অষ্টম পরিচ্ছেদ
[ মহারাজা ও মহারানি সীমান্তের দিকে যাত্রা করলেন। লেখকও তাঁদের সঙ্গে গেলেন। কী ভাবে তিনি দৈত্যদের দেশ ত্যাগ করলেন তার বিশদ বর্ণনা। লেখক ইংল্যান্ডে ফিরলেন। ]
বরাবর আমার একটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে এদের হাত থেকে পালাতে পারব এবং কোনো না কোনো সময়ে আমি দেশে ফিরবই ফিরব। তবে কী করেই বা এদের হাত থেকে মুক্তি পাব এবং কী করে দেশে ফিরতে পারব সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কিংবা কোনো পরিকল্পনাও রচনা করতে পারি নি, শুধু একটা বিশ্বাস অথবা ভিতর থেকে কেউ আমাকে প্রেরণা যোগাতো। আমি যে জাহাজ এসেছিলাম সেইটাই প্রথম জাহাজ যা এদেশের সামুদ্রিক এলাকায় ঢুকে পড়েছিল এবং মহারাজা কঠোর আদেশ দিয়েছিলেন যে যদি কোনো সময়ে ঐ রকম আর একটা জাহাজ এদিকে এসে পড়ে তাহলে সেখানে আটক করে যেন তার সমস্ত নাবিক ও যাত্রীসহ তাকে লোরক্রগ্রুডে তুলে আনা হয়।
তাঁর ভীষণ ইচ্ছে আমার মতো একটি রমণী যোগাড় করা, আমি তার সঙ্গে বিয়ে করে এদেশে সন্তান সন্ততির জন্ম দিতে পারি। কী ঘৃণিত প্রস্তাব। আমি এমন একটা বংশ এদেশে প্রতিষ্ঠা করব যারা বংশানুক্রমে পোষা ক্যানারি পাখির মতো খাঁচার মধ্যে বন্দী জীবন যাপন করবে। এবং নিজে কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্যে অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অভিজাত ব্যক্তিরা তাদের কিনে বন্দী করে রাখবে। আমাকে অবশ্য খুবই যত্নে রাখা হয়েছিল, আমি মহান রাজার এবং মহারানির প্রিয়পাত্র ছিলাম।
রাজসভায় সকলের আনন্দের উৎস ছিলাম কিন্তু এইভাবে দাসের মতো জীবন যাপন করা আমি মানুষের মর্যাদা হানির নামান্তর বলেই মনে করি। আমি ইংল্যান্ডে আমার নিজের বাড়িতে যেসব কথা দিয়ে এসেছিলাম সেসব আমি কখনই ভুলতে পারি না। আমি আমার মতোই মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই, তাদের সঙ্গে পথে প্রান্তরে বিচরণ করতে চাই, কেউ আমাকে চলবার সময় ব্যাঙের মতো পায়ে মাড়িয়ে অথবা কুকুর-বান্দার মতো সজোরে লাথি মেরে হত্যা করুক এই চিন্তায় সর্বদা শঙ্কিত থাকতে চাই না। কিন্তু আমি।যা আশা করি নি তার চেয়েও আগে এবং সহজে মুক্তি পেয়ে গেলাম। সমস্ত কাহিনী ও ঘটনা আমি যথাসময়েই বলব।
দেখতে দেখতে এদেশে আমার দুবছর কেটে গেল এবং আমি তিন বছরে পড়লাম। মহারাজা ও মহারানি রাজ্যের দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে ভ্রমণে যাবেন। আমি এবং গ্লামডালক্লিচ তাঁদের সঙ্গী হলাম। আমাকে যথারীতি আমার সেই ছোটো বাক্স-ঘরে বসিয়েই নিয়ে যাওয়া হল। এই ঘরের বিবরণ আমি আগেই দিয়েছি, বার ফুট চওড়া, বেশ আরামদায়ক। ছাদের চার কোণ থেকে সিলকের একটা হ্যামক ঝুলিয়ে দেবার নির্দেশ আমি দিয়েছিলাম। যাতে ভ্রমণের সময় আমি সেই হ্যামকে শুয়ে ঘুমোতে পারি। মিস্ত্রিকে আমি বলেছিলাম ছাদে এক ফুট ব্যাসওয়ালা গোল একটা ফুটো করে দিতে। তাহলে আমি যখন হ্যামকে শুয়ে থাকব তখন ঘরে হাওয়া খেলবে, আমি গরমে কষ্ট পাব না। তবে গর্তটা যেন ঠিক আমার মাথার ওপর না করা হয়, আর সেই ফুটোর নিচে একটা কাঠ এমনভাবে লাগানো থাকে যেটা আমি ইচ্ছামতো ঠেলে ফুটো বন্ধ করতে পারি।
আমাদের যাত্রাপথ শেষ হল, এইবার কিছুদিন বিশ্রাম। আমরা যেখানে থামলাম সেখান থেকে আমাদের বিলিতি হিসেব মতো সমুদ্র আঠার মাইল দূরে। এখানে মহারাজার একটা প্রাসাদ আছে। কাছেই একটা শহর আছে, সে শহরের নাম হল ফ্ল্যানফ্ল্যাসনিক । গ্লাম এবং আমি, আমরা দুজনেই অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম । আমার সামান্য সর্দি হয়েছিল । কিন্তু বেচারি গ্লাম এত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে, সে তার নিজের ঘরেই শুয়ে থাকত। এদিকে আমি সমুদ্র দেখবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সমুদ্র আমার পলায়নের একমাত্র পথ। অবশ্য সে সুযোগ যদি ঘটে যায়! আমার যত না সর্দি হয়েছিল, আমি তার চেয়ে বেশি কাতর হওয়ার ভান করলাম। আমি বললাম সমুদ্রের তাজা হাওয়া পেলে ভালো হয়।
আমার আবেদন মঞ্জুর হল, সঙ্গে একজন বালকভৃত্য দেওয়া হল । এই বালক আমার অনুরক্ত ছিল, ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে আমি শলা পরামর্শও করেছি। গ্লামডালক্লিচের ইচ্ছে নয় আমি যাই। তাই সে বার বার সেই বালককে সতর্ক করে দিতে লাগল । গ্লাম ছল ছল চোখে আমাকে বিদায় দিল, আমি গ্লামের সে মুখ ভুলব না। কে জানে যা ঘটতে যাচ্ছে তা সে আশঙ্কা করেছিল কি না। বালক আমাকে আমার বাক্সে বন্দী করে নিয়ে চলল। সমুদ্রের ধারে যেখানে পাহাড় ও পাথর আছে তা প্রাসাদ থেকে আধঘণ্টার পথ। সমুদ্রের ধারে পৌঁছে বালককে বললাম আমাকে নামিয়ে দিতে।
সমুদ্রের ধারে এসে আমি নিজেকে সুস্থ বোধ করলাম না। বালককে বললাম আমি হ্যামকে উঠে একটু ঘুমোব। একটু ঘুমোলে শরীর ঠিক হয়ে যাবে। আমি হ্যামকে উঠলাম। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল তাই বালক জানালা বন্ধ করে দিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমোবার আগে একটা জানালা দিয়ে দেখেছিলাম ছেলেটা তখন আমার বাক্স যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল সেখানে কোনো বিপদের আশঙ্কা না করে পাহাড় ও পাথরের খাঁজে খাঁজে পাখির ডিম খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম ।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাক্সর মাথায় যে আংটা আছে সেটা ধরে কে যেন হঠাৎ টেনে তুলল । বাক্সটা সহজে বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ঐ আংটা লাগানো হয়েছিল। আমার মনে হল আমার বাক্সটা আকাশে অনেক উঁচুতে উঠেছে আর সেটা প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রথম ধাক্কাতেই আমি হ্যামক থেকে বাক্সর মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলাম, তখন বাক্স খুব দুলছিল কিন্তু তারপর স্বাভাবিক হয়ে গেল। যত জোরে পারলাম আমি কয়েকবার চিৎকার করলাম কিন্তু বৃথা। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখলাম শুধু আকাশ আর মেঘ। মাথার ওপর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, পাখি বা পাখিরা যেন ডানা ঝটপট করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলাম কী সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি। নিশ্চয় কোনো ঈগল আমার বাক্স-ঘরের মাথার ওপরে আংটাটি তার ঠোঁট দিয়ে ধরে আকাশে উড়তে আরম্ভ করেছে, এবার পাথরের ওপর আছড়ে ফেলে দেবে, বাক্স ভাঙবে, আমি মরব, ঈগলটা আমার মৃতদেহটা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। দূরে কোথাও পাহাড়ে এই পাখির বাসা, গন্ধ চিনে সে সেখানে যাবে। আমি আর বাক্সর ভেতর কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারব! কে জানে ভাগ্যে কী আছে।
কিছুক্ষণ পরে ডানা ঝটপট ও আওয়াজ যেন খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম আমার বাক্স পড়ে গেল আর তারপরই অনুভব করলাম বাক্সটা কিছুর ওপর ওঠানামা করতে করতে দোল খাচ্ছে। পড়বার আগে বাক্সটা বেশ জোরে দুলে উঠেছিল, ডানা ঝটপটের আওয়াজও বেশ জোরে শুনেছিলাম। আমার মনে হয়, যে ঈগল আমার বাক্স তার ঠোঁটে ধরে উড়ে পালাচ্ছিল তাকে অন্য এক বা একাধিক ঈগল তাড়া করেছিল এবং তখন প্রথম ঈগল বাক্সটা সোজা ফেলে দেয়। পড়বার সময় আতঙ্কে আমি নিশ্বাস বন্ধ করেছিলাম । পড়বার সঙ্গে সঙ্গে একটা আওয়াজ শুনলাম। সে আওয়াজ নায়েগ্রা জল প্রপাতের চেয়েও জোর। তারপর মিনিট খানেক অন্ধকার। কী ঘটে গেল বুঝতে সময় লাগল। মাথা একটু ঠিক হতে বুঝলাম বাক্সটা ওঠা নামা করছে, জানালা দিয়ে বাইরে আলো দেখা যাচ্ছে। বাক্সটা একেবারে ফাঁকা নয় যে উলটে-পালটে যাবে। ভেতরে কিছু ওজন আছে, আমি আছি এবং কিছু মালপত্তরও আছে। বাক্সটা তখন পাঁচ ফুট মতো জলে ডুবে ভাসতে ভাসতে চলেছে।
আমার অনুমান ঠিক। ঈগল যখন আমাকে নিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছিল তখন দুটো তিনটে ঈগল তাকে তাড়া করেছিল, তখন সে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে আমাকে জলে ফেলে দেয়। বাক্সর নিচে লোহার মজবুত পাত বসানো থাকায়, নিচের অংশ ভারী ছিল অতএব সোজা হয়েই পড়েছে এবং জলে পড়ার আঘাতটাও সহ্য করেছে, বাক্সটা ভেঙে যায় নি। বাক্সটা বেশ মজবুত করেই তৈরি, অন্য দরজার মতো এর দরজা খোলার ব্যবস্থা নেই, ওপর থেকে নিচে টেনে নামিয়ে বন্ধ করতে হয় । পড়বার সময় দরজা বন্ধই ছিল, ফাঁক দিয়ে সামান্য জলই ঢুকেছিল । মাথার ওপর হাওয়া চলাচলের যে ফুটোটা ছিল সেটা বন্ধ করে দিলাম।
এখন আমার বারবার গ্লামডালক্লিচের কথা মনে পড়তে লাগল। মাত্র এক ঘণ্টা আগেও তার কাছে ছিলাম, মনে হচ্ছে কতদিন তাকে ছেড়ে আছি। আমি নিজেই এক দারুণ বিপদে পড়েছি তারই মধ্যে সত্যি কথা বলতে কি বেচারির কথা ভেবে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি । আমাকে আর না দেখতে পেয়ে বেচারি নিজেতো কষ্ট পাবেই উপরন্তু তাকে মহারানির ভর্ৎসনা শুনতে হবে, তিনি হয়তো ওকে তাড়িয়েই দেবেন। আমার মতো কোনো ভ্রমণকারী বোধহয় এমন বিপদে ও দুর্দশায় পড়ে নি। প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে বাক্সটা বুঝি পাহাড়ে ধাক্কা লেগে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে অথবা হঠাৎ ঝড়ে বা বড় ঢেউয়ের আঘাতে উলটে যাবে। কোনো দিকের কাঠ ফেটে গেলে বা জানালা ভেঙে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু । ভাগ্যিস জানালার কাচের ওপাশে দুর্ঘটনা এড়াবার জন্যে লোহার জাল লাগানো আছে এবং সে কাচও বেশ পুরু নইলে এতক্ষণে একটা কিছু হয়ে যেত।
কোনো কোনো ছিদ্র থেকে জল চুঁইয়ে ভিতরে ঢুকছিল তবে ভয়ের কিছু নয় । আমি সেই জল বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। আমি বাক্সর ছাদের ফুটোর ঢাকাটা খুলতে পারছিলাম না, পারলে বাক্সর ছাদে উঠে বসে থাকতাম। ঘরের বন্ধ অবস্থার যন্ত্রণার দায় থেকে মুক্তি পেতাম। বাক্সবন্দী হয়ে দুচার দিন যদি এইভাবেই থাকি তাহলেই বা তার ফল কী হবে? শীতে ও অনাহারে মৃত্যু। এইভাবে ঘণ্টা চারেক কাটল। প্রতি মুহূর্তে বিপদ আশঙ্কা করছি, এই বুঝি সব শেষ হল।
আমি পাঠকদের আগেই বলেছি আমার বাক্সর দুপাশে দুটি লোহার মজবুত হ্যান্ডেল ছিল। ওদিকে কোনো জানালা ছিল না। হ্যান্ডেল দুটো রাখবার উদ্দেশ্য আমি যখন বেড়াতে যেতাম তখন একজন ভৃত্য ঐ দুটো হ্যান্ডেল দুহাতে ধরে ঘোড়সওয়ারের কাছে তুলে দিত আর ঘোড়সওয়ার হ্যান্ডেল দুটোর ভিতর দিয়ে একটা বেল্ট ঢুকিয়ে দিয়ে বেল্টটা নিজের কোমরের বেল্টের সঙ্গে আটকে দিত। আমার মনে অবস্থা যখন এইরকম, প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা করছি, ঠিক সেই সময় আমার মনে হল বাক্সর হ্যান্ডেল দুটোতে যেন একটা আওয়াজ হল এবং আমার এও মনে হল আমার বাক্সটা সমুদ্রের ওপর দিয়ে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, দুপাশে ঢেউ কাটছে ঢেউ আছাড় দিচ্ছে অতএব বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে একটু ক্ষীণ আশা জাগল। যদিও বুঝতে পারছি না কী ভাবে আমার আশা ফলবতী হতে পারে। আমি আমার একটা চেয়ারের স্ক্রু খুলে ফেললাম কারণ চেয়ারগুলো ঐ স্ক্রু দিয়ে বাক্সর সঙ্গে আঁটা ছিল। তারপর সেই চেয়ারখানা তুলে এনে ছাদের ফুটোর ঠিক নিচে লাগালাম। এবার চেয়ারে উঠে ঢাকাটা সরিয়ে ফুটোর যত কাছে সম্ভব মুখ নিয়ে গিয়ে খুব জোরে চিৎকার করতে লাগলাম—জান বাঁচাও! যত রকম ভাষা আমার জানা আছে সবরকম ভাষায়। আমার সঙ্গে সব সময় যে ছড়ি থাকত তার ডগায় আমার রুমালটা আটকে ফুটো দিয়ে বাইরে বার করে কয়েকবার আন্দোলিত করলাম। যদি কাছে কোনো জাহাজ বা নৌকো থাকে তাহলে তারা বুঝতে পারবে একটা হতভাগা মানুষ বাক্সটার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।
আমার মনে হল আমার সব চেষ্টাই বিফল হচ্ছে তবুও আমি চেষ্টা করে চলেছি। তবে বাইরে দেখতে না পেলেও আমি বেশ বুঝতে পারছি যে আমার বাক্সটা কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই রকম ঘণ্টাখানেক চলল বা তারও কিছু বেশি হবে তারপর বাক্সটার যেদিকে হ্যান্ডেল আছে এবং যে দিকে জানালা নেই সেই দিকটা হঠাৎ একটা শক্ত কিছুতে ধাক্কা খেল । আমার মনে হল পাথর ধাক্কা লেগেছে। ধাক্কার ফলে আমাকে বাক্সর মধ্যে কয়েকবার গড়গড়ি খেতে হল। আমার বাক্সর ওপর কয়েকটা শব্দ শুনলাম। যেন একটা আংটার কাছি আমার বাক্সর উপর পড়ল এবং সেই কাছি বুঝি কেউ বাক্সর মাথায় পরাচ্ছে।
তারপর কেউ আমার বাক্সটাকে উপর দিয়ে তুলছে, অন্তত ফুট তিনেক তো তুলেছেই । তখন আমি আমার ছাদের ফুটো দিয়ে রুমাল বাঁধা ছড়িটা উপর দিকে তুলে ধরলাম আর সেই সঙ্গে বেশ জোরে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করতে লাগলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার গলা ভেঙে গেল। যাক তারপরই বাইরে থেকে আমি একটা উত্তর শুনতে পেলাম। বার বার তিন বার। আমার তখন যা আনন্দ হল তা এমন কেউ বুঝবে না যে না, আমার মতো বিপদে পড়েছে। মাথার উপর আওয়াজ শুনছি, ছাদের গর্তর দিকে মুখ করে কেউ ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, ভিতরে কেউ আছ নাকি? কথা বল। আমি উল্লসিত । ইংরেজিতে জবাব দিলাম, আমি ইংরেজ, খুব বিপদে পড়েছিলাম, এমন বিপদে মানুষ পড়ে না, এখন আমাকে এই বন্দী ঘর থেকে উদ্ধার কর। ওপর থেকে উত্তর এল, আর ভয় নেই, তুমি বেঁচে গেছ, তোমার বাক্স এখন একটা জাহাজের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে, ছুতোর মিস্ত্রিকে ডাকা হয়েছে, সে এসে বাক্স কেটে তোমাকে বার করবে। আমি বললাম, তার দরকার নেই। তাতে অনেক সময় লাগবে। বাক্সর মাথার আংটা ধরে বাক্সটা জাহাজের উপর টেনে তোল। তারপর ক্যাপটেনের কেবিনের সামনে নিয়ে চল।
আমি বুঝি তখন উত্তেজনায় পাগল হয়ে গেছি। আমি পাগলের মতো চিৎকার করে কথা বলছি। ওরা ভাবল আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি। ওরা হাসতে লাগল অথচ আমি আমারই মতো ইংরেজ এবং আমারই মতো মানুষদের মধ্যে এসে গেছি। তাদের শক্তিও আমার মতো। তবুও ছুতোর মিস্ত্রি এল এবং বাক্সর মাথায় চারফুট চওড়া একটা গর্ভ কাটল, তারপর ভেতরে একটা মই নামিয়ে ধিল। আমি সেই মই বেয়ে উপরে উঠলাম। এবং আমাকে জাহাজে নিয়ে যাওয়া হল। আমি তখন অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ও দুর্বল।
জাহাজের নাবিকেরা অবাক, স্তম্ভিত। আমাকে তারা হাজার প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল । কিন্তু আমার তখন সে সব প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। নাবিকদের মতো আমিও অবাক ও বিহ্বল। ভাবছি এতগুলো বেঁটে মানুষ এখানে এল কী করে অথচ তারা আমারই মতো মানুষ। আসলে দীর্ঘদিন দৈত্যপুরীতে থাকায় আমার দৃষ্টি তখন পর্যন্ত অভ্যস্ত হয় নি, নিজেকেও তখন দৈত্য মনে হচ্ছে। কিন্তু জাহাজের ক্যাপটেন মিঃ টমাস উইলকক্স একজন সজ্জন ও যোগ্য ব্যক্তি, প্রপশায়ারে তাঁর বাড়ি। তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন। তিনি বুঝলেন আমি বোধহয় জ্ঞান হারাব, তিনি নাবিকদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিজের কেবিনে নিয়ে গেলেন ।
তারপর আমাকে সুস্থ করবার জন্যে বলদায়ক একটি পানীয় (করডিয়াল) পান করতে দিলেন। বললেন ওঁরই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। ঘুমোবার আগে আমি ক্যাপটেনকে বললাম, বাক্সটি তাঁরা উদ্ধার করেছেন তার মধ্যে বেশ কিছু দামি আসবাব আছে। যা আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। ঐ বাক্সয় আছে চমৎকার একটি হ্যামক, উত্তম বিছানা সমেত একটি খাট, দুটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং কাপড়চোপড় রাখবার একটি ক্যাবিনেট। এছাড়া বাক্সর ভেতরের দেওয়াল সিলকের ওয়াড় দেওয়া নরম ও পাতলা গদি দিয়ে আচ্ছাদিত । ক্যাপটেন যদি বাক্সটা তার কেবিনে আনান তাহলে আমি কৃতাৰ্থ হব । আমি তখন বাক্সর দরজা খুলে দেখাতে পারব ভেতরে কী আছে। বাক্স আমি তাঁরই সামনে রেখে খুলব। আমি অবশ্য ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না তাই আমার কথা বলার ধরন দেখে ক্যাপটেন ভাবলেন আমার মাথা গুলিয়ে গেছে, আমি আবোল তাবোল বকছি। আমাকে বোধহয় সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যেই তিনি তখন বললেন ঠিক আছে সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি জাহাজের ডেকে গেলেন এবং আমার বাক্স-ঘরে কয়েকজন লোককে পাঠালেন ।
কিন্তু মতোমধ্যে নাবিকেরা (আমি পরে জানতে পেরেছিলাম) বাক্সঘরের ভেতর থেকে সব কিছু টেনে বার করেছে। দেওয়াল থেকেও তুলোর আস্তরণ খুলে ফেলেছে। নাবিকদের জানা ছিল না টেবিল চেয়ারগুলো স্ক্রু দিয়ে আঁটা তাই সেগুলো টেনে তুলতে গিয়ে তারা সব রীতিমতো জখম করেছে। এমন কি বাক্স থেকে কিছু কাঠ বার করে সেগুলো জাহাজ মেরামতের কাজে লাগিয়েছে। যখন তারা বুঝেছে ভাঙা বাক্সটা নিয়ে আর কিছু করবার নেই তখন সেটা জলে ফেলে দিয়েছে। বাক্সটার সব দিক ভেঙে যাওয়ায় সেটা সহজে জলে ডুবে গেছে। যাহোক এ দৃশ্য আমাকে দেখতে হয় নি। আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গীর এমন দুরবস্থা দেখলে আমার ভীষণ মানসিক কষ্ট হত। যদিও আমি তখন সব কিছু ভুলতে চাই তবুও সেই সময়ে অতীতের অনেক কথাই হয়তো আমার মনে পড়ত ।
আমি অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু দৈত্যপুরীর নানা ঘটনা এবং যেসব বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম সেগুলো স্বপ্নে দেখতে দেখতে বার বার আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। যাহোক ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে হল। এখন রাত্রি প্রায় আটটা। ক্যাপটেন তখনি রাতের আহার দিতে বললেন। ভেবেছিলেন আমি অনেকক্ষণ অভুক্ত আছি। তখন তিনি লক্ষ করলেন আমি স্বাভাবিক হয়েছি, দৃষ্টি সহজ হয়েছে, এলোমেলো কথা বলছি না তখন তিনিও নিম্ন কণ্ঠে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন, অত্যন্ত ভদ্রভাবে। ঘরে আমরা দুজন ব্যতীত যখন আর কেউ রইলাম না তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করলেন। আমি কোথায় গিয়েছিলাম এবং কী ভাবে ঐ বাক্সবন্দী হয়ে জলে ভাসছিলাম।
ক্যাপটেন বললেন বেলা বারটা আন্দাজ সময়ে দুপুরে তিনি যখন চোখে দূরবীন লাগিয়ে দূর সমুদ্রের দিকে নজর রাখছিলেন তখন অদ্ভুত বাক্সটা দূরে জলে ভাসতে দেখেন। প্রথমে উনি ভেবেছিলেন ওটি কোনো নৌকোর পাল, তার মানে কাছে কোনো বন্দর আছে। ওদের কিছু বিসকুট কেনার দাকার ছিল। কিন্তু কাছে আসতে তাঁর ভুল ভাঙল। কোনো কোনো নাবিক আবার সেটা দেখে ভয় পেয়েছিল। তারা ক্যাপটেনকে বলল, একটা বাড়ি সাঁতার কাটছে। তাদের বোকামি দেখে তিনি হাসতে থাকেন এবং তখন কয়েকজন নাবিক নিয়ে তিনি নিজেই নৌকোয় ওঠেন, আর তাদের বললেন সঙ্গে মজবুত দাঁড় নিতে।
সমুদ্র তখন শান্ত ছিল। আমাকে অর্থাৎ আমার বাক্স-বাড়িটা প্রথমে তিনি কয়েকবার প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর জানালা ও লোহার জাল লক্ষ করলেন, কিন্তু ভেতরে কিছু দেখা গেল না। তখন বাক্সর দুদিকে দুটো লোহার হ্যান্ডেল দেখতে পেয়ে নাবিকদের বললেন নৌকো তার কাছে নিয়ে যেতে। তারপর নির্দেশ দিলেন একটা হ্যান্ডেলের ভিতর দিয়ে দড়ি গয়ে সিন্দুকটাকে (ক্যাপটেন আমার বাক্স-বাড়িকে সিন্দুক বলতেন) জাহাজের দিকে টেনে আনতে । তাই আনা হল। বাক্সটা জাহাজের কাছে আসতে তিনি এবার বললেন তার মাথার ওপর আংটায় দড়ি লাগিয়ে সেটা টেনে জাহাজের উপর তুলতে। নাবিকেরা পুলি লাগিয়ে তার ভেতর দিয়ে দড়ি গলিয়ে বাক্সটা টেনে তুলতে লাগল। কিন্তু দু তিন ফুটের বেশি তুলতে পারল না।
ক্যাপটেন বললেন, তারপর ছড়ির ডগায় বাধা রুমাল দেখতে পেয়েই তাঁরা বুঝতে পারলেন কোনো দুর্ভাগ্য ব্যক্তি ঐ বাক্সর মধ্যে আটকে আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি অথবা তাঁর কোনো নাবিক আকাশ তখন বিরাট আকারের কোনো পাখি দেখতে পেয়েছিল কি না? অর্থাৎ যখন বাক্সটা সর্বপ্রথম ওদের নজরে পড়েছিল। তিনি ভেবে বললেন, আমি যখন ঘুমোচ্ছিলাম তখন নাবিকদের মধ্যে আমাকে নিয়ে কিছু আলোচনা চলছিল । তখন একজন নাবিক বলেছিল, সে দূর আকাশে উত্তর দিকে তিনটে ঈগল উড়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের দেখা ঈগল অপেক্ষা ছোটো কি বড় তা সে বলে নি। না বলতে পারার সম্ভবত কারণ ঈগলগুলো দূরে এবং অনেক উঁচুতে উড়ছিল ।
আমি ক্যাপটেনকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি তখন কূল থেকে কত দূরে ছিলেন বলে মনে করেন? তিনি অনেক ভেবে ও কিছু হিসেবনিকেশ করে বললেন তা একশ লিগ হবে। আমি বললাম আপনি বোধহয় ভুল করছেন, আপনি ওর অর্ধেক দূরেও ছিলেন না। কারণ আমি যে দেশ থেকে আসছি এবং ঈগল যখন আমাকে জলে ফেলে দিয়েছে ইতোমধ্যে দু ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়েছিল। ক্যাপটেন আবার চিন্তা করতে লাগলেন তারপর বললেন, আশঙ্কায় তোমার মাথা নিশ্চয়ই ঠিক কাজ করছিল না এবং আমার মনে হয় এখনো তা স্বাভাবিক হয় নি। তুমি তোমার কেবিনে গিয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। আমি বললাম আপনি ও আপনার লোকজনের সযত্ন পরিচর্যায় আমি বেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়েছি এবং এখন পূর্বের মতোই আমার বুদ্ধি বৃত্তি কাজ করছে।
এবার তিনি গম্ভীর হলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোনো গুরুতর অপরাধ করে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছি? তোমার অপরাধের জন্যে তোমার দেশের রাজা কি দণ্ডবিধান স্বরূপ তোমাকে সিন্দুকে বন্ধ করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন? অনেক দেশে এমন শাস্তি বিধান করা হয়। অপরাধীকে জোর করে ছিদ্র নৌকোয় তুলে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে কোনো খাবার বা পানীয় জল দেওয়া হয় না। ক্যাপটেন বললেন, এমন একজন ব্যক্তিকে জাহাজে তুলে তিনি যদিও দুঃখ বোধ করছেন তথাপি তিনি আমার কোনো ক্ষতি করতে চান না। প্রথমে যে বন্দরে জাহাজ ভিড়বে সেই বন্দরে তিনি আমাকে নামিয়ে দেবেন।
তিনি বললেন জাহাজে উঠে আমি নাবিকদের যে সমস্ত অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য কথা বলেছি এবং পরে আমার সিন্দুক বা বাক্স সম্বন্ধে তাঁকেও যা বলেছি তাতেই তার সন্দেহ হয়েছিল। তাছাড়া রাতে আহারের সময় আমার দৃষ্টি ও ব্যবহার লক্ষ করেও তাঁর এইরকম ধারণা হয়েছে। আমি বললাম তাহলে আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। তারপর আমি ইংল্যান্ড ছাড়ার পর থেকে তিনি আমাকে জাহাজে তোলা পর্যন্ত যা ঘটেছিল সেই কাহিনী তাঁকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে বললাম। মানুষের যুক্তিবাদী মন সত্য মিথ্যা বুঝতে পারে। জাহাজের ক্যাপটেন যোগ্য ও সৎ এবং তিনি শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি আমার কাহিনী বিশ্বাস করলেন।
আমার কাহিনীর কিছু প্রমাণ দেবার জন্যে আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম যে, আমার ক্যাবিনেটটি এই কেবিনে আনার ব্যবস্থা করতে যার চাবি আমার পকেটেই আছে। নাবিকরা আমার বাক্সর কী দুর্দশা করেছে সে কথা তিনি আমাকে আগেই বলেছিলেন। ক্যাবিনেট আনা হলে আমি সে দেশে যে সব দুর্লভ সাম্ৰগী সংগ্রহ করেছিলাম সেগুলো তাঁকে দেখাতে লাগলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমি সেগুলো আমার ছোটো বাক্সঘরের ক্যাবিনেটেই রেখেছিলাম। মহারাজার দাড়ি কেটে যে চিরুনি করেছিলাম এবং মহারানির বুড়ো আঙুলের কাটা নখে মহারাজার দাড়ি বসিয়ে যে আরেকটা সব আমি ক্যাপটেনকে দেখালাম। তারপর সুচ ও পিনের সংগ্রহ ছিল যা এক একটা এক ফুট থেকে দেড় ফুট লম্বা । বোলতার চারটে হুল জুড়ে একটা ছোটো যন্ত্র।
মহারানি একদিন আমাকে একটা সোনার আংটি উপহার দিয়েছিলেন, হাসতে হাসতে সেটা আবার তিনি আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ সেটা তার কড়ে আঙুলের আংটি, তাও দেখালাম। ক্যাপটেন আমার প্রতি যে ভদ্রতা ও সৌজন্যে দেখিয়েছেন তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আংটিটা আমি ক্যাপটেনকে উপহার দিতে চাইলাম। কিন্তু তিনি নিতে রাজি হলেন না। মহারানির একজন সহচরীর পায়ের আঙুলের একটা কড়া আমি কেটেছিলাম, এই যে সেই কড়াটা, দেখেছেন কত বড় । এটা ক্রমশ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি যখন ইংল্যান্ডে পৌছব তখন এটা আরো শক্ত হবে। তখন এটা দিয়ে একটা বাটি বানিয়ে রুপো দিয়ে মুড়ে দেব।
অবশেষে আমি যে ব্রিচেশ পরে আছি সেদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, তাঁকে বললাম এই ব্রিচেশ ও দেশের ইঁদুরের চামড়ার তৈরি। গ্লামডালক্লিচের একজন ভৃত্যের একটি দাঁত আমার কাছে ছিল। একজন আনাড়ি ডাক্তার তার যন্ত্রণাদায়ক দাঁতটা তুলতে গিয়ে ভালো দাঁত তুলে ফেলেছিল। আমি সেই দাঁত পরিষ্কার করে আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। দাঁতটা এক ফুট লম্বা এবং বেড়ে চার ইঞ্চি। দাঁতটার প্রতি ক্যাপটেন কৌতূহল প্রকাশ করতে থাকায় সেটা আমি তাকে উপহার দিলাম। তিনি আমাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে সেটি নিজের কাছে রাখলেন।
ক্যাপটেন আমার প্রতি অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং আমাদের উভয়ের সম্পর্ক নিবিড় হল। তিনি আমাকে বললেন যে আমি ইংল্যান্ডে ফিরে আমার এই অভিজ্ঞতা সংবাদপত্র মারফত যেন পৃথিবীকে জানিয়ে দিই। আমি বললাম ভ্রমণের বই প্রচুর আছে, এত বেশি যে আমরা সব বই পড়ে উঠতে পারি না এবং নতুন যে বই লেখা হবে তা অসাধারণ না হলে কেউ পড়বে না। তবে কিছু ভ্রমণকারী বা লেখক এমন কাহিনী লিখেছেন যা তিনি নিজে দেখেন নি বা অতিরঞ্জিত করেছেন। আমি বললাম আমার অভিজ্ঞতার বিষয় নতুন করে কী আর লিখতে পারি? অন্যান্য ভ্রমণকারী মতোই আমিও বিভিন্ন দেশের মানুষজন, গাছপালা, পশুপাখি, রীতিনীতি, অসভ্যদের মূর্তিপূজা, এই সবই তো দেখেছি। এসব বিষয়ে অনেকেই লিখেছেন। ক্যাপটেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম আপনি যখন বললেন তখন আমি ভেবে দেখব।
ক্যাপটেন আমাকে বললেন, একটা জিনিস ভেবে তিনি অবাক হচ্ছেন যে আমি এত জোরে কথা বলছি কেন? সে দেশের রাজা ও কি কানে কম শুনতেন? আমি বললাম গত দুবছর ধরে জোরে কথা বলে বলে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। রাজা ও তার প্রজাদের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক ও শ্রুতিমধুর, তাঁরা আমার সঙ্গে ফিসফিস্ করে কথা বলতেন তাই আমি শুনতে পেতাম বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু ওদেশে আমি যার সঙ্গে কথা বলতাম আমার মনে হত সে বুঝি কোনো রাস্তার ধারে উঁচু বাড়ির চুড়োয় বসে আছে, তারা এত লম্বা ছিল । আমাকে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে তাঁরা সামনে চেয়ারে বসলে অথবা আমাকে হাতে করে তুলে না নিলে তাঁরা আমার কথা শুনতে পেতেন না ।
আরো একটা কথা বলি, সে দেশে সব মানুষ তো বিরাট লম্বা। দু বছর তাদের দেখে দেখে আমার নজরও সেই রকমই হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি যখন বাক্স থেকে বেরিয়ে জাহাজে চারপাশে তাকালাম তখন আপনার নাবিকদের দেখে আমার মনে হচ্ছিল এ কোথায় এলাম! এখানে সব মানুষ তো ক্ষুদ্রকায়! তখন আমার মনে হচ্ছিল এমন বেঁটে মানুষ আমি বুঝি কখনা দেখি নি। ঐ মহারাজার দেশে আমি যখন ছিলাম তখন আমি আয়নায় নিজেকে দেখতে লজ্জা পেতাম কারণ আমার চারদিকে সব বিরাটকার মানুষ। তাদের তুলনায় নিজেকে পিপীলিকা মনে হত।
ক্যাপটেন আমাকে বললেন রাতে আহারের সময় তিনি লক্ষ করেছেন আমি যেন অনেক কিছু অবাক হয়ে দেখছি এবং মাঝে মাঝে হাসি দমন করতে পারছি না। তখন ক্যাপটেন মনে করেছিলেন আমার মাথার কোনো গোলামাল আছে। আমি বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন, তবে আমার মাথার কোনো গোলামাল হয় নি। আসলে ওদেশে সব কিছু বড় বড় আকারের দেখে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই খাবার টেবিলে ডিশ দেখে মনে হল ওটা বুঝি আমাদের তিন পেন্স রুপোলি মুদ্রার চেয়ে বড় নয়। পর্ক-এর ঠ্যাং বুঝি এক গ্রাসেই খেয়ে নেওয়া যাবে। একটা কাপ বুঝি বাদামের খোলার চেয়ে বড় নয়। এই ভাবে আমি ওদেশের মহারাজাদের প্রাসাদের নানা সামগ্রীর সঙ্গে আমাদের নিজেদের নানা সামগ্রীর তুলনা করে ক্যাপটেনকে বললাম এই আমার অবাক ও হাসবার কারণ । মহারানির কাছে এবং তাঁর সেবায় আমি বেশ আনন্দেই ছিলাম। তিনি অবশ্য আমার ব্যবহারের জন্যে সব কিছুই মাপ মতো তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন । কিন্তু চারপাশে যা দেখতাম সেগুলার সঙ্গে আমার নিজস্ব সামগ্রীগুলো ও নিজেকে তুলনা করে আমি নিজে নিজেই হাসতাম। কখনো মনে হত ছোটো হওয়াটা বুঝি একটা ত্রুটি।
এতক্ষণে ক্যাপটেন আমার বক্তব্য বুঝলেন এবং মজা করে বললেন আমার চোখ অনেক বড় হয়ে গেছে কিন্তু আমার পেট সে তুলনায় ছোটো। কারণ সারাদিন উপবাস করার পর রাত্রে যা খেলাম তা যৎসামান্য। তারপর কৌতুকের সঙ্গে বললেন আমার বাক্সটা ঈগল পাখি ঠোঁটে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ও তারপর সেটা অনেক উঁচু থেকে সে জলে ফেলে দিল, এ দৃশ্য দেখবার জন্যে তিনি সানন্দে একশ পাউন্ড খরচ করতে পারেন। এই বিরল ঘটনা ও দৃশ্য ভবিষ্যৎ বংশের জন্যে অবশ্যই লিপিবদ্ধ করে রাখা উচিত। তবে তিনি ফেটনের সঙ্গে তুলনা করে যে মন্তব্য করলেন তা আমি ঠিক হজম করতে পারলাম না।
ক্যাপটেন টনকিন থেকে ইংল্যান্ডে ফিরছিলেন। কিন্তু জাহাজ উত্তর-পূর্বদিকে পথভ্রষ্ট হয়ে ৪৪ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ১৪৩ ডিগ্রি দ্রাঘিমা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমি জাহাজে ওঠার দুদিন পরেই ট্রেড উইন্ডের প্রভাবে এসে আবার সে পথ পেয়ে যায় এবং সেই হাওয়া অনুসরণ করে দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ দিকে গিয়ে নিউ হল্যান্ড বন্দরে নোঙর ফেলে। তারপর নোঙর তুলে পশ্চিম-দক্ষিণের পশ্চিমে এবং পরে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে কম্পাসের কাঁটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গিয়ে আমরা কেপ অফ গুড-হোপ বন্দরে পৌছই ।
এই সমুদ্রযাত্রা অত্যন্ত সফল হয়েছিল। তবে তার বিবরণ দিয়ে পাঠকদের ধৈর্যের পরীক্ষা করতে চাই না। ফেরার পথেও কয়েকটা বন্দরে ক্যাপটেন জাহাজ ভিড়িয়েছিলেন। তাজা পানীয় জল ও আহার্য দ্রব্যের জন্যে ক্যাপটেন তীরে নৌকো পাঠাতেন কিন্তু আমি জাহাজেই থাকতাম এবং ইংল্যান্ডে ডাউনস না পৌঁছনো পর্যন্ত আমি আর কোথাও নামি নি। আমি দৈত্যপুরী থেকে পলায়নের পর প্রায় ন’মাস পরে ১৭০৬ সালের ৩রা জুন দেশের বন্দরে পৌঁছলাম। শুল্ক বাবদ আমি আমার মালপত্র জাহাজে ক্যাপটেনের কাছে জমা রাখার প্রস্তাব করলাম। কিন্তু ক্যাপটেন বললেন আমার মাল নামিয়ে নিতে, শুল্ক বাবদ তিনি এক ফার্দিংও নেবেন না। আমরা হৃদ্যভাবে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমি তাঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালাম তিনি যেন রেডরিফ-এ আমার বাড়িতে আসেন।
জাহাজ থেকে নেমে আমি পাঁচ শিলিং দিয়ে একটা বড় ঘোড়া ও পথপ্রদর্শক ভাড়া করলাম। ঐ পাঁচ শিলিং আমি ক্যাপটেনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দুপাশের বাড়ি, গাছ, মানুষ, গরু, ছাগ সব কিছু দেখে আমার মনে হতে লাগল আমি যেন লিলিপুটদের দেশে বিচরণ করছি। আমি কি আমার সামনের পথিককে মাড়িয়ে ফেলব নাকি? তাই আমি তাদের হেঁকে বলছিলাম সরে যেতে নইলে ওদের হয়তো আমি মাড়িয়েই ফেলব।
অনেক দিন বাড়ি ছাড়া। বাড়ির খবর আগে নেওয়া দরকার। কিন্তু তখনো আমি নিজেকে দৈত্য ভাবছি তাই যখন একজন ভৃত্য দরজা খুলে দিল তখন রাজহাঁস যেমন তার লম্বা ঘাড় বেঁকিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে, পাছে পাথা ঠুকে যায় সেই ভয়ে আমিও মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলাম। আমাকে আলিঙ্গন করার জন্যে আমার স্ত্রী ছুটে এল, আমি তখন হাঁটু মুড়ে প্রায় তাঁর হাঁটুর সমান নিচু হয়েছি। আমার মেয়েও এল আমার আশীর্বাদ নিতে । আমি তো দৈত্যপুরীতে দৈত্যদের মুখ দেখবার জন্যে সর্বদা মাথা তুলে রাখতাম, সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, তাই এই অবস্থায় আমি প্রথমে আমার মেয়েকে দেখতে পাই নি। দৈত্যদের মতো তাকে আমাকে চোখের কাছে নেবার জন্যে তার কোমর ধরে উঁচু করে তুললাম । ঘরে ভৃত্যরা এবং কয়েকজন বন্ধু ছিল। তখন তাদেরও আমি বামন ভাবছি। আমার স্ত্রীকে বললাম তুমি বুঝি খুব হাত টিপে খরচ করেছ, দেখছি না খেয়েই ছিলে, মেয়েটাও রোগা হয়ে গেছে। আমি এমন ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছিলাম যে জাহাজের ক্যাপটেনের মতো আমার স্ত্রী ও আর সকলেও ভাবতে আরম্ভ করেছিল যে আমার মাথায় কিছু গোলমাল হয়েছে। ভিন্ন দেশে থেকে আমার স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছিল, অভ্যাসও পালটে গিয়েছিল।
আমার স্ত্রী ও বন্ধুরা ক্রমশ আমার অবস্থা বুঝল এবং আমিও ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলল তোমার আর সমুদ্রে যাওয়া চলবে না কিন্তু আমার মাথার পোকা যখন নড়ে ওঠে তখন স্ত্রী বাধা দিলে আর কী হবে। পাঠক শিগগির জানতে পারবেন কী ঘটল। তবে এই সঙ্গে শেষ হল আমার সমুদ্র যাত্রার দ্বিতীয় ভাগ।
-সমাপ্ত-