ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর

ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর

ললিতাদিত্য তখন কাশ্মীরের রাজা৷ তিনি সিংহাসন অধিকার করেছিলেন ৭৩৩ থেকে ৭৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত৷

তিনি ছিলেন শক্তিশালী দিগ্বিজয়ী৷ তিব্বতিদের, ভুটিয়াদের ও সিন্ধুতীরবর্তী তুর্কিদের দমন করে তিনি নাম কিনেছিলেন৷ ভারতের দেশে দেশেও উড়েছিল তাঁর জয়পতাকা৷ কাশ্মীরের বিখ্যাত মার্তণ্ড-মন্দির তাঁর দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ আজও বিদ্যমান আছে ওই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ৷

সেই সময়ে কনোজ বা কান্যকুব্জে রাজত্ব করতেন আর এক পরাক্রান্ত রাজা, নাম তাঁর যশোবর্মা৷ তাঁর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মগধ ও বঙ্গদেশের রাজারা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন৷ মগধের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত৷ কিন্তু বঙ্গ বা গৌড়ের সিংহাসন ছিল কোন রাজার অধিকারে, ঐতিহাসিকরা আজও তাঁর নাম খুঁজে পাননি৷ তবে তিনি ছিলেন নাকি অসংখ্য হস্তীর অধিকারী৷

চিরকালই এক রাজার উন্নতি আর-এক রাজা দেখতে পারেন না৷ পৃথিবীতে এই নিয়েই যত অশান্তি, যত যুদ্ধবিগ্রহ৷ রাজা যশোবর্মার যশ ললিতাদিত্য সহ্য করতে পারলেন না৷ সসৈন্যে তিনি করলেন যশোবর্মাকে আক্রমণ৷ যশোবর্মা হলেন পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত৷

তখন বঙ্গেশ্বর কতকগুলি হস্তী উপঢৌকন-স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন ললিতাদিত্যের কাছে৷ এর দুটি কারণ থাকতে পারে৷ যশোবর্মার দ্বারা বিজিত বঙ্গেশ্বর শত্রুর পতনে খুশি হয়েই হয়তো ললিতাদিত্যের কাছে উপহার পাঠিয়ে মনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন৷ কিংবা এও হতে পারে, ললিতাদিত্য পাছে বঙ্গদেশও আক্রমণ করেন, সেই ভয়েই তিনি তাঁকে তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন৷

তার পর বঙ্গেশ্বরের কাছে কাশ্মীর থেকে এল আমন্ত্রণ, তাঁকে ললিতাদিত্যের আতিথ্য স্বীকার করতে হবে৷

তখন অষ্টম শতাব্দী চলছে৷ সে সময় বাংলা থেকে কাশ্মীরে যাওয়া বড়ো যে-সে কথা ছিল না৷ তারপর এই আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য এবং ললিতাদিত্যের মনের কথা কেউ জানে না৷ বঙ্গেশ্বর যথেষ্ট ভীত হলেন বটে, কিন্তু উপায় কী? দিগ্বিজয়ী ললিতাদিত্যের আমন্ত্রণ ও আদেশ একই কথা৷

সুদীর্ঘ, দুর্গম পথ পার হয়ে কয়েক মাস পরে বঙ্গেশ্বর কাশ্মীরে গিয়ে উপস্থিত হলেন৷

কাশ্মীরে ললিতাদিত্য একটি নতুন নগর স্থাপন করে তার নাম রেখেছিলেন, ‘পরিহাসপুর’, এখন তাকে ‘পরসপোর’ বলে ডাকা হয়৷ সেখানে ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘পরিহাসকেশব’ নামে দেবতার বিগ্রহ ও মন্দির৷

অবশেষে পরিহাসপুরে হল দুই রাজার সাক্ষাৎকার৷

বঙ্গেশ্বরের মুখ বিষণ্ণ, তখনও তাঁর মনের ভয় ভাঙেনি৷

আসল ব্যাপারটা উপলব্ধি করে ললিতাদিত্য বললেন, ‘রাজন, আশ্বস্ত হন৷ আপনি আমার অতিথি৷ এই আমি ভগবান পরিহাসকেশবকে মধ্যস্থ রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আমার দ্বারা আপনার কোনো অনিষ্ট হবে না৷’

বঙ্গেশ্বর হয়তো আশ্বস্ত হলেন৷

তার পরের ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যায় না৷ বঙ্গেশ্বর যখন ত্রিগামী নামে একটি স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, ললিতাদিত্য তাঁকে হত্যা করে নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলেন৷ হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে এক অসহায় অতিথিকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার কারণ কী? ইতিহাস সে সম্বন্ধে নীরব! এমন অহেতুক বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজলেও আর পাওয়া যায় কি না সন্দেহ৷

যথাসময়ে এই দারুণ দুঃসংবাদ এসে পৌঁছোল বাংলাদেশে৷

সারা দেশ শোকাচ্ছন্ন, রাজপ্রাসাদে হাহাকার৷

কিন্তু নারীর মতো হায়-হায় করে কেঁদে নিজেদের কর্তব্য সমাপ্ত করল না বঙ্গেশ্বরের প্রিয় পরিচারকবৃন্দ৷ বাঘের মুলুক বাংলাদেশে কোনোদিনই দৃপ্তমনের অভাবে হয়নি৷ একালে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই ফিরিঙ্গি বণিকরা বাঙালি কাপুরুষ বলে মিথ্যা অপবাদ রটাবার চেষ্টা করেছে৷ আসলে তারাও বাঙালিদের ভয় করত মনে মনে৷

পরিচারকদের সর্দার ক্রোধকম্পিত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই!’

কেউ প্রশ্ন করল, ‘কেমন করে প্রতিশোধ নেবে?’

‘আমরা কাশ্মীরে যাত্রা করব৷’

‘কোথায় কাশ্মীর, আর কোথায় বাংলা!’

‘দরকার হলে আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও যেতে ছাড়ব না৷ হাত গুটিয়ে বসে থেকে এ অপমান মাথা পেতে সহ্য করব? ভাইসব, আমরা কি বাঙালি নই?’

‘আমরা হচ্ছি মুষ্টিমেয় বিদেশি, সেই সুদূর অজানা দেশে অসংখ্য শত্রুর সামনে গিয়ে আমরা কি দাঁড়াতে পারব? এ অসাধ্যসাধন কি সম্ভবপর?’

‘আমাদের অন্নদাতা প্রভু বিশ্বাসঘাতকের হাতে নিহত৷ যে তাঁর অন্ন গ্রহণ করেছে, সেই-ই আজ একাই হবে একশোজন-সেই-ই আজ করতে পারবে অসাধ্যসাধন৷ আজ কোনো কথা নয়-কাশ্মীরে চলো, কাশ্মীরে চলো৷’

পরিচারকের দল সমস্বরে গর্জন করে উঠল, ‘কাশ্মীরে চলো, কাশ্মীরে চলো!’

দিনের পর দিন যায়, রাতের পর রাত৷ সূর্য ওঠে, চাঁদ ওঠে, উদয়ের পরে অস্ত, মাসের পরে হয় মাসকাবার৷ নদ, নদী, প্রান্তর, দুর্গম কান্তার, দুরারোহ গিরিদরী৷ ক্রোশের পর ক্রোশ-তবু যেন পথের শেষ নাই৷ ঋতুর পর ঋতু চলে যায়-কখনো অগ্নিবাণ হেনে, কখনো তুষারবৃষ্টি করে- তবু পথিকরা শ্রান্ত নয়, তারা চলছে, দুলছে, চলছে৷ একটু শিথিল হয়নি তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা৷

অবশেষে পথের শেষ৷ এই তো কাশ্মীরের সীমান্ত!

কাশ্মীরি রক্ষী সবিস্ময়ে দেখল, অদ্ভুত পোশাক-পরা একদল বিদেশিকে৷ শুধোল, ‘কে তোমরা?’

‘আমরা গৌড়বাসী৷’

‘এদেশে এসেছ কেন?’

‘তীর্থ করতে৷’

‘কোথায় যাবে?’

‘কাশ্মীরে সারদা দেবীর মন্দিরে পূজা দিতে৷’ রক্ষী পথ ছেড়ে দিল৷

সর্দার পরিচারক বলল, ‘আমরা পরিহাসপুরেও গিয়ে পরিহাসকেশবের মন্দির দেখব৷ সেখানে যাবার পথ কোন দিকে?’

রক্ষী পথ বাতলে দিল৷

‘মহারাজ ললিতাদিত্য এখন কোথায়?’

‘রাজ্যের বাইরে৷’

মনে মনে হতাশ হয়েও সর্দার মুখে কোনো ভাবই প্রকাশ করল না৷

তারা প্রবেশ করল পরিহাসপুরে৷

সর্দার গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সবাই ছদ্মবেশ খুলে ফেলো৷ অস্ত্র ধরো!’

‘তারপর আমরা কী করব?’

‘পরিহাসকেশবকে আক্রমণ করব৷’

‘পরিহাসকেশব যে দেবতা!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতকের উপাস্য দেবতা! পরিহাসকেশবকেই মধ্যস্থ রেখে ললিতাদিত্য প্রতিজ্ঞা করেছিল, বঙ্গেশ্বরের গায়ে সে হাত দেবে না৷ তারপর সে যখন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হয়, পরিহাসকেশব কি তাকে নিরস্ত করতে পেরেছিলেন? ললিতাদিত্য রাজ্যের বাইরে, এত দূরে এসে আমরা কি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব? তার বদলে চাই আমরা পরিহাসকেশবকেই! যে-দেবতাকে উপাসনা করে মানুষ এমন হীন, এমন বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, আমরা সকলে মিলে আজ চূর্ণবিচূর্ণ করব সেই পঙ্গু, অপদার্থ দেবতাকে! ভাইসব! অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো!’

পরিহাসকেশবের মন্দিরের পূজারিরা সভয়ে ও সবিস্ময়ে দেখলেন, একদল ভৈরবমূর্তি শূন্যে তরবারি নাচাতে নাচাতে ও বিকট স্বরে চিৎকার করতে করতে বেগে ছুটে আসছে-‘চূর্ণ করো, চূর্ণ করো, চূর্ণ করো পরিহাসকেশব!’

প্রমাদ গুণে পুরোহিতরা মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিলেন৷

বাঙালিরা তখন পর্যন্ত জানত না, কোনটি পরিহাসকেশবের মন্দির৷

সামনে পেল তারা আর একটি জমকালো মন্দির, তার ভিতরে ছিল রামস্বামীর রৌপ্যনির্মিত বিগ্রহ৷ তাকেই পরিহাসকেশবের মূর্তি মনে করে তারা হইহই করে তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্রুদ্ধ শার্দুলের মতো৷ যারা বাধা দিতে এল, তারা হল হত কি আহত৷ তারপর খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ধুলোয় লুটোতে লাগল রুপোয়-গড়া মূর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ৷ রাজধানী থেকে খবর পেয়ে ছুটে এল কাতারে কাতারে কাশ্মীরি সৈনিক৷

সর্দার পরিচারক নির্ভীক কন্ঠে বলল, ‘আমরা বাংলার বীর৷ কারুর দয়া চাইব না, কারুকে দয়া করব না৷ আমরা অস্ত্র নিয়ে শত্রুসংহার করতে করতে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন করব! ভাইসব, মারো আর মরো!’ নগণ্য বাঙালির দল, অগণ্য শত্রুসৈন্য৷ এক-এক বাঙালি চেষ্টা করল একশো জনের মতো হতে, মরিয়া হয়ে সবাই লড়তে লাগল-বধ করল বহু শত্রুকে৷ তারপর শত্রুরক্তে প্লাবিত মৃত্তিকার উপর লুটিয়ে পড়ে একে একে করল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ৷ কেউ পালিয়েও গেল না, কেউ প্রাণেও বাঁচল না৷

প্রায় চার শতাব্দী পরেও কহ্লন দেখেছিলেন রামস্বামীর বিগ্রহহীন মন্দির এবং তখনও সারা কাশ্মীরে কথিত হত বঙ্গবীরদের অপূর্ব বীরত্ব৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *