প্রথম পরিচ্ছেদ
[ তুমুল ঝড়ের বিবরণ। জাহাজ থেকে লম্বা নৌকো নামিয়ে দ্বীপে পাঠানোর হল পানীয় জল আনতে। দ্বীপটা দেখবার জন্যে লেখকও সঙ্গী হলেন। তাঁকে ফেলে সঙ্গীরা চলে গেল, স্থানীয় এক অধিবাসী লেখককে পাকড়াও করে এক চাষীর বাড়ি নিয়ে গেল। সেখানে আশ্রয়লাভ এবং কয়েকটি দুর্ঘটনা। সেই দেশ বাসীদের বর্ণনা ।]
আমার চঞ্চল প্রকৃতি আর অস্থির জীবন আমাকে শান্তিতে ঘরে চুপ করে বসে থাকতে দেবে না। তা নইলে অত সব কাণ্ড কারখানার পর দুমাসের মধ্যেই আমার পায়ে কে এমন সুড়সুড়ি দিতে লাগল? অতএব আমি আবার স্বদেশ ত্যাগ করলাম এবং ১৭০২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জুন ডাউনস-এর গিয়ে জাহাজে উঠলাম। জাহাজের নাম এ্যাডভেঞ্চার, ক্যাপটেনের নাম জন নিকোলাস, কর্নওয়ালের মানুষ, দক্ষ কমান্ডার। জাহাজ যাবে সুরাট। জাহাজ থেকে মালপত্তর নামাতে হল। মেরামত করতে সময় লাগবে। শীত পড়েছিল, স্থির হল শীতটা এখানেই কাটিয়ে যাব। অন্য একটা কারণও ছিল। ক্যাপটেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সারা দেহে অজানা ব্যথা। ‘কেপ অফ গুড হোপ’ বন্দর ছাড়তে ছাড়তে মার্চ মাস হয়ে গেল। পাল তোলা হল, পালে বাতাস লাগল, পাল ফুটে উঠল, জাহাজ চলল । ম্যাডাগাসকার প্রণালী একদিনে পার হলাম নির্ঝঞ্ঝাটে। কিন্তু প্রণালী পার হয়ে ম্যাডাগাসকার দ্বীপের উত্তরে পাঁচ ডিগ্রি অক্ষাংশে যখন পৌছলাম তখন থেকেই গোলমাল আরম্ভ হল। এই অঞ্চলে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত উত্তর আর পশ্চিম দিক থেকে প্রবল বেগে বাতাস বইতে থাকে। ১৯ এপ্রিল থেকে বাতাসের বেগ উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল বিশেষ করে পশ্চিমা বাতাসটা। বাতাস নয় রীতিমোত ঝড়। ঝড়ের দাপাদাপি চলল শান্ত হল, ক্যাপটেন হিসেব করে বললেন আমরা আমাদের পথ থেকে তিন ডিগ্রি করে এসেছি। সমুদ্র এখন শান্ত কিন্তু আমার মন শান্ত হল না কারণ এদিককার সমুদ্র আমাদের জানা আছে, যে কোনো মুহূর্তে আবার ঝড় উঠতে পারে এবং আমরাও সেজন্যে প্রস্তুত হলাম। ভালোভাবে প্রস্তুত হতে না হতে পরদিনই ঝড় উঠল ৷ ঝড় আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। এ ঝড়ের নাম দক্ষিণ মৌসুমী, সাদার্ন মনসুন। ঝড়ের বেগ বাড়বে আমরা জানি, জাহাজ সামলানো খুবই দুরূহ ব্যাপার। জাহাজে অনেক আকারের অনেক পাল আছে, সে সবের পৃথক নামও আছে। বাতাস অনুসারে সেসব পাল খাটাতে হয়, ওঠাতে হয়, নামাতে হয়, দারুণ পরিশ্রমের ব্যাপার এবং ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি না করতে পারলে যে কোনো সময়ে বিপদ আঘাত করবে। এর উপর মাস্তুল, হাল ও জাহাজের অন্যান্য অংশও সামলাতে হয়। সোজা কাজ নয়। তারপর আছে নাবিকদের মেজাজ। কখন কে কী মেজাজে থাকবে তা সেই নাবিক নিজেই জানে না। এসব তো গেল প্রাকৃতিক ব্যাপার তারপর ভয় আছে জলদস্যুদের। তারাও যে কখন কোন দিক থেকে এসে চূড়াও হবে কে জানে।
যাহোক দক্ষিণ মৌসুমী ঝড় উঠল, আমাদের প্রচণ্ড বেগ দিতে লাগল। আহার নিদ্রা একরকম ত্যাগ করে জাহাজের পাল, হাল, মাণ্ডুল এই সব নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত রইলাম। তবুও জাহাজকে ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম না। আমাদের তখন একমাত্র লক্ষ্য ছিল জাহাজ বাঁচানো, অতএব কোন দিকে যাচ্ছি জানি না।
ঝড় একদিন থামল । জাহাজখানা বেশ মজবুত ছিল তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। ঝড় থামলেও বাতাসের বেগ আছে ফলে আমাদের জাহাজ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। অনুমান করা হল আমরা বোধ হয় আমাদের পথ থেকে পাঁচশ লিগ সরে গেছি কিন্তু কোন সমুদ্রের কোথায় আছি তা আমাদের প্রবীণতম নাবিকও বলতে পারল না। আমাদের জাহাজে প্রচুর খাদ্য ছিল। অত পরিশ্রম সত্ত্বেও আমাদের সকলের স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল কিন্তু একটা সংকট দেখা দিল। পানীয় জল ফুরিয়ে এসেছে। আর একটা সমস্যা আমরা এখন কোন দিকে যাব? সুরাটের পথে ফিরে যাবার চেষ্টা করাই উচিত কিন্তু কোথায় আছি তাই তো বুঝতে পারছি না, শেষে না বরফ জমা সমুদ্রে চলে যাই!
মাস্তুলের মাথায় একজন ছোকরাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে মাঝে মাঝে হাঁক পাড়ছে। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জনু তারিখে হাঁক দিল, ডাঙা দেখা যাচ্ছে। সতের তারিখে আমরা বেশ স্পষ্টই দেখতে পেলাম একটা মস্ত বড় দ্বীপের অংশ অথবা মহাদেশও হতে পারে (কারণ আমরা তখনো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না)। ঐ দ্বীপ বা দেশ থেকে লম্বা খানিকটা জমি সমুদ্রের দিকে এগিয়ে এসেছে আর সমুদ্রের একটা খাঁড়ি ডাঙার ভিতর ঢুকে গেছে কিন্তু খাড়িটা গভীর নয়, একশ টনের উপর জাহাজ ভিতরে ঢুকতে পারবে না। আমরা এই খাঁড়ির এক লিগের মধ্যে নোঙর ফেললাম। ভিতরে যদি পানীয় জল পাওয়া যায় এজন্যে আমাদের ক্যাপটেন পাত্রসহ বারজন সশস্ত্র নাবিককে লম্বা নৌকোয় চাপিয়ে পাঠালেন। আমিও সঙ্গে যাবার অনুমতি চাইলাম, দেশটা একটু দেখতে চাই এবং যদি কিছু আবিষ্কার করতে পারি সেই আশায়। নৌকো থেকে ডাঙায় নেমে আমরা ভিতরে এগিয়ে চললাম কিন্তু কোনো নদী বা ঝরনা এমন কি মানুষের কোনো বাসভূমিও আমাদের চোখে পড়ল না। অন্যান্য সকলে যখন সমুদ্রের উপকূলের দিকে গেল সেখানে যদি স্বাদু জল পাওয়া যায়, আমি তখন ভিতরের দিকে এগিয়ে চললাম। ভিতরে মাইলখানেক ঢুকে পড়লাম, মনে হল দেশটা অনুর্বর, পাথুরে । ক্লান্তি অনুভব করতে লাগলাম এবং উল্লেখযোগ্য কিছু দেখা যাবে না অনুমান করে আমি খাড়ির দিকে ফিরতে লাগলাম। সমুদ্র বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। আমি দেখলাম আমার সঙ্গী নাবিকেরা নৌকোয় উঠে পড়েছে এবং প্রাণপণে নৌকো চালিয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে চলছে। যদিও কোনো কাজ হত না তবুও আমি ওদের চিৎকার করে ডাকতে গেলাম আর তখনি দেখলাম বিশাল একটা প্রাণী দ্রুত ওদের দিকে এগিয়ে চলছে। প্রাণীটা এক হাঁটু জলে নেমে পড়েছে, লম্বালম্বা পা ফেলছে। আমাদের লোকেরা তখন তার থেকে আধ লিগ দূরে। জলের নিচে সুচালো পাথর থাকে, জলও গভীর হচ্ছে তাই প্রাণীটা আর এগিয়ে গিয়ে নৌকোটা ধরতে পারল না। এই ঘটনার বিবরণ আমি পরে শুনেছিলাম কিন্তু এখন যা ঘটছিল বা ঘটতে যাচ্ছে তা দাঁড়িয়ে দেখবার মতো আমার সাহস তখন ছিল না। যে দিক থেকে এসেছিলাম, আমি সেই দিকে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম তারপর একটা উঁচু পাহাড়ে উঠে দেশটা দেখবার চেষ্টা করতে লাগলাম। দেখলাম সারা অঞ্চলেই জমি চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু আমি অবাক হলাম ঘাসের দৈর্ঘ্য লক্ষ করে। সম্ভবত গবাদি পশুর জন্যে যেগুলো আঁটি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেগুলো অন্তত কুড়ি ফুট লম্বা ।
পাহাড় থেকে নেমে আমি একটা বার্লি ক্ষেতের মাঝ পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পথটা আমার কাছে বেশ চওড়া মনে হল কিন্তু এখানকার অধিবাসীদের কাছে সেটা নিশ্চয় গলি পথ ৷ এই পথ ধরে আমি হেঁটে চললাম কিন্তু উভয় দিকে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। শস্য দেখে মনে হল ফসল কাটার সময় হয়েছে। বার্লির শিষগুলো চল্লিশ ফুট উঁচুতে হাওয়ায় দুলছে। এক ঘণ্টা হাঁটার পর ক্ষেতের শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম। বেড়াগাছ দিয়ে ক্ষেতটি ঘেরা আর সেই বেড়া অন্তত একশ কুড়ি ফুট উঁচু হবে। বড় গাছগুলো যে কত উঁচু আমি তা হিসেব করতে পারলাম না। এই ক্ষেত থেকে পাশের ক্ষেতের মাঝে একটা বাঁধ কিন্তু তার ওপারে যাবার জন্যে ধাপ কাটা আছে। চারটে করে মোট ধাপ । একেবারে মাথায় আছে একটি পাথর। এই বাঁধ পার হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব কারণ প্রতি ধাপ ছ ফুট উঁচু আর মাথার উপর পাথরটা কুড়ি ফুটের উপর তো হবেই। বেড়ার মাঝে কোনো ফাঁক আছে কিনা আমি খোঁজ করছি তখন দেখলাম অপর দিকের ক্ষেত থেকে এই দেশের একজন অধিবাসী ধাপকাটা বাঁধের দিকে এগিয়ে আসছে। খানিকটা আগে আমাদের নৌকো তাড়া করতে যে মানুষটাকে দেখেছিলাম এর আকারও তত বড়।
লোকটা গির্জার চুড়োর সমান লম্বা হবে আর মনে হল এক একবার পা ফেলছে আর দশ গজ এগিয়ে আসছে। আমি যতটা অবাক হলাম ভয়ও পেলাম ততটা এবং বার্লি ক্ষেতের মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করতে লাগলাম। লোকটা তখন ধাপকাটা বাঁধের উপর উঠে পড়ে তার ডান দিকের ক্ষেতে ঘাড় ফিরিয়ে কাকে যেন ডাকছে। গলার আওয়াজ কী? যেন আকাশ ফাটিয়ে ভেরি বাজছে। তার কান ফাটানো গালার আওয়াজ প্রথমে শুনে আমার মনে হয়েছিল যেন বাজ পড়ল। তার ডাক শুনে তারই মতো সাতটা দৈত্য এল । তাদের প্রত্যেকের হাতে শস্য কাটবার কান্তে, প্রতিটা কান্তে আমাদের অন্তত ছটা কাস্তের সমান। প্রথম লোকটির মতো এই লোকগুলোর পরিচ্ছদে তফাত আছে, ওরা বোধহয় ওর ভৃত্য বা জন মজুর। কারণ প্রথম ব্যক্তির কথা শুনে আমি যে ক্ষেতে লুকিয়েছিলাম সেই ক্ষেতে বার্লি কাটতে এল। আমি যতদূর সম্ভব তাদের থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ক্ষেতে বার্লিগাছ এত ঘন যে আমি তাদের ফাঁক দিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারছি না। গাছের ফাঁক কোথাও কোথাও এক ফুটেরও কম, সেইটুকু ফাঁক দিয়ে তাড়াতাড়ি পালানো সম্ভব নয়। তবুও আমি চেষ্টা করে এগিয়ে চললাম এবং এমন একটা জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে বৃষ্টি ও হাওয়ার ফলে গাছগুলো মাটিতে শুয়ে পড়েছে। ওই জায়গাটা পার হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব তাছাড়া বার্লির শিষগুলো সুচালো আর গাছের পাশ ধারালো। নড়তে গেলে হাত পা কাটছে কিংবা শিষের খোঁচা লেগে জামাকাপড় ছিড়ছে। এদিকে আবার কয়েক জন জন-মজুর আমার পিছনে একশ গজের মধ্যে এসে গেছে। কী যে করি! পথশ্রম, দুঃখবোধ ও হতাশায় আমি ভেঙে পড়ছি। দুটো খাঁজের মধ্যে একটা জায়গা বেছে নিয়ে আমি যতদূর সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে-শুটিয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে প্রাণে ভাবতে লাগলাম জীবন শেষ হয়ে যাক। আমি আমার হতভাগিনী বিধবা আর পিতৃহীন সন্তানদের কথা চিন্তা করতে লাগলাম । হায়! আমি কী মূর্খ! বন্ধু ও আত্মীয়দের পরামর্শ উপেক্ষা করে কেন আমি দ্বিতীয়বার সমুদ্র যাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম।
মনের এই বিক্ষুব্ধ অবস্থায় লিলিপুটদের কথা মনে পড়ল। আমাকে দেখে তারা ভেবেছিল এত বড় অতিকায় মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। সেদেশে একটা পুরো নৌবহর আমি আমার হাত দিয়ে টেনে এনেছিলাম এবং আর যেসব কাণ্ড কারখানা করেছি সেসব তো তাদের দেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে যা তাদের বংশধররা হয়তো বিশ্বাসই করবে না যদিও সারা লিলিপুট দেশ সেই অসম্ভব ঘটনার সাক্ষী। এই দৈত্যদের মধ্যে এসে আমি ভাবতে লাগলাম যে আমাদের মধ্যে মাত্র একট লিলিপুট দ্বীপবাসী ক্ষুদ্র প্রাণী যদি এসে পড়ত তাহলে তার যে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হত এখন এই দৈত্যদের মাঝে পড়ে আমার সেই অভিজ্ঞতা হতে চলছে। লিলিপুটদের দেশে আমি কী বাহাদুরিই না দেখিয়ে এসেছি ভেবে আমার অনুতাপ হতে লাগল। যদি ধরে নেওয়া যায় যে মানুষ তার দেহের অনুপাতে বর্বর ও নিষ্ঠুর হয় তাহলে আমি এই বিরাটকায় দৈত্যদের কাছে কী রকম ব্যবহার আশা করতে পারি? ওরা কেউ যদি আমাকে ধরে ফেলে? আমরা যেমন একটা ছোলার দানা গিলে ফেলতে পারি বা চিবিয়ে খাই ওরা তো আমাকে সেইভাবে খেয়ে ফেলবে। তবে দার্শনিকরা নাকি বলেন এই পৃথিবীতে তুলনা না করলে কিছুই বড় বা ছোটো নেই। লিলিপুটরাও হয়তো তাদের চেয়েও ক্ষুদ্র মানবিক প্রাণীর দেখা পেতে পারে, তাদের উপর কর্তৃত্বও করতে পারে। আজ যে বিরাট আকারের দৈত্যদের আমি দেখছি হয়তো এদের চেয়েও আরো বড় আকারের মানুষ আছে কোনো দেশে যে দেশ আজও আবিষ্কৃত হয় নি।
আমি ভয় তো পেয়েইছি, হতবুদ্ধিও হয়ে গেছি, কী যে করব কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছি না। আমি যখন এই ভাবে নিজেকে নিয়ে বিব্রত সেই সময় সভয়ে দেখলাম, আমি যে খাঁজে আশ্রয় নিয়েছি তার দশ গজের মধ্যে একটা দৈত্য এসে পড়েছে। আমার ভয় হল ও পরের ধাপে বোধহয় আমাকে মাড়িয়ে ফেলবে কিংবা ওর কাস্তে দিয়ে আমাকে দুটুকরো করে ফেলবে। ও কী করল তা হয়তো আমি জানতেও পারব না। প্রাণভয়ে ভীত হলেও যখন দেখলাম দৈত্যটা পা তোলবার উপক্রম করছে আমি তখন প্রাণপণে জোরে চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার দৈত্যের কানে পৌছল, সে দাঁড়িয়ে পড়ল তারপর কোমর বাঁকিয়ে নিচু হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। ভাবছি আবার চিৎকার করে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করব কি না, এমন সময়ে দৈত্যটা আমাকে দেখতে পেল । আমকে সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিল না, কী ভাবল। অনেক সময় ক্ষুদ্র প্রাণী বা কীট পতঙ্গরা দংশন করে বা হুল ফুটিয়ে দেয় তো! স্বদেশে আমার নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে তার তর্জনি ও বুড়ো আঙুল দিয়ে আমাকে টপ করে তুলে নিল এবং তিন গজ আন্দাজ দূরে ধরে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
আমার চিৎকারটা তার কাছে বোধহয় ওদের নিজেদের মতোই মনে হয়েছিল যদিও ওদের কণ্ঠস্বরের তুলনায় মৃদু। তাই আমাকে তুলে নিয়ে আমার আকার প্রকার লক্ষ করতে লাগল। ওর হাতে আমি তখন মাটি থেকে অন্তত ষাট ফুট উঁচুতে। ওর আঙুলের চাপে আমার দুদিকের পাঁজরে ব্যথা লাগছিল। পাছে আঙুল ফসকে পড়ে যাই এই জন্যেও বোধহয় আমাকে ঈষৎ জোরে ধরে রেখেছিল, যাহোক আমি ঠিক করলাম এ অবস্থায় হাত পা নাড়া ঠিক হবে না কারণ এখান থেকে পড়লে হাড়গোড় চূর্ণ হয়ে যাবে।
আমি সাহস করে সূর্যের দিকে চাইলাম। তারপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে দুই হাত জড়ো করে করুণ স্বরে আমার বিপজ্জনক অবস্থার কথা নিবেদন করলাম। কারণ আমার ভয় হচ্ছিল দৈত্যটা আমাকে হয়তো আছড়ে মাটিতে ফেলে দেবে ঠিক আমরা যেভাবে বাজে ক্ষুদ্র প্রাণীকে মাটিতে আছড়ে মেরে ফেলি। আমার গ্রহ বোধহয় আমার অনুকূলে। দৈত্যটা আমার কণ্ঠস্বর শুনে ও হাত পা নাড়া দেখে কৌতূহলী হল এবং আমার ভাষা না বুঝলেও সবাই তাদের মতো কথা বলছি এটুকু বোধহয় সে বুঝতে পারল ইতোমধ্যে আমার দুপাশে যন্ত্রণা হচ্ছে, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ছে। আমি আমার দুই পাশে চেয়ে দৈত্যকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলাম যে আমার ভীষণ লাগছে, অত চেপে ধরো । দৈত্যটা বোধহয় আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারল, সে আমাকে তার জামার একটা খাঁজে বসিয়ে দিল এবং আমাকে সেইভাবে নিয়েই তার মনিবের দিকে ছুটল। মনিব একজন সঙ্গতিসম্পন্ন চাষী আর এই দৈত্যটাকেই আমি প্রথমে ক্ষেতে দেখেছিলাম।
চাষী-মনিব তার মজুরের কাজ থেকে আমার বিষয়ে শুনল। (ওদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমার তাই মনে হচ্ছিল)। মনিব আমাদের ছড়ির আকারে একটা শুকনো খড় তুলে নিল তারপর সেইটে ডগা দিয়ে আমার জামা তুলল। জামাটা যে পোকার আবরণের মতো নয় ও বোধহয় তাই দেখতে চাইল। ফুঁ দিয়ে আমার মাথার চুল উড়িয়ে দেখল তারপর আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও আমার চোখ মুখ ভালো করে দেখতে লাগল। সে তার শ্রমিকদের ডেকে জিজ্ঞাসা করল। (পরে আমি জানতে পেরেছিলাম) যে ক্ষেতে আমার মত খুদে প্রাণী তারা আর দেখেছে কি না। তারপর সে আমার পিঠের দিক ধরে আমাকে আস্তে আস্তে আমার দুই পা ও দুই হাতের উপর নামিয়ে দিল। আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে, আস্তে আস্তে কয়েক পা এগিয়ে ও পিছিয়ে হেঁটে তাদের বুঝিয়ে দিলাম আমার পালিয়ে যাবার কোনো মতলব নেই। তারা সকলে আমাকে ঘিরে বসে আমার নড়াচড়া ভালো করে দেখতে লাগল। আমি আমার মাথার টুপি খুলে কোমর বেঁকিয়ে মনিবকে অভিবাদন জানিয়ে হাঁটু ও মুখ তুলে নিবেদনের ভঙ্গিতে যত জোরে সম্ভব কয়েকটা কথা বললাম, তারপর স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলি পকেট থেকে বার করে সবিনয়ে তাকে উপহার দিলাম। থলিটি সে হাতে তুলে নিয়ে চোখের কাছে তুলে ধরে দেখবার চেষ্টা করতে লাগল, জিনিসটা কী? জামার হাতা থেকে একটা পিন বার করে থলেটা খুঁচিয়ে দেখল কিন্তু বুঝতে পারল না। তখন আমি তাকে ইশারা করে হাত নামাতে বললাম। হাত নামালে আমি তার হাত থেকে থলেটা নিয়ে সেটা খুলে স্বর্ণমুদ্রাগুলো বার করে তার হাতে দিলাম। স্পেন দেশের চার পিস্টোলের ছটি মুদ্রা এবং বিশ তিরিশটা ছোটো মুদ্রা ছিল। মনিব মশাই কড়ে আঙুলটা জিভের ডগে ভিজিয়ে সবচেয়ে বড় মুদ্রাটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগল কিন্তু এগুলো কী হতে পারে তা সে বুঝতে পারল না। সে আমাকে ইশারা করল মুদ্রাগুলো আবার থলের মধ্যে ভরে দিতে এবং থলেটি আমার পকেটে রাখতে। তবুও আমি থলেটি তাকে আবার দিতে চাইলাম কিন্তু যখন গ্রহণ করল না তখন সেটি আমার পকেটে রাখাই ভালো মনে করলাম।
চাষী এতক্ষণে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে আমি বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন একটি নীব। সে আমার সঙ্গে অনেক কথাই বলতে লাগল কিন্তু কী জোর আওয়াজ! আমার কান বুঝি ফেলে যাবে। যদিও তার কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না তবুও সে যে একটা ভাষা অনুসরণ করছে তা বোঝা গেল। আমি একাধিক ভাষায় তার কথার জবাব দেবার চেষ্টা করছিলাম যতদূর পারি চিৎকার করে। আর সেও তার কান আমার মুখের দুই তিন গজের মধ্যে নিয়ে আসছিল। কিন্তু বৃথা। কারণ আমরা পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। এরপর সে তার মজুরদের কাজে পাঠিয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা বই রুমাল বার করল। রুমালটা দুর্ভাঁজ করে মাটিতে রেখে নিচু হয়ে আমাকে রুমালের উপর নামবার জন্যে ইশারা করল। আমাকে যেখানে রেখেছিল সেখান থেকে দুফুটখানেক মতো লাফিয়ে আমি সহজেই রুমালের উপর নেমে পড়লাম। আমি চিন্তা করলাম ওর আদেশ পালন করা আমার কর্তব্য। আমি রুমালের উপর শুয়ে পড়লাম আর চাষী রুমালের চারটে কোণ তার আঙুল দিয়ে জড়ো করে আমাকে তুলে নিল আর সেই ভাবে আমাকে ওর বাড়ি নিয়ে চলল। বাড়ি ফিরে সে তার বউকে ডেকে আমাকে দেখাল । কিন্তু ইংল্যান্ডের মেয়েরা যেমন ব্যাঙ বা মাকড়সা দেখে চিৎকার করে ভয় পেয়ে পালায় চাষী বউও তেমনি আমাকে দেখেই ছুটে পালাল। যাহোক দূর থেকে আমার ব্যবহার ও ওর স্বামীর ইশারা অনুসারে আমাকে কাজ করতে দেখে বৌটি আশ্বস্ত হল এবং ক্রমশ আমার প্রতি তার মনোভাব কোমল হল। বেলা প্রায় বারটার সময় একজন ভৃত্য দুপুরের আহার নিয়ে এল। এক ডিশ মাংস (একজন কর্মী চাষীর জন্যে উপযুক্ত পরিমাণ) এনেছে, সেই ডিশটির ব্যাস চব্বিশ ফুট প্রায়। পরিবারের মানুষ হল চাষী ও তার বউ, তিনটে বাচ্চা আর বৃদ্ধ দাদীমা। ওরা টেবিল ঘিরে বসল, চাষী আমাকে টেবিলের এক পাশে বসিয়ে দিল, টেবিলটা তিরিশ ফুট উঁচু। এত উঁচু টেবিল, আমি ভয়ে ভয়ে কিনারা থেকে যতটা পারি দূরে সরে বসলাম। পড়ে যাবার ভয় আছে তো!
চাষী বউ এক টুকরো মাংস নিয়ে সেটা কুঁচি কুঁচি করে কেটে আর কিছু রুটি ছোটো ছোটো টুকরো করে একটা কাঠের প্লেটে দিয়ে আমার সামনে রাখল। আমি মাথা নুইয়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে আমার ছুরি কাঁটা বার করে খেতে আরম্ভ করলাম। আমাকে কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে দেখে ওরা খুব মজা অনুভব করতে লাগল। চাষী বউ তার দাসীকে বলল ওষুধ খাবার ছোটো গেলাস আনতে। ওদের ছোটো গেলাস আমার কাছে মস্ত বড়। বউ তাতে সুরা ঢেলে দিল, তা প্রায় দু’গ্যালন হবে। অনেক কষ্টে দুহাত দিয়ে সেই পাত্র ধরে ও শ্রদ্ধা সহকারে যতদূর সম্ভব উচ্চস্বরে ইংরেজিতে আমি চাষী-বউয়ের স্বাস্থ্য কামনা করে সুরা পান করতে আরম্ভ করলাম। আমার কথা বলার ও পান করবার ভঙ্গি দেখে ওরা এত জোরে হেসে উঠল যে আমার কানে তালা ধরে গেল। সুরার স্বাদ ভালো, অনেকটা আমাদের সাইডায়ের মতো। পান শেষ হলে চাষী আমাকে ইশারা করে তার ডিশের কাছে যেতে বলল। টেবিলের উপর দিয়ে যেতে যেতে আমি হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম তবে আঘাত পাই নি। আমি তৎক্ষনাৎ উঠে পড়লাম। লক্ষ করলাম যে আমি পড়ে যাওয়াতে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি সৌজন্যে জানাবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে আমার টুপি বার করে মাথার উপর নাড়তে নাড়তে তিনবার আনন্দসূচক ধ্বনি করে ওদের জানিয়ে দিলাম যে পড়ে গিয়ে আমার কোনো চোট লাগে নি। তারপর আমি যখন আমার কর্তা মশাইয়ের (এখন থেকে আমি চাষীকে কর্তামশাই বলব) দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তার সবচেয়ে ছোটো ছেলেটি যে কর্তার পাশেই বসেছিল এবং দেখেই মনে হয় দুষ্টু সে আমার পা ধরে টপ করে এত উঁচুতে তুলে ধরল যে আমি তো ভয়েই সারা। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। কিন্তু তার বাবা চট করে আমাকে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এত জোরে ছেলেটার কান মলে দিল যে সেই জোর প্রয়োগ করলে ইউরোপের এক দল ঘোড়া একেবারে কাৎ হয়ে যেত। কর্তা বলল, ছেলেটাকে টেবিল থেকে তুলে নিতে। সাজা পেয়ে বালকটি আমার প্রতি ঘৃণাভাব পোষণ করল।
কিন্তু ছেলেরা অমন একটু দুষ্টু হয়। আমাদের ছেলেরাও চড় ই, খরগোস, বেড়াল বা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে দুষ্টুমি করে। তাই আমি হাঁটু গেড়ে কর্তা মশাইকে ইঙ্গিতে অনুরোধ করলাম এবারের মতো বাচ্চাটাকে ক্ষমা করুন। বাবা আমার অনুরোধে ছেলেটিকে আবার তার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। আমি খুশি হয়ে এগিয়ে গিয়ে কর্তার হাতে চুম্বন করলাম, কর্তাও আমার হাতে চাপ দিয়ে জানালেন যে তিনি খুশি হয়েছেন। ডিনার চলার সময় আমার কর্ত্রীর প্রিয় বেড়ালটি তাঁর কোলে উঠে বসল। আমি আমার পিছন দিকে একটা অচেনা আওয়াজ শুনলাম, যেন একডজন কারিগর তাদের মেসিনে মোজা বুনছে কিন্তু তা নয়। আওয়াজের উৎস হল সেই বিড়াল, সে গজরাচ্ছে।
বিড়ালের মাথা আর থাবা দেখে অনুমান করলাম যে সেটি আমাদের একটি ষাঁড়ের চেয়ে তিনগুণ বড় । কর্ত্রী বিড়ালটিকে আদর করতে করতে খাচ্ছিলেন। যদিও আমি টেবিলের অপর প্রান্তে, বিড়ালটি থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে ছিলাম তবু পাছে বিড়ালটি সহজে লাফিয়ে উঠে আমাকে আঁচড়ে দেয় এজন্যে কর্ত্রী জীবটিকে শক্ত করে ধরে ছিলেন। তা সত্ত্বেও তার মুখ দেখে আমার বেশ ভয় করতে লাগল। বিড়ালটিকে আমি ভয় না করলেও পারতাম কারণ যখন কর্তা আমাকে তুলে বিড়ালটার তিন গজের মধ্যে আমাকে বসিয়ে দিল তখন বিড়াল আমার দিকে চেয়েও দেখল না। আমি আমার ভ্রমণের সময় যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি তাতে দেখেছি যে কোনো হিংস্র জন্তুকে দেখে ভয় পেলে বা পালাতে থাকলে তাকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া হয় এবং তখন সে আক্রমণ করে বা তাড়া করে। অতএব আমি এমন ভাব দেখালাম যে বিড়ালকে আমি মোটেই গ্রাহ্য করি না।
তার মাথার কাছে পাঁচ ছ’বার ঘুরেও এলাম। এমন কি তার কাছে আধ গজের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে এমন ভাব দেখালাম যেন ওকে গ্রাহ্য করি না। দেখি কি বিড়াল মশাই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, ও যেন আমাকেই বেশি ভয় পাচ্ছে। চাষীদের বাড়িতে যেমন হয়ে থাকে, তিন চারটে কুকুর ঘরে ঢুকল। কুকুরকে আমার তেমন ভয় নেই। একটা মাস্টিফ কুকুর ছিল, চারটে হাতির সমান। একটা গ্রে-হাউন্ডও ছিল। সেই মাস্টিফের চেয়ে লম্বা হলেও আকারে ছোটো।
ডিনার যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন বছর খানেক বয়সের একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নার্স ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখেই তো বাচ্চা বায়না ধরল-বাচ্চাদের যা স্বভাব—সে আমাকে চায়, ভেবেছে নতুন কোনো খেলনা বুঝি। শেষে চিৎকার আরম্ভ করল । সেই চিৎকার লন্ডন ব্রিজ থেকে চেলসি পর্যন্ত শোনা যাবে। মা তো ভালোবেসে আমাকে তুলে বাচ্চার কাছে নামিয়ে দিতেই সে আমার কোমর টিপে ধরে তুলে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটা তার হাঁ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ভয়ে পেয়ে আমি তো প্রাণপণে এত জোরে চিৎকার করে উঠলাম যে বাচ্চাও ভয় পেয়ে আমাকে ফেলে দিল।
ভাগ্যিস মা তার এপ্রনটা তুলে ধরেছিল নয়তো নিচে পড়ে গেলে আমার ঘাড়টা নিশ্চয়ই মটকে যেত। ওদিকে বাচ্চার কান্না থামাবার জন্যে তার নার্স বাচ্চার কোমরে আটকানো একটা ডুগডুগি বাজাতে লাগল। কিন্তু বাচ্চা কিছুতেই থামে না তখন নার্স বাধ্য হয়ে ওকে বুকের দুধ খাওয়াতে লাগল। আমার স্বীকার করতে বাধা নেই যে নার্সের ঐ শরীর দেখে আমি যত রিবক্ত হয়েছিলাম এমন বিরক্ত আর কখনো হই নি। নার্সের শরীরের গঠন আকার ও রং আমি কীসের সঙ্গে তুলনা করব তা বলতে পারছি না। মাপলে বিরাট হবে। সারা শরীর দাগ ও ফুসকুড়িতে ভর্তি বিশ্রী দেখতে। এত বলতে পারছি কারণ আমি তো ওর কাছেই টেবিলে দাঁড়িয়ে দিলাম, সবই ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে পড়ল আমাদের ইংরেজ মহিলাদের শুভ্র ও সুন্দর শরীরের কথা, অবশ্য তারা আমাদেরই আকারের। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে তাদের ত্বক দেখলে তবে তার ত্রুটি ধরা পড়ে, নইলে নয়।
আমি লিলিপুট দ্বীপে দেখেছি ওদের গায়ের রং ভারী চমৎকার, এমন আমি আর দেখি নি । ঐ দ্বীপে আমার এক পণ্ডিত বন্ধু বলেছিল যে মাটিতে দাঁড়িয়ে সে যখন আমার মুখের দিকে তাকায় তখন আমার মুখ খুব ফর্সা ও ত্বক মসৃণ দেখায়। কিন্তু আমি তখন তাকে হাতে করে তুলে আমার মুখের কাছে নিয়ে এলাম তখন সে স্বীকার করল কাছ থেকে মোটেই ভালো দেখাচ্ছে না। সে বলল আমার মুখে অনেক গর্ত, দাড়ির গোড়াগুলো শুয়োরের লোমের চেয়ে দশগুণ মোটা আর মুখের রঙ ও নানা বর্ণের মিশ্রণ যা মোটেই ভালো বলা চলে না। অবশ্য আমার দেশে অন্যান্য পুরুষদের মতোই আমার রঙ ফর্সা আর ঘুরে বেড়ালেও চামড়া রোদে বেশি পোড়ে নি। অথচ আমার সেই বন্ধু বলেছিল তাদের দেশের মেয়েদের অনেক ত্রুটি আছে। যেমন কারো মুখে বিন্দু বিন্দু বাদামি ছোপ আছে, কারো হাঁ-মুখ বড়, নাক থ্যাবড়া কিন্তু এসব ত্রুটি আমার চোখে পড়ত না কারণ আমিও তাদের দেখছি অনেক দূর থেকে। সেই হিসেবে বলতে পারি নিকট থেকে দেখে এই দৈত্যদের আমি যে ত্রুটি দেখতে পাচ্ছি তাতে আমার পাঠকদের মনে হতে পারে ওরা বুঝি কুৎসিত কিন্তু তা নয়। ওরা রূপবান না হতে পারে কিন্তু সুদর্শন। আমার কর্তা চাষী হলেও আকার অনুসারে তার দেহের গঠন ও মুখশ্রী উত্তম।
ডিনার শেষ হল। কর্তা আবার কাজে বোরোবেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ও হাত পা নাড়া দেখে বুঝলাম তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলছেন আমার দিকে যেন কড়া নজর রাখা হয় এবং যত্ন নেওয়া হয় । আমি ভীষণ ক্লান্ত, ঘুমে চোখ জুড়ে আসছিল। আমার কর্ত্রী তা বুঝতে পেরে আমাকে তাঁর নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন এবং পরিষ্কার একটি রুমাল ঢাকা দিলেন।
রুমালটি আমাদের মানোয়ারি জাহাজের পালের চেয়ে বড় ও মোটা। আমি প্রায় দুঘণ্টা ঘুমিয়েছিলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমি যেন আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের সঙ্গে রয়েছি। বেশ ভালো লাগছিল কিন্তু ঘুম ভেঙে যেতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এখানে আমি একা। দু’শ থেক তিনশ ফুট চওড়া একটা মস্ত বড় ঘরে শুয়ে আছি। ঘরটা দু’শ ফুট উঁচু। আর যে খাটে শুয়ে আছি সেটা কুড়ি গজ চওড়া। কর্ত্রী মহিলা তার সাংসারিক কাজে যাবার আগে আমার ঘরে তালা লাগিয়ে গেছেন। মেঝে থেকে খাটটা আট গজ উঁচু। কিছু প্রাকৃতিক কাজ সারবার জন্যে খাট থেকে নিচে নামা দরকার অথচ দরজা খোলবার জন্যে কাউকে ডাকাও যাচ্ছে না কারণ যদি ডাকাডাকি করি তাহলে আমি যত জোরেই চিৎকার করি না কেন আমার ডাক অতদূরে রান্নাঘরে পৌছবে না । আমার যখন এইরকম অবস্থা তখন পর্দা বেয়ে দুটো ইঁদুর উঠে এল তারপর সে দুটো খাটে নেমে এল। একটা আমার মুখের কাছে এসে গেল। আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, উঠে দাঁড়িয়ে আমার ছোরাখানা বার করলাম। ওরা আমার মতো একটা ক্ষুদে প্রাণীকে ভয় করবে কেন? ভয়ংকর প্রাণী দুটো আমাকে দুদিক থেকে তেড়ে এল।
একটা ইঁদুর তো তার একটা পা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল কিন্তু সে ব্যাটা আর কিছু করার আগেই আমি আমার ছোরা দিয়ে ওর পেটটা চিরে দিলাম। ইঁদুরটা আমার পায়ের কাছে পড়ে গেল। অপর ইঁদুরটা সঙ্গীর দুরবস্থা দেখে পালাল কিন্তু পালাবার আগে আমি ওর পিঠে ছোরা দিয়ে আঘাত করলাম। সেখান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়ল। দম নেবার জন্যে এবং সাহস ফিরিয়ে আনার জন্যে আমি খাটের উপর পায়চারি করতে লাগলাম।
এই ইঁদুরগুলো আমাদের এক একটা মাস্টিফ কুকুরের সমান কিন্তু আরো চঞ্চল ও হিংস্র। আমি ছোরা সমেত আমার বেলটি খুলে যদি ঘুমিয়ে পড়তাম তাহলে তো ওরা আমাকে এতক্ষণে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত তারপর বেমালুম খেয়ে ফেলত। মরা ইঁদুরটার লেজ মাপলাম, এক ইঞ্চি কম দু’গজ। সেটাকে খাট থেকে সরাতে গিয়ে দেখি ব্যাটা তখনো বেঁচে আছে। ছোরা দিয়ে গলায় আবার কয়েকটা আঘাত করতেই শেষ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে কর্ত্রী মহিলা ঘরে ঢুকে আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে নিজের হাতে তুলে নিলেন। আমি মরা ইঁদুরটাকে দেখিয়ে দিলাম এবং নানাভাবে যখন বুঝিয়ে দিলাম যে আমার কোনো আঘাত লাগে নি তখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, মুখে হাসি ফুটল। তারপর তিনি পরিচারিকাকে ডাকলেন, সে একটা চিমটে এনে ইঁদুরটাকে তুলে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। কর্ত্রী আমাকে টেবিলে বসিয়ে দিলেন। আমি তাঁকে আমার রক্তমাখা ছোরাখানা দেখিয়ে আমার জামায় মুছে খাপে ভরে রাখলাম। এরপর আমাকে যে কাজটা করতে হবে সেই প্রাকৃতিকে কাজটা আমার হয়ে কেউ করে দিতে পারবে না তাই আমি তাকে ইশারায় বললাম আমাকে নিচে নামিয়ে দিতে। কিন্তু যা করতে চাই তা মহিলাকে বলতে শালীনতায় বাধল। তাই আর কিছু না বলে বাইরে বেরোবার দরজা দেখালাম আর সেই সঙ্গে কোমর বেঁকিয়ে কয়েকবার অভিবাদন জানালাম। প্রথমে তার বুঝতে অসুবিধে হয়েছিল তারপর আমাকে হাতে তুলে নিয়ে বাইরে এসে বাগানে নামিয়ে দিলেন। দু’শ গজ দূরে একটা জায়গা বেছে নিয়ে মহিলাকে কাছে আসতে বা দেখতে নিষেধ করে আমি দুটো সরেল পাতার আড়ালে নিজেকে ভারমুক্ত করলাম।
আমি আশা করি আমার সহৃদয় পাঠকরা এইসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে খুঁটিনাটি লেখার জন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন। এগুলো অবশ্যই তুচ্ছ এবং নিচুমনা ব্যক্তিদের কাছে এগুলো অশ্লীল মনে হবে তথাপি এগুলো দার্শনিকের ভাব ও কল্পনা প্রসারিত করতে হয়তো সাহায্য করবে এবং ব্যক্তি হিসেবে সাধারণ একজন মানুষকে কতরকম সমস্যায় পড়তে হয় তা জেনে তাঁরা হয়তো এইসব অনুল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো কাজে লাগাতে পারেন। এইজন্যেই আমি কোনো আড়ম্বর বা অলংকার যোগ না করে সরল ও স্বাভাবিক ভাষায় আমার ভ্রমণ কাহিনীর সত্য রূপ দেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই ভ্রমণ কাহিনী আমার মনে এমন গভীর রেখাপাত করেছিল যে আমি কোনো ঘটনাই বিস্মৃত হই নি, তাই লেখবার সময় কিছুই বাদ দিই না শুধু যেগুলো পাঠকদের একঘেয়ে মনে হতে পারে বা বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে সেইগুলো ছাড়া। যদিও ভ্রমণকারীরা তাদের সবকিছু লিপিবদ্ধ করে রাখে।