ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর – হেমেন্দ্রকুমার রায়

ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর – হেমেন্দ্রকুমার রায়

নদীর পাড়ে ছোট্ট গ্রাম৷ ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখা নেই৷ তার বুক দিয়ে কখনো ভেসে যায়নি সওদাগরের সমুদ্রগামী নৌকা কিংবা দিগ্বিজয়ী সম্রাটদের যুদ্ধজাহাজ৷ কোনো রাজা বা জমিদার তার তীরে বাঁধিয়ে দেননি শ্বেতপাথরের ঘাট৷ ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়েচলা পথ শুধু নেমে গেছে উঁচু পাড় থেকে একেবারে জল অবধি৷

পাহাড়ের ওপর দাঁড়ানো বুড়ো বট গাছের ঝুরিগুলো আজ রংবেরঙের বৃষচিহ্নিত নিশান দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ দশবল লোকনাথ ঠাকুরের পুজো হবে আজ সেখানে৷ নির্জন ঘাটে আজ অনেক মানুষের ভিড় হয়েছে তাই৷ ছোটোরা জলে দাপাদাপি জুড়েছে৷ মেয়েরা গল্পগাছা করছেন পাড়ে বসে৷ কোমর অবধি জলে দাঁড়ানো বয়স্করা মন্ত্র পড়ে জল তুলে অঞ্জলি দিয়ে পুজো সারছেন৷ সব মিলিয়ে গমগমে শব্দ উঠেছে নদীর ধারে৷ এরই মাঝে তিনি নীরবে স্নান সেরে নিচ্ছিলেন৷ আশির ওপর বয়স৷ কিন্তু এখনও চেহারায় একসময়ের অসামান্য রূপের আভাস পাওয়া যায়৷

বেলা প্রায় এক প্রহর পেরিয়েছে৷ স্নান আর পুজো সেরে বৃদ্ধা অবশেষে জল ছেড়ে উঠে বাড়ির পথ ধরলেন৷ বট গাছের গোড়ায় তখন মহাসমারোহে পুজোর আয়োজন চলছে৷ পুজোর বেদির একপাশে বসেছে গানের আসর৷ বাঁশি, মৃদঙ্গ, করতালের শব্দ উঠেছে সেখানে৷ অন্যপাশে বয়স্ক মানুষেরা নবদল খেলা (দাবা)-র গুটি সাজিয়ে বসেছেন এখানে-ওখানে৷ পুজোর জায়গা থেকে বেশ খানিক দূরে ডোম, শবর আর চণ্ডালেরা কুস্তি আর মুরগির লড়াই নিয়ে মেতে উঠেছে৷

আজ গোটা গ্রামই বুড়ো বট গাছের চারপাশে জমা হয়েছে এসে৷ সন্ধ্যে অবধি এইখানেই থাকবে সবাই৷ গ্রামের বিষয়পতি সোমভদ্রের সেইরকমই আদেশ৷ পুজোর পরে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন তিনি৷ ক্রোশ দুই দূরে তাঁর বাড়ি থেকে খাবারদাবার আর পুজোর উপকরণ এসে পৌঁছোবার কাজ চলছে এখনও৷ বিষয়পতি নিজেও বাড়ির লোকজন নিয়ে খানিক বাদেই এসে পৌঁছোবেন বলে খবর পাঠিয়েছেন৷

বুড়ো বট গাছের চৌহদ্দি ছেড়ে এগোতে যেতে বাধা এল৷ ভট্ট উন্মীলনস্বামী এসে দাঁড়িয়েছেন বৃদ্ধার সামনে৷ বয়স বেশি নয় তাঁর৷ সবেমাত্র গুরুগৃহের শিক্ষা করে গ্রামে ফিরে এসে একটি টোল খুলে বসেছেন তিনি৷ রঙ্গরসিকতা করতে ভালোবাসেন একটু, তবে মানুষটি পণ্ডিত, সচ্চরিত্র৷ দেদ্দাদেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভারি মিষ্টি৷ সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটি নমস্কার করে বললেন, ‘লোকনাথদেবের পুজোয় থাকবেন না দেবী?’

‘তিনি তো আমার হৃদয়েই আছেন বাবা৷ সেইখানেই তাঁর পুজো করি যে রোজ৷ গাছের তলায় আর কী পুজো করব?’ দেদ্দাদেবী মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন৷

‘সে ঠিক, কিন্তু আমাদের বিষয়পতি মশাই যে বেজায় রাজভক্ত! গৌড়রাজ ধর্মপাল অনেক বিপদ পেরিয়ে মৎস্যদেশ জয় করে ফিরেছেন বলে খবর পৌঁছেছে কালকে৷ সেইজন্যেই তো আজ লোকনাথদেবের পুজোর আয়োজন করেছেন বিষয়পতি৷ সবাইকে হাজির থাকতে আদেশ দিয়েছেন যে৷’

‘আর তুমিও বাছা তাই পড়াশোনা ফেলে এইখানে এসে জুটেছ, কেমন?’

‘সাধে কি আর আসি? বিষয়পতি সোমভদ্রের অন্নে টোল চলে যে৷ নইলে এই ভিড়ের মধ্যে কে আর আসতে যায়?’

‘তা বটে৷ কিন্তু, কাজটা সে ভুল করেনি কিছু৷ রাজা যুদ্ধে জিতলে প্রজার একটু উৎসব তো করাই উচিত৷’

‘তাহলে আপনি যে বড়ো সে আদেশ না মেনে-‘

দেদ্দাদেবী মৃদু হাসলেন, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো বাবা৷ আমি বুড়োমানুষ৷ সোমভদ্র আমাকে কিছু বলবে না৷ আর, তোমারও যদি এইসব মোটাদাগের আনন্দস্ফূর্তিতে থাকতে মন না চায় তাহলে তুমিও আমার সঙ্গে আসতে পার৷ দুপুরে নয় আমার ওখানেই দুটি খেয়ে নেবে৷ কেউ কিছু বললে আমি সোমভদ্রদেবকে বলে দেবখন৷’

মধুর কিন্তু দৃঢ় গলায় বলা সে নিমন্ত্রণে এমন এক আদেশের সুর লুকিয়ে ছিল যাকে অমান্য করার সাধ্য ছিল না উল্মীলন ভট্টের৷ নদীর পাড় ছেড়ে গুটিগুটি দেদ্দাদেবীর সঙ্গে রওনা দিলেন৷

তেঁতুল আর গুড় দিয়ে মেখে শেষ গ্রাস দুটি মুখে তুলতে দেদ্দাদেবী বললেন, ‘দাঁড়াও বাবা৷ আচমন করে ফেলো না এখনি৷ একটু দুধ আছে ঘরে৷ আম কেটে দিই৷ আম দুধ দিয়ে মুখ মিষ্টি করে তবে উঠবে৷’

‘রক্ষা করুন দেবী৷ যা খাইয়েছেন, তার ওপরে আবার আম দুধ? পেটে আর জায়গা নেই যে!’

‘কীই বা এমন খেলে বাবা? বিধবা মানুষ৷ একা একা থাকি৷ শাকভাত খাই৷ নলিতা (পাট) শাক আর কাঁকরোলের ব্যঞ্জন, এই তো আয়োজন৷ তোমাদের তরুণ বয়স! এ বয়সে আমার কর্তা এক আসনে বসে একটি গোটা রোহিত মৎস্যের ব্যঞ্জন একাই শেষ করতে পারতেন৷ সঙ্গে অন্যান্য পদও থাকত সেই পরিমাণে৷ আমি নিজে সামনে বসে কতদিন তাঁকে খাইয়েছি৷ সে তুলনায়-‘

‘আপনার হাতের শাকান্নই আমার কাছে যথেষ্ট৷ সামান্য নলিতার শাক যে এত সুস্বাদু হতে পারে তা কে জানত৷ এমন অপূর্ব রান্না আপনি শিখলেন কোথায়?’

মুখ টিপে হাসলেন দেদ্দাদেবী৷ তারপর বললেন, ‘কল্যাণীকে কাল-পরশু আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো৷ তাকে আমার গুপ্তবিদ্যাটি শিখিয়ে দেবখন৷ তোমার মতো পণ্ডিতের কাছে সে বিদ্যার কথা বলা অরণ্যে রোদন হয়ে যাবে যে বাবা!’

‘তা ঠিক৷ তবে কর্তাঠাকুর মানুষটি বড়ো সৌভাগ্যবান ছিলেন, প্রতিদিন এমন খাবার পেতে পূর্বজন্মের সুকৃতি লাগে৷’

বেলা বেড়েছে৷ গরম পড়েছে বেশ৷ দূরে নদীর ধার থেকে উৎসবের হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছিল৷ আকাশে দু-টি চিল ভাসছে৷ বারান্দায় একটি শীতলপাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন উন্মীলন ভট্ট৷ তাঁর মাথার কাছে পানের বাটা হাতে বসে দেদ্দাদেবী দূর আকাশে ভাসমান চিলদম্পতির দিকে চেয়ে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা ভাবছিলেন৷ সেইভাবে বসে থাকতে থাকতেই খানিক আগের কথার সুত্র ধরে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ৷ পূর্বজন্মের সুকৃতি তো ছিলই৷ সৌভাগ্যবানও ছিলেন৷ নইলে-‘

এই অবধি বলেই হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সচেতন হলেন বৃদ্ধা৷ তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘তবে সে গল্প আজ থাক৷’

উন্মীলন ভট্টের কৌতূহল হচ্ছিল৷ মাথা তুলে বললেন, ‘থাকবে কেন দেবী? বলুন আপনি তাঁর গল্প৷ আমি শুনব৷’

‘কেন শুধু শুধু সময় নষ্ট করবে উন্মীলন? সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনি শুনে সময় না কাটিয়ে সেই সময়ে মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনলে ভালো কাজ হয়৷ তুমি বরং তাই করো না কেন?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ তবে সেইরকম কোনো গল্পই বলুন দেবী৷ আপনার মুখে গল্প শুনতে বড়ো ভালো লাগে আমার৷ আপনি তো যৌবনে গৌড়বাসী ছিলেন৷ সম্রাট গোপালদেবকে দেখেছেন নিশ্চয়ই? মহারাজ ধর্মপালের মতন সুপুত্রের পিতা, মাৎস্যন্যায়ের হাত থেকে গৌড়বঙ্গের রক্ষাকর্তা এই মানুষটিকে সমগ্র আর্যাবর্তই মহাপুরুষ হিসাবে মানে৷ আপনি বরং আজ তাঁরই গল্প বলুন৷’

একটা বিচিত্র হাসি ছড়িয়ে গেল দেদ্দাদেবীর ঠোঁটে, ‘আজকের দিনে তুমি তাঁরই গল্প শুনতে চাইলে উন্মীলন?’

‘কেন নয় দেবী? পালবংশের গোড়াপত্তন তাঁর হাতে৷ আজ তাঁর দিগ্বিজয়ী পুত্রের তলোয়ারের সামনে মৎস্যদেশ নতজানু হয়েছে৷ গৌড়ের অধীনে যে ভারতজোড়া সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন গোপালদেব, আজ সে স্বপ্ন আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল৷ আজই তো তাঁর গল্প শোনবার দিন’৷

‘ভুল কথা৷ তলোয়ারের শক্তিতে দিগ্বিজয় আর রক্তপাত মহারাজ গোপালের স্বপ্ন ছিল এ কথা তোমাকে কে বলল? এই নিয়ে নতুন কোনো সংগীত বা গাথা রচনা হয়েছে নাকি? নাকি রাজধানী গৌড়ের পথে-ঘাটে আজ মানুষ এইরকম মিথ্যাই বলে চলেছে? উত্তর দাও উন্মীলন৷’

হঠাৎ ঝলসে ওঠা চোখ দুটির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন উন্মীলন ভট্ট, ‘না দেবী, তা নয়৷ আসলে যেকোনো রাজ্যে শাসকেরই তো সেই স্বপ্নই থাকে; থাকা উচিত৷ তাই অনুমান করছিলাম-‘

‘ভুল অনুমান করেছিলে বালক৷ কতটুকু জান তুমি গোপালদেবের কথা? এসো আজ তবে তাঁরই একটা গল্প শোনাই তোমায়৷ এই গ্রাম ছেড়ে কখনো যদি গৌড়নগরীতে যাও তবে শুনবে, সে গল্প সেখানে চারণকবিদের মুখে মুখে ফেরে৷ মহারাজ গোপাল ও মেঘবর্ণের কাহিনি-

‘কম্বোজীয় ক্ষত্রিয়দের দুই শক্তি৷ শাস্ত্রে আর শস্ত্রে৷ গোপালের প্রপিতামহ দয়িতবিষ্ণু তার মধ্যে প্রথমটাকে বেছে নিয়েছিলেন৷ তবে পাণ্ডিত্যের খ্যাতি তাঁর বেশি জোটেনি যে, তার প্রধান কারণ, বরেন্দ্রভূমির ছোট্টো এক গ্রামের জন্মভিটে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হননি তিনি৷ নামযশ, টাকাপয়সা কোনো লোভই তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে পারেনি তাঁর জনকভু (জন্মভূমি) ছেড়ে রাজধানী গৌড়ে৷ সেই নগণ্য গ্রামেই রাজাধিরাজ গোপালেরও জন্ম৷’

‘কোন গ্রামে দেবী? সন্ধান পেলে একবার সেই পুণ্যভূমিকে দেখে আসতাম৷’

মৃদু হাসলেন দেদ্দা৷ এখনও তাঁর গালে হাসলে টোল পড়ে৷ ‘সে কথাটি বলা যে বারণ আছে বাবা৷ রাজার আদেশ৷ তবে নাম দিয়ে প্রয়োজন নেই৷ গল্পটা শোনো বরং৷ দয়িতবিষ্ণুর ছেলে ছিলেন খণ্ডিতরাট বপ্যট৷ এই বপ্যটের জীবনেই কম্বোজীয় ক্ষত্রিয়ের দ্বিতীয় শক্তির প্রকাশ ঘটে৷ পুঁথি ছেড়ে তলোয়ার ধরেছিলেন বপ্যট৷ শস্ত্রজীবি সৈনিক হয়ে বের হয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর পথে৷ যথেষ্ট অর্থও উপার্জন করেছিলেন নিজের ক্ষমতায়৷

‘বীর পিতা আর পণ্ডিত পিতামহের সেরা গুণগুলো একত্র হয়েছিল গোপালদেবের মধ্যে৷ জ্ঞানচর্চার দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি৷ কিন্তু, শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর পর মাৎস্যন্যায়ের কবলে পড়ে গৌড়বঙ্গের তখন নাভিশ্বাস উঠেছে৷ ফলে নিজেকে রক্ষা করার জন্যেই বপ্যটের কাছে তাঁর যুদ্ধবিদ্যায় হাতেখড়ি৷ বাহুবল আর বুদ্ধিবল দু -দিকেই ঈশ্বরের বরপুত্র ছিলেন৷ ফলে যুদ্ধবিদ্যায় বপ্যটকে ছাড়িয়ে যেতে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি৷

‘শিক্ষা শেষ হলে বরেন্দ্র দেশের এক সামান্য গৃহস্থ পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হল তাঁর৷ সংসারধর্ম পালনের পাশাপাশি সদ্ধর্মের দিকেও মন গেল৷ বুদ্ধের শরণ নিলেন৷ গৃহী ভক্ত হিসেবে ধর্ম আর কর্ম দু-টিই মনোযোগ দিয়ে পালন করতে লাগলেন৷ ধীরে ধীরে গৌড়বঙ্গেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ল তাঁর৷

‘কিন্তু শান্তি তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল না৷ তোমার জন্মের বেশ কিছুকাল আগের কথা বাবা৷ দেশে তখন চূড়ান্ত অরাজকতা৷ গৌড়ের সিংহাসন তখন বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে৷ এক বছরের বেশি কোনো রাজাই নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না৷ শিশু নামে এক রাজা তো সিংহাসনে বসবার পনেরো দিনের মধ্যে নিহত হলেন৷ রাজকোষে অর্থ নেই৷ প্রকৃতিও বিমুখ৷ তাম্রলিপ্তির সমুদ্রবন্দর ধ্বংস হবার মুখে৷ ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ৷ তার ওপর মাত্রই কিছুকাল আগে কনৌজরাজ যশোবর্মার হাতে গৌড়বঙ্গ শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়েছে৷ এর ওপর সে বছর যখন দেশ জুড়ে এক প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষ শুরু হল তখন গৌড়বঙ্গে সমস্ত সামন্তরাজারা একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, গৌড়বঙ্গে শান্তি ফেরাবার দায়িত্ব নিতে হবে গোপালদেবকে৷

‘রাজা হবার লোভ ছিল না তাঁর৷ কিন্তু তাই বলে দায়িত্বকে অস্বীকার করে পালাবার মানুষ তো ছিলেন না তিনি৷ অতএব সুখের সংসারের আশ্রয় ছেড়ে তিনি গৌড়ের সিংহাসনের দায়িত্ব নিলেন৷ আর, তারপর থেকে তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল গৌড়ের রক্ষা ও পালন৷

‘বাহুবল ছাড়া অত্যাচারী শত্রুর মোকাবিলা করা যায় না, এ কথা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন গোপালদেব৷ অতএব প্রথমেই সামন্তরাজাদের সাহায্যে গড়ে তুললেন এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী৷ কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে৷ যেকোনো সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তি তার অশ্বারোহীরা৷ বাংলায় ঘোড়া জন্মায় না৷ বিদেশি ঘোড়া ব্যবসায়ীদের কাছে চড়া দামে ঘোড়া কেনবার মতো অর্থ তখন রাজকোষে নেই৷ ফলে গোপালদেবের অশ্বারোহী সেনা সংখ্যায় যথেষ্ট ছিল না৷ মহারাজ এ সমস্যার সমাধান করলেন দৈত্যসদৃশ হাতিদের দিয়ে৷ বঙ্গদেশ আর তাকে ঘিরে থাকা সমতট, পৌন্ড্রবর্ধন, কামরূপ সর্বত্রই এই মেঘবর্ণ দানবদের বাসভূমি৷ দেখতে দেখতে গড়ে উঠল সুবিশাল রণহস্তীর বাহিনী৷ আজ যে সম্রাট ধর্মপালের বিখ্যাত হস্তীব্যূহ ‘ঘণাঘণ’ এর নামে সারা ভারত তটস্থ থাকে, তার সৃষ্টিও কিন্তু সেই গোপালদেবেরই হাতে৷

‘তারপর দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে গৌড়বঙ্গের দিকে দিকে ছুটে বেড়িয়েছেন মহারাজ৷ অবিরত রক্তস্নান করে, নিজের জীবনের সব শান্তি, সুখ বিসর্জন দিয়ে ধীরে ধীরে শান্তি ফিরিয়েছেন দেশে৷ মানুষের জীবনে সুখ ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ রাজলক্ষ্মী ফের সদয় হয়েছেন গৌড়বঙ্গের ওপর৷ সে কাজে তাঁকে একনিষ্ঠভাবে সাহায্য করে গেছে তাঁর তৈরি কালান্তক রণহস্তী বাহিনী৷

‘অবশেষে একদিন সম্পূর্ণ শান্তি ফিরে এল গৌড়বঙ্গে৷ প্রায় এক বছর ধরে রাজ্যের কোথাও আর অস্ত্রের শব্দ শোনা গেল না৷ গোপালদেব তৃপ্ত হলেন৷ তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন৷

‘কিন্তু যে সামন্তরাজারা তাঁকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, তাঁরা তখনও তৃপ্ত নন৷ যুদ্ধের নেশার ঘোর তাঁদের তখনও কাটেনি৷ দেশে শান্তি ফেরবার পর এইবার তাঁরা মহারাজ গোপালদেবের কাছে নতুন দাবি তুললেন-এইবার প্রকৃত দিগ্বিজয়ে বের হোক পালসেনানী৷ সমগ্র আর্যাবর্ত গোপালদেবের পদানত হোক৷ কনৌজের যশোবর্মন থেকে কাশ্মীরের ললিতাদিত্য-এমন ছোটো-বড়ো অনেক রাজার হাতেই গত এক-শো বছর ধরে লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে গৌড়বঙ্গ৷ এইবারে সে সেই লাঞ্ছনার উপযুক্ত জবাব দিক গোপালদেবের নেতৃত্বে৷

‘দিগ্বিজয়ে যাবার সাধ গোপালদেবের কখনোই ছিল না৷ মানুষের রক্তপাত করতে তাঁর বাধত৷ অথচ সামন্তদের দাবিকে একেবারে অগ্রাহ্যও করতে বিবেকে বাধছিল তাঁর৷ মাতৃভূমির গৌরব বাড়াতে চাইছেন তাঁরা৷ এ নিয়ে বড়ো দ্বন্দ্বে দিন কাটছিল মহারাজ গোপালদেবের৷

‘সে বছর বর্ষার শেষে যখন মেঘেরা বিদায় হল, তখন একদিন মহারাজ তাঁর প্রিয় হস্তিবাহিনীকে ফের কুচ করবার আদেশ দিলেন৷ শরৎকাল এ দেশে চিরকালই দিগ্বিজয়ে যাবার জন্য রাজাদের প্রিয় ঋতু৷ অতএব সকলেই ধরে নিল এইবার মহারাজ গোপালদেব ফের দিগ্বিজয়ে যাবার ইচ্ছা করেছেন৷ মহা উৎসাহে প্রস্তুতি শুরু হল৷ আদেশ দেবার তিন দিনের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে এই বিশাল হস্তিবাহিনী এসে হাজির হল রাজপ্রাসাদের সামনের বিরাট মাঠটিতে৷

‘সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘর্ঘর শব্দ করে খুলে গেল রাজপ্রাসাদের দরজা৷ মহারাজ গোপালদেবকে নিয়ে তাঁর সোনায় মোড়া রথ বের হয়ে এল প্রাসাদের ভেতর থেকে৷ দেহে বয়সের সামান্য ছাপ পড়েছে, কিন্তু চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একেবারেই অটুট৷

‘রণহস্তীদের দলপতির নাম মেঘবর্ণ৷ সুদূর কামরূপের অরণ্যে তার জন্ম৷ অতিকায় এই হস্তিরাজের পিঠ থেকে বহু যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন মহারাজ গোপালদেব৷ এক বছর অদর্শনের পর আজ প্রভুর দেখা পেয়ে মেঘবর্ণ খুশিতে শুঁড় তুলে ডাক ছাড়ল একবার৷ তারপর ধীরে ধীরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল মহারাজের সামনে৷

‘রথ থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে এলেন মহারাজ গোপাল৷ একপাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর সামন্তরাজারা৷ তাঁদের পেছনে যতদূর চোখ যায় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গোপালদেবের অগণিত চতুরঙ্গ সেনা৷

‘দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রিয় মেঘবর্ণের মাথায় সওয়ার হলেন গোপালদেব৷ সারা প্রান্তর তখন নিস্তব্ধ হয়ে তাঁর আদেশের প্রতীক্ষায়৷ অবশেষে নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে উঠল মহারাজের গম্ভীর গলা৷

‘প্রিয় বন্ধুরা, গৌড়বঙ্গের চরম দুর্দিনে আপনারা আমাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন৷ আমার ওপর দায়িত্ব ছিল মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার৷ দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য আমি হাসিমুখে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম৷ সবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্য আমার সিংহাসনে বসা৷ সে গুরুদায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছি বলে নিজেকে ধন্য বোধ করছি আমি৷’

‘উত্তরে জয়ধ্বনিতে গর্জে উঠে তাঁর কন্ঠস্বরকে ডুবিয়ে দিল সেই প্রান্তর৷ খানিক বাদে জয়ধ্বনি থামলে তিনি ফের বললেন, কিন্তু দায়িত্ব পালনের পর, এইবার আমি অব্যাহতি চাই৷ সুখী, সমৃদ্ধ গৌড়বঙ্গ এইবারে সমগ্র আর্যাবর্তের রক্ত দেখতে চায়৷ আমার সামন্তবন্ধুরা ক্রমাগতই সে দাবি রেখে চলেছেন আমার কাছে৷ কিন্তু আমি তা মানতে অক্ষম৷ দিগ্বিজয় রাজার ধর্ম বটে, কিন্তু আমার কাছে তার চেয়েও বড়ো হল মানব ধর্ম৷ আত্মরক্ষার জন্য অনেক রক্তপাত করেছি আমি, কিন্তু রাজ্যলোভে একবিন্দু রক্তপাতও করতে আমি সম্মত নই৷ আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন৷ আপনারা আমায় একদিন নির্বাচন করেছিলেন৷ আপনাদের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে পারছি না তাই এ সিংহাসনে বসবার অধিকারও আমি হারিয়েছি৷ আপনাদের সম্মতি থাকলে আজ থেকে আমার জায়গায় গৌড়বঙ্গের নেতৃত্ব দেবেন যুবরাজ ধর্মপাল৷

‘ঘোষণার আকস্মিকতায় সকলেই হতবাক হয়ে পড়েছিলেন৷ তবে সে সামান্যক্ষণের জন্যই৷ দেশবাসীর পরমপ্রিয় যুবরাজ ধর্মপাল এইবার সম্রাট হবেন, এ সংবাদটি সবার মনে আনন্দের স্রোত বইয়ে দিল৷ তাঁরা সকলেই তাতে সম্মত৷ পিতা ও পুত্র দু-জনের জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়তে লাগল গোটা প্রান্তর৷

‘খানিকবাদে সবাই শান্ত হলে গোপালদেব বললেন, একটি ছোটো কর্তব্য পালনের বাকি আছে আমার৷ তারপরেই ধর্মপালের রাজ্যাভিষেক হবে৷ সেই উদ্দেশ্যেই আপনাদের এইখানে আহ্বান করা৷’

‘এই অবধি বলে রণহস্তীর বিরাট বাহিনীর দিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘গৌড়বঙ্গে শান্তি ফেরাবার যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য এই সহস্র সহস্র হস্তীকে তাদের জন্মভূমির কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল আমার আদেশে৷ আমারই আদেশে শত্রুনিপাত করে, প্রাণ দিয়ে, অস্ত্রাঘাত সহ্য করে তারা নিজেদের আহারের সংস্থান করেছে এতকাল৷ এই হস্তীবাহিনীর ওপর আমি বাদে কারও আর কোনো অধিকার আছে কি?’

‘সমস্ত প্রান্তর নীরব হয়ে রইল৷ এইবারে মৃদু হাসি ফুটল গোপালদেবের মুখে৷ বললেন, বেশ৷ তাহলে এদের ভবিষ্যৎ কী হবে সে সিদ্ধান্ত আমার একার৷ আমার মতন এরাও নিজেদের গৃহকোণের শান্তিকে ত্যাগ করেছিল গৌড়বঙ্গের শান্তি ফেরাবার জন্য৷ আজ তাই আমার বিদায়বেলায় আমি এদেরও মুক্তি দিতে চাই৷ যুবরাজ ধর্মপালের উপযুক্ত ক্ষমতা আছে৷ এর চতুর্গুণ রণহস্তী সে নিজেই সংগ্রহ করে নিতে পারবে৷ কিন্তু গৌড়বঙ্গের শান্তি ফিরিয়ে দেওয়া এই হস্তীবন্ধুদের আপনারা হাসিমুখে মুক্তি দিন৷

‘এই বলে মেঘবর্ণের পিঠ থেকে নেমে এসে তলোয়ারের একটি কোপে তার পেটের সঙ্গে বাঁধা হাওদার রজ্জুটি কেটে দিলেন তিনি৷ মুক্ত মেঘবর্ণ শুঁড় তুলে আকাশ কাঁপিয়ে জয়ধ্বনি করল একবার৷ গোটা প্রান্তর জুড়ে তখন প্রতিটি রণহস্তীর শরীর থেকে খসে পড়ছে মানুষের দেওয়া বাঁধন আর রণসজ্জার বোঝা৷ প্রথম বর্ষার মেঘমালার মতোই সেই হস্তীবাহিনী তখন ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে নিজেদের মুক্তির পথে৷

‘খানিক বাদে রাজপুরীতে ধর্মপালদেবের অভিষেক উৎসব শেষ হল৷ তাকে সিংহাসনে বসিয়ে বিশ্রাম করবার জন্য অঃন্তপুরে গেলেন মহারাজ গোপালদেব৷ তারপর, উৎসবে মাতোয়ারা প্রজাদের অলক্ষ্যে অতি সাধারণ পোশাকে প্রাসাদ ছেড়ে পথে এসে নামলেন৷ সঙ্গে একটি নিরাভরণ পালকিতে রয়েছেন মহারানি৷ কেউ খেয়াল করল না তাঁদের৷ করলেও, সাধারণ পোশাকের এক মধ্যবয়সি দম্পতিকে দেখে কারও মনে কোনো সন্দেহ হবার কথাও নয়৷

‘এইবার পথ চলা শুরু হল গোপালদেব ও তাঁর মহিষীর৷ গন্তব্য জনকভু বরেন্দ্রভূমির এক নগণ্য গ্রাম, যার শান্তির আশ্রয়ে একদিন জ্ঞানচর্চা করেছিলেন পিতামহ দয়িতবিষ্ণু৷ শস্ত্রব্যবসায়ী পিতা বপ্যটের কাছে পিতৃঋণ শোধ করেছেন গৌড়বঙ্গে শান্তিকে পুঃনপ্রতিষ্ঠিত করে৷ এইবার পিতামহের ঋণ শোধবার পালা৷ সে ঋণ রাজসভার সহস্র যুদ্ধজয়ের গৌরব দিয়ে হবার নয়৷ সে ঋণ শোধ করতে হবে পিতামহের ভিটেয় বসে নির্জনে জ্ঞানসাধনায়’৷

‘তারপর?’

অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোটি তখন মায়াবি আভা ফেলেছে উঁচু গাছেদের মাথায়৷ সেদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা আনমনে বললেন, ‘তারপর আর কী শুনতে চাও উন্মীলন? রাজমন্ত্রীর ইতিহাসের রাজপথ ছেড়ে তিনি চলে গেলেন গ্রামের শান্তিময় জীবনে৷ পূর্বপুরুষের মাটিতেই শান্তিতে মিশে গিয়েছেন নিশ্চয়৷ কে আর তাঁর সংবাদ রাখে! সমস্ত পৃথিবী এখন তাঁর পুত্রের বিজয়রথের দিকে চেয়ে আছে৷’

কথা বলতে বলতেই হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ যেতে শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন দেদ্দাদেবী, ‘ওঠো, ওঠো, বাড়ি যাও এবারে৷ কল্যাণী এরপর চিন্তা করবে যে?’

‘হ্যাঁ দেবী, এই যাই!’

‘যাই বলতে নেই৷ এসো বাবা৷ আর, কাল মনে করে কল্যাণীকে পাঠিয়ে দিয়ো একবার আমার কাছে৷ ভুলো না’৷

‘ভুলব কী করে দেবী? আমারই স্বার্থ আছে তাতে৷ অমন মধুর শাকান্ন রান্নার কৌশল সে শিখে নিলে আমারই লাভ যে!’

তার যাবার পথের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন দেদ্দাদেবী৷ তারপর ঘরে ঢুকে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে ভেতর বাড়ির উঠোনের দিকে গেলেন৷ এখানে বিরাট এক আম গাছের নীচে ছোট্টো একটি সমাধি মন্দির৷ তার চারপাশের ঝোপঝাড়ে ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে জোনাকির রোশনাই৷ মন্দির ঘিরে ঝিঁঝিঁরা সান্ধ্য তান ধরেছে৷ সেই আলো সংগীতের মধ্যে একাকী বসে মহারাজ গোপালদেবের নির্জন সমাধিতে প্রদীপের আলো দেখিয়ে প্রণাম করলেন একদা গৌড়বঙ্গের পট্টমহিষী মহাদেবী দেদ্দা৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *