ব্রেজিলের কালো বাঘ – আর্থার কনান ডয়েল

ব্রেজিলের কালো বাঘ – আর্থার কনান ডয়েল

মেজাজটা বনেদী, প্রত্যাশা অসীম, অভিজাত বংশের রক্ত বইছে ধমনীতে, অথচ পকেটে পয়সা নেই, রোজগারের কোন রাস্তা নেই—একজন যুবকের পক্ষে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? আমার বাবা ছিলেন সহজ, সরল মানুষ। তাঁর দাদা, অকৃতদার লর্ড সাদারটন, বিশাল সম্পত্তির মালিক। এই দাদার বদান্যতার উপর বাবার এমনই আস্থা ছিল যে তাঁর একমাত্র সন্তান হয়ে আমার যে কোনদিন অন্নসংস্থানের চিন্তা করতে হবে এটা তিনি ভাবতে পারেননি। তাঁর ধারণা ছিল, হয় সাদারটনের বিস্তীর্ণ জমিদারি এস্টেটে, না হয় নিদেন পক্ষে সরকারের কূটনৈতিক বিভাগে আমার একটা স্থান হবেই। তাঁর অনুমান যে সম্পূর্ণ ভুল সেটা তাঁর অকালমৃত্যুর ফলে বাবা আর জেনে যেতে পারেননি। যেমন আমার জ্যাঠা, তেমনি বৃটিশ সরকার, আমার সংগতির জন্য কিছুই করলেন না, বা আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো তাপ উত্তাপ প্রকাশ করলেন না। ক্কচিৎ কদাচিৎ কিছু ফেজান্ট পাখি বা গুটিকয়েক খরগোশ উপঢৌকন হিসেবে জ্যাঠার কাছ থেকে আসে, আর সেই থেকেই বোঝা যায় যে আমি ইংল্যান্ডের অন্যতম সবচেয়ে সমৃদ্ধ জমিদারিতে অবস্থিত অটওয়েল প্রাসাদের উত্তরাধিকারী। যাই হোক, আমি নিজে বিয়ে করিনি, লন্ডনের গ্রোভনর ম্যানসন্‌সে ঘর নিয়ে নাগরিক জীবন যাপন করি। কাজের মধ্যে আছে পায়রা শিকার ও হার্লিং হ্যামে পোলো খেলা। আমার ঋণ যে মাসে মাসে বেড়েই চলেছে, কিছুদিন পরে আর তা শোধ করার কোনো উপায়ই থাকবে না, এটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আমার এই শোচনীয় অবস্থাটা আরো প্রকট হয়ে উঠছে এই কারণেই যে লর্ড সাদারটন ছাড়াও আমার আরো বেশ কয়েকজন ধনী আত্মীয় রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নিকট হলেন আমার খুড়তুতো ভাই এভারার্ড কিং। বেশ কিছুদিন ব্রেজিলে অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ জীবন কাটিয়ে সে সম্প্রতি দেশে ফিরে দিব্যি গুছিয়ে বসেছে। তার উপার্জনের পন্থাটা কী সেটা আমার জানা নেই, তবে তার অবস্থা যে রীতিমতো সচ্ছল সেটা বোঝাই যায়, কারণ সে এখন সাফোকের ক্লিপ্টন-অন-দ্য-মার্শে গ্রেল্যান্ডসের জমিদারির মালিক। ইংল্যান্ডে আসার পর প্রথম বছরটা সে আমার কঞ্জুস জ্যাঠার মতোই আমার কোনো খোঁজখবর নেয়নি, কিন্তু এক গ্রীষ্মের সকালে মনটা খুশিতে ভরে উঠল, যখন দেখলাম, সে একটি চিঠি মারফত গ্রেল্যান্ডস কোর্টে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসার জন্য আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি তখন দেউলে হবার আশংকায় অন্যরকম কোর্টে যাবার কথা ভাবছিলাম, আর ঠিক সেই সময় দৈবক্রমে এসে গেল এই চিঠি। আমার এই অচেনা ভাইটিকে যদি হাত করতে পারি, তাহলে হয়ত একটা উদ্ধারের পথ পেলেও পেতে পারি। অন্তত বংশ মর্যাদার খাতিরেও ত তার আমাকে পথে বসতে দেওয়া উচিত নয়। চাকরকে বলে আমার বাক্স গুছিয়ে নিয়ে সেই দিনই সন্ধ্যায় আমি ক্লিপ্টন-অন-দ্য-মার্শের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।

ইপ্‌সিচে গাড়ি বদল করে একটি লোক্যাল ট্রেন আমাকে অসমতল তৃণ প্রান্তরের মাঝখানে একটি জনবিহীন ছোট্ট স্টেশনে নামিয়ে দিল। আমার জন্য কোনো গাড়ি আসেনি (পরে জেনেছিলাম আমার টেলিগ্রাম পৌঁছতে দেরি হয়েছিল), তাই আমি কাছেই একটি পান্থনিবাস থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রওনা দিয়ে দিলাম। গাড়ির সহিস দিব্যি লোক—সে আমার ভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বুঝলাম এ অঞ্চলে এর মধ্যেই এভারার্ড কিং-এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য সে পার্টি দিয়েছে, জনসাধারণ যাতে তার বিস্তীর্ণ বাগান ঘুরে দেখতে পারে তার ব্যবস্থা করেছে, নানান জনহিতকর কাজে সে অর্থ সাহায্য করেছে। মোটকথা, এত ভাবে সে তার দরাজ মনের পরিচয় দিয়েছে যে আমার সহিসের ধারণা হয়েছে সে পার্লামেন্টে পদক্ষেপ করার জন্য জমি তৈরি করছে।

পথে যেতে যেতে সহিসের দিক থেকে আমার দৃষ্টি হঠাৎ চলে গেল এক বিচিত্রবর্ণ পাখির দিকে। রাস্তার ধারে টেলিগ্রাফ পোস্টের উপর বসেছে পাখিটা। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি নীলকণ্ঠ জাতীয় কোন পাখি, কিন্তু কাছে আসতে দেখলাম আয়তনে তার চেয়ে বেশ খানিকটা বড়, আর পালকে রঙের বাহারও অনেক বেশি। সহিস বলল আমরা যে ব্যক্তির কাছে চলেছি এটা তাঁরই পাখি। ইনি নাকি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নানারকম পশুপাখি এনে এখানকার আবহাওয়ায় সেগুলো প্রতিপালনের চেষ্টা করছেন। গ্রেল্যান্ডস পার্কের গেট দিয়ে প্রবেশ করার পর এই কথার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেল। ছোটো ছোটো বুটিদার হরিণ, এক ধরনের শূয়োর-জাতীয় জানোয়ার—নাম বোধহয় পেকারি—একটি ঝলমলে রং বিশিষ্ট ওরিয়োল পাখি, এক শ্রেণীর পিপীলিকাভুক, আর একরকম স্থূল ব্যাজার-জাতীয় জানোয়ার চোখে পড়ল গাছপালায় ঘেরা আঁকাবাঁকা পথটা দিয়ে যেতে।

আমার খুড়তুতো ভাইটি গাড়ির শব্দ পেয়ে আমি এসেছি বুঝে বাড়ির বাইরের সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছিল। চেহারায় একটা অমায়িক ভাব ছাড়া তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। আকারে বেঁটে ও মোটা, বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, রোদে পোড়া গোল মুখে অজস্র বলিরেখা। পরনে সাদা লিনেনের জামা—যেমন প্লান্টাররা পরে থাকে—মুখে চুরুট্‌ ও মাথায় পানামা টুপি। দেখে মনে হয় ইনি প্রাচ্যের কোনো উপনিবেশের বাংলো বাড়ির বাসিন্দা, ইংল্যান্ডের এই সুউচ্চ পালাডিও স্তম্ভ-বিশিষ্ট সুবিশাল অট্টালিকায় ইনি বেমানান।

‘শুনছ!’ ভদ্রলোক ঘাড় ফিরিয়ে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘উনি এসে গেছেন—আমাদের অতিথি! গ্রেল্যাণ্ডসে তোমায় স্বাগত জানাচ্ছি, মার্শাল ভায়া! তোমার সঙ্গে আলাপের সুযোগে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এই ঘুমিয়ে-আসা পল্লীগ্রামে আমার এই বাসস্থানে তোমার যে পায়ের ধুলো পড়ল তাতে আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি।’

তার এই সাদর অভ্যর্থনায় মুহূর্তের মধ্যে আমার সব সঙ্কোচ কেটে গেল। আর এটার প্রয়োজন ছিল একান্তভাবেই, কারণ স্বামীর ডাকে যে বিবর্ণ, দীর্ঘাঙ্গিনীটি বেরিয়ে এলেন, তাঁর আচরণ অস্বাভাবিক রকম রূঢ়। আমার ধারণা হল ইনি ব্রেজিলের মেয়ে, যদিও ইংরাজিটা বলেন ভালোই। হয়ত আমাদের দেশের আদব-কায়দার সঙ্গে পরিচয়ের অভাবই তাঁর এই রুক্ষস্বভাবের কারণ। তাঁর আচরণ থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে গ্রেল্যাণ্ডস কোর্টে আমার উপস্থিতিতে তিনি আদৌ প্রসন্ন নন। তাঁর কথায় কোনো অশালীনতার পরিচয় না পেলেও, তাঁর ভাবব্যঞ্জক চোখের চাহনিই স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে আমি লণ্ডনে ফিরে না যাওয়া অবধি তাঁর শান্তি নেই।

কিন্তু আমার ঋণের ভার এত বেশি, এবং আমার এই ধনী আত্মীয়টি আমার ত্রাণকর্তার ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, এ সম্পর্কে আমি এতই আস্থাবান যে আমি স্ত্রীর রূঢ়তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বামীর হৃদ্যতার ষোল আনা সুযোগ নেওয়া স্থির করলাম। আমার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দেখলাম তার সজাগ দৃষ্টি। যে ঘরটি আমায় দেওয়া হয়েছে সেটি চমৎকার। তা সত্ত্বেও ভদ্রলোক বারবার বললেন আমার সুবিধার জন্য যা কিছু দরকার তা তিনি করতে রাজি আছেন। আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম সবচেয়ে সুবিধা হয় কিছু অর্থসমাগম হলে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল সেটার সময় এখনো আসেনি। নৈশভোজের ব্যবস্থা ছিল পরিপাটি, আর ভোজনান্তে ছিল হাভানা চুরুট আর কফির ব্যবস্থা। চুরুট নাকি তার নিজের বাগানের তামাক থেকে তৈরি। আসার পথে সহিস যা বলছিল তা যে একটুও বাড়িয়ে বলা নয় সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। এনার মতো মহানুভব, অতিথিবৎসল ব্যক্তি আমি আর দুটি দেখিনি।

কিন্তু এই ব্যক্তির মধ্যেও যে একটি আত্মম্ভর অগ্নিগর্ভ মানুষ বাস করে তার পরিচয় পেলাম পরদিন সকালে। কিং গৃহিণী আমার প্রতি এতই বিমুখ যে প্রাতরাশের সময় সেটা প্রায় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। স্বামী ঘর থেকে বেরোনমাত্র তাঁর মনের ভাবটা পরিষ্কার ফুটে বেরোল।

‘লণ্ডন ফিরে যাবার সবচেয়ে ভালো ট্রেন হচ্ছে দুপুর সাড়ে বারোটায়’, হঠাৎ বললেন ভদ্রমহিলা।

আমি খোলাখুলি বললাম, ‘আমি কিন্তু আজ ফেরার কথা ভাবছি না।’

এই মহিলার দ্বারা বিতাড়িত হবার কোনো বাসনা ছিল না আমার।

‘আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই যদি সেটা নির্ভর করে—’ কথাটা শেষ না করে অত্যন্ত উদ্ধতভাবে ভদ্রমহিলা চাইলেন আমার দিকে।

আমিও ছাড়বার পাত্র নই। বললাম, ‘আমার বিশ্বাস এভারার্ড যদি মনে করে আমি তার আতিথেয়তার অন্যায় সুযোগ নিচ্ছি তাহলে সেকথা সে নিশ্চয়ই আমাকে বলবে।’

‘ব্যাপার কী?’

ঘরে ফিরে এসেছে এভারার্ড। মনে হল আমার কথাগুলো সে শুনেছে, এবং আমাদের দুজনের দিকে চেয়ে সে পরিস্থিতিটা আঁচ করে নিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে তার খুশিতে ভরা গোল মুখটায় এক অনির্বচনীয় হিংস্রভাব ফুটে উঠল।

‘তুমি একটু বাইরে যাবে কি, মার্শাল?’ (আমার নাম যে মার্শাল কিং সেটা এইবেলা বলে রাখি)।

আমি বেরোতে আমার পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিল এভারার্ড, আর তার পরেই শুনলাম তীব্র ভর্ৎসনার সুরে সে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। আতিথেয়তার অবমাননায় সে যে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ তাতে সন্দেহ নেই। আড়ি পাতার কোনো অভিসন্ধি ছিল না আমার, তাই আমি বারান্দা থেকে নেমে এলাম বাগানে। কিছুক্ষণ পরে দ্রুত পায়ের আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখি মহিলা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর মুখ বিবর্ণ, দৃষ্টি বিস্ফারিত।

‘আমার স্বামী আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন, মিঃ মার্শাল’, দৃষ্টি না তুলে বললেন মহিলা।

আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘দোহাই মিসেস কিং, এ নিয়ে আর কিছু বলবেন না।’

তাঁর কালো চোখদুটো হঠাৎ ঝলসে উঠল।

‘মূর্খ!’

চাপা অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে কথাটা বলে সদর্পে ঘরের ভিতর চলে গেলেন মহিলা।

অপমানটা এতই অপ্রত্যাশিত, এতই অসহ্য যে আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম দরজার দিকে। এমন সময় এভারার্ড এলো বারান্দায়।

‘আশা করি আমার স্ত্রী তার অর্বাচীন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছে তোমার কাছে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—চেয়েছেন বৈ কি!’ এভারার্ড আমার কনুইটাকে তার হাতে নিয়ে হাঁটতে সুরু করল।

‘তুমি ব্যাপারটা গায়ে মেখ না’, বলল এভারার্ড। ‘তোমার মেয়াদের একটি ঘণ্টাও কম যদি থাক তুমি এখানে তাহলে আমি অত্যন্ত দুঃখ পাব। ব্যাপারটা হচ্ছে কী—ভাইয়ের কাছে গোপন করার কোনো মানে হয় না—আমার স্ত্রী অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ। আমাদের দুজনের মাঝখানে কেউ এসে দাঁড়ালেই সেটা ও আর বরদাস্ত করতে পারে না, তা সে লোক পুরুষই হোক আর মহিলাই হোক। ও সবচেয়ে কিসে খুশি হয় জান?—স্বামীস্ত্রীতে সমুদ্রের মাঝখানে কোনো জনবিহীন দ্বীপে বসে গল্প করে যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিই তাহলে। এর থেকেই বুঝতে পারবে ও মানুষটা কেমন। আসলে এটা একটা ব্যারামের সামিল। তুমি কথা দাও এ নিয়ে আর চিন্তা করবে না।’

‘মোটেই না।’

‘তাহলে এই চুরুটটা ধরিয়ে আমার সঙ্গে এস। আমার পশুসংগ্রহটা দেখাই তোমাকে।’

সারা বিকেলটা কেটে গেল এই কাজে। বাইরের থেকে আনা যত পাখি, যত সরীসৃপ সবই দেখা হল। এদের মধ্যে কিছু রয়েছে খাঁচায়, কিছু খাঁচার বাইরে, আর কিছু একেবারে বাড়ির ভিতর ছাড়া-অবস্থায়। চলতে চলতে সামনে ঘাস থেকে হঠাৎ কোনো রঙবেরঙের পাখি লাফিয়ে উঠতে দেখে, বা কোনো অচেনা জানোয়ারকে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে দেখে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত হয়ে উঠছিল এভারার্ড। সবশেষে প্রাসাদের এক প্রান্তে একটি লম্বা প্যাসেজের ভিতর গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা খড়খড়ি লাগানো ভারী দরজা, আর তার পাশেই একটা হাতল লাগানো চাকা। সেই সঙ্গে লক্ষ করলাম লোহার ফ্রেমে লাগানো এক সারি খাড়াখাড়ি লোহার শিক দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাসেজের ভিতর।

‘এবার যেটা দেখাব সেটা হল আমার সংগ্রহের একেবারে সেরা জিনিস’, বলল এভারার্ড। ‘ইউরোপে আর একটি মাত্র নমুনা আছে এই জিনিসের। রটারড্যামে একটা বাচ্চা ছিল, সেটা মরে গেছে। জিনিসটা হল একটা ব্রেজিলিয়ান বাঘ।’

‘তার সঙ্গে অন্য বাঘের তফাৎ কোথায়?’

‘সেটা এখুনি দেখতে পাবে’, হেসে বলল কিং। ‘খড়খড়িটা তুলে একবার ভিতরে দেখবে কি?’

দরজার গায়ের খড়খড়ি ফাঁক করে চোখ লাগাতেই দেখলাম একটি বেশ বড় ঘর। তার মেঝেতে পাথর বসানো, তার দেয়ালের উপর দিকে শিক দেওয়া দুটি ছোট্ট জানালা। ঘরের মাঝখানে মেঝের উপর বসে রোদ পোয়াচ্ছে একটি জানোয়ার। সেটা বাঘের মতোই বড়, যদিও গায়ের রং কুচকুচে কালো। আয়তন বিশাল হলেও ভঙ্গিটা দেখে পোষা বেড়ালের কথাই মনে হয়। তার দেহের সুঠাম, পেশল গড়ন, বীর্যের সঙ্গে কমনীয়তার আশ্চর্য সমাবেশ, আমাকে এমন মুগ্ধ করল যে আমি জানোয়ারের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।

‘জাঁদরেল জানোয়ার, নয় কি?’ প্রশ্ন করল এভারার্ড।

‘নিঃসন্দেহে’, বললাম আমি। ‘এমন আশ্চর্য জানোয়ার দেখিনি কখনো।’

‘কেউ কেউ এটাকে প্যূমা বলে। কিন্তু আসলে এটা মোটেই প্যূমা নয়। এটা মাথা থেকে লেজের ডগা অবধি আঠারো ফুট। চার বছর আগে এটা ছিল দুটো ড্যাবড্যাবে হলদে চোখ বসানো একটি কালো পশমের বল। রিও নিগ্রো নদীর কাছে এক আদিম অরণ্যে একজন এটা বিক্রী করেছিল আমাকে, মা-টাকে বল্লম দিয়ে মেরে ফেলে, যদিও তার আগে এগারোটি মানুষ গেছে তার পেটে।’

‘তার মানে এরা বুঝি খুব হিংস্র হয়?’

‘এমন শয়তান, এমন রক্তপিপাসু জানোয়ার আর দুটি নেই। দক্ষিণ আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের এই বাঘের কথা বললে দেখবে তারা কিরকম চমকে ওঠে। এই জানোয়ারের চেয়ে মানুষের উপর তাদের বিশ্বাস অনেক বেশী। ইনি এখনো মানুষের রক্তের স্বাদ পাননি, কিন্তু একবার পেলে এঁর চেহারাই বদলে যাবে। এখন পর্যন্ত আমাকে ছাড়া আর কাউকে বরদাস্ত করে না ওর ঘরে। ওর পরিচর্যা করে যে লোক—বল্‌ডউইন—সেও ওর কাছে যেতে সাহস পায় না। ওর বাপ, মা দুই-ই হচ্ছি আমি।’

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ও আমাকে চমকে দিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকে আবার তৎক্ষণাৎ সেটা বন্ধ করে দিল। তার কণ্ঠস্বর শুনে বিশাল জানোয়ারটা উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুলে নিজের মাথাটা এভারার্ডের গায়ে ঘষতে লাগল, আর এভারার্ডও জানোয়ারটার গায়ে হাত বুলোতে লাগল।

‘এবার দেখি টমি বাবু, খাঁচায় ঢোক ত!’

আদেশ শোনামাত্র কৃষ্ণকায় জীবটি ঘরের এক পাশে গিয়ে একটি গরাদের ছাউনির তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসল। তারপর এভারার্ড বাইরে এসে হাতলটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে প্যাসেজে বেরিয়ে থাকা ফ্রেম-বদ্ধ লোহার শিকের সারি দেয়ালের একটা ফাটল দিয়ে বাঘের ঘরে ঢুকে ছাউনির সঙ্গে লেগে গিয়ে দিব্যি একটি খাঁচার সৃষ্টি করল। এবার এভারার্ড দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ডাকল। এই বিশেষ শ্রেণীর শ্বাপদের ঘরে যে বিশেষ গন্ধ পাওয়া যায়, এই ঘর এখন সেই গন্ধে ভরপুর।

‘এটাই ব্যবস্থা’, বলল এভারার্ড। দিনের বেলা ও সমস্ত ঘরটাতেই পায়চারি করে, রাত্রে এক পাশে খাঁচাটায় পুরে দেওয়া হয়। বাইরে থেকে হাতল ঘোরালেই খাঁচার দেয়াল সরে গিয়ে ও ছাড়া পেয়ে যায়। আর যদি তা না চাও ত ওকে ওই ভাবেই বন্দী করে রাখতে পার। উঁহু উঁহু—ওরকম কোরো না।’

আমি গরাদের মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে বাঘের গায়ে রাখতে গিয়েছিলাম, সে এক হ্যাঁচকাটানে আমার হাতটা বার করে আনল।

‘ওকে বিশ্বাস নেই। আমি যা করি, আর পাঁচজনের তা করা চলে না। সবাইকে ও বন্ধু বলে মানতে রাজি নয়। তাই না টমি? হুঁ, এবারে লাঞ্চের গন্ধ পেয়েছেন বাবু। তাই না, টমি?’

বাইরে প্যাসেজে পায়ের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে অপরিসর খাঁচাটার মধ্যে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। তার হলুদ চোখের চাহনি তীক্ষ্ণ ও অস্থির, তার লেলিহান জিভ বেরিয়ে পড়েছে হাঁ-করা মুখের অসমান দাঁতের সারির ফাঁক দিয়ে। একজন পরিচারক পাত্রে একটি মাংসখণ্ড নিয়ে ঘরে এসে গরাদের মধ্যে দিয়ে সেটাকে খাঁচার ভিতর গলিয়ে দিল। বাঘ থাবা দিয়ে আলতো করে সেটাকে তুলে নিয়ে খাঁচার এক কোণে বসে সেটার সদ্ব্যবহার করতে শুরু করল। মাংস টেনে ছেঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে রক্ত মাখা মুখটা তুলে আমাদের দিকে চাইছে। আমিও এক দৃষ্টে দেখছি এই বন্য দৃশ্য।

‘টমির উপর আমার টানের কারণটা বুঝলে ত?’ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করল এভারার্ড। ‘হাজার হোক, আমার হাতেই ত ও মানুষ। কম ঝক্কি গেছে ওকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এখানে আনতে? অবিশ্যি এখানে এসে ও ভালোই আছে। যা বলছিলাম, এই বিশেষ বাঘের এর চেয়ে ভালো নমুনা ইউরোপে আর নেই। চিড়িয়াখানার কর্তারা ওকে নেবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ছি না। যাক্ গে, আমার মনের কথা ঢের বলা হল, এবার চল টমির মতো আমরাও গিয়ে লাঞ্চ করি।’

দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা আমার এ ভাইটি তার জন্তুজানোয়ার নিয়ে এতই মস্‌গুল যে সে-জগতের বাইরে যে আর একটা জগৎ থাকতে পারে সেটা ভাবাই মুশকিল। কিন্তু সেটাও যে রয়েছে সেটা বুঝতে পারতাম তার পাওয়া টেলিগ্রামের বহর থেকে। দিনের যে কোনো সময় আসত এই টেলিগ্রাম, আর তার প্রত্যেকটি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে খুলত এভারার্ড নিজেই। একেকবার মনে হত সেগুলো হয়তো ঘোড়ার মাঠ বা স্টক মার্কেট সংক্রান্ত কোনো খবর। মোট কথা, এটা বোঝাই যেত যে এমন কিছু কারবারের সঙ্গে সে জড়িত রয়েছে যেটা ঘটছে সাফোকের বাইরে। আমি যে ছদিন ছিলাম তার মধ্যে দিনে চার খানা করে টেলিগ্রাম ত এসেইছে, একদিন এল সাতখানা।

এই ছ’ দিন এত ভালো ভাবে কেটেছে যে ভাইয়ের সঙ্গে একটা চমৎকার সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। প্রতি রাতে বিলিয়ার্ড রুমে বসে এভারার্ড তার আশ্চর্য ভ্রমণকাহিনী শোনাতো আমাকে। শুনে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হত যে আমার এই নিরীহ ভাইটিই এইসব রোমহর্ষক ঘটনার নায়ক। তার অভিজ্ঞতার পরিবর্তে আমি তাকে শোনাতাম গ্রোভনর ম্যানসন্‌সের জীবনযাত্রার খবর। তাতে সে এতই মুগ্ধ হত যে বারবার বলত একবার লন্ডনে এসে আমার বাসস্থানে কটা দিন কাটিয়ে যাবে। লন্ডনের চঞ্চল জীবনযাত্রা সম্বন্ধে দেখতাম তার একটা অদম্য কৌতুহল রয়েছে। বলাবাহুল্য এ ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো গাইড সে পাবে না।

শেষ দিনে আমি আর কথাটা না বলে পারলাম না। সরাসরি বলে দিলাম যে আমার আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, এবং সম্পূর্ণ দেউলে হতে আমার আর বেশিদিন বাকি নেই। আমি যদিও তার কাছে পরামর্শই চাইলাম, যেটা আসলে দরকার ছিল সেটা হল বেশ খানিকটা ক্যাশ টাকা।

‘কিন্তু তুমিই ত লর্ড সাদারটনের উত্তরাধিকারী, তাই না?’ প্রশ্ন করল এভারার্ড।

‘আমার ত তাই ধারণা, কিন্তু তিনি আমাকে এক কপর্দকও দেননি কখনো।’

‘জানি’, বলল এভারার্ড। ‘সে যে কত কঞ্জুস সে কথা আমি শুনেছি। সত্যি ত, তোমার অবস্থা ত বেশ কাহিল বলে মনে হচ্ছে। ভালো কথা, সাদারটনের স্বাস্থ্য এখন কেমন?’

‘ছেলেবেলা থেকেই ত শুনে আসছি সে অত্যন্ত রুগ্ন।’

‘হুঁ..তাও ট্যাঙস ট্যাঙস করে চালিয়ে যাচ্ছে। বেচারা তুমি!’

‘আমার বড় আশা ছিল তুমি সব শুনে-টুনে হয়ত কিছু—’

‘আর বলতে হবে না’, হেসে বলল এভারার্ড। ‘আজ রাত্রে এবিষয় কথা হবে। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব করব, কথা দিচ্ছি।’

আমার যে বিদায় নেবার সময় এসে গেছে তাতে আমার আক্ষেপ নেই, কারণ জানি যে এবাড়িরই একজন বাসিন্দা আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। কিং গৃহিণীর বিষদৃষ্টি আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তিনি যে আগ বাড়িয়ে আমাকে অপমান করেন তা নয়; সেখানে স্বামীর ভয় তাঁকে বেশিদূর এগোতে দেয় না। কিন্তু চরম ঈর্ষার বশে তিনি আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং গ্রেল্যান্ডসে আমার অবস্থান যাতে সব দিক দিয়ে অস্বস্তিকর হয়, সে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন না। বিশেষত শেষ দিনে তাঁর ব্যবহার এমনই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেল যে এভারার্ডের কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি না পেলে আমি সেইদিনই দুপুরের গাড়িতে রওনা দিয়ে দিতাম।

ঘটনাটা ঘটতে বেশ রাত হল। আমার আশ্রয়দাতা আজ অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি টেলিগ্রাম পেয়েছে। সেগুলো নিয়ে সে চলে গেল তার কাজের ঘরে। যখন বেরোল ততক্ষণে বাড়ির আর সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি শুনতে পেলাম সে রোজকার অভ্যাসমতো ঘুরে ঘুরে নিচের দরজাগুলো বন্ধ করছে। অবশেষে সে বিলিয়ার্ড রুমে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিল, তার স্থূল দেহ ড্রেসিং গাউনে আবৃত, পায়ে একজোড়া টার্কিশ স্লিপার। আরাম কেদারায় বসে গেলাসে পানীয় ঢেলে সে নিজের সামনে টেনে নিল; লক্ষ করলাম তাতে জলের চেয়ে হুইস্কির মাত্রাই বেশি।

‘কী রাত রে বাবা!’ মন্তব্য করল এভারার্ড।

কথাটা ভুল বলেনি। সারা বাড়িটাকে ঘিরে ঝোড়ো বাতাস বইছে, তার শব্দ যেন প্রকৃতির আর্তনাদ। জানালাগুলো থর থর করে কাঁপছে, বাইরে অন্ধকারের ফলে ঘরের হলদে বাতিগুলো অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে।

‘শুনি তোমার কাহিনী’, বললেন আমার আশ্রয়দাতা। ‘আমরা দুজনে এখন একা। এই দুর্যোগের রাতে কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না। তুমি বল, তারপর দেখি তোমার একটা হিল্লে করা যায় কিনা।’

এইভাবে উৎসাহ দেবার ফলে আমি আদ্যোপান্ত বললাম আমার ব্যাপারটা। যেসব লোকের সঙ্গে আমার কারবার, আমার পাওনাদারেরা, আমার বাড়িওয়ালা, আমার চাকর-বাকর—কেউই সে বর্ণনা থেকে বাদ পড়ল না। সঙ্গে আমার নোটবুক ছিল, সব তথ্য গুছিয়ে নিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাবে আমার শোচনীয় অবস্থাটা তাকে বুঝিয়ে দিলাম। কিন্তু দেখে খারাপ লাগল যে শ্রোতা আমার কথায় মনোযোগ দিচ্ছে না। যে দু-একটা মন্তব্য সে করছিল সেগুলো এতই মামুলি ও অপ্রত্যাশিত যে আমার সন্দেহ হল সে আদৌ আমার কথা শুনছে কিনা। মাঝে মাঝে হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে আমার কোনো উক্তির পুনরাবৃত্তি করতে বলে সে আগ্রহের একটা ভান করছিল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারছিলাম তার মন অন্য দিকে চলে গেছে। অবশেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে চুরুটের অবশিষ্টাংশ ফায়ার প্লেসে ফেলে দিয়ে সে বলল, ‘তোমায় বলি শোন—হিসেব জিনিসটা কোনদিনও আমার মাথায় ঢোকে না। তুমি বরং পুরো ব্যাপারটা একটা কাগজে লিখে ফেল, তারপর তোমার কত হলে চলে সেটাও লিখে দাও। চোখের সামনে জিনিসটা দেখতে পেলে আমার বুঝতে সুবিধা হবে।’

প্রস্তাবটা শুনে আমার ভালোই লাগল। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

‘চল এই বেলা শুয়ে পড়া যাক্। ওই শোন হলঘরের ঘড়িতে একটা বাজছে।’

‘ঘড়ির ঘণ্টা ঝড়ের গোঙানি ছাপিয়ে শোনা গেল। বাতাসের শব্দ শুনে মনে হয় যেন একটা উত্তাল নদী বয়ে চলেছে বাড়ির গা ঘেঁষে।’

‘শোবার আগে বাঘটাকে একবার দেখে যেতে চাই’, বলল এভারার্ড। ‘ঝড় জিনিসটা ও ঠিক পছন্দ করে না। তুমি আসবে?’

‘চলো’।

‘চুপচাপ শব্দ না করে এস। আর সবাই ঘুমোচ্ছে।’

পারস্যের গালিচা বিছানো হল ঘরে ল্যাম্প জ্বলছে; সে ঘর পেরিয়ে একটা দরজার মধ্যে দিয়ে গিয়ে ঢুকলাম প্যাসেজে। অন্ধকার প্যাসেজ, দেয়ালে একটি লণ্ঠন ঝুলছে। এভারার্ড সেটাকে নামিয়ে জ্বালিয়ে নিল। লোহার গরদগুলো দেখা যাচ্ছে না, বুঝলাম বাঘ এখন খাঁচায় বন্দী।

‘এস ভিতরে, বাঘের দরজা খুলে দিয়ে বলল এভারার্ড।’

ঘরে ঢোকামাত্র একটা গর্জন শুনে বুঝলাম ঝড়ে বাঘের মেজাজ বেশ বিগড়ে দিয়েছে। ল্যাম্পের কম্পমান আলোয় দেখলাম বিশাল কৃষ্ণকায় জীবটিকে, খাঁচার এক কোণে খড়ের গাদার উপর বসে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। পিছনের সাদা দেয়ালে পড়েছে তার প্রকাণ্ড ছায়া। বাঘের লেজটা মাঝে মাঝে নড়ে উঠে মেঝের খড়গুলোকে ইতস্তত ছড়িয়ে দিচ্ছে।

‘বেচারি টমির মেজাজ তেমন সুবিধের নয়’, হাতের ল্যাম্পটাকে এগিয়ে ধরে বলল এভারার্ড কিং। একটি আস্ত কেলে শয়তানের মতো দেখতে লাগে ওকে, তাই না? ওর জন্য কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা না করলে ওর মেজাজ ভালো হবে না। দেখি ভাই, একটু ধরো ত লণ্ঠনটা।’

আমি তার হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।

‘বাইরেই আছে ওর খাবার’, বলল এভারার্ড, ‘আমি এক মিনিটে ঘুরে আসছি।’ ও কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর সেই মুহূর্তে একটা ধাতব খুট্ শব্দের সঙ্গে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

শব্দটা কয়েক মুহুর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ করে দিল। আমার সর্বাঙ্গে একটা আতঙ্কের ঢেউ খেলে গেছে, একটা চরম বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় রক্ত হিম হয়ে গেছে। আমি দরজার উপর লাফিয়ে পড়লাম—কিন্তু দেখলাম ঘরের ভিতর দিকে দরজার কোনো হাতল নেই।

‘দরজা খোল!’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ‘দরজা খোল!’

‘হল্লা কোর না’, প্যাসেজ থেকে উত্তর এল—‘তোমার কাছে আলো রয়েছে ত।’

‘এ ভাবে একা বন্দী থাকতে চাই না আমি!’

‘বটে?’ একটা বিশ্রী হাসির সঙ্গে উত্তর এল। ‘বেশিক্ষণ একা থাকতে হবে না তোমায়।’

‘দরজা খোল বলছি!’ আমি আবার চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘এ ধরনের রসিকতা আমি বরদাস্ত করতে পারি না।’

এবারে একটা বিদ্রুপের হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে শুনলাম একটা যান্ত্রিক ঘড় ঘড় শব্দ। সর্বনাশ! হাতল ঘুরিয়ে লোহার ঝাঁঝরিটাকে টেনে বাইরে বার করে নিচ্ছে এভারার্ড কিং।

অর্থাৎ বাঘ আর খাঁচায় বন্দী থাকবে না।

লণ্ঠনের আলোতে দেখতে পাচ্ছি লোহার শিকগুলো ক্রমশঃ সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। শিকওয়ালা দেয়াল যেখানে ঘরের দেয়ালের সঙ্গে গিয়ে ঠেকেছিল সেখানে এর মধ্যেই প্রায় এক হাত ফাঁক দেখা দিয়েছে। মরিয়া হয়ে আমি শেষ শিকটা আঁকড়ে ধরে উল্টো দিকে টানতে লাগলাম। রাগ ও আতঙ্কে তখন আমি দিশেহারা। দরজাটা দুদিক থেকে টানার ফলে মিনিট খানেক অনড় হয়ে রইল। বেশ বুঝতে পারছি ও সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হাতলটা ঘোরাবার চেষ্টা করছে, এবং আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার শক্তি তার কাছে হার মানবে। এবার শিকটার সঙ্গে সঙ্গে আমিও হড়কাতে শুরু করেছি পাথরের মেঝের উপর দিয়ে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি এই পৈশাচিক মানুষটির হাতে যেন আমায় মরতে না হয়। অনেক অনুনয় করে তাকে বোঝালাম যে আমার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক। আমি তার অতিথি। আমি তার কী ক্ষতি করেছি যে সে আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছে।—কিন্তু জবাবে সে আরো বলপ্রয়োগ করে চলেছে হাতলের উপর, এবং একটি একটি করে লোহার শিক বেরিয়ে চলেছে ঘরের বাইরে। টানের চোটে আমিও এগিয়ে চলেছি খাঁচার সামনে দিয়ে।

অবশেষে আমার কবজি যখন যন্ত্রণায় অসাড়, আমার আঙুল ক্ষতবিক্ষত, তখন নিরুপায় হয়ে হাল ছাড়তে হল। একটা ঘটাং শব্দ করে খাঁচার দেওয়ালটা পুরো সরে গেল, আর তারপর শুনলাম টার্কিশ চটি পরা পায়ের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে প্যাসেজের শেষ প্রান্তের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর আর শব্দ নেই।

এতক্ষণ জানোয়ারটা অনড় ভাবেই বসে ছিল খাঁচার এক কোণে। তার লেজ আর নড়ছে না। তার সামনে দিয়ে একটা মানুষকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে—এ দৃশ্য নিশ্চয়ই তার ভারী অদ্ভুত লেগেছিল। তার বিশাল চোখ দুটি এখন আমার দিকে চাওয়া। শিকটা ধরার সময় লণ্ঠনটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিলাম। মনে হল সেটা হাতে থাকলে তার আলোটা হয়ত আত্মরক্ষায় কিছুটা সাহায্য করবে; কিন্তু সেটা তুলতে যেই হাত নামিয়েছি অমনি বাঘটা একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল। আমি তৎক্ষণাৎ আতঙ্কে পাথর। বাঘের থেকে আমার দূরত্ব এখন মাত্র দশ ফুট। তার চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। অদ্ভুত সে চাহনি;মনের গভীরে ত্রাসের সঞ্চার করলেও চোখ ফেরানো যায় না। চরম সংকটের মুহূর্তে প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালে মনে হয় জ্বলন্ত গোলক দুটি যেন একবার আয়তনে বাড়ছে, একবার কমছে। আবার মনে হয় যেন অন্ধকারে দুটি উজ্জ্বল বিন্দু ক্রমে বড় হতে হতে ঘরের ওই বিশেষ অংশটিতে একটা ভৌতিক আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর তার পরেই দেখি আলো নেই।

অর্থাৎ জানোয়ার চোখ বন্ধ করেছে। মানুষের অপলক দৃষ্টিতে এক অমোঘ শক্তি আছে, এমন একটা প্রচলিত ধারণায় কোনো সত্য আছে কিনা জানি না; হয়ত বা জানোয়ারটার মধ্যে একটা তন্দ্রার ভাব এসেছিল। মোট কথা, আক্রমণের কোনো চেষ্টার বদলে সেটা দিব্যি পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে বলেই মনে হয়। পাছে তার মধ্যে আবার হিংস্রভাব জেগে ওঠে, তাই আমিও সম্পূর্ণ অনড় হয়ে রইলাম। ওই ভয়ংকর চোখ দুটো আমার চোখের সামনে না থাকায় এখন তবু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে পারছি। এই পৈশাচিক জানোয়ারের সঙ্গে সারারাত সহবাস করতে হবে আমাকে। আমার নিজের মন বলছে, এবং যার জন্য আমার এই দশা তার কথাতেও বুঝেছি, যে এই জানোয়ার তার মনিবের মতোই মারাত্মক। কাল সকাল পর্যন্ত একে ঠেকিয়ে রাখব কী করে? দরজা ত খুলবেই না, আর ওই শিকওয়ালা খুপ্‌চি জানালাও আমার কোনো কাজে আসবে না। ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে তারস্বরে চেঁচিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ আমি এখন যে অংশটাতে রয়েছি সেটা বাড়ির বাইরে; সেই বাড়ি আর ব্যাঘ্রাবাসের মধ্যে যে প্যাসেজটা রয়েছে সেটা প্রায় একশো ফুট লম্বা। তাছাড়া এই ঝড়বাদলের শব্দের মধ্যে আমার চীৎকার শুনবে কে? একমাত্র ভরসা আমার সাহস ও উপস্থিতবুদ্ধি।

ঠিক এই মুহূর্তে আমার অসহায়ভাব দ্বিগুণ বেড়ে গেল লণ্ঠনের দিকে চোখ পড়াতে। বাতির যে এখন শেষ অবস্থা সেটা শিখার অস্থিরতা থেকেই বোঝা যায়। এর আয়ু আরো দশ মিনিট। যা করার এর মধ্যেই, কারণ অন্ধকারে ওই জানোয়ারের সঙ্গে একা পড়লে তখন আর সুস্থমস্তিষ্কে কিছু করার অবস্থা থাকবে না। কথাটা ভাবতেই আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে এল। দিশেহারা ভাবে এদিক ওদিক চাইতে একটা জিনিসের উপর চোখ পড়াতে একটা ক্ষীণ আশার উদ্রেক হল। এতে সংকট থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি না পেলেও, অন্তত সাময়িক নিরাপত্তার একটা সম্ভাবনা আছে।

আগেই বলেছি যে খাঁচার দুটো অংশ ছিল—একটা ছাত ও একটা সামনের দেয়াল। দেয়ালটা বাইরে বার করে নিলেও, ছাতের অংশটা ভিতরেই থেকে যায়। এই ছাতেও কয়েক ইঞ্চি অন্তর অন্তর একটা করে লোহার শিক, আর শিকের মধ্যের ফাঁকগুলো ভরা লোহার জাল দিয়ে। সেই আচ্ছাদনের নিচে খাঁচার এক কোনায় এখন বসে আছে বাঘটা। খাঁচার ছাত আর ঘরের সীলিং-এর মধ্যে হাত দুয়েকের ব্যবধান। যদি কোনোরকমে ওই ছাতের উপর উঠতে পারি, তাহলে অন্তত পিছন থেকে, মাথার দিক থেকে, আর দুপাশ থেকে আমি নিরাপদ। খোলা থাকবে শুধু সামনের দিকটা। সেদিক থেকে বাঘ আমায় আক্রমণ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু তাহলেও বলব যে বাঘ যদি হঠাৎ ঘরে পায়চারি শুরু করে তাহলে আমাকে তার সামনে পড়তে হবে না। আমার নাগাল যদি তাকে পেতে হয় তাহলে কিছুটা কসরৎ করতে হবে। যা করার এই বেলা, কারণ বাতি নিভে গেলে কাজটা আমার পক্ষে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়বে।

যা থাকে কপালে করে এক লাফে ছাউনির পাশটা দুহাতে খামচে ধরে দেহটাকে কোনমতে উপরে নিয়ে গিয়ে ফেললাম। আমার মুখ তখন দুই শিকের মাঝখানে জালের উপর; দেখতে পাচ্ছি বাঘের মুখ হাঁ, আর তার ভয়ংকর চোখ দুটো চেয়ে আছে সটান আমার দিকে, তার নিশ্বাসের বোঁটকা গন্ধে আমার নাক জ্বলছে।

জানোয়ারের ভাব দেখে কিন্তু মনে হল রাগের চেয়ে তার কৌতূহলটাই যেন বেশি। এবারে সে তার দেহের মাংসপেশিতে ঢেউ খেলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনের দুপায়ে ভর করে একটা থাবা পিছনের দেয়ালে রেখে অন্যটা দিয়ে খাঁচার ছাতের জালের উপর দিয়ে একটা লম্বা আঁচড় টানল। তার ফলে তার একটা নখ আমার পাৎলুন ভেদ করে আমার হাঁটুতে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করল। এটাকে আক্রমণ বলা চলে না, বরং আক্রমণের মহড়া মাত্র, কারণ আমার আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে সে থাবা নামিয়ে নিয়ে এক লাফে খাঁচা থেকে বেরিয়ে সারা ঘর জুড়ে দ্রুত পায়চারি শুরু করে দিল। তারই ফাঁকে ফাঁকে তার দৃষ্টি বার বার চলে আসছে আমার দিকে। আমি দেহ সঙ্কুচিত করে নিজেকে একেবারে দেয়ালের সঙ্গে সিঁটিয়ে দিলাম। যত পিছিয়ে থাকব, ততই তার পক্ষে আমার নাগাল পাওয়া কঠিন হবে।

বাঘের উত্তেজনা যেন ক্রমেই বাড়ছে, হাঁটার গতিও বাড়ছে সেই সঙ্গে, তার অস্থির পদক্ষেপ বার বার তাকে নিয়ে আসছে আমার লৌহাসনের ঠিক নিচে। আশ্চর্য এই ছায়াসদৃশ বিশাল শ্বাপদের নিঃশব্দ গতি। এদিকে লণ্ঠনের আলো এতই মৃদু যে তাতে বাঘকে প্রায় দেখাই যায় না। অবশেষে একবার দপ্ করে জ্বলে উঠে লণ্ঠনটা নিভেই গেল। সূচিভেদ্য অন্ধকারে এখন শুধু আমি আর বাঘ।

বিপদের সামনে পড়ে যদি বুঝতে পারি যে আমার যথাসাধ্য আমি করেছি, তাহলে শুধু পরিণতির অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। বর্তমান ক্ষেত্রে আমি যেখানে যে অবস্থায় আছি, সেটাই হল আমার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। আমি সেই ভাবেই হাত-পা গুটিয়ে প্রায় দম বন্ধ করে পড়ে রইলাম। আশা আছে আমার অস্তিত্ব জানান না দিলে বাঘ হয়ত আমার কথা ভুলে যাবে। আন্দাজে মনে হয় দুটো বাজতে চলল। ভোর হবে চারটায়। দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো দু ঘণ্টা।

বাইরে ঝড় চলেছে পুরোমাত্রায়। বৃষ্টির জল এসে আছড়ে পড়ছে জানালার গায়ে। ঘরের ভিতরে বিষাক্ত জান্তব গন্ধে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। বাঘ এখন আমার কাছে অদৃশ্য। তার কোনো শব্দও আসছে না আমার কানে। আমি বাঘের চিন্তা মন থেকে দূর করে অন্য কথা ভাবার চেষ্টা করলাম। একটি চিন্তাই স্থান পেল মনে; সেটা হল আমার খুড়তুতো ভাইটির শয়তানী, তার চরম বিশ্বাসঘাতকতা, আর আমার প্রতি তার গভীর বিদ্বেষের ভাব। ওই গালভরা হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে এক নৃশংস খুনী। যতই ভাবলাম, ততই তার পরিকল্পনার চাতুরীটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এল। সকলের সঙ্গে সেও চলে গিয়েছিল শুতে, তারপর গোপনে ফিরে এসে আমাকে তার বাঘের ঘরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রেখে চলে যায়। অত্যন্ত সহজেই সে ঘটনাটা বুঝিয়ে দেবে আর পাঁচজনকে বিলিয়ার্ড রুমে বসে চুরুটটা শেষ করে তবে আমি উঠব; সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুডনাইট করে চলে যায়। আমি নিজের খেয়াল বশত দিনের শেষে একবার বাঘটা দেখতে যাই, খাঁচা খোলা আছে না জেনে ঘরে ঢুকি, আর তার ফলেই ফাঁদে পড়ি। এর জন্য তাকে দায়ী করবে কে? আর যদি বা তার উপর সন্দেহ হয়—প্রমাণ ত নেই।

দু ঘণ্টা সময় যেন কাটতেই চায় না। একবার একটা খস্ খস্ শব্দে বুঝলাম বাঘ তার নিজের গায়ের লোম চাটছে। বার কয়েক একজোড়া সবুজ আলো দেখে মনে হল সে আমার দিকে চাইছে, কিন্তু তাও বেশিক্ষণের জন্য নয়। ক্রমে একটা বিশ্বাস দানা বাঁধতে লাগল যে সে হয়ত আমার অস্তিত্ব ভুলে গেছে; কিম্বা আমাকে অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশেষে জানালা দিয়ে একটা ক্ষীণ আলো ঘরে প্রবেশ করল। প্রথমে দেখলাম দেয়ালের গায়ে এক জোড়া ধূসর চতুষ্কোণ; তারপর সেদুটো ক্রমে সাদায় পরিণত হল; তারপর আমার সহবাসিন্দাটি প্রতীয়মান হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম বাঘও আমার দিকে চেয়ে আছে।

দৃষ্টি বিনিময়ের পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম যে শেষ দেখার সময় যা মনে হয়েছিল, বাঘের মেজাজ তার চেয়ে শত গুণে বেশি ভয়ংকর। ভোরের শীত তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না; তার উপর সে হয়ত ক্ষুধার্ত। ঘরের ওপাশটায় অনবরত গর্জনের সঙ্গে সে দ্রুত পায়চারি করছে। পাথরের মেঝের উপর বার বার আছড়ে পড়ছে তার লেজ। কোণ অবধি গিয়ে উল্টো মুখে ঘোরার সময় তার নির্মম দৃষ্টি চলে আসছে আমার দিকে। বুঝতে পারলাম আমাকে সে আস্ত রাখবে না। কিন্তু এই রকম হতাশার মুহূর্তেও এই ভয়াল পশুর গতিবিধির আশ্চর্য সাবলীলতা, তার পেশল দেহের ভাস্কর্যসুলভ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ না করে পারল না। এদিকে চাপা গর্জন ক্রমে অসহিষ্ণু হুঙ্কারে পরিণত হচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছি আমার অন্তিম সময় উপস্থিত।

এই ভাবেই কি শেষে মরতে হবে—এই লোহার গরাদের উপর শুয়ে শীতে কম্পমান অবস্থায়? আমার অন্তরাত্মাকে এই শোচনীয় অবস্থার ঊর্ধ্বে উত্তরণের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে, একজন মুমূর্ষ ব্যক্তির চিন্তায় যে সচ্ছলতা আসে তার সাহায্যে ভাবতে চেষ্টা করলাম আত্মরক্ষার কোনো উপায় আছে কিনা। ভেবে একটা জিনিসই মনে হল, যে খাঁচার দেয়ালটা যদি কোনোরকমে বাইরে থেকে আবার ভিতরে এনে বসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেটাই হবে বাঁচার একমাত্র পথ। ওটাকে কি টেনে আনা যায়? এদিকে এও বুঝতে পারছি যে অঙ্গ সঞ্চালনার সামান্য ইঙ্গিতেই বাঘ হয়ত আমাকে আক্রমণ করে বসবে।

অত্যন্ত সন্তর্পণে ডান হাতটা বাড়িয়ে খাঁচার দেয়ালের যে দিকটা ঘরের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল সেটাকে ধরলাম। আশ্চর্য এই যে, একটা টান দিতেই সেটা খানিকটা এগিয়ে এল আমার দিকে। কিন্তু আমি যে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি তাতে খুব বেশি জোর দিয়ে টানা সম্ভব নয়। আরেকবার টান দিতে ইঞ্চি তিনেক ঢুকে এল দেয়ালটা। এবার বুঝলাম দেয়ালের তলায় চাকা লাগানো রয়েছে। আরেকবার দিলাম টান—সেই মুহূর্তেই বাঘটা দিল লাফ।

ব্যাপারটা এত আচমকা ঘটল যে আমি টেরই পাইনি। শুধু কানে এল একটা হুঙ্কার, আর সেই সঙ্গে আমার চোখের সামনে দেখলাম এক জোড়া জ্বলন্ত হলুদ চোখ ও মিশকালো মুখে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরোন একটা লক্লকে লাল জিভ। বাঘ লাফিয়ে পড়ার ফলে আমার লৌহাসন থর থর করে কেঁপে উঠেছে—মনে হয় এই বুঝি সবসুদ্ধ ভেঙে পড়ল। বাঘটা কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় রইল, তার মাথা ও সামনের থাবা আমার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে, আর পিছনের থাবা খাঁচার দেয়ালে একটা অবলম্বন খোঁজার চেষ্টায় অস্থির। কিন্তু লাফটা ঠিক যুৎসই হয়নি। বাঘ সেই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। প্রচণ্ড রাগে দাঁত খিচিয়ে জালে আঁচড় দিতে দিতে সে সশব্দে লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে। কিন্তু তার পরেই আবার আমার দিকে ফিরে দ্বিতীয়বার লম্ফের জন্য প্রস্তুত হল।

আমি জানি আমার চরম পরীক্ষার সময় উপস্থিত। বাঘ একবার ঠেকে শিখেছে, দ্বিতীয়বার আর সে ভুল করবে না। আমার বাঁচতে হলে যা করার তা করতে হবে এই মুহূর্তে। এক ঝলকে পন্থা স্থির করে নিলাম। চোখের নিমেষে আমার কোটটা খুলে নিয়ে সেটাকে জানোয়ারটার মাথার উপর ছুঁড়ে ফেললাম, আর প্রায় একই মুহূর্তে এক লাফে খাঁচার ছাত থেকে লাফিয়ে নেমে দেয়ালের শিকটা ধরে প্রাণপণে দিলাম টান।

যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক সহজেই দেয়ালটা ঘরের মধ্যে চলে এল। আমি যত দ্রুত সম্ভব সেটাকে খাঁচার অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে গেলাম, কিন্তু সেইভাবে টানার ফলে আমি নিজে রয়ে গেলাম খাঁচার বাইরে। ভিতরে থাকলে হয়ত আমি রেহাই পেতে পারতাম, কিন্তু সেটা করার চেষ্টায় আমাকে যে কয়েক মুহূর্ত থামতে হল তাতে বাঘটা তার মাথা থেকে কোটটা ফেলে দিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি খাঁচার সামনেটা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে এসেছি, কিন্তু তার আগে বাঘটা তার থাবার এক চাপড়ে আমার পায়ের ডিমের বেশ খানিকটা অংশ তুলে নিয়েছে র‍্যাঁদা দিয়ে চাঁছা কাঠের মতো করে। পরমুহূর্তেই যন্ত্রণায় প্রায় বেহুঁশ হয়ে আমি খাঁচার ভিতরে খড় বিছানো মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম। আমার সামনে খাঁচার গরাদ, আর তার উপর নিষ্ফল ক্রোধে বার বার আঘাত করছে ব্রেজিলের বাঘ। অর্ধমৃত অবস্থায় আমার মন থেকে আতঙ্কের ভাব দূর হয়ে গেছে, আমি সামনের দিকে চেয়ে দেখছি বাঘ তার কালো বুকটা গরাদের উপর রেখে তার থাবা দিয়ে আমার নাগাল পাবার চেষ্টা করছে, ঠিক যেমন কলে ধরা-পড়া ইঁদুরের নাগাল পেতে চেষ্টা করে বেড়াল। আমার জামায় এসে ঠেকছে তার নখগুলো, কিন্তু গায়ের চামড়া পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। শুনেছিলাম বাঘ বা ওই জাতীয় জানোয়ারের দ্বারা জখম হলে মানুষের মধ্যে কেমন যেন একটা অসাড় ভাব আসে। সেটা এখন দিব্যি অনুভব করছি। আমি যেন আর আমি নই, কোনো এক তৃতীয় ব্যক্তি যেন কৌতূহলের সঙ্গে দেখে চলেছে বাঘটা তার চেষ্টায় কৃতকার্য হয় কিনা। তারপর ক্রমে আমার চেতনা লোপ পেয়ে আমি যেন এক দুঃস্বপ্নের জগতে চলে গেলাম, যেখানে আমার চোখের সামনে রয়েছে কেবল বাঘের সেই কালো মুখ আর তার থেকে বেরিয়ে আসা লক্‌লকে লাল জিভ। সব শেষে আমার লাঞ্ছনার শেষ হল এক মোহাচ্ছন্ন প্রলাপের অবস্থায়।

এখন ভাবলে মনে হয় আমি অন্তত ঘণ্টা দুই এই ভাবে অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। জ্ঞান হল সেই তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দে, যাতে আমার বিপদের সূত্রপাত। খাঁচার দেয়াল আবার বাইরে বেরিয়ে তার খাপে বসল। তারপর সম্পূর্ণ জ্ঞান হবার আগেই দেখলাম আমার ভাইয়ের সেই গোল হাসিভরা মুখ খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি মারছে। সে যা দেখল তাতে সে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিল। বাঘ বসে আছে খাঁচার বাইরে ঘরের মেঝেতে, আর আমি ছিন্নভিন্ন পাৎলুনে কোটবিহীন অবস্থায় রক্তাপ্লুত দেহে পড়ে আছি খাঁচার ভিতর। সকালের রোদ পড়া মুখে তার চরম বিস্ময়ের ভাবটা এখনো দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। সে একবার দেখল আমার দিকে, তারপর আবার। তারপর ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাঁচার দিকে এগিয়ে এসে আবার দেখল আমি সত্যি মরে গেছি কিনা।

ঘটনার সঠিক বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন যা অবস্থা তাতে সব কিছু সম্যক্ অনুধাবন করার সামর্থ্য ছিল না আমার। শুধু এইটুকু দেখলাম যে তার দৃষ্টিটা হঠাৎ আমার দিক থেকে সরে গিয়ে গেল বাঘের দিকে।

‘সাবাস, টমি, সাবাস!’ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল এভারার্ড কিং।

তারপর সে হঠাৎ খাঁচার দিকে পিছিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠল—‘সরে যাও বলছি, সরে যাও! মূর্খ জানোয়ার—তোমার মনিবকে চেনো না তুমি?’

এই মুহ্যমান অবস্থাতেও কিং-এর একটা উক্তি আমার হঠাৎ মনে পড়ল। মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে নিরীহ জানোয়ারও রাক্ষসে পরিণত হয়। এই পরিণতির জন্য আমার রক্তই দায়ী, কিন্তু তার মাশুল দিতে হবে আমাকে নয়, আমার এই ভাইটিকে।

‘সরে যাও বলছি!’ চীৎকার করে উঠল এভারার্ড কিং। ‘সরে যাও শয়তান!—বল্ডউইন! বল্ডউইন!—ওরে বাবা রে!’……

তারপর দেখলাম সে মাটিতে পড়ল। পড়ল, উঠল, আবার পড়ল, আর সেই সঙ্গে এক রক্ত-হিমকরা শব্দ—যেন কাপড় ছেঁড়া হচ্ছে ফালা ফালা করে। আর্তনাদের শব্দ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এসে শেষে যে শব্দটা রইল সেটা মানুষের নয়, জানোয়ারের। আর তারপর, যখন ভাবছি সে মরে গেছে, তখন এক বিভীষিকাময় মুহূর্তে দেখলাম একটি অর্ধমৃত, প্রায়ান্ধ, রক্তাক্ত মানুষ পাগলের মতো ঘরের-চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। তারপর আমিও সংজ্ঞা হারালাম।

বেশ কয়েক মাস লেগেছিল আমার সুস্থ হয়ে উঠতে। সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি, কারণ সেই ব্রেজিলীয় শার্দুলের সঙ্গে রাত্রিযাপনের চিহ্নস্বরূপ আজও আমাকে একটি লাঠি হাতে চলতে হয়। বল্ডউইন, বাঘের পরিচারক এবং অন্যান্য চাকরবাকর যখন এভারার্ডের আর্তনাদ শুনে বাঘের ঘরে এসে খাঁচার মধ্যে আমায় এবং বাঘের কবলে তাদের মনিবের অবশিষ্টাংশ দেখতে পায়, তখন কেমন করে এ ঘটনা ঘটল সেটা তারা অনুমান করতে পারেনি। তপ্ত লোহার শিকের সাহায্যে বাঘকে কোণঠাসা করে দরজার ফাঁক দিয়ে গুলি করে তাকে মেরে আমাকে খাঁচার ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে শোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। তারপর বেশ কয়েক সপ্তাহ আমার শত্রুর বাড়িতে থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হয়েছিল আমাকে। ক্লিপটন থেকে এসেছিলেন এক সার্জন, আর লন্ডন থেকে নার্স। এক মাস পরে আমাকে পৌঁছে দেওয়া হয় স্টেশনে, আর সেখান থেকে আমি চলে আসি আমার বাসস্থান গ্রোভনর ম্যানসন্‌সে।

আমার অসুখের সময়ের একটা ঘটনা আমার মনে আছে। অত্যন্ত স্পষ্ট হওয়াতে এই স্মৃতিটাকে আমার স্বরবিকারজনিত দুঃস্বপ্নের অঙ্গ বলে মনে হয় না। এক রাত্রে—নার্স তখন আমার ঘরে নেই—দরজা খুলে প্রবেশ করলেন এক দীর্ঘাঙ্গিনী, তাঁর পরনে বিধবার কালো পোষাক। তিনি কাছে এসে আমার উপর ঝুঁকে পড়াতে দেখলাম এভারার্ড যে ব্রেজিলীয় মহিলাটি বিবাহ করেছিল, ইনি তিনিই। তাঁর চাহনিতে যে করুণা ও সহানুভূতি দেখলাম, তেমন আর কোনোদিন দেখিনি।

‘আপনার জ্ঞান আছে?’ জিগ্যেস করলেন মহিলা।

আমি তখন খুবই দুর্বল, তাই মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালাম।

‘আমি এইটুকু বলতে এসেছি যে আপনার এই দুর্দশার জন্য আপনিই দায়ী। আমি ত চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। প্রথম থেকেই চেয়েছিলাম যাতে আপনি না থাকেন। আপনি যাতে তাঁর কবলে না পড়েন তার জন্য আমার স্বামীকে বঞ্চনা না করে যতটা করা সম্ভব সবই করেছিলাম আমি। আমি জানতাম সে আপনাকে কেন ডেকে এনেছিল। আমি জানতাম সে আর কোনোদিন আপনাকে ফিরে যেতে দেবে না। আমি যত ভালো করে চিনতাম তাঁকে, তেমন ত আর কেউ চিনত না! আমি নিজে যে ভুক্তভোগী! সে কথা ত আর আপনাকে বলা যায় না। কিন্তু আপনার যাতে মঙ্গল হয় তার চেষ্টার ত্রুটি করিনি আমি। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে আপনি আমার বন্ধুর কাজ করেছেন। আমি ভাবতাম আমার মৃত্যু না হলে আমার মুক্তি নেই, কিন্তু আপনি আমার মুক্তি দিয়েছেন তাঁর কবল থেকে। আপনার এত কষ্টভোগ করতে হল বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি ত বলেইছিলাম—আপনি মূর্খ, এবং মূর্খের মতোই কাজ করেছিলেন আপনি।’

কথাটা বলে চলে গেলেন সেই আশ্চর্য মহিলা, যাঁকে আর কোনদিন দেখিনি আমি। স্বামীর সম্পত্তি থেকে তাঁর যা প্রাপ্য তাই নিয়ে তিনি দেশে ফিরে গিয়েছিলেন, এবং পরে নাকি সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়েছিলেন।

লণ্ডনে ফেরার বেশ কিছুদিন পরে ডাক্তার আমাকে জানালেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, এবং আবার কাজ শুরু করতে পারি। কথাটা শুনে আমার মনটা যে খুব প্রসন্ন হল তা নয়, কারণ কাজ মানেই পাওনাদারের স্রোত রোধ করার চেষ্টা। আসল খবরটা প্রথম দিল আমার উকীল সামার্‌স।

‘আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন এটা খুবই আনন্দের কথা’, বলল সামার্‌স। ‘আপনাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি।’

‘অভিনন্দন? তুমি কী বলছ সামার্‌স! মসকরা করার সময় নয় এটা।’

‘যা বলছি ঠিকই বলছি’, বলল সামার্‌স। ‘গত দেড় মাস হল আপনি লর্ড সাদারটন হয়েছেন। পাছে অসুস্থ অবস্থায় খববটা পেলে আপনার রোগমুক্তিতে ব্যাঘাত ঘটে তাই এতদিন বলিনি।’

লর্ড সাদারটন! ইংলন্ডের অন্যতম সবচেয়ে বিত্তবান অভিজাত বংশের প্রতিভূ। আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর মনে পড়ল যে অনেকটা সময় ত পেরিয়ে গেছে এর মধ্যে, আর আমি ত এই সময়টা ছিলাম শয্যাশায়ী। বললাম, ‘তাহলে লর্ড সাদারটন মারা গেছেন আমি অসুস্থ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই?’

‘ঠিক সেই একই দিনে’, আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল সামার্‌স। সে বুদ্ধিমান লোক, সে কি আর অনুমান করতে পারেনি আমার দুর্দশার কারণটা? কিন্তু আমি তাকে কিছু বললাম না। তার কাছে আগ বাড়িয়ে পারিবারিক কুৎসা রটাতে যাব কেন?

‘হুঁ, ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্য,’ আমার দিকে সেই একই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে বলল। ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আপনার অবর্তমানে এই এভারার্ড কিংই পেতেন ওই খেতাব। তিনি না হয়ে আপনি যদি ওই বাঘের কবলে পড়তেন তাহলে উনিই হতেন লর্ড সাদারটন।’

‘তা ত বটেই’, বললাম আমি।

‘আর ভদ্রলোক এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন’, বলল সামার্‌স। ‘আমি জানি লর্ড সাদারটনের চাকরের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল, আর সেই চাকর ঘন ঘন টেলিগ্রাম করে কিংকে জানাত তার মনিবের অবস্থা। সেই সময়টা আপনি ছিলেন কিং-এর বাড়িতে। আপনি উত্তরাধিকারী, অথচ বার বার সে খোঁজ নিচ্ছে লর্ড সাদারটনের—ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত নয় কি?’

‘নিঃসন্দেহে’, বললাম আমি। ‘আর শোন, সামার্‌স—এবার ত কাজকর্ম শুরু করে দিতে হয়। দাও ত দেখি আমার বিলগুলো আর আমার নতুন চেক বইটা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *