ছান্দোগ্যোপনিষৎ। ৪ প্রপাঠক। ৪ অধ্যায় অন্ধকারে বনচ্ছায়ে সরস্বতীতীরে অস্ত গেছে সন্ধ্যাসূর্য ; আসিয়াছে ফিরে নিস্তব্ধ আশ্রম - মাঝে ঋষিপুত্রগণ মস্তকে সমিধ্ভার করি আহরণ বনান্তর হতে ; ফিরায়ে এনেছে ডাকি তপোবনগোষ্ঠগৃহে স্নিগ্ধশান্ত - আঁখি শ্রান্ত হোমধেনুগণে ; করি সমাপন সন্ধ্যাস্নান সবে মিলি লয়েছে আসন গুরু গৌতমেরে ঘিরি কুটিরপ্রাঙ্গণে হোমাগ্নি - আলোকে । শূন্য অনন্ত গগনে ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি ; নক্ষত্রমণ্ডলী সারি সারি বসিয়াছে স্তব্ধ কুতূহলী নিঃশব্দ শিষ্যের মতো । নিভৃত আশ্রম উঠিল চকিত হয়ে ; মহর্ষি গৌতম কহিলেন , ‘ বৎসগণ , ব্রহ্মবিদ্যা কহি , করো অবধান ।' হেনকালে অর্ঘ্য বহি করপুট ভরি' পশিলা প্রাঙ্গণতলে তরুণ বালক ; বন্দী ফলফুলদলে ঋষির চরণপদ্ম , নমি ভক্তিভরে কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে , ‘ ভগবন্ , ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা - অভিলাষী আসিয়াছি দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী , সত্যকাম নাম মোর ।' শুনি স্মিতহাসে ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে , ‘ কুশল হউক সৌম্য । গোত্র কী তোমার ? বৎস , শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার ব্রহ্মবিদ্যালাভে ।' বালক কহিলা ধীরে , ‘ ভগবন্ , গোত্র নাহি জানি । জননীরে শুধায়ে আসিব কল্য , করো অনুমতি ।' এত কহি ঋষিপদে করিয়া প্রণতি গেল চলি সত্যকাম ঘন - অন্ধকার বনবীথি দিয়া , পদব্রজে হয়ে পার ক্ষীন স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী ; বালুতীরে সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননীকুটিরে করিলা প্রবেশ । ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা ; দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি জননী জবালা পুত্রপথ চাহি ; হেরি তারে বক্ষে টানি আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী কল্যাণকুশল । শুধাইলা সত্যকাম , ‘ কহো গো জননী , মোর পিতার কী নাম , কী বংশে জনম । গিয়াছিনু দীক্ষাতরে গৌতমের কাছে , গুরু কহিলেন মোরে — বৎস , শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার ব্রহ্মবিদ্যালাভে । মাতঃ , কী গোত্র আমার ? ' শুনি কথা , মৃদুকণ্ঠে অবনতমুখে কহিলা জননী , ‘ যৌবনে দারিদ্র্যদুখে বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে , জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে , গোত্র তব নাহি জানি তাত ।' পরদিন তপোবনতরুশিরে প্রসন্ন নবীন জাগিল প্রভাত । যত তাপসবালক শিশিরসুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলোক , ভক্তি - অশ্রু - ধৌত যেন নব পুণ্যচ্ছটা , প্রাত : স্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্দ্রসিক্তজটা , শুচিশোভা সৌম্যমূর্তি সমুজ্জ্বলকায়ে বসেছে বেষ্টন করি বৃদ্ধ বটচ্ছায়ে গুরু গৌতমেরে । বিহঙ্গকাকলিগান , মধুপগুঞ্জনগীতি , জলকলতান , তারি সাথে উঠিতেছে গম্ভীর মধুর বিচিত্র তরুণ কণ্ঠে সম্মিলিত সুর শান্ত সামগীতি । হেনকালে সত্যকাম কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম — মেলিয়া উদার আঁখি রহিলা নীরবে । আচার্য আশিষ করি শুধাইলা তবে , ‘ কী গোত্র তোমার সৌম্য , প্রিয়দরশন ? ' তুলি শির কহিলা বালক , ‘ ভগবন্ , নাহি জানি কী গোত্র আমার । পুছিলাম জননীরে , কহিলেন তিনি , সত্যকাম , বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে , জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে — গোত্র তব নাহি জানি ।' শুনি সে বারতা ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিলা কথা মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল পতঙ্গর মতো — সবে বিস্ময়বিকল , কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার । উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন , বাহু মেলি বালকেরে করিয়া আলিঙ্গন কহিলেন , ‘ অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত । তুমি দ্বিজোত্তম , তুমি সত্যকুলজাত ।'