ব্যাঙ্ক ডাকাত আর লাফানো থলে – শেখর বসু
অফিসপাড়ার ব্যাঙ্ক। বেলা দেড়টা। ব্যস্ত হাতে টাকার লেনদেন হচ্ছে কাউন্টারে। কাউন্টারের ওপাশে আর এপাশে সেই পরিচিত দৃশ্য। এদিকে খদ্দের ওদিকে ব্যাঙ্ক-কর্মচারী। কোথাও কোনো ঝক্কিঝামেলা নেই, অন্তত বাইরের চেহারা দেখলে তাই মনে হবে, কিন্তু ভেতর-ভেতরে ভয়ংকর এক কান্ড ঘটতে চলেছিল সেই মুহূর্তে।
ক্যাশিয়ার সুপ্রকাশ কাউন্টারের ওপাশের খদ্দেরের কাছ থেকে ছোট্ট একটা স্লিপ পেল। স্লিপে গোটাগোটা করে লেখা আছে: আমরা ব্যাঙ্ক ডাকাত। আমাদের প্রত্যেকের কাছে ভরতি করে দিয়ে দাও।
স্লিপটা পড়ে সুপ্রকাশ চোখ তুলতেই দেখতে পেল, কাউন্টারের সামনে কালো চশমা পরা তিনটে শক্ত চোয়ালের লোক দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় লোকগুলো পাকা ডাকাত, এদের পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব।
সুপ্রকাশের চাকরি বেশিদিনের নয়, কোনোরকম গন্ডগোলে পড়লেই ও হেড-ক্যাশিয়ার মধুসূদনবাবুর কাছে ছোটে। মধুসূদনবাবু সবরকম কাজই খুব ভালোভাবে জানেন। পরোপকারী এবং রসিক, মজাদার কথা বলতে বলতে গন্ডগোল থেকে উদ্ধার করে দেন সুপ্রকাশকে। বিচিত্র এই বিপদের মধ্যে পড়ার পরেই যার কথা মনে পড়ল তাঁর নাম মধুসূদন।
মনে মনে মধুসূদনের স্মরণ নিয়ে ওই কাগজের স্লিপের নীচে সুপ্রকাশ লিখল: সব টাকা হেড ক্যাশিয়ারবাবুর কাছে আছে, উনি আমার পেছনের ঘরে আছেন।
স্লিপে নোট লিখে সেটা সামনের কালো চশমার হাতে তুলে দিল ও।
কালো চশমা নোটের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে লিখল: ঠিক আছে, এটা হেড-ক্যাশিয়ারকে দাও। এক্ষুনি টাকা চাই, নাহলে সবাইকে গুলি করে উড়িয়ে দেব।
সুপ্রকাশ নতুন এই নোটটা পড়ার পরেই কাউন্টার থেকে ভাঁজকরা পলিথিনের একটা ব্যাগ পড়ল ঠক করে। সুপ্রকাশ একটাও কথা না বলে পেছনের লোহার জালের ফাঁক দিয়ে ব্যাগ আর কাগজের টুকরো এগিয়ে দিল হেড ক্যাশিয়ার মধূসূদনবাবুর দিকে। উনি হাত বাড়িয়ে ওই কাগজের টুকরো আর ব্যাগ নিলেন।
কাউন্টার থেকে মধুসূদনবাবুর শরীরের পাঁচ ভাগের একভাগ মাত্র দেখা যায়! সুতরাং কাউন্টারের কালো চশমারা বুঝতে পারল না নোট পড়ে হেড-ক্যাশিয়ারবাবুর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, কিংবা উনি এখন ঠিক কী করছেন!
জানা গেল একটু বাদেই। মধুসূদনবাবু একটু ঝুঁকে পড়ে দুহাত তুলে একটা ইঙ্গিত করলেন। যার অর্থ—কই হে, তোমার লোক কোথায়?
সুপ্রকাশ আঙুল তুলে কালো চশমাদের দেখিয়ে দিল। তাই দেখে সচকিত হয়ে উঠল কালো চশমারা। মধুসূদনবাবু এবার পলিথিনের একটা পেটমোটা থলে সামান্য উঁচুতে তুলে আর একটা ইঙ্গিত করলেন। যার অর্থ—ওদিক থেকে একজন ভেতরে এসে থলেটা নিয়ে যাও।
কালো চশমারা অমনি নানারকম পজিশনে দাঁড়িয়ে পড়ল চটপট। অর্থাৎ চালাকি করলে টের পাবে মজা। একজন কালো চশমা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে টুক করে ভেতরে ঢুকে মধুসূদনবাবুর হাত থেকে ভারী ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত বাইরে চলে এল।
আশেপাশে কত লোক, কিন্তু কারও পক্ষে বোধহয় কল্পনা করাও সম্ভব নয় কী ঘটে চলেছে এখন। বেলা দেড়টা থেকে একটা পঁয়ত্রিশ—এই পাঁচ মিনিটের মধ্যে নি:শব্দে ভয়ংকর একটা কান্ড ঘটে গেল। কিন্তু সবাই সবকিছু জানতে পারল আর একমিনিট বাদেই।
পুশ-ডোর দিয়ে বেরুতে গিয়েই কালো চশমা-পরা একটা লোক ‘ওরে বাবারে’ বলে ছিটকে পড়ল একপাশে। তার হাতের পলিথিনের ব্যাগটাও ছিটকে পড়েছে মেঝেতে। কিন্তু অবাক কান্ড! ব্যাগটা নিজে থেকেই লাফিয়ে যাচ্ছে তিড়িংবিড়িং করে। আর একজন কালো চশমা সেটাকে জড়িয়ে ধরে পালাবার চেষ্টা করতেই আছাড় খেল বিচ্ছিরিভাবে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট একটা পটকার শব্দ। ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার হয়ে গেল চতুর্দিক। চিৎকার-চেঁচামেচি আর্তনাদ। শব্দ শুনে ছুটে এল ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড আর রাস্তা থেকে পুলিশ। পুলিশ দেখে সাহস পেয়ে সুপ্রকাশ এক কালো চশমার দিকে আঙুল তুলে চেঁচাতে লাগল—ওকে ধরুন, ওকে ধরুন—ব্যাঙ্ক-ডাকাত।
পুলিশ আর সিকিউরিটি গার্ডদের তৎপরতায় চারজন ব্যাঙ্ক-ডাকাত ধরা পড়ে গেল চটপট। ডাকাতরা আর লড়বার চেষ্টা করল না। লড়ে কী লাভ, অফিসপাড়ার ব্যাঙ্ক, পটকার শব্দ আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে কয়েকশো লোক জমে গেছে রাস্তায়।
চারজন সশস্ত্র ব্যাঙ্ক-ডাকাত ভদ্রলোকের মতো আত্মসমর্পণ করল পুলিশের হাতে। এত সহজে চারজন কুখ্যাত ব্যাঙ্ক-ডাকাতকে ধরতে পেরে পুলিশদের আনন্দ দেখে কে! ডাকাতদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হল চারটে পিস্তল আর তিনটে পটকা। পটকার সংখ্যা ছিল চার। একটা তো একটু আগেই ফেটে গেছে। পটকাগুলো নির্দোষ ফাটলে বিকট আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় ধোঁয়া বার হয়। এগুলো লোকজনকে ভয় দেখিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য। কিন্তু পিস্তলগুলো আসল। আসল পিস্তল থেকে চটপট গুলি বার করে নিল পুলিশের লোকরা।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, টাকাভরতি থলিটা তখন থেকে তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়েই যাচ্ছে মেঝের ওপর। পুলিশের কাছে ডাকাত ধরার চাইতে টাকার থলি ধরা কঠিন কাজ হয়ে উঠল। চারদিকে বিস্তর লোকজন, মধ্যিখানে লাফানো টাকার থলি।
এমন কান্ড কেউ কখনো দেখেনি! কিন্তু আর দেরি করা ঠিক নয়, টাকার থলিটা এইভাবে লাফাতে লাফাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে চম্পট দিতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে।
সাহসী পুলিশ সার্জেন্ট কিছুক্ষণ দোনামোনা করার পরে লাফিয়ে পড়ে টাকার থলিটাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর উফ বলে ছিটকে গেল পাঁচ হাত দূরে। সার্জেন্টের ডান হাতে রক্তের দাগ ফুটে উঠেছে। এ তো খুনি টাকার থলে।
ব্যাগের দিকে এগোতে আর কেউ সাহস পেল না। ব্যাগটা আগের মতোই তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে যাচ্ছিল মেঝের ওপর।
এমন সময় পেছন থেকে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন মধুসূদনবাবু। তারপর নির্ভয়ে ব্যাগের কাছে গিয়ে মুখ দিয়ে চুক-চুক করে আওয়াজ তুললেন। আর কী আশ্চর্য, ওই আওয়াজেই শান্ত হয়ে গেল ব্যাগটা।
মধুসূদনবাবু ব্যাগের মুখের বাঁধন খুলে ভেতর থেকে বার করলেন দুধ-সাদা একটা বেড়াল। বেড়াল দেখে হৈ-হৈ করে উঠল ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা—আরে, এতো ক্যান্টিনের সেই বেড়ালটা।
অফিসের সব ক্যান্টিনেই দু-চারটে করে বেড়াল কেমনভাবে যেন জুটে যায়। ব্যাঙ্কের এই ক্যান্টিনেও দুটো আছে। দুটোর একটা মধুসূদনবাবুর খুব প্রিয়। সব সময় ওঁর পায়ে-পায়ে ঘোরে। মধুসূদনবাবু প্রতিদিনই বাড়ি থেকে বেড়ালটার জন্যে কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসেন অফিসে। বেড়ালটা বসে থাকে ওঁর পায়ের কাছে। কাজের ফাঁকে-ফাঁকে এটাসেটা ওকে খেতে দেন উনি। কিন্তু এই বেড়ালটা ডাকাতদের ব্যাগে গেল কী করে!
ব্যাগে বেড়াল বাদে আর কিছু ওয়েট পেপার ছিল। সব দেখে ডাকাতদের সেকী রাগ! এর জন্যে ধরা পড়তে হল! কিন্তু ধরা পড়ার পরে রাগ দেখাবার কোনো মানেই হয় না।
ডাকাতদের বোকা বানাবার জন্য সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল মধুসূদনবাবুকে। একেই বলে উপস্থিত বুদ্ধি! টাকার নাম করে ব্যাগের মধ্যে বেড়াল আর বাজে কাগজ ভরে দেওয়া। ওই বেড়ালের আঁচড়-কামড় খেয়েই দুটো ডাকাত আছড়ে পড়েছে মেঝেতে। পকেটের পটকা ফেটেছে সেই আঘাতে। তারপরেই ওরা ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।
মধুসূদনবাবুর বাহাদুরি নিয়ে প্রশংসার তুবড়ি উঠছিল চারদিক থেকে। কিন্তু প্রশংসার দিকে একটুও কান দিচ্ছিলেন না উনি। সত্যিকারের গুণী মানুষ বোধহয় এঁদেরই বলা হয়ে থাকে।
পরদিন কাগজে কাগজে মধুসূদনবাবুর উপস্থিত বুদ্ধির কাহিনি ছাপা হল ফলাও করে। এও জানা গেল ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে একটা প্রোমোশান দিয়ে মধুসূদনবাবুর বাহাদুরির স্বীকৃতি দেবে।
মধুসূদনবাবু কিন্তু ঘটনার পর থেকে আশ্চর্য রকমের চুপচাপ হয়ে গেছেন। রসিক, আড্ডাবাজ মানুষ, কিন্তু আজকাল আর কারও সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলেন না। ক্যান্টিনের ওই বেড়ালটার শুধু আদর যত্ন বেড়ে গেছে অনেকখানি। মধুসূদনবাবু বেড়ালটার জন্যে বাড়ি থেকে ভালো-ভালো খাবারদাবার আনছেন রোজ।
একদিন আড়ালে মধুসূদনবাবুকে চেপে ধরল সুপ্রকাশ। ‘দাদা, এতবড়ো একটা কান্ড ঘটে গেল, অথচ আপনি এত চুপচাপ কেন?’
মধুসূদনবাবু শুকনো হেসে বললেন, ‘সব কৃতিত্ব এপ্রিলফুলের। কিন্তু ব্যাপারটা এদ্দূর গড়িয়ে গেছে যে এখন আর ও নিয়ে মুখ খুলতে ভরসা পাচ্ছি না।’
‘মানে?’
মানেটা সহজে মধুসূদনবাবু ভাঙতে চাননি, কিন্তু সুপ্রকাশের চাপের কাছে হার স্বীকার করতে হয়েছিল ওঁকে। সুপ্রকাশ অবশ্য কথা দিয়েছিল, আসল ব্যাপারটা কাউকেই জানাবে না। জানায়ওনি, তবে ব্যাপারটা এখন অনেকদিনের পুরোনো ঘটনা হয়ে গেছে বলে জানাতে আর দোষ নেই। মধুসূদনবাবু ইতিমধ্যে রিটায়ারও করে গেছেন চাকরি থেকে।
আসল ব্যাপারটা জানাচ্ছি এবার তোমাদের। সেদিন ছিল পয়লা এপ্রিল। সেদিন সকালে বাড়ির সবাই মধুসূদনবাবুকে আলাদা আলাদা করে পাঁচবার এপ্রিল ফুল করেছিল। সাতসকালে পাঁচ পাঁচবার বোকা বনে উনি খুব সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। সুপ্রকাশের পাঠানো নোট আর থলে দেখে উনি ধরেই নিয়েছিলেন, সুপ্রকাশও ওঁকে বোকা বানাবার তালে আছে। তাই তিনি পালটা বোকা বানাবার জন্যে সবার চোখের আড়ালে ব্যাগের মধ্যে বেড়াল আর বাজে কাগজপত্র ভরে দিয়েছিলেন।
তারপর কী-কী ঘটেছিল—সেটা তো তোমরা জেনে গেছ আগেই।