ব্যাকরণের কথা
শুদ্ধতার ধারণাটি প্রাণের মতো বিরাজ করে একটি গ্রন্থে। ওই গ্রন্থকে বলা হয় ব্যাকরণ। ব্যাকরণ বইয়ের পাতায় পাতায় একটা স্বর যেনো অবিরাম ব’লে যেতে থাকে এটা শুদ্ধ, ওটা শুদ্ধ, সেটা শুদ্ধ; আর এটা অশুদ্ধ, ওটা অশুদ্ধ, সেটা অশুদ্ধ। চাই শুধু শুদ্ধতা। ব্যাকরণের প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি সূত্র শ্লোগানের মতো বলে এ-কথা। ব্যাকরণের উৎপত্তিই ঘটেছিলো ভাষার কোন শব্দটি শুদ্ধ আর কোনটি অশুদ্ধ, তা নির্দেশ করার জন্যে। কোনো একটি জাতি যখন নিজের ভাষার মানরূপ স্থির করতে চায়, দূর করতে চায় ভাষার নানা রকম বিশৃ খলা, তখন তাদের মধ্যে উৎসাহ দেখা দেয় ব্যাকরণ রচনার। এমন উৎসাহ দেখা গিয়েছিলো প্রাচীন গ্রিসে, পুরোনো ভারতে, আঠারোশতকের ইংল্যান্ডে। ব্যাকরণবিদেরা খুঁজেখুঁজে বের করেন নানা সূ ত্র, বহু নিয়ম। ভাষার কিছুকিছু ব্যাপারকে তাঁরা ঘোষণা করেন অশুদ্ধ ব’লে। অন্যরা মেনে নেয় ব্যাকরণরচয়িতার অনুশাসন। তখন ভাষা পেতে থাকে স্থির সুস্থিত রূপ। যে-ব্যাকরণ ভাষার নিয়মকানুনসূত্র স্থির ক’রে দেয়, শুদ্ধ প্রয়োগের বিধান দেয়, তাকে বলা হয় ‘আনুশাসনিক ব্যাকরণ’। এর অন্য নাম ‘প্রথাগত ব্যাকরণ’। আধুনিক কালে অবশ্য জন্ম নিয়েছে নতুন এক ধরনের ব্যাকরণ, যা শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা সম্পর্কে বলে না কিছু; শুধু বর্ণনা করে, কেবল ব্যাখ্যা করে। কিন্তু প্রথাগত ব্যাকরণের জন্ম হয়েছিলো ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ শেখানোর উদ্দেশ্যে। ভারতবর্ষ খুব বিখ্যাত ব্যাকরণের জন্যে। এ-অঞ্চল পরিপূর্ণ পাণিনিতে আর পতঞ্জলিতে। কিন্তু আদিযুগে আর মধ্যযুগে কোনো বাঙালি বোধ করে নি বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার উৎসাহ। ব্যাকরণবিদেরা সব ব্যস্ত ছিলেন সংস্কৃত ব্যাকরণ নিয়ে।
বাঙলা ভাষার বিকাশ ঘটানোর কোনো আগ্রহ ছিলো না পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউর। তাঁর আগ্রহ ছিলো জেসাসের ধর্ম প্রচারে। তবুও তিনিই হলেন বাঙলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণরচয়িতা। ১৭৪৩ অব্দে পর্তুগালের লিসবন শহরে বেরিয়েছিলো তাঁর যে-অভিধানটি, তাতে পাদ্রি আসসুম্পসাঁউ জুড়ে দিয়েছিলেন একখানি সংক্ষিপ্ত, খণ্ডিত, বাঙলা ব্যাকরণ। ব্যাকরণটি সংক্ষিপ্ত, খণ্ডিত, অপরিকল্পিত। আসসুম্পসাঁউর অভিধান-ব্যাকরণ ছিলো খুবই লাজুক; চোখের আড়ালে গোপনে থেকে গেছে আঠারো আর উনিশ শতক। তাই তা কোনো উপকারে আসে নি বাঙালি ও বাঙলা ভাষার। কিন্তু তা খুব উপকার করেছে রচয়িতার। এ-যুগল গ্রন্থ রচয়িতার জন্যে মরলোকে এনে দিয়েছে অমরতা।
১৭৭৮। ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। বাঙলা ব্যাকরণ। ঢালাই করা বাঙলা বর্ণমালা। চারটি ব্যাপার—অব্দ, ব্যক্তি, ভাষা, মুদ্রণ—একসাথে দেখা দিয়েছিলো বাঙলা ভাষার জীবনে। ওই বছর ইংরেজ হ্যালহেড প্রকাশ করেন বাঙলা ভাষার প্রথম ব্যাপক ও পরিকল্পিত ব্যাকরণপুস্তক। হুগলি থেকে বেরিয়েছিলো তাঁর বিখ্যাত ব্যাকরণ এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ। ১৭৭৮ অব্দে। সব দিক থেকেই চমৎকার বই হ্যালহেডের ব্যাকরণটি। ছাপা ঝকঝকে, অক্ষরগুলো সুশ্রী সুন্দর। এ-ব্যাকরণের জন্যেই প্রথম ধাতুতে ঢালাই হয় বাঙলা বর্ণমালা। বাঙলা ভাষা ঢালাই করা অক্ষরে মুদ্রাযন্ত্রস্থ হয় এ-ব্যাকরণেই সর্বপ্রথম। হ্যালহেডের বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ অতি-উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে বাঙলা ব্যাকরণ ও মুদ্রণের ইতিহাসে। ব্যাকরণরচয়িতা হিশেবেও চমৎকার ছিলেন হ্যালহেড। ভালোবেসেছিলেন তিনি বাঙলা ভাষাকে; বাসনা ছিলো তাঁর বাঙলা ভাষাকে একটি বিকশিত ভাষায় পরিণত করার। হ্যালহেড বাঙলা ভাষার প্রথম প্রথাগত ব্যাকরণবিদ, যিনি কিছু নিয়ম স্থির ক’রে দিতে চেয়েছিলেন বাঙলা ভাষার। হ্যালহেড থেকেই সূচনা ঘটে ধারাবাহিক ব্যাকরণ রচনার; প্রথমে ইংরেজি ভাষায়, পরে বাঙলা ভাষায়।
বাঙলা ভাষার আদি ব্যাকরণপ্রণেতারা বিদেশি ও বিভাষী। তাঁরা লাতিন ও ইংরেজি ব্যাকরণের আদলে রচনা করেন বাঙলা ব্যাকরণ। তারপর আসেন সংস্কৃত পণ্ডিতেরা। তাঁরা বাঙলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুষ্ট মেয়ে ভেবে তাকে সৎপথে আনার জন্যে সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঠামোতে রচনা করতে থাকেন বাঙলা ব্যাকরণ। আর বাঙলা ভাষা, তার স্বভাব অনেকটা সোনার মতো, কখনো এদিকে কখনো ওদিকে বেঁকে না-ভেঙে লাভ করতে থাকে নিজের চরিত্র। উনিশশতকের প্রথাগত ব্যাকরণরচয়িতারা অনেক নিয়ম স্থির ক’রে দিয়েছিলেন বাঙলা ভাষার। তার কিছুটা মেনেছে বাঙলা ভাষা, মানে নি কিছুটা। এগিয়েছে সামনের দিকে। তারপর উনিশশতকের শেষ দশকে দেখা দেন একদল ব্যাকরণবিদ : দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং আরো অনেকে। তাঁরা বাঙলা ভাষাকে দেখতে চান বাঙলা হিশেবেই, সংস্কৃতরূপে নয়। তাঁরা খুঁজে বের করেন বাঙলা ভাষার বহু একান্ত আপন বৈশিষ্ট্য।
হ্যালহেডের পর একটি ধারা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো বাঙলা ব্যাকরণ রচনার। উনিশশতকের শুরুতেই বেরোয় উইলিয়ম কেরির ব্যাকরণ এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। তিনি আর হ্যালহেডের মতো বাঙলাকে ‘বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলেন নি, বলেছেন, ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’। তারপর ইংরেজিতে বাঙলা ব্যাকরণ লেখেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য (১৮১৬), জেমস কিথ (১৮২১), রামমোহন রায় (১৮২৬)। বাঙলা ভাষায় যে-বাঙালি প্রথম বাঙলা ব্যাকরণ রচনা করেন, তাঁর নাম রামমোহন রায়। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ১৮৩৩ অব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর “গৌড়ীয় ব্যাকরণ”। উনিশশতকে আরো অনেকে লিখেছিলেন বাঙলা ব্যাকরণ। তাঁদের মধ্যে আছেন শ্যামাচরণ গাঙ্গুলি, যদুনাথ ভট্টাচার্য, শ্যামাচরণ সরকার, ব্রজনাথ বিদ্যালঙ্কার, নিত্যানন্দ চক্রবর্তী, নীলমণি মুখোপাধ্যায়, প্রসন্নচন্দ্র বিদ্যারত্ন, নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ, এবং আরো অনেকে। তাঁদের ব্যাকরণ ছিলো ছাত্রপাঠ্য : ইংরেজদের ও বাঙালি কিশোর-তরুণ ছাত্রদের বাঙলা শেখানোর জন্যেই রচিত এগুলো। ত্রুটিও আছে অনেক। তবু এ-ব্যাকরণরাশি নানাভাবে সাহায্য করেছিলো বাঙলা ভাষার মানরূপ সুস্থিতিতে।