ব্যবহার বিধি
প্রতিটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসের একটা ব্যবহার বিধি আছে। ধরা যাক, শ্যাম্পু। শিশির গায়ে লেখা থাকে নির্দেশ। চুল ভিজিয়ে, হাতে ঢেলে ফ্যানা করে মাথার পেছন দিক থেকে ঘষে ঘষে সামনের দিকে চলে এসো। ধুয়ে ফেলে আবার লাগাও। তারপর ধুয়ে যাও, ধুয়ে যাও যতক্ষণ না ফেনা বেরোনো বন্ধ হয়। যেমন, উকুন মারা তেল। যেমন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। টেপ রেকর্ডার। মিকসার গ্রাইন্ডার। যেমন অম্বলের ওষুধ। চুলের কলপ। ব্যবহার-বিধি জানা না থাকলে ফল হবে বিপরীত। প্রতিটি বস্তুর গায়ে এই ব্যবহার-বিধি ছোট-ছোট হরফে লেখা থাকে সুন্দর করে, ইউস। ইলেকট্রনিকস হলে সঙ্গে থাকে নির্দেশিকা, পুস্তিকার আকারে। যাকে বলা হয় লিটারেচার।
মানুষের গায়ে লেখা থাকে না, অথচ একজন মানুষ কোনও-না-কোনও মানুষকে বা একাধিক মানুষকে ব্যবহার করে। সেই কারণেই এই জগতের আর এক নাম ব্যবহারিক জগৎ। একটি জনপ্রিয় সঙ্গীতের একটি লাইন এইরকম, মানুষ মানুষকে জীবিকা করে, মানুষ মানুষকে পণ্য করে। যে মানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাকে ব্যবহারের বিধিটা জানা থাকলে সহজেই অনেক সংঘাত এড়িয়ে চলা যায়। যেমন মেন সুইচ ‘অফ’ না করে ইলেকট্রিক প্লাগের ধাতব অংশে হাত দিলে শক খেতে হবে। কনসেনট্রেটেড অ্যাসিডে জল ঢাললে বিপদের সম্ভাবনা। অ্যালার্জি থাকলে পেনিসিলিন খাওয়ার আগে সাবধান হতে হবে। চিংড়ি মাছ সকলের সহ্য হয় না। মা মনসা ধুলোর গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। কাঁচকলায় আদা চলে না।
একজন মানুষকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা আমরা অনেক দিনের চেষ্টায় ঠেকে শিখি। আর যখন শিখলুম, তখন জীবনের মূল্যবান সময়ের অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে। সংসারের কথাই ধরা যাক। আদর্শ একটি সংসার। বাবা, মা, ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে, বাড়িতে যে মহিলা কাজ করে, একটি কুকুর, দুটি বেড়াল। ছোট একটি বাড়ি। তিনটি ঘর। বাথরুম। রান্নাঘর। দরজা, জানলা, টেবিল, টিভি, পাপোশ, খাট, সোফা কাম বেড, পাখা, আলো। সব কিছুই ব্যবহারের। এ ওকে, সে তাকে, প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ব্যবহার করছে।
এখন বাবার গায়ে বাবার ব্যবহার-বিধি যদি লেখা থাকত এই ভাবে, মাননীয় এবং গুরুপাক। বেশি নাড়ালে ব্যবহারে উপকারের চেয়ে অনুপকারের সম্ভাবনাই বেশি। সাইড এফেক্ট হতে পারে। উপেক্ষা সহ্য করতে পারেন না; যেমন ফোটো ফিল্ম আলো সহ্য করতে পারে না। যেমন টেপ গরমে জড়িয়ে যায়। যেমন পেন্ডুলামওয়ালা দেওয়াল ঘড়ি সামান্য বেঁকে গেলেই বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেশান গ্যাপের কারণে বস্তুটির বিশ্বাস, আদর্শ, মতবাদ, নীতি, নিষ্ঠা সবই আধুনিক, আধুনিকাদের কাছে পাগলের পাগলামি, বয়স্কের বোকামি বলে মনে হলেও, বস্তুটি বুক দিয়ে ভবিষ্যৎ আগলে রাখে। যতদিন বাঁচে, সংসারের মাথায় মেলা থাকে ছাতার মতো। উচ্ছে, করলা, নিমপাতা তেতো হলেও পিত্ত নাশ করে, রক্ত পরিষ্কার করে। বস্তুটিকে সহ্য করে নিতে পারলে, জীবন সুখের হয়। সংসারে শান্তি নামে। পালিশ করা টেবিল যেমন খসখসে জিনিসের ঘষা সহ্য করতে পারে না, সেইরকম এই বস্তুটিকে ব্যক্তিত্ব দিয়ে, ঔদ্ধত্য দিয়ে, অবাধ্যতা দিয়ে ঘষা মাজা করলে পালিশ চটে যাবে। সাবধানে একপাশে সযত্নে রাখুন, নিয়মিত সেবা করুন। শুনে যান, শোনাবার বা বোঝাবার চেষ্টা করবেন না। কডলিভার যেমন, স্বাদ আর গন্ধ সহ্য হয়ে গেলে, অমন উপকারী বস্তু আর দ্বিতীয় নেই।
মায়ের গায়ে যদি লেখা থাকত! অভিমানী, উপেক্ষিতা। এইরকম একটি সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক ধারণা নিয়ে বড়ই স্পর্শকাতর। মনে-মনে ভাবেন—সারাটি জীবন কী যে পেলাম, মায়া-ভরা পৃথিবীতে নিয়েছি যত, তারও বেশি হয় তো, হয় তো হয়েছে দিতে। সেবা নয়, ভালো আহারাদি নয়, ইনি একটু মনোযোগ চান। স্বীকৃতি চান। ভালো সাহিত্যিকের মতো। যে সংসার নিয়ে সাহিত্য, আকাদেমি, জ্ঞানপীঠ—সেই সংসারটাই ইনি সৃজন করেছেন। তোমরা সব বোলচাল, বেচাল এঁরই কৃপায়। তোমার অনেক গু-মুত ঘেঁটেছেন। বহু রাত বিনিদ্র কাটিয়েছেন, তোমার সেবায়। প্রয়োজনে এখনও কাটাবেন। ‘খোকা’ বলে যখন ডাকবেন, সেই ডাকে তুমি যে আন্তরিকতা পাবে, তা আর কোথাও পাবে না। ‘শুনচ’-তে পাবে অন্য জিনিস। এই বস্তুদায়িনী, জীবনদায়িনী, স্নেহ-ভালোবাসা-মমতা দিয়ে সাজানো অতুলনীয় এক নৈবেদ্য। শুধু সঙ্গ দাও, শ্রদ্ধা দাও, উৎসটিকে মুক্ত রাখো, দেখবে ঝরনাধারা। এমন এক নদী, যা শুকোয় না।
ছেলের গায়ে যদি লেখা থাকত, প্রথম বয়সে লাফাবে, মধ্য বয়সে অনুশোচনায় ভুগবে, প্রৌঢ় বয়সে ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করবে, বার্ধক্যে মেনে নেবে পিতার ভাগ্য। প্রজন্ম-সেতুর দু-প্রান্তের দুই স্তম্ভ, পিতা ও পুত্র। এই স্তম্ভের পার্শ্ব পরিবর্তন হয়। উপেক্ষা করলে, দূরে সরে যায়। স্নেহে বশ মানে। সমালোচনায় বিদ্রোহী হয়! স্বাধীন হতে চায় তাড়াতাড়ি। শাসনে বেগড়ায়, আদরে মাথায় চড়ে। নরমগরম ট্রিটমেন্টেই খোলতাই হয়। তাড়াতাড়ি সংসারী করে কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে দেওয়াই ভালো, নয়তো ভুল করে এফ ডবল ও এল, ফুল হয়ে যেতে পারে। এরা হল কাগজের টুকরো, যেকোনও বাতাসে সংসারের টেবিল থেকে উড়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি পেপার ওয়েটের তলায় ফেলে দাও।
স্বামীর গায়ে যদি, ম্যানুফ্যাকচারার লিখে দিতেন—আসলে, এই বস্তুটি একটি মোটর গাড়ি। সংসারের সবাই এটি চেপে হাওয়া খেতে বেরোতে পারেন। ব্যাটারি ডাউন গাড়ির। সেল্ফ কাজ করে না। হয় হাতল মেরে, না-হয় ঠেলে স্টার্ট করাতে হয়। সকালে একবার চালু করে দিতে পারলে, গ্যারেজ না হওয়া তক, বেশ ভালোই চলে। গতির চেয়েই শব্দ একটু বেশি; কারণ এগজস্টে অনেক ময়লা জমেছে। এ গাড়ির তেল হল আশা। মবিল হল উপার্জন। সেই আশা-পোড়া ছাই এগজস্টে জমে আছে। জমেছে ক্রোধ আর হতাশা। এই গাড়ির অ্যাকসিলারেটার হল ক্রোধ। রেগে গেলে স্পিড বাড়ে। অনেকে এটিকে গাধা ভাবে। নাকের ডগায় গাজর ঝোলালে ভালো সার্ভিস দেয়।
আর যদি স্ত্রীর গায়ে লেখা থাকত, এই বস্তুটি হল ড্রাইভার কাম ডিনামাইট কাম আতসবাজি কাম কাচের শার্সি। ড্রাইভার সর্ব অর্থে। গাড়ির ড্রাইভার, তখন এঁরই হাতে স্টিয়ারিং, গিয়ার। মোটর মেকানিজম ভালোই জানেন, তখন ইনি স্বয়ং একটি স্ক্রু ড্রাইভার। ভালোই জানেন, কোন স্ক্রু আলগা করতে হবে, কোনটাকে কি পরিমাণ টাইট দিতে হবে। এঁরই পায়ের কাছে ব্রেক আর অ্যাকসিলারেটার। আসেন ড্রাইভার হিসাবে বছর না-ঘুরতেই মালিক। ইনি স্টিক ডিনামাইট। সম্পর্কের ফাটলে ঢুকিয়ে পলতেতে আগুন দিলেই সংসার শতখণ্ড। এমনি ফাটলে শুধুই শব্দ, যেন বুড়ি মার চকোলেট বোম। খুশি রাখতে পারলে আতসবাজি। সংসারের জানালার কাচের শার্সি। ঢিল ছুঁড়ো না ভুলে।