ব্যাপারটা কী হল
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর রত্নেশ্বর খানিকক্ষণ ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে উঠে পড়লেন। হ্যাঁ আজই। আজই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। এমন সুবর্ণযোগ আর সহজে আসবে?
আজ রত্নেশ্বরের সেই মস্তান ভাইপোটা নাকি কোথায় যেন কাদের কোন টিমের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গেছে। ফিরবে কী ফিরবে না। এ কী সোজা সুবিধে? ওর চোখ এড়ানো কী সহজ?
বেকার তো, তাই সারাদিনই বাড়িতে নেই, আবার সারাদিনই বাড়িতে আছে। এই দেখলে সদর দিয়ে বেরিয়ে গেল, এই দেখবে খিড়কি দিয়ে এসে ঢুকল। আর রত্নেশ্বরের চোখাচোখি হলেই একটা না একটা হাড়-জ্বালানো কথা বলে উঠবে। কথা তো আর কিছু নয়। জেঠুর ওপর খবরদারি। সর্দারি!
গার্জেনগিরি! গার্জেনগিরি সকলেরই। রত্নেশ্বর যেন জেলখানার আসামি। আর বাড়ির খুদেটা থেকে বড়োটি পর্যন্ত সব্বাই পাহারাদার, দারোগা!
সেসবের সমাপ্তি ঘটাচ্ছেন এবার রত্নেশ্বর!
এমন নিরিবিলি দিন আর পাবেন না।
কারণ শুধু মস্তানটাই নয় বাড়ির হেড রত্নেশ্বরের বড়ো বউমাটিও আজ বাপের বাড়ির কী একটা ঘটাপটায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নেমন্তন্ন গেছে, একেবারে রাতের খাওয়া সেরে ফিরবে। দেখা যাচ্ছে বাড়ির কাজের মেয়েটাকেও নিয়ে গেছে।
কাজ করাতে, না নেমন্তন্ন খাওয়াতে কে জানে। নিয়ে গেছে, আপদ গেছে। ও মেয়েটার দৃষ্টিও যেন ঘুঘুপাখির দৃষ্টি। কেউ কোথাও একটা আলপিন নাড়ালেও তার নজর এড়ায় না। আর এ তো জলজ্যান্ত আস্ত একটা মানুষ। এখনও পর্যন্ত তাইই তো! ওই মেয়েটা থাকলে কি আর এই চুপিচুপি উঠে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হত? ঠিক কোনখান না কোনখান থেকে দেখতে পেয়ে বলে উঠত ‘দাদু! এই ভরদুপুরে টাকমাথায় রোদ লাগিয়ে বেরোচ্ছেন যে বড়ো। খুব সাহস হয়েছে না? ডাক্তারবাবু কী বলে দেছে?’
বাড়ির সকলের রত্নেশ্বরের ওপর ছড়ি ঘোরানো দেখে, ওরও সাহস বেড়ে গেছে।
তবে আজ কি আর এখন দুপুরে কেউই বাড়ি নেই? তা থাকবে না কেন? বাড়িতে লোক কি কম? সর্বদাই হইচই রম-রম গমগম। রত্নেশ্বরই ফেকলুপার্টি হয়ে ঘরে বসে থাকেন। তো আছে বাড়িতে ছোটোবউমা। তবে তাদের দিক থেকে আশঙ্কার কোনো ও কারণ নেই। একজন নিজের কুচিকাচি দুটো ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুম পাড়াতে ঘরে ঢুকে খিল দিয়েছে। আর অন্যজন গল্পের বই হাতে নিয়ে বোধ হয় নিজেই ঘুমোতে গেছে। তাই তো দেখা যায় রোজ।
তা ছাড়া বামুনঠাকুরও হয়তো আছে, তবে তার দিবানিদ্রাটি প্রায় মহানিদ্রার কাছাকাছি। কাজেই বলা যায় সব সাফ!
কাজটা সারবার জন্যে এত দিনক্ষণ দেখতে হবে, তা কি জানতেন রত্নেশ্বর? এই বিষয়েই যখন সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তো ভেবেছিলেন রাতারাতিই সেরে ফেলা যাবে, ঘরে খিল দিয়ে। কিন্তু কপালের ফের রত্নেশ্বরের, ঠিক যেদিন তিনি এই নাইলন দড়িগাছাটি কিনে নিয়ে এলেন, ঠিক সেইদিনই কিনা ওই ভাইপোটি—ওই মস্তান ঘণ্টু কিনা—রত্নেশ্বরের ঘরে আড্ডা গাড়তে এল! একটা বালিশ আর একখানা শতরঞ্জি হাতে নিয়ে ঝড়ের বেগে ঢুকে এসে বলে উঠল, ওঘরে আর আমার পোষাবে না। মণ্টু সণ্টুর রাত জেগে পরীক্ষার পড়ার জ্বালায় আমার ঘুমের বারোটা বেজে যায়।
এসে আহ্লাদে ভাসা গলায় বলেছে, ওঃ জেঠুর ঘরে তো এনতার জায়গা, আমার খাট বিছানা ওইখানেই আনিয়ে নেব! আরামে থাকা যাবে, নো ডিসটার্বান্স।
এনতার জায়গা অবশ্য আছে রত্নেশ্বরের ঘরে। ঘরের গিন্নিটি না থাকলে যা হয়। তো তিনি তো কবেই স্বর্গারোহণ পর্ব সেরে ফেলে নিশ্চিন্ত আছেন। রত্নেশ্বরের যে কী হাল তা কে বুঝবে? ঘণ্টুবাবুর তো নো ডিসটার্বান্স।
এদিকে তার জেঠুটির যে, সব পরিকল্পনা বানচাল। রাত্রে ঘরে খিল দিয়ে কাজটা সারার আর প্রশ্নই রইল না।
কিন্তু এত দুর্গতি কি হত রত্নেশ্বরের? যদি না চিরদিনের প্রাণের বন্ধু প্রাণকেষ্ট অমন বিশ্বাসঘাতকতা করত। বিশ্বাসঘাতকতাই তো। তার কি আবার হাত-পা আছে? একেই বলে বিশ্বাসঘাতকতা। দারুণ, নিদারুণ!
প্রথমে তো আর নাইলন দড়ির চিন্তা মাথায় আসেনি রত্নেশ্বরের। নিভৃতে প্রাণকেষ্টকে বলেছিলেন, তোর শালা না ভায়রাভাই কার যেন একটা ডিসপেনসারি আছে না।
প্রাণকেষ্ট বলেছিল, আছে তো! শালার। কেন, তাতে কী?
কিছু না। তাহলে তোর কোনো অসুবিধে নেই। আমায় মুঠোখানেক ঘুমের বড়ি এনে দিবি। যা দাম লাগে দিয়ে দেব। মুঠোটা যেন বেশ বড়ো হয়।
প্রাণকেষ্টর হাঁ বুজতে সময় লাগে।
মুঠোভরতি ঘুমের বড়ি নিয়ে কী করবি?
রত্নেশ্বর রেগে উঠে বলেন, কী আবার করব? ঘুমের বড়ি নিয়ে লোকে যা করে তাই করব!
কেন, রাতে ঘুম হয় না বুঝি?
মারব থাপ্পড়! একরাতের ঘুমোর জন্যে আমি তোর কাছে ধরনা দিতে এসেছি? চিরজীবনের মতো ঘুমোতে চাই।
প্রাণকেষ্ট হাঁসফাঁস করে উঠেছিল, সেকী? কী হল?
রত্নেশ্বর বলেছিলেন, কী না হয়েছে? জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে। বেঁচে থাকবার ইচ্ছে চলে গেছে। বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না।
বন্ধুর কাছে প্রাণের কথা খুলে বলেছিলেন রত্নেশ্বর —মান নেই মর্যাদা নেই কারুর কাছে কোনো দাম নেই, স্বাধীনতা নেই, প্রাধান্য নেই, এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়?
গড়গড়িয়ে বলে চলেন রত্নেশ্বর, এই লোকটা যে একসময় একটা সাহেবের অফিসের দন্ডমুন্ডের কর্তা ছিল, গাদা গাদা কর্মচারীরা তার কথায় উঠত বসত, ভয়ে জোরহস্ত থাকত, সেসব এরা মোটেই মনে রাখে না, বরং সেই গৌরবের দিনের গল্প-টল্প একটু করতে গেলেই বলে, ‘রাখো দাদু তোমার সাহেবের অফিস। শুনে শুনে কান পচে গেছে।’
আবার পুঁচকে নাতি-নাতনিগুলো পর্যন্ত বলে ‘দাদুর মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই।… দাদু বোকার মতো কথা বোলো না! দাদু তুমি স্রেফ একটি বুদ্ধু!… দাদু, তুমি কী গাঁইয়া।’
এইপর্যন্ত শুনেই প্রাণকেষ্ট হঠাৎ হাহা করে হেসে উঠে বলে ওঠেন, ওইসব পুঁচকে-টুঁচকেরা কী বলেছে না বলেছে, তুই ইয়ে একটা গৃহবধূর মতো আত্মহত্যা করে মরবি? এই সত্তর বছর বয়সে?
সত্তর? সত্তর আবার কখন হল রে প্রাণকেষ্ট? তোমার আমার একই বয়স না? সবে তো এই উনসত্তর বছর একমাস সতেরো দিন।
প্রাণকেষ্টর আবার হাসি, শুধু ক-মাস ক-দিন? ক-ঘণ্টা ক-মিনিট সেটা বললি না? আরে আমি ওকেই সত্তর বলি। তো সেযাক গে— না হয় উনসত্তর বছর একমাস সতেরো দিনই হল, তবু বুড়ো বই তো খোকা নয়? তা বুড়ো মেরে খুনের দায়ে পড়বি কেন বাবা? এমনিতেই তো আর দু-চারটে বছর পার করে ফেললেই ল্যাঠা মিঠে যাবে?
রত্নেশ্বর খাপ্পা হন। বলেন, দু-চারটে বছর? কুড়ি-বাইশটা বছর নয়, তার গ্যারান্টি আছে? নব্বই নিরানব্বই বছর অবধি বাঁচে না মানুষ? দেখিসনি?
আরে বাবা, তা দেখব না কেন, একশো বছরও তো দেখি মাঝে মাঝে। তবে কিনা তোর এই নানান রোগের শরীর, বেশিদিন কি আর টানতে পারবি?
কী বললি? রোগের শরীর? বলি, কী রোগটা তুই দেখছিস আমার? অ্যাঁ? রোজ তো দেখছিস।
বা:, এই যে শুনি হাই ব্লাডপ্রেসার, হাই ব্লাডসুগার, কোলেস্টেরল—
তুই ওইসব বিশ্বাস করিস?
রত্নেশ্বর গর্জে ওঠেন, সব বাজে কথা! বানানো গপ্পো। এই রত্নেশ্বর রায়টিকে জব্দ রাখতে ডাক্তারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ওইসব গপ্পো চালাচ্ছে ছেলেব্যাটারা। আমার শরীরের মধ্যে দশটা রোগ ভরা আছে, আমি জানলাম না ওরা জানবে? সব ছল। ধাপ্পা! ঠিক আছে, ওইসব করে তোরা আমায় খাঁচায় পুরে রাখবি? আমার স্বাধীনতা খর্ব করে রাখবি? কাঁচকলা। খাঁচা ভেঙে পাখি ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। ব্যস।
প্রাণকেষ্ট বলেন, তো তাই যদি হয় মরতে যাবি কী দুঃখে? ‘‘ধুত্তোর সংসার’’ বলে চলে গেলে পারিস। এতবড়ো পৃথিবীটায় মাত্র সাড়ে তিন হাত একটা মানুষের জায়গা হবে না?
চলে গেলে? কোথায় যাব শুনি ?
কোথায় আবার? নিরুদ্দেশ হয়ে লোকে যেখানে যায়।
নিরুদ্দেশ! অ।
রত্নেশ্বর মুখ বাঁকিয়ে বলে ওঠেন, খুব একখানা অর্ডার দিয়ে বসা হল! ‘নিরুদ্দেশ হয়ে যা!’ বলি তার হ্যাপাটা ভেবেছিস? না হয় গেলাম! দাঁতের মাজনটা ব্রাশটা শেভিংসেটটা আর জোর দু-একটা ধুতি পাঞ্জাবি গেঞ্জি রুমাল সাবান তোয়ালে নিয়ে বেরিয়েও পড়লাম। রাতে যেখানে-সেখানে কাটানোও গেল, খাওয়াও গেল। কিন্তু তারপর ? সক্কালবেলা প্রকৃতি যখন ডাক দিয়ে উঠবে? প্রাতঃকৃত্যটি সারা হবে কোথায়? আমার তো একদম নিজস্ব স্পেশাল বাথরুমটি ছাড়া চলে না। …তা ছাড়া একটু ময়লা হলে জামাকাপড়ও পরতে পারি না। তাহলে?
প্রাণকেষ্ট বলেন, আরে বাবা তোর তো পয়সার অভাব নেই, না হয় দু-চারটে কিনেই নিবি। টাকাকড়ি নিবি সঙ্গে বেশকিছু। কিনেই নিবি।… টাকা পয়সা সঙ্গে নিবি।
রত্নেশ্বর খিঁচিয়ে ওঠেন, তারপর? সেগুলো বয়ে বেড়াবে কে? নাইতে খেতে যাবার সময় আগলাবে কে? আর পয়সার অভাব না থাকলেও, কত পয়সা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে? দে এসবের উত্তর। ‘নিরুদ্দেশ হয়ে যা!’ হুঁ! আর এদিকে? ওই ফিচেল ব্যাটারা খবরের কাগজে হাহাকার করে বিজ্ঞাপন দিক, ‘বাবা! যেখানে থাক, চলে এসো। আমরা সকলে চিন্তায় ভাবনায় মৃতপ্রায়।’… টিভির পর্দায় বাপের মুখখানি ঝলসে দিয়ে জানান দেবে ‘নাম রত্নেশ্বর রায়, বয়স উনসত্তর, উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, গায়ের রং ফর্সা, মাথায় টাক। নিরুদ্দেশ হবার সময় পরনে ছিল কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি, গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি। বিশেষ চিহ্ন, নাকের ডগায় একটি জড়ুল আছে।…
সন্ধান জানাইবার ঠিকানা—বাইশের তিন যজ্ঞেশ্বর রায় লেন, হুজ্জোৎ শিবপুর। জেলা হাওড়া।’…আর লাখ লাখ লোক দেখুক সেই বাহার। পুরোনো কালের চেনাজানারাও দেখবে। তার থেকে গলায় দড়িও ভালো হে প্রাণকেষ্ট! তবে—দড়ির ফাঁস লাগিয়ে, সাতহাত জিভ বার করে একখানা কুদৃশ্য হয়ে মরতে চাই না বলেই, তোর শরণ নেওয়া। … আমার ওই ভাইপোটা, ওটা, আবার এত ধুরন্ধর, বুড়োধাড়ি দাদাদের, মানে আমার ছেলেদেরকে পরামর্শ দেয়। প্যাঁচ শেখায়।… হয়তো বুদ্ধি দেবে, পুরস্কার ঘোষণা করো বড়দা মেজদা! কাগজে কাগজে ছবি ছাপিয়ে বিবরণ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করো—‘সন্ধান জানাইতে পারিলে—এত টাকা’—তখন? নিরুদ্দেশ হওয়াটি ঘুচে যেতে কতক্ষণ? টাকার গন্ধ পেলে, লোকে সন্ধানের চেষ্টা করবে না? নিরুদ্দেশ হলে হোটেলে রেস্টুরেন্টে চায়ের দোকানে হাটে-বাজারে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াতে হবে তো? তো কে না আজকাল কাগজ পড়ে? আর কে না ওসব বুঝে ফেলে?… হয়তো কেউ বুঝে ফেলে কিডন্যাপই করে ফেলল। তারপর পুরস্কার আদায় করতে গেল। শেষ রেজাল্টটি তাহলে কী। ফের সেই ‘ধুত্তোর সংসারে’ ফিরে আসা। আর পুনর্মূষিকটি হওয়া। এই তো? লাভের মধ্যে খানিকটা ধাষ্টামো, খানিকটা লোকহাসানো।
প্রাণকেষ্ট ‘থ’ হয়ে তাকিয়ে থেকে এই লম্বা ভাষণটি শুনে শেষ করে তবে মুখটি খোলেন। বলেন, এখনও কি তোর সেই কমবয়েসের গোয়েন্দা গল্প পড়ার অভ্যাস আছে রে রতনা?
…এত সব শিখলি কোথা থেকে?
রত্নেশ্বর রায় বেজার গলায় বলেন, এসব শিখতে আবার বইখাতা লাগে নাকি? নাকি পয়সাই লাগে?—চোখ কান খোলা রাখতে পারলেই সব শেখা যায়। …অথচ—।
কী অথচ?
অথচ আমার বাড়ির ওই পুঁচকে শয়তানেরা? আমি এসবের কিছু নিয়ে গল্প করতে এলেই বলবে, ‘এঃ দাদু! কোন যুগে পড়ে আছ?’ …বলবে, ‘মানুষ চাঁদে উঠেছে ও খবর এখন পচে পুরোনো হয়ে গেছে। সেখবর রাখো? …এখন হচ্ছে সূর্য অভিযানের যুগ। আর তোমরা সেই আদিকালে পড়ে আছ!’ …ওই ধুরন্ধর ঘণ্টুটা তো আমাদের কালের সব কিছুকেই ‘কিস্যু না’ বলে উড়িয়ে দেয়। সণ্টু মণ্টু দুটোও আমার সব কিছুতে কুসংস্কার দেখে। …হাঁচিটা যে অযাত্রা, পিছু ডাকলে যে যাত্রায় বিঘ্ন ঘটে, সক্কালবেলা এক চোখ দেখালে যে ঝগড়া হয়, এসব নাকি পাগলের কথা। পাগুলে মাথা থেকে যত সব উদ্ভট চিন্তার ফল এসব।…
রত্নেশ্বর নতুন করে চাঙ্গা হয়ে বলেন, শুধু কি তাই? আবার পাজিরা বলে কিনা, ‘শুধু বয়েসে বড়ো গুরুজন বলেই ভক্তি করতে হবে এর কোনো মানে নেই। ভক্তির যোগ্য হলে, তবেই ভক্তি।’ বোঝ ? কী লম্বাচওড়া কথা? …বলি —যোগ্যতা অযোগ্যতার বুঝিস কী রে তোরা?
প্রাণকেষ্ট বন্ধুকে একটু ঠাণ্ডা করতেই বোধ হয় অগ্রাহ্যভাবে বলেন, আজকালকার ছেলেপুলেরা তো ওইরকমই হয়েছে।
‘হয়েছে’ বলেই মেনে নিতে হবে?
রত্নেশ্বর জ্বলে ওঠেন, ছেলেপুলের শিক্ষাদীক্ষা থাকবে না? ম্যানার্স থাকবে না? গুরুলঘু জ্ঞান থাকবে না? আমাদের ছেলেবেলার কথা ভাব? গুরুজনদের কী ভীষণ ভয় করতাম? বাঘের মতো। গোঁফের আগাটি দেখতে পেলেই গায়ে কাঁটা।
রত্নেশ্বরের ছেলেবেলা মানেই প্রাণকেষ্টরও ছেলেবেলা। এই ‘হুজ্জোৎ শিবপুরের’ একই পাড়ায় তো দুজনারই তিনচার পুরুষের বাস। সেই ‘জন্মদিনের পোশাক পরা’ অবস্থা থেকে দুজনে প্রাণের বন্ধু। এই উনসত্তর বছরেও তাতে চিড় খায়নি।
প্রাণকেষ্ট বললেন, তা আর বলতে! তুই তো তুই! তোর বড়োজ্যাঠাকে আমরা পাড়াসুদ্ধ ছেলেরা সব্বাই বাঘের মতো ভয় করতাম না? তোর মনে আছে? একদিন ঘোষালদের পোড়ো-বাড়ির বাগানের মধ্যে ঢুকে ওদের পড়ে থাকা পেয়ারাগাছে চড়ে পেয়ারা পাড়ছি, হঠাৎ রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে বড়োজ্যাঠার চোখে পড়ায়, ‘কে রে ওখানে’ বলে এমন একখানা হাঁক পেড়ে ছিলেন যে ভয়ে কেঁপেটেঁপে পা ফসকে পড়ে আছাড় খেয়ে দু-দুখানা হাঁটুর মালাই চাকির দফা গয়া! মনে আছে তোর?
মনে আবার নেই? বাড়িতে আহা করা দূরে থাক, বকুনি দিয়ে দিয়ে তুলোধোনা করে ছেড়েছিল। এগজামিন দেওয়া হল না বলে! তাই না?
শুধু বাড়িতে? পাড়াসুদ্ধু সবাই একবার করে একহাত নেয়নি? তখন তো বয়েসে বড়ো হলেই সবাই গার্জেন। এমনকী মুদি খুড়ো, গোয়ালা পিসে, কুমোর ঠাকুরদা পর্যন্ত সবাই। …তো শেষপর্যন্ত পরামাণিক-জ্যাঠা বকাবকি করতে করতে কোথা থেকে যেন হাড়জোড়ার পাতা এনে বেঁধে দিল, বাস! একমাস না হতেই একদম ফিট!
তাই তুই তার তিনদিন পরই গাছে চড়তে গেলি।
তা গেলুম বটে।
তবে? হাহা করে হেসে ওঠেন প্রাণকেষ্ট— তুই একটা গেছো বাঁদর ছিলি।
তুইও কিছু কম যেতিস না। ইস্কুল পালিয়ে ভরদুপুরে ‘পেঁচোর খালে’ ছিপ ফেলে বসে থাকতিস না?
রত্নেশ্বর এত বেজার মনেও হেসে ফেলে বলেন, একদিন তার — শাস্তিটিও যা পাওয়া গিয়েছিল! তোর কি মনে আছে?
মনে আবার নেই। তোর হাড়হদ্দ কোনটা আমার অজানা? আর কোনটা ভুলে গেছি? সেই তোর হেডপন্ডিত মশাইয়ের ব্যাপার তো?
হুঁ! সবে ফাতনাটা নড়েছে, একটা মাছ বড়শিটা গিলেছে, আর দেখি পন্ডিতমশাই আসছেন পুকুরপাড়ের দিকে!
বাস! ছিপটিপ ফেলে সাঁত করে জলে নেমে পড়েছি, আর ডুবসাঁতার দিয়ে চলেছি, পন্ডিতমশাই আর নড়েন না। নিবিষ্টমনে পুকুরধার থেকে থানকুনির পাতা না ব্রাহ্মীশাক কী যেন খুঁজে চলেছেন। …উঃ আমার এদিকে পচা খালে ডুবে থেকে দম আটকে আসছে। … আবার তারমধ্যেই জলের মধ্যে হাতড়াচ্ছি যদি বড়শি গেলা মাছটাকে কবজা করতে পারি। সেআর হল না। পন্ডিতমশাই সরে যেতে হাঁপ ছেড়ে বেঁচে, উঠে এলাম বটে, তারপর সেকী সর্দি কাশি। …তারসঙ্গে বাড়িতে কী লাঞ্ছনা। অসুখ করলেই যা হয়।
তা যা বলেছিস। আমাদের ছেলেবেলায় অসুখ-টসুখ করলেই তো ফার্স্ট ট্রিটমেন্টই ছিল কষে বকুনি। তবু কখনও মুখের ওপর কথা বলেছি?
মুখের ওপর কথা? আমরা? অত সাহস ছিল? একদিন মনের সুখে একটু লাট্টু ঘোরাচ্ছি, ছোটকা এসে খপ করে এক হ্যাঁচকা টান মেরে হাত থেকে লেত্তিটা কেড়ে নিয়ে খিচিয়ে বলে উটল, ‘সামনে একজামিন, আর বাবুর লাট্টু ঘোরানো হচ্ছে!’ তো শুধু বলেছিলুম সব পড়া তৈরি করে ফেলে একটু ঘোরালে কী হয়? আর কিছু না শুধু এইটুকু। বাস, সক্কলের সামনে সাতহাত নাকেখত দিইয়েছিল আমায় ছোটকা। তবু কতই বা বড়ো ছিল আমার থেকে ছোটকা? বাবার থেকে কুড়িবছরের ছোটো ভাই। …কিন্তু আমার ওই হ্যানস্থায় বাবা মা জ্যাঠা কেউ কিছু বলতে এসেছিল? মোটেই না। বরং সবাই বলেছিল গুরুজনের মুখের ওপর কথা? ঠিক হয়েছে। শিক্ষা হওয়া দরকার। তখন সাহস ছিল —রাগে দুঃখে অপমানে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু যাইনি কেন? জানিস? একজামিনের রেজাল্ট দেখিয়ে সক্কলকে ট্যারা করে দেব বলে। তো দিয়েও ছিলুম। ক্লাসে ফার্স্ট! রেকর্ড নম্বর। …তোর মনে আছে? সেই যেবারে তোর তেমন জুত হয়নি। বলে তোর মেজজ্যাঠার কাছে খড়ম পেটা খেয়েছিলি!
রত্নেশ্বর নিশ্বাস ফেলে বলেন, তুই বললি বলে মনে পড়ল। কিন্তু তাই বলে কি গুরুজনদের আমরা কম ভক্তি-মান্য করতাম? না কম ভালোবাসতাম?
পাগল? ওই ছোটকাকে প্রাণতুল্য ভালোবাসতুম না? ছোটকার একবার কী একটা শক্ত অসুখ হওয়ায় বাড়ির সবাইকে লুকিয়ে মা কালীর কাছে পাঁচ পয়সার হরির লুট দিয়ে আসিনি?
…প্রাণকেষ্ট একটু হেসে বলেন, পয়সাটা অবশ্য—একটু চোরাই মাল। ঠাকুমার ঘর থেকে না বলে চেয়ে নিয়ে আসা। তো তারজন্যে মা কালীর কাছে মনে মনে কান মুলে নিয়েছিলুম।… কী করব বল? আমাদের আর পয়সা কোথায় বল?…ঠাকুমা রথের দিন দোলের দিন চড়কের দিন একটা করে চকচকে আনি দিতেন, সেই ছিল সারাবছরের আয়।
হাহা করে হেসে উঠলেন প্রাণকেষ্ট। রত্নেশ্বর বলে উঠলেন, তাইতেই তো তোকে আমার ‘রাজা’ বলে মনে হত! আমার তো সেগুড়েও বালি। ঠাকুমাকে চক্ষে দেখিনি। ছিলেন ঠাকুরদা! ওরেব বাস! কী দারুণ দুর্দান্ত। ষাঁর কাছে আমার সেই বাঘা বড়োজ্যাঠাও কেঁচো! আর বাবা কাকারা পিঁপড়ে!
প্রাণকেষ্ট বলে ওঠেন, তোর ঠাকুরদা? ওরে বাবা! সেই যজ্ঞেশ্বর রায়? সবাই যাঁর কথায় বলত ওনার ভয়ে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায়। তো ওনার কাছে শুধু তাঁর ছেলেরা কেন, পাড়ার সব্বাই তো কেঁচো কেন্নো মশামাছি পিঁপড়ে। …রাস্তায় হাঁটার সময় অপর কারও সাধ্য ছিল না ওঁকে ওভারটেক করবার! দারুণ খেতে পারতেন, তাই না?
রত্নেশ্বর বলেন, দারুণ? বরং বলতে পারিস নিদারুণ! একঝুড়ি ইয়া ইয়া হিমসাগর আম সেঁটে একটা ঢাউস কাঁঠাল নিয়ে বসে, পুরোটা সাবড়ে ফেলতেন। তারসঙ্গে আবার মাঝে মাঝে মুখবদল করতে একখানা পাঁপর ভাজা মজুত রাখতে হত! পিসি আবার মাঝেমাঝে পিতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তারসঙ্গে একখানা বেগুনিও রেখে দিয়ে যেত। …তো জানিস, ছেলেবেলার ছেলেবুদ্ধি, একদিন ‘হাঁ’ করে ওই খাওয়া দেখতে দেখতে বলে ফেলেছিলাম ‘ও দাদু অত খাচ্ছ কেন? অসুখ করে মরবে যে—’ সেই অপরাধে বাবার কাছে এমন ঠ্যাঙানি খেয়েছিলাম যে সাতদিন গায়ে ব্যথা ছিল। …আর বাড়ির সক্কলে ‘বে-সহবত ছেলে’ বলে ছি ছি করেছিল। …আর এখন? আমার আমলে?
রত্নেশ্বর হঠাৎ সাপের মতো ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, এখন আমার বউমারা অনায়াসে মুখের ওপর বলেন, ‘বাবা আপনার শরীর সম্পর্কে একটু সেন্স নেই? এত হাইপ্রেশার, অথচ যা ইচ্ছে খাচ্ছেন, রোদের মধ্যে বেরোচ্ছেন।’ ..ছেলেরা বলে, ‘বাবা আপনার একটাও আলু খাবার কথা নয়। আর আপনি বাটি ভরতি আলুর দম খাচ্ছেন?’ …আর শুনলে বিশ্বাস করবি? বড়ো নাতিটি কিনা—চোখ রাঙিয়ে বলে ‘দাদু, ডাক্তার তোমায় চিনি ছাড়া চা খেতে বলেছে, আর তুমি কিনা খাবারের দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ে কোণে বসে টপাটপ রসগোল্লা সাঁটো, ঠোঙাঠোঙা গরম জিলিপি ওড়াও, তারওপর আবার ইয়া বড়ো একভাঁড় দই সাবড়াও? ছি ছি।’ ..ভাবতে পারিস ঠাকুরদার মুখের ওপর ‘ছি ছি’। আর তারজন্যে তার বাপ কাকা কিছু বলে না!
প্রাণকেষ্ট বন্ধুর রাগরাগ মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে বলেন, তা ডাক্তার যখন বারণ করেছে, তুইই বা কেন—
কী? থামলি কেন? বলে ফেল সবটা! আমিই বা কেন ‘কী?’
ওই তো — দোকানে ঢুকে ওইসব খেতে যাস কেন বাবা! …
… বটে? তুইও যে দেখছি ওদের দলে। ‘দোকানে ঢুকে খাস কেন?’ বলি দোকানে গিয়ে ঢুকব না? বাড়িতে আমায় আধখানা রসগোল্লাও দেবে? মনপ্রাণ বলে কিছু আছে? লোকটা যে চিরকাল মিষ্টির ভক্ত ছিল তা ভাবে কেউ? … বাড়ির বাইরেও চর লাগিয়ে রেখেছে। চর আর কে? ওই আমার বিচ্ছু নম্বর ওয়ান ভাইপোটি। সর্বদা যিনি রাস্তা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন।… এত অপমান এত পরাধীনতা, এ মানুষে সহ্য করতে পারে? ডাক্তার বারণ করেছে বলেই তোমরা গুরুলঘু জ্ঞান করবে না? ভেবেছে কী সব? .. না না, এভাবে স্বাধীনতাহীন হয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। আমি মনস্থির করে ফেলেছি। তুই শুধু একথাবা ঘুমের বড়ি সাপ্লাই কর প্রাণকেষ্ট! ব্যস। বেঁচে মরে থাকার থেকে, পুরো মরাই ভালো!
প্রাণকেষ্ট দুঃখু দুঃখু মুখে বলেন, হ্যাঁ রে রতনা! আমি তোর চিরকালের প্রাণের বন্ধু হয়ে তোকে একথাবা বিষবড়ি সাপ্লাই করব?
রত্নেশ্বর তেজি গলায় বলেন, করবি একশোবার করবি। আমার ভালোর জন্যেই করবি।… মরব তো নিশ্চয়। না মরে তো ছাড়বই না। তবে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে সাতহাত জিভ বার করে মরার তেমন ইচ্ছে নেই। ভদ্রভাবে সভ্যমতো হয়ে মরতে চাই। তাই তোর খোশামোদ করা। আমি জোগাড় করতে গেলেই নির্ঘাত প্ল্যান ফাঁস হয়ে যাবে জানাজানি হয়ে। বাড়ির সব্বাই স্পাই সব্বাই টিকটিকি!
প্রাণকেষ্ট তবু বলেন, কিন্তু সত্যিই একেবারে মরবিই ঠিক করে ফেলেছিস?
আলবাত! ওর আর নড়চড় নয়।
আহা, নাতিপুতি ছেলে বউ-টউ, ওদের ছেড়ে যেতে একটু মন কেমন করবে না?
মন কেমন? ওদের জন্যে?…রত্নেশ্বর গর্জন করে ওঠেন —ওদের দুর্ব্যবহারেই তো এই পৃথিবীটাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। … না না ওসব মন কেমন-টেমনের মধ্যে নেই আমি। তুই কালই এনে দিবি। কত দাম লাগবে বল?
প্রাণকেষ্ট একটু উদাসভাবে বলেন, ছেলেবেলায় তোর সঙ্গে এক পয়সার ছোলাভাজা ভাগ করে খেয়েছি, আর আজ জীবনের শেষবেলায় তোর কাছে সামান্য একটু ঘুমের বড়ির দাম নেব? ও আর দিতে হবে না।
রত্নেশ্বর বলেন, ঠিক আছে, তাহলে দিচ্ছি না। তবে জিনিসটি আমার চাই।
পরদিনই তাগাদা দিতে এলেন রত্নেশ্বর বন্ধুর কাছে।
এনেছিস?
এনেছি—তবে মানে—
এনেছিস? তাহলে আবার ‘তবে মানে’টা কী? দে, দে! শিগগির দে।
প্রাণকেষ্ট বলেন, দিতে মন সরছে না রে। আর একটা দিন সময় নে না, ভাববার জন্যে!
রত্নেশ্বর অস্থির চঞ্চল।
ওসব ভাবা-ফাবা হয়ে গেছে। আমি আমার সংকল্প থেকে একচুল নড়ছি না।
বাড়ির কারওর কথা একটুও ভাববি না?
বাড়ির? ওদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েই তো — জানিস — কালই আবার হয়ে গেছে একপালা। তাতেই হয়ে গেছে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া। ছেলেরা বলে কিনা ‘সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসো কেন বাবা? ওসব তুমি বুঝবে না।’ ছোটোভাই বলে, ‘ভালো করে কানে শুনতে পাও না তবু শোনা চাই? এত কৌতূহল কীসের?’… ভাইপো ব্যাটা বলে, ‘সর্বদা হাঁকডাক, ছটফটানি। তোমার বাবার মতো পুজো-আচ্চা গীতাপাঠ-ফাঠ নিয়ে থাকলেও তো পারো!’… তো এইসব শোনবার জন্যে বেঁচে থাকতে হবে? নেভার।… দে বড়ি ক-টা দে।
প্রাণকেষ্ট মলিন মুখে বলেন, ক-টা কী রে ‘একথাবা’ তো! যা বলেছিলি। নিজের শালার দোকান বলে, কেউ কিছু অবজেকশন তোলেনি। … বরং কম্পাউণ্ডার ছোকরাটা দাঁত বার করে হেসে বলেছে ‘বাইরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন বুঝি? তাই স্টক করছেন? রাতে কি একেবারেই ঘুম হয় না?’… তা যা এনেছি তাতে তোর তিনবার মরা হতে পারে।
রত্নেশ্বর অস্থিরভাবে বলেন, তিনবার মরার দরকার নেই ভাই। একবারেই যথেষ্ট। বাড়তিটা তুই বরং নিজের কাছে রেখে দিস। পরে কাজে লাগতে পারে। দে চটপট। গিয়ে বাড়িসুদ্ধ সবকটাকে জব্দ করে ছাড়ছি।
হাত বাড়ান রত্নেশ্বর।
কিন্তু প্রাণকেষ্ট তখুনি সেহাতের ওপর কিছু রাখেন না। তার বদলে মলিন মুখে বলেন, মরে গিয়ে তুই আর ওদের কী জব্দ করবি ভাই? তুই গেলেও—ওদের তো আরাম আয়েশ আহ্লাদ আমোদের কিছুই কমতি হবে না। ওদের এখন কম বয়েস। বাড়ি থেকে একটা সর্বদা অসন্তোষ স্বভাব খিটখিটে বুড়ো বিদায় নিলে কে আর দুঃখে মরবে?
কী, আমি খিটখিটে বুড়ো? এই কথা বলছিস?
আহা আমি কী আর বলছি? ওরা তো বলতে পারে।
কে বলতে পারে অ্যাঁ? শুনি তো তার নামটা।
আহা বলুক না বলুক ভাবতেও তো পারে।
ভাবলে তো বয়ে গেল। আমি তো বাড়ির সব ক-টাকে ছোটো থেকে বড়ো—‘কুমড়ো পটাশ হুঁকোমুখো হ্যাংলা আর বকচ্ছপ’ ভাবি! তারজন্যে ওদের কিছু এসে যাচ্ছে? দে বড়ি দে।
প্রাণকেষ্ট বলে, আহা সেতো দেবই। দেবার জন্যেই তো এনেছি। তবে বলছিলুম, ওই যে জব্দর কথা বলছিলি, তো তুই মরে গেলে ওদের আবার জব্দটা কী? তোর ঘরবাড়ি টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি, সবই তো রয়ে যাচ্ছে। বরং তুই গেলে ওদের নিজস্ব হয়ে যাচ্ছে। যত ইচ্ছে স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারবে। তাহলে?
রত্নেশ্বর রায় প্রায় খিঁচিয়ে বলে ওঠেন, তা ওসব রয়ে যাবে না তো কি আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব?
প্রাণকেষ্ট আরও মলিন আর উদাসভাবে বলেন, না:! নিয়ে আর কী করে যাবি? নিয়ে যাবার তো উপায় নেই! যারা সোনার পাহাড় জমিয়ে তোলে তাদেরও একটা ছুঁচ পর্যন্ত নিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই। …তবে—
কী? তবে কী? হ্যাঁ? কেবলই পাঁয়তাড়া কষছিস! চটপট বলে ফেল তো।
মানে বলছি কী নিয়ে যেতে না পারলেও, ওদের জব্দ করতে, অন্য কাউকে তো দিয়েও যেতে পারিস।
রত্নেশ্বর তো টগবগ করে ফুটছিলেন, হঠাৎ একটু থিতিয়ে পড়ে বলেন, দিয়ে যাব মানে? কাকে?
সেতোর যাকে ইচ্ছে। একটা রাস্তার লোককেও দিতে পারিস। উদ্দেশ্যটা তো ‘দেওয়া’ নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমার বিরোধীপক্ষকে জব্দ করা। তাই না?
রত্নেশ্বর ভুরু কুঁচকে বলেন, ওসব দেওয়া-টেওয়া আবার কীভাবে হবে?
কীভাবে আবার? উকিল ডেকে উইল বানিয়ে লেখাপড়া করে দানপত্র করে দিয়ে !
রত্নেশ্বর চমকে ওঠেন, ওরে বাবা! উকিল-ফুকিল! ওসব ফ্যাচাং-এর মধ্যে আমি নেই বাবা! মরে গেলাম, ফুরিয়ে গেল।
প্রাণকেষ্ট বলেন, তাহলে তো তোর আসল উদ্দেশ্যটাই সিদ্ধ হল না। ওই জব্দ করা?
কিন্তু তাহলে তো আজই কিছু হয় না।
তা হয় না বটে। দুটো দিন ওয়েট করতে হবে। জাস্ট দুটো দিন। তা ভিন্ন অন্য কোনো ঝামেলা নেই। আমার নিজের শালির ছেলেই রয়েছে উকিল। আমি ডাকলে ফিও নেবে না। এতদিনই যখন সহ্য করছিস, আর দুটো দিন কর।
বলছিস।
বলছি তো। ওটিই হচ্ছে ওদের জব্দ করার মোক্ষম উপায়।
কথা হচ্ছিল একটা কাদাখোঁচা পার্কে, রেলিং ভাঙা বেঞ্চে বসে। প্রাণকেষ্ট রত্নেশ্বরদের এই চিরকেলে দেশ হুজ্জোৎ-শিবপুরের এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গ্রাম থেকে শহর হয়ে উঠেছে সে। ওঁদের ছেলেবেলায় আশপাশে দিনে শেয়াল ডাকত। আর এখন দু-দুটো সিনেমা। ঘরে ঘরে টিভি, রঙিন টিভি। কিন্তু এই পার্কটার হাল এখনও সেই একই। একদম বেহাল। একদা এই পার্কেই এই বেঞ্চে বসে দু-বন্ধুতে এক পয়সার ঝালমুড়ি ভাগ করে খেয়েছেন, দু-পয়সার চিনেবাদাম খেয়েছেন ভাগ করে। ছাড়িয়ে খোলাগুলো দুজনে দু-দিকে জমিয়ে রেখে পরে হেসে হেসে বলেছেন, দেখি কে বেশি খেয়েছে।… সেতখন ছাত্রজীবন।… তারপর এখন এই শেষজীবনেও দুজনে অন্তত একবার এখানে এসে বসেন। সকাল বিকেল যখন হোক। অথচ এখন পার্কটার উন্নতি দূরে থাক প্রায় বসবার অযোগ্য। এত হয়েছে, কিন্তু পার্কটা ধ্বংস হয়েই চলেছে। কোনো বেঞ্চেই রেলিং নেই, দু-একটায় আবার বসবার জায়গাটাই নেই।
সেকালের ব্যাপার, লোহার বেঞ্চ, পায়াগুলো মাটিতে পোঁতা। কাজেই কেউ উপড়ে নিয়ে যেতে পারেনি। তবে মরচে পড়ে পড়েই খতম।
এখন আর ছোলাভাজা চিনেবাদাম ঝালমুড়ি পানমশলা কিছুই খাবার যোগ্য দাঁতের জোর নেই, তাই দুজনে একটু করে হজমিগুলি খান। দুজনের পকেটেই থাকে। তবে শেয়ার করে খাওয়া হয়।
শেষ গুলিটা ফুরিয়ে ফেলে, রত্নেশ্বর বলেন, ঠিক আছে আর দুটো দিন রইলাম। তো বড়িগুলো দিয়ে দে, নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখি গে।
প্রাণকেষ্ট বলে ওঠেন, সর্বনাশ! তাই কখনো করতে আছে! কোথায় রাখতে কোথায় রাখবি, কে হয়তো ভুল করে কোথায় ফেলে দেবে। আমার কাছেই থাক এ দু-দিন! … এই তো এ পকেটে রয়েছে।
দেখালেন। হজমিগুলির পকেটে নয়, অন্য পকেটে রাখা আছে। একটা সাদা কাগজের বড়োসড়ো মোড়ক বার করে সামান্য খুলেই আবার মুড়ে ফেললেন প্রাণকেষ্ট।
রত্নেশ্বর আস্তে তার গায়ে একটা হাত বুলিয়ে বলেন, ঠিক আছে। ওই সবগুলোই দিয়ে দিস আমায়। দামই যখন নিচ্ছিস না। আর তোরও কিছু কাজে লাগবে না।… ইয়ে —আর হজমিগুলি আছে নাকি?
না তো। এইমাত্র শেষটা শেষ করলাম।
আমারও তাই। এখানে এই আমাদের শেষ আসা, কি বলিস?
প্রাণকেষ্ট বলেন, তা বটে। দুটো দিন তো ব্যস্ত থাকতে হবে ওই উইল-ফুইল নিয়ে। যাক, আজ ওঠা যাক। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসছে।
রত্নেশ্বর উঠতে গিয়েও হঠাৎ না উঠে, চিন্তিতভাবে বলেন, আচ্ছা কেষ্টা, হঠাৎ একটা রাস্তার লোককে ডেকে আমার যথাসর্বস্ব দান করতে বসতে চাইলে, সেঘাবড়ে যাবে না তো? ব্যাপারটা সন্দেজনক ভাববে না তো?
প্রাণকেষ্টও উঠতে গিয়ে বসে পড়ে আরও চিন্তিতভাবে বলেন, তা সত্যি। সেটা একটা কথা বটে। এযুগে তো কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। ভালো করতে গেলেও মন্দ ভাবে। হয়তো লোক জানাজানি করে বসবে। পুলিশে খবর দিয়ে বসবে।
তাহলে?
তাই তো। …ভাবছি! …কী করা যায়! …আচ্ছা—আচ্ছা তো এক কাজ করলে হয়। তুই আমার নামেও লেখাপড়া করে দিতে পারিস। কেউ টেরটি পাবে না।
তোর নামে? ধ্যাৎ।
তাতে কী? …একটা সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তা ছাড়া পেলে আমারও যথেষ্ট সুবিধে হয়।
কী বললি প্রাণকেষ্ট? পেলে তোর সুবিধে হয়?
ছিটকে ওঠেন রত্নেশ্বর।
প্রাণকেষ্ট নির্বিকারভাবে বলেন, তা একটু হয় বই কী। সামনেই মেয়ের বিয়ে আসছে। তা ছাড়া পচা বাড়িখানাও পয়সার অভাবে সারানো হচ্ছে না! প্রায়ই ভাবি যদি লটারিতে একটা ফার্স্ট প্রাইজ ওঠে রে। …তা এ-ও বলতে গেলে তাই হবে।
রত্নেশ্বর রায় এতক্ষণ চুপচাপ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রাণের বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনলেন। আর কথা শেষ হতেই ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে কড়া গলায় বলে উঠলেন, বটে! বটে! ‘এও একরকম লটারির টিকিট পাওয়া।’ মনে মনে এই মতলবটি ভেঁজে তুমি আমায় ‘ওদের জব্দ করার’ ফরমুলা শোনাচ্ছিলে? ‘মেয়ের বিয়ে! বাড়ি সারানো!’ এইসব মাথায় রেখে তুমি আমার চিরকালের প্রাণের বন্ধু হয়েও বিষবড়ি সাপ্লাই করতে রাজি হয়েছিলে? তা-ও একবার মরার মতো নয়, তিন-তিনবার মরার মতো! যাতে কোনো মতেই না ফেলিওর হয়। ওঃ প্রাণকেষ্ট! তুই এই? ছি ছি! আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিগে যা তোর বাড়ি। জীবনে আর তোর মুখদর্শন করতে চাই না। রত্নেশ্বর রায় ওই সাত হাত জিভ বার করে গলায় দড়ি দিয়েই ঝুলবে। … দেখতে যাস সেই বাহারে দৃশ্য ড্যাবডেবিয়ে চোখে।
বলেই হনহন করে এগিয়ে যান রত্নেশ্বর প্রাণকেষ্টর দিকে আর না তাকিয়ে।
প্রাণকেষ্ট ওর যাওয়ার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ঝোলা গোঁফের ফাঁকে একটু মুচকি হেসে উঠে পড়েন। সেই সাদা কাগজের মোড়কটা বার করে তা থেকে দুটো বড়ি বার করে মুখে ফেলে হাঁটতে থাকলেন। ছোট্ট ছোট্ট সাদা সাদা এই পিপারমেন্ট লজেন্সগুলো খেতে বেশ মুখরোচক। …
তা এ হচ্ছে ক-দিন আগের কথা।
রাগের মাথায় রত্নেশ্বর তক্ষুনিই একগাছা দড়ি কিনে বাড়ি ফিরবেন ভাবতে ভাবতে একটু থমকালেন।…এই ‘হুজ্জোৎ শিবপুরের’ সব দোকান আর দোকানিই তো তাঁর চেনাজানা। সন্ধের মুখে হাঠাৎ লম্বা একটা মজবুত নাইলন দড়ির খোঁজ করতে গেলে, সাত সতেরো প্রশ্ন করতে বসবে। কী কাজ হবে অত মজবুত দড়ি দিয়ে তার কৈফিয়ত দিতে হবে! সেএক ঝামেলা। তাই তখন রাগ চেপে বাড়ি ফিরলেন, আগামীকাল হাওড়াবাজারে গিয়ে কিনবেন ভেবে।… সেখানে কে তাঁকে চেনে? জোরে পা চালালেন! জোর বৃষ্টি এসে গেল।
তবে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই আর একবার রাগ উথলল! রত্নেশ্বরের বেশ কয়েকজন গার্জেন পাঁচ বছর থেকে পঞ্চাশ বছরেরর, তেড়ে এসে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বৃষ্টিতে ভিজে আসার জন্যে।
…‘এতটি বয়সে কোনো আক্কেল নেই?…কতক্ষণ থেকে মেঘ করেছে, বাড়ি চলে আসতে হয় না? …এত ভিজে এলে, অসুখ করার ভয় নেই’… এইসব।
আজ আর রত্নেশ্বর তেড়ে উঠে তর্ক করতে যান না ওদের সঙ্গে। …মনে একটু উদাস হাসি হাসেন। …নে আজকের দিনটা সর্দারি করে নে। …তারপর কাল দেখিস।…
কিন্তু সেই ‘কাল’কে আর দেখানো হয়নি।
যদিও পরদিনই হাওড়াবাজারে গিয়ে খুব মজবুত আর লম্বা একখানা নাইলন দড়ি কিনে এনেছিলেন সাইডব্যাগে ভরে। কিন্তু ওই আগে যা বলা হয়েছে—কপালের ফের! ঠিক সেই-দিনই ওই পাজি ঘণ্টুটা আহ্লাদে ভেসে জেঠুর ঘরে শুতে এলেন।…ঘর থেকে বেরিয়ে? তাই কি চুপিচুপি বেরোনোর উপায় আছে? বেরোবেনই বা কোথা দিয়ে? সারাবাড়িতে যে ক-টা বেরবার পথ আছে, সব তালাচাবি মারা। …যেন বাড়ির বাইরে ঝাঁকে ঝাঁকে চোর ওঁত পেতে বসে আছে। মশারির বাইরে মশাদের মতো!
হ্যাৎ! রত্নেশ্বরের ছেলেবেলায়, দেখেছেন গরমকালে বাবা জ্যাঠারা খোলা উঠোনে শুয়ে থাকতেন ক্যাম্পখাট পেতে। ঘরে ঘরেও দরজা দুহাট। না হলে হাওয়া আসবে কী করে?
তা এখন আর ভগবানের হাওয়ার ধার ধারে কে? ইলেকট্রিক ফ্যানই যখন রয়েছে। ফুলস্পিডে চালিয়ে রাখলেই হল। আর সর্বত্র তালাচাবি মার।
যাকগে সেকালের কথা।
আজ এতদিনে রত্নেশ্বর একখানি সুবর্ণযোগ পেয়ে গেছেন। আজ দুপুরে বাড়ি শুনশান। … এ সুযোগ ছাড়া চলে না।
…যতগুলো দিন চলে যাচ্ছে, ততই তো মনে মনে লজ্জা আসছে, প্রাণকেষ্টর কাছে মুখ থাকছে না বলে। … সেদিন থেকে অবশ্য আর প্রাণকেষ্টর মুখদর্শন করেননি রত্নেশ্বর! কিন্তু মনের মধ্যে তো ভাবনা ধরছে প্রাণকেষ্টটা হয়তো ভাবছে আমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলাম। …
যাক আজ সব ভাবনার শেষ।
ঝাঁঝাঁ রোদ, নি:শব্দে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে … খোয়াখন্দ রাস্তা, খানা ডোবা, ভাঙা শিবমন্দির, ষষ্ঠীতলা শিবমন্দির, ষষ্ঠীতলা সব পার হয়ে চলেন ভূতনির জঙ্গলের উদ্দেশে! ছেলেবেলায় যেখানে খেলতে যেতেন।
কিন্তু কী রে বাবা! সেই জঙ্গলটা কোথায় উবে গেল? বহুদিন আর এদিকে আসা হয়নি। দেখা হয়নি। দেখা হয়নি, জঙ্গল সব কেটে সাফ। ওইখানে বাড়ি তৈরির তাল হচ্ছে।
অথচ রত্নেশ্বরদের ছেলেবেলায়, এই ‘ভূতনির জঙ্গলের’ মধ্যে ঢুকে পড়লে দিন-দুপুরকে রাত-দুপুর মনে হত। গাছের ছায়ার জন্যে রোদ ঢুকত না। সাপ-খোপও ছিল বিস্তর।… জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে যেত, কাঠুরে গোছের চোরা লোকেরা। যারা আর কী জঙ্গলের কাঠ কেটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত।…
আর ঢুকতে যেত ডানপিটে ছেলেরা।
সেই ছেলেদের দলে রত্নেশ্বর আর প্রাণকেষ্ট ছিলেন নেতা! ওঃ সেকতদিন আগে!
এখন কিনা রত্নেশ্বর সেই জঙ্গলটা খুঁজতে এসেছেন একটা শক্তপোক্ত গাছের সন্ধানে। যার ডালে দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়া যায়। তা গাছ একেবারে নেই, তা অবশ্য নয়। ঘন জঙ্গল না থাকুক তাও গাছ অনেক আছে।…কিন্তু কতরকম যে অসুবিধে! বৃহৎ বৃহৎগাছগুলোর শাখাপ্রশাখাগুলো এত উঁচুতে যে, হাতের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে দড়ির ফাঁস লাগাবেন কী করে? আবার যে গাছগুলোকে হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে, তার ডালপালার ওপর বিশ্বাস হচ্ছে না। ঝুলে পড়তে গিয়ে মট করে ভেঙে পড়লে? শরীরখানি কম ওজনদার নয় রত্নেশ্বরের! ভেঙে পড়লে কী হতে পারে তাই ভেবেই হাত-পা এগোয় না রত্নেশ্বরের। কী আশ্চর্য! সামান্য একটা শক্তপোক্ত গাছের ডালের অভাবে রত্নেশ্বরের সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে? প্রাণকেষ্টটার কাছে মুখ থাকবে না?
হঠাৎ পায়ের কাছ দিয়ে কী যেন সরসরিয়ে সরে গেল। রত্নেশ্বর ভয়ে সিঁটিয়ে উঠলেন। সর্বনাশ! সাপ নয় তো? নাকি বেজি-টেজি? সাপই হতে পারে। কেমন সড়াৎ করে সরে গেল! … উঃ ভগবান খুব রক্ষে করেছেন।…
সাবধানে পা টিপে টিপে আর একটু এগোলেন! সামনে একটা মনের মতো গাছ দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে। বোধ হয় জাম, গাছ। নীচের দিকের একটা ডালে পা দিয়ে উঠতে পারলেই, আর হাত বাড়িয়ে দড়িটাকে ছুড়ে দিতে পারলেই—
কিন্তু ফাঁসটা লাগানো যাবে কীভাবে? সিনেমার ছবিতে দেখেছেন বটে ফাঁসির দড়ি গোল হয়ে দুলছে। কিন্তু কোনখানটায় প্যাঁচ মারতে হয়?
বারবার দড়িটা ছোড়েন আর ফসকে নেমে আসে, ডালের গোড়ায় আটকায় না!
হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ কে একটা বলে উঠল, ‘এ কী? এখেনে কে?’… কী বিচ্ছিরি ভাঙা ভাঙা গলা!
চমকে ঘাড় ফিরোতেই ভয়ে কাঁটা দিয়ে এল রত্নেশ্বরের। ডাকাত-ফাকাত নয় তো? কী চেহারা রে বাবা! কালো মিশমিশে রং! ঝাঁকড়া ঝঁকড়া চুল, পরনে শুধু একটা গিঁটবাঁধা ছেঁড়া লুঙ্গি, বাস আর কিছু না। … না কিছু আছে।
হাতে একখানা কুড়ুল। রত্নেশ্বর ‘রত্নেশ্বরে’ নেই। একবার তাকিয়েই আর তাকাতে পারেন না।
আর লোকটা কী দেখল?
দেখল গাওয়া ঘিয়ের মতো রঙের এক ভারী-সারী চেহারার বুড়োবাবু। চেহারার কী জেল্লা। আর সাজেরও। পরনে ফর্সা ধবেধবে মিহি ধুতি, গায়ে তেমনি ফর্সা মিহি পাঞ্জাবি, পায়ে জুতো। মাথার মাঝখানে বেশ খানিকটা টাক থাকলেও দু-পাশে চুল আছে। পাকা হলেও বাহার আছে। ডানহাতের পাঁচটা আঙুলের মধ্যে তিনটে আঙুলের ঝলমলে ঝকঝকে আংটি। তা ঝলমলে ঝকঝকে তো হবেই, একটা তো রত্নেশ্বরের বিয়ের সময়কার হিরের আংটি। বড়োলোক শ্বশুর একটি দামি হিরের আংটি দিয়েছিলেন একমাত্র জামাইকে। …আর একটা হচ্ছে পলার আংটি, স্বাস্থ্য ভালো রাখবার। আর বাকিটা ভাগ্য ভালো হওয়ার, গাঢ় সবুজ পান্নার। কিন্তু এসব তো আর রত্নেশ্বরের সাজগোজের ব্যাপার নয়। আর দড়ি সঙ্গে নিয়ে গাছ খুঁজে বেড়াবার সময় সাজবার কথাও নয়। এ তো রত্নেশ্বরের সর্বদার পোশাক। … মিহি ছাড়া ধুতি পাঞ্জাবি নেই তাঁর ! আর ফর্সা ছাড়া ময়লা পরেনও না। আংটিরা তো আঙুলেই থাকবার।
তবে লোকটা ভাবল, এ কোনো রাজাবাবুই হয়তো। তাই হাঁ করে চেয়ে দেখতে থাকে।
ওর ওই হাঁ করা ভাব দেখে রত্নেশ্বরের ভয় একটু কমে। বলেন, তুই কে? কী করছিস এখানে?
আজ্ঞে বাবু, আমি তো জগা! জগা মন্ডল। এই একটু কাঠকুটো কুড়োতে আসি এখানে। …কিন্তুক আপনি রাজা হেন ব্যক্তি, এখানে কী করছেন?
লোকটা কুড়ুল নামিয়ে দু-হাত কচলাতে থাকে।
রত্নেশ্বর মেজাজ ফিরে পান। বলে ওঠেন, কী করছি, তা জানবার তোর দরকার কী রে? যা যা, তোর নিজের কাজে যা।
উঃ। সামান্য একটু গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার এত বিঘ্ন, এত বাধা! অথচ শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে লোক করছে কাজটা!
লোকটা কিন্তু নড়বার নাম করে না।
বেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে রত্নেশ্বরকে দেখতে থাকে। ওই বড়োলোক মতো বুড়োটাকে কি এখানে দেখেছে কোনোদিন? কই? মনে তো পড়ছে না।
রত্নেশ্বরের বুকের মধ্যেটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে! গলা শুকিয়ে ওঠে। লোকটার মতলবখানা কী? ভালো ঠেকছে না তো? আশপাশে কেউ কোথাও নেই! চেঁচিয়ে মরলেও কারও কানে যাবে না। হাতের ওই কুড়ুলখানা উঁচিয়ে ঘাড়ের ওপর এক ঘা বসিয়ে দিলেই তো দফা গয়া।
হায় হায়! এদিকে-ওদিকে কত তো গাছ ছিল, কোন দুর্মতিতে এই ভূতনির জঙ্গলে ঢুকতে এলেন তিনি।
তবু রত্নেশ্বর ঠাণ্ডা বুক গরম করবার, আর শুকনো গলায় জল আনবার চেষ্টা করতে করতে প্রাণপণে বলে ওঠেন, কী দেখছিস হাঁ করে?
লোকটা একগাল হেসে বলে, আজ্ঞে, দেখতেচি বাবুমশাই ওই পেল্লায় দড়িখান নিয়ে লটপটাচ্চে ক্যানো?
সেরেছে। লোকটা রত্নেশ্বরের অভিসন্ধি বুঝে ফেলছে না তো? তবু মুখের জোর দেখান, ‘ক্যানো’ তা তোর জেনে কী হবে শুনি?
আজ্ঞে হবে আর কী! তবে দিশ্যটা নতুন তো! এ জঙ্গলে তো নিত্য আসি, তো আর কখনো তো কোনো বাবু ভদ্দরলোককে দড়ি এনে গাছের ডালে ফাঁস লাগাবার চেষ্টা করতে তো দেকি নাই।
রত্নেশ্বরের হাত পা ছেড়ে আসে। তবু বলেন, দেখিস নাই দেখলি। এখন যা।
যাব ত বটেক। বেলা পড়ে এয়েছে, সাপখোপ বেরোতে পারেন। তো কাজটা কী হতেচে সেইটাই জানতে ইচ্ছে!
রত্নেশ্বর হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলিয়ে বলে ওঠেন, দোলনা বানাচ্ছি! ছেলেবেলার মতো দুলব।
লোকটা আরও একগাল হাসে। সম্পূর্ণ অবিশ্বাসের হাসি। কিন্তু কী বিচ্ছিরি হাসি রে বাবা! মানুষ এত দাঁতাল হয়? …কালো কুচকুটে মুখে সাদা মুলোর মতো দাঁতগুলো যেন খিঁচিয়ে ওঠে। সেই হাসি হেসে লোকটা বলে, আহা। দড়িটা কী জম্পেস! এ তল্লাটে এমন দড়ি মিলবেনি। কলকেতার বাজার থে কেনা বুজি?
তোমার অত খোঁজে দরকার কী বাপু? কিনতে যাবে?
লোকটা আধহাত জিভ কেটে ওঠে, কী যে কন বাবুমশাই। আমার সেই সাদ্যি? …তো বড্ড খাসা দড়ি তো! তাই দেকেও সুক!
আরও কাছে এসে, মাটিতে লুটিয়ে থাকা দড়ির আগাটায় সাবধানে একটু হাত বুলিয়ে বলে, তো বাবুমশাই, আপনার ওই দোল খাবার দোলনাটা টাঙাতে কী এতখানির সবটা লাগবে? কিচু বাঁচবেনি? মন নিচ্চে বাঁচতি পারে! তাই বলতেচি—
রত্নেশ্বর মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, মন নিচ্ছে! কী করে মন নিচ্ছে শুনি? আমি কীরকম দোলনা টাঙাতে চাই তুই জেনে বসে আছিস?
লোকটা এবার একগাল নয় একদাঁতের হাসি হেসে বলে, তা আজ্ঞে অনুমানে জেনে যাচ্চি আর কী …তো বাবুমশাই বলতেচি, সেই বাড়তি খানিকটা যদি গরিবকে বিতরণ করেন তো ওই কাটের বোঝাটা বেঁধে নে যাই! আজ এত কাট জমেচে এই গামছার বাঁধনে কুলাবে বলে মনে হচ্ছে না। সেই থেকেই তাই আপনারে নজরে রেকেচি।
সেই থেকে নজরে রেখেছি!
তার মানে রত্নেশ্বরের সব কিছু ফাঁস হয়েই গেছে। রত্নেশ্বর কাঁপা গলায় বলেন, তো খানিকটা দেব কী করে শুনি? টেনে ছেঁড়া যাবে?
কী কন কত্তা! এই দড়ি টেনে ছেঁড়বে? ভামের বাবারও সাদ্যি নাই। এ হলগে বিলাইতি লাইলন দড়ি। হাতি বেঁদে ঝুইলে দেলেও ছেঁড়বে না। …তো বাবুমশাই— এই কুড়ালখানায় ঘষে একটুক কাটতে পারে।
রত্নেশ্বর আর পারেন না। ধুলোর ওপরই বসে পড়ে বলেন, তো যা পারো করো!
লোকটা আহ্লাদে ভাসা মুখে দড়িটার একদিকটা তুলে কুড়ুলে একটু ঘষে নিয়ে বলে হবেক নাই। কুড়ালখানার ধার গেচে।
তবে আর কী কেটে পড়ো। দেখছ তো বেলা পড়ে আসছে। কিন্তু কেটে পড়ার লক্ষণ কোথায় লোকটার?
কুড়ুল নামিয়ে রেখে হাত দুটো কচলাতে কচলাতে বলে, বাবুমশাই আজ্ঞে, একখান কতা বলব? ছোটোমুকে বড়ো কতা বললে রাগ করবেন না তো!
ভণিতা রাখো। কী বলবে বলো?
বলতেচি, বাবু কি সাঁতার জানেন?
সাঁতার! এ আবার কি ধান ভানতে শিবের গীত?
রত্নেশ্বর বলে ওঠেন, হঠাৎ সাঁতারের কথা যে?
আজ্ঞে শুদোচ্চি অ্যাকটা কারণে।
আমার এই ওজনদার দেহটা দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে সাঁতার জানি?
লোকটা যখন কুড়ুলখানা এত কাছে এনেও, ঘাড়ে কোপ মেরে বসল না, ‘তখন ভয়টা একটু কেটে গেছে। তাই রত্নেশ্বর একটু সহজভাবে বলেন, না বাবু জানি না। ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে ছিলাম বটে, তবে আমার পিসির মাথার দিব্যি ছিল জলে নামায়।
তবে তো বেবস্তা হয়েই গেল। বলছিলুম কী এমন একখান সোন্দর দড়ি বেরথা অপোচয় করে, গলায় ফাঁস নাগিয়ে হাঁস-ফাঁসিয়ে মরণের থে, মা গঙ্গার কোলে টুপ করে তইলে গেলেই তো কাজ মিটে যায়! সাঁতার যখন জানেন না, তইলে যেতে কতক্ষণ?
অ্যাঁ। কী বললি? আমি গলায় ফাঁস লাগাতে এসেছি?
জানলি কীভাবে? তুই কে রে ব্যাটা? ভূত না ভগবান?
আজ্ঞে কেউ না! তবে অ্যাতকাল পিথিমীতে চরে বেড়াচ্চি জ্ঞানগম্যি তো হয়েচে একটু। এই বয়েসে কি আর কেউ পাড়া ছেড়ে ভেন্ন পাড়ায় এসে, দোলদোল দুলুনি খেতে আসে? একবার ঝুলে পড়ে দুলতে থাকে। … তো বুজেচি, সোমসারে বীতরাগ ঘটেচে। তো আমি বলি কী ওই দোলের থে মা গঙ্গার কোলই ভালো। … উপরি লাভ এমন সোন্দর দড়িখান বেঁচে যাচ্চে।…
রত্নেশ্বর মনে ভেবে দেখেন, লোকটার কথাটা মন্দ নয়।
সত্যিই ফাঁস লাগাবার চেষ্টাতেই তো যা হাঁসফাঁসানি আসছিল। উদারভাবে বলেন, তো বাঁচলেও আমার আর কী কাজে লাগবে? তোমার যদি ইচ্ছে হয় নিয়ে যেতে পারো।
অ্যঁ। কী বললেন? যদি ইচ্চে হয়? সেই ইচ্চেতেই তো এখেন থেকে নড়তে পারচিনে।… তো এটাই বা আপনার কোন কাজে লাগবে?
বলে পাশে ফেলে রাখা সাইডব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে, দড়িটাকে বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে তারমধ্যে ভরে ফেলে কাঁধে ঝুলিয়ে রত্নেশ্বরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, সরে গিয়ে ছেঁড়া গামছাখানা দিয়েই কাঠের বোঝাটা বেঁধে নিয়ে মাথায় তুলে বলে, তো এই বেলায়ই জঙ্গল থে বেইরে পড়ুন বাবু । আঁদার নামলে দিশে খুঁজে পাবেন না। একটুক রাত হলে উই শালিমার ঘাটটা পেইরে খানিকটা হাঁটা মেরে একটা আঘাটায় নেমে পড়বেন। জনমনিষ্যি টের পাবে না। …
হনহন করে হেঁটে জঙ্গল পার হয়ে যায় লোকটা।
রত্নেশ্বর প্রায় হতভম্বের মতো তাকিয়ে বসে থাকেন।
বেশ কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ায় প্রাণকেষ্ট পালিত একটু নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন, রগচটা লোকটার রাগ পড়ে গেছে ভেবে। …কিন্তু হঠাৎই শুনলেন, রত্নেশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
না।
কখন থেকে?
শেষ দেখা গিয়েছিল মঙ্গলবার দুপুরে খাওয়ার সময়। …ঘণ্টু তো ছিল না, সেপ্রায়ই দুপুরে জেঠুর সঙ্গে খায়। বেকার তো, সকালে সাত তাড়াতাড়ি খাবার দরকার নেই। তো সেতো ফুটবল খেলতে কাঁচরাপাড়ায় গেছে। …বড়োবউমাও বাড়ি নেই, বাপের বাড়ি গেছেন।
থাকতে ছোটোবউমা আর বামুন ঠাকুর। তো কেউ তো কোনো বৈলক্ষণ দেখেনি। দিব্যি রেলিশ করে খেয়েছেন। এমনকী কাঁচা আম দিয়ে মৌরলামাছের অম্বল দুবার চেয়ে খেয়েছেন তারিফ করে। …তারপর ঘরে শুতে গেছেন।
বিকেল থেকে দেখা যাচ্ছে হাওয়া। নাতি-নাতনিরা স্কুল থেকে এসে আর দেখতে পাচ্ছে না। তদবধি গোরু খোঁজা করে খোঁজা হচ্ছে তাঁকে। যারা বাড়িতে ছিল তারা বকুনি খেয়ে খেয়ে ক্রমে প্রায় কাঁদতে বসেছে, যারা বাড়িতে ছিল না, তারা ফিরে এসে কপাল চাপড়াচ্ছে। … আর দশবার করে প্রাণকেষ্টর বাড়িতেই খোঁজ করছে ওখানে গেছেন কি না।
প্রাণকেষ্ট এখন মনের দুঃখে মনে মনে কপাল চাপড়াচ্ছেন। হায়! হায়! তিনি কেন এই ক-দিন নিশ্চিন্দি ছিলেন? …সেনা হয় রাগ করে বলে গিয়েছিল ‘জীবনে আর মুখদর্শন করব না।’
প্রাণকেষ্ট তো আর তেমন প্রতিজ্ঞা করেননি? …মজা দেখবার জন্যে— ওই উকিল-টুকিলের কথা না বললেই হত! চিরকেলে রগচটা আর এক বগগা, জানেনই তো। …কিন্তু এখন আর লোকসমাজে সেদিনের মজার গল্পটা করা হয় না। সেই ঘুমের বড়ি-কাহিনি। মজাটা তো এখন ঠিক মজা রইল না।
তার মানে, প্রাণকেষ্টর পরামর্শই নিয়েছে শেষপর্যন্ত। নিরুদ্দেশই হয়ে গেছে। তবে সন্ধানে জানা যাচ্ছে একবস্ত্রেই গেছে। …ঘণ্টু মারফত জানা গেছে— এমনকী টুথপেস্ট টুথব্রাশ শেভিংসেট চিরুনি তোয়ালে পর্যন্ত কিচ্ছু সঙ্গে নেননি।
টাকা?
তা সেআর কে জানে? নিয়েছেন কী নেননি, বাড়িতে ছিল কি না, বা কত ছিল, সেআর কার জানা?
তবে নিরুদ্দেশ ছাড়া আর কী?
প্রাণকেষ্ট মনে মনে ঠাকুরের নাম জপেন আর ভাবেন, অন্য কিছু হলে, মানে ওর ভাষায় সেই ‘সাত হাত জিভ বার করা’ দৃশ্যটা হলে কোনোখানে না কোনোখানে দৃশ্যমান হত।…
ভরদুপুরে বেরিয়েছিলেন নিশ্চয়। কিন্তু ছাতাটাও তো নেননি। নাতি-নাতনিরা হাউহাউ করে কান্না লাগিয়ে চলেছে।
পরদিন কেউ স্কুলে যায়নি। ছেলেরাও অফিস যায়নি। বউমারা কুটনো কোটেননি, রান্নাবান্নার দিকে যাননি। শুধু হা-হুতাশ করে চলেছেন, কেন মরতে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম।… কেন অমন অজ্ঞান হয়ে দিবানিদ্রা দিয়েছিলাম।
ওদিকে ঘণ্টু আর ছেলেরা খবরের কাগজের অফিসে আর দূরদর্শনের অফিসে লালবাজার আর ভবানীভবনে ছুটোছুটি করে চষে বেড়াচ্ছে। …দুদিনেই যেন দশদিন।… তিনদিনে—তিন মাস।
আর প্রাণকেষ্ট?
তিনি ভাবছেন হতভাগাটার ওপর শোধ নিতে তিনিও কি তাহলে যেদিকে দু-চক্ষু যায়, সেদিকে চলে যাবেন?
উঃ কী ভুলই হয়েছে সেদিন, ওর ওই স্থির সংকল্পের কথা চুপিচুপি ওর বাড়ির লোকদের না জানিয়ে দেওয়া। …তাহলে সবাই বেশি সতর্ক থাকত। কিন্তু এখন তো সেকথা বলতে যাওয়া যায় না। বলবে কী তারা?
আসলে প্রাণকেষ্ট সেদিন রত্নেশ্বরের ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেননি। ভেবেছেন ও তো চিরকালই ওইরকম রগচটা।
একটু পরেই রাগটা থিতিয়ে যায় … তা বলে সত্যি সত্যি যে একটা কান্ড করবে, কে বুঝেছে? এখন প্রাণকেষ্টর নিজের প্রাণের মধ্যে তো হাহাকার হচ্ছেই, আবার রত্নেশ্বরদের বাড়ির লোকের কথা ভেবে নিজেকে যত দোষের মূল ভেবে যন্ত্রণা হচ্ছে।
যত শুনছেন কোনোখান থেকে কোনো খবরও পাওয়া যাচ্ছে না,ততই কষ্ট বাড়ছে। … দেখতে দেখতে তিন-চারটে দিন কেটে গেল, নো পাত্তা!
প্রাণকেষ্ট না-নাওয়া না-খাওয়া অবিরত শুধু ভেবেই চলেছেন। …কেন মরতে আমি লজেন্সগুলো ওর হাতে দিয়ে দিলাম না। দিলে তো অত রেগে উঠত না। …নিয়ে যেত হাস্যবদনে। পরে কাজ হল না দেখে বলতে পারতুম ‘কী করে জানব ভাই ভেজাল জিনিস গছিয়েছে।’ …তো অবিশ্বাসের কিছু ছিল না। আজকাল তো সবেতেই ভেজাল। রোগের ওষুধে যদি ভেজাল থাকে, তো ঘুমের ওষুধেই বা থাকবে না কেন? …তা হল না। কী কুক্ষণেই আমি মজা করতে গেলুম। কী কুক্ষণে নিরুদ্দেশের নির্দেশ দিতে গেলুম।…
ভাবতে ভাবতে প্রাণকেষ্টর মাথায় যে ক-টা চুল কাঁচা ছিল, সবই এই ক-দিনে পেকে ভূত হয়ে গেল!…
প্রাণকেষ্টর গিন্নি কর্তার অবস্থা দেখে সাহস করে আর ভাত বেড়ে খেতে ডাকতে পারেন না। সারাদিন শুধু ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা সাপ্লাই করে চলেন। …তবু তো পেটে একটু দুধ চিনি পড়বে।
তো প্রাণকেষ্টর অনুশোচনাটা যে নেহাত অমূলক, তা বলা যায় না। …রগচটা রত্নেশ্বরের রাগ-টাগ পড়েও যায়। …তা নইলে—সবসময় নিজেকে অপমানিত অবহেলিত ভাবতে থাকলেও আর মৃত্যুসংকল্পে দৃঢ় হলেও, দিব্যি আবার বাজারে গিয়ে বড়ো বড়ো গলদা চিংড়ি ইয়া ইয়া ডিমভরা ট্যাংরা, লাফাই- ঝাপাই করা কইমাছ কিনে এনে, বউমাদের ডেকে বলেন কী করে, ‘বউমা এইটা বেশ তেলঝাল দিয়ে রাঁধতে দাও, ওইটা নারকেলবাটা দিয়ে রাঁধতে দাও। …কইমাছটা যদি তুমি একটু নিজে হাতে রাঁধো বউমা, বড়ো ভালো হয়, ঠাকুর কি আর তেমন পারবে?’
কিন্তু—এবারে ব্যাপারটার মোড় ঘুরে গেছে। বন্ধুর ওপর রাগে দিশেহারা হয়ে—তার কাছে যে তেজটি দেখিয়ে বসেছিলেন রত্নেশ্বর, সেইটিই তাঁকে জব্দ করে বসেছিল। … মরাটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল! … ‘প্রাণকেষ্টটা ভাববে আমি পিছিয়ে গেছি।’… তা ছাড়া সেই কথাটা বুকের মধ্যে গুণছুঁচের মতো বিঁধেছিল না—‘এও ধরো একরম লটারিতে ফার্স্টপ্রাইজ পাওয়া।’… ইস! এই তাঁর চিরকালের বন্ধু!
এই মিলিয়েই রত্নেশ্বর বেঁচে থেকে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।
কী করে জানবেন সেই রত্নেশ্বরের এই হঠাৎ উবে যাওয়ায়—প্রাণকেষ্ট বেঁচে থেকেও মৃত্যুযন্ত্রণা পাচ্ছেন।
তা বলতে গেলে উবে যাওয়াই।
কিংবা বাতাসে উড়ে যাওয়া….
সেই মোক্ষম দিনটায়, দু-তল্লাটের একটা লোকও কি দুপুরবেলা রাস্তায় বেরোয়নি? কেউ তো বলছে না, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ একবার যেন—অমুক জায়গায় দেখেছিলাম। মনে হচ্ছে।’
না: কেউ বলছে না।
কাগজে কাগজে পুরস্কার ঘোষণা করার ব্যবস্থা করে এসে বড়োছেলে ছোটোছেলে দুই ভাই বাড়ি ফিরে হতাশভাবে বলাবলি করে, ‘আচ্ছা দাদা, দশহাজার টাকা নেহাত কম হয়ে গেল? টাকা তো আজকাল খোলামকুচি। ওই সামান্য টাকাটা কি লোকে গ্রাহ্য করে একটু খোঁজাখুঁজি করবে?’ …ঘন্টু শুনতে পেয়ে নাক কুঁচকে বলে, ‘কী? মাত্তর দশহাজার লিখে এসেছ বড়দা? বলিহারি!! জেঠুর দাম তাহলে মোটে দশহাজার? ওর বেশি আর উঠতে পারলে না? ছ্যা ছ্যা।’…
শুনে বড়দা ছোড়দা দুজনে মরমে মরে যায়।
সত্যি খুব কমই বলা হয়ে গেছে! কিন্তু এখন তো বোধ হয় —ছাপা হতে চলে গেছে।
রত্নেশ্বরের ছোটোভাই পরমেশ্বর কাতরভাবে বলে, শুধু নিরুদ্দেশের খবর আর পুরস্কার ঘোষণা? এরকম একটা চিঠি ছাপতে দিয়ে এলি না তোরা—‘বাবা তুমি যেখানেই থাকো, চলে এসো। আমরা বাড়িসুদ্ধ সকলেই মৃতুশয্যায়।’
ইস। সেরকম তো কই লেখা হয়নি। লেখা উচিত ছিল।
সত্যি খুব ভুল হয়ে গেছে।
শুধু ভুল হয়ে গেছে বলে থেমে গেলে তো হবে না। ভুলটা সংশোধন করতে হবে! ঠিক আছে, আমিই আলাদা ‘জরুরি’ বলে একটা চিঠি ছাপতে দিয়ে আসি, ‘দাদা যেখানেই থাক—’ বলে !
কিন্তু ‘বাড়িসুদ্ধ সবাই মৃত্যুশয্যায়—’ এটা শুনতে একটু অবাস্তব লাগবে না?
অবাস্তব? চমৎকার। খোদ বাড়ির হেড আজ সাড়ে তিন-দিন নিখোঁজ , আর বাড়িসুদ্ধ সবাই সুখশয্যায়, এটাই বুঝি খুব বাস্তব হল?
পিণ্টু এসে বলে, ফোটোটা একটু স্পেশাল কেয়ার নিয়ে ছাপতে বলা হয়েছিল?
স্পেশাল কেয়ার? কই না তো? তা তো কই—
জানি তোমাদের ওইরকম ভুলো মন। ছবিটা দেখে মানুষের না বনমানুষের সেটা তো অন্তত বোঝা দরকার। খবরের কাগজের প্রিন্ট—
এদের কথার মধ্যে হঠাৎ ‘কাজের মেয়ে’ ঝরনা এসে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে বলে ওঠে, আপনাদের ওসবে—কিচ্ছুটা হবে না গো! …দাদুরে আর পাওয়া যাবে না। দাদুরে ভূতে উইড়ে নিয়ে গেছে।
শুনে সকলে বকে ওঠে, একথার মানে? তুই সব জেনে বসে আছিস? যত সব অপয়া কথা। দাঁড়কাকের ডাক।
ঝরনা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বলে ওঠে, আমি নিজে থেকে বলেছি? … মন্দিরতলায় গুণিন মায়ের কাছে গিয়ে দশ নয়া দিয়ে গোণান করাতে যাই নাই? তিনিই তো বলল, ‘অ্যাকে, মঙ্গলবার, তায়ে আমাবস্যে! তারওপর, আবার ভরদুপুরবেলা। জানিস না —ভরদুপুরবেলা, ভূতে মারে ঠ্যালা—’
তা ওই ঝরনার ‘গুণিনমার’ কথা ভুলই বা বলা যায় কী করে? ভূতে ঠ্যালা মারলেই লোকে সুখে থাকতে ভূতের কিল খেতে যায়। তা নইলে ওই ‘হুজ্জোৎ শিবপুরের’ রায়বাড়ির খোদকর্তা রত্নেশ্বর রায় কিনা এই ভরসন্ধেবেলা ভূতনির জঙ্গলের মাঝখানে ধুলোর ওপর বসে হতভম্ব হয়ে ভেবে লজ্জা পাচ্ছেন, অ্যাঁ, একটা কেলে দাঁতলা মুখ্যু গাঁইয়া লোক কিনা তাঁকে স্রেফ কথার প্যাঁচে বোকা বানিয়ে ‘মা গঙ্গার কোল’ দেখিয়ে অত টাকা দিয়ে কেনা অমন একখানা পেল্লায় লম্বা মজবুত নাইলনের দড়ি, আর প্রায় নতুন শ্রীনিকেতনি সাইডব্যাগটা বাগিয়ে নিয়ে চলে গেল।
রত্নেশ্বর শৌখিন মানুষ, কখনও চটের থলি-টলির মতো বাজে জিনিস ব্যবহার করেন না। তাই বাড়ির যে যখন কোথাও যায়, রত্নেশ্বরের জন্যে শৌখিন জিনিস দেখলেই এনে উপহার দেয়। লোকটার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল রত্নেশ্বরের। তারপর হঠাৎই ভাবলেন যাক গে, ওই জিনিস দুটো আর এখন কী কাজেই বা লাগত! ইচ্ছে করলেই তো লোকটা হাতের কুড়ুলখানা রত্নেশ্বরের ঘাড়ে বসিয়ে জিনিস দুটো কেড়েও নিতে পারত। তাহলে কী অবস্থা হত রত্নেশ্বরের?…
এই ভূতনির জঙ্গলে ধড় মুন্ডু আলাদা হয়ে পড়ে থাকতেন, কেউ দেখতও না।
ও বাবা। সেহিসেবে লোকটাকে ভালোই বলতে হবে। না: লোকটা ভালোই। মহৎই বলা যায়।… মা গঙ্গার বুদ্ধিটাও দিয়ে গেল।
আসলে প্রথমেই লোককে সন্দেহ করা আমাদের একটা রোগ। মোটামুটি বেশিরভাগ লোক ভালোই।
মনটাকে ভালো করে নিয়ে উঠে পড়ে হাঁটতে লাগলেন রত্নেশ্বর। …হাঁটা মারতে মারতে দূর থেকে চোখে পড়ল সন্ধে হতেই শালিমার ঘাটের সব পোস্টগুলোর আলো জ্বলে উঠে যেমন ঝলমলিয়ে ওঠে, তা উঠছে। …চিরপরিচিত জায়গা। যখন অফিসে যাতায়াত করতেন কতদিন এই ঘাট থেকে গঙ্গা পার হয়েছেন। …সঙ্গে পাড়ারই কে যেন থাকত? নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না।… মনে আনবার চেষ্টা করতে থাকেন। …কী যেন , কী যেন। …ততক্ষণে অফিসের কতজনের নাম আর মুখ মনে পড়ে যাচ্ছে! …আহা কী সুখের দিনই ছিল যেসব।…আহা কত বছর রিটায়ার করেছেন রত্নেশ্বর?…হিসেব করতে থাকেন, আটান্ন বছরে তো? না আটান্ন বছর দশমাস।
…ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটে দশমাস বয়স কম লেখানো ছিল। কেন তা ছিল ঠিক মনে পড়ছে না। …মনে পড়াতে হঠাৎ চমকে ওঠেন রত্নেশ্বর। …কী হল? কোনদিকে চলে এসেছেন? …সেই আলোর মালাটালা কখন মিলিয়ে গেছে।…
যেদিকে তাকাচ্ছেন গাঢ় অন্ধকার। … গঙ্গার ধারই বটে, তবে কোন ঘাট? লোকটা অবশ্য বলেছিলে আঘাটা দরকার! কিন্তু সেটা কোনখানের, কোন পাড়ার সেটা না জেনেই গঙ্গায় ঝাঁপ দেবেন? তাও কি হয়? কতক্ষণ হেঁটেছেন রত্নেশ্বর? রাত যেন বেশ গভীর হয়ে উঠেছে মনে হচ্ছে! … কোনদিকে যেন খুব বিচ্ছিরি করে কুকুর ডাকছে!… একটা শেয়ালও যেন ডেকে উঠল…একটার পরই একসঙ্গে অনেকগুলো!
গা ছমছম করে ওঠে রত্নেশ্বরের । কী বেঘোরে জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা! কীসের ঘোরে হাঁটছিলাম?… ধারেকাছে যে, কোনো মানুষের বসতি আছে, তা মনে হচ্ছে না।… থাকলে অন্ধকার জঙ্গল ভেদ করে কোথাও না কোথাও একটু প্রদীপের আলোও চোখে পড়ত। কুঁড়েবাড়িতেও তো কিছু আলো জ্বলে।… রত্নেশ্বরের যেন কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করল! … বুড়ো বয়সে —চিরকালের চেনা জায়গা থেকে কিনা রাস্তা হারিয়ে ফেললাম!…
‘দুরছাই, যেখান থেকেই হোক ঝাঁপই দিই’ ভাবলেও তো সুবিধে হচ্ছে না। পায়ের কাছেই তো গঙ্গা বইছে না। অনেকখানি বালির চড়া। তাও তো ধার থেকে অনেকটা নীচুতে। ঘাটে না হলে নামা যায়? তিনি তো দিব্যি বলে দিলেন আঘাটায় ডুববেন। …বললেই হল। সুবিধে অসুবিধে দেখতে হবে তো?…
হঠাৎ চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল, একখানা ডিঙি নৌকো পড়ে আছে উপুড় হয়ে।…
আরে। তাহলে তো আশেপাশে মানুষ আছেই। এটা হয় খেয়া পারাপারের নৌকো, নয়তো জেলেদের মাছ ধরার নৌকো। ‘গঙ্গার ইলিশ’ ধরবার। … ছেলেবেলায় কতদিন দেখেছেন বাবা কী কাকা নাকে দড়িবাঁধা ইয়া প্রকান্ড একজোড়া গঙ্গার ইলিশ নিয়ে বাড়ি ঢুকছেন আহ্লাদে-ভাসা-গলায় বলতে বলতে ‘পাঁচসিকেয় জোড়া পেয়ে গেলাম, নিয়ে এলাম। সদ্য টাটকা।’ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলেন ওলটানো নৌকোটার কাছে।… আর দেখে চমকে উঠলেন, সেই ওলটানো ডিঙির ওপর বসে আছে অন্ধকার মিশে যাওয়া একটা বুড়ো! মাঝিই খুব সম্ভব। কিন্তু নৌকোটা উলটোনো কেন? ট্যাক্সি-ড্রাইভারের মিটার ডাউন করে রাখার মতো নাকি?
আহা, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যদি একটা টর্চ সঙ্গে নিয়ে বেরোতেন! খুব ভুল হয়ে গেছে। তা বেরিয়েছিলেন তো ভরদুপরে। কী করেই বা জানবেন পরিস্থিতি এমন বদলে যাবে। যাক, ছায়া চাঁদের আলোয় তাকিয়ে দেখেন, নৌকোটা , যেখানে উপুড় করা রয়েছে সেখানটা একটু যেন ঢিবি মতো উঁচু। সাবধানে পায়ে পায়ে এগোতে থাকেন। বিচ্ছিরি এবড়ো-খেবড়ো জায়গা। …আঃ জুতো জোড়াটার বারোটা বেজে গেল। ক-দিনই বা কেনা হয়েছে? …রত্নেশ্বর যে আবার মোটেই চটি ফটফটিয়ে হাঁটতে ভালোবাসেন না। রাস্তায় বেরোলেই সাবেকি নিউকাট। একটু এগিয়ে আসতেই দেখেন সেই বুড়োটাও তার রাজাসন ছেড়ে নেমে আসছে। হেঁটে আসছে। হেঁটে আসছে, না ভেসে আসছে? কেমন যেন সরসরিয়ে সরে এল। রত্নেশ্বরের গাটা ছমছম করে উঠল, কী রে বাবা, কোনো খারাপ মতলব নেই তো? তা ভয়ের সময় কথা কইলে একটু ভয় ভাঙে, তাই রত্নেশ্বর ডাক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী মাঝি সাহেব, নৌকো উলটানো কেন?’
রত্নেশ্বর জানেন এই মাঝি-টাঝিরা অনেকে মুসলমান হয়, এদের ডাকতে সাহেব বলা ভালো। খুশি হয়।
লোকটার অবশ্য খুশি-অখুশি কিছু বোঝা গেল না। নির্লিপ্তভাবে বলল, আজ্ঞে কত্তা, ভাঙা নৌকো!
ভাঙা! তাহলে নৌকো নিয়ে অন্ধকারে একা বসে আছ যে?
আজ্ঞে আমাদের আবার একা-দোকা। আমাদের আবার আলো আঁদার। তো আপনি এমন সময় এখেনে কেন?
দরকার আছে।
খেয়া পার হতে এয়েছেন? তো এখানে তো ঘাটও নাই নৌকোও নাই, আঘাটা!
আঘাটা! বা সেটাই তো দরকার রত্নেশ্বরের।
বললেন, আমার খেয়া পারের দরকার নেই। জলে নামার দরকার।
এই রেতের বেলা জলে নামা দরকার? কন কী কত্তা? কোনো আত্মবন্ধুর মড়া পুড়িয়ে আলেন বুজি। তাই গঙ্গায় অ্যাকটা ডুব দে নেবেন?
‘আত্মবন্ধুর মড়া’। কথাটা শুনেই রাগে মাথাটা জ্বলে ওঠে রত্নেশ্বরের। একেই তো পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে। সেই কোনকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন, আর এখন কোন রাত নটা-দশটা। ঘড়িটা তো নেই হাতে। তবে সেই কখন সন্ধে হয়েছে, আর কতক্ষণ হেঁটেছেন তার ঠিক নেই। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে দু-প্রস্থ খাওয়া হয়ে যেত আর তৃতীয় প্রস্থ অর্থাৎ ‘ডিনার’- এর আয়োজন হত। দুপুরে দিবানিদ্রাটি সেরে উঠেই তো একপ্রস্থ ফল শরবত ছানা মিষ্টি! দ্বিতীয় প্রস্থে চা বিস্কুট এবং তাঁর প্রিয় বাড়ির তৈরি বেগুনি আলুর চপ কী নিমকি! …তারপর তো আবার পার্কের বেঞ্চে বসে হজমিগুলি! প্রাণকেষ্টর সঙ্গে সেই চটাচটির পর বশ্য ক-টা দিন সেটা বন্ধ ছিল।
‘পৈটিক’ অবস্থা এই, মানসিক অবস্থাও খুব খারাপ! তারপর এত হাঁটাহাঁটি! এর ওপর কিনা বুড়োটার অমন যাচ্ছেতাই কথা!
রত্নেশ্বর খেঁকিয়ে উঠে বলেন, তুমি তো আচ্ছা বে-আক্কেলে লোক হে! ফট করে এমন একটা অপয়া কথা বলে ফেললে?… বুড়ো হয়ে মরতে চলেছ, একটা আক্কেল নেই?
লোকটা কিন্তু এই খিঁচুনিতে রেগে না উঠে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হসে উঠে বলে, এজ্ঞে কত্তা বুড়ো হলে তো আক্কেল বুদ্ধি হরেই যায়। তো মরতে তো আমি যাচ্চি না, যাচ্ছেন তো আপনি!
রত্নেশ্বর এখন আবার চমকাল।
এই সেরেছে। এ লোকটাও রত্নেশ্বরের মতলবটা বুঝে ফেলেছে!
তবু রেগে রেগে বলেন, মরতে চলেছি, একথাটি তোমায় কে বলতে গেল শুনি?
এজ্ঞে কর্তা অনুমানে। বয়েস হওয়ার এই এক দোষ, সবই অনুমানে, বুজে যাওয়া যায়। তো তাহলে বুঝি মরতে নয়, সাতারখেলা খেলতে জলে নামতে এয়েছেন? তো যান খেলুন গে।
ওঃ ওই কেলে কুচ্ছিৎ হাড় শুঁটকো বুড়োটা রত্নেশ্বরের সঙ্গে ঠাট্টা করছে। কী সাহস!… রত্নেশ্বর মনে মনে জ্বলে উঠলেও ভাবেন, মরুক গে। আমি তো এখুনিই ফুরিয়ে যাচ্ছি। ক্ষমাই করে দিই।
ক্ষমা করে ফেলে গম্ভীরভাবে বলেন, তোমার অনুমান ঠিকই। মরতেই যাচ্ছি। তবে একটা অসুবিধেয় পড়ে গেছি। পাড়টা এত উঁচুতে, যে ঝাঁপ দিতে পারা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। চড়ায় নামতে গিয়ে বালিতে পা ঘষটে পড়ে যেতে পারি, তাই ভাবছি—
লোকটার সেই হাসি!
অন্ধকারে মুখ-চোখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু একটা ছায়ামূর্তির মতো। তার মধ্যে থেকে এরকম খ্যাঁকখেঁকে হাসি। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।… লোকটা হেসে উঠে বলে, ধুস! এ আবার একটা সমিস্যে? আমি একখান ধাক্কা মেরে দিলেই তো কাজ মিটে গেল। সাঁতার জানেন?
না। তবে আর কী! এদিকে আসুন, এখেনে আসুন, এখেন থেকে ঠ্যালা মারার সুবিদে হবে!
সাঁড়াশির মতো আঙুলে লোকটা রত্নেশ্বরের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে পাড়ের ধারের দিকে সরে এল। … আর তারপরই- বলে উঠল, অ্যাকটা কথা কইব কত্তা?
একটা কেন? একশোটাই তো কইছ। আবার একটার জন্যে পারমিশন কীসের?
না মানে কইতেছিলুম কী—যাচ্ছেন তো মা গঙ্গার কোলে —আত্মবিসর্জন দিতে। তো এই ফুরফুরে জামা লম্বাকোঁচা ধুতি আর পায়ের পামশু জুতো জোড়াদেরও শুদুমুদু বেসজ্জন দেওয়া কেন? খুলে থুয়ে জলে নামলে, কোনো গরিবের কাজে লাগতে পারে। আণ্ডারপ্যান্টটুকু পরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
রত্নেশ্বর লোকটার নির্লজ্জতায় অবাক হন। একটা লোক মনের দুঃখে মরতে যাচ্ছে, তা দেখেও চেষ্টা চলছে কিছু বাগিয়ে নিই।… ইস। ঠিক আছে, নে।
গঙ্গায় নাইতে নামার সময় লোকে যেমন সঙ্গের লোকের হাতে সব খুলে ধরিয়ে দেয়, সেইভাবে একে একে ধুতি পাঞ্জাবি গেঞ্জি সব দিয়ে , রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠেন রত্নেশ্বর, হয়েছে? পাঞ্জাবির পকেটে কিছু টাকাও আছে, নিয়ে নিয়ো। আর পারা যাচ্ছে না। এখন দয়া করে—ঠ্যালাটা মার দিকি বাপু! তুমিও বাঁচো, আমিও বাঁচি!
আমার আবার বাঁচন মরণ! আমার তো আজ্ঞে বাঁচনও যা মরণও তা। তো আসুন আর একটু সরে—
বলার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ কড় কড় করে একটা মেঘ ডাকে, বিদ্যুৎ ঝলসায়। … আর লোকটা প্রায় চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আরেব বাস!
কত্তার অঙ্গুলিতে ও কী ঝকমকাল?
কী আবার? আংটি!
অ্যাঁ, হিরে-মুক্তো নাকি?
রত্নেশ্বরের মনের মধ্যে একটু গর্বিত ভাব আসে। বলে ওঠেন, মুক্তো নয়, হিরে পান্না পলা।
কত্তা গো, অ্যাকটায় যেন বিদ্যুৎ ঝলসাল।
হুঁ। আসল হিরে। বিয়ের সময় আমার শ্বশুর দিয়েছিল।
খুব বড়োলোক ছিল তো।
কথাটা বলে বেশ সুখ সুখ ভাব এল রত্নেশ্বরের। বলেন, অন্য দুটোও কম দামি নয়!
কত্তা! ভয়ে বলব, না নিভ্যয়ে?
কী হে! আবার কী?
বলতেচি—তালে এই দামি দামি জিনিসগুলোও আপনার সাতে বেসজ্জন যায় কেন?…ও ক-টাও যদি খুলে আমাদের দিয়ে দ্যান, তো বেচে আমার ভাঙা নৌকোখানা সারাই করে নিই।
অভাবের জ্বালায় হতেচে না তো!
বটে! বটে! এত লুভিষ্টে বুড়ো। তাক করে বসে আছে, আরও কী বাগাতে পারে। ওনার ভাঙা নৌকোখানা সারিয়ে নিয়ে আবার কাজে নামবেন। খুব রেগে বলে ওঠেন, বুড়ো তোর বয়স কত রে?
বয়েস। আমার? হ্যা হ্যা হ্যা। তার কি গাচ-পাতর আছে? না হিসেব আচে? ক্যানো আমার বয়েস জেনে কী হবে কত্তা?
বলছি— এখনও তোমার এত লোভ?
লোকটা অম্লান বদনে বলে, সেআমার মনিষ্যি ধম্মো! কতাতেই তো আছে ‘স্বভাব যায় না মলে!’ …নচেৎ আপনিও তো মরতে সংকল্প, তবু দামি জিনিসে মায়া। …অঙ্গুলি থেকে আর খুলতে মন যাইছে না।
কী ! বুড়োর এত লম্বা কথা?
রাগে গনগন করতে করতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আঙুল থেকে আংটি তিনটি খুলে বুড়োর হাতে দিয়ে দেন। বুকটাও পেঁচিয়ে মুচড়ে ওঠে। উঃ কতকাল ধরে রত্নেশ্বরের অঙ্গে লেগে ছিল এরা।
ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর একবার বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল বুড়োর মুখেও হাসির বিদ্যুৎ!
এ অতিউত্তম বেবস্তা হল কত্তা!… এই সুব্ধু জলে ডুবলে —কী হত ভাবেন? জলে ডুবে পেটের মধ্যে কলসি কলসি গঙ্গাজল ঢুকে পড়ে পেট ফুলে ঢাউস হয়ে য্যাখন ‘লাশ’ হয়ে ভেসে উটতেন কত্তা, ত্যাখন আঙুলগুলানও তো চাঁপাকলা হেন হয়ে উটত! ওই অঙ্গুরি আর পেঁইচে খোলা যেতনি। তো যাদের হাতে পড়তেন, তারা কি আর মায়া মমতা করে ছেড়ে দিত? আঙুলগুলানে কোপ মেরে কেটে বার করে নিত।… আহা! সেকী যন্তোন্না ভাবুন? এটা ভালো হল। আপনারও আঙুলগুলান আস্ত থাকবে। আমারও ভাঙা নৌকোখান সারাই হয়ে যাবে।
উঃ। বুড়োর কথাগুলো কী বদ।
রত্নেশ্বর শুনতে শুনতে বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি বুঝেছি। এখন শেষ ভালোটি করে আমায় রেহাই দাও তো। উঃ! সামান্য একটু ঝাঁপ দিতে পারার অভাবে এত দুর্ভোগ! শরীরটা যদি আড়াইমনি না হত।… হবে না কেন? বউমারা যে শ্বশুরকে যত্ন দেখাতে, যত পারেন ঠেসে পেটের মধ্যে চালান করে ছাড়েন। আবার দুই বউয়ে পাল্লা দিয়ে তার সঙ্গে ভাইয়ের বউটিও আছেন। তিনিও কম যান না।
ভাবছেন, লোকটা আবার মিনতির গলায় ডেকে উঠল, কত্তা!
কী? আবার কী?
আজ্ঞে বলতেচি যে— এই দামি জিনিসগুলান বেচে অনেক ট্যাকা পাব বলে তো মনে মনে আহ্লাদে নাচতেচি, কিন্তুক—
রত্নেশ্বর মনে মনে ছিটফিটিয়ে ওঠেন, বটে! বটে। আহ্লাদে নাচতেছে! মিচকে শয়তান। শুঁটকো ঘুঘু। কেলে চামচিকে। মুখে বলেন, তো কিন্তুকটা কী? শুনি? বলেই ফেলো। আর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মেরো না।
রুষ্ট হতেচেন কত্তা? তো বলতেচি কী, এই হাবাতে বুড়ো দামি দামি জিনিস নে বেচতে গেলে, দোকানি নিঘঘাত সন্দ করবে। বলবে চোরাই মাল। হয়তো বা ভাববে কাউকে মেরে কেটে কেড়ে নেচি। সেইসময়ে পুলিশেও দিতে পারে।…
তো তারজন্যে আমার কী করবার আছে হে?
অন্য কিচু না। বলতেচি কী, জিনিস তিনটে যদি আপনি নিজে স্যাকরার দোকানে গিয়ে বেচে ট্যাকাটা আমারে দিয়ে দেন তালে অ্যাকটা মহোৎ কাজ হয়।
বটে! বটে! মহৎ কাজ। অত মহত্ত্বে আমার কাজ নেই বাপু। যা করবার করে কেটে পড়ো। দেখছ ভীষণ বৃষ্টি আসছে।
তাতো দেকচি, তো কত্তামশাই আপনার একটু সাহায্যের অভাবে, আমার নৌকোখানাও সারাই হবে না, আবার উলটে পুলিশে ধরবে।
ওরে বাবা রে। বুড়ো তুমি কি আমায় পাগল করবে? চলো তো দেখি কোথায় তোমার স্যাকরার দোকান—
হাহা! কী যে কন কত্তা! এই রাত দুপুরে দোকান খোলা আচে?
তবে? তালে আর কী! রাতটুকুন যদি গরিবের কুঁড়েয় একটু মাথা গুঁজে থেকে—সকালে দোকান খোলাবেলায়—
কথা শুনে রত্নেশ্বর একটু হাঁ করে তাকান। তোমার কুঁড়েয় থেকে।
এই গঙ্গার ধার থেকে ফিরে গিয়ে?
অ্যাকটা রাত বই তো না কত্তা। আমার কাজটা মিটে গেলে নিয্যস আমি আপনার কাজটি করে দেব।
বলি বিশ্বাস কী? ঠকাবে না তো?
আজ্ঞে তাই কখনও ঠকাই? ধম্মের ভয় নাই?
তবে চল, কোথায় তোমার কুঁড়ে!
সত্যি কথা বলতে, এক্ষুনি যে গঙ্গায় তলিয়ে যেতে হল না, তা ভেবে মাত্র একটু আহ্লাদ আহ্লাদ ভাবই এসে গেল।…
আরও আহ্লাদ হল যখন লোকটা বলল, এখন তালে কত্তা আংটি কটা আবার আঙুলে গইলে ন্যান। আমার হাতে আপনার জামাজুতো কাপড় গেঞ্জি। ছিটকে পড়ে যেতে পারে!
এই চিরকালের জিনিসগুলো আবার আঙুলে পরতে পেয়ে সত্যিই মনটা রীতিমতো ভালো হয়ে গেল।
কিন্তু কোথায় বুড়োর কুঁড়ে?
ওই ছায়ামূর্তিটার পেছনে পেছনে হাঁটছেন তো হাঁটছেন। এ কোন জায়গা? তাঁদের হুজ্জোৎ শিবপুরের ধারে কাছে, এমন নী নী করা জায়গা ছিল কোথায়?
ধারেকাছে তো বটেই, হেঁটেই তো এসেছেন!
কী হে, কোথায় তোমার বাড়ি?
বাড়ি কয়ে লজ্জা দেবেন না কত্তা, বলেন কুঁড়ে।
আচ্ছা, আচ্ছা তাই। তো সেকতদূরে?
এই তো এলুম বলে।…
বলতে বলতে হঠাৎ ভীষণ কড়কড়িয়ে বাজ পড়ার শব্দ। তারপরই ঝড় আর প্রবল বৃষ্টি। এলোমেলো ছুটোছুটি দিশেহারা অবস্থা। অন্ধকারে ঝড় আর প্রবল বৃষ্টি। এলোমেলো ছুটোছুটি দিশেহারা অবস্থা, অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, শুধু বুড়োর বুকে সাপটে ধরা রত্নেশরের ফর্সা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবির সাদা রংটা মাঝে মাঝে চোখে পড়ায় পথনির্দেশের কাজ করছে।
কীভাবে কোথা দিয়ে যে একটা কুঁড়েবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন রত্নেশ্বর, তা বুঝতে পারলেন না। তবে হঠাৎ দেখলেন একটা ঘরের মধ্যে বসে পড়েছেন, একখানা ভাঙামতো চৌকির ওপর। ঘরের কোণে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে, কীসের তা কে জানে। কেরোসিনের, নাকি মাটির প্রদীপের? …তবে সেই আলোতেই আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, পাতালতা খড়কুটো যা দিয়েই ঘরখানা তৈরি হোক, ভেতরটা বেশ শুকনো খটখটে।
রত্নেশ্বরের এতক্ষণের রাগ বেশ থিতিয়ে এল। …এই ঘোর বৃষ্টির সময় গঙ্গার স্রোতে ভেসে কোথায় চলে যেতেন কে জানে। মানে তিনি কি আর? তাঁর দেহটা।… তার বদলে জলজ্যান্ত একটা শুকনো ঘরে বসে রয়েছেন। …না:, লোকটা ভালোই। তার মানে সব্বাইকে ‘খারাপ’ ভেবে ভেবে আমাদের অভ্যাসটা খারাপ হয়ে গেছে।
লোকটা বলল, ঝড়েজলে কাঁপুনি ধরতেচে, গেঞ্জিটা ধুতিটা পরে ন্যান আজ্ঞে।
শুনে রত্নেশ্বরের প্রাণ জুড়িয়ে গেলেও একটু লজ্জা লজ্জাও করল। ওসব তো একরকম দান করে ফেলা জিনিসই। তবু পরে বাঁচলেন। আশ্চর্য বাহাদুরি লোকটার, এত ঝড়জলেও কীভাবে সাপটে এনেছে, একটুও ভিজে যায়নি।…
লোকটাকে পাজি ভাবছিলেন, এখন বেশ ভালো ভাবতে শুরু করেছেন, তারওপর চাঁদের ওপর চুড়ো লোকটা বলে উঠল, কত্তার তো কিছু— আহারের দরকার!
আহার! মানে খাওয়া।
রত্নেশ্বর যেন একটি স্বর্গলোকের বার্তা শুনলেন। তবু চক্ষুলজ্জায় বলতে হল, সেই নিয়ে আর তোমায় ভাবতে হবে না বাপু! এখন এত রাত্তিরে এই দুর্যোগ— তোমার তো নিজের মতো কিছু আছে? তাই থেকে না হয় সামান্য কিছু—
আমার। আমার কতা বাদ দ্যান। সেকিচু নাই। আপনার কত্তা রাত উপুস চলবেনি, রাত উপুসে হাতি কাবু। দেখি কী পাই।
কী পাই মানে? এই বৃষ্টিতে কোথায় যাবে?
ও কিচু না। ও আমার অব্যেস আচে।
কিন্তু এত রাতে এরকম সময় কে দোকান খুলে বসে আছে তোমার জন্যে?
লোকটা বলল, আজ্ঞে এই মড়িপোড়ার ঘাটের কাছে, ভাতের হোটেল, চা-রুটির দোকান রাতদিন খোলা।
কী পোড়া ঘাট বললে?
আজ্ঞে মড়িপোড়া। আপনারা যারে শ্মশানঘাট বলেন। তো যত লোক মড়া পোড়াতে আসে তারা তো কিচু খায়।
কী? শ্মশানের দোকানের জিনিস খাব? না না! এঃ! …
কত্তার অ্যাক কতা! দোকানে কি মড়ারা এসে ঢুকতেচে? তারা খাবারে লেগে আচে? …তা ছাড়া—এখন আর আপনার কীসের ঘিন্না! নিজেই তো তাই হতে যাচ্ছিলেন।
লোকটা সেই বৃষ্টিতেই বেরিয়ে যায়। এবং আশ্চর্য, একটু পরেই সঙ্গে একটা ছেলে, তার একহাতে একটু কাগজে মুড়ে খানচারেক রুটি আর কিছু তরকারি, এবং অন্য হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কেটলি করে চা নিয়ে এল। সঙ্গে একটা মাটির ভাঁড়।
নামিয়ে দিয়েই চলে গেল ছেলেটা।
এই পরিস্থিতিতে গরম চা! এ যে প্রায় ভগবান পাওয়ার মতো। তাও আবার এত তাড়াতাড়ি। পেল কোথায় বুড়ো? মনে হল যেন ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির উঠোনের গাছ থেকে পেড়ে আনল!
থাক বাবা, পাওয়া তো গেছে!
শ্মশানঘাটের কাছের হোটেলের জিনিস! অত আর বিচার করা চলে না। দিব্যি খেয়ে নিলেন রত্নেশ্বর। আর শুনলে লোকে হাসবে, খেয়ে মনে হল তাঁর জীবনে এমন ভালো চা খাননি। শুধুই কি চা? এত ভালো তরকারি আর রুটি? মনে হল অপূর্ব!…
রত্নেশ্বর খুব লজ্জা লজ্জা ভাবে বুড়োকে বললেন, আমার জন্যে তোমার অনেক খাটুনি গেল!
লোকটা বলল, তাতে কী? আমারও তো আপনার জন্যে ভাঙা নৌকোখানা মেরামত হতি পাবে! তো নিদ্রা যান কত্তা! ইয়ে, তুমি কিছু খেলে না?
আমার কতা বাদ দ্যান। আমার খাওয়াও যা, খাওয়াও তা।
কী আশ্চর্য। একটু কিছুও তো খাবে।
না না ও কিচু লাগে না।
তা ভালো। তবে শোবেই বা কোথায়? তোমার জায়গাটা আমি দখল করলাম—
ও কতা ছাড়েন কত্তা। আপনি এখন নিদ্রা যান!
তা তো যাব! খুব ঘুম পাচ্ছে। তো এতক্ষণ কথা হল বাপু, তোমার নামটা তো জানা হল না! কী নাম?
নাম? আমার নাম ?
লোকটা যেন ভারি হাসির কথা শুনেছে, এইভাবে খি খি করে হেসে বলে, তো নাম একখানা ছেল বটে, একদা কিন্তুক কেউ তো আর ডেকে কতা কয় না, ও আর মনে নাই। ও বিত্তান্ত থাক কত্তা। এখোন ঘুম দ্যান।
হ্যাঁ, তাই দিই। যা ঘুম আসছে।
রত্নেশ্বর মস্ত একখানা হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়লেন।
মাথার মধ্যে যেন ঝিঁঝি পোকা ডাকছে।…
যখন ঘুম ভাঙল তখন চারিদিক তাকিয়ে প্রথমটা অবাক হয়ে গেলেন। এ কোথায় আছেন রত্নেশ্বর?…মরবার কথা ছিল না তাঁর? তাহলে কি মরেই গেছেন? এই চেহারাটা পরলোকের? তারপরই মনে মনে হেসে ফেললেন। দিব্যি সশরীরে রয়েছেন। ধুতির খানিকটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শুয়েছিলেন, দেখলেন গায়ের ওপর পাঞ্জাবিটা বিছোনো। …কিন্তু ঘরে কেউ নেই। লোকটা কোথায় গেল? রাতে ঘরে শুয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।…
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। খোলাই ছিল। …কিন্তু কী আশ্চর্য! কে বলবে গতরাতে অত ঝড়বৃষ্টি গেছে। আকাশ যেন ঝলমল করছে। চারিদিক শুকনো খটখটে, কোনোকালেও যে বৃষ্টি হয়েছে তা মনে হচ্ছে না।… কিন্তু লোকটা ? তাকিয়ে দেখলেন —আসছে। সঙ্গে অন্য একটা চায়ের দোকানের ছেলের মতন ছেলে। …তারও একহাতে চায়ের কেটলি আর ঠোঙার মধ্যে কী যেন। অন্য হাতে একটা জলের বালতি। তা লোকটা অতিথিবৎসল বটে!
যদিও এর আগে রত্নেশ্বর কোনোদিন ভাবতেও পারতেন না ওই বালতির জলে মুখ-হাত ধোবেন, এখন কিন্তু দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।
ন্যান কত্তা, হাতমুখ ধুয়ে একটু চা টিফিন খেয়ে ন্যান।
লোকটার গলার স্বরে চমকে উঠলেন রত্নেশ্বর। কী বিশ্রী ভাঙা ভাঙা।
কিন্তু শুধুই কি গলার স্বর? চেহারা? দিনের আলোয় ভালো করে দেখে যেন শিউরে উঠলেন! এত বিচ্ছিরি দেখতে মানুষ হয়? তাড়াতাড়ি মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলেন। …মনে হল টুথপেস্ট টুথব্রাশটা সঙ্গে না নেওয়া খুব ভুল হয়েছে।… কী আর করা!
ঘরে এসেই আর একবার চোখ জুড়িয়ে গেল।
ইতিমধ্যে ছেলেটা সেই ভাঙা চৌকিটার ওপর একটুকরো খবরের কাগজ বিছিয়ে, তার ওপর শালপাতা পেতে সাজিয়ে রেখেছে চারখানা শিঙাড়া আর খানআষ্টেক জিলিপি। পাশে দুটো মাটির ভাঁড়।
খাবারগুলো একটু কেলে-কোলে দেখে মনে হচ্ছে তেলে-ভাজা। কিন্তু তাতে কী? পরমায়ু যার আর ঘন্টাকয়েক মাত্র, তার আবার তেলেভাজা-ঘিয়েভাজা! জিলিপি তাঁর বিশেষ প্রিয়, বাড়িতে হেনস্থা খেয়েও লুকিয়ে দোকানে ঢুকে খেয়ে নেন। দেখে খুব আহ্লাদ হলেও, সৌজন্য হিসেবে বলে উঠলেন রত্নেশ্বর, এ কী করেছ হে? এত খাওয়া যায়?
আজ্ঞে কত্তা, সোনা রুপোর দোকান আজ্ঞে, সিই বেলা দশটা নাগাদ খুলবে। তার বেশি বই আগে নয়। তা ততক্ষণ তো শরীলটাকে টানতি হবে!
ওঃ সেই কথা! সেই আংটি বিক্রি।
ভালো হয়ে ওঠা মনটা খরাপ হয়ে গেল!
তাই বেজার গলায় বললেন, তা হলেও—এত পয়সা খরচ করবার দরকারটা কী ছিল বাপু?
আজ্ঞে কত্তা, এ তো— আপনারই। জামার পকেটে ছেল। খেয়ে ন্যান কত্তা। হাতে গরম।
রত্নেশ্বর আবার মনটা ভালো করবার চেষ্টা করলেন। ওই বুড়োর আর দোষ কী! রত্নেশ্বর নিজেই তো তাকে অনুরোধ করেছিলেন ঠেলা মেরে গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার জন্যে। ও বেচারা গরিব মানুষ, সেই ঘটনাটি ঘটাবার আগে, নিজের অভাব দূর করবার আশায় রত্নেশ্বরের আংটি তিনটে কাজে লাগাতে চেয়ে— জলে ডুবে ফুলে ফেঁপে আঙুলগুলো যে চাঁপাকলার মতো হয়ে যাবে, আর পুলিশ তাদেরকে কেটে কুপিয়ে বার করে নেবে, সেইটুকুই জানিয়েছিল। না: ওর ওপর রাগ করা ঠিক হয়নি। …হাতে গরম জিলিপিগুলোর সদব্যবহার করা যাক। রত্নেশ্বর শালপাতাখানা টেনে নিয়ে একখানা জিলিপিতে কামড় দিয়েই তাকিয়ে দেখলেন শালপাতার নীচেয় বিছোনো খবরের কাগজের টুকরোটার ওপর।… অলসভাবেই চোখ ফেলেছিলেন, হঠাৎ তাঁর চোখ দুটো গোল্লা হয়ে উঠল, টাকের চুল খাড়া হয়ে উঠল, হাতের জিলিপিখানা হাত থেকে খসে পড়ল!
এ কী? কী লিখেছে এসব?
রত্নেশ্বর কি সত্যি দেখছেন? না পড়তে ভুলে গিয়ে উলটো-পালটা দেখছেন?… এ কাগজ কবেকার? এই ময়লা পুরোনো চটকানো ছেঁড়া টুকরোটা কোন তারিখের? কোন কাগজ? খাওয়া মাথায় উঠে গেল, কাগজখানা খ্যাঁস করে টেনে নিয়ে উলটে দেখলেন, না: দেখা গেল না,—কোন কাগজ কত তারিখ।
ওপর দিকটা নেই। মাঝখানের টুকরো একটুমাত্র।
হোটেলের ছেলেটা কেটলি খালি হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে দাঁড়িয়ে আছে, রত্নেশ্বর উত্তেজিতভাবে বলে ওঠেন, ওহে, এ কাগজ কবেকার? কী নাম কাগজের?
ছেলেটা না রাম, না গঙ্গা! হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
মাঝি বুড়ো বলে, ছেলেটা কত্তা বোবা কালা!
চমৎকার। আমার ভাগ্যে একটা বোবা কালা ছাড়া আর কিছু জুটল না! তো তুমি জানো, এ কাগজটা কোথা থেকে পেয়েছে ছেলেটা? কাগজের কী নাম, কোন তারিখের?
লোকটা ঠিক সেইরকম খ্যাঁকখেঁকিয়ে হেসে উঠে বলে, দ্যাখেন কান্ড! আমার কাচে আবার দিন মাস বছর তিথি তারিকের খোঁজ!
ওসবের ধার কে ধারে কত্তা?
ওঃ। বলি— পড়তে পারো? বাংলা?
পড়তে? হ্যা হ্যা হ্যা! মনে জাগচে বটে একদা যেন পারতুম এট্টু এট্টু। তো সেকোনকালের কতা! স্মরণ নাই। ক্যানো, কী নিকেচে?
রত্নেশ্বর হঠাৎ নিজেকে সামলে নেন।
বলেন, ও তুমি বুঝবে না। একটা জরুরি কথা লেখা আছে। কিন্তু ঠিক মালুম হচ্ছে না।
বলে সাবধানে কাগজটুকু পাশে সরিয়ে রাখেন।
খাবারটা খান কত্তা। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্চে।
ও। হ্যাঁ।
রত্নেশ্বর আবার খাওয়ার মন দিতে চেষ্টা করলেন।
কিন্তু চেষ্টা করলেই হল? মন তো আর কাঠ-পাথর নয়?
সেতো ছুটোছুটি করছে, লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে। ডিগবাজি খেতে চাইছে, দু-হাত তুলে নাচতে চাইছে। …আবার যেন কেমন বেভুল হয়ে ঝিমিয়ে যাচ্ছে।
চা-টা ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে, আর অর্ধেক খাবার আর পারছি না বলে ঠেলে রেখে হাত ধুয়ে নিলেন রত্নেশ্বর।
আজ মনে হল চা-টা সুখাদ্য, আর খাবারগুলো জঘন্য। আরও একবার পড়তে হবে কাগজটা। বার বার, বারংবার। বুঝতে হবে এটা কী রহস্য।
একই নামের লোক জগতে থাকতেই পারে, কিন্তু একই ঠিকানায়?
তাহলেও মাঝখানের রহস্যটা? সেটা ভেদ হবে কী করে?
ছেলেটা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বুড়োটাও চলে যেতেই রত্নেশ্বর আবার পড়ে থাকা সেই কাগজাংশটুকু চোখের সামনে তুলে ধরলেন। বয়েস উনসত্তর হলে কী হবে, চোখের দৃষ্টি ভালোই পরিষ্কার। চশমা লাগে না।
বড়ো হেডিংটা হচ্ছে—‘দশ হাজার টাকা পুরস্কার।’
এইটাতে প্রথম চোখ পড়েছিল। তারপর?
‘সন্ধান জানাইতে পারিলে নগদ দশ হাজার টাকা হাতে হাতে।
নিরুদ্দিষ্টের নাম রত্নেশ্বর রায়… বয়স উনসত্তর, রং ফর্সা, উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, ভারী গড়ন। নিখোঁজ হওয়ার সময় পরনে ছিল—মিহি শান্তিপুরি ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে নিউকাট জুতো। মাথায় টাক। বিশেষ চিহ্ন নাকের ওপর একটি লাল জড়ুল।… গত ১৬/৫/৯২তারিখ হইতে নিখোঁজ।…. সন্ধান জানাইবার ঠিকানা—বাইশের তিন যজ্ঞেশ্বর রায় লেন … হুজ্জোৎ শিবপুর, জেলা—হাওড়া।’
এতেও যদি টাকের চুল খাড়া হয়ে না ওঠে, তো আর কীসে উঠবে?…
তো, সেটা রত্নেশ্বরের বাড়ির লোকেরা হারিয়ে যাওয়া রত্নেশ্বরের খোঁজ পেতে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে বলেই কি?…
মানে যাদের ব্যবহারে সংসারের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন, তারাই এমন?… না ঠিক তা নয়। …সেটা পরে ভাববার। ভাবছেন, এই ঘোষণাটা করল কখন? কাগজে দিল কবে? তারা ছাপল কবে? এই কাগজটা যদি আজকেরও হয়, (যদিও দেখে তা মনে হচ্ছে না) তা হলেই বা হিসেব মিলছে কই? আর বিগত ১৬-৫-৯২মানেই বা কী? সেটা তো মাত্র গত-কালকের তারিখ। কালই তো রত্নেশ্বর দুপুরে চর্বচোষ্য খেয়ে, একটুক্ষণ ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে, সেই নাইলন দড়িটাকে সাইডব্যাগে ভরে নিয়ে চুপিসারে বাড়ি থেকে কেটে পড়েছিলেন। …তারপর থেকে এই আজ সকালপর্যন্ত তো নানা কান্ডকারখানা।
তবু হারিয়ে যাওয়াটা আবিষ্কার করতেও তো অন্তত রাত আটটা-নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে?…বাচ্চা শিশু নয় যে একবার বাড়িতে দেখতে না পেলেই ভাবতে বসা হবে হারিয়ে গেছে।
বয়স্ক একটা লোক, অথর্ব নয়, অপটু নয়, ইচ্ছে হলে কোথাও বেড়াতে তো যেতেই পারে। …একবার না দেখতে পেলেই কি হারিয়ে গেছে ভেবে খবরের কাগজের অফিসে ছুটবে পুরস্কার ঘোষণা করতে? তা তো আর হয় না?
তবে?
কাগজটাকে আবার মোচড়ানো জায়গাটা টানটান করে চোখের সামনে মেলে ধরলেন। আর তখনই আরও একটি বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল। ঈষৎ ছোটো ছোটো অক্ষরে বলে আর জিলিপির রস গড়িয়ে লেগে যাওয়ার ফলে আগে চোখে পড়েনি।
‘দাদা, যেখানেই থাক, চলে এসো। বাড়িসুদ্ধ সকলে মৃত্যুশয্যায়। …পরমেশ্বর রায়।’
না, এখন আর টাকের চুল খাড়া নয়, সমস্ত শরীরের রোমগুলো নেতিয়ে এলিয়ে পড়ে। … রত্নেশ্বরের অভাবে, বাড়ি-সুদ্ধ সবাই মৃত্যুশয্যায়! ওরে বাবা এরে— এখুনি যে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। ওঃ। বাড়ির সবাই এত ভালোবাসে রত্নেশ্বরকে?… আর রত্নেশ্বর এত নিষ্ঠুর? নিজের ব্যবহারে সক্কলকে ‘মৃত্যুশয্যায়’ শুইয়ে দিয়েছেন!
কিন্তু?
আবার সেই চিন্তা।
এসব হলটা কখন?
যদি রাতারাতি হয়, আর রত্নেশ্বরকে দেখতে না পাওয়া মাত্রই যদি সব্বাই দড়াম দড়াম মৃত্যুশয্যায় ঢলে পড়ে থাকে, তাহলেও রত্নেশ্বর সংক্রান্ত খবরটা খবরের অফিসে পৌঁছে দিতে গেল কে? আর কখন? …যাতে পরদিনই সেখবর ছাপাই হয়ে, নেহাত মফসসল জায়গাতেও বিলি হয়ে—শ্মশানযাত্রী ঘাটের চায়ের দোকানে চলে এসে সকালবেলাই শিঙাড়া জিলিপি মুড়ে এই কুঁড়েঘরেও এসে ঢুকে পড়তে পারে? এত করিতকর্মা কোন কাগজ?…
আশ্চর্য! খবরেরে কাগজখানার ঠিক নাম তারিখের জায়গাটাই উধাও। তা এইরকম হয়। একশোখানা চিঠির মধ্যে থেকে ঠিক দরকারি চিঠিটাই খুঁজে পাওয়া যায় না।
ভাবতে ভাবতে প্রাণের মধ্যেটা ধড়ফড় করে উঠতে থাকে রত্নেশ্বরের। ওদিকে বেলা-বাড়তে থাকে, রোদ চড়া হয়ে ওঠে। মাঝি এল বলে। এসেই তো একগাল হেসে বলে উঠবে, চলেন কত্তাবাবু স্যাকরার দোকান খুলেছে।
তারপর?
তারপর আর কী? আবার আংটি ক-টা খুলে বুড়োর হাতে দিয়ে দেওয়া। তার সঙ্গে গিয়ে দোকানে বেচে দেওয়া।
তারপর? তারপর বুড়ো সেই টাকাটাকে হাতিয়ে নিয়ে রত্নেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গার ধারে চলে আসবে, এবং রত্নেশ্বরকে এক ধাক্কা দিয়ে—
ওরে বাবা রে! কী হবে রে! এত নিষ্ঠুর হতে পারবে বুড়ো? কিন্তু ওর সঙ্গে তো সেইরকমই চুক্তি আছে। …গতকাল সন্ধ্যায় তো রত্নেশ্বর নিজেই তাকে বার বার চাপ দিচ্ছিলেন। …তখনকার মতো এই আংটিরাই রত্নেশ্বরকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু আর কতক্ষণ বাঁচাতে পারবে?
রত্নেশ্বরের ছেলেরা বউরা নাতি-নাতনিরা ভাই ভাইবউ ভাইপোরা রত্নেশ্বরকে হারিয়ে মৃত্যুশয্যায় পড়ে ছটফট করবে, ঘোষণা করা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতিটা মাঠে মারা যাবে, আর রত্নেশ্বর তখন জলের তলায় তলিয়ে গিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে আবার ভেসে ওঠবার তাল করতে থাকবেন? সেই ওঠাটা কী মূর্তিতে?
এই যে কত্তাবাবু চলেন।
ডাকটা শুনতে পেলেন রত্নেশ্বর।
চোখের সামনেটা গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেল।
আর তারপরই আকাশে বিদ্যুৎ খেলে যাওয়ার মতো মাথার মধ্যে একটা আলো ঝলসে উঠল। বুদ্ধির আলো।
আচ্ছা, ওই দোকানে-টোকানে না গিয়ে বুড়োটাকে সরাসরি আমার বাড়িতেই তো নিয়ে গেলে হয়।
এই কাগজের টুকরোটা হাতে করে নিয়ে গিয়ে ছেলেদের বলবেন , আমার জন্যে যে পুরস্কার ঘোষণা করেছিস তোরা, সেটা এই বুড়োর হাতে দিয়ে দে। …পরে কথা হবে।
বা:। সমস্যা সমাধানের এমন একটা উপায় ছিল, তা এতক্ষণ মাথায় আসছিল না?
রত্নেশ্বর খোশমেজাজে বললেন, চলো। একখানা রিকশগাড়ি ডাকো।
রেকশো কী হবে বাবু? সেতো এখানে। কাছেই উই মোড়ের মাতায়। এট্টু চরণ চালালেই—
রত্নেশ্বরের তো এখন খোশমেজাজ, তাই হাসতে হাসতে বলেন, তোমাদের শ্মশানঘাটের ধারেও গহনার দোকান? কেনে কে?
আজ্ঞে, কেনে না কেউ, বেচে। বড়োমানুষের ঘরের মেয়েরা বউরা জ্বালাই হতে এসেও অঙ্গে কিচু অলংকার রাকে। এই ‘অঙ্গুরি মাকুড়ি নাকফুল’ এইসব। ঘাটের লোকেরা সেগুলান বেচে দেয়।
রত্নেশ্বর হেসে বলেন, আমি অবিশ্যি জ্বালাই হতে আসছি না। তা বল তো এগুলো বিক্রি করলে কত টাকা হবে?
তা আজ্ঞে এই গরিব হতভাগা কী জানবে? আমার ওই ভাঙা নৌকোখান মেরামতি করার যুগ্যি ট্যাকা পেলেই হল।
আচ্ছা আচ্ছা তার বেশি পেলেই বা মন্দ কী? তোমার এই ভাঙা ঘরখানাও তো সারাই করে নিতে পারলে ভালো। বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।
বাকি জেবনটা? হ্যা হ্যা হ্যা।
লোকটা প্রায় অট্টহাস্য করে উঠে বলে, তো কী হবে? রেকশো চাই?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তোমায় আমার চেনা একটা জায়গায় নিয়ে যাব-চল, তারা এই আংটির বদলে মোটা টাকা দেবে।
তবে চলেন। উই তো বাজারধারে রেকশোরা সার দে দাঁইড়ে আচে।
রিকশওয়ালাটা যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘হুজ্জোৎ শিবপুর?’ সেটা আবার কোথায় বাবু? নামও শুনি নাই।
বটে? এখানে নতুন এসেছ বুঝি?
নতুন হতে যাবে ক্যানো? পাঁচ বছর রিকশো চালাচ্ছি।
আর পাশের পাড়ার নাম জানো না? বলি শালিমার ঘাটের নাম জানো?
শালিমার ঘাট। তা জানি। তো সেতো বহুৎ দূর। গঙ্গার ওপারে।
রত্নেশ্বর রেগে উঠে বলেন, এ আবার কী উজবুক লোক। এই গতকাল সন্ধেবেলা আমি একটু রাস্তা গুলিয়ে ফেলে সেখান থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে এখানে চলে এসেছি,আর তুমি বলছ বহুৎ দূর। গঙ্গার ওপারে?
হঠাৎ মাঝি বড়ো রলে ওঠে, ওর দ্বারা হবে না কত্তা, দাঁড়ান আমার জানা লোক ধরে নে আসি।
ফট করে কোথায় চলে গেল, আর কোথা থেকে যেন চট করে একটা রিকশোগাড়ি ধরে নিয়ে এল… তো সেরিকশাওয়ালাটি বোধ হয় এই মাঝিরই ক্লাসফ্রেন্ড। তেমনি হাড়বুড়ো! আরে বাবা! ও পারবে?
খুব পারবে?
খুব পারবে।
উলটে ফেলে দেবে না তো বাপু! কোথা থেকে আবার এই বুড়ো লোককে ধরে নিয়ে এলে? দেখে ভাবনা হচ্ছে।
আজ্ঞে কত্তা, বুড়ো হাড়ই মজবুত বেশি। দেখবেন অ্যাকেবারে উইড়ে নে যাবে।
আগের রিকশোওয়ালাটা ঠাট্টার হাসি হেসে বলে, তাহলে বাবু আপনি উড়তে যান। আমি যাচ্ছি। —হাটতলায় যাই। বুধবারের হাট!
রত্নেশ্বর চমকে বলেন, আজ কী বারের হাট বললে?
ক্যানো বুধবার। হাটবার।… বলে পা চালিয়ে চলে যায়। বুধবার! তাহলে তো হিসেবের কোনো গোলমাল নেই। কাল দুপুরে দড়িটা হাতে নিয়ে ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখে গিয়েছিলেন, নিজের মৃত্যুতারিখটা দেখে রাখতে। তাহলে যে কী একটা কাদাখোঁচার মতো হচ্ছে। যাকগে। বুড়ো রিকশওয়ালাকে বললেন, ‘হুজ্জোৎ শিবপুর’ জানো?
বুড়ো মাঝিই তার হয়ে জবাব দিয়ে দেয়, ওর কিছু অজানা নাই কত্তা।
তা বেশ! তা হলে বলি বাপু, সাবধানে নিয়ে যাবে। উলটে ফেলে-টেলে দিয়ো না! ভাড়া বাদেও ভালো বকশিশ পাবে।
তোমার এই বন্ধুটিকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি কেন জানো? মোটা টাকা পাইয়ে দেব বলে। দশ হাজার টাকা! মালুম হোগা?
গর্ব গর্ব ভাব দেখাতে রত্নেশ্বরের মুখ দিয়ে হিন্দি কথা বেরিয়ে যায়। … রিকশোয় উঠে পড়ে বুড়ো মাঝিকে পাশে বসবার জন্য জায়গা ছেড়ে দেন।
রিকশাওয়ালাটা কোনো কথা বলে না, ধাঁই করে প্যাডেল মারে। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ঝাঁকুনি লেগে যেন মাথাটা বেঁা— ও— করে ঘুরে যায় রত্নেশ্বরের। চোখে অন্ধকার দেখেন। কতক্ষণ কে জানে। মাথাটা স্থির করে চোখ খুলে দেখেন বাড়ির দরজায়। সেই তাঁর বাইশের তিন নং যজ্ঞেশ্বর রায় লেনের বাড়ি।
তারপর?
তারপ যেন ঝড় বইতে থাকে। সাইক্লোন বললেও বলা চলে। দাদু এসেছে। দাদু এসেছে। ও মা, ও বাবা, ঝরনাদি, ঠাকুর—দাদু। দাদু।
বাবা! …ছেলেরা উথলে ওঠে।
জেঠু! …ভাইপো ডুকরে ওঠে।
দাদা! …ভাই গদগদ হয়।
এতদিন কোথায় ছিলেন? ছেলেরা কাতর প্রশ্ন করে।
কাউকে কিছু না বলে গিয়েছিলে কোথা? ছিলে কোথায় এতদিন? ভাইপো ধমক দেয়।
বাবা! রাস্তায় বেরিয়ে হঠাৎ কোনো অসুখে পড়ে যাননি তো? বউমারা কাঁদো কাঁদো হয়।
নাতি-নাতনিরা অভিমান করে বলে, দাদু তুমি আমাদের না বলে চলে গেছলে কেন? আমাদের বুঝি রাগ হয় না? আমরা রোজ কাঁদি।
কাজের মেয়ে ঝরনা বলে ওঠে, গুণিন মা বলেছিল, ‘ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, তোদের দাদুকে। আর আসবে না।’ গিয়ে মজা দেখাচ্ছি তেনাকে।
হঠাৎ এরকম নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার মানে কী দাদা? ওঃ। আমাদের সকলের যে—ওদিকে প্রাণকেষ্টদা তো খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে হাফ পাগল হয়ে বসে আছেন। বউদি ভাত রেঁধে খেতে ডাকতে সাহস পান না।
বাবা! আপনি না থাকায় আমাদের যা অবস্থা। বাজার হয় না, রান্না হয় না। বামুনঠাকুর শুধু ভাত আর ডাল রান্না করে বসে থাকে। কিছু বললে বলে, ‘রান্নায় মন নাই।’
কথার বন্যা।
তারমধ্যে আবার ঘণ্টুর হুমকি! তোমরা সবাই একটু থামবে? জেঠুকে একটু বিশ্রাম করতে দেবে?
রত্নেশ্বর আলপিনের মতো একটু ফাঁক পাচ্ছেন না যে নিজে একটু কথা বলবেন। যতবার বলার চেষ্টা করছেন, ততবারই অন্য কেউ ঝাঁপিয়ে এসে কথা বলছে।…
অনেকক্ষণ পরে যখন বড়োবউমা একটা কচি ডাবের মুখ কেটে সামনে এনে ধরেছে, ভাইবউ একগ্লাস লেবুর শরবত এগিয়ে ধরেছে, আর ছোটোবউমা এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা নিয়ে এগিয়ে আসছে, সেইসময় ওই আলপিনের আগার মতো একটু ফাঁক পেয়ে বলে ওঠেন, তোরা বাবা তিলকে তাল করে তুলিস। বাপ একরাত্তির বাড়ি ফেরেনি তো দশ হাজার পুরস্কার ঘোষণা—এখন—
ঘন্টা বলে ওঠে, দশ হাজার মানে? আমি তো তোমার কিপটে ছেলেদের কিপটেমির জন্য যাচ্ছেতাই হ্যানস্থা করে, ‘কুড়ি হাজার’ বলে আবার ছাপতে দিয়ে এলাম।
শুনে আহ্লাদে চোখে জল আসে রত্নেশ্বরের। এত ভালোবাসে সবাই তাঁকে? আর ওই ঘণ্টাটা? যাকে রত্নেশ্বর দু-চক্ষের বিষ দেখতেন ‘মস্তান’ বলে? …কিন্তু সবাই মিলে ‘এতদিন এতদিন’ করছে কেন? মনের কষ্টে ‘একদিন’কে এতদিন মনে হয়েছে? যাকগে সব কথা পরে হবে, আগে আসল কাজটা হয়ে যাক। …ডাবে মুখ দিয়ে জলটা চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিয়েই লেবুর শরবতটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলে, চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলেন, আচ্চা সব কথা পরে হবে, এখন আসল কাজটা আগে সারা হোক। …ঘোষণার দশ হাজার টাকাটা চটপট বার করে ফেলে, বাইরে একটা রোগা শুঁটকো বুড়ো রিকশায় বসে আছে তাকে দিয়ে দিগে যা। … বলতে গেলে ওই তোদের বাবার জীবনদাতা। …ওর জন্যেই আমাকে পেলি তোরা। বলব সব বলব। সেএক মহাভারত। …তো ওকে আর বসিয়ে রেখে কাজ নেই। …আর দেখ রিকশাওলাটাকেও গোটাকুড়ি টাকা দিয়ে দিস। বলিস—ভাড়া আর বকশিশ মিলিয়ে! …ও, আর যদি ডাব থাকে তো বামুনঠাকুরকে বল দুটোর মুখ কেটে ওদের দিতে। বুড়োমানুষ দুটো রোদে এসেছে!
তা ডাব বাড়িতে থাকেই। নারকেলবাগান আছে তো!
বামুনঠাকুর দু-হাতে দুটো ডাব নিয়ে দরজা পার হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আর রত্নেশ্বরের দুই ছেলে ঘণ্টুকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাশ দশ হাজার টাকা নিয়ে তার পিছু পিছু যায়। আগে গলাটা ভিজুক বুড়ো দুটোর। …টাকা হাতে পাওয়ার পর তো দিশেহারা হয়ে খেতেই ভুলে যাবে। রত্নেশ্বর আর সঙ্গে গেলেন না। লজ্জা করছে। ভয়ও। গঙ্গায় ডুবতে যাওয়ার কথা যদি এদের সামনে ফাঁস করে দেয়?
কিন্তু এ কী?
বেশ অনেকক্ষণ পরে ছেলেরা টাকাটা নিয়ে, আর বামুন-ঠাকুর ডাব দুটো হাতে নিয়ে, ফিরে আসে।…
রিকশোই বা কোথা? আর তাতে লোকই বা কোথা?
এই যজ্ঞেশ্বর লেনের ত্রিসীমায় কোনো রিকশো দেখা যায়নি!
তার মানে?
মানে তুমিই জানো জেঠু।
কদিন না খেয়েদেয়ে বোধ হয় মাথাটা একটু ইয়ে হয়ে গেছে, তাই স্বপ্ন ভাব এসে গেছে।
শুধু না খাওয়া? মাথায় তেলই কি পড়েছে? টাক হলেও তেল মাখতে তো ছাড়তেন না।
রত্নেশ্বর রাগে দুঃখে অবাকে হাঁসফাঁস করে চেঁচিয়ে ওঠেন, কেউ নেই? আমি কি তবে হেঁটে এসেছি? উঃ। আমি এখানে গল্পে মেতে দেরি করে ফেলায়, অপমান অভিমানে চলে গেছে। কেন মরতে আমি তক্ষুনি—
ঘণ্টু এবং সণ্টু মণ্টু তিনমূর্তি একসঙ্গে বলে ওঠে, ওইটুকু দেরির জন্যে দশ-দশ হাজার টাকা থোড়াই কেয়ার করে চলে যাবে? পাগল না মাতাল? এ ছাড়া কেউ এত মানী হবে না।
তবু রত্নেশ্বরের মন মানে না। নিজেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে দু-দিকে যতটা চোখ যায় দেখতে থাকেন হাঁ করে। কোথায় রিকশো? তার ছায়ামাত্রও নেই।
এমনকী চাকার রেখাও নেই।
মনটা হায় হায় করতে থাকে। তা ছাড়া কেমন যেন হেরো হয়ে থাকার মতো লাগছে।
রাগও হচ্ছে। আংটিগুলো নিতিস নিতিস, এত বায়নাক্কা কেন? বেচে টাকা করে দিতে হবে। …ওসব না বললে তো আর রত্নেশ্বর এমন ফ্যাসাদে পড়তেন না।…
ফিরে এসে হতাশ হয়ে বলেন, না: দেখতে পেলাম না। চাকার দাগটাও নয়, কিন্তু আচ্ছা গতকাল অত প্রলয়কান্ড ঝড়বৃষ্টি তার চিহ্নমাত্র দেখছি না তো? এখানে হয়নি?
বৃষ্টি? কাল? কাল আবার কখন বৃষ্টি?
দাদু তুমি বুঝি স্বপ্ন দেখছ?
আর ছেলে বলে, বৃষ্টি তো হয়েছিল সেই গত মঙ্গলবারে বাবা। তোমায় খুঁজতে বেরিয়ে কী নাস্তানাবুদ। কাকা, মনে নেই তোমার?
মনে আবার নেই? ঝড় বৃষ্টি বাজ পড়া। সেই দুর্যোগে পাড়ায় বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি কোথায় গিয়ে আটকে পড়েছেন। বামুনঠাকুরটা তো আবার কপাল চাপড়াতে বসল ‘বাবুর মাথায় বজরোঘাত হইল না তো?’ বোঝো আমাদের অবস্থা! …কিন্তু সেতো গত মঙ্গলবারে, তুমি যেদিন নিখোঁজ হয়ে গেছলে। …গতকাল তো কই—কোথায় গিয়ে পড়েছিলে?
কতদূরে? সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল কাল? আশ্চর্য ! তা হঠাৎ অমন না বলা কওয়া বেরিয়ে পড়েছিলে কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে না বিশেষ কিছু বিপদে-টিপদে পড়েছিলে। ব্যাপারটা কী বল তো?
রত্নেশ্বর কি এই ভালোবাসার স্রোতের সামনে বলে উঠবেন, ‘গিয়েছিলাম তোদের জব্দ করব বলে সুইসাইড করতে।’ অসম্ভব! ও খবর চেপে যেতে হবে। একটা ভব্যিযুক্ত গপ্পো বানাতে হবে। উপায় কী? বোঝা যাচ্ছে প্রাণকেষ্টটা বলে ফেলেনি। তবু রক্ষে। যতই হোক, চিরকালের প্রাণের বন্ধু তো! …ওর কাছেই পরামর্শ নিতে হবে।
ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বলব! সবই বলব! ধীরে ধীরে বলব। আজ বড়ো টায়ার্ড।
ঘণ্টু তড়বড়িয়ে ‘ওঠে, নিশ্চয় নিশ্চয়। এই, আজ আর কেউ জেঠুকে ডিস্টার্ব করবে না!…শান্তিতে নাওয়া-খাওয়া রেস্ট নেওয়ার পর সব শোনা যাবে। …কিন্তু জেঠু, যে লোক দুটো দিনদুপুরে উবে গেল, তারা কে?
বলব রে—!
আহা সেতো বলবেই। না শুনে ছাড়ছেই বা কে? কিন্তু তাদের মধ্যে একটাকে আবার জীবনদাতাও বললে। পুরস্কারের টাকাটা দিতে চাইলে—।
ঘণ্টু! তুই নিজেই ডিস্টার্ব করছিস। …কাকা বলে।
ঠিক আছে। আর কথা বলছি না। তবে টাকাটা তাকে দেবে বলেই তো সঙ্গে ডেকে এনেছিলে? হঠাৎ কী হল বল তো? কাকা বলে ওঠে ঘণ্টু, তুমি নিজেই নিজের নিয়ম ভাঙছ।
আঃ রাখো তো নিয়ম। লোকটা টাকা না নিয়ে কেটে পড়ল কেন, সেটা ভাবতে হবে না?
ওর আবার ভাবাভাবির কী আছে? বোঝাই তো যাচ্ছে ভয় খেয়ে সটকেছে। সাত জন্মে তো আর অত টাকার নাম শোনেনি। ঘাবড়াতেই পারে।
টায়ার্ড রত্নেশ্বর এখন আবার জোরগলায় বলে ওঠেন, সাধে বলেছি, তোদের সবই বাড়াবাড়ি! দশ-দশ হাজার কবুল করবার কী দরকার ছিল? হাজারপাঁচেক লিখলেই হত।
কাছে বসে থাকা ঝরনা ফট করে বলে ওঠে, আহা! দাদু, তাতে তো তোমার মাত্তর পাঁচ হাজার বাঁচত! আর এ যে দশ হাজার বেঁচে গেল।
আরার প্রাণকেষ্টও বলে ওঠেন, তোর তো বাবা সবই বেঁচে গেল! প্রাণটা তো বটেই, মান-সম্মানও। তা ছাড়া লোক হাসানো, চক্ষুলজ্জা। এবং রক্ষেকবচ আংটি তিনটেও। সব্বের ওপর ছেলে ব্যাটাদের একগাদা টাকা। …এত বাঁচার পর হিসেবের খাতা থেকে সামান্য গোটাসাতেক দিনরাত্তির উবে যাওয়ার লোকসানে এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন বল তো?
রত্নেশ্বর উত্তেজিতভাবে বলেন, সামান্য? আর ওই উবে যাওয়ার রহস্যটা? সেটা অসামান্য নয়? সেটা ভেদ করতে না পারলে?
আরে দুর! আমাদের আশপাশে কত রহস্যের জাল বিছানো। সব ভেদ হচ্ছে? ওর মধ্যেই হেসে-খেলে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হল! নিজেরও শান্তি অপরেরও শান্তি।
তা বলে ওই ভাঙানৌকোর মাঝিটা কে, তা জানতে হবে না?
প্রাণকেষ্ট একটু হেসে উঠে বলেন, ভূতও হতে পারে। ভগবানও হতে পারে, ও নিয়ে মাথা ব্যথায় কাজ কী বাবা?
পরিবেশ সেই পচা পুরোনো কাদাখোঁচা পার্ক। সেই রেলিংভাঙা বেঞ্চ, সেই সন্ধ্যাকাল, আর সেই দুই উনসত্তুরে বুড়ো!
রত্নেশ্বরের ফেরার খবর পেয়েই পাড়াসুদ্ধু লোক ওঁদের বাড়িতে ভেঙে পড়েছিল। প্রাণকেষ্টও এসেছিলেন, তবে মুখে একটা রুমাল চাপা দিয়ে।
রত্নেশ্বরের ছেলেরা বলে উঠেছিল, এ কী কাকু?
প্রাণকেষ্ট বলেছিলেন, তোদের বাবা বলেছিল, আমার মুখদর্শন করবে না। তাই—
‘বুড়োবয়েসে ছ্যাবলামি করিস না প্রাণকেষ্ট—’ রত্নেশ্বর বলে উঠেছিলেন, বোস। আজ না হয় আমার সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেয়ে নিবি।
প্রাণকেষ্ট হইচই করে উঠেছিলেন, না ভাই না। গিন্নি আজ আটদিন পরে সমারোহ করে রাঁধতে বসেছেন! এ ক-দিন তো উনুন জ্বালেনি। শুধু চায়ের ওপর চালিয়েছেন।
ঠিক আছে! তাহলে—সেই যথাসময়ে আমাদের পীঠস্থানে দেখা হবে, কথা হবে!
এখন হচ্ছে সেই কথা!
ওই সাতটা দিন হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কিচ্ছু— ভাবব না?
দরকারটা কী?…তবে ভাবলে ভাবতে পারিস ওর ফলেই তোর মনের বোকামি ঘুচল! টের পেলি সংসারে তোর কত দাম। সবাই তোকে কত ভালোবাসে।…পরদিনই ফিরে এলে ভাগ্যে তো শুধু সেই বকুনিই জুটত। যাতে আরও চটতিস।
কিন্তু গপ্পোটা কি বানানো হবে?
গপ্পো? দুর! সেটা আবার একটা সমস্যা নাকি! বললেই বলতে পারা যায় একটা ভণ্ড সাধুর খপ্পরে পড়ে সন্নিসি হবার তালে— তার সঙ্গে চলে গিয়েছিলি। হঠাৎ ছেলেপুলে নাতি-পুতি ভাই ভাইপোদের জন্যে মন কেমন করে ওঠায়, সটকে এসেছিস!
যদি বলে, ‘সঙ্গের ওই লোকটা কে? যে টাকা না নিয়ে চলে গেল?’
বলবি—ও একটা প্রকৃত সাধু আমাকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। ওর কাছে টাকা মাটি, মাটি টাকা!
যদি বলে, সাত-সাতটা দিন সাধুর আশ্রমে কাটিয়ে এলে, কই, দাড়ি-টাড়ি তো গজায়নি। সঙ্গে কি শেভিংসেট নিয়ে গেছলে!
ওঃ! রতনা। এখনও কি গোয়েন্দা গল্প-টল্প পড়িস নাকি? এতও মাথায় আসছে?
বা:! আসবে না? গল্পের মধ্যে ফাঁক থাকলে চলে?…
তাহলে বলবি, ‘ফেরার সময় একটা রাস্তায় নাপিতের কাছে কামিয়ে এসেছি।’
তা বলা যায় বটে। …তবু একটা ভাবনা থেকেই যাবে। যদি সেই নাইলনের দড়িখানা বাগিয়ে নেওয়া লোকটা হঠাৎ এসে হাজির হয়।
আসবে না।
আসবে না? বলছিস?
আমার তো তাই ধারণা হচ্ছে। সেও তোর ওই ভাঙা নৌকার মাঝির মতোই ভূতও হতে পারে, ভগবানও হতে পারে। তোকে তোর দুর্মতি থেকে রক্ষে করতে ছদ্মবেশে উদয় হয়েছিল।
কী জানি! হয়তো তাই। না হলে—দড়িটার জন্যে অমন হ্যাংলামি করবে কেন? ইচ্ছে করলেই তো কুড়ুল উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে কেড়ে নিতে পারত। উঃ। দুর্মতিই বটে। যদি ঘটনাটা ঘটিয়ে বসতাম! তাহলে? তাহলে আজ আমার ছেলেরা আমার শ্রাদ্ধর নেমন্তন্ন পত্তর বিলি করতে বেরোত।
রাখে হরি মারে কে?
তবে তোরও কিছু ক্রেডিট আছে। তুই যদি সেদিন সেই ঘুমের বড়িগুলো নিয়ে অমন ছোটোলোকোমি না করতিস—তাহলে তো হয়েই যেত! খেল খতম! সব ফিনিশ!
থাম! বুদ্ধুর মতো কথা বলিস না। তাহলে ‘হয়েই যেত!’ ওই একথাবা সত্যি ঘুমের বড়ি এনেছিলাম বুঝি আমি!
আনিসনি?
মাথা খারাপ!
‘তাহলে কী সেগুলো? দেখালি যে?
চিনির কোটিং পিপারমেন্ট লজেন্স। …তা সত্যি বলতে সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনের আহ্লাদে টপাটপ সবই প্রায় ফিনিশ করে ফেলেছিলাম। নেহাত তোর নাম করে কিনেছিলাম বলে কিছুটা বাকি রেখেছিলাম। …কে জানত যে তুই পরদিনই ওই কান্ড করবি। …তো-আজ নিয়ে এসেছি সেই ক-টা। নে, খা। পকেট থেকে মোচড়ানো দোমড়ানো সেই সাদা প্যাকেটটা বার করেন প্রাণকেষ্ট। গোটা কতক ছোটো ছোটো সেই লজেন্স বার করে রত্নেশ্বরের হাতে দেন।
রত্নেশ্বর সেক-টা মুখে ফেলে বলে ওঠেন, বা রে বেশ খেতে তো। ঝাঁঝ ঝাঁঝ মিষ্টি! নে এই বাকি দুটো তুই খা।
না না। আমি তো বেশিটাই সাবড়েছি। ও দুটো তুই খা। দুর। তাই কখনও হয়? মনে নেই একসময়—শেষ চিনেবাদামটির দানাটা দু-ভাগ করে খুলে দুজনে খেয়েছি।
অথচ তুই আমায় অকূলে ভাসিয়ে রেখে—ছি:!
না! সত্যি, আমি একটা বুদ্ধু!
কিন্তু তারপর?
অনেকক্ষণ হাসিগল্পের পর ফেরার সময় আবার মনের মধ্যে অস্বস্তি জেগে ওঠে। আচ্ছা তা হলে আসল রহস্যটা কী? আর ওই সাত-সাতটা দিনরাত্তির গেল কোথায়?
এর জবাব কি পাবেন কোনোদিন বাইশের তিন যজ্ঞেশ্বর লেনের রত্নেশ্বর রায়!
পরে পাওয়ার চেষ্টা করেননি তা নয়। দুই বন্ধুতে একদিন চুপি- চুপি বেরিয়ে—শালিমার ঘাট থেকে—দিকে দিকে অনেক তল্লাট খোঁজ করেছেন। … কোথায় বা সেই কুঁড়েবাড়ি, কোথায় বা ওলটানো নৌকো!
কিন্তু কোনো— শ্মশানঘাট?
তার কাছাকাছি চায়ের দোকান?
দিনরাত চালু থাকা ভাতের হোটেল?
কোথায় কী?
সমস্ত এলাকাটা জুড়ে তো ঠাসা দোকান-বাজার। জমজমাটি কারবার।
ব্যাবসা-বাণিজ্যের জায়গা, কলকারখানা। ফাঁকা জায়গা বলে কোথাও কিছু নেই।
কাছাকাছি কি কোথাও ‘বুধের হাট’ হয়?
বুধের হাট?
নামই শোনেনি কেউ।
তাহলে? রহস্যটা কী?
সবকিছুই যদি ‘স্বপ্ন’ বলেও মেনে নিতে হয়, তো দিন সাতটা গেল কোথায়?