5 of 8

ব্যাটবল

ব্যাটবল

ক্রিকেট নিয়ে আমাকে লিখতে বলা কেন? খেলিনি। দূর, গরিব মফস্বলে আমরা ছোট বয়েসে যে খেলা খেলেছি সেটা অনেকটা ক্রিকেটের মতো, কিন্তু ক্রিকেট নয়, আমরা খেলেছি ব্যাটবল।

কিন্তু কলকাতা যখনই ক্রিকেট-জ্বরে আক্রান্ত হয়, ক্রীড়া উত্তাপের থার্মোমিটারে পারদের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে আমার মতো ক্রিকেট অর্বাচীনের ওপর চাপ আসে খেলা নিয়ে লেখার জন্যে। গত পনেরো বছর নিয়মিতভাবে এ ব্যাপারটা ঘটে যাচ্ছে।

আমি ক্রিকেটের সূক্ষ্ম ব্যাপারটা কিছুই বুঝি না। ক্রিকেট সংক্রান্ত গল্পগুজবেও খুব রুচি নেই। এ বিষয়ে বইও পড়িনি।

একথা ঠিক ক্রিকেটের মোটা দাগের ব্যাপারগুলো যেমন রান করা, আউট হওয়া, বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি, ক্যাচ ফসকানো, হিট-উইকেট—এগুলো আমি ভালই বুঝতে পারি। তবে এল বি ডব্লু আর রান আউট নিয়ে অনেক সময়েই খটকায় ভুগি।

ক্রিকেট নিয়ে লেখার অধিকার আছে সুনীল গাভাসকার কিংবা পঙ্কজ রায়ের, স্বমহিমাতেই তাঁরা ক্রিকেটের জটিলতম সমস্যায় আলোকপাত করতে পারেন, উপদেশ দিতে পারেন, ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার জোরে লিখতে পারেন শ্যামসুন্দর ঘোষ কিংবা জয়ন্ত চক্রবর্তী।

এ কথা অবশ্য সত্যি যে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার বন্ধু-ভ্রাতা, চুনী গোস্বামী আমার সুহৃদ, একদা অরুণলালের পাড়ায় বাস করতাম, এখনও সান্ধ্যপানীয় প্রয়োজন হলে সেটা সংগ্রহ করি প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটারের সুরাবিপণি থেকে। কিন্তু তাই বলে এসবের কোনও একটি বা একাধিক কারণে আমি ক্রিকেট সম্পর্কে লেখার যোগ্যতা অর্জন করেছি তা তো নয়।

আসলে সমস্যাটার শুরু হয়েছিল প্রায় চার দশক আগে। বোধহয় আনন্দবাজার পত্রিকায় সন্তোষকুমার ঘোষ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে রাজি করিয়ে ছিলেন তখনকার ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচের প্রাত্যহিক ক্রীড়াবিবরণী লিখতে। কল্লোল যুগের সাহিত্যিক, পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের অচিন্ত্যকুমার ছিলেন ভাষার জাদুকর এবং প্রকৃত ক্রিকেট বোদ্ধা। তাঁর সেই ক্রীড়াভাষ্য সে সময়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

তারপর ক্রিকেট-রসিক এবং সুরসিক শ্রী শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ক্রীড়া কৌতুকময় প্রতিবেদন ও আলোচনাগুলি পাঠকদের মুগ্ধ করে। সেই সময়ে আমার প্রাণের বন্ধু মতি নন্দী খেলা ও সাহিত্যকে এক সঙ্গে মিলিয়ে ছিলেন। গল্পে-উপন্যাসে খেলা ঢুকে গেল, ক্রীড়াসংবাদ সাহিত্য হয়ে উঠল।

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। বাংলা ভাষার ক্রীড়া সাংবাদিকেরা অনেকেই এখন কবিতার ভাষায় প্রতিবেদন রচনা করেন। যুক্তি, তথ্য সেখানে থাকে কিন্তু তার পরিবেশন খুবই চিত্তগ্রাহী।

ঠিক এর মধ্যে আমি কোথা থেকে এলাম, তা নিয়ে আমি কিছুটা ভেবেছি। ক্রিকেট পুজোর বোধনের ঢাকে কাঠি পড়লেই কেন আমার খোঁজ পড়ে। এ যাবৎ কত যে উলটো-পালটা, ভুল-শুদ্ধ লিখেছি পাঠক-পাঠিকারা হাসতে হাসতে মার্জনা করে দিয়েছেন।

বাংলা ভাষায় একটি চমৎকার যুগ্ম শব্দ আছে ক্রীড়া-কৌতুক। ক্রীড়া ও কৌতুক, ক্রীড়া-কৌতুক পরিষ্কার দ্বন্দ্ব সমাস।

এই ক্রীড়া-কৌতুকই আমার কাল হয়েছে। ক্রীড়া যখন শুরু হয়েছে, সঙ্গে কৌতুকও চাই। সেই কৌতুকে ক্রীড়া ব্যাপারটা রীতিমতো বেসামাল হয়ে যায়। তা হোক। বৈচিত্র্যের জন্যে একটু কৌতুক চাই।

কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে কৌতুককাহিনী তো তেমন জানি না। রচনার প্রসঙ্গেই বলেছি যে আমাদের ছেলেবয়সে আমরা ক্রিকেট খেলিনি। খেলেছি ব্যাটবল।

ব্যাটবলের প্রসঙ্গে আসছি। তার আগে একটি অল্প দিন আগের অভিজ্ঞতার কথা বলি।

অলস, কর্মহীন দুপুরবেলায় ঘুমোব না প্রতিজ্ঞা করে বিছানায় বসে অন্যমনস্কভাবে রেডিয়োর নব ঘোরাচ্ছিলাম। এক জায়গায় এসে থেমে গেলাম। বাংলাদেশের কোনও কেন্দ্র থেকে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী প্রচার হচ্ছে, শুনতে পেলাম ‘বেটে বলে হুলো না।’ যিনি বাঙাল ভাষার ব্যাপারটায় সড়গড় নন তাঁর পক্ষে কথাটা বোঝা কঠিন। তিনি ভাবতে পারেন কোনও এক ব্যক্তির কথা হচ্ছে, সেই ব্যক্তি বেঁটে কিন্তু তাই বলে হুলো বা পাজি বেড়ালের মতো নয়।

আসলে কথাটা হল, ‘ব্যাট-বলে হল না।’ বোলার বল করেছেন। ব্যাটসম্যান ব্যাট হাঁকিয়েছেন, কিন্তু ব্যাটে বল লাগেনি।

এই ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে আমি ফিরে গেলাম। ব্যাটবলের পৃথিবীতে। যেখানে আমি জন্মেছিলাম, বড় হয়েছিলাম।

স্কুল-কলেজে এবং অফিসার্স ক্লাবে দেখেছি বটে কিন্তু ক্রিকেটের ব্যাট আমাদের হাত দিয়ে ছোঁয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তক্তা কেটে ব্যাটের আকার করে ছুতোর মিস্ত্রি দিয়ে বানানো হত আমাদের ব্যাট। তার সাইজের হেরফের হত, লম্বায়-পাশে কম বেশি। তবে খুব বেঢপ হত না।

অফিসার্স ক্লাবের মালিদের কাছ থেকে ব্যবহৃত টেনিসবল কিনে আনতাম, তিন আনা চার আনা দাম। ছয় আনা খরচ করলে পাড়ার মুচি চামড়ার বল সেলাই করে বানিয়ে দিত। রবারের টুকরো, চামড়ার কুচি, ছোট ছোট পাথরকুচি, এই সব পোরা থাকত সেই বলের পেটে। ব্যাট দিয়ে মারলে ক্রিকেট বলের মতোই শব্দ হত, যেটা টেনিস বলে হত না।

উইকেট তৈরি হত বাঁশের লগা বা কঞ্চি দিয়ে। একদিকে তিনটে, সেদিকে ব্যাটসম্যান আর অন্যদিকে একটা, সেদিকে বোলার। বল সর্বদাই একদিক থেকে হত, দিক বদল হত না। ওভারের শেষে ব্যাটসম্যানদের স্থান বদল হত।

উঁচুনিচু জমির মতো একটু সমতল জায়গায় খেলার মাঠ। চার পাশেই ঝোপজঙ্গল, খানা ডোবা। ছোট মাঠ। বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি অতি সহজেই হত তাই বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারিতে চার বা ছয় না হয়ে যথাক্রমে দুই এবং তিন হত। চারদিকে ডোবা জঙ্গল এইসব থাকায় মাঝে মাঝে বল হারিয়ে যেত। অনেক আলোচনা করে, সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বল হারিয়ে গেলে হবে সেঞ্চুরি। কিন্তু যে সেঞ্চুরি করবে, তাকে বলের দামটা দিতে হবে। এই নিয়মের ফলে আমাদের খেলায় সেঞ্চুরি করা একদম কমে গিয়েছিল।

কয়েক বছর আগেও দেশে গিয়ে দেখেছি আমাদের সেই ব্যাটবল খেলা আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। ছেলেরা দল বেঁধে মনের আনন্দে তক্তাকাটা ব্যাট দিয়ে রবারের বল হইচই করে পেটাচ্ছে।

পুনশ্চঃ

অবশেষে ক্রিকেটের একটা নতুন গল্প বলি।

খেলার মাঠ থেকে দিনের শেষে বেরচ্ছি। এমন সময় পাশ থেকে দেখি চার-পাঁচজন যুবক গরদের পাঞ্জাবি, তাঁতের ধুতি পরিহিত অন্য একটি যুবককে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে, মুখে বলছে, ‘দাদা, তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দিন বর যাচ্ছে।’

‘খেলার মাঠে বর?’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্নটা করতেই গরদের পাঞ্জাবি বলল, ‘গোধূলি লগ্নে বিয়ে হলে আজ আমার এমন রোমাঞ্চকর খেলাটা দেখা হত না। ভাগ্যিস লগ্ন পড়েছে রাত দশটায়।’ এই বলে সে একটু সলজ্জ চেয়ে দ্রুত পা চালাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *