ব্যাঙ্ক ডাকাত কুপোকাত – সমরেশ মজুমদার

ব্যাঙ্ক ডাকাত কুপোকাত – সমরেশ মজুমদার

ঠোঁটের ওপর ঈষৎ লালচে লোম ক্রমশ কালচে হয়ে যাচ্ছে। অজান্তেই ওখানে আঙুল চলে যায়, খসখস করে নাকের তলা। চুল আঁচড়াতে গেলেই বারংবার দৃষ্টি ওখানে আটকে যায়। কিন্তু, একে যদি গোঁফ বলা যায় তা হলে তা বড্ড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু এটা তো ঠিক, তাপস বড় হয়েছে এই হল তার প্রমাণ। ওদের ক্লাসে একমাত্র নীতীশের এরকম গোঁফ আছে। আর বাকি সবাই এখনও ছোটদের দলে। ইদানীং তাপসের গলার স্বরটাও বেশ পালটে গেছে। সেই রিনরিনে ভাবটা এখন মোটেই নেই। অথচ বাড়ির কেউ তার এইসব পরিবর্তন যেন লক্ষই করছে না। এমনকী তাপস যে বড় হয়েছে সেদিকেও কারও হুঁশ নেই। গতমাসে সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে সে কয়েকটা ছবি দেখে এসেছে। সেলুনওয়ালা একজন সাহেবের অনেকরকম গোঁফের ছবি। কী তার কায়দা! দেখেই মনে হয় আমারটাও অমন করে নিই। চুলকাটার সময় আড়চোখে তার একটা পছন্দ করে রেখেছে। প্রজাপতি গোঁফ। কিন্তু মুশকিল হল, সে নিজে থেকে গোঁফটায় স্টাইল কী করে করবে? বাবা নিশ্চয়ই অবাক চোখে ওর মুখের দিকে তাকাবেন! অসম্ভব, সহ্য করা যাবে না। বাড়িতে হারানদা আসে দাদুর দাড়ি কামাতে। ওকে ম্যানেজ করলে কেমন হয়। সবার সামনে বলবে, ‘দাদাবাবু, এসো তোমার গোঁফ ছেঁটে দিই।’ দেখা হলেই যদি বলতে পারে, এসো চুল ছাঁটি, তা হলে গোঁফ বলতে দোষ কী। তখন দাদু যদি একবার হ্যাঁ বলেন তো হয়ে গেল। নীতীশকে টপকে ও ক্লাসের একমাত্র অ্যাডাল্ট হতে পারবে।

আজ দুপুরে হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় তাপস হারানদাকে ধরবে বলে বটতলায় এসেছিল। আগেভাগে ম্যানেজ করে রাখলে সামনের রবিবারই কাজটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বটতলা ফাঁকা। ইটালিয়ান সেলুন বন্ধ। জায়গাটা এমনিতেই নির্জন, তার ওপর দুপুরের রোদ ফুটছে বলে রাস্তায় লোকজন নেই বললেই হয়। এটা বাড়ির পথ নয়, তাপসের ইচ্ছে হল ‘লিপিকা’র সামনে দিয়ে ঘুরে যাবার। লিপিকাতে এখন দারুণ ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ চলছে। একবার দেখা হয়ে গেছে কাকুর সঙ্গে, তবু বাইরে টাঙানো ছবিগুলোকে দেখারও একটা আরাম আছে।

সামান্য এগোতেই তাপস দেখতে পেল একটা কালো অ্যামবাসাডার গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। ওটা যে মিশিরলালজির গাড়ি তা এ শহরে সবাই জানে। তবে গাড়িটা চালাচ্ছে অন্য লোক, মিশিরলালজির ড্রাইভার নয়। ভেতরে আরও পাঁচজন বসে ছিল, গড়ানো গাড়ি থেকে দু’জন নেমে দাঁড়াল। আরও খানিক এগিয়ে বাকি তিনজনকে নামিয়ে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে থেমে গেল। ব্যাপারটা এমন কিছু নজরে পড়ার নয়, কিন্তু মিশিরলালজির গাড়ি এবং ড্রাইভার নেই বলেই তাপস ওদের দেখছিল। মজার ব্যাপার হল, গাড়িটা থামতেই ড্রাইভার নেমে এসে বনেট খুলে ইঞ্জিনটাকে দেখতে লাগল এমন ভঙ্গিতে যেন ওটা গোলমাল করছে।

‘লিপিকা’ এখান থেকে বেশ দূরে। তাপস চুপচাপ গাড়িটার পাশে এসে দেখল লোকটা ঝুঁকে পড়ে সিগারেট খাচ্ছে, ইঞ্জিনের দিকে নজর নেই। কেউ কাছে এসেছে বুঝতে পেরে লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। বেশ বড় গোঁফ এবং জুলপি প্রায় ঠোঁটের বরাবর নেমে এসেছে। তাপসকে দেখে লোকটা বিরক্ত কিন্তু সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, “এই, কী চাস এখানে, ভাগ!”

“অমন করে কথা বলছেন কেন?” লোকটার ওপর তাপসের বেশ রাগ হল।

“কী করে কথা বলব চাঁদ, ননি খাইয়ে? যা, কাট এখান থেকে!”

“কেন, এটা কি আপনার জায়গা?”

“মারব টেনে এক থাবড়া, বাপের নাম খগেন হয়ে যাবে।” লোকটা সত্যি সত্যি হাত উঁচু করে ওর দিকে এগিয়ে এল।

এমন সময় দূর থেকে একটা গলা শোনা গেল, “পার্টনার, কী হচ্ছে কী?”

তাপস দেখল প্রথম দু’জন যারা একটু আগে গাড়ি থেকে নেমেছিল তাদের একজন রাস্তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাকি চারজনের কোনও হদিশ পেল না সে। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

হঠাৎ কানের ভিতরটা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। তাপসের ডান কান মুঠোয় ধরে লোকটা বলল, “মুখে মুখে তর্ক করা একদম পছন্দ করি না আমি। যা, এক দৌড়ে বাড়ি চলে যা।”

খামোকা গালাগালি খেয়ে তাপসের মন বিচ্ছিরি হয়ে গিয়েছিল, এখন কান ব্যথা করে উঠতেই সে ছটফটিয়ে সদ্য-শেখা লাথি এবং ডান হাতের পাশ দিয়ে আঘাত করাটা প্রয়োগ করল। লিপিকায় দেখা ছবির নায়কের মতো সেটা করতেই লোকটার মুখ হতভম্ব হয়ে গেল। তলপেটের ওপর তাপস পৌঁছাতে পারেনি বলেই বোধহয় আঘাতটা বেদম হয়েছিল, কারণ একটু বাদেই লোকটা ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। ব্যাপারটা এমন আকস্মিক যে তাপস নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিল। অতবড় লোকটাকে সে মাটিতে ফেলে দিল? লোকটা একটা হাত পেটে চেপে গোঁ গোঁ করতে করতে অন্য হাতে কোমর থেকে ছুরি বের করছে। তাপসের শরীরে কাঁপুনি এল। লোকটার হাত ওপরে ওঠার আগেই সে একটা পেনাল্টি কিক ঝাড়ল ওর মুখে এবং সেটি করেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় শুরু করল।

ও যে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে এবং পার্টনার বলে চেঁচানো লোকটির কাছে পৌঁছেছে বুঝতে পারেনি। হঠাৎ একটা চাপা ধমক কানে এল, “এই খোকা, দৌড়াচ্ছ কেন?”

তাপস ঘনঘন নিশ্বাস নিতে নিতে দেখল রোগামতন একটা লোকের হাতে কাপড় জড়ানো কিছু, তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে।

তাপস আর একটু হলেই আগের ঘটনাটা বলে ফেলছিল, কিন্তু এই লোকটার চোখমুখ দেখে সে মুহূর্তেই সামলে নিল, “আমার শরীর খারাপ, বাড়িতে যাচ্ছি।”

“শরীর খারাপ? এঃ, শরীর খারাপ হলে কেউ ছোটে?”

“পেট খারাপ।”

‘‘অ। তা হলে অবশ্যি—। পার্টনার তোমাকে কী বলছিল? ওকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?” লোকটা কথা বলছে কিন্তু তার চোখ সামনের দিকে আঠার মতো আটকে আছে। তাপস দূরে দাঁড়ানো গাড়িটা দেখল। না, পড়ে-যাওয়া লোকটা গাড়ির আড়ালে রয়ে গেছে। সে জবাব দিল, “গাড়ি সারাচ্ছে।”

এমন সময় রাস্তার উলটো দিকের একটা দরজা দিয়ে চারজন লোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক কিংবা রিভলভার, অন্য হাতে বড় বড় থলি। তাপস এক পলকে দেখে নিল ওটা স্টেট ব্যাঙ্কের বাড়ি। তাপসের সামনে দাঁড়ানো লোকটা ‘যা ভাগ’ বলে দৌড়াতে লাগল ওদের পিছু পিছু। এবং সেই সময় ওর হাতের কাপড়টা সরে গিয়ে স্টেনগানের মতো কিছু দেখা গেল। তাপসের বুঝতে অসুবিধে হল না এরা ব্যাঙ্ক ডাকাত, নির্ঘাত স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে ডাকাতি করে ফিরে যাচ্ছে। সে এখন কী করবে? নার্ভাস হয়ে রাস্তার দু’পাশে তাকাল। না, কেউ নেই। এমনকী স্টেট ব্যাঙ্ক থেকেও কেউ বের হচ্ছে না।

লোকগুলো দৌড়ে যাচ্ছে গাড়িটার দিকে। তাপস এবার ভয় পেল। ওরা যদি জানতে পারে সে ওদের একজনকে মেরেছে তা হলে—! সোজা দৌড়লে ওরা ওকে দেখে ফেলবে। হঠাৎ তার খেয়াল হল ব্যাঙ্কের একটা লোকও বের হচ্ছে না কেন? সবাইকে কি ওরা মেরে ফেলেছে? সে কিছু না ভেবে রাস্তা পার হয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়ল। এখানে ওর বন্ধু বিজুর ছোটকাকা কাজ করেন। কিন্তু কাউকেই সে প্রথমে দেখতে পেল না। সমস্ত ব্যাঙ্কটা যেন জনশূন্য। কাগজপত্র চারধারে ছড়ানো। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে সে আবার দরজার কাছে ফিরে উঁকি মেরে দেখল ওরা তখনও যায়নি। গাড়িটাকে ঘিরে ওরা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। কী ব্যাপার বুঝতে না পেরে সে ঘুরে দাঁড়াতেই দরজায় কেউ আঘাত করছে টের পেল। দরজাটা আবিষ্কার করতে দেরি হল না, কিন্তু তালা লাগানো থাকায় সে কিছুতেই খুলতে পারল না। তাপস বুঝল ব্যাঙ্কের লোকজন এই ঘরে বন্দি হয়ে রয়েছে।

এবং এইসময় চাবির তোড়াটাকে দেখতে পেল তাপস। ঘরের এক কোণে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। চকিতে সেটাকে তুলে নিয়ে সে একটার পর একটা চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে দরজাটা খুলে গেল। জলস্রোতের মতো মানুষেরা বেরিয়ে এল। ভীত সন্ত্রস্ত মুখগুলো যেন ওকে আশাই করেনি। বিজুর কাকা ওকে চিনতে পেরে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই এখানে?”

“হারানদার খোঁজে এসেছিলাম।”

“কেন?”

“গোঁফ ছাঁটতে—” কথাটা শেষ করল না তাপস। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাটা। “অ্যাঁ, গোঁফ!” বিজুর কাকার মুখ দেখবার মতো। বললেন, “ডাকাতদের দেখেছিস?”

ঘাড় কাত করল তাপস, “হ্যাঁ। বাইরে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থুল পড়ে গেল। ডাকাতি করেও ডাকাতরা রাস্তায় রয়ে গেছে এখনও। একজন থানায় টেলিফোন করতে গিয়ে দেখল লাইন কাটা। ততক্ষণে দরজায় পৌঁছে গেছে কেউ কেউ। বাইরে চিৎকার উঠেছে, ডাকাত ডাকাত। তাপসও ছুটে দরজার কাছে চলে এল। গাড়িটা তখনও দাঁড়িয়ে, ছয়জন যে যার সিটে বসে, কিন্তু গাড়িটাই চলছে না।

চিৎকার শুনে একটু একটু করে লোক জমছে। হঠাৎ একটা ডাকাত গাড়ি থেকে বেরিয়ে বোমা ছুড়ল। প্রচণ্ড শব্দ করে সেটা ব্যাঙ্কের কাছে ফাটতেই সবাই পড়িমড়ি করে দৌড়াল। তাপস একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। ও ভেবে পাচ্ছিল না ওরা গাড়িটা চালিয়ে চলে যাচ্ছে না কেন? গাড়ি তো খারাপ ছিল না, তা হলে?

সেই সময় পাঁচজন নেমে এল গাড়ি থেকে। প্রত্যেকের হাতে ব্যাগ এবং অস্ত্র। একজন চিৎকার করে উঠল, “কেউ যদি আমাদের পেছনে আসে তা হলে শেষ করে দেব।” এই বলে ওরা বটতলার দিকে হাঁটতে লাগল। তাপস দেখল ষষ্ঠ লোকটি, যাকে সে লাথি মেরেছিল, সে গাড়ি থেকে নামল না। তার মাথাটা দেখা যাচ্ছে কাচের জানালা দিয়ে। ওকে ওরা ফেলে যাচ্ছে কেন?

পাঁচজন যখন বেশ কিছুটা দূরে তখন তাপস ছুটে গেল গাড়িটার কাছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সামনের সিটটা। লোকটা হেলান দিয়ে রয়েছে, চোখ বন্ধ। প্রথমে মনে হয়েছিল মরে গেছে। ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে ব্যাঙ্কের লোকজন ছুটে এসেছে। দূরে পাঁচজন এবার ছুটছে।

ব্যাঙ্কের লোকজনই ড্রাইভারটাকে টেনে নামাল। ওকে ছুরি মারা হয়েছে, পেটে পিঠে এবং বুকে। এখনও টিমটিম করছে তার প্রাণ। বিজুর কাকা ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাকে ছুরি মারল কেন?”

কোনওরকমে চোখ খুলল লোকটা, তারপর ফিসফিস করে বলল, “গাড়ি চালাতে পারছিলাম না। একটা ছোঁড়া আমার তলপেটে—।”

“ওরা গাড়ি চালাতে জানে না?”

সামান্য মাথা নেড়ে লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেল।

এবার পুলিশের গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। অ্যাম্বুলেন্সও আসছে। চটজলদি শুনে নিয়ে পুলিশের গাড়িগুলো তেড়ে গেল দূরে মিলিয়ে আসা ডাকাতদের উদ্দেশে।

লোকটাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল, এইসময় আবার জ্ঞান ফিরে এল তার। চোখ খুলতেই তাপসকে দেখতে পেয়ে সে বলে উঠল, “এই ছোঁড়া, এই ছোঁড়া!” তারপরই জ্ঞান হারাল।

সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা তাপসকে ঘিরে ধরল। বিজুর কাকা ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই ওর তলপেটে কী করেছিলি?”

“আমার কান ধরেছিল বলে লাথি মেরেছিলাম। কুংফু।”

অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাপসের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সবাই বলতে লাগল তাপস ড্রাইভারটাকে অকেজো করে দিয়েছিল বলে ওরা পালাতে পারেনি। বিজুর কাকা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু তাপসের নজর তখন ভিড়ের দিকে। কৌতূহলী মানুষগুলোর মধ্যে হারানদা এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে কাঠের হাজামবাক্স। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে হারানদা।

তাপস নিজের অজান্তে গোঁফে হাত বোলাল।

ওদিকে তখন গোলাগুলির শব্দ শুরু হয়েছে, পুলিশে ডাকাতে ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে।

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮২

ছবি: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *