ব্যাকরণিয়া রবীন্দ্রনাথ
সব যুগে আর সব জাতের মধ্যে দেখা যায় যে, নিছক ব্যাকরণিয়াদের সম্বন্ধে সাধারণ শিক্ষিত লোকের যে ধারণা বিদ্যমান সেটি একটি বিশেষ মিশ্র বস্তু, তাতে শ্রদ্ধা বা প্রীতির চেয়ে অবজ্ঞা, করুণা আর প্রকট বা প্রচ্ছন্ন ভয়ের ভাগ-ই বেশি থাকে বলে মনে হয়। অবজ্ঞা এইজন্যে যে, কিছু সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করা তাদের সাধ্যের অতীত; করুণা, কারণ ব্যাকরণিয়া ভাষার ছোবড়া নিয়েই ব্যস্ত, তারা সাহিত্যের রসের উপভোক্তা হবার শক্তি রাখে না,—তাদের কাছে সাহিত্যের মূল্য কেবল এইজন্যেই যে, ব্যাকরণ আর অলংকারের উদাহরণ যোগায় বলে ‘সাহিত্য’-কে এই দুই শাস্ত্রের ‘সহিত’ পড়া চলে; আর ভয় এইজন্যে যে, ব্যাকরণিয়ারা ভাষার নাড়ীনক্ষত্র আর তার আইনকানুন সব জানে, তারা অনায়াসেই লেখার দোষ দেখিয়ে দিতে পারে আর তাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুক্তিতে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারি না। ব্যাকরণিয়া যেন সাহিত্যনগরীর পাহারাওয়ালা। এই নগরে চলাফেরা করতে হলে—কি তার বড়ো সড়কে আর কি তার গলিঘুঁজিতে যাতায়াতের নিয়ম মেনে চলা চাই—এই পাহারাওয়ালা সারাক্ষণ পাশে রয়েছেন তালিম দিতে, তা মিষ্টি গলায়ই হোক, আর হুমকি দিয়েই হোক। সাহিত্যের নগরের সহজ নাগরিক যারা নয়, যারা সাহিত্য বিষয়ে জানপদ, যারা অজ্ঞানতার জন্য এই নগরীর বিধি-নিয়ম ভাঙতে খুবই পটু সেই রকম ‘গাঁওয়ার’ লেখক বা সাহিত্যিকম্মন্যেরা এই পাহারাওয়ালাদের জন্য বড়োই অস্বস্তি বোধ করে। আর অন্য সাধারণ লোক যারা সাহিত্যের হাটে খালি মজা দেখতে চায়, তারাও অনেক সময়ে এই পাহারাওয়ালাদের টিকটিক করাটা পছন্দ করে না। অনেক জায়গায় আবার ব্যাকরণিয়া অনাবশ্যক বড়ো বেশি চিৎকার করে। তার আইনকানুন যে মাঝে-মাঝে বদলানোর দরকার সে-খেয়াল তার থাকে না, আর কতদূর পর্যন্ত তার এলাকা সেটাও সে নিজে ভালোরকম জানে না।
আগেকার যুগের ব্যাকরণিয়ারা যে বিদ্যাটুকু নিয়ে আসর জমিয়ে এসেছে, দেখা যাচ্ছে যে আধুনিককালে জীবন্ত ভাষার ব্যাকরণিয়াদের আর খালি সে বিদ্যাটুকুতে আঁটছে না। দু-পাত সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়ে—তাও আবার অত্যন্ত আবছা-আবছা-ভাবে—বাঙলা ভাষার দরবারে মোড়লি করা আর সম্ভব হচ্ছে না। যেমন খালি লাটিনের আর গ্রিকের ওস্তাদ হয়ে ইংরিজি ভাষায় আজকাল আর অপ্রতিহতভাবে রাজ্য শাসন করা চলে না। বৈয়াকরণকে এখন ভাষাতাত্ত্বিক হতে হচ্ছে; খালি পুরাতন ভাষার বা আর্য ব্যাকরণের নজির দেখিয়ে তার বাড়াবাড়ি নিয়ে আস্ফালন কেউ মানতে চায় না। আধুনিক ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে যাঁরা কিছু বলতে চান, তাঁদের গুরুমশাইগিরি ছেড়ে এখন আধুনিক জীবন্ত ভাষার রীতিনীতি নিয়ে অনুশীলন করতে হবে,—এর গতি এর নিয়ম সব বার করতে হবে। তাঁদের এখন নিজের ভাষার সব তল্লাটের খবর রাখতে হবে, কেবল ভাষা-সরস্বতীর উদ্দন্ড চৌকিদার হয়ে সাহিত্যিক আর পাঠকের মনে ব্যাকরণ-বিভীষিকা জাগিয়ে তুললে চলবে না। সমগ্র সাহিত্যনগরীর বা ভাষা-বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিজে জেনে সাধারণ অব্যবসায়ীদের মুখ্য কথাগুলি সহজবোধ্য সুখবোধ্য করে বুঝিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা নিজের ভাষা আর তার গতি আর সঙ্গে সঙ্গে তার সাহিত্যের বিশিষ্টতা আর বৈচিত্র্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, আর এই নবীন রীতির ব্যাকরণিয়াদের দ্বারা তাদের চোখের সামনে ধরে দেওয়া ভাষার নিয়ম বা সূত্রগুলির সার্থকতা উপলব্ধি করে চলতে পারে।
বাঙলা ভাষা এখনও সাবেক কালের এইসব চৌকিদার ব্যাকরণিয়াদের হাত থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি পায়নি। এঁরা এখনও ‘পৃষ্ঠ’ না লিখে ‘পৃষ্ঠা’ লিখলে আপত্তি করেন—‘পরিষৎ-মন্দির’, ‘পাশ্চাত্য’, ‘সৃজন’, ‘সহায়ক’, ‘অন্তর্যামী’, ‘নিস্তেজ’, ‘রজকিনী’, ‘বিবরণী’, ‘স্বর্গীয়’ প্রভৃতি বাঙলার পদ দেখতে পেলে এঁরা এখনও বাঙলা ভাষার দুরবস্থার কথা ভেবে আকুল হন, আর কেউ কেউ বা আবেগের ভরে কবিতাও লিখে ফেলেন। এইসব ব্যাকরণিয়াদের হাতে বাঙালি শিক্ষিত লোকে ইস্কুল-পাঠ্য ব্যাকরণ আর ছেলেদের শাসনের ভারটা অর্পণ করে দিয়ে, ভাষা বিষয়ে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে, আর নিশ্চিন্ত মনে এতদিন ধরে যেমন শব্দ বা ভাষা সাধারণ জীবনে সে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত সেইরকম ভাষা বা শব্দ সাহিত্যেও ব্যবহার করে আসছে—সংস্কৃত অভিধানের সঙ্গে মিলিয়ে নেবার তার ফুরসৎও নেই, ইচ্ছাও নেই। চৌকিদার ব্যাকরণিয়া মাঝে মাঝে ‘বে-আইনি হলো!’ বলে চেঁচালেও সেকথা কেউ মানছে না—ইস্কুল-কলেজের ‘পা শা র্থী’ পড়োদের কেউ কেউ ছাড়া।
বাঙলা ভাষার রাজ্যে এখন বহু বিষয়ে অরাজকতা চলছে। এখানে শৃঙ্খলা আনা চাই। কিন্তু এ বড়ো কঠিন কাজ। প্রথমেই তো দেখা যায়, বাঙলার বানান-সম্বন্ধে কোনো নিয়ম নেই। ‘তৎসম’ বা সংস্কৃত শব্দ যেগুলি ভাষায় আমদানি করা হয়েছে আর যেগুলি নিজেদের মূল সংস্কৃত রূপ অনেকটা অক্ষুণ্ণ রেখেছে (তা উচ্চারণেই হোক আর কেবল বানানেই হোক), সেগুলি নিয়ে কোনও গোল নেই। সেগুলি বাঙলা ভাষায় সংস্কৃত বানান-ই বজায় রাখবে। অর্ধতৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে ধার করে নেওয়া আর তারপর বাঙালির মুখে বিকৃত হয়ে যাওয়া শব্দ নিয়েও তেমন ঝঞ্ঝাট নেই; এগুলিকে আমরা প্রায় উচ্চারণ অনুসারে বানান করি, যেমন ‘কেষ্ট, নেমন্তন্ন, চন্নামের্ত, চক্কত্তী, ভটচাজ, শীগগির, মোচ্ছব’, ইত্যাদি। কিন্তু যত গোল ‘তদ্ভব’ অর্থাৎ প্রাকৃতের মধ্যে দিয়ে পাওয়া অর্থাৎ কিনা খাঁটি বাঙলার শব্দ আর রূপে। বিদেশী শব্দের সম্বন্ধেও আমাদের কোনো শৃঙ্খলা নেই। যাঁরা ‘কাজ’ শব্দকে অন্তস্থ ‘য’ দিয়ে বা ‘সোনা’ শব্দকে মূর্ধন্য ‘ণ’ না দিয়ে লিখলে ভাষার বিরুদ্ধে অপরাধ করা হলো মনে করেন, তাঁরা অম্লান বদনে—আর অকম্পিত করে—দন্ত্য ‘স’ দিয়ে ‘সাধ সরম সহর’ লেখেন, তালব্য ‘শ’ দিয়ে ‘শোওয়া’ লেখেন, আর মূর্ধন্য ‘ষ’ দিয়ে ‘জিনিষ’ লেখেন। সংস্কৃত ব্যাকরণিয়াদের হাতে পড়ে বাঙলার প্রাকৃতজ তদ্ভব শব্দগুলি তাদের বানানের ইতিহাসকে ভুলে গিয়েছে। এসব বিষয়ের সমাধান করতে গেলে, ব্যাকরণের খুঁটিনাটি আলোচনা করে যাঁরা আনন্দ পান এমন বাঙালির বাঙলা ভাষার ইতিহাস আর তার আধুনিককালের হালচালের সম্বন্ধে ঠিক খবর জানবার জন্য চেষ্টা করা উচিত। ভাষার ঠিক স্বরূপটি নির্ণয় হলে তবে তার সম্বন্ধে নিয়মাবলী করতে পারা যাবে।
বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ অনেক লেখা হয়েছে, কিন্তু তার সবগুলিই হচ্ছে সংস্কৃতের আওতায় বেড়ে-ওঠা আধুনিক সাহিত্যের ‘সাধুভাষা’-র ব্যাকরণ। বাঙলার ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় যেটুকু কাজ হয়েছে তাও নগণ্য। বিদেশীরা যা কিছু একটু এবিষয়ে অন্য ভাষার সঙ্গে তুলনা করবার কালে করেছেন। বাঙলাভাষীদের মধ্যে প্রথম মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় বাঙলা ভাষায় বাঙলা ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন (গৌড়ীয় ব্যাকরণ, প্রকাশকাল ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ)। এই বইয়ে রামমোহন তাঁর অনন্যসাধারণ সহজ সুবুদ্ধির পরিচয় দেন। বাঙলা ভাষার শব্দ-সাধন বললে বাঙালি ব্যাকরণিয়া বুঝতেন ভাষাগত সংস্কৃত শব্দের সাধন,—খাঁটি বাঙলা তদ্ভব শব্দ নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাতে চাইতেন না—বাঙলার ঠিক রূপটি কী সেবিষয়ে সাধারণত কোনো ধারণা তাঁদের না থাকায়। ১৮৮১ সালে চিন্তামণি গাঙ্গুলী মহাশয় তাঁর বাঙলা ব্যাকরণে এই বিষয়ে আলোচনা করেন, আর খাঁটি বাঙলার শব্দ আর প্রত্যয় নিয়ে ‘ঐতিহাসিক আলোচনা’ করেন, তাদের উৎপত্তি আর বিকাশের সূত্র বার করবার চেষ্টা করেন।
কিন্তু আধুনিককালের কথিত বাঙলা ভাষার আলোচনায় কতকগুলি মৌলিক প্রসঙ্গ বাঙালির কাছে প্রথম উত্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মন্তব্যগুলি ১২৯৮ সাল থেকে বার হতে থাকে, সেগুলিকে ‘শব্দতত্ত্ব’ নাম দিয়ে আলাদা বইয়ের আকারে প্রকাশ করা হয়েছে; পরে দু-একটি লেখা—যেমন বাঙলা তির্যক রূপের উপর—প্রবাসী পত্রিকায় আর অন্যত্র বেরিয়েছে। কোন পথ ধরে বাঙলা ভাষার চর্চা করতে হবে তা এমন করে তাঁর আগে কেউ দেখাতে পারেননি। আধুনিক মতে ব্যাকরণের তিনি অঙ্গ—১. উচ্চারণ-বানান-ছন্দ, ২. সুপ-তিঙ-কৃৎ-তদ্ধিত শব্দসাধন, আর ৩. বাক্যরীতি। এর মধ্যে উচ্চারণটা-ই এক হিসাবে সবচেয়ে বেশি দরকারী জিনিস—উচ্চারণের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষায় বিভক্তি আর প্রত্যয়ও বদলায়, ভাষার পরিবর্তন ঘটে। বাঙলার উচ্চারণ সম্বন্ধে কতকগুলি অতি সাধারণ কথা—এত সাধারণ কথা যে সেগুলি আমরা আগে লক্ষ্যই করিনি—রবীন্দ্রনাথ প্রথম আমাদের চোখের সামনে ধরে দেন। বাঙলার ধ্বনি-সমষ্টির ইতিহাসের সবচেয়ে বিশিষ্ট কতকগুলি সূত্র বোধহয় রবীন্দ্রনাথ-ই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন (তাঁর ‘বাঙলা উচ্চারণ’, ‘টা টো টে’, ‘স্বরবর্ণ অ’, ‘স্বরবর্ণ এ’,—১২৯২ আর ১২৯৯ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ-চতুষ্টয়ে)। কি কোল, কি দ্রাবিড়, কি আর্য,—আধুনিককালের সমস্ত ভারতীয় ভাষার একটি প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে তাদের ধ্বন্যাত্মক শব্দ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ১৩০৭ সালে প্রকাশিত ‘ধ্বন্যাত্মক শব্দ’ প্রবন্ধে বাঙলা ভাষায় ব্যবহৃত এইরূপ শব্দের একটি পূর্ণ সংগ্রহ দিয়েছেন,—আর এইরূপ শব্দ ব্যবহারের অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ত্বটুকু তাঁর কবি-মনের কাছে যেরূপ প্রকাশ পেয়েছে তা তিনি ব্যক্ত করেছেন। ভারতের আর কোনো ভাষায় এইরকম শব্দের এর চেয়ে ভালো আলোচনা আছে কিনা জানি না। পরে ১৩১৪ সালে স্বর্গীয় আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয় সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা-য় ‘ধ্বনি-বিচার’ নামে এক উপাদেয় আর বহু বিচারপূর্ণ প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে আরও খুঁটিয়ে আলোচনা করেন। তেমনি রবীন্দ্রনাথের ‘বাঙলা শব্দদ্বৈত’ (১৩০৭ সাল), ‘বাঙলা কৃৎ ও তদ্ধিত’ (১৩০৮), ‘সম্বন্ধে কার’ (১৩০৫) আর ‘বাঙলা বহুবচন’ (১৩০৫) প্রবন্ধে ওই ওই বিষয়ে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য আলোচনা আছে। বীমসের বাঙলা ব্যাকরণ সমালোচনা উপলক্ষ্যে (১৩০৫ সালে লেখা) বাঙলার উচ্চারণ সম্বন্ধে তিনি কতকগুলি মূল্যবান মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন; আর তাঁর ‘ভাষার ইঙ্গিত’ প্রবন্ধে বাঙলার কতকগুলি সাধারণ কতৃক অলক্ষিত বিশেষত্ব পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে।
বাঙলা ভাষার চর্চায় বাঙলার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক, আধুনিক জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক ও চিন্তা-নেতা যে পথ দেখিয়েছেন—যে কথিত ভাষায় পূর্ণ আলোচনা বিনা কোনো ভাষায় ব্যাকরণ বা ইতিহাস লেখা হতে পারে না—সেইটেই বাঙলার ব্যাকরণ আর ইতিহাস আলোচকের পক্ষে একমাত্র পথ। ভাষাতত্ত্বের আলোচনা কেবল উপলব্ধি দ্বারা হয় না, একে প্রতি পদে বাঙময় বস্তুকে, উচ্চারিত শব্দকে আশ্রয় করে চলতে হয়। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের গভীর অধ্যয়নের আর চিন্তার বহু প্রমাণ তাঁর লেখা থেকে পাওয়া যায়। এই বিদ্যার আলোচনায় যে পরিশ্রম আবশ্যক তা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। তবেই তো তিনি তাঁর সহজ-বুদ্ধিপ্রসূত ভাষার স্বরূপবোধকে বিজ্ঞানের আলো দিয়ে উদ্ভাসিত করে দেখাতে পেরেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বাঙালিকে বলেছেন যে, ‘প্রাকৃত বাঙলাভাষার নিজের একটি স্বতন্ত্র আকারপ্রকার আছে, এবং এই আকৃতি-প্রকৃতির তত্ত্ব নির্ণয় করিয়া শ্রদ্ধার সহিত অধ্যবসায়ের সহিত বাঙলাভাষার ব্যাকরণ রচনায়’ যোগ্য লোকের উৎসাহ হওয়া উচিত। সুতরাং ভবিষ্যৎ বাঙালি ব্যাকরণিয়া, যাঁরা গুরুমশাইগিরি ত্যাগ করে ‘শ্রদ্ধার সহিত অধ্যবসায়ের সহিত’ এ পথে চলবেন, তাঁদের সকলকেই রবীন্দ্রনাথকে একজন ‘পথিকৃৎ’ আর ‘পূর্ব্যঃ ঋষি:’ বলে মেনে নিতে হবে। আর আমাদের মধ্যে যারা ভাষাতত্ত্বকে উপজীব্য বিদ্যা করে নিয়েছি, যারা এর অন্ধি-সন্ধি গলিঘুঁজিতে ঘোরাঘুরি করছি আর তার মধ্যেকার ধসনা আর ঢিবি খুঁড়ে দেখবার চেষ্টা করছি, আমাদের এই সুপ্রাচীন ভাষানগরী এই সুবিরাট সাহিত্যপুরী আগে কী অবস্থায় ছিল, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে এই নগরীর কাব্য-দর্শন-ইতিহাস-রূপকর্ম প্রভৃতির নোতুন নোতুন সব বড়ো সড়কের সঙ্গে পরিচয় রাখবারও চেষ্টা করছি। জীবনের আর সাহিত্যের রসের দিকটাকে বর্জন করে একেবারে নিছক ব্যাকরণিয়া বনে যাবার প্রবৃত্তি আমাদের যাদের নেই—আমরা যদি এ বিষয়ে একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করি যে, যিনি বিশ্বসাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ রসস্রষ্টা তিনি-ই এ-বিষয়ে আমাদের অগ্রণী, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণিয়া, তাহলে আশা করি আমাদের সেই আত্মপ্রসাদটুকু সকলেই ক্ষমা করবেন।
শান্তিনিকেতন, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩