ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর
ললিতাদিত্য তখন কাশ্মীরের রাজা। তিনি সিংহাসন অধিকার করে ছিলেন ৭৩৩ থেকে ৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
তিনি ছিলেন শক্তিশালী দিগবিজয়ী। তিব্বতিদের, ভুটিয়াদের ও সিন্ধুতীরবর্তী তুর্কিদের দমন করে তিনি নাম কিনেছিলেন। ভারতের দেশে দেশেও উড়েছিল তাঁর জয়পতাকা। কাশ্মীরের বিখ্যাত মার্তণ্ড-মন্দির তাঁর দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজও বিদ্যমান আছে ওই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
সেই সময়ে কনোজ বা কান্যকুব্জে রাজত্ব করতেন আর এক পরাক্রান্ত রাজা, নাম তাঁর যশোবর্মা। তাঁর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মগধ ও বঙ্গদেশের রাজারা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন। মগধের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত। কিন্তু বঙ্গ বা গৌড়ের সিংহাসন ছিল কোনও রাজার অধিকারে, ঐতিহাসিকরা আজও তাঁর নাম খুঁজে পাননি। তবে তিনি ছিলেন নাকি অসংখ্য হস্তীর অধিকারী।
চিরকালই এক রাজার উন্নতি আর এক রাজা দেখতে পারেন না। পৃথিবীতে এই নিয়েই যত অশান্তি, যত যুদ্ধবিগ্রহ। রাজা যশোবর্মার যশ ললিতাদিত্য সহ্য করতে পারলেন না। সসৈন্যে তিনি করলেন যশোবর্মাকে আক্রমণ। যশোবর্মা হলেন পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত।
তখন বঙ্গেশ্বর কতকগুলি হস্তী উপঢৌকন স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন লতিতাদিত্যের কাছে। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। যশোবর্মার দ্বারা বিজিত বঙ্গেশ্বর শত্রুর পতনে খুশি হয়েই হয়তো ললিতাদিত্যের কাছে উপহার পাঠিয়ে মনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। কিংবা এও হতে পারে, ললিতাদিত্য পাছে বঙ্গদেশও আক্রমণ করেন, সেই ভয়েই তিনি তাঁকে তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন।
তারপর বঙ্গেশ্বরের কাছে কাশ্মীর থেকে এল আমন্ত্রণ, তাঁকে ললিতাদিত্যের আতিথ্য স্বীকার করতে হবে।
তখন অষ্টম শতাব্দী চলছে। সে সময়ে বাংলা থেকে কাশ্মীরে যাওয়া বড় যে-সে কথা ছিল না। তারপর এই আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য এবং ললিতাদিত্যের মনের কথা কেউ জানে না। বঙ্গেশ্বর যথেষ্ট ভীত হলেন বটে, কিন্তু উপায় কী? দিগবিজয়ী ললিতাদিত্যের আমন্ত্রণ ও আদেশ একই কথা।
সুদীর্ঘ, দুর্গম পথ পার হয়ে কয়েক মাস পরে বঙ্গেশ্বর কাশ্মীরে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
কাশ্মীরে ললিতাদিত্য একটি নতুন নগর স্থাপন করে তার নাম রেখেছিলেন, ‘পরিহাসপুর’, এখন তাকে ‘পরসপোর’ বলে ডাকা হয়। সেখানে ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘পরিহাসকেশব’ নামে দেবতার বিগ্রহ ও মন্দির।
অবশেষে পরিহাসপুরে হল দুই রাজার সাক্ষাৎকার।
বঙ্গেশ্বরের মুখ বিষণ্ণ, তখনও তাঁর মনের ভয় ভাঙেনি।
আসল ব্যাপারটা উপলব্ধি করে ললিতাদিত্য বললেন, ‘রাজন, আশ্বস্ত হন। আপনি আমার অতিথি। এই আমি ভগবান পরিহাসকেশবকে মধ্যস্থ রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আমার দ্বারা আপনার কোনও অনিষ্ট হবে না।’
বঙ্গেশ্বর হয়তো আশ্বস্ত হলেন।
তার পরের ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যায় না। বঙ্গেশ্বর যখন ত্রিগামী নামে একটি স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, ললিতাদিত্য তাঁকে হত্যা করে নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলেন। হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে এক অসহায় অতিথিকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার কারণ কী? ইতিহাস সে সম্বন্ধে নীরব! এমন অহেতুকী বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজলেও আর পাওয়া যায় কি না সন্দেহ।
যথাসময়ে এই দারুণ দুঃসংবাদ এসে পৌঁছোল বাংলাদেশে।
সারা দেশ শোকাচ্ছন্ন, রাজপ্রাসাদে হাহাকার।
কিন্তু নারীর মতো হায় হায় করে কেঁদে নিজেদের কর্তব্য সমাপ্ত করল না বঙ্গেশ্বরের প্রিয় পরিচারকবৃন্দ। বাঘের মুলুক বাংলাদেশে কোনওদিনই দৃপ্তমনের অভাব হয়নি। একালে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই ফিরিঙ্গি বণিকরা বাঙালি কাপুরুষ বলে মিথ্যা অপবাদ রটাবার চেষ্টা করেছে। আসলে তারাও বাঙালিদের ভয় করত মনে মনে।
পরিচারকদের সরদার ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই!’
কেউ প্রশ্ন করল, ‘কেমন করে প্রতিশোধ নেবে?’
—’আমরা কাশ্মীরে যাত্রা করব।’
—’কোথায় কাশ্মীর, আর কোথায় বাংলা!’
—’দরকার হলে আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও যেতে ছাড়ব না। হাত গুটিয়ে বসে থেকে এ অপমান মাথা পেতে সহ্য করব? ভাইসব, আমরা কি বাঙালি নই?’
—’আমরা হচ্ছি মুষ্টিমেয় বিদেশি, সেই সুদূর অজানা দেশে অসংখ্য শত্রুর সামনে গিয়ে আমরা কি দাঁড়াতে পারব? এ অসাধ্যসাধন কি সম্ভবপর?’
—’আমাদের অন্নদাতা প্রভু বিশ্বাসঘাতকের হাতে নিহত। যে তাঁর অন্নগ্রহণ করেছে, সেই-ই আজ একাই হবে একশোজন—সেই-ই আজ করতে পারবে অসাধ্যসাধন। আজ কোনও কথা নয়—কাশ্মীরে চলো, কাশ্মীরে চলো!’
পরিচারকের দল সমস্বরে গর্জন করে উঠল, ‘কাশ্মীরে চলো, কাশ্মীরে চলো!’
দিনের পর দিন যায়, রাতের পর রাত। সূর্য ওঠে, চাঁদ ওঠে, উদয়ের পরে অস্ত, মাসের পরে হয় মাসকাবার। নদ, নদী, প্রান্তর, দুর্গম কান্তার, দূরারোহ গিরিদরি। ক্রোশের পর ক্রোশ—তবু যেন পথের শেষ নেই। ঋতুর পর ঋতু চলে যায়—কখনও অগ্নিবাণ হেনে, কখনও তুষার-বৃষ্টি করে—তবু পথিকরা শ্রান্ত নয়, তারা চলছে, চলছে চলছে। একটু শিথিল হয়নি তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
অবশেষে পথের শেষ। এই তো কাশ্মীরের সীমান্ত!
কাশ্মীরি রক্ষী সবিস্ময়ে দেখল, অদ্ভুত পোশাক-পরা একদল বিদেশিকে। শুধোল, ‘কে তোমরা?’
—’আমরা গৌড়বাসী।’
—’এদেশে এসেছ কেন?’
—’তীর্থ করতে।’
—’কোথায় যাবে?’
—’কাশ্মীরে সারদা দেবীর মন্দিরে পূজা দিতে।’ রক্ষী পথ ছেড়ে দিল।
সরদার পরিচারক বলল, ‘আমরা পরিহাসপুরেও গিয়ে পরিহাসকেশবের মন্দির দেখব। সেখানে যাবার পথ কোন দিকে?’
রক্ষী পথ বাতলে দিল।
—’মহারাজ ললিতাদিত্য এখন কোথায়?’
—’রাজ্যের বাইরে।’
মনে-মনে হতাশ হয়েও সরদার মুখে কোনও ভাবই প্রকাশ করল না।
তারা প্রবেশ করল পরিহাসপুরে।
সরদার গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সবাই ছদ্মবেশ খুলে ফ্যালো। অস্ত্র ধরো!’
—’তারপর আমরা কী করব?’
—’পরিহাসকেশবকে আক্রমণ করব।’
—’পরিহাসকেশব যে দেবতা!’
—’হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতকের উপাস্য দেবতা! পরিহাসকেশবকেই মধ্যস্থ রেখে ললিতাদিত্য প্রতিজ্ঞা করেছিল, বঙ্গেশ্বরের গায়ে সে হাত দেবে না। তারপর সে যখন প্রতিজ্ঞা করতে উদ্যত হয়, পরিহাসকেশব কি তাকে নিরস্ত করতে পেরেছিলেন? ললিতাদিত্য রাজ্যের বাইরে, এত দূরে এসে আমরা কি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব? তার বদলে চাই আমরা পরিহাসকেশবকেই! যে দেবতাকে উপাসনা করে মানুষ এমন হীন, এমন বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, আমরা সকলে মিলে আজ চূর্ণবিচূর্ণ করব সেই পঙ্গু, অপদার্থ দেবতাকে! ভাইসব! অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো!’
পরিহাসকেশবের মন্দিরের পূজারিরা সভয়ে ও সবিস্ময়ে দেখলেন, একদল ভৈরব মূর্তি শূন্যে তরবারি নাচাতে নাচাতে ও বিকট স্বরে চিৎকার করতে করতে বেগে ছুটে আসছে—’চূর্ণ করো, চূর্ণ করো, চূর্ণ করো পরিহাসকেশব!’
প্রমাদ গুনে পুরোহিতরা মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিলেন।
বাঙালিরা তখন পর্যন্ত জানত না, কোনটি পরিহাসকেশবের মন্দির।
সামনে পেলে তারা আর একটি জমকালো মন্দির, তার ভিতরে ছিল রামস্বামীর রৌপ্যনির্মিত বিগ্রহ। তাকেই পরিহাসকেশবের মূর্তি মনে করে তারা হইহই করে তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্রুদ্ধ শার্দূলের মতো। যারা বাধা দিতে এল, তারা হল হত কি আহত। তারপর খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ধুলোয় লুটোতে লাগল রুপোয় গড়া মূর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। রাজধানী থেকে খবর পেয়ে ছুটে এল কাতারে কাতারে কাশ্মীরি সৈনিক।
সরদার পরিচারক নির্ভীক কণ্ঠে বলল, ‘আমরা বাংলার বীর। কারুর দয়া চাইব না, কারুকে দয়া করব না! আমরা অস্ত্র নিয়ে শত্রুসংহার করতে করতে সম্মুখ-যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন করব! ভাইসব, মারো আর মরো!’ নগণ্য বাঙালির দল, অগণ্য শত্রু-সৈন্য। এক-এক বাঙালি চেষ্টা করল একশো জনের মতো হতে, মরিয়া হয়ে সবাই লড়তে লাগল—বধ করল বহু শত্রুকে। তারপর শত্রুরক্তে প্লাবিত মৃত্তিকার উপর লুটিয়ে পড়ে একে একে করল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ। কেউ পালিয়েও গেল না, কেউ প্রাণেও বাঁচল না।
প্রায় চার শতাব্দী পরেও কল্হন দেখেছিলেন রামস্বামীর বিগ্রহহীন মন্দির এবং তখনও সারা কাশ্মীরে কথিত হত বঙ্গবীরদের অপূর্ব বীরত্ব।