ব্রিফকেস রহস্য

ব্রিফকেস রহস্য

০১.

টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল নীতার।

টেলিফোনটা বিদেশি। এর শব্দটা চাপা। কিছুটা জলতরঙ্গের বাজনার মতো। কিন্তু নিঝুম নিশুতি রাতে সেই বাজনা বিরক্তিকর উপদ্রব।

সাড়া না দিলে সব টেলিফোন একসময় থেমে যায়।

কিন্তু থামছে না। ক্রমাগত রিং হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখতে গিয়ে হঠৎ নীতার খেয়াল হল, এই নাম্বারটা প্রাইভেট। খুব ঘনিষ্ঠ ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়।

সে মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টিপল। ঘড়ি দেখল। রাত একটা দশ।

একটু দ্বিধা, একটু অস্বস্তি–তারপর সে রিসিভার তুলে সাড়া দিল।

 নীতা সোম?

কোনও পুরুষের কণ্ঠস্বর। চাপা আর কর্কশ। নীতা বলল, হু ইজ ইট?

 কাল আপনি আউটডোর শুটিংয়ে যাচ্ছেন। যাবে না।

নীতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। হোয়াট দ্য হেল আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? কে আপনি?

আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না? আমি বলছি, আপনি কাল আউটডোর শ্যুটিংয়ে যাবেন না। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

নীতা একটু দমে গেল। কী বলবে ভেবে পেল না। দুঃস্বপ্ন দেখছে কি?

কিন্তু আবার সেই চাপা রুক্ষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। হ্যালো। আর ইউ দেয়ার?

কে আপনি?

 চিনবেন না। আপনার ভালোর জন্য বলছি

আমার এই নাম্বার কোথায় পেলেন?

 পেয়েছি। মিস সোম! আপনি কাল আউটডোর শ্যুটিংয়ে চণ্ডীতলা যাবেন না।

ইজ ইট এ থ্রেটনিং?

 দ্যাট ডিপেন্ডস। আপনি আপনার ডাইরেক্টরকে লোকেশন চেঞ্জ করতে বলুন।

কানেকশন কেটে গেল। নীতা কয়েকবার হ্যালো বলল। উত্তেজনা আর অস্বস্তিতে অস্থির নীতা সোম রিসিভার মুঠোয় চেপে ধরল। তারপর বিছানা থেকে উঠে বসল।

এয়ারকন্ডিশানের স্নিগ্ধহিম ঘরে আরাম ছড়িয়ে রেখেছিল। সেই আরাম তছনছ করে দিয়েছে মধ্যরাতের একটা অদ্ভুত উপদ্রব। রিসিভারটা বালিশের পাশে রেখে দিল সে, পাছে আবার আততায়ী কণ্ঠস্বর হানা দেয়।…

রাত একটা পঁচিশে নীতা একটা নাম্বার ডায়াল করল। দুবার রিং হওয়ার পর সাড়া এল। অবিনাশের জেগে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

নীতা আস্তে বলল, অবিনাশদা। নীতা বলছি।

 হাউ স্ট্রেঞ্জ। তুমি এখনও জেগে আছ নাকি?

 ঘুম আসছে না। আপনি এখন কী করছেন?

অবিনাশ ঘোষালের হাসির শব্দ ভেসে এল। আমার যা করা উচিত। শুভকে নিয়ে স্ক্রিপ্টটা ফাইনাল করছি। জাস্ট এ টাচ আপ। শুভ অবশ্য ঘুমে ঢুলছে। ওকে বাড়ি ফিরতে দিইনি। জানো? ওর বউ তিনবার রিং করেছিল। তো কী ব্যাপার? তোমার ঘুম আসছে না কেন?

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসছে না।

 ও দুষ্টু মেয়ে। তাই আমাকে–

না অবিনাশদা।

অবিনাশ দ্রুত বললেন, এটা হয়। র‍্যাদার–এ সাইকোলজিক্যাল প্রব্লেম। তুমি শাইনিং স্টার। তোমার অবচেতনায় একটা অনিশ্চয়তার আশঙ্কা থাকতে বাধ্য। বিশেষ করে এ ধরনের প্রফেশনে তো-না? তুমি তাই বলে ঘুমের বড়ি-টড়ি খেয়ো না।

অবিনাশদা। কাল আমরা কোথায় যেন যাচ্ছি?

বেশি দূরে নয়। তোমাকে তো বলেছি মাত্র ঘণ্টাতিনেকের জার্নি। খুব শান্ত নির্জন জায়গা।

আমরা কাল যাচ্ছি?

কী আশ্চর্য। নীতা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এত বাঁত্রে হঠাৎ–এনিথিং রং? নীতা। …হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!

 অবিনাশদা। আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল।

 কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ করছে?

 কেমন যেন একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে।

 আনক্যানি ফিলিং। তার মানে?

 আচ্ছা অবিনাশদা, শ্যুটিং কয়েকটা দিন পিছিয়ে দিতে অসুবিধে কী?

কী অদ্ভুত কথা বলছ তুমি! আজ বিকেলে আমার টিম সেখানে রওনা হয়ে গেছে। আর রাত দুপুরে তুমি বলছ–ওঃ নীতা। প্লিজ পাগলামি করো না। শোনো আমি নিজে দেখে এসেছি। তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। কেউ তোমাকে ডিসটার্ব করবে না। তাছাড়া স্টোরিতে ঠিক যেমন একটা বাড়ির কথা ভেবেছিলাম, বনেদি অ্যারিস্টোক্র্যাট ফ্যামিলির বাগানবাড়ি-নদী বা ঝিল, প্রচুর গাছপালা। আরও একটা ফেসিলিটি আছে। ইলেকট্রিসিটি। একটা টেলিফোন পর্যন্ত। আসলে বাড়ির মালিক একজন এক্স এম পি। নাইস ওল্ড ম্যান। অবিনাশ আবার হেসে উঠলেন। না–তিনি ড্রাকুলা নন, সো মাচ আই ক্যান অ্যাসিউর ইউ? ও কে? রাখছি।

অবিনাশদা! বলেই নীতা থেমে গেল। সে জানে, অবিনাশ ঘোষাল জেদি ও খেয়ালি মানুষ। কথাটা শুনলে হয়তো এখনই ছুটে আসবেন। ফিল্মমেকার হিসেবে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। পুলিশ-প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করে ফেলবেন। কিন্তু তাতে নীতার অস্বস্তি ঘুচবে না। একটা লোক যেভাবে হোক, তার প্রাইভেট ফোন নাম্বার জেনেছে এবং প্রকারান্তরে তাকে হুমকিই দিয়েছে।

রাত একটা দশে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে কেউ হুমকি দিয়েছে। এটাই অস্বস্তিকর।

হ্যালো… হ্যালো… হ্যালো…! নীতা! কথা বলছ না কেন?

অবিনাশদা, আমরা সকাল আটটায় যাচ্ছি। তাই না?

তোমার উঠতে দেরি হবে। এই তো? ঠিক আছে। মেক ইট নাইন ও ক্লক।

নীতা চুপ করে থাকল। ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার সে বোবা হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

নীতা হোয়াটস রং?

কিছু না হঠাৎ ঘুম ভেঙে

 শোনো। একটু ব্র্যান্ডি খেয়ে নাও। চিয়ার আপ। ছাড়ি?…

নীতা আগের মতো বালিশের পাশে রিসিভার রেখে দিল। তারপর উঠে গিয়ে ব্র্যান্ডির বোতল বের করল।

রাত একটা পঞ্চাশ মিনিটে মাথার ভেতর তীব্র উত্তেজনা তাকে নাড়া দিল। টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করল। তারপর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পাতা ওল্টাতে থাকল। একটা নাম্বার খুঁজছিল অভিনেত্রী নীতা সোম।

তার হাত কাঁপছিল। সেই হাতে নাম্বারটা ডায়াল করল। প্রায় এক মিনিট ধরে রিং হওয়ার পর ঘুমজড়ানো গলায় সাড়া এল। ইয়া?

 নীতা বলল, রাত্রি? আমি নীতা বলছি। তোকে ডিসটার্ব করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু

কে? নীতা–নীতা কী?

তুই কি জেগেছিস, না ঘুমের মধ্যে কথা বলছিস? আমি নীতা।

ও। তুই? তোর ভয়েস এমন কেন? মাই গুডনেস! দুটো বাজতে চলল। তুই নিশ্চয় কোনও স্টুডিও থেকে ফোন করছিস। রাত্রির হাসির শব্দ ভেসে এল বাহ্। নিজে ঘুমনোর চান্স পাচ্ছে না বলে আমাকে টিজ করার ধান্দা?

রাত্রি! দিস ইজ সিরিয়াস। আমি বাড়ি থেকে বলছি।

 সিরিয়াস মানে? কোনও মিসহ্যাপ নাকি?

আগে শোন, যা বলছি। নীতা শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলল। শোনার পর তুই বলবি আমার কী করা উচিত।

বল। কিন্তু তুই কি অসুস্থ? নাকি কারও পাল্লায় পড়ে ড্রিঙ্ক করেছিস?

 একটু ব্র্যান্ডি খেয়েছি।

এতেই? ও কে। বল। …ওয়েট, ওয়েট, তুই কি এখন একা আছিস?

 নীতা রেগে গেল। শিট! আই অ্যাম নট এ হোর ইউ নো৷

 ঠিক আছে বাবা। মুখখিস্তি করতে হবে না। বল, কী বলবি।

নীতা হঠাৎ শক্ত আর শান্ত হয়ে গেল। ঘটনাটি বলতে থাকল। তার কণ্ঠস্বর অবশ্য মাঝে মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছিল। রাত্রির সাড়া না পেলেই তাকে ডাকছিল। কথা বলতে বলতে নীতা টের পাচ্ছিল উত্তেজনার চাপে একটু বেশি ব্র্যান্ডি খেয়ে ফেলেছে। ক্রমে তার স্নায়ু কী এক অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল।

রাত্রি বলল, ও কে। তুই এখন শুয়ে পড়। আর রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দে। পরে সময়মতো এক্সচেঞ্জ থেকে নাম্বারটা বদলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবি। আমি মর্নিংয়ে–ধর, আটটার পর যাচ্ছি। তখন কথা হবে।

এখনই বল।

শাট আপ। শুয়ে পড় বলছি। আর রিসিভারটা–ডোন্ট ফরগেট।

 নীতা রিসিভারটা মেঝেয় ফেলে দিল। কার্পেটে অদ্ভুত শব্দ হল। হাত বাড়িয়ে কয়েকবার চেষ্টার পর সে টেবিলল্যাম্পের সুইচটা খুঁজে পেল এবং অফ করে দিল। ঠিক ঘুম নয়, ঘুমের মতো গাঢ় একটা আচ্ছন্নতা তার চেতনার ওপর চেপে বসছিল।

ভোরের দিকে একবার ঘুম ভেঙেছিল। শীত করছিল। সে চাদরটা টেনে গায়ে চাপাল। এয়ারকন্ডিশনার বন্ধ করে দেবে কি না ভাবছিল। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করল না।

তার শরীর জুড়ে অবসাদ। এ শরীর যেন তার নিজের নয়। আর তার মনও যেন তার নিজের মন নয়।

নীতা সোম অলস দৃষ্টিপাতে নিজের জীবনকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে দেখছিল. ..

.

০২.

সৌম্য ও অরিত্র খুব ভোরে ঝিলের জলে রোয়িং করছিল।

বাউন্ডারি ওয়ালে ঘেরা প্রায় তিরিশ একর বাগানবাড়ির পূর্বসীমানায় একতলা আউটহাউস। তার নিচে পুরনো ঘাট। এই শরতের ঝিলের জল ঘাটের বেশ কয়েকটা ধাপ বুকের তলায় আশ্রয় নিয়েছে।

ঝিলটা এখানে বিস্তীর্ণ। উত্তরে সাদাফুলে ভরা ঘন কাশবন। দক্ষিণে বাঁধের গায়ে এলোমেলো জঙ্গল। পশ্চিমে কিছুটা দূরে হাইওয়ের ওপর উঁচু ব্রিজ। পূর্বে ঝিলটা সংকীর্ণ হতে হতে বাঁক নিয়েছে। সেদিকে এখন নীলচে কুয়াশার পর্দা ঝুলছে।

এক চক্কর রোয়িং করে সৌম্য ঝিলের মাঝামাঝি পৌঁছে বলল, এনাফ। একটু রেস্ট নেওয়া যাক।

অরিত্র বলল, এই ঝিলের মালিকও কি তোমার মামাবাবু?

সৌম্য হাসল। নাহ্। ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট। তবে এটা আসলে কোনও পুরনো নদীর–কী বলব? স্মৃতিরেখা।

 রেখাটা ঠিক ফিট করছে না।

করবে। আরও পূর্বে গেলে।

 চলো, যাই।

যাওয়া যাবে না। জাল পাতা আছে। ওদিকটায় মামাবাবুর তদ্বিরে। ফিশারিজ কোঅপারেটিভ হয়েছে।

এই ঝিলটার কোনও নাম থাকা উচিত।

আছে। ডাইনির ঝিল।

 সে কী।অরিত্র হেসে ফেলল। এমন সুন্দর ঝিলের সঙ্গে ডাইনি-ফাইনির কী সম্পর্ক?

গ্রাম্য সুপারস্টিশন। ছোটবেলায় দিদিমার কাছে সব সাংঘাতিক সাংঘাতিক গল্প শুনেছি। জেলেরাও নাকি সন্ধ্যার পর এদিকে মাছ ধরতে আসত না। ওই ব্রিজ পেরিয়ে গেলে একটা পুরনো শোন আছে। কালীমন্দির ছিল। এখনও তার চিহ্ন আছে। সব মিলিয়ে একটা সুপারস্টিশন তৈরি হয়েছিল।

তুমি তো মাঝেমাঝে এখানে এসে থাকো বলেছিলে।

 আসি। মা মামাবাবুর দেখাশোনার জন্য এখানেই থাকেন। তাই আসতে হয়। তা ছাড়া আমার ভালোও লাগে। বিশেষ করে জ্যোৎস্নারাতে ঝিলের জলে রোয়িং–জাস্ট ইমাজিন ইট।

তোমার ভয় করে না?

নাহ্।

 তুমি একা?

 তোমার মতো আমার কোনও স্মার্ট গার্লফ্রেন্ড নেই। থাকলেও তাকে এখানে আনা যেত না।

অরিত্র কৌতুক গায়ে নিল না। বলল, এই বোটটা তা হলে তুমিই তৈরি করিয়েছ?

না। এটা মামাবাবুর বোট। তার রোয়িংয়ের হবি ছিল।

 উনি কি হুইলচেয়ারে বসেই রোয়িং করেন?

 রিস্ক আছে। চাইলেও মা বাধা দেবেন।

ওঁর মাঝে মাঝে ক্র্যাচ ব্যবহার করা উচিত। সবসময় হুইলচেয়ার ব্যবহার করা ঠিক নয়।

করেন। বাথরুমে গেলে বা শোওয়ার সময়।

 নিচে নামেন না?

দ্বারিককে দেখেছ। ও একটা দৈত্য। হুইল চেয়ারসুদ্ধ তুলে মামাবাবুকে বাগানে পৌঁছে দেয়। তারপর হোল এরিয়া চক্কর দিয়ে বেড়ান। বডিগার্ড জনি।

জনি?

 অ্যালসেশিয়ান। কোনও আউটসাইডারকে বরদাস্ত করে না।

অরিত্র ঘড়ি দেখল। তারপর বলল, বটুকদা বলছিল, কোথায় নাকি প্লেনক্র্যাশ হয়েছিল। শুধু তোমার মামাবাবু বেঁচে যান।

হ্যাঁ। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে লন্ডন যাচ্ছিলেন। ইতালির ওই এরিয়ায় তখন রাফ ওয়েদার। প্লেনটা ক্র্যাশল্যান্ডিং করেছিল। সৌম্য একটু চুপ করে থাকার পর বলল, ছোটবেলা থেকে লক্ষ করেছি, মামাবাবুর একটা ইন্সটিংকট আছে–র্যাদার এ সিক্সথ সেন্স। ঠিক সময়ে এমার্জেন্সি ডোর খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ওঁর মুখেই শুনবে। খুব স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স। চলো। আর এক চক্কর ঘুরে আসি।

থাক। আমি এবার একটু ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করব।

দুজনে বোট নিয়ে ঘাটের দিকে এগোল। সৌম্য বলল, আচ্ছা, মাথায় টাক পেল্লায় গোঁফ ওই ভদ্রলোক কে?

তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি? খুব মালদার পার্টি। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা আছে। ফরেন ফিল্ম মার্কেটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। অবিনাশদা ওঁকে পেয়ে বসেছেন, নাকি উনিই অবিনাশদাকে পেয়ে বসেছেন, আমি জানি না।

নাম কী ভদ্রলোকের?

রমেশ ভার্মা।

 অবাঙালি?

হ্যাঁ। কিন্তু কথা বলে বুঝতে পারবে না। তবে ভদ্রলোকের একটা গুণ অস্বীকার করা যাবে না। আর্টফিল্ম বুঝুন বা না বুঝুন, ওয়েস্টার্ন অডিয়েন্স ইন্ডিয়ান ফিল্মের কাছে কী চায়, সেটা দারুণ বোঝেন!

অবিনাশদা বলছিলেন, তার এ ছবির থিম ডেকাডেন্স অব ইন্ডিয়ান ফিউড্যালিজম। এ কিন্তু বস্তাপচা হয়ে গেছে। সৌম্য হাসতে হাসতে বলল। আমার ভয় করছে। মামাবাবুকে না অ্যাপ্রোচ করে বসেন। মামাবাবু কোনও কোনও ব্যাপারে ভীষণ রিঅ্যাক্ট করেন।

অবিনাশদা তো এসেছিলেন।

হ্যাঁ। আলাপ করেও গেছেন। কিন্তু

সৌম্য ঘাটে লাফ দিয়ে নেমে একটা লোহার আংটার সঙ্গে বোটের দড়িটা বাঁধল। অরিত্র নেমে এসে বলল, কিন্তুটা হচ্ছে এই যে, আমি স্টোরিলাইনটাই জানি না। আমার রোলটাই বা কী, তাও জানি না।

নীতা সোম জানে। দ্যাটস অল।

 দ্যাট আই ভেরি মাচ ডাউট।

 জানে না বলছ?

অরিত্র খুবই আস্তে বলল, অবিনাশদার একটা ছবিতে আমি কাজ করেছি। একটা মাইনর রোলে। সে-ও প্রায় একবছর আগে। বড় পর্দার ছবির। এই। ছবিটা ছোট পর্দার জন্য। টিভি ফিল্ম।

সৌম্য ওর দিকে তাকাল। তাতে কী?

 ছোট পর্দার জন্য এই লোকেশানের কী দরকার ছিল?

বুঝলাম না। অরিত্র ঘাটের মাথায় দাঁড়িয়ে জগিংয়ের ভঙ্গিতে এক্সারসাইজ করছিল। সৌম্য আবার বলল, কত বিখ্যাত টিভি ফিল্ম আউটডোর লোকেশানে তোলা হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের সদগতি।

অরিত্র বলল, পরে বলব।

 সৌম্য শর্টস খুলে ঘাটের মাথায় রাখা প্যান্ট পরে নিল। তারপর পায়ে চটিজোড়া গলিয়ে নিল। কিছুক্ষণ অরিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে ঘাটের মাথায় বসল।

একটু পরে আউটহাউসের একটা ঘরের জানলা থেকে বটুকবাবু ডাকলেন, সৌম্য।

সৌম্য ঘুরে বসল। বলল, উঠেছেন দেখছি। রাত্রে বলছিলেন, আটটার আগে ওঠেন না।

উঠলাম। তো অরিত্র বাঁদরের মতো লাফায় ক্যানে?

 এটাই নাকি অরিত্রের ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ।

খাইছে।

একটু পরে বটুকবাবু ডোরাকাটা রাত-পোশাকটা পরে বেরিয়ে এলেন। কাঁধে তোয়ালে। হাতে সাবান এবং পেস্টলাগানো টুথব্রাশ। সৌম্য বলল, আপনি কি ঝিলের জলে স্নান করবেন নাকি? না বটুকদা। জলে ভীষণ জোঁক আছে। বিলিভ মি।

আরে। ঘাট আছে। স্নান করা যাইব না? কও কী?

সত্যি বলছি। ঘাটটা শুধু রোয়িংয়ের জন্য। দাদামশাইয়ের আমলে নাকি এখানে পানসি বাঁধা থাকত। পানসি চেপে হাঁস মারতে যেতেন। মামাবাবুর একেবারে মডার্ন চালচলন।

বটুকবাবু বেজার মুখে বললেন, রাত্রে ভালো ঘুম হয় নাই। মশারি। তার ওপর হঠাৎ-হঠাৎ কারেন্ট বন্ধ।

অরিত্র আসন করার ভঙ্গিতে বসল। বলল, মশা এবং জোঁক। সাপও আছে বটুকদা। তা ছাড়া এই ঝিলটার নাম ডাইনির ঝিল। সাবধান।

হঃ। বলে বটুকবাবু ভেতরে ঢুকে গেলেন।

বটুক দত্ত বাংলা সিনেমার ভাষায় ব্যবস্থাপক বা তত্ত্বাবধায়ক। তাছাড়া তাঁকে এই টিমের সবরকম দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আউটহাউসের মধ্যিখানে একটা চওড়া করিডর। তার একদিকে প্রায় হলঘরের মতো বড় একটা ঘর। অন্যদিকের ঘরটা ছোট। বড় ঘরটার লাগোয়া বাথ এবং স্যানিটারি ল্যাট্রিন। কাল দুপুরে সৌম্য এসে সব সাফসুতরো করিয়েছিল। সামনে খুঁটি পুঁতে তেরপল টাঙিয়ে অস্থায়ী কিচেনের ব্যবস্থাও হয়েছে। ঘাসের ওপর একটা লিমুজিন এবং একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। একসময় ওখানে ফুলবাগিচা ছিল। এই আউটহাউসে বারীন্দ্রনাথের গণ্যমান্য বন্ধুরা এসে থাকতেন। এখান থেকে সুরকি-বিছানো সংকীর্ণ একটা রাস্তা দোতলা বাগানবাড়ির পার্টিকোর পাশ দিয়ে ঘুরে পশ্চিমের ফটকে পৌঁছেছে। বিশাল ফটকের পর একটা প্রাইভেট রোড এগিয়ে গিয়ে হাইওয়ের সঙ্গে মিশেছে। সেখানে একটা মরচেধরা লোহার খুঁটির মাথায় আটকানো ফলকে লেখা প্রাইভেট রোড কথাটা ক্ষয়ে গেছে।

বাড়িটার নাম বিশ্রাম। বারীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন চণ্ডীতলা মহালের জমিদার। এটা ছিল আসলে তার কাছারিবাড়ি। সেই আমলে চণ্ডীতলা ছিল  জেলাবোর্ডের পিচরাস্তার ধারে একটা সমৃদ্ধ গ্রাম। স্বাধীনতার পর ক্রমে ক্রমে চণ্ডীতলা মফস্বল শহর হয়ে উঠেছে। প্রায় সাড়ে তিন মাইল দূরে ঝিলের ধারে এই নিরিবিলি পরিবেশে উঁচু তিরিশ একর মাটি তাকে টেনেছিল। বারীন্দ্রনাথের বাবা সৌরীন্দ্রনাথ হাওয়া বুঝে চলতেন। স্বাধীনতার আগেই রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাবার কাছারিবাড়ি দ্রুত বাউন্ডারি ওয়ালে–ঘিরে ফেলেন। স্বাধীনতার পর ভোটে জিতে মন্ত্রী হন। আত্মরক্ষার একটা লড়াই।

বারীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য ধাতের মানুষ। তার কিছু আদর্শবাদ ছিল। তাঁর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া সেই আদর্শবাদের তাগিদে। তার পার্টি তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। লোকসভার আসনে তিনি বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতে যান। কিন্তু তারপর তার মোহভঙ্গ হতে থাকে। টার্ম শেষ হওয়ার পর আর সক্রিয় রাজনীতি করেননি। ক্রমশ নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে এনেছিলেন। এলাকায় নানা রকম সমাজসেবার কাজে নামেন। দু বছর আগে তাঁর জীবনে ঘটে যায় আকস্মিক এক দুর্বিপাক।…

অরিত্র তার এক্সারসাইজ শেষ করে বলল, ঝিলের জলে সত্যি জোঁক আছে নাকি?

সৌম্য বলল, আছে। তুমি এক মিনিট জলে পা ডুবিয়ে দেখে নিতে পারো।

তোমার মামাবাবু কি জোঁক পোষেন?

 সৌম্য হাসল। একটা গল্প কিন্তু চালু আছে।

 কী গপ্প?

 দাদামশাইয়ের বাবা নাকি ঝিলে জোঁক ছেড়েছিলেন। প্রজারা বদমাইশি করলে ঝিলের জলে অদের ফেলে দিতেন। তারা রক্তশূন্য হয়ে মারা পড়ত। এই জোঁকগুলো সেই থেকে বংশানুক্রমে ম্যানইটার হয়েছে।

জোঁক নয় তাহলে। জোক!

 গল্পটা সত্যি হতেও পারে। আগের দিনে কোনও কোনও জমিদার মূর্তিমান টেরর ছিল!

সৌম্য উঠে দাঁড়াল। তারপর আস্তে বলল, ফিল্মের ব্যাপারে কি যেন বলছিলে?

বলেছি তো। পরে বলব।

জাস্ট একটু হিন্ট দাও না?

প্লিজ সৌম্য। ইনসিস্ট কোরো না। অরিত্র তার একটা হাত ধরে পা বাড়াল। তারপর আউটহাউসের করিডরে ঢুকে বলল, তোমার মামাবাবুর সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। অবিনাশদা এসে গেলে আর সুযোগ পাব না।

আচ্ছা দেখছি। বলে সৌম্য এগিয়ে গেল। অরিত্র তাকে একটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।

হলঘরে ঢুকে সে দেখল, দ্বারিক আর বাবুরাম ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। সুদক্ষিণা সিঁড়ির ধাপে নির্দেশ দিচ্ছেন। সৌম্যকে দেখে বললেন, হ্যাঁ রে। ডাইরেক্টর ভদ্রলোক কখন পৌঁছুবেন বলেছেন?

এগারোটা নাগাদ। কেন?

আগেভাগে সব সাজিয়েগুছিয়ে রাখাই ভালো। কিন্তু একটা কথা ভাবছি। চল, তোকে দেখিয়ে নিই।

সুদক্ষিণা নেমে এসে দক্ষিণের একটা ঘরে ঢুকলেন। সৌম্য দেখল, দরজায় সাবেক আমলের ভেলভেটের নকশাকাটা পর্দা ঝোলানো হয়েছে। ঘরে ঢুকে সুদক্ষিণা বললেন, এই ঘরে দেশের বিখ্যাত লোকেরা এসে থেকেছেন। আমি ভাবছি, তোদের হিরোইন এসে যদি বলে, এ ঘর তার পছন্দ নয়। ফিল্মের মেয়েদের একটু উঁট হয়।

সৌম্য একটু হেসে বলল, সে অবিনাশদা দেখবেন। উনি নিজেই তো দেখে গেছেন।

ফ্যামিলির মান-সম্মানের প্রশ্ন, সৌম্য। তেমন কিছু ঘটলে দাদা রেগে যাবেন।

 ঘটবে না। নীতা সোম সুপারস্টার নয়।

সুদক্ষিণা একটু ইতস্তত করার পর খুব আস্তে বললেন, তুই যে ফিল্মম্যাগাজিনটা এনে দাদাকে দিয়েছিস, ওতে নীতা সোমের ছবি আছে।

কিছুক্ষণ আগে দাদা বলছিলেন, মেয়েটিকে চেনা লাগছে। খুলে কিছু বললেন না। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, দাদা ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছেন। সবসময় হাসিখুশি মানুষ। হঠাৎ যেন কেমন বদলে গেছেন।

আমি দেখছি। বলে সৌম্য বেরিয়ে গেল…

.

০৩.

 দোতলায় পুবের বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন বারীন্দ্রনাথ। জনি তার বাঁ পাশে পেছনের দুই ঠ্যাং মুড়ে বসে ছিল। তার গলার চেন রেলিঙের থামে বাঁধা আছে। সামনে পোর্টিকোর চৌকো খোলা ছাদ। পাইনগাছটা খুব ঝাপালো হয়ে সেই ছাদকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। রাতে হাওয়া দিলে পাইন কাটাগুলো কার্নিশ আর রেলিঙে ঘষা খেয়ে অদ্ভুত শব্দ করে।

জনি ঘুরে তাকিয়ে গরগর করল। সৌম্য এসে বলল, মর্নিং মামাবাবু।

 বারীন্দ্রনাথের ডানপাশে বেতের টেবিল আর একটা চেয়ার। সৌম্য চেয়ারে বসে আবার বলল, হাই জনি। মর্নিং। জনি তার কাছে আসার চেষ্টা করছিল। সৌম্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল।

বারীন্দ্রনাথ হাসলেন। হঠাৎ খুব স্মার্ট হয়ে উঠেছ। কোনও মতলব আছে। সম্ভবত। পটে গরম লিকার আছে। রুক্সিণীকে ডেকে একটা কাপ আনিয়ে নাও। রোয়িংয়ের পর মন্দ লাগবে না।

আপনি লক্ষ্য রেখেছিলেন?

হুঁউ। ও ছেলেটি কে?

 অরিত্র সেন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

অ্যাকটিং করে বুঝি?

করে। তবে থিয়েটারেই বেশি ঝোঁক।

 বারীন্দ্রনাথ একটু গলা চড়িয়ে ডাকলেন, রুক্মিণী! একটা কাপ দিয়ে যা তো তোর ছোটাসাবকে।

রুক্মিণী পিছনে তার ঘরের মেঝে মুছছিল। জি বড়াসাব! বলে দ্রুত ভেতরে উধাও হয়ে গেল।

সৌম্য টেবিলে রাখা বাংলা ফিল্মম্যাগাজিনটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, আপনি নাকি নীতা সোমের ছবি দেখে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছেন?

তোমার মায়ের ধারণা সবসময় ঠিক হয় না তুমি জানো!

 মা বলল নীতা সোমকে আপনার চেনা মনে হয়েছে?

বারীন্দ্রনাথ একটু কেসে নিয়ে বললেন, আমি অ্যানাটমি বিশারদ নই। নৃতাত্ত্বিকও নই। তবে আমার ধারণা, পৃথিবীর সব মানুষকে চেহারার দিক থেকে লক্ষ্য করলে কতকগুলো–আমি জানি না সংখ্যাটা কত দাঁড়াতে পারে, হ্যাঁ– এভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। এজন্যই হঠাৎ অচেনা কাকেও দেখলে চেনা লাগে। সে তুমি মুখের চেহারা বলো, শারীরিক গড়ন বলো, কিংবা হাঁটাচলার ভঙ্গি বলো–হ্যাঁ, একটা ক্ল্যাসিফিকেশন করা যায়।

সৌম্য হাসল। অসাধারণ। আপনার এই থিওরির সঙ্গে আমি একমত।

রুক্মিণী একটা কাপ-প্লেট রেখে গেল। সৌম্য একটু লিকার ঢেলে চিনি মেশাল। বারীন্দ্রনাথ বললেন, কক্ষণো খালি পেটে চা খাবে না। ওই তো বিস্কুট আছে।

 আপনার অনারে চা-বিস্কুট খাচ্ছি। আমি চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

বাহ। ভালো করেছ। আমিও আজকাল দুবেলা দুকাপ–আগে তো যত চা তত সিগারেট। বারীন্দ্রনাথ সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিলেন। লাইটারে ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং তৈরি করতে থাকলেন।

সিগারেট কিন্তু কমাতে পারেননি।

 অনেক কমিয়েছি। তবে টেনসনের সময় একটু বেশি হয়ে যায়।

এখন কি কোনও টেনসন আছে? অবশ্য অ্যাশট্রে বলে দিচ্ছে আছে। অথচ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, নেই। অ্যাজ ইট ইজ জলি মুড।

বারীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন–হা, মুড ফিরে এসেছে। কিন্তু তুমি ঠিকই ধরেছ। এরপর চারটে সিগারেট খেয়েছিলাম। তোমাদের হিরোইনের ছবিটা দেখার পর কিছুক্ষণের জন্য এক্সাইটেড হয়ে উঠেছিলাম। পরে মনে হল আমার ভুল হচ্ছে। যাই হোক, বলো। তুমি কি রোলে থাকছ? হিরো, না ভিলেন?

এ ছবিতে হিরো-ভিলেনের ব্যাপার নেই। অবিনাশদা রিয়্যাল লাইফ থেকে ক্যারেক্টার বেছে নেন। হয়তো দেখবেন আপনিও এ ছবিতে একটা ক্যারেক্টার।

আপত্তি নেই।

 আমি কিন্তু খুব রিস্ক নিয়ে কথাটা বলেছি মামাবাবু। ভেবেছিলাম আপনি ভীষণ রিঅ্যাক্ট করবেন।

বারীন্দ্রনাথ সৌম্যের কথায় কান দিলেন না। বললেন, ডাইরেক্টর হিরোইনকে নিয়ে কখন এসে পৌঁছুবেন?

বলেছেন সকাল আটটায় স্টার্ট করবেন। ঘণ্টা তিনেক তো লাগবেই। সৌম্য একটু ইতস্তত করে ফের বলল, মামাবাবু। অরিত্র আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। এখন সময় হবে?

 তোমার অনারে সময় দেব। তবে জনিকে দূরে কোথাও বেঁধে রাখতে হবে। বাইরের লোক দেখলে হৈচৈ করবে। নাহ্। তুমি ওকে সামলাতে পারবে না। রুক্মিণীকে বলছি।

 সৌম্য চলে গেল। বারীন্দ্রনাথ রুক্মিণীকে ডেকে কুকুরটা সরিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। তারপর পত্রিকাটা তুলে নীতা সোমের ছবির পাতাটা খুঁজে বের করলেন। ছবিটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন বারীন্দ্রনাথ।

একটু পরে পাঞ্জাবির ঝুল পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। খাম থেকে একটা ফোটোগ্রাফ বের করে মিলিয়ে দেখলেন। আবার উত্তেজনাটা ফিরে এল।

নীচের সুরকি-বিছানো রাস্তায় একটু দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে সৌম্য ও অরিত্রকে আসতে দেখে বারীন্দ্রনাথ খামটা পকেটে ঢোকালেন। পত্রিকাটা রেখে দিলেন টেবিলে। তারপর ডাকলেন, রুক্মিণী!

রুক্মিণী দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এল।

 চায়ের ট্রে নিয়ে যা। আর শোন। তোর বরকে বলবি, ওই ডালগুলো ছাঁটতে হবে। এখন নয়। পরে।

সৌম্য অরিত্রকে নিয়ে উত্তরের বারান্দা হয়ে এল। মামাবাবু। এই সেই অরিত্র।

অরিত্র পায়ে প্রণাম করতে এল। বারীন্দ্রনাথ হাসলেন। পা নেই। একজোড়া নকল পা। প্রণাম করবে কোথায়? বসো। সৌম্য! আমার ঘর থেকে চেয়ার এনে বস।

সৌম্য বলল, মা আমাকে বসতে বারণ করেছে। দ্বারিককে গাড়িতে বইতে হবে। হরিবল। আমার মারুতির শ্যাসি ভেঙে পড়লেই গেছি।

ওসব পলকা গাড়ি কিনেছ কেন?

 দ্বারিকের জন্য নিশ্চয় কিনিনি।

বারীন্দ্রনাথ ঘড়ি দেখে বললেন, চণ্ডীতলা বাজারে যাচ্ছ–সাবধান। দ্বারিক যেন কাকেও শ্যুটিংয়ের খবর দেয় না। আমার বলা আছে। তবু–

মামাবাবু। কোনও কোনও ব্যাপারে মা আপনার চেয়ে ইনটেলিজেন্ট। আমাকে দ্বারিকের এসকর্ট সার্ভিসের দায়িত্ব কেন দিচ্ছে, অলরেডি বুঝিয়ে বলেছে।

সৌম্য চলে যাওয়ার পর অরিত্র বলল, খবর রটে যেতে দেরি হয় না। তবে আমার ধারণা, শ্যুটিং বলতে ঠিক যা বোঝায়, তেমন কিছু হবে না।

বারীন্দ্রনাথ তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন। কী হবে?

অরিত্র হাসল। অবিনাশদার শো বিজনেস। আমাদের সঙ্গে রমেশ ভার্মা নামে এক ভদ্রলোক এসেছেন। ওয়েস্টার্ন ফিল্ম মার্কেটের ব্রোকার বলতে পারেন ওঁকে। অবিনাশদাকে ডিসটার্ব করবেন। আই মিন, একটা লিস্ট ধরিয়ে দেবেন হাতে। এটা করুন, ওটা করবেন না–আই নো হিম ওয়েল।

তাহলে আপনাদের ডাইরেক্টর ওঁকে সঙ্গে রাখছেন কেন?

ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। মনে হচ্ছে, ভার্মাসায়েব নিজেই ইনসিস্ট করে থাকবেন। অরিত্র হঠাৎ পাইন গাছটার দিকে আঙুল তুলল। কী আশ্চর্য! এটা পাইনগাছ না?

 হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদার অদ্ভুত অদ্ভুত হবি ছিল। এবাড়িতে অনেক বিদেশি গাছ দেখতে পাবে। তিনি হাতুড়ে বটানিস্ট ছিলেন। তুমি চা খাবে?

আজ্ঞে না। চা আমি খাই না। ধন্যবাদ।

 তুমি কি অন্য কিছু করো? নাকি শুধু অ্যাকটিং?

অরিত্র হাসল। আমি চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। একটা ফার্মে চাকরি করি।

বাহ্। খুব ভালো।

আপনার সঙ্গে আলাপের ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কাল রাত্রে আমাদের টিমের ম্যানেজার বটুকদা বলছিলেন, সাংঘাতিক একটা প্লেন অ্যাকসিডেন্টের পর আপনি বেঁচে যান। খুব থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স।

বারীন্দ্রনাথ তার কথার ওপর বললেন, বটুকদা বললে। ওঁর পুরো নাম কী?

 বটুক দত্ত।

ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। উনি কী করে জানলেন?

 সম্ভবত অবিনাশদা কিংবা সৌম্যের মুখে শুনে থাকবেন। অরিত্র একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল, ডিটেলস আপনার মুখে জানতে ইচ্ছে করছে।

কাগজে তো বেরিয়েছিল। টিভি-তেও নাকি দেখিয়েছিল–পরে শুনেছি।

 পড়ে থাকব। মনে নেই। কিংবা অত লক্ষ্য করিনি। অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি ইনসিস্ট করছি না। আপত্তি থাকলে বলবেন না। আসলে আমি নিজে একবার সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট থেকে দৈবাৎ বেঁচে যাই। সৌম্য বলছিল আপনার ইনসটিংকট কাজ করেছিল। আই বিলিভ দ্যাট।

কী অ্যাকসিডেন্ট?

তখন আমি ছাত্র। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ফুটপাতে একটা ঝুলবারান্দার তলায় দাঁড়িয়েছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ মাথার ওপর ছাদটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, ধসে পড়বে না তো? জাস্ট টু অর থ্রি সেকেন্ডস। পাশেই একটা রেস্তোরাঁর দরজায় সরে গেছি, ছাদটা সত্যি ভেঙে পড়ল। যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা কেউ বাঁচেনি। কয়েকজন পরে হসপিটালে গিয়ে মারা যায়। সেই থেকে একটা আতঙ্ক আমার পিছু ছাড়েনি। পুরনো কোনও বাড়ি দেখলেই একটা স্ট্রেঞ্জ ফিলিংস হয়।

বারীন্দ্রনাথ হাসলেন। এই বাড়িটা নাইনটিন টুয়েলভে তৈরি।

নাহ। আমি ঠিক তা বলছি না। ইনসটিংকটের কথা বলছি। সিক্সথ সেন্স বললে পয়েন্টটা হয়তো স্পষ্ট হয়। আমার ধারণা, একসময় প্যারাসাইকোলজি নিয়ে খুব পড়াশুনা করেছিলাম। এখনও তেমন বইটই পেলে পড়ি। ই এস পি বলে একটা টার্ম আছে শুনে থাকবেন। এক্সট্রাসেনসুয়ারি পার্ফেকশন। এ নিয়ে ওয়েস্টে প্রচুর রিসার্চ হয়েছে। হচ্ছে।

 বারীন্দ্রনাথ একটা সিগারেট ধরিয়ে অভ্যাসমতো ধোঁয়ার রিং বানাতে থাকলেন। তারপর বললেন, সিক্সথ সেন্স কি না জানি না। পাইলট জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাফ ওয়েদার। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং ছাড়া উপায় নেই। আমার সিটের পাশেই এমার্জেন্সি ডোর ছিল। প্লেনটা তখন বরফে ঢাকা গ্রাউন্ড লেভেল থেকে বিশ পঁচিশ ফুট উঁচুতে। শোনামাত্র এমার্জেন্সি ডোর খুলে ঝাঁপ দিলাম। নরম বরফের স্তর। তেমন কিছু আঘাত লাগেনি।

তাহলে আপনার পা।

 ফর্স্ট বাইট। প্রায় দুমাইল হেঁটে–ঠিক হাঁটা নয়, ওটা ছিল একটা অসমতল উপত্যকা। তবে ঝড়টার গতি যে দিকে, সেইদিকেই যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তারপর একটা রাস্তা পেয়ে যাই। সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফেরে হসপিটালে।

প্লেনটা?

 একবার ঘুরে দেখেছিলাম। আগুন জ্বলছিল।

 আর একজনও বাঁচেনি?

বারীন্দ্রনাথ একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আমার পাশের সিটে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনিও আমার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তার কী হল?

 আমি সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, কাছেই ওঁর চিৎকার শুনলাম। দেখলাম একটা উঁচু জায়গা থেকে গড়িয়ে পড়ছেন। সেখানে কয়েকটা পাইনগাছ ছিল। এজাতের পাইন নয়। ক্রিসমাস ট্রির মতো দেখতে। ওঁর কাছে যাওয়ার আগেই উনি গড়াতে গড়াতে আমার কাছে এসে হাজির। বারীন্দ্রনাথ হাসলেন। ব্লিজার্ড, তুষারঝড় হলে বাঁচার কোনও চান্স ছিল না। যাইহোক, একজন সঙ্গী থাকলে ওই অবস্থায় মনোবল বাড়ে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য! কিছুক্ষণ হাত ধরাধরি করে হাঁটার পর–হ্যাঁ, উনিই আমার হাত ছাড়তে চাইছিলেন না। ভীষণ আতঙ্কে যা হয়। তো আমার ডান হাত ব্যথা করছিল। আমি ওঁর কানের কাছে মুখ রেখে চিৎকার করে বললাম, আমার হাতে আঘাত লেগেছে। হাতটা ছাড়ুন। উনি ছাড়লেন না। অগত্যা জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম। আর সেই মুহূর্তেই ভদ্রলোক তুষারখাদে তলিয়ে গেলেন। নাহ্। আমি ওঁকে ইচ্ছে করে ধাক্কা মারিনি, কিংবা জানতাম না পাশেই তুষারখাদ আছে। খাদগুলো নরম বরফে ঢাকা থাকে। দেখে বোঝা যায় না কিছু। আমি কেন কোনও খাদে যে তলিয়ে যাইনি, তার ব্যাখ্যা দিতে পারব না।

তখন সময় কত? আই মিন, ডে অর নাইট?

ভোরবেলা। নাইঙ্খ নভেম্বর।

ইতালির কোন এরিয়া ওটা?

 তুসকানি এরিয়া। ইংরেজরা বলে টাসক্যানি। পাহাড়ি এলাকা। রাফ ওয়েদারের জন্য আমাদের প্লেনটা পথ বদলেছিল। যেখানে ক্র্যাশল্যান্ডিং করেছিল, সেই জায়গাটার নাম লা মারেম্মা। ওখানকার পাইনের জঙ্গল বিখ্যাত। পরে জেনেছিলাম।

তারপর?

 তারপর আর কী? মাস তিনেক ফ্লোরেন্সে একটা হসপিট্যালে থাকার পর ভারত সরকার আমাকে বোম্বেতে এনেছিলেন। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমি একজন এক্স এম পি। বারীন্দ্রনাথের ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল। আমাদের সরকারের একটা প্রেসটিজ বলে কথা। ফ্লোরেন্সে ডাক্তাররা আমাকে বলেছিলেন, পা ফিরে পাব। বোম্বের ডাক্তাররা বললেন, হাঁটুর নীচে থেকে বাদ না দিলে উরুও নষ্ট হয়ে যাবে। যাক গে। আপদ গেল। বারীন্দ্রনাথ হেসে উঠলেন।

সেই ভদ্রলোকের পরিচয় জানা যায়নি?

 বাঙালি।

অরিত্র নড়ে বসল। বাঙালি? কী নাম ছিল ভদ্রলোকের?

 এস কে রায়। ব্যবসা ট্যাবসা করতেন–যতদূর মনে পড়ছে। কলকাতার লোক। বারীন্দ্রনাথ দূরের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে ফের বললেন, তদন্ত হয়েছিল। আমি সত্যি যা ঘটেছিল, তাই বলেছিলাম।

ওঁর ফ্যামিলির মোটা টাকা কম্পেনসেশন পাওয়ার কথা। তাই না?

জানি না। আমার পা দুটো ঠিক থাকলে খোঁজ নিতাম। তবে কম্পেনসেশন– তুমি ঠিক বলেছ, পাওয়ারই কথা। ফ্যামিলি থাকলে নিশ্চয় পেয়েছিল। না থাকলে অন্য কথা।

সুদক্ষিণা এসে বললেন, তোমার ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে গেছে।

অরিত্র উঠে দাঁড়াল। বলল, সরি মাসিমা।

 সুদক্ষিণা বললেন, না, না–তুমি বসো। সৌম্য বলে গেছে। তোমাকে যেন না খাইয়ে ছাড়ি না।

 না মাসিমা। বটুকদা রাগ করবেন। তা ছাড়া আমাদের টিমের একটা ডিসিপ্লিন আছে। মামাবাবু! চলি!

অরিত্র বারীন্দ্রনাথের সামনে প্রণামের ভঙ্গিতে নত হল। তারপর সুদক্ষিণার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। বারীন্দ্রনাথ বললেন, একে সিঁড়ি অব্দি পৌঁছে দাও। রুক্মিণী কোথায় জনিকে বেঁধে রেখেছে জানি না। আর শোনো। রুক্মিণীকে বল, এবার জনিকে নিয়ে আসুক। আমরা দুই বন্ধু এখানেই ব্রেকফাস্টে বসতে চাই।

সুদক্ষিণা অরিত্রকে পৌঁছে দিতে গেলেন। বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ার গড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন। টেবিলের ড্রয়ারের তালা খুলে পকেটে রাখা ছবির খামটা ড্রয়ারে ঢোকালেন। তালা এঁটে বেরিয়ে এলেন।

একটু পরে রুক্মিণী জনিকে নিয়ে এল। আগের জায়গায় বেঁধে রাখল। বারীন্দ্রনাথ নীচের রাস্তাটা দেখছিলেন। অরিত্র যেতে যেতে বার দুয়েক পিছু ফিরে তাঁকে দেখে গেল। হঠাৎ মনে হল, সৌম্যের বন্ধু প্লেনক্র্যাশের ঘটনা সম্পর্কে যেন একটু বেশি আগ্রহী। সিক্সথ সেন্স, প্যারাসাইকোলজি, ই এস পি এবং আমহার্স্ট স্ট্রিটে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া–

কিন্তু তার মুখের হাবভাব এবং চোখের দৃষ্টিতে যেন এসবের অতিরিক্ত কিছু ছিল।

নাকি বারীন্দ্রনাথের নিজেরই দেখার ভুল? আগে কেউ সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইলে খুব রঙ চড়িয়ে বলতেন। ক্রমশ একই কথা আর বলতে ভাল লাগে না। মোটামুটি একটা বর্ণনা দিয়ে থেমে যান। যে শুনছে, সে হয়তো তার প্রতি সমবেদনা দেখানোর জন্যই আগ্রহ দেখায়।

তবু একটা খটকা থেকে গেল।…

বেলা একটা নাগাদ বারীন্দ্রনাথ বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলেন, সেই সময় সুদক্ষিণা এসে ঘোষণা করলেন, এতক্ষণে ওরা এল। সৌম্য দেরি দেখে অস্থির। পাগলামির একটা সীমা থাকা উচিত। স্নান খাওয়া নেই। গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল।

বারীন্দ্রনাথ বই রেখে বললেন, সেই মেয়েটি–নীতা সোমকে দেখলে?

হ্যাঁ। মোটামুটি ভদ্র বলেই মনে হল। খুব উঁট দেখাবে ভেবেছিলাম। তেমন কিছু নয়। ওর সঙ্গে আরও একটি মেয়ে এসেছে। নীতার বন্ধু। ফিল্ম জার্নালিস্ট। বড় বেশি গায়ে পড়া। তোমার সঙ্গে আলাপ করতে আসবে বলল। আমি বললাম দাদাকে জিজ্ঞেস করব। সৌম্য বলে দিল, জিজ্ঞেস করার কী আছে? সৌম্যের আদিখ্যেতা দেখে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে।

বারীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন, আমার রাগ হচ্ছে না। তবে আগে আমি নীতা সোমের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। সৌম্যকে পাঠিয়ে দিও।…

.

০৪.

 বিকেলে সহসা প্রাকৃতিক উপদ্রব। তুমুল বৃষ্টি এবং মেঘের গর্জন। সেই সঙ্গে ঝাঁপিয়ে আসা এলোমেলো হওয়া। শ্যুটিংয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। পণ্ড হয়ে গেল।

শরৎকালে এ উপদ্রব অপ্রত্যাশিত ছিল না। কদিন থেকে গুমোট গরম পড়েছিল। নিসর্গ ছিল পটে আঁকা ছবির মতো স্থির। এখন চারদিকে জোরালো আলোড়ন। চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের মুহুর্মুহু চাবুক।

বারীন্দ্রনাথ ফিল্মের লোকেদের সভয়ে পালিয়ে যাওয়া দেখে মনে মনে হাসছিলেন। একসময় টের পেলেন বৃষ্টির ছাঁট এসে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাইনের ডালগুলো হেঁটে ফেলা ঠিক হয়নি। আসলে আউটহাউসের পুরোটা যাতে চোখে পড়ে, সেইজন্য বাবুরামকে কতকগুলো ডাল দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বাবুরাম এ বাড়ির পুরনো মালী। এসব কাজ সে শিল্পীর দক্ষতায় করতে পারে। পাইনগাছটার দিকে তাকালে এখন বরং ছিমছাম লাগে।

জনি মেঘ ডাকলে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। রুক্মিণী তাকে পাশের ঘরে রেখে এসেছে। ও ঘরে কিছু পুরনো আসবাব আছে। দুটো আলমারি আর একটা আয়রন চেস্ট আছে। জনির মন্দ লাগবে না।

বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ার গড়িয়ে তাঁর শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে সরে এলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। সৌম্য বলে গিয়েছিল, চারটেয় নীতা সোম আসবে। এদিন সে নাকি খুব ক্লান্ত। শুটিংয়ের মেজাজ নেই। চারটে বাজতে দু মিনিট বাকি। এখনই ঘরের ভেতর আবছা আঁধার ঘনিয়েছে। বারীন্দ্রনাথ ডাকলেন, রুক্মিণী!

রুক্মিণী দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। জি বড়াসাব বলে ছুটে এল।

বারীন্দ্রনাথ বললেন, আলো জ্বেলে দে।

রুক্মিণী তার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে বলল, কারেন্ট বন্ধ আছে বড়াসাব!

বারীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন, ট্রান্সফর্মারে বাজ পড়ে গেল নাকি দ্যাখ। সিনেমার বাবুরা আজ রাতে ঝিলের ডাইনির পাল্লায় পড়বে। কী বলিস?

রুক্মিণী হেসে ফেলল। তারপর বলল, চিনাবাত্তি জ্বেলে দিই বড়াসাব। মাচিস কোথায় রাখলেন?

নিয়ে আয়। আমি লাইটারে জ্বেলে দিই। আমার কাছে দেশলাই নেই।

চিনা লণ্ঠন টেবিলে রেখে রুক্মিণী বলল, চা আনব বড়াসাব?

 পুরো একপট চা নিয়ে আয়। দুটো কাপপ্লেট আনিস। কেমন?

রুক্মিণী চলে গেল। প্রতীক্ষা একটা দুঃসহ ঘটনা মানুষের জীবনে। সৌম্য কি ডাইরেক্টর ভদ্রলোকের সঙ্গে আউটহাউসে চলে গেছে? বৃষ্টি সমানে ঝরছে। এলোমেলো হাওয়া বইছে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেল ক্রমশ।

সুদক্ষিণা দক্ষিণের বারান্দা ঘুরে এলেন। তার সঙ্গে দুই যুবতী। সুদক্ষিণা বললেন, কারেন্ট নেই। হঠাৎ কি বিচ্ছিরি উৎপাত। আমি বললাম, ওপরে চলো বরং। দাদা আলাপ করতে চেয়েছেন।

বারীন্দ্রনাথ নীতার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নীতা সোম?

নীতা একটু ঝুঁকে করজোড়ে নমস্কার করল। তার পরনে শাড়ি। গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা। সিনেমার নায়িকাদের আদল তার মুখে।

বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ার গড়িয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, বসো। বাইরে বৃষ্টির ছাঁট আসছে।

নীতা শান্তভাবে বসল। রাত্রির পরনে সালোয়ার কামিজ। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে বারীন্দ্রনাথ বললেন, কাঠের পা প্রণাম নেয় না। বসো। তোমার নাম কী?

রাত্রি সেন।

 বাহ। অসাধারণ নাম। তুমি ফিল্ম জার্নালিস্ট? কোন কাগজের?

আমি ফ্রি ল্যান্সার।

সকালে একটি ছেলে আলাপ করতে এসেছিল। অরিত্র সেন। বাই এনি চান্স, তোমাদের দুই সেনের মধ্যে কোনও আত্মীয়তা আছে কি?

রাত্রি মাথা নাড়ল। নাহ্। অরিত্র থিয়েটারে অভিনয় করে। সেই সূত্রে চেনা জানা আছে।

পুপু। রুক্মিণীকে চা আনতে বলেছি। তুমি গিয়ে দেখ। আরও একটা কাপপ্লেট পাঠিয়ে দিও। আর দ্বারিককে হলঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বলো।

রাত্রি বলল, মাসিমা। আমি কিন্তু চা খাই না। নীতা। তুমি তো খাও।

নীতা বারীন্দ্রনাথকে দেখছিল। কোনও কথা বলল না। সুদক্ষিণা চলে গেলেন। বারীন্দ্রনাথ রাত্রির দিকে ঘুরে বললেন, রাত্রি। আমার মনে হচ্ছে তোমাদের মধ্যে বন্ধুতার সম্পর্ক আছে।

রাত্রি হাসল। আছে। আমি ওকে এক্সপ্লয়েট করি। তবে ওরও পাবলিসিটি হয়।

বারীন্দ্রনাথ সিগারেট অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে আস্তে বললেন, তুমি কিছু। মনে কোরো না। আমি নীতার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলব। প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেনসিয়াল।

বলুন না। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। রাত্রি নীতার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল।

 বারান্দায় দাঁড়ালে ভিজে যাবে। বরং তুমি নীচে আমার বোনের সঙ্গে গল্প করতে পারো। বারীন্দ্রনাথ হাসলেন। শি টক্স মাচ। তো তুমি জার্নালিস্ট। ইউ লাইক টক্স।

আমি ফিল্ম জার্নালিস্ট।

হু। যে পরিবেশে এই ফিল্ম তোলা হচ্ছে, সে বিষয়ে ডিটেলস জানতে পারবে। এবাড়ির একটা ইতিহাস আছে। তা ছাড়া উত্তরের ওই ঝিলটার নাম ডাইনির ঝিল। ইন্টারেস্টিং না?

রাত্রি হাসবার চেষ্টা করল। তারপর বেরিয়ে গেল। উত্তরের বারান্দার দিকে এগোতে গিয়ে ঘুরল দক্ষিণের বারান্দায়। তিনটে ঘরের পর হলঘরে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। সে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সুদক্ষিণা তাকে দেখতে পেয়ে নীচে ডাকলেন। হলঘরে টেবিলের ওপর একটা চিনা লণ্ঠন জ্বলছে। অনিচ্ছার সঙ্গে রাত্রি নেমে গেল। বলল-মাসিমা। আপনারা এমার্জেন্সি লাইট রাখেন না কেন? চার্জ দিয়ে রাখলেই তো লোডশেডিংয়ের সময় প্রচুর আলো পান।

সুদক্ষিণা বললেন, যতগুলো সৌম্য এনে দেয়, বেশিদিন টেকে না। দাদা কি নীতার সঙ্গে একা আলাপ করতে চাইলেন?

হ্যাঁ। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

 দাদার ওই এক বেয়াড়া স্বভাব। দেখবে, তোমার সঙ্গেও একা আলাপ করতে চাইবেন। ও কিছু না।

নীতা সোম আস্তে বলল, আমার সঙ্গে আপনার প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেনসিয়াল কী কথা থাকতে পারে? আমি আপনাকে কখনও দেখিনি। চিনি না।

তোমাকে একটা ছবি দেখাব। বলে পকেট থেকে চাবি বের করলেন বারীন্দ্রনাথ। পাশের টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। তারপর একটা খাম থেকে ছবি বের করে বললেন, দেখ তো, চিনতে পারো কি না?

নীতা ছবির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল। কিন্তু মুহূর্তে শক্ত হয়ে উঠল সে। তারপর শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কেন এ ছবি দেখাচ্ছেন আমাকে?

এই ভদ্রলোকের নাম এস কে রায়। ভদ্রমহিলা তার স্ত্রী। মাঝখানে তাদের মেয়ে–তোমার সঙ্গে আশ্চর্য মিল। এমন কি চিবুকের তিলটাও।

নীতা চুপ করে থাকল। রুক্মিণী এসে চা রেখে গেল। বারীন্দ্রনাথ চা তৈরি করে তার হাতে তুলে দিলেন। তারপর নিজের চা তৈরি করে চুমুক দিলেন। বললেন, দু বছর আগে ইতালির লা মারেম্মা পাইন উডসের মধ্যে একটা প্লেন ক্র্যাশল্যান্ডিং করেছিল। আমি সেই প্লেনের যাত্রী ছিলাম। আমার পাশের সিটে ছিলেন এস কে রায়। এমার্জেন্সি ডোর খুলে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। মিঃ রায়ও আমার সঙ্গে ঝপ দেন। তার দুর্ভাগ্য। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ উনি তুষারখাদে তলিয়ে যান। যাওয়ার মুহূর্তে ডান হাতে ওঁর ব্রিফকেসটা থেকে যায়। ফ্লোরেন্সের একটা হসপিট্যালে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ব্রিফকেসটা আমি খুলেছিলাম। হাইট ওয়াজ লকড। আমি নার্সদের বলে একজন লক মেকানিকের সাহায্য নিয়েছিলাম।

নীতা ঠোঁট কামড়ে ধরে শুনছিল। বলল, কী ছিল ওতে?

কিছু জামাকাপড়। অনেকগুলো নেমকার্ড। কয়েকটা চিঠি। ছ মাস পরে এই অবস্থায় কলকাতায় ফিরলাম। তারপর তোক পাঠিয়ে মিঃ রায়ের ঠিকানায় খোঁজ নিলাম। শুনলাম মিঃ রায়ের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে গেছেন। প্লেন কোম্পানির অফিসে যোগাযোগ করেছিলাম। আমি একজন এক্স এম পি। আমার বাবা মন্ত্রী ছিলেন। আই হ্যাড সো মেনি কনট্যাক্টস্, ইউ নো? তো ওঁরা জানালেন, মিসেস রায় সত্তর হাজার টাকা কম্পেনসেশন পেয়েছেন। আমি সব নিউজ পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। দুটো রেসপন্স পেয়েছিলাম। দুটোই জাল। পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। মিসেস রায়ের ছবির সঙ্গে মেলেনি।

নীতা চুপ করে থাকল। তার দৃষ্টি নীচের দিকে।

বারীন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে বললেন, মিঃ রায় ছিলেন বিজনেসম্যান। তবে একই সঙ্গে অকশনিয়ারের কারবারও করতেন। ওঁর কাগজপত্র থেকে একথা জেনেছি। দামি জিনিস বিশেষ করে পুরনো ঐতিহাসিক জিনিস নিলামে কিনে অন্য দেশে নিলামে বেচতেন। ওঁর স্ত্রীর নাম তপতী রায়। মেয়ের নাম ঊর্মি।

নীতা চাপা শ্বাস ছেড়ে মাথা দোলাল। বলল, আমি বুঝতে পারছি না কিছু। গতরাতে কেউ আমার প্রাইভেট নাম্বারে ফোন করে থ্রেটন করেছিল, এখানে এলে নাকি আমার বিপদ হবে। এখন আপনি এসব কথা বলছেন। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। প্লিজ স্টপ ইট।

বারীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি চা খাচ্ছ না!

 ইচ্ছে করছে না।

বারীন্দ্রনাথ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, লা মারেম্মা পাইন উডস ভ্যালিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ডান হাতে আঘাত লেগেছিল। মিঃ রায় আমার এই হাতটা আঁকড়ে ধরেছিলেন। আমি জোর করে ছাড়িয়ে না নিলে হয়তো– হ্যাঁ। এই অপরাধবোধ আমার মধ্যে থেকে গেছে। তাই ওঁর ব্রিফকেস ওঁর স্ত্রী বা মেয়ের হাতে তুলে দিতে চাই। অ্যান্ড আই থিংক, আই অ্যাম নট টকিং টু দ্য রং পার্সন।

নীতা একবার তাকিয়েই চোখ নামাল।

 বারীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন, সৌম্য বলে, আমার নাকি সিক্সথ সেন্স আছে। সৌম্য কাল বিকেলে আমাকে এই ফিল্ম ম্যাগাজিনটা দিয়েছিল। এতে তোমার ছবি আছে। এনিওয়ে। তুমি এইমাত্র বললে, গতরাতে কে তোমাকে এখানে আসতে নিষেধ করে হুমকি দিয়েছে। কাজেই হা–তুমি ঊর্মি। এক মিনিট। তোমাকে ব্রিফকেসটা এনে দেখাচ্ছি।

নীতা ভাঙা গলায় বলল, প্লিজ। দ্য পাস্ট ইজ পাস্ট। আই ওয়ান্ট টু ফরগেট দ্যাট ন্যাস্টি টাইম।

ব্রিফকেসটা এখন তোমাকে দেব না। কারণ তোমার বাবা একটা খুব দামি জিনিস লন্ডনের অকশন হাউসের মাধ্যমে বেচতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেটা ওতে আছে। যাইহোক, তোমার মা কোথায় আছেন?

আমি নিজের মুখে বলতে পারব না। দ্যাট্রক্স এ স্ক্যান্ডালাস অ্যাফেয়ার।

ঊর্মি। এ খুব গোপনীয় ব্যাপার। তোমার প্রাণের ঝুঁকি আছে তা বুঝতে পেরেছি। এর মধ্যে কোনও থার্ড পার্সনকে টেনে আনা ঠিক নয়। বারীন্দ্রনাথ চাপা গলায় বললেন ফের, তোমার বন্ধুকে কিছু বোলো না।

নীতা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, শি ইজ এ প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

বলো কী, বারীন্দ্রনাথ হাসলেন। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে বললেন, এটা তোমার কোনও সিনেমার গল্প না। রূঢ় বাস্তব।

রাত্রির একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। ব্ল্যাক ক্যাট এসকর্ট সার্ভিস। নীতা চোখের জল মুছে ফের বলল, দ্য সন অব এ বিচ–যে লোকটা আমার মাকে এলোপ করেছিল, অ্যান্ড দ্যা ফুলিশ উওম্যান হ্যাড টু কমিট সুইসাইড রাত্রি তাকে ফিনিশ করেছে।

ফিনিশ? হোয়াট ডাজ দ্যাট মিন?

 শি ইজ ডেঞ্জারাস।

 বারীন্দ্রনাথ দরজার দিকে ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে বললেন, দেন ইউ মাস্ট। অ্যাভয়েড হার।

রাত্রির কাছে আমার কিছু গোপন থাকে না।

এটা তোমাকে গোপন রাখতেই হবে, ঊর্মি।

 প্লিজ ডোন্ট কল মি ঊর্মি। শি ইজ ডেড।

ঠিক আছে। বারীন্দ্রনাথ চোখ বুজে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, বাট আই ইনসিস্ট, ওকে ব্রিফকেসের কথা বোলো না।

গতরাতে আমাকে থ্রেটন করার কথা রাত্রিকে তখনই জানিয়েছিলাম। তারপর সে আমার সঙ্গে এসেছে। রিস্ক নিয়েও এসেছে। নাও ইউ থিংক।

বারীন্দ্রনাথ সিগারেট অ্যাসট্রেতে ঘষে নিবিয়ে দিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, তুমি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের নাম শুনেছ?

 না। হু ইজ হি?

হি ইজ মোর জেঞ্জারাস দ্যান ইওর ডিটেকটিভ ফ্রেন্ড। তিনিও প্রয়োজনে কাকেও ফিনিশ করেন। তবে নট ইন দ্যাট সেন্স। ডোন্ট ফরগেট নীতা, আমি একজন এক্স এম পি। তুমি আমার কথা শোনো। এ ধরনের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কথা আমি জানি। ওরা আসলে ভাড়াটে গুণ্ডা পোষে। পুলিস এদের দিকে নজর রেখে চলে। হা–পুলিসকে এরা একটা শেয়ার দেয়। তাও জানি। অ্যান্ড আই মাস্ট টেল ইউ-অরিত্র ইজ ভেরি মাচ ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট দ্য প্লেনক্র্যাশ। রাত্রি আর অরিত্র পরস্পর পরিচিত।

এইসময় পাশের ঘরে জনির গর্জন শোনা গেল। বারীন্দ্রনাথ আস্তে বললেন, যা শুনেছ, ভুলে যাও। কেউ আসছে–যাকে জনি পছন্দ করে না। তুমি বসো। আমি দেখছি।

বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ার গড়িয়ে বাইরে গেলেন। তিনি ডাকলেন, দ্বারিক। দ্বারিক।

রুক্মিণী দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে দৌড়ে এল। জি বড়াসাব।

দ্বারিক কোথায়?

 কিচেনে বৈঠে আছে। ঠাকুরমোশায়ের সঙ্গে কথা বলছে।

জনিকে নিয়ে আয়। শোন। এ ঘরের ভেতর দিয়ে যা। ও ঘরটা আমি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছি। গলার চেন ধরে নিয়ে আসবি। দেখিস, আমার ঘরে ফিল্মের মেমসাব বসে আছে। জনির মেজাজের ঠিক থাকে না।

রুক্মিণী সাবধানে জনিকে নিয়ে এল। জনি নীতাকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। বারীন্দ্রনাথ রুক্মিণীর কাছ থেকে জনিকে নিলেন। বললেন, তুই নীচে গিয়ে দ্বারিককে বল, সিঁড়ির মাথায় হ্যাঁজাগটা জ্বালিয়ে রাখবে।

বৃষ্টি টিপটিপ করে ঝরছে। হাওয়াটা থেমে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছমছম করছে নীচের দিকে। আউটহাউসে আলো জ্বলছে। বারীন্দ্রনাথ উত্তরের বারান্দা থেকে দরজার সামনে দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় গেলেন। তারপর ফিরে এলেন।

জনির গলার চেন ধরে হুইলচেয়ার গড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন বারীন্দ্রনাথ। তারপর টেবিলের একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখলেন। কুকুরটা পিছনের দুই ঠ্যাং মুড়ে জিভ বের করে তাকিয়ে থাকল নীতার দিকে।

বারীন্দ্রনাথ বললেন, জনি লাইকস ইউ।

নীতা সেই ছবিটা দেখছিল। সে নিঃশব্দে কাঁদছিল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল, এই ছবিটা আমি নিতে পারি?

এখন নয়। যথাসময়ে এটা তুমি পাবে। ব্রিফকেসটাও পাবে। বারীন্দ্রনাথ ছবিটা নীতার হাত থেকে নিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেন। তারপর ড্রয়ারে তালা এঁটে সিগারেট ধরাতে যাচ্ছেন, সেইসময় আউটহাউসের দিকে একটা চিৎকার-চাঁচামেচি শোনা গেল। জনি গরগর করে উঠল। বারীন্দ্রনাথ দ্রুত ওর গলার চেন ধরে না ফেললে টেবিলসুদ্ধ টেনে দরজার দিকে এগিয়ে যেত সে।

নীতা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বারীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি বসো। আমি দেখছি কী হয়েছে।

জনির চেন ধরে বারান্দায় গেলেন বারীন্দ্রনাথ। নীচের রাস্তার টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কে দৌড়ে আসছে। বারীন্দ্রনাথ ডাকলেন, দ্বারিক। দ্বারিক।

হলঘরে সিঁড়ির মাথায় হ্যাঁজাগ জ্বলছে। দ্বারিকের সাড়া পাওয়া গেল নীচে পোর্টিকোর কাছে। তারপর সৌম্যের গলা শোনা গেল। সে দ্বারিককে কিছু বলল। দ্বারিক টর্চ জ্বালতে জ্বালতে আউটহাউসের দিকে দৌডুল। জনি সমানে গর্জন করছিল।

একটু পরে সৌম্য দক্ষিণের বারান্দা ঘুরে ছুটে এল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, মামাবাবু। সাংঘাতিক ব্যাপার। অরিত্রকে কে মার্ডার করেছে।

একটু শান্ত হও। তারপর বলো।

এ একটা অসম্ভব ব্যাপার। আমরা মেঝেয় বসে স্ক্রিপ্ট শুনছিলাম। লক্ষ্য করিনি কখন অরিত্র করিডরের দরজা খুলে ঘাটে গেছে। বটুকদা বাইরে থেকে বললেন, ঘাটের দরজা খুলল কে? আমি অরিত্রকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই মনে হল, রোয়িং করতে গেল নাকি। ও মাই গড! ঘাটে আলো ফেলে দেখি, অরিত্রের মাথায় চাপ-চাপ রক্ত-উপুড় হয়ে ঘাটের ধাপে পড়ে আছে।

সুদক্ষিণা হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, কোথায় খুনোখুনি হয়েছে সৌম্য?

 নীতা সোম উঠে দাঁড়িয়েছিল। ভাঙা গলায় বলল, রাত্রি কোথায় মাসিমা?

 ও তো আউটহাউসের দিকে ছুটে গেল। বারণ করলাম। শুনল না।

বারীন্দ্রনাথ বললেন, পুপু। তুমি নীচে গিয়ে থাকো। সৌম্য। আমি দেখছি থানার লাইন পাই কি না। না পেলে তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাবে। এক মিনিট।

ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে একটা টুলে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে বারীন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে বললেন, টেলিফোন লাইন ডেড। সৌম্য। তুমি থানায় গিয়ে খবর দাও। আর এই টেলিফোন নাম্বারটা নিয়ে যাও। বরং ওঁর নেমকার্ডটাই দিচ্ছি। এক্সচেঞ্জের বা থানা যেখান থেকে হোক, এই ভদ্রলোককে ট্রাঙ্ককল করে আমার কথা বলবে। শুধু বলবে, হেয়ার ইজ আ ভেরি মিসটিরিয়াস মার্ডার। যতক্ষণ লাইন না পাও, ওয়েট করবে। তবে আমার নাম করলে শিগগির পেতেও পারো। কুইক…

.

০৫.

সৌম্য গাড়ি নিয়ে চণ্ডীতলা বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল। এক্সপ্রেস বাসটা এল পাঁচ মিনিট দেরিতে। সকাল নটায় পৌঁছুনোর কথা। বারীন্দ্রনাথ চেহারার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তাই চিনে নিতে দেরি হল না। মাথায় টুপি, সাদা গোঁফ দাড়ি লম্বা-চওড়া মানুষ। গলায় বাইনোকুলার ও ক্যামেরা ঝুলছে। পিঠে আটকানো একটা ব্যাগ। ব্যাগের কোনা দিয়ে ছড়ি বা ছাতার বাঁটের মতো কী একটা উঁচিয়ে আছে। গায়ে ছাইরঙা ফুলহাতা শার্ট। পরনে ব্রিচেসের মতো আঁটো প্যান্ট এবং পায়ে হান্টিং বুট। হঠাৎ দেখলে সায়েব ট্যুরিস্ট মনে হয়।

সৌম্য এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করে বলল, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? আমি সৌম্য ব্যানার্জি। বারীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী আমার মামা। কাল রাতে আমি আপনাকে ট্রাঙ্ককল করেছিলাম।

কর্নেল নিঃসঙ্কোচে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমার বাবা অশোক ব্যানার্জিকে আমি চিনতাম। তুম কী করো?

বাবার অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিটা চালিয়ে যাচ্ছি। সৌম্য গাড়ির দরজা খুলে দিল। মামাবাবুর কাছে আপনার পরিচয় পেলাম। আপনি ওঁর বাগানবাড়িতে নাকি অনেকবার এসেছেন। আমি জানতাম না।

কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন, তোমার মা-ও আমার পরিচিত।

সৌম্য স্টার্ট দিয়ে বলল, মা আপনার কথা বলছিল। আপনি নাকি ঘন্টায় ঘণ্টায় কফি খান।

এবং চুরুট। কর্নেল বাইনোকুলার তুলে বললেন, চণ্ডীতলার পর থেকে বসন্তপুর পর্যন্ত প্রায় কুড়ি কিলোমিটার লো ল্যান্ড! একসময় প্রায় সবটাই ছিল জলা আর-মার্শল্যান্ড। আর কত পাখি।

সৌম্য বলল, জায়গাটা আমার ভাল লাগে। কিন্তু হঠাৎ একটা সাংঘাতিক মিসহ্যাপ হয়ে গেল।

তুমি বলছিলে এ ভেরি মিসটিরিয়াস মার্ডার।

 হ্যাঁ। অরিত্র সেন নামে আমার এক বন্ধু

 গোড়া থেকে বলো। মেক ইট ব্রিফ। আর গাড়ি আস্তে চালাও। আমার পাখি দেখার সুবিধে হবে।

সৌম্য স্পিড কমাল। তারপর আগাগোড়া ঘটনার বিবরণ দিতে থাকল। কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার। শুনছেন কি না বুঝতে পারছিল না সে।

বাগানবাড়ি প্রায় আধকিলোমিটার দূর থেকে হাইওয়ের চড়াই শুরু হয়েছে। সে থেমে গেলে কর্নেল বললেন, পুলিশ কি কাকেও অ্যারেস্ট করেছে?

অবিনাশদার টিমের ম্যানেজার বটুক দত্তকে ধরে নিয়ে গেছে। সৌম্য উত্তেজিতভাবে বলল, অ্যাবসার্ড। বটুকদা সন্ধ্যা থেকে ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকেন। পুলিস বলছে, মদ খেয়ে মারামারি। আউটহাউসের করিডরে রান্নার জন্য কিছু কাঠ ছিল। ঘাটের পাশে রক্তমাখা এক কাঠও পড়ে ছিল। কিন্তু বটুকদা জলি টাইপ মানুষ। আসলে উনিই প্রথমে ঘাটের দিকের দরজা খোলা দেখতে পান। পুলিশ এই পয়েন্টটাকে গুরুত্ব দিয়েছে।

ওঁরা কি এখনও আছেন?

ভোরে অবিনাশদা আর রমেশ ভার্মা চণ্ডীতলা গেছেন। আমার ধারণা হায়ার অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি ওঁদের ফিরতে দেখিনি। অবিনাশদার খ্যাতি-প্রতিপত্তি আছে। রমেশ ভার্মাও নাকি বিগ গাই–অরিত্র আমাকে বলেছিল।

তোমার কী ধারণা?

কী ব্যাপারে?

 আবাউট দিস ভেরি মিসটিরিয়াস মার্ডার?

আপনাকে বলেছিলাম। অরিত্র এই শ্যুটিংয়ের ব্যাপারে একটা গোপন কথা আমাকে পরে বলবে বলেছিল।

হু। কিন্তু বলার সুযোগ পেল না। ইজ ইট?

 এখন আমার মনে হচ্ছে, অরিত্র কোনও সাংঘাতিক কথা জানতে পেরেছিল বলেই তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বাট হু ক্যান ডু দ্যাট, ইউ থিঙ্ক?

বুঝতে পারছি না। মে বি, অরিত্র তার মার্ডারারকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য চুপিচুপি ঘাটে ডেকেছিল। কিংবা তার মার্ডারারই রফা করার ছলে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আসলেস্তখন কারেন্ট ছিল না। এমার্জেন্সি লাইটের সামনে বসে অবিনাশদা স্ক্রিপ্ট পড়ছিলেন–বটুকদা রাতের রান্নার ব্যবস্থা করতে বেরিয়েছিলেন। তখন ওঁর ড্রাঙ্ক অবস্থা।

 এখন কি পুলিস আছে ওখানে?

 একজন এস আই এবং জনাচার কনস্টেবল আছে।

 হু। পুলিসভ্যান দেখতে পাচ্ছি।

অদ্ভুত ব্যাপার। পোর্টিকোর পাশে টেলিফোন বসের তার কেউ টেনে ছিঁড়ে রেখেছিল। রাতেই অবশ্য জোড়া দিয়েছি।

পুলিশ দেখেছিল কি?

হ্যাঁ। ও সি নরেশবাবু আমাকে জোড়া দিতে বলেছিলেন। এ থেকে আমার ধারণা, মার্ডারার অরিত্রর বডি কোথাও লুকিয়ে ফেলার জন্য সময় চেয়েছিল। আই মিন, মার্ডারের আগেই এটা করেছিল সে।

কেন তা করবে সে?

পুলিস আসতে দেরি হবে। প্রায় ছ কিলোমিটার দূরে থানায় খবর দিতে যেতে হবে এবং তারপর পুলিস সেখান থেকে আসবে। এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যাবে। তা ছাড়া রাফ ওয়েদার।

বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ।

 সৌম্য প্রাইভেট রোডে গাড়ি ঢোকাল। দুধারে গভীর খাদ। জলে শালুক ফুটে আছে। রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো এবং কাল বিকেলের বৃষ্টির জল এখনও গর্তে জমে আছে। সৌম্য সাবধানে ড্রাইভ করছিল। ফটকের কাছাকাছি পৌঁছে বলল, আর একটা ব্যাপার। ঘাটে রোয়িং বোটের দড়ির ফাঁস ঢিলে হয়ে ছিল। আমি পুলিসকে বলেছিলাম। ওঁরা বললেন, ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। কাজেই ওটা কিছু নয়। কিন্তু আমি নিজে কাল ভোরে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিলাম। আমার ধারণা, অরিত্রের বডি বোটে চাপিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল মার্ডারার। উত্তরে ঘন কাশবন আছে। পরে সময়মতো গিয়ে পুঁতে ফেলা যেত। ওখানে মাটিটা খুব নরম।

খোঁড়ার জন্য একটা কোদাল বা কিছু দরকার হত।

 ঠিক এটাই বলতে চাইছিলাম। বাবুরাম মালীর কাছে উনুন খোঁড়ার জন্য বটুকদার লোকেরা একটা কোদাল চেয়ে নিয়েছিল। আজ ভোরে বাবুরাম বলল, কোদালটা খুঁজে পাওয়া গেল না।

রামবাহাদুর ফটক খুলে দিয়ে সেলাম ঠুকল। গাড়ি ভেতরে ঢোকার পর কর্নেল বললেন, কাল অবিনাশবাবু যখন আসেন, তখন ওঁর সঙ্গে কারা ছিলেন?

হিরোইন নীতা সোম, তার ফিল্মজার্নালিস্ট বন্ধু রাত্রি সেন, ক্যামেরাম্যান শুভময় ঘোষ আর এক ভদ্রলোক আমি চিনি না। ছবির প্রোডিউসারও হতে পারেন।

উত্তরে ঘুরে গাড়ি পুবের পোর্টিকোর তলায় পৌঁছুল। কর্নেল নেমে বাইনোকুলারে আউটহাউসটা দেখে নিয়ে বারান্দায় উঠলেন। সুদক্ষিণা হন্তদন্ত এসে প্রণাম করলেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, সৌম্য, তুমি কি জানো তোমার মায়ের নাম পুপু? তো পুপু। আগে কফি।

সৌম্য কর্নেলকে ওপরে নিয়ে গেল। সিঁড়ির মাথায় বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন, মর্নিং মিঃ রায়চৌধুরী।

বারীন্দ্র দু হাতে ওঁর হাতটা চেপে ধরে বললেন, মর্নিং কর্নেল সরকার। বাধ্য হয়ে আপনাকে কষ্ট দিলাম। তবে আমি জানতাম, আপনি আসবেন। আসুন।

সৌম্য বলল, আমার থাকার কি দরকার আছে মামাবাবু?

না। রাত্রি সেন তোমাকে খুঁজছিল। তাকে একটু আগে আউটহাউসের দিকে যেতে দেখলাম।

সৌম্য চলে গেল। বারীন্দ্রনাথ কর্নেলকে পুবের বারান্দায় তার ঘরের সামনে নিয়ে গেলেন। দক্ষিণের বারান্দা থেকে জনির গরগর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। রাবীন্দ্র বললেন, বারান্দায় বসা যাক। কাজ ভোরবেলা থেকে হাওয়া আছে। কদিন যা গুমোট গরম গেল। বসুন।

কর্নেল পিঠে আটকানো ব্যাগটা খুলে পায়ের কাছে রাখলেন। ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার টেবিলে রেখে টুপি খুললেন। অভ্যাসমতো টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, ভেরি মিসটিরিয়াস মার্ডার ঘটিয়ে ফেলেছেন!

বারীন্দ্রনাথ আস্তে বললেন, দ্য ব্রিফকেস মার্ডার।

কর্নেল তাকালেন। একটু পরে বললেন, আই সি।

 ঊর্মি রায়কে এতদিনে খুঁজে পেয়েছি। ইউ নো দ্য ট্র্যাজিক এপিসোড।

হু। বলুন।

 তাকে এখানে আনা হয়েছে। তার নাম এখন নীতা সোম। ফিল্মস্টার।

 আর ইউ সিওর?

অফকোর্স। তাকে ডেকে গোপনে সব কথা খুলে বলেছি। প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। তারপর ক্রমশ ভেঙে পড়ল।

সৌম্যের কাছে একটা ভার্সান শুনেছি। এবার আপনারটা শোনা যাক।

বারীন্দ্রনাথ সিগারেট ধরিয়ে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে রুক্মিণী কফি এবং কিছু স্ন্যাক্স আনল। বারীন্দ্রনাথ তাকে বললেন, দ্বারিককে বলেছি। উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরটা কর্নেলসায়েবের জন্য সাফ করে গুছিয়ে রাখে যেন। তুই গিয়ে দ্যাখ কী করছে।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হু। বলুন।

বারীন্দ্রনাথ আবার শুরু করলেন। শেষে বললেন, একটু আগে থানায় ফোন করেছিলাম। ও সি নরেশ ভদ্র বললেন, মর্গের ফাইন্যাল রিপোর্ট এখনও পাননি। তবে তার ধারণা নাকি সঠিক। ডেডবডির স্টমাকে প্রচুর অ্যালকোহলিক সাবট্যান্স পাওয়া গেছে।

অরিত্র সেনের জিনিসপত্র কি পুলিস নিয়ে গেছে?

জানি না। পুলিসের সার্চ করার কথা। তবে কয়েকটা হুইস্কির বোতল আর গ্লাস নিয়ে গেছে শুনেছি। আপনি তো জানেন, পুলিস ঝপট একটা কেস সাজিয়ে ফেলে।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনি একজন এক্স এম পি। পুলিস একটু বেশি অ্যাকটিভ হতেই পারে। যাই হোক, এই ঘটনায় দুটো পয়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। প্রথমটা হল, নীতা সোমকে এখানে আসতে নিষেধ করে কেউ হুমকি দিয়েছিল। দ্বিতীয়টা হল, ফিল্ম ম্যাগাজিন।

সৌম্য আমাকে দিয়েছিল পত্রিকাটা।

আপনি কি ফিল্ম ম্যাগাজিন নিয়মিত পড়েন?

নাহ্। ওসব ট্র্যাশ পড়তে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু সৌম্য বলল, এখানে যে হিরোইন আসছে, ওতে তার ছবি আছে। তাই একটু কৌতূহল হয়েছিল। দেখাচ্ছি। বলে বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ার গাড়িয়ে তার ঘরে ঢুকলেন।

কর্নেল বাইনোকুলারে ঝিল দেখতে থাকলেন। উত্তরের বাউন্ডারি ওয়ালের নীচে ঝিলের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল। একজন মধ্যবয়সি পুরুষ এবং যুবতী রোয়িং করছিল। বোটটা দ্রুত দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। কর্নেল বললেন, আপনার বোটটা এখনও আছে দেখছি।

আছে। মাঝেমাঝে সৌম্য এসে রোয়িং করে।

সৌম্য নয়, অন্য কারা রোয়িং করছে দেখলাম।

তা হলে ফিল্মের লোকেরা। বারীন্দ্রনাথ বেরিয়ে এলেন। পত্রিকা এবং সেই ফোটোটা কর্নেলকে দিয়ে বললেন, মিলিয়ে দেখে নিন।

কর্নেল পকেট থেকে আতশ কাঁচ বের করে কিছুক্ষণ মনোযাগ দিয়ে দেখার পর বললেন, হ্যাঁ। মিল আছে। তবে–

তবে কী?

 কর্নেল পত্রিকাটি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, আজকাল প্রিন্টিং টেকনোলজি দারুণ উন্নত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কত উঁইফোড় পত্রিকা বেরুচ্ছে। এটা নতুন পত্রিকা। একেবারে প্রথম সংখ্যা। প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে। এত সব ফুল পেজ কালার ফোটোগ্রাফি!

বারীন্দ্রনাথ কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, এবার নীতা সোমকে ডেকে পাঠাচ্ছি। মুখোমুখি দেখুন। কথা বলুন।

কর্নেল হাসলেন। নীতা সোমকেই রোয়িং করতে দেখলাম।

 সে কী! ওকে আমি নিষেধ করেছিলাম আপনি না আসা পর্যন্ত যেন বাইরে না বেরোয়।

বোঝা যাচ্ছে, ব্ল্যাক ক্যাট এসকর্ট সার্ভিসের রাত্রি সেনের ওপর ওর আস্থা বেশি।

কলকাতার প্রাইভেট ডিটেকটিভদের সঙ্গে আপনার চেনাজানা আছে। রাত্রি সেনকে চেনেন?

না। তবে শুনেছি, ব্ল্যাট ক্যাট সিনেমা মহলেই গোয়েন্দাগিরি করে-টরে। আজকাল যেখানেই টাকাকড়ির লেন-দেন, সেখানে এক পক্ষ অপর পক্ষের গোপন তথ্য জানতে চায়। প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আমি সৌম্যের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।

নাহ। আমি আউটহাউসে গিয়ে অবস্থাটা দেখি।..

আউটহাউসের সামনে একটা লিমুজিন এবং একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। লিমুজিনের ভেতরে দুটো লোক পা তুলে শুয়ে আছে। পুলিসের ছোট্ট দলটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে টহল দেওয়ার ভঙ্গি করছে। কর্নেল চওড়া করিডরে ঢুকে দেখলেন, বাঁদিকের বড় ঘরের মেঝেয় সতরঞ্জি বিছানো এবং একদঙ্গল নানা বয়সি লোক শুয়ে ও বসে ঝিমোচ্ছে। ঘাটের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সৌম্যের সঙ্গে দেখা হল। তার পাশে জিনস্-শার্ট পরা গাঁট্টাগোট্ট চেহারার একটি মেয়ে। এই তাহলে রাত্রি সেন। সে ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে ডাকছে, নীতা! দ্যাটস এনাফ। চলে এস। নীতা বোকামি কোরো না।

সৌম্য গম্ভীর মুখে বলল সি দ্যা ফান!

কর্নেল বললেন, ওরা এঞ্জয় করছে। তারপর রাত্রির দিকে তাকালেন।

 রাত্রি তার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার ডাকল, নীতা! কাম ব্যাক!

কর্নেল সৌম্যকে বললেন, ওই ভদ্রলোক কে?

সৌম্য খাপ্পা হয়ে বলল, জানি না। কোনও চামচা-টামচা হবে। ইউ নো দ্য টার্ম!

রাত্রি বলল, চামচা বলবেন না। প্রতুলবাবুই নীতাকে লাইমলাইটে এনেছেন। কিন্তু প্রব্লেম হল, নীতা রোয়িং জানে না।

সৌম্য বলল, ওই ভদ্রলোক তো জানেন।

 রাত্রি বলল, নীতা দুষ্টুমি করছে দেখছেন না? একটা অ্যাসিডেন্ট ঘটে গেলে কী হবে?

সৌম্য বলল, জোঁকে রক্ত চুষে এক মিনিট মড়া করে ফেলবে।

কর্নেল সৌম্যের কাঁধে হাত রেখে বললেন, লেট দেম এঞ্জয়। এস।

করিডরে ঢুকে সৌম্য বলল, বোটটা তুলে রাখা উচিত ছিল। আমাকে না জানিয়ে কেউ বোট ব্যবহার করলে আমার বড় খারাপ লাগে।

বাগানের মাঝামাঝি গিয়ে একটা অশোক গাছের তলায় কর্নেল দাঁড়ালেন। বললেন, একটা প্রশ্ন করব। আশা করি ঠিকঠাক জবাব পাব।

সৌম্য একটু অবাক হল। বলুন!

 তুমি যে ম্যাগাজিনটা তোমার মামাবাবুকে দিয়েছিলে, ওটা কোথায় কিনেছ?

 ওটা আমার কেনা নয়। অবিনাশদার শ্যুটিং টিমের কেউ এনেছিল। সন্ধ্যায় ওরা এল। আমি ওদের আউটহাউসের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করছিলাম। তখন দেখি, করিডরে ওটা পড়ে আছে। করিডরের সামনে একটা বেশি পাওয়ারের বা জ্বালানো হয়েছিল। তা না হলে ওটা চোখে পড়ত না। তারপর পাতা উল্টে দেখি। নীতা সোমের ছবি।

 তোমার মামাবাবুকে পত্রিকাটা দিতে গেলে কেন?

সৌম্য আরও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর বলল, মামাবাবুকে–মাই-গুডনেস! এসব পত্রিকা মামাবাবুকে আমি দেব কেন? কোন সাহসে দেব? আশ্চর্য তো।

কিন্তু তুমি দিয়েছিলে। ওঁকে বলেছিলে, যে হিরোইন আসবে, এতে তার ছবি আছে।

এক মিনিট! আমাকে ভাবতে দিন। আসলে তখন অবিনাশদার টিম এসে গেছে। আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। যে বলছিল, তখনই তা করছিলাম। মে বি, সামবডি টোল্ড মি সামথিং টু ইম্প্রেস হিম। বাটু হু? সৌম্য স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। হ্যাঁ। আমি যখন ম্যাগাজিনটার পাতা উল্টে নীতা সোমের ছবি দেখছি, তখন কেউ আমাকে প্রোভোক করে থাকবে। ঠিক মনে করতে পারছি না। নাহ। অরিত্র নয়। নিশ্চয় অন্য কেউ আমাকে বলেছিল কিছু। তা না হলে আমি নিজে থেকেইম্পসিব! কাল ভোরে মা বলছিলেন, নীতা সোমকে নাকি মামাবাবুর চেনা মনে হয়েছে। আমি ওঁর কাছে চলে গেলাম। ঠিক তখনই কিন্তু কথাটা মাথায় একবার এসেছিল। ভীষণ বিব্রতবোধ করছিলাম।

কর্নেল বাইনোকুলার তুলে একটা পাখি দেখতে দেখতে বললেন, যদি তোমার কথা ঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে, প্ল্যানটা মোটামুটি সফল হয়েছে।

কিসের প্ল্যান?

টু ইম্প্রেস মিঃ রায়চৌধুরি। যাই হোক, তুমি গিয়ে তোমার বোটটা উদ্ধার করো। বলে কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে দক্ষিণে বাগানের ভেতর ঢুকে গেলেন। ওদিকটা জঙ্গল হয়ে আছে।

সৌম্য একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর আউটহাউসের দিকে চলে গেল।…

.

০৬.

কর্নেলকে দেখে বারীন্দ্রনাথ বললেন, আপনার ব্রেকফাস্টের দেরি হয়ে গেল। ভাবছিলাম সেবারকার মত কোন পাখির পেছনে পাঁচিল ডিঙিয়ে উধাও হলেন নাকি! কিংবা একঝক প্রজাপতির সামনে ধ্যানস্থ!

বারীন্দ্রনাথ হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, নীচে পুপু ওত পেতে ছিল। প্রচুর খাইয়ে দিল আতঙ্কে ওর দিশেহারা অবস্থা। সৌম্যকে ফিল্মওয়ালাদের হাত থেকে যেন বাঁচাই। ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, সিনেমার পর্দায় যারা খুনোখুনি করে, বাস্তবে তারা নিরীহ ভীতু মানুষ। পুপু মানতে চায় না। বলে কী, এই তো চোখের সামনে সদ্য খুনোখুনি হল।

টেলিফোন বাজল। বারীন্দ্রনাথ হুইলচেয়ার গড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন। জনি এখন পোর্টিকোর খোলা ছাদে রেলিংয়ে বাঁধা আছে। মুখ ঘুরিয়ে ধমক দিল।

কর্নেল টেবিলে টুপি রেখে চুরুট ধরালেন। তারপর বাইনোকুলারে আউটহাউস দেখতে থাকলেন। একই দৃশ্য। এখনও কী নীতা সোম এবং তার প্রোমোটার প্রতুলবাবু ঝিলের জলে ভেসে আছেন? এতক্ষণে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক যেন বা।

বারীন্দ্রনাথ বেরিয়ে এলেন। মুখে উত্তেজনার ছাপ। বললেন, ও সি নরেশবাবুর ফোন। মর্গের ফাইন্যান্ রিপোর্ট অন্য কথা বলছে। ভিকটিমের মাথার পেছনে রিভরের নল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে। গুলিটা হাড়ের খাঁজে আটকে ছিল। গুলি করার পর জ্বালানি কাঠ দিয়ে মাথার পেছনটা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। সদরে সি আই ডি-তে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বলে হাঁক দিলেন, রুক্মিণী!

দক্ষিণের বারান্দা থেকে রুক্মিণী ছুটে এল। জি বড়োসাব!

দ্বারিককে ডাক। শিগগির আসে যেন!

রুক্মিণী চলে গেল। কর্নেল বললেন, সৌম্য বলছিল, ডাইরেক্টর এবং রমেশ ভার্মা নামে এক ভদ্রলোক ভোরে বেরিয়ে গেছেন। তারা কিন্তু এখনও ফেরেননি!

পুলিস ওঁদের যেতে দিচ্ছিল না। অবিনাশবাবু এসে আমাকে অনুরোধ করলেন, ওঁর টিমের ম্যানেজার বটুকবাবু গোবেচারা মানুষ। একটুখানি ড্রিঙ্ক করলেই নাকি মাতাল হয়ে যান। উনি থানায় গিয়ে ও সি-কে বুঝিয়ে বলবেন। তো আমি এস আই বক্সিবাবুকে ডেকে বলে দিলাম। আফটার অল, অবিনাশবাবু একজন বিখ্যাত ফিল্ম ডাইরেক্টর।

কর্নেল দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন, সৌম্য একটা পয়েন্ট তুলেছে। রমেশ ভার্মা ওয়েস্টে ওরিয়েন্টাল ফিল্ম মার্কেটে দালালি করেন। তিনি লোকেশনে কেন?

পয়েন্টটা অরিত্রের কাছে কাল আমিও তুলেছিলাম। যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাইনি।

দ্বারিক এল। বারীন্দ্রনাথ বললেন, রামবাহাদুরকে গিয়ে বল, গেটে যেন তালা আটকে দেয়। ভেতর থেকে কেউ যেন বেরুতে না পারে। থানা থেকে আরও পুলিস আসছে। তারা এলে কাকে বেরুতে দেবে বা না দেবে, তারা বুঝবে। আর শোন, নীচে কোথায় বসিবাবু আছে, তাকে একটু লক্ষ্য রাখতে বলবি। সাব-ইন্সপেক্টর বসিবাবুকে তুই তো ভাল চিনিস। তোর দেশের লোক বলছিলি।

 আজ্ঞে! বলে মূর্তিমান দৈত্যটি চলে গেল।

নীচে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। একটু পরে গাড়িটা দেখা গেল। বারীন্দ্রনাথ আস্তে বললেন, অবিনাশবাবুর গাড়ি। বলছিলাম না, বিখ্যাত ফিল্ম ডাইরেক্টর? কেরিয়ার নষ্ট হোক, এমন কিছু করার মানুষ নন।

গাড়িটা আউটহাউসের সামনে গিয়ে থামল। কর্নেল ফিল্ম ম্যাগাজিনটার পাতা উল্টে বললেন, সৌম্য এটা নিজে থেকে আপনাকে দেয়নি। কেউ আপনাকে নীতা সোমের ছবি দেখানোর জন্য আগ্রহী ছিল। সে সৌম্যকে কাজে লাগিয়েছিল।

বলেন কী!

 এই পত্রিকার সম্পাদক লীনা বসু। প্রকাশক প্রতুল বসু। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা। কর্নেল হাসলেন। নীতা সোমকে জনৈক প্রতুলবাবু নাকি লাইমলাইটে এনেছেন। ঝিলের জলে নীতার সঙ্গে তাকে রোয়িং করতে দেখলাম। কিন্তু সৌম্য তাকে চেনে না। তার অজান্তে বোট ব্যবহার করার জন্য সৌম্য তার ওপর খাপ্পা। যাই হোক, এ একটা ওয়েল-প্ল্যানড গেম। সৌম্যের ফিল্মে নামার লোভ এবং সরলতাকে এক্সপ্লয়েট করা হয়েছে।

বারীন্দ্রনাথ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং বানাতে থাকলেন। দৃষ্টি রিংয়ের দিকে। কিন্তু হাওয়া এসে দুষ্টুমি করে রিংগুলো ভাঙচুর করছিল।

মিঃ রায়চৌধুরী।

বলুন।

নাও দ্য ভাইটাল কোয়েশ্চেন। এস. কে. রায়ের ব্রিফকেসে নিলামে কেনা দামি ঐতিহাসিক গয়নার কথা সম্প্রতি কেউ বা কারা জেনে গেছে। বাট হাউ? আপনি কি কাকেও

নো, নো! নেভার! বারীন্দ্রনাথ জোরে মাথা দোলালেন। পুপুকেও বলিনি। কারণ তার পেটে কথা থাকে না। জানি শুধু আমি এবং আপনি।

আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, বিজ্ঞাপন দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। বরং কাস্টমস্ ডিপার্টমেন্টের হাতে ব্রিফকেসটা তুলে দিন। ঝুঁকি নেবেন না।

মাই গুডনেস্! বারীন্দ্রনাথ সোজা হয়ে বসলেন। গত জুলাই মাসে কাস্টমসে রেজিস্টার্ড এ ডি পোস্টে ডিটেল্স জানিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলাম। অ্যানলেজমেন্ট রিসিটটা ফিরে এল। কিন্তু কোনও জবাব নেই। অগাস্টের গোড়ায় আবার একটা রিমাইন্ডার পাঠিয়েছিলাম। রেজিস্টার্ড পোস্টে। নো রিপ্লাই। আপনাদের দেখাচ্ছি।

বারীন্দ্রনাথ ব্যস্তভাবে হুইলচেয়ার গড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে দেখছিলেন, সৌম্যের সঙ্গে নীতা সোম আর রাত্রি সেন আউটহাউস থেকে ফিরে আসছে। বারীন্দ্রনাথ বেরিয়ে এসে বললেন, এই দেখুন। চণ্ডীতলা পোস্ট অফিসের দুটো রিসিট। আর এইটে অ্যাকনলেজমেন্ট রিসিট।

বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল সেগুলো দেখলেন। তারপর বললেন, কাকে পোস্ট করতে পাঠিয়েছিলেন?

আমার পি এ অক্ষয়কে। তাকে আপনি দেখেছেন। লোকসভায় আমার টার্ম শেষ হওয়ার পরও তাকে ছাড়িয়ে দিইনি। অনেক খুচরো বৈষয়িক কাজকর্মের জন্য একজন লোক আমার দরকার ছিল।

 অক্ষয়বাবু কি এখনও আছেন?

না। সেপ্টেম্বরে চলে গেছে। কোথায় ভাল মাইনেতে কাজ পেয়েছে বলল। আমি আপত্তি করিনি। দেখলাম সুদক্ষিণা আছে। অসুবিধে হবে না।

কর্নেল রিসিটগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, কাস্টমস ডিপার্টমেন্টের ঠিকানায় একটা অন্য খামে ভরে একটা সাদা কাগজ পাঠিয়ে দিলেও পোস্ট অফিস আপনাকে রিসিট দেবে। কাস্টমসের ছাপ দেওয়া অ্যাকনলেজমেন্ট রিসিটও ফিরে আসবে।

বারীন্দ্রনাথ চমকে উঠেছিলেন। আস্তে বললেন, নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু অক্ষয়ের এত সাহস হবে?

হয়েছে। সে আপনার পি. এ. ছিল। এতদিন পরে কাস্টমসে আপনার চিঠি লেখায় তার কৌতূহল হতেই পারে। কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিয়ে ফের বললেন, কিন্তু অক্ষয়বাবু ঊর্মির ফোটোগ্রাফ

বারীন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে বললেন, ছেড়ে দিন। ওটা আলাদা ব্যাপার। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এতদিনে যেভাবে হোক ঊর্মিকে যখন পেয়েছি, তখন তার হাতে তার বাবার ব্রিফকেস তুলে দিলেই আমার শান্তি।

কর্নেল হাসলেন। কিন্তু ঊর্মিকে আপনি পাননি মিঃ রায়চৌধুরী।

 পাইনি?

নাহ। ইটস্ ও ওয়েল্‌-প্ল্যান্ড গেম। আপনি আসলে অকারণ একটা অপরাধবোধে ভুগছেন। তাই টাইম-ফ্যাক্টর আপনার মাথায় নেই। ব্রিফকেসের ফোটোটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট।

সো হোয়াট?

 ফোটোগ্রাফটা পুরনো। আর এই পত্রিকার ছবিটা এ মাসেই তুলে ছাপানো হয়েছে।

আমি মুখোমুখি ওকে খুঁটিয়ে দেখেছি।

চিনা লণ্ঠনের আলোয় দেখেছেন। মেকআপ তার মুখ। অ্যান্ড শি ইজ অ্যান অ্যাকট্রেস। কর্নেল চাপা স্বরে ফের বললেন, নীতা সোম দিনের আলোয় আপনার মুখোমুখি হবে না।

আমি ওকে ডাকছি। রুক্মিণী!

তখনই সারা এল। জি বড়াসাব!

 নীচে গিয়ে সৌম্যকে বল, নীতাকে নিয়ে আসবে। নীতা নামটা মনে থাকবে?

জি বড়াসাব! উনিই তো সেনিমার হিরোইন আছে। রুক্মিণী মুচকি হেসে চলে গেল।

 একটু পরে সৌম্য ওল। তার মুখ বেজায় গম্ভীর। বলল, নীতা রোয়িং করে টায়ার্ড। তাছাড়া অবিনাশদা এসে ওকে খুব বকাবকি করেছেন।

কর্নেল বললেন, বসো সৌম্য! বলো, এতক্ষণে আউটহাউসে কী সব হল?

সৌম্য হাসল। তারপর বলল, কী হবে? অবিনাশদা ফিরলেন। রমেশ ভার্মা নাকি চণ্ডীতলা বাজারে সিগারেট কিনতে গিয়ে উধাও হয়েছে। আপনি তখন জিজ্ঞেস করছিলেন, কে আমাকে পত্রিকাটা মামাবাবুকে দিতে বলেছিল। এখন আমার মনে হচ্ছে, ওই লোকটাই বলে থাকবে।

কেন মনে হচ্ছে?

 পত্রিকাটা ওর হাতে একবার দেখেছিলাম। গুটানো অবস্থায় মুঠোয় ধরে গাড়ি থেকে নেমেছিল। এই তো। এখনও দেখে বোঝা যাচ্ছে। তাই না?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমার বোটটা কি তুলে রেখে এলে?

নীতার প্রোমোটার প্রতুল বোস নীতাকে নামিয়ে দিয়ে এখনও রোয়িং করছে। অবিনাশদা ওকে খাতির করেন। বললেন, ওকে চটিও না। কী করব? অবিনাশদা না করা যায় না।

কর্নেল বাইনোকুলার তুলে ঝিলের দিকটা দেখতে দেখতে বললেন, সৌম্য। তোমার বোট ঝিলের ওপারে চলে গেছে। প্রতুল বোসকে দেখতে পাচ্ছি না। এখনই গিয়ে পুলিসের এস আই বসিবাবুকে খবর দাও। রমেশ ভার্মার মত প্রতুল বোসও মনে হচ্ছে উধাও হয়ে গেছেন।

সৌম্য তখনই ছুটে গেল। জনি গরগর করতে থাকল।

 বারীন্দ্রনাথ গুম হয়ে বসে ছিলেন। গলার ভেতর বললেন, আই ওয়াজ সো ফুলিশ! ঊর্মির ফোটোগ্রাফটা নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে গত মাসে অক্ষয়কে দিয়ে তিনটে কপি করিয়ে রেখেছিলাম। কলকাতার কোন স্টুডিয়ো থেকে কপি করে এনেছিল অক্ষয়। ও জিজ্ঞেস করেছিল। আমি ওকে শুধু বলেছিলাম, প্লেনক্র্যাশের পর আমার যে সহযাত্রী তুষার খাদে তলিয়ে যান, এটা তাঁর ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফ। অক্ষয়ের কাছে অন্তত এটুকু গোপন করার অর্থ হয় না।

কর্নেল বললেন, কাস্টমসকে লেখা আপনার গোপন চিঠি এবং এস কে রায়ের ফ্যামিলি ফোটো। অক্ষয়বাবু চান্সটা ছাড়তে চাননি। কিন্তু তাঁর দুর্বুদ্ধি। যাদের সাহায্য নিতে গেলেন, তারাই তাকে ল্যাং মেরেছে।

নীতা সোমকে তা হলে ওই বজ্জাতটাই ফোনে গ্রেটন করেছিল।

 আবার কে? কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। অবিনাশবাবুর সঙ্গে আলাপ করে আসি।

বারীন্দ্রনাথ রুষ্ট মুখে বললেন, নীতা সোমকে মিসপার্সোনিফিকেশনের দায়ে ধরিয়ে দেব।

মিঃ রায়চৌধুরী! সৌম্যের মত নীতা এই দাবার চালে একটা খুঁটি মাত্র। কেরিয়ারের স্বার্থে সে ঊর্মির রোলে অভিনয় করেছে মাত্র। আফটার অল সে একজন অভিনেত্রী। তার কথা ভুলে যান। তাছাড়া মিঃ রায়ের ব্রিফকেস পুলিসের হাতে যাক, এটা আমি উচিত মনে করি না। চিন্তা করুন। চীনের প্রাচীন মি রাজবংশের এক রাজকুমারীর জড়োয়া নেকলেস। এই অলঙ্কারের একটা অসাধারণ ঐতিহাসিক মর্যাদা আছে। আপাতত প্লিজ কিপ ইট ইন ইওর কাস্টডি। যথাসময়ে আমি বলব এবার আপনাকে কী করা উচিত।

বারীন্দ্রনাথ আবার সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়ার রিংগুলো নিয়ে আবার হাওয়ার দুষ্টুমি শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলেন কর্নেল নীচের রাস্তায় আউটহাউসের দিকে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ বাইনোকুলার তুলে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ডানদিকে বাগানের ভেতর অদৃশ্য হলেন। ওঁর এই অদ্ভুত বাতিক।

এই সময় জনি মুখ ঘুরিয়ে গরগর করতে থাকল। বারীন্দ্রনাথ ঘুরে দেখলেন, নীতা সোম আসছে। তার পেছনে ব্ল্যাক ক্যাট। নীতা এসে খুব আস্তে বলল, আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।

বারীন্দ্রনাথ শান্তভাবে বললেন, বসো।…

নীতা সোম বসল না। সে বারীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং হু হু করে কেঁদে ফেলল। বিশ্বাস করুন! আপনাকে আমি প্রতারণা করতে চাইনি। আমি জানতাম না, ব্রিফকেসের মধ্যে কী আছে। আমি শুধু কেরিয়ারের স্বার্থে প্রতুল বোসের কথায় রাজি হয়েছিলাম।

বারীন্দ্র একটু হাসলেন। তুমি দক্ষ অভিনেত্রী!

নীতা কান্নাজড়ানো গলায় বলল, আমি অভিনয় করছি না! আপনি যখন আমাকে ঊর্মির কথা বলছিলেন, তখন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। ঊর্মির জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের এত মিল! আমার বাবাও অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। আমার মা এক লোফারের সঙ্গে চলে গিয়েছিল আমাকে ফেলে। তারপর মা সুইসাইড করেছিল। আমার বিধবা মাসি আমাকে আশ্রয় দেন। তারপর

সে কান্না সামলে চোখ মুছল। বারীন্দ্রনাথ বললেন, ওঠ। সামনে বসে কথা বলো!

নীতা উঠে দাঁড়ালে রাত্রি তাকে বারীন্দ্রনাথের মুখোমুখি একটা চেয়ারে জোর করে বসিয়ে দিল। সে ক্ষুব্ধভাবে বলল, নীতাকে আমি স্কুলজীবন থেকে চিনি। ও আমার বন্ধু। অথচ এখানে আসবার সময় আসল কথাটা খুলে বলেনি। শুধু বলেছিল, উড়োফোনে কে ওকে হুমকি দিয়েছে।

নীতা বলল, আমি তখনও কিছু জানতাম না। এখানে আসবার পর প্রতুলদা আমাকে গোপনে ঊর্মি নামে একটি মেয়ের কাহিনী বলল। তারপর বলল সৌম্যের মামাবাবুর কাছে একটা ব্রিফকেস আছে। ঊর্মি হয়ে আমাকে ওটা নিতে হবে। তারপর হঠাৎ যখন অরিত্র খুন হয়ে গেল, আমি ভয় পেলাম। প্রতুলদাকে বললাম, আমি ঊর্মি হয়ে ব্রিফকেস হাতাতে পারব না। তখন রোয়িংয়ের ছলে প্রতুলদা। আমাকে ঝিলের জলে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিতে থাকল। কেরি সারের স্বার্থে প্রাণের ভয়ে আমি রাজি হলাম।

বারীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি অক্ষয় সাঁতরা নামে কাকেও চেনো?

নীতা চমকে উঠে তাকাল। একটু পরে বলল, হ্যাঁ। স্টুডিয়োমহলে ওঁকে দেখেছিলাম। গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসতেন। তারপর প্রতুলদার সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়েছিল। আমি দেখতাম, আমাকে লক্ষ্য করে দুজনে কী সব আলোচনা করছেন। এখানে আসবার কদিন আগে প্রতুলদার সঙ্গে খুব ঝগড়া হচ্ছিল। আমার সামনেই প্রতুলদা দুজন মস্তানটাইপ ছেলেকে ডেকে ওঁকে মারতে মারতে বের করে দিয়েছিলেন স্টুডিয়ো থেকে।

বারীন্দ্রনাথ আবার সিগারেট ধরিয়ে বললেন, হু। অক্ষয় একসময় ছিল আমার পি এ।

রাত্রি বলল, সত্যি বলতে কী, প্রতুল বোস যখন নীতাকে ঝিলের জলে রোয়িংয়ের ছলে নিয়ে গেছে, তখন আমার খুব ভয় করছিল। আমার মনে হচ্ছিল, নৌকো যেভাবে ইচ্ছে করে সে দোলাচ্ছে, নীতা যে-কোনো মুহূর্তে টাল খেয়ে জলে পড়ে যাবে।

জনি গরগর করে উঠল। সিঁড়ির মাথায় কর্নেলকে দেখা গেল। বারীন্দ্রনাথ ধোঁয়ার রিং বানিয়ে বললেন, পাখিটাকে নিশ্চয় হারিয়ে ফেলে ফিরে এলেন?

কর্নেল হাসলেন। নাহ্! আপনার প্রাক্তন পি এ অক্ষয়বাবু বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিমকোণের ভাঙা পাঁচিলের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে ছিলেন। বাইনোকুলারে তাকে দেখেই ছুটে গিয়েছিলাম।

বারীন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে বললেন, তারপর? তারপর?

পেছন থেকে ঝাঁপ দিয়ে ভদ্রলোককে ধরে ফেললাম। আপনি তো জানেন, সামরিক জীবনে গেরিলা হামলার ট্রেনিং আমার রপ্ত। তখনও অবশ্য জানি না, উনি অক্ষয় সাঁতরা। প্রাণের দায়ে ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, স্যারকে কিছু গোপন কথা বলার জন্য লুকিয়ে এসেছি। যাই হোক, ওঁকে পুলিশের জিম্মায় দিয়ে এলাম। কর্নেল বসে নীতা সোমের দিকে তাকালেন। তোমার ভিজে চোখ দেখে বুঝতে পারছি–হ্যাঁ, এই কান্নার জলটা গ্লিসারিন নয়। খাঁটি অঞ। তবে অবিনাশ ঘোষালের কাছে তোমার জীবনকাহিনী শুনে এলাম। ঊর্মির জীবনের সঙ্গেও তোমার মিল আছে। মিঃ রায়চৌধুরী! আপনাকে বলে গিয়েছিলাম, নীতা সৌম্যের মতোই দাবার চালে একটা খুঁটি মাত্র। চিয়ার আপ নীতা! অবিনাশ ঘোষাল তোমার পাশে। প্রতুল বোস ধরা পড়বে। তার জেল হবে। কিন্তু অবিনাশ ঘোষাল তোমাকে জিইয়ে তুলবেন। মিঃ রায়চৌধুরী! এবার কফিপার্টির আয়োজন করা হোক। অক্ষয় আমার আঙুলে কামড়ে দিয়েছে।

বারীন্দ্রনাথ এবং অন্যেরা হেসে উঠলেন। তারপর বারীন্দ্রনাথ হাঁকলেন, রুক্মিণী! কফি আনো।…