ব্রিফকেস রহস্য – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
অবস্থা বিপাকে তখন আমি জোড়ামন্দিরের কাছে এক পিসির আশ্রয়ে আছি। চাউলপট্টি রোডে কিছু কুঁড়েঘর নিয়ে একটা বস্তিতে বাস। সি আই টি রোড তখনও হয়নি। দেশভাগের কিছু পরের সময়। একটা কুঁড়েঘর আর বারান্দায় পিসি আর তাঁর ছেলেমেয়েরা, একটা ঘরে পিসেমশাই এবং আমি। আশপাশে ডোবা আর কচুরিপানার জঙ্গল। ছোট্ট বস্তিটা ডোবা, জল, জঙ্গল আর মশার উপদ্রবে ঘিঞ্জি হয়ে থাকত।
মেন রোডে উঠতে হলে সরকার বাড়ির মাঠ ডাইনে ফেলে কুলগাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা পোড়োবাড়ি ডিঙিয়ে যেতে হত। পোড়োবাড়িটা বড়ো রাস্তার ধারে দরজা-জানলা নেই বললেই চলে। ভাঙা পাঁচিল, এবং নোনাধরা ইটের গা বেয়ে নানাবিধ লতাগুল্ম। পিসির ফুটফরমাশ সকালবেলা থেকেই শুরু।
‘যা, কাঁচালঙ্কা নিয়ে আয়।’ দৌড়ে যেতাম। কখনও পোড়োবাড়ির ভিতর দিয়ে, কখনও সরকারবাড়ির মাঠের ওপর দিয়ে। সকালে মাঠে ফুটবল খেলা হত। বিকেলেও। সকালবেলাতেই পিসির ফুটফরমাশের চাপ থাকত বেশি। পিসের অফিসের রান্না—রান্না বসিয়ে হাতের কাছে সবসময় সবকিছু জোগাড় থাকত না। পিসির রান্নার হাত ছিল ভারি সুন্দর। শীতের দিনে কইমাছ মুলো দিয়ে ঝোল। বড়ি নেই। ‘যা, বড়ি আন। যা, ধনে পাতা নিয়ে আয়।’
খুচখাচ কাজে আমাকে পড়া ফেলে ছুটতে হত। মাঠে ফুটবল খেলা থাকলে পোড়োবাড়িটা পার হয়ে জোড়ামন্দিরের বাজারে ছুটতাম। মাঠে ঢুকলে তাড়া খাব ‘ক্যা রে।’ বলে তেড়ে এসেছিল একবার গাট্টাগোট্টা কয়েকটা ছেলে। সেই থেকে সকাল-বিকেলে বাজারে যেতে হলে মাঠের পাশ দিয়ে পোড়োবাড়িটা পার হয়ে যাই। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, কলোনি থেকে কলকাতায় পড়তে আসা। সবকিছুকেই সমীহ করি, ভয় পাই, পায়ে পাতা ঠেকলেও কপালে হাত ঠেকাই।
পোড়োবাড়িটার সামনেই বাসস্টপ। কলেজে যাওয়ার সময় সেও মাঝে মাঝে বের হয়ে আসত পোড়োবাড়িটা থেকে। একই সঙ্গে পাশাপাশি কতদিন ফিরেছি। কিন্তু কোনও কথা হয়নি। অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতাম। পাছে কী বলতে কী বলে ফেলি। আর কথা বলার আছেই বা কী। কলকাতার জনারণ্যে কে কার খোঁজ রাখে। কে যেচে কার সঙ্গে কথা বলে। পিসির বাড়িতে খুব যে ভালো ছিলাম, বলা যায় না। পিসির মন জুগিয়ে চলতে হত। ভাইবোনেরা আমাকে হ্যাটাও করত। পিসি তখন কুপিত হতেন। বাসভাড়া দেন, ফেরার পয়সাও। পিসে খোঁজখবর নিচ্ছেন কোথাও টিউশনি পাওয়া যায় কি না। যতই হ্যাটা করুক, বলার কিছু ছিল না। সবই গা-সওয়া হয়ে গেছিল। নিজের পড়া, ভাইবোনদের পড়া দেখিয়ে দেওয়া এবং সব সময় অস্বস্তি, কখন না কে নালিশ করে বসে। নালিশ যে করত না, তাও নয়। তবে পিসি পাত্তা দিতেন না। পিসির এক অভিযোগ, ‘তোরা বড়ো ওকে হ্যাটা করিস।’
আসলে আমার মনে হত, এতটা যিনি করছেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের উপদ্রব সহ্য করা আমার একটা দায়। আর যখন উপদ্রব চরম সীমায়, যেমন কেউ চুল ধরে টানছে, খামছি দিয়ে পালাচ্ছে, চিমটি কাটছে—আমাকে একা পেলেই হল—তখন বড়ো অভিমান হত। চোখে জল আসত। নিজের ভাইবোনগুলোর জন্য মন খারাপ হত। বাড়ির জন্য বড়ো উতলা হয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে কথা নেই বার্তা নেই, পিসিকে বলতাম, ‘বাড়ি যাব।’ ‘বাড়ি যাবি, টাকা পাবি কোথায়? মাসের শেষ।’
কিন্তু এই একটা ভুতুড়ে ঝোঁক আছে আমার। মন বাড়ির নামে কাতর হলে কে আটকায়। যা হয় হবে, বাড়ি যখন যাব ঠিক করেছি, টাকার জন্য আটকাবে না।
বলতাম, ‘হয়ে যাবে।’ হয়ে যাবে মানে বিনা টিকিটে রওনা দেওয়া। কোনওরকমে শিয়ালদায় যেতে পারলেই হল। রেলে চড়ে বসতে পারলেই হল। হাফপ্যান্ট-হাফশার্ট গায়, প্রায় বালকই বলা চলে, কামরা বদল করে, কিংবা রিফিউজির দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যেতাম। মন যখন উড়ে গেছে, পিসি নানা অসুবিধার কথা বলেও আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না জানেন। রাত সাড়ে আটটায় ধরতে পারলে দুটো-আড়াইটে লেগে যাবে বাড়ি পৌঁছতে। সঙ্গী পেলে ভালো, না পেলে, প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকো। সকাল হলে বাড়ি ফেরা। যেন এক আশ্চর্য মুক্তি ঘটে যাবে। মা, ভাই, বোন, বাবার কাছে ফেরার আনন্দ আমাকে কিছুটা অবিবেচকও করে রাখত। পিসি রেগে গিয়ে বলতেন, ‘যা খুশি কর। আমি কিচ্ছু জানি না।’
খুবই দমে যেতাম পিসির কথায়। ভালো ছেলে বলে বদনামও কম না আমার। সেই যদি পিসির মুখরক্ষা না করে, তবে আর কিছু করার থাকে না। তার দস্যি সন্তানসন্ততির উপদ্রব সহ্য না করতে পেরেই পালাচ্ছি, এমনও ভাবতে পারেন। এতে পিসি খাটো হয়ে যেতে পারেন। মুখ গোমড়া করে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকত না।
পিসি আবার গোমড়া মুখ একদম সহ্য করতে পারতেন না। ‘কাল গেলে হয় না?’ চুপ করে থাকতাম।
‘রাতের ট্রেনে যাবি, চিন্তা হয় না?’ ‘আমার কিছু হবে না।’ ‘তুই ভাড়া পাবি কোথায়?’
‘ভাড়া লাগে না। রিফিউজি বললে কিছু বলে না। টিকিটও চায় না।’ ‘যা তবে। সাবধানে যাস।’
তারপরই আর আমাকে পায় কে। আট আনা পকেটে সম্বল করে সাইড ব্যাগে জামা-প্যান্ট ভরে, চুল পাট করে কেডস জুতো পরে সেই পোড়োবাড়িটার সামনে। সাঁঝ লেগে আছে। রাতের ট্রেন ধরব। ভিড় থাকে বেশ। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। বাসের অপেক্ষায় আছি। এলেই উঠে পড়ব। পাশ থেকে গলাখাঁকার দিল কে।
দেখি সেই পোড়োবাড়ির লোকটা। হাতে ব্রিফকেস, ধূসর রঙের জামা গায়, সাদা প্যান্ট, পায়ে শু, চেনা লোক—আমার সঙ্গে বাসে উঠে গেল। কৌতূহল থাকার কথা না। কোথাও যাবে। রোজই তো যায়।
লোকটি বাসে সিট পেয়ে গেল। পেছনের দিকে গিয়ে বসেছে। তারপরই হাত তুলে আমাকে ডাকছে। ডাকতেই পারে, আমরা পরস্পরকে চিনি। আমি যে চাউলপট্টি রোডে একটা টিনের বাড়িতে থাকি, তাও বোধহয় জানে। কাছে গেলে বলল, ‘বোসো। জায়গা হয়ে যাবে।’ বলে নিজে সামান্য সরে বসল। কিছুটা ফাঁকা জায়গা, তবে একজন লোকের মতো বসার জায়গা আদৌ নেই। বরং গুঁজে দেওয়া যায় কাউকে। আমাকেও ফাঁকা জায়গাটায় গুঁজে দেওয়া যাবে ভেবেই বসতে বলছে। বসার পর মনে হল, কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কোথায় যাব জানতে চাইলে বললাম, ‘বাড়ি যাচ্ছি।’ বাড়ি কোথায়, কোন স্টেশনে নামব, লোকটা সবই এক সময় জেনে নিল।
আর কোনও কথা না। লোকটি জানলার বাইরে চোখ রেখে বসে আছে। রাসমণি বাজারের কাছে বাস থামতেই লোকটি কেন যে উসখুস করতে থাকল। যেন বসতে তার অসুবিধে হচ্ছে। সরে বসার চেষ্টা করলাম। যদি এতে লোকটির বসতে সুবিধে হয়। কিন্তু সেকেন যে উঠে পড়ল। আমার কাছে ভারী ব্রিফকেসটি গচ্ছিত রেখে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। আর দেখলাম, সিটে এতটুকু জায়গা নেই। আমারই উচিত উঠে পড়া। উঠতে যাচ্ছিলামও, কিন্তু হাতের ইশারায় আমাকে দমিয়ে দিল।
বেশ তো বসে ছিল। সহসা দুম করে উঠে পড়লই বা কেন। কোনও অসুবিধে ছিল না বসার। ছ-জনের সিট। গুনে দেখলাম আমরা ছ-জনই বসে আছি। আর একজনের বসার বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। কেউ উঠেও যায়নি। বাস থেকে নেমেও যায়নি। তবু লোকটি উঠে যাওয়ায় জায়গা বিন্দুমাত্র খালি না কেন, এ-সবই ভাবছিলাম।
বিফ্রকেসটি বেশ ভারী, টের পাচ্ছিলাম। ভেতরে কী আছে কে জানে। দু-জন ষন্ডামতো লোক ওর পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। ওরা কোথা থেকে উঠল বুঝতে পারছি না। রাসমণি স্টপ থেকে উঠতে পারে। ওরাও শক্ত করে রড ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল, লোকটি যেন পালাতে না পারে। পালাতে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাকেও চোখ কটমট করে দেখছে।
আমার কেমন ভয় করতে থাকল। আর সরকার বাজার আসতেই ধুন্ধুমার কান্ড। লোকটি ছুটে নেমে গেল। আমার কোলে ব্রিফকেস, ডাকলাম, ‘ও শুনছেন, শুনুন—।’ ষন্ডামতো লোক দুটিও দ্রুত নেমে গেল। মানুষ আত্মরক্ষার তাগিদেই শুধু এভাবে পাগলের মতো ছুটন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়ে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়ে গেল। পেছনের চাকার তলায় মাথাটি চেপটে গেছে। কিন্তু তিনজনের কে বাস চাপা পড়ল। ব্রিফকেসটির কী হবে। কাকে বলি। জানলায় মুখ বাড়িয়ে স্পষ্ট দেখলাম, ধূসর রঙের শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা লোকটাই চাপা পড়েছে। মাথাটা চাকার তলায়। দেখা যায় না। গলা শুকিয়ে কাঠ। বমি পাচ্ছে। মাথাটা কেমন করছে। তারপর কিছুটা হতভম্ব অবস্থা আমার। লোকজন বাসটাকে ঘিরে ধরার আগেই উধাও। এক হ্যাঁচকায় শিয়ালদায় এসে যাত্রী নামিয়ে হাওয়া।
ব্রিফকেসটি নিয়ে আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কাকে বলি? এ এক ঝামেলা—থানা-পুলিশ, ভাবতে পারছি না। আমার সাতপুরুষের কেউ থানা-পুলিশ করেছেন জানি না। গোবেচারা মানুষ আমরা। ভারী ব্রিফকেসটি নিয়ে হাঁটতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল। ফেলেও দিতে পারছি না। লোক গিজগিজ করছে, ফেলে গেলেই লোকে আমাকে ছাড়বে কেন। ফের ওটা হাতে ধরিয়ে দেবে। বলবে, ‘খোকা, এটা ফেলে যাচ্ছ কেন?’ ষন্ডামতো লোক দুটিও যে আমাকে ফলো করছে না, কে বলবে। এলে বাঁচতাম। ওদের হাতে তুলে দিয়ে ভারমুক্ত হতাম। যদি ব্রিফকেসটা নিয়ে লাঠালাঠির ব্যাপার থাকে, ওরা পেলেই খুশি হয়ে চলে যাবে। কিন্তু না, কেউ না। পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে আছি, ইচ্ছে আছে, ট্রেনে ওঠোর সময়, ফেলে চলে যাব। এত ভারী জিনিস নিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। কে জানে কী আছে ভেতরে।
ট্রেন এলে চোরের মতো উঠতে যাচ্ছি। কে যেন বলল, ‘খোকা, এটা ফেলে যাচ্ছ কেন?’
মহা মুশকিল। আমার জিনিস নয়, তবু আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। বাড়ির জন্য মন উতলা না হলে এমন একটা ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়তে হয় না। মনে মনে খুবই পস্তাচ্ছি। কে যে ব্রিফকেসটা হাতে তুলে দিয়ে চলে গেল, বুঝতে পারলাম না।
যাকগে, রাতের ট্রেন। গোপনে জানলা গলিয়ে ফেলে দিলেই চলবে। এখন ভালোমানুষ সেজে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। চেকারবাবু কামরায় উঠে এলেই আর এক আতঙ্ক। এই লাইনে যাওয়াআসার অভ্যাস আছে। বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুখও জানি। সারা রাস্তায় টেনশন থাকে। তারপর নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে গেট অতিক্রম করতে পারলেই রাজা হয়ে যাই। তখন টাকাটা সিকিটা পকেটে যাই থাকে, মেঠাই-মন্ডা না হলেও চানাচুর, বাদাম খেতে-খেতে বাড়ির রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার মজাই আলাদা। গলায় তখন উচ্চাঙ্গ সংগীত—তা রা রা ধিন, না তা রা রা। কখনও লোকসংগীত কন্ঠে, ভেদা মাছে কাদা খায়, পুঁটি মাছে চরচরায়। দূর থেকে এই গান শুনলেই প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে ধর্মদাস ঠাকুরের লায়েক পুত্র সুজন ঠাকুর বিদেশ ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরছে।
এহেন ভ্রমণকারীর কপালে এই ছিল শেষে। ব্রিফকেসটি সিটের তলায় গোপনে রেখে দিয়েছি। জানলার ধারে সিট। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। ফালগুন মাস শেষ হয় হয়। ঠাণ্ডা হাওয়া। রাতের দিকে বেশ আমেজ বোধ হওয়ার কথা। কিন্তু কেন যে ভেতরে এত অস্বস্তি। ঘামচ্ছিলাম। সামনে পেছনে সিট একটাও খালি নেই। কৃষ্ণনগর না এলে ট্রেনের ভিড় পাতলা হবে না। মানুষজন দাঁড়িয়ে, ভিড় ক্রমেই বাড়ছিল। ট্রেন ছাড়ার সময় মনে হল, এই পলাশি পর্যন্ত চলবে। অগত্যা চোখ বুজে পৃথিবী সম্পর্কে উদাসীন হওয়া যায় কি না চেষ্টা করা ছাড়া অন্য কোনও কর্তব্যের কথা বিন্দুমাত্র ভাবতে পারছি না।
ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেনের দুলুনি ভালোই লাগে। ঘুম পায়। তবে ঘুমোতে পারি না। টিকিট থাকলে কথা ছিল, ব্রিফকেসটা না থাকলেও কথা ছিল—ঘুম পেলে ঘুমাতে পারতাম। বসে-বসে ঢুলি ঘুমোই, এর-ওর ঘাড়ে ঢলে পড়ি। মাথা সোজা করে দেয়— তবে এবারে ঘুম দূরে থাকুক, তদ্রাও নেই চোখে। বরং সব সময় আতঙ্ক। ব্রিফকেসটা সিটের নীচে। গোপনে পা ঠেলে দেখছি আছে কি নেই। পকেটমার, চুরিচামারি, কত কিছুই হয়। হলে কী যে ভালো হত। একেবারে গোবেচারা স্বভাব ব্রিফকেসেরও—যেখানেই ফেলে রাখবে, পড়ে থাকবে। নড়বে না। ধনুর্ভঙ্গ পণ।
স্টেশনের পর স্টেশন ফেলে চলে যাচ্ছি। রাত বাড়ছে। আশ্চর্য, আজ কামরায় চেকার পর্যন্ত ওঠেনি। উঠলে তাড়া খেতাম। তাড়া খেলে কে আর লটবহরের কথা মনে রাখে। তাড়া না খেলেও উঠে যেতে পারি, সিটের নীচে পড়ে আছে যখন, খপ করে পায়ে ধরে টেনেও রাখবে না-কিন্তু মুশকিল, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াবারও জায়গা নেই। সুখে থাকতে ভুতে কিলোক, কে চায়। নানা দ্বিধায় ভুগছি।
পাশের সিটগুলোর লোকজন আমাকে যে খুব লক্ষ রাখছে তাও না। বরং পাত্তাই দিচ্ছে না কেউ। এ-সময় এমন দামি ব্রিফকেসটা তুলে জানলায় গলাতে গেলেও বিপদ। তবু চেষ্টা করা যাক। বুঝি ব্রিফকেসটি দেখলে ওদের চোখ পড়বেই। আমার জামা-প্যান্টের যা ছিরি, তাতে ব্রিফকেসটা যথার্থ বেমানান। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে, দশবার গায়ত্রী জপ করে দশবার দুর্গানাম স্মরণ করে ব্রিফকেসটা সিটের তলা থেকে টেনে বের করলাম—জানালায় গলানো যায় কিনা। সোজা তো গলানো যাবে না, জানালার কাছে রাখা, দিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে রাখা, আসলে সাইজমতো ফাঁক পাওয়া যাচ্ছে না। জানালার আড়াআড়ি গরাদের যা ফাঁক তাতে গলিয়ে দেওয়া খুবই সোজা। দু-বার আংশিক ঢুকিয়ে দেখে নেওয়া গেল। আবার দুর্গানাম জপ—এবারে শেষ চেষ্টা। আরে ঢুকছে না তো। গলেও যাচ্ছে না। বাইরে ঠেলে ফেলি কী করে। আড়াআড়ি লোহার শিকগুলি নাচানাচি করছে। আচ্ছা মরণ, ফেলব ভাবলে, গলছে না, ফেলব না ভাবলে গলে যাচ্ছে।
পাশের বয়স্ক লোকটি বোধহয় ব্রিফকেসের তামাশায় রগড় বোধ করছিল।
‘কী খোকা গরাদের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ কেন? বাক্সটা যে ভাঙবে।’
বাক্সটা ভাঙুক, গুড়িয়ে যাক, আমার কিছু আসে-যায় না। আগুন লাগিয়ে দিতে পারলে আরও ভালো হত। মাথা গরম। বিচলিত হয়ে পড়ছি। কী আছে ভেতরে, জানিই না নোটের বান্ডিল না হিরে-জহরত, কিংবা যদি কাটা মুন্ডু না হোক কাটা হাত-পা থাকে—সঙ্গে-সঙ্গে বুক ধুকপুক শুরু। শেষ পর্যন্ত লোকটা ব্রিফকেসটা গছিয়ে বাসের তলায় পিষে গেল। ষন্ডামতো লোক দুটি এজন্য বোধহয় আর আমাকে তাড়া করছে না। পরে-পরে পারাপার কে না চায়।
ট্রেন ছুটছে। অন্ধকার মাঠ পার হয়ে ছুটছে। স্টেশন এলে থামছে। আবার ছেড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি জানালা দিয়ে বাক্সটা গলিয়ে দেওয়া আমার কম্ম নয়। আমি ছাড়লেও বাক্সটা আমাকে ছাড়বে না। লোকজনের ভিড় পাতলা হয়ে আসছে। বসার জায়গাও খালি হয়েছে এদিক-ওদিক। পলাতকের মতো সতর্ক নজর। গুটিগুটি উঠে পালাবার চেষ্টা করছি। কামরা-বদল করব। আর দুটো স্টেশন। তারপরই আর আমাকে পায় কে! বাক্সটার তাড়া থেকে অন্তত বেঁচে যাব। বাক্স পড়ে থাকবে ট্রেনে, আমি চলে যাব বাড়ি।
পাশের কামরায় উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সিটের নীচে বাক্সটা পড়ে আছে। কার বাক্স পড়ে থাকল, বোঝা যাবে পরে। তার আগে আমি হাওয়া।
বেশ যা হোক নিষ্কৃতি পেয়ে সাইড ব্যাগে হাত দিলাম। ঠিকঠাক আছে কিনা সব দেখে নিলাম। পকেট-চিরুনি বের করে মাথা আঁচড়ালাম। সারাটা রাস্তা এমন উদবেগে কাটবে, বের হওয়ার আগে যদি জানতাম—যাই হোক, বাবা বলেন, গতস্য শোচনা নাস্তি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন বাড়ির ছেলে ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে বাঁচি।
আর তখনই কে একজন অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দিল। স্টেশনের আলোতে মুখ স্পষ্ট নয়। জামা-প্যান্টের রংও বোঝা যায় না। আবছা ধূসর হয়ে আছে চারপাশ। ব্রিফকেসটা নাকের ডগায় দুলছে।
‘এটা ফেলে এলে কেন। সিটের নীচে দেখলাম পড়ে আছে। নাও ধরো। বোকা কোথাকার?’
কেমন হিমশিম খাচ্ছি বলতে, ‘না, না, এটা আমার না।’
‘তোমারই। কে বলেছে তোমার না। ধর, নিজের জিনিস চিনতে পারো না। সিটের তলায় ফেলে এলে কেন?’
এবার আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। প্রায় ছিটকে বের হয়ে দৌড়লাম। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে অন্য এক কামরায় উঠে পালাচ্ছি। আচ্ছা বিপাকে পড়া গেল। ‘আরে খোকা ছুটছ কেন? পড়ে মরবে যে।’
কে বলে, কার গলা, কিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটাও ছুটছে। স্টেশন, দূরে দূরে গ্যাসবাতি।
গ্যাসবাতির আলোর জোর কম। প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে লাফিয়ে মালগাড়ি শান্টিং-এর রাস্তায় উঠে যাচ্ছি। সামনে মালগুদাম। তারপর তুঁতগাছের জঙ্গল। জঙ্গল পার হয়ে পঞ্চাননতলা। সেখান থেকে ক্রোশখানেক পথ হেঁটে গেলেই বাড়ি।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি।
পেছনে বাক্সটা তেড়ে আসছে আমাকে। ধূসর অন্ধকারে চকচক করছে। বাক্সটা কারও হাতেও ঝুলছে না। নিজেই ঝুলে-ঝুলে, দুলে-দুলে এগিয়ে আসছে। সামনে ছুটলে, সামনে ঝুলে আছে, পেছনে ছুটলে, পেছনে ঝুলে থাকে। যেদিকে তাকাই, বাক্সটা মহামারি বাধিয়ে মজা ভোগ করছে যেন। সবই কয়েক মিনিটের মধ্যে। কারণ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যায়নি। আসলে ঘোরে পড়ে গেছি হয়তো। আতঙ্ক থেকে এমন হতে পারে। ছুটে আসছিল লোকটা। সেগেল কোথায়। ওই তো সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে বাক্স। ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসছে। তা হলে লোকটাই বাক্স নিয়ে আমাকে তাড়া করছে। কেন করছে, তাও বুঝছি না।
সামনে এসে লোকটি বলল, ‘কোথায় পালাবে। যাও উঠে পড় ট্রেনে। নিজের জিনিস ফেলে যেতে নেই। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এত কষ্ট করে শহর থেকে এতদূর নিয়ে এলে। বাড়ির কাছে এসে কেউ ফেলে যায়। যতই ভারী হোক। উঠে পড় ট্রেনে। সামনে স্টেশনে তো নেমে যাবে। এই স্টেশনে নেমে পালাচ্ছিলে কেন?’’
এত কথা শোনার পর বোধহয় আমার ঘোর কেটে যাচ্ছিল। ভালো করে চোখ মেলে দেখলাম। দেখে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। বাসের সেই ষন্ডামতো দু’জনের একজন। রাতের অন্ধকারে আমাকে ঘিরে ধরেছে।
কুঁই-কুঁই করে বললাম, ‘এটা তো আপনাদের।’ ‘আগে ট্রেনে উঠে পড়। পরে দেখা যাবে।’
এত কথা হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মে মানুষজনের ভিড় না থাকলেও, একেবারে ফাঁকা নয়। কেউ দেখছি, ভ্রূক্ষেপই করছে না। বাক্স নিয়ে ঝামেলা করছে দু-জন লোক, তাও যেন বুঝছে না।
আর তখনই দেখছি পোড়োবাড়ির সেই লোকটা টলতে টলতে আসছে। আমার হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছিল।
চোখ ঘোলা-ঘোলা। বাসের তলায় মাথা চেপটে গেছে। রক্তে ভেসে গেছে—কিন্তু সেএখন পান চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আমি জানি, তুমি কখনও অবিশ্বাসের কাজ করতে পার না। অক্ষত অবস্থায় আছে, থাকারই কথা। আর মিনিট তিনেক অপেক্ষা, চল হেঁটে চলে যাই। সামনে মালগুদাম, তারপর কিছুটা গেলে তোমার তুঁতের জঙ্গল। তোমার বাড়ি তো এখান থেকেও নেমে যাওয়া যায়। পরের স্টেশনে আর গিয়ে কাজ নেই।
আমার মুখ থেকে রা সরছে না। আর দেখছি সেই ষন্ডামতো দু-জনের একজন ভিরমি খেয়ে পড়ে গেছে প্ল্যাটফর্মে। আর একজন মনে হল ছুটে পালাচ্ছে। লোকটি হাসল।
আমাকে অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয় নেই। তোমার কোনও ক্ষতি করব না। তবে সময় নেই। এসো, আমার সঙ্গে।’ দ্রুত ট্রেন লাইন পার হয়ে গুদামঘর পার হয়ে নামতেই লোকটি বলল, ‘যাও ভয় নেই। বাক্সটি আমার হাতে দাও।’
‘আমায় আবার তাড়া করবে না তো?’ ‘না, না। বলছি তো, আমার জিনিস ফেরত পেয়েছি, তাই যথেষ্ট। ধন্যবাদ তোমাকে।’
ট্রেনটা হুইসেল দিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে সামনে স্টেশনের দিকে ঝিক-ঝিক করে কদম দিতে থাকল। কালো ধোঁয়ার গন্ধ, ভক-ভক করে স্টিমও গড়াচ্ছে। আর তখনই দেখলাম, লোকটি ঘড়ি দেখছে, ঘড়ি দেখে কী বুঝল কে জানে। বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলে দিল তুঁতের জঙ্গলে ভয়ংকর এক বিস্ফোরণ। সারা স্টেশন কেঁপে উঠল। রেলের স্লিপার ছিটকে পড়ল। ধোঁয়া আর আগুনের মধ্যে দেখলাম, লোকটা মিলিয়ে গেল।
পরদিন সকালের কাগজ দেখে স্তম্ভিত। ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনজনের একটি দল ট্রেনে উঠে বসেছিল। দু-জনের লাশ প্ল্যাটফর্মে পাওয়া গেছে। আর একজনের কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে। বিস্ফোরণ ট্রেনে না ঘটে মালগুদামে কী করে ঘটল, এটা তদন্তকারী দল এখন খুঁজে দেখবে। কেউ ধরা পড়েনি। ফরাক্কা ব্যারেজের জরিপ কার্যের শেষ সিদ্ধান্তটি যেসব বিশেষজ্ঞের হাতে ছিল, সেই বিশেষজ্ঞ দলটি ট্রেনে যাচ্ছিলেন। তাঁদের কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।
নীচে দুর্ঘটনার ছোট্ট আর একটি খবর, বেলেঘাটার সরকার বাজারের কাছে বাস দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু। পরনে ধূসর রঙের জামা এবং সাদা প্যান্ট। কে যে কার কখন কীভাবে উপকারে লাগে, কেউ জানে না। উপকারের ইচ্ছে থাকলে মানুষ তা পারেই, ভূতও পারে।