ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
[ মহারাজা ও মহারানিকে খুশি করবার জন্যে লেখকের কয়েকটি কৌশল । তিনি সঙ্গীতে তাঁর পটুতা দেখালেন। মহারাজা ইউরোপের বিষয় জানতে চাইলেন এবং লেখকও তাঁর বিবরণ পেশ করলেন। মহারাজার মন্তব্য। ]
আমি মহারাজার কাছে সপ্তাহে একবার বা দুবার যেতাম এবং সেই সময়ে প্রায়ই দেখতাম তিনি দাড়ি কামাচ্ছেন । প্রথম প্রথম দেখেই আমার ভয় করত কারণ ক্ষুরটা ছিল বিরাট, আমাদের সবচেয়ে বড় তলোয়ার অপেক্ষা অনেক চওড়া ও লম্বা। দেশের রীতি অনুসারে মহারাজা সপ্তাহে দুদিন কামাতেন। একদিন পরামানিককে বললাম কামার পর ক্ষুরের গায়ে লেগে থাকা খানিকটা সাবান আমাকে দিতে। আমি সেই সাবান থেকে চল্লিশ মোটা ও শক্ত দাড়ি বেছে নিলাম। তারপর এক টুকরো কাঠ নিয়ে সেটা ছুলে চিরুনির মাথার মতো করে গ্লামের কাছ থেকে একটা সুচ চেয়ে নিয়ে সেই কাঠে কয়েকটা ছিদ্র করলাম। দাড়িগুলো এবার ছুরির সাহায্যে কেটে তার ভিতর ঢুকিয়ে কাজচলা গোছের একটা চিরুনি বানালাম। আমার নিজের চিরুনিটা অনেক পুরনো ও ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল, সেটা আর চুলে ধরছিল না। এদেশে এমন কারিগর থাকা সম্ভব নয় যে আমার জন্যে ছোট্ট একটা চিরুনি বানিয়ে দিতে পারবে।
এই চিরুনি তৈরি করা থেকে আমার মাথায় একটা মতলব এল যার দ্বারা আমি আমার অলস সময়গুলো কাজে লাগাতে পেরেছিলাম। যে রমণী মহারানির চুল আঁচড়ে দিত তাকে আমি বললাম চুল আচড়াবার সময় যেসব চুল মহারানির মাথা থেকে উঠে আসে সেগুলো আমাকে দিতে। এইভাবে আমি বেশ কিছু চুল জমালাম ও সেগুলো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখলাম। এরপর আমি সেই ছুতোর মিস্ত্রীকে বললাম আমার মাপমতো চেয়ার বানিয়ে দিতে কিন্তু তার বসবার ও পিঠ ঠেস দেবার জায়গা খালি রাখতে । দরকার মতো আমার জন্যে কিছু বানিয়ে দেবার আদেশ সেই ছুতোরকে দেওয়া ছিল। চেয়ারের ফ্রেম বানাবার পর আমি তাকে চেয়ারে জায়গামতো ছিদ্র করে দিতে বললাম । আমি তখন সেই ছিদ্রে মহারানির মাথার চুল ঢুকিয়ে বসবার আসন ও পিঠ ঠেস দেবার জায়গা ভরাট করে ফেললাম। ঠিক যেভাবে ইংল্যান্ডে বেতের চেয়ার তৈরি করা হয় আর কি। এইভাবে কয়েকটা চেয়ার তৈরি হতে আমি সেগুলো মহারানিকে উপহার দিলাম। তিনি খুশি হয়ে চেয়ারগুলো তাঁর আলমারিতে রেখে দিলেন। কেউ এলে রানি চেয়ারগুলো তাদের দেখাতেন, বলতেন দেখত কেমন ক্ষুদে অথচ চমৎকার জিনিস। সকলে তারিফ করত।
একদিন মহারানি আমাকে বললেন ঐ চেয়ারে বসতে। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হলাম না, বললাম ঐ চেয়ারে বসা অপেক্ষা আমার হাজার বার মৃত্যু ভালো, যে চুল মহারানির মাথার শোভা বৃদ্ধি করত সেই চুলে আমি আমার দেহের পশ্চাদ্দেশ রাখতে পারব না। কারিকুরি কাজে আমার দক্ষতা আছে। আমি মহারানির মাথার চুল দিয়ে পাঁচ ফুট লম্বা সুন্দর একটা পার্স বুনে তার ওপর সোনালি সুতো দিয়ে মহারানির নাম লিখে তাঁকে উপহার দিলাম। তিনি খুব তারিফ করলেন কিন্তু সেটি গ্লামডালক্লিচকে দিতে বললেন। আমি তাই সেটি গ্লামকেই দিলাম। সত্যি কথা বলতে কি পার্সটি ব্যবহার করা যায় না, বরঞ্চ একটি কৌতূহলের বস্তু, ওদেশের ভারী ও বড় মুদ্রা ওতে রাখা চলে না। গ্লাম ওর মধ্যে মেয়েদের প্রিয় দুচারটে ছোটো খেলনা রেখেছিল।
মহারাজা সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন এবং তিনি প্রায়ই ঐকতানের ব্যবস্থা করতেন। সেই সময়ে আমাকেও আমার বাক্স সমেত নিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর বসিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রগুলোর এত প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হত যে বাজনা ও সুরের পার্থক্য আমি ধরতেই পারতাম না, কানে তালা ধরে যেত। ইংল্যান্ডে পুরো একটি রাজকীয় বাহিনীর সমস্ত ড্রাম ট্রামপেট একসঙ্গে উচ্চগ্রামে বাজালেও এই প্রচণ্ড আওয়াজের কাছে পৌছতে পারবে না। অতএব প্রাসাদে যখন ঐক্যতান বাজানো হত আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম না। যতটা সম্ভব দূরে আমার বাক্স রাখতে বলতাম। তারপর আমি আমার ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে পর্দা নামিয়ে দিতাম তবেই আমি সেই সমবেত সঙ্গীত উপভোগ করতে পারতাম, তখন মন্দ লাগত।
আমি যখন যুবক ছিলাম তখন স্পিনেট নামে তারের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখেছিলাম। এরা এই যন্ত্রকে কী বলে জানি না, আমি ওটাকে স্পিনেটই বলতাম কারণ বাজাবার পদ্ধতিটা একই রকম ছিল। আমি দেখতাম একজন শিক্ষক সপ্তাহে দুদিন এসে গ্লামকে ঐ বাজনাটি বাজাতে শেখাত। আমার ইচ্ছে হল আমি ঐ যন্ত্রে কিছু ইংরেজি সুর মহারাজাকে শোনাই । কিন্তু গ্রামের যন্ত্রটা বাজানো আমার পক্ষে অসম্ভব। গ্লামের স্পিনেট ষাট ফুট লম্বা, চাবিগুলো এক ফুট তফাতে, আমি দুদিকে দুহাত প্রসারিত করলে পাঁচটার বেশি চাবি আয়ত্তে আনতে পারব না, তাছাড়া চাবিগুলো টিপতে হলে আমাকে ঘুসি মারতে হবে। তার মানে প্রচণ্ড পরিশ্রম অথচ অভীষ্ট ফল পাওয়া যাবে না। তখন আমি এক কাজ করলাম। দুটো বেটন মানে ছোটো লাঠি নিলাম, লাঠির মাথায় বেশ মজবুত করে দুটো কাঠের বল ঢুকিয়ে দিলাম। বল দুটো ইঁদুরের চামড়া দিয়ে বেশ করে মুড়ে দিলাম অর্থাৎ এমন দুটো হাতুড়ি তৈরি করলাম যা দিয়ে স্পিনেটের চাবিতে আঘাত করা।যায় অথচ চাবিগুলোর কোনো ক্ষতি হবে না। তারপর চারফুট লম্বা একটা বেঞ্চি তৈরি করিয়ে সেটা স্পিনেটের চাবিগুলোর নিচে রাখা হল। আমি সেই বেঞ্চিতে উঠে এদিক থেকে ওদিকে ছোটাছুটি করে চাবির ওপর হাতুড়ির আঘাত করে যন্ত্রটিতে নাচের সুর।তুলে মহারাজার মুখে হাসি ফোটালাম। মহারাজা ও মহারানি উভয়েই আমার সঙ্গীত উপভোগ করলেন কিন্তু আমার প্রচণ্ড পরিশ্রম হল এবং ষোলটার বেশি চাবিতে আঘাত করতে পারলাম না এবং অন্য শিল্পীদের মতো সব চাবি টিপে ব্যাস বা ট্রেবল সুর ঠিক মতো বার করতে পারি নি। তবুও একটা ক্ষুদে মানুষ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চমৎকার বাজনা বাজাতে পেরেছিল এতে মহারাজা মহারানি ও সমবেত নরনারী আনন্দিত।
মহারাজা কিন্তু রাজার মতো রাজা ছিলেন, সহানুভূতিশীল ও সমঝদার। তিনি গুণের আদর করতেন। তিনি প্রায়ই আমাকে তাঁর খাস কামরায় ডেকে পাঠাতেন, এবং বাক্স সমেত আমাকে তাঁর একটি টেবিলের ওপর রাখা হত। তারপর তিনি আমাকে একটা চেয়ার নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বলতেন। আমি তাঁর টেবিলের ওপর তিন গজ দূরে বসতাম যাতে তাঁর ঠিক মুখোমুখি বসতে পারি। তাঁর সামনে টেবিলের ওপর বসে তাঁর সঙ্গে খোলাখুলি অনেক বিষয়ে আলোচনা হত।
একদিন আমি সাহস করে মহারাজাকে বললাম, আপনি ইউরোপ ও বাকি জগটার ওপর বৃথা ঘৃণা পোষণ করেন, আপনি একজন মহানুভব ব্যক্তি, অতএব অন্য দেশের প্রতি বিরূপ ভাব কেন পোষণ করেন এটা ঠিক বোঝা যায় না। মানুষের আকার অনুসারে তার যুক্তিও যে গ্রাহ্য হবে এমন কথা ঠিক নয় বরঞ্চ আমাদের দেশে আমরা মনে করি মানুষ যত লম্বা হয় তার বিচারশক্তিও সেই অনুপাতে কমতে থাকে। ক্ষুদ্র প্রাণীদের মধ্যে দেখেন মৌমাছি ও পিপীলিকা কী পরিমাণে পরিশ্রমী। মৌচাক তার বাসা তৈরি করতে যে কুশলতার পরিচয় দেয় তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। মহারাজা আপনি হয়তো আমাকে অবুঝ বা দুর্বল ভাবছেন তবুও আমি হয়তো আপনার কোনো উপকারে আসতে পারি। মহারাজা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন এবং আমার প্রতি তার ধারণার উন্নতি হতে লাগল।
ইংরেজরা কী করে তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে সে বিষয়ে তিনি জানবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। যদিও সব রাজা নিজের শাসনব্যবস্থা উত্তম মনে করে থাকে তথাপি ইংরেজ শাসনব্যবস্থায় কিছু অনুকরণযোগ্য থাকলে তা তিনি গ্রহণ করবেন। সুজন পাঠক একবার কল্পনা করুন আমি তখন আকাঙ্ক্ষা করছিলাম আমার যদি ডিমস্থেনিস বা সিসেরো-এর মতো বাকশক্তি থাকত তাহলে মহারাজার প্রশংসা শুনে আমি যে গৌরব বোধ করেছিলাম তা আমার স্বদেশের গুণ প্রকাশ করতে উপযুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারতাম। আমি আমার সাধ্যানুযায়ী আমার দেশ সম্বন্ধে মহারাজাকে বলতে আরম্ভ করলাম।
আমি বললাম আমাদের সাম্রাজ্য দুটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। কিন্তু একই রাজা অধীন তিনটি দেশে সাম্রাজ বিস্তৃত। এ ছাড়া আমেরিকায় আমাদের উপনিবেশ আছে। জমির উর্বরতা ও দেশের আবহাওয়া সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বললাম। তারপর বললাম ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংগঠন যার একটি বিশিষ্ট অংশ হল হাউস অফ পিয়ারস, ইংল্যান্ডের প্রাচীন ও অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জন্যে এই হাউস সংরক্ষিত। এই হাউসে যারা প্রবেশের অধিকার লাভ করেন তাঁদের সর্বতোভাবে শিক্ষিত করার জন্যে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় । তাদের চারুকলা ও সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে হয়, রণকৌশল ও রাজনীতিতে পারঙ্গম হতে হয় যাতে তারা দেশ শাসনের উপযুক্ত হয়ে রাজাকে সুপরামর্শ দিতে পারে। শুধু তাই নয় আমাদের বিচার ব্যবস্থাও অতি উচ্চস্তরের, বিচারকদের সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ হতে হয়, তাদের পাণ্ডিত্য ও বিধানবলীতে এমন জ্ঞান থাকা চাই যা হবে তর্কাতীত । পার্লামেন্টের সভ্য ও অমাত্যগুণ এমন হবেন যাঁরা সর্বদা দেশের স্বার্থের প্রতিতীক্ষ্ণ নজর রাখবেন ও তাঁরা নিজেরা সাহস শৌর্যে কারো অপেক্ষা হীন হবেন না।
এইসব গুণাবলী বংশ পরম্পরায় চলে আসছে তাই আমাদের ন্যায়ে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ফলে এই সকল সদ্গুণের জন্যে তাঁরা উপযুক্ত পুরস্কারও পেয়ে থাকেন। ধর্মকেও আমরা উপেক্ষা করি না। জনসাধারণ যাতে ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত না হয় সেজন্যে বিশেষ এক সম্প্রদায় আছে যাদের আমরা বিশপ বলি। এই কাজের জন্যে।বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপযুক্ত লোককেই বেছে নেন, এমন লোক যারা পবিত্রভাবে জীবন যাপন করতে পারবেন কারণ তারা হবেন আদর্শ মানুষ, জনসাধারণ যাঁদের ধর্মপিতা বলে মেনে নেবেন।
পার্লামেন্টের আর একটি অংশ বা বিধানসভা আছে যাকে আমরা বলি হাউস অফ কমনস। দেশপ্রেম, সততা, যোগ্যতা, পাণ্ডিত্য ও সদগুণ বিচার করে হাউস অফ কমনসের সভ্যদের নির্বাচন করেন। আর এই হাউস মিলিত হওয়ার ফলে এবং প্রধানহিসেবে মাথায় সম্রাটকে রেখে শাসন ব্যবস্থা ইংল্যান্ডে প্রচলিত আছে তা হল ইউরোপের সেরা।
এরপর আমি আমার দেশের বিচার ব্যবস্থার কথা তুললাম। আমি বললাম আমাদের বিচারপতিরা প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, আইনের ব্যাখ্যা করতে সিদ্ধহস্ত, সম্পত্তি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধের তারা সুচারুরূপে নিষ্পত্তি বা মীমাংসা করে দেন, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে তাঁরা সদা সচেতন। তারপর আমি বললাম সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর আমাদের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থ বণ্টন করা হয়। শুধু বিচার ব্যবস্থা বা অর্থনীতি নয় আমাদের স্থল ও নৌসেনা তাদের সাহস ও শৌর্যের জন্যে সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত । আমাদের জনসংখ্যা প্রচুর, বিভিন্ন রাজনৈতিক।মতাবলম্বী বা কয়েক প্রকার ধর্ম মতাবলম্বী সম্প্রদায় থাকলেও তাদের স্বার্থ রক্ষা করে উদ্ভূত সমস্যারও সমাধান করা হয়। তারপর খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের নানা ব্যবস্থা আছে, অন্য দেশের তুলনায় আমরা সেখানেও পিছিয়ে নেই। আমরা সকলেই স্বদেশপ্রেমী, আমাদের কাছে দেশের সম্মান সর্বাগ্রে। মহারাজাকে এসব ব্যাখ্যা করে ইংল্যান্ডের গত একশত বৎসরের বিভিন্ন ঘটনাবলী ও ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করলাম।
এইসব আলোচনা চলেছিল অন্তত পাঁচদিন একটানা এবং আলোচনা চলত কয়েক ঘণ্টা ধরে। রাজা মনোযোগ দিয়ে ধৈর্যসহকারে শুনতেন। তিনি মাঝে মাঝে কিছু নোট করতেন এবং পরে আমাকে কী প্রশ্ন করবেন তাও লিখে রাখতেন। এইসব দীর্ঘ আলোচনার বুঝি শেষ নেই। মহারাজা আরো একদিন আমাকে নিয়ে বসলেন। তিনি নানা বিষয়ে যেসব নোট রেখেছিলেন তার মধ্যে কিছু অস্পষ্ট বিষয় ছিল, কিছু ব্যাখ্যা করার অবকাশ ছিল, কিছু তথ্য জানার ছিল, আপত্তিও কিছু ছিল। এইগুলো তিনি পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করে পরিষ্কার করে নিতে চাইলেন।
যেমন একটা প্রশ্ন করলেন যে অভিজাত পরিবারের যুবকদের দেহমনের বিকাশের জন্যে কী ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, তাদের শিক্ষা দেবার প্রাথমিক পর্যায়ে কী ও কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। যদি কোনো অভিজাত পরিবার নির্বংশ হয়ে যায় তাহলে বিধান পরিষদে তাদের স্থান কীভাবে পূরণ করা হয়। যাদের লর্ড উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাদের কী বিশেষ কোনো গুণাবলী থাকা প্রয়োজন? কখনো কোনো রাজা বা রাজবংশের কোনো ব্যক্তির মন জয় করবার জন্যে কিংবা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো মহিলাকে বা কোনো প্রধানমন্ত্রীকে বা বিরুদ্ধ দলের নেতাকে কিংবা নিজের দেলর সংগঠন মজবুত করতে অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে কি না অর্থাৎ মহারাজা জানতে চাইলেন আমাদের দেশে ঘুষ প্রথা চালু আছে কি না।
তারপর তিনি জানতে চাইলেন সকল লর্ড বংশের সন্তান বা স্বয়ং লর্ডগণ দেশের আইন সম্বন্ধে বা সম্পত্তি ও সম্পদের বিলি ব্যবস্থায় কতটা অভিজ্ঞ বা সচেতন। তারা নীচ প্রবৃত্তি, হিংসা, অভয়ে ঘুষ ইত্যাদি দ্বারা কতটা প্রভাবিত। লর্ড বংশের ব্যক্তি ও সন্তানদের সম্বন্ধে তিনি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। এত বিষয়ে প্রশ্ন করলেন এবং এমন খুঁটিয়ে আলোচনা করলেন যে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন করার আর কিছু বাকি থাকল না। আমিও এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করলাম।
এরপর তিনি সাধারণ বিধায়কদের বিষয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন। অর্থাৎ হাউস অফ কমনস-এর যারা নির্বাচিত হয় তাদের বিষয়ে। তাদের নির্বাচিত হওয়ার জন্যে কী যোগ্যতা থাকা দরকার বা কোনো বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয় কি না। কোনো রীতিবিহীন অথচ অর্থশালী প্রার্থী প্রচুর অর্থ ছড়িয়ে ভোটদাতাদের প্রভাবিত করতে পারে কি না এবং এর দ্বারা ভোটদাতাদের জমিদার বা যোগ্য ব্যক্তি প্রার্থী হলেও তাকে পরাজিত করতে পরে কি না। মহারাজা আরো জানতে চাইলেন সঙ্গতিপন্ন না হয়েও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে (যেজন্যে একটা পরিবার হয়তো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে) অথব অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে মানুষ বিধান পরিষদে নির্বাচিত হতে এত ব্যগ্র কেন! কী উদ্দেশ্য? অথচ নির্বাচিত হলে তাদের কোনো বেতন বা পেনসন দেওয়া হয় না মহারাজা মন্তব্য করলেন এই সকল ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের নির্বাচক-মণ্ডলীর প্রতি সুবিচার করতে পারে না বলে তাঁর বিশ্বাস।
আমি অবশ্য বলেছিলাম সম্মান, মর্যাদা এবং দেশসেবায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার হাউস অফ কমনস-এ নির্বাচিত হয়। তথাপি মহারাজা বিশ্বাস করতে পারলেন না, তিনি বললেন এসব ব্যক্তি সাধারণত নীতিহীন হয়, তারা কোনো নীতিহীন মন্ত্রীর সহযোগিতা কুকার্য করতে পারে। এছাড়া তিনি আমাকে আমার দেশ ও রীতিনীতি ও প্রথা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন, তার মধ্যে কিছু আপত্তিজনক প্রশ্নও ছিল। যা হোক সে সকল প্রশ্ন অবান্তর বলে এখানে তার পুনরাবৃত্তি করলাম না।
এবার মহারাজা আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে পড়লেন। কতকগুলো বিষয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে চাইলেন। আদালতের বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল কারণ আমি একটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম অতএব আমি মহারাজার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পেরেছিলাম। একটা মামলা চলতে কতদিন লাগে, কী রকম ব্যয় হয়। সুবিচার সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যায় কিনা ইত্যাদি জানতে চাইলেন। আমি তাঁর প্রতিটি প্রশ্নের সদুত্তর দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিলাম। কিন্তু তাঁর প্রশ্নের বুঝি শেষ নেই। কোনো মামলা যদি মিথ্যা অর্থাৎ সাজানো হয় সে ক্ষেত্রে আইনজীবীদের ভূমিকা কী? রাজনীতি ও ধর্মসংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি কীভাবে হয়? এই ধরনের মামলায় যেসব আইনজীবী পক্ষ সমর্থন করেন তাঁদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে কি না? বিচারকদের এক্ষেতে ভূমিকা কী? যদিও ধরে নেওয়া যায় তারা যথেষ্ট জ্ঞানী তথাপি তাঁরা কি প্রভাবিত হন? একই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে তাঁরা কি কখনো স্বতন্ত্র রায় দিয়েছেন? বিচারকরা কি স্বচ্ছল ব্যক্তি? নাকি অভাবী। তাঁরা তাঁদের সুচিন্তিত রায়দানের জন্যে অথবা অন্য কোনো কারণে পুরষ্কৃত হন? কর্মত্যাগ করে অথবা অবসর গ্রহণ করে তাঁরা কি কখনো হাউস অফ কমনস-এর সভ্য নির্বাচিত হয়েছেন?
ইংল্যান্ডের অর্থভাণ্ডার সম্বন্ধে তিনি প্রশ্ন করলেন এবং এক সময়ে মন্তব্য করলেন আমার স্মরণশক্তি বেশ দুর্বল কারণ পূর্বে আমি বলেছিলাম যে রাজস্ব বাবদ আমাদের আদায় হয় বছরে পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষ আর এখন আমি যে সংখ্যা বলছি তা নাকি আগে যা বলেছি তার দ্বিগুণ কারণ তিনি নোট রেখেছেন। তিনি বলতে চান আমি তাকে যেসব তথ্য সরবরাহ করেছি তা সঠিক হওয়া দরকার কারণ এই সকল তথ্য তাঁর কাজে লাগতে পারে । তিনি লক্ষ করেছেন যে আমি তাঁকে যে হিসেব দিয়েছি তাতে আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি দেখা গেছে। এটা কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষেত্রে ঋণ নিয়ে চলতে পারে কিন্তু একটা রাষ্ট্রের পক্ষে হলে রাষ্ট্র কার কাছে ঋণ নিচ্ছে? এবং ঋণ পরিশোধের অর্থ কোথা থেকে আসছে? আমরা এত যুদ্ধ করি কেন? তাহলে আমরা ভীষণ ঝগড়াটে? নাকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো মোটে ভালো মানুষ নয়? এবং সেনাপতিরা রাজা অপেক্ষা ধনী হয় কী করে? আমরা প্রধানত কী ব্যবসা করি? ব্যবসা থেকে আয় কেমন হয়? দেশের সঙ্গে ব্যবসাগত ও রাজনীতিগত কি বা কী ধরনের চুক্তি বিদ্যমান। দেশ ঘিরে একটা নৌবহর কী কাজ করে? শান্তির সময় বিপুল ব্যয়ে আমরা একটা বিরাট সেনাবাহিনী রাখি শুনে মহারাজা বললেন আমরা যদি আমাদের প্রতিনিধি মারফত নিজেরাই দেশ শাসন করি তাহলে তিনি ভাবতেই পারছেন না আমরা কাদের ভয় করি এবং আমরা কার বিরুদ্ধেই বা যুদ্ধ করব? একজন সাধারণ বক্তি কি নিজে তার সন্তানদের সাহায্যে নিজের পরিবার রক্ষা করতে পারে না? তাহলে যৎসামান্য বেতন দিয়ে কতকগুলো পাজি লোককে সৈন্য করবার দরকার কী? ওরা তো যে কোনো পরিবারে ঢুকে সকলের গলা কেটে শতগুণ বেশি রোজাগার করতে পারে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় বা রাজনৈতিক দলে কতজন মানুষ আছে তার ওপর ভিত্তি করে দেশের জনসংখ্যা নির্ধারণ করাটা তিনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। আমাকে বললেন তুমি অঙ্কে কাঁচা, ওভাবে মানুষ গণনা করা যায় না। তিনি বললেন, তোমাদের দেশে কোনো কোনো দল জনসাধারণকে সমর্থন করে না এমন মতবাদে বিশ্বাসী। সে।ক্ষেতে আমি বলি কি এরকম ঠিক নয়, তাদের উচিত তাদের মতবাদ জনসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া অথবা জানাতে বাধ্য করা। এ চলতে দেওয়া উচিত নয়। একজন লোক নিজের ঘরে বিষ লুকিয়ে রাখবে তা ঠিক নয়।
মহারাজা বললেন, তোমাদের দেশে অভিজাত পরিবারের লোকেরা জুয়ো খেলে চিত্ত বিনোদনের জন্যে। তারা কত বছর বয়স থেকে এই খেলা আরম্ভ করে, আর ছেড়ে দেয় কত বয়সে? এই খেলাটা কি মাত্রা ছাড়িয়ে পারিবারিক অর্থভাণ্ডারে তারতম্য ঘটায় না? চতুর ব্যক্তিরা কি ধনীদের ঠকিয়ে প্রচুর সম্পদ লাভ করে ধনীদের তাদের কাছে ঋণগ্রস্ত করে তোলে না ?
আমি আমাদের দেশের ইতিহাসের যে সব তথ্য তাঁর কাছে পেশ করেছিলাম তার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমাকে যা বলেছ তা তো শুধু ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, বিদ্রোহ, খুন, পাইকারি হারে হত্যা, বিপ্লব, নির্বাসন বা লোভ, দলাদলি, ভণ্ডামি, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, বাতুলতা, ঘৃণা, হিংসা, কাম, অপকার করবার প্রবৃত্তি এবং উচ্চাশার নামান্তর। আর একদিন মহারাজ আমি যা বলেছি এবং তিনি যে সমস্ত প্রশ্ন করেছেন তার আমি যেভাবে উত্তর দিয়েছি তিনি সেসব পর্যালোচনা করে আমাকে হাতে তুলে নিলেন।
তারপর আস্তে আস্তে আমার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে যা বললেন তা আমি কোনোদিন ভুলব না। তিনি আমাকে বললেন আমার ছোট্ট বন্ধু গ্রিলড্রিগ তুমি তোমার স্বদেশের প্রশংসনীয়ভাবে গুণকীর্তন করেছ কিন্তু তোমার বিবৃতি শুনে মনে হয়েছে যে অজ্ঞতা, আলস্য, চরিত্রহীনতা ও আনুষঙ্গিক নির্গুণ না থাকলে তোমাদের দেশে বিধায়ক হওয়া যায় না। চতুর ব্যক্তিরা আইনের অপব্যাখ্যা করে সৎ ব্যক্তিকে ঠকায়। তুমি তোমাদের দেশের প্রচলিত আইন ও বিধান সম্বন্ধে কিছু ভালো কথা বলেছ কিন্তু সেগুলো এমন ভাষায় লেখা যে তার অনেক রকম ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় যার ফলে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তোমাদের দেশে ধার্মিক ব্যক্তিরা সৎপথে থেকে আদর্শ জীবন যাপন করার জন্যে, পণ্ডিতেরা তাঁদের জ্ঞান ও বিদ্যার জন্যে, সৈনিকরা সাহস ও শৌর্যের জন্যে, বিচারকরা তাঁদের নিষ্ঠার জন্যে, বিধায়করা দেশপ্রেম ও তাঁদের সৎকাজের জন্যে সরকারের কাছে থেকে কতখানি কী উৎসাহ পায় বা তাদের নিজ নিজ বৃত্তিতে উন্নতির জন্যে তারা কী করেন তা তোমার বিবৃতি থেকে আমি জানতে পারি নি।
আমাকে সম্বোধন করে মহারাজা বললেন, তুমি তোমার দেশের অনেক বদঅভ্যাস থেকে বেঁচে গেছ। কারণ তুমি তোমার জীবনের অধিকাংশ সময় ভ্রমণ করে কাটিয়েছ। কিন্তু তুমি তোমার দেশ ও জনসাধারণ সম্বন্ধে যা বলেছ তা থেকে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে তোমার দেশের অধিকাংশ মানুষ অসৎ এবং তারা পাপে ডুবে আছে।