদু আধো-আলোকিত। তাদের পোশাকের কারণে (যার উপরের দিকটা ঢিলেঢালা) তাদের পুরো শরীর পেছন থেকে দেখতে লাগছে। দ্বিধান্বিত; এরকম রমণীদের যখন দ্বিধান্বিত লাগে, তখন কী একটা মিশ্র ও শান্তি-নষ্ট-করা ভাব হয় মনের মধ্যে! এদের বক্ষবন্ধনী বেশ নিচুতে, এত নিচুতে যে ওখানে পৌঁছানো যাবে না; তাদের কোমর দেখতে লাগছে স্বাভাবিকের চাইতে ঘেরে বড়, কারণ সবকিছু যে অত সরু; এই রমণীদের আলিঙ্গন করতে হবে শরীরের নিচের দিকে।

এতক্ষণ যা দেখলাম তা কেবল লা ব্লা-র উড়োজাহাজ। কিন্তু এবার এল সেই উড়োজাহাজ, যেটাতে করে ব্লেরিও চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন; কেউ তা বলে দেয়নি, কিন্তু সবাই জানে। একটা দীর্ঘ বিরতি, তারপর ব্লেরিও আকাশে, দেখা যাচ্ছে তার শরীরের উপরের অংশ ডানার ওপরে তিনি টান টান করে রেখেছেন, তার পাগুলো ভেতরে কোথাও ঝুলছে প্লেনের যন্ত্রপাতির মাঝখানে। সূর্য নিচে নেমে এসেছে, আর স্ট্যান্ডের শামিয়ানার নিচে আলো ফেলে ঝলক মারছে দুলতে থাকা ডানায়। সবাই তার দিকে উপরে তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে, কারোর মনেই এখন আর অন্য কারোর জন্য স্থান নেই। তিনি একটা ছোট বৃত্তাকারে উড়ে গেলেন, তারপর প্রায় খাড়া আমাদের মাথার উপরে দেখা গেল তাকে। সারসের মতো গলা বের করে সবাই তাকিয়ে দেখছে কীভাবে তার প্রতিপাশে এক-পাখার উড়োজাহাজটা দুলছে, কীভাবে ব্লেরিও ওটা নিয়ন্ত্রণ করছেন আর আরো উঁচুতে উঠে যাচ্ছেন। ঘটছেটা কী এখানে? আমাদের মাথার উপরে, মাটি থেকে বিশ মিটার উপরে, একজন মানুষ আটকে আছেন একটা কাঠের খাঁচায়, লড়াই করে যাচ্ছেন এক অদৃশ্য বিপদের সঙ্গে, এই মোকাবিলা তাঁর নিজের খুশিতেই। আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি নিচে কোথায়, খোঁয়াড়ের মধ্যে পরিত্যক্ত ও নিরর্থক হয়ে, দেখছি তাঁকে।

সবকিছু ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে। একই সময়ে সিগন্যালের খুঁটি দেখে বোঝা গেল বাতাস এখন আরো অনুকূলে এবং কার্টিস এবার উড়বেন ব্রেসার গ্র্যান্ড প্রাইজের জন্য। তাহলে তিনি উড়তে যাচ্ছেন, সত্যিই? আমরা তথ্যটা ঠিকমতো হজমও করতে পারিনি, কার্টিসের ইঞ্জিন গজরাতে শুরু করল; তাকে ঠিকমতো দেখেই উঠিনি, তিনি উড়ে আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন; তার সামনে বিস্তৃত সমতলভূমির উপর দিয়ে উড়ছেন তিনি, দূরে বনের দিকে চলে যাচ্ছেন, এই প্রথমবারের মতো বনটা মনে হয় জেগে উঠেছে। ঐ বনের উপর দিয়ে তিনি উড়লেন যেন বহুকাল, হারিয়ে গেলেন, আমরা তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে না, বনের দিকে। কতগুলো ঘরবাড়ির পেছন থেকে, কোথায় তা খোদাই জানেন, তিনি আবির্ভূত হলেন আবার, ঠিক আগের উচ্চতায়, ধেয়ে আসতে লাগলেন আমাদের দিকে; যখন তিনি উপরে উঠছেন, তখন তার দুই জোড়া-পাখার উড়োজাহাজের তলাটা দেখা যাচ্ছে অন্ধকার হয়ে আসছে, যখন তিনি নিচের দিকে ডুব মারছেন, ওটার উপরের অংশটা ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়। সিগন্যাল খুঁটি বেড় দিয়ে তিনি ফিরে এলেন, তাঁকে সম্ভাষণ জানানো চিৎকারের দিকে কোনো খেয়াল নেই তার, তারপর ঘুরে গেলেন সোজা সেই পথে যেদিক থেকে এসেছেন, স্রেফ যেন দ্রুত আবার একাকী ও ক্ষুদ্র হওয়ার বাসনা থেকেই। এরকম বৃত্তাকারে পাঁচ বার ঘোরা শেষ করলেন তিনি, ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে উড়লেন ৫০ কিলোমিটার আর তা দিয়ে জিতে নিলেন ব্রেসসার গ্র্যান্ড প্রাইজ, ৩০ হাজার লিরা। এটা একটা নিখুঁত কৃতিত্ব, কিন্তু কোনো নিখুঁত কৃতিত্বকে কখনোই উদ্যাপন করা যায় না, শেষমেশ গিয়ে সবাই ভাবে যে নিখুঁত কৃতিত্ব দেখাতে সবাই পারে, নিখুঁত কৃতিত্ব দেখানোর জন্য যেন কোনো সাহসের প্রয়োজন নেই। যখন কার্টিস ওখানে ওই বনের উপরে একা ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছেন, যখন তার স্ত্রী (ইতোমধ্যে সবাই তাকে ভালোমতো চিনে গেছে) তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় মগ্ন, এদিকে লোকজন যেন তাকে প্রায় ভুলেই বসেছে। চতুর্দিকে শুধু শোনা যাচ্ছে এই অভিযোগ যে কালদেরারা উড়বেন না (তাঁর উড়োজাহাজ ভেঙে গেছে), রুঝে দুই দিন যাবৎ তার ভইসিন উড়োজাহাজটা নিয়ে নাড়াচাড়াই করেছেন, ওটাকে মুক্তি দেননি তবু, ইতালিয়ান আকাশে চলার বেলুন জোডিয়াক এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। কালদেরার এই দুর্ভাগ্য নিয়ে চারদিকে চলতে থাকা গুজব তাকে এমন যশ-গৌরব দান করেছে যে আপনার একান্তভাবেই মনে হবে তার রাইট-ভাইদের ঐ উড়োজাহাজের থেকে বরং তার জাতির ভালোবাসাই তাকে আরো নিরাপদে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

কার্টিস তাঁর ওড়া তখনো শেষ করেননি, শোনা গেল আরো তিনটে হ্যাঙারে এরই মধ্যে ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে, যেন সংক্রামক এক প্রবল উদ্দীপনায় পেয়েছে ওগুলোকে। দুটো মুখোমুখি দিক থেকে ভয়ংকর ঘুরপাক খেয়ে আসছে বাতাস ও ধুলা। একজোড়া চোখ এ সবকিছু দেখার জন্য যথেষ্ট না। আমরা আমাদের আসনে মোচড়াচ্ছি, ঘুরে যাচ্ছি, হেলে পড়ছি, কাউকে ধরে বসছি, বলছি যে আমরা দুঃখিত, অন্য কেউ হেলে-নুয়ে পড়ছে, আমাদের আঁকড়ে টেনে ধরছে, আমরা ধন্যবাদ পাচ্ছি। ইতালিয়ান শরতের সাঁঝবেলার পূর্বাভাস শুরু হয়েছে, আর মাঠে সবকিছু পরিষ্কার দেখা সম্ভব না।

কার্টিস তাঁর বিজয়ীর উড়ান শেষ করে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পরপরই (আমাদের এদিকে না-তাকিয়েই তিনি একটা ক্ষীণ হাসি দিয়ে তাঁর মাথার টুপি তুললেন), ব্লেরিও একটা সংক্ষিপ্ত বৃত্তাকার ওড়ার জন্য যাত্রা শুরু করে দিলেন, এর আগে দেখার কারণে সবাই জানে তিনি সেটা পারেন! বোঝারই উপায় নেই কাকে সবাই করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে– কার্টিসকে, নাকি ব্লেরিওকে, নাকি এতক্ষণে রুঝেকে যার বিশাল ভারী উড়োজাহাজটা এবার আকাশে উঠবার পথে। রুঝে তার নিয়ন্ত্রণ আসনে বসে আছেন লেখার টেবিলে বসা কোনো ভদ্রলোকের মতো; একটা ছোট সিঁড়ি দিয়ে পেছন থেকে তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি উপরে উঠছেন বৃত্তাকারে, ব্লেরিওরও উপরে উঠে গেছেন, ব্লেরিওকে একজন দর্শক বানিয়ে ফেলেছেন তিনি, তারপর আরো উপরে উঠেই যাচ্ছেন।

আমাদের যদি ঘোড়াগাড়ি পেতে হয়, তাহলে এখনই এখান থেকে বেরোতে হবে; অনেক মানুষ এরই মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে আমাদের পার হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, শেষের এই উড়ানগুলো সব পরীক্ষামূলক, যেহেতু এরই মধ্যে ৭টা প্রায় বেজে গেছে তাই এগুলো অফিশিয়ালি আর গোনায় ধরা হবে না। বিমানঘাঁটিতে ঢোকার পথের মোটরগাড়ির পার্কিং এলাকায় ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির মাইনে-বাঁধা চালক আর ভৃত্যেরা তাদের সিটের উপর দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে রুঝেকে দেখাচ্ছে; বিমানঘাঁটির বাইরে চার চাকার ঘোড়াগাড়ির চালকেরাও ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ভাড়াগাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে– রুঝেকে; তিনটা ট্রেন, রেল-ইঞ্জিনের সংঘর্ষ ঠেকানোর শেষ যন্ত্রটা পর্যন্ত ভর্তি, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে রুঝেরই কারণে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে ঘোড়াগাড়ি পাওয়া গেল, চালক আমাদের সামনে আসনপিড়ি হয়ে বসা (এ গাড়িটায় আলাদা চালকের বক্স নেই); অবশেষে আবার একবার আমরা স্বনির্ভর হয়ে যাত্রা শুরু করলাম। ম্যাক্স খুব যুক্তিসম্মত মন্তব্য করল যে এরকম কিছু একটা প্রাগেও আয়োজন করা যেতে পারে, এবং করা উচিত। সেটা আকাশে ওড়ার প্রতিযোগিতাই যে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, যদিও করলে তা ভালই হয়, সে বলল, তবে স্রেফ একজন বৈমানিককে আনলেই চলবে, আর তা এমন কোনো কঠিন কাজও না, এবং আয়োজকদেরও তাতে ভালোমতোই পুষিয়ে যাবে। পুরো ব্যাপারটা খুবই সহজ; ঠিক এখন রাইট উড়ছেন বার্লিনে, কদিন পরই ব্লেরিও উড়বেন ভিয়েনায়, লাথাম বার্লিনে। অতএব কাজ বলতে এটাই যে ওদের একটু সামান্য পথ পরিবর্তন করতে রাজি করানো। আমরা বাকি দুজন কোনো উত্তর দিলাম না, প্রথম কথা আমরা ক্লান্ত, আর দ্বিতীয় হলো আমাদের এ বিষয়ে কোনো আপত্তি এমনিতেই নেই। রাস্তা বাঁক নিল, রুঝেকে আবার দেখা যাচ্ছে, তিনি এত উপরে উঠে গেছেন যে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর অবস্থান কেবল তারার মাধ্যমেই নির্ধারণ করা সম্ভব; এরই মধ্যে অন্ধকার হয়ে ওঠা আকাশে শিগগিরই তারা ফুটবে। আমাদের গাড়ি বাঁক নিয়ে নিয়ে চলতেই লাগল; রুঝে তখনো আরো উপরে উঠেই চলেছেন, কিন্তু আমাদের কথা যদি বলতে হয়, আমরা শেষবারের মতো নেমে যাচ্ছি কাম্পানইয়ার খোলা সমতলভূমির গভীরে।

1 Comment
Collapse Comments
নিশির শিশির June 2, 2023 at 12:17 am

Extraordinary

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *