তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

ব্যবহার ও বিতাড়নের ইতিহাস: জাতীয়তাবাদ ও রাবীন্দ্রিক উপন্যাসে নারী – অর্পিতা ব্যানার্জি

ব্যবহার ও বিতাড়নের ইতিহাস জাতীয়তাবাদ ও রাবীন্দ্রিক উপন্যাসে নারী – অর্পিতা ব্যানার্জি

ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বহুস্তরীয় ও দ্ব্যর্থবোধক প্রকরণগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহা আখ্যানগুলির ব্যাখ্যাবৃত্তের বাইরে থেকে যায়। তাই প্রতিরোধ এমনকী মুক্তি প্রকল্পগুলিও যে সহজ সমীকরণে ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের অবসানকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল তা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে অতিসরলীকৃত। বিষয়টি আরও জটিলতর হয়ে ওঠে তখনই যখন ‘বিষয়ী’ (Subject) হিসেবে ‘নারী’কে স্থাপন করা হয় সেই ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে যেখানে প্রভুত্বকারী এবং প্রভুত্বাধীন দু’টি পুরুষতন্ত্র এক অভিনব সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়। এমতো পরিস্থিতিতে ‘নারী’কে চিহ্নিত করা সেই ছিদ্রাল ভেদ্যস্তর হিসেবে যাকে কেন্দ্র করে দূষিত হতে পারে জাতি-বিশুদ্ধতা। তাই ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটের এক বিশেষ পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই প্রভুত্বকারী এবং প্রভুত্বাধীন পুরুষতন্ত্র অভিসন্ধিগতভাবে প্রায় একই অবস্থানে পৌঁছে যায়। উভয় পুরুষতন্ত্রের ক্ষেত্রেই সে-কারণে ‘নারী’কে নিয়ন্ত্রণ, অবদমন এবং বিশিষ্টভাবে আদর্শায়িত করার তীব্র প্রচেষ্টা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে যে, এই বাস্তবতাই অনেক ক্ষেত্রে উপনিবেশরেখার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষতন্ত্রের সামনে নারীকে একইভাবে শৃঙ্খলিত ‘বিষয়ী’ হিসাবে হাজির করতে উদ্যত হয়। তাই ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে মুক্তি প্রকল্পগুলির আঙ্গিক যেমনই হোক না কেন সেখানে বিষয়ী হিসেবে ‘নারী’ এবং ‘পুরুষ’কে একইভাবে শামিল করা সম্ভব হয়নি। আর সে-কারণেই ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সবচেয়ে জনপ্রিয় রণনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’ সংক্রান্ত মূলস্রোত রাজনীতিতে নারীকে কতখানি অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেই প্রশ্নটিই হয়তো যেকোনও নির্ধারণবাদী অবস্থান থেকে বিচার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এবং বিষয়ী হিসেবে নারীর যে পারস্পরিক অবস্থান, তার জটিলতাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে আশিস নন্দী বলছেন যে, উপনিবেশবাদ দেশীয় পুরুষতন্ত্রের এক প্রতীকী নির্বীর্যকরণ ঘটিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে এই আঘাত প্রভুত্বাধীন পুরুষতন্ত্রের আত্মমূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক বিরল আঘাত হানে। তাই উপনিবেশবাদ নেহাতই কেবল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক স্বনিয়ন্ত্রণ হারানোর সনদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে না, আত্মপ্রকাশ করে ‘অক্ষম’ করে দেওয়ার একটি ‘পেশিবলসর্বস্ব’ পৌরুষ আশ্রিত সন্দর্ভ হিসেবেও। এমতাবস্থায় ‘হীনবীর্য’ দেশীয় পুরুষতন্ত্র, গণপরিসরের হৃত গৌরবকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেছে নেয় গৃহপরিসরকে, যা ছিল তথাকথিতভাবে নারীর বিচরণস্থল। এমতাবস্থায় অতিসচেতন দেশীয় পুরুষতন্ত্র তার প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে যে জাতীয়তাবাদী প্রকল্প নির্মাণ করে তাকে জারিত করে রাখে হিংসাশ্রয়ী বীররস এবং যেকোনও প্রতিরোধ, প্রতিস্পর্ধার মূল ভাষাই হয়ে ওঠে অতিপুরুষালি (Hyper-masculine)। প্রকৃত প্রস্তাবে এভাবেই পরাভূত একটি জনসমাজকে জাতীয়তাবাদী মুক্তি প্রকল্প সক্ষমতার এক অলীক স্বপ্নে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যদিও এই উদ্যোগেও উপনিবেশিত জনসমাজ অনুকরণ করে তার ঔপনিবেশিক পিতার ভাষাকেই। পার্থ চ্যাটার্জি তাই খুব সংগতভাবেই দেখান যে, সূচনাকাল থেকেই জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের অন্তর্বিশ্বে তৈরি হয়েছিল কিছু বিপ্রতীপ টান। হীনমন্যতাবোধ ও নিরাপত্তাহীনতাকে কাটিয়ে উঠতে তাই দেশীয় পুরুষতন্ত্র ঔপনিবেশিক পরিসরকে বিভাজিত করেছিল ‘বস্তুগত ক্ষেত্র’ (Material sphere) এবং ‘সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র’ (Spiritual sphere)-এ। এই ‘দ্বিবিভাজন’-এর মাধ্যমে সে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল যে, বস্তুগত পরিসরে পশ্চিমি সভ্যতাগুলি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং বস্তুগত প্রেক্ষিতে এই উৎকৃষ্টতাই তাদের অ-ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম করে তুলেছে। অন্য দিকে আধ্যাত্মিক পরিসরে পূর্বের রাষ্ট্রগুলি সমৃদ্ধতর। ফলত বস্তুজগতে প্রভুত্বাধীনের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ঐতিহ্যগত দিক থেকে জাতীয় সংস্কৃতিকে পুনঃসজ্জিত করা প্রয়োজন হলেও, প্রক্রিয়াটি সীমাবদ্ধ থাকবে কেবল বস্তুগত পরিসরেই। মূলত এই যুক্তিতেই ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে জন্ম নিল কিছু আপাত নিরীহ দ্ব্যণুক বিভাজন, যেমন বস্তুজগৎ/আধ্যাত্মিক জগৎ, বহির্জগৎ/অন্তর্জগৎ এবং গৃহপরিসর/গণপরিসর। এক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী মুক্তিকামী প্রকল্পগুলি দেখাতে চেষ্টা করল যে, ‘বস্তুগত’, ‘বহির্জগৎ’, ‘গণপরিসর’-এর মতো বিষয়গুলি প্রভুত্বাধীনের সত্তাবহির্ভূত বিষয়, এগুলি কেবলই বাহ্যিক এবং সেগুলি কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রভুত্বাধীনের ক্রিয়াপরিবর্তগুলিকে (Alternative) প্রভাবিত করতে পারে মাত্র, কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রভুত্বাধীনের চৈতন্যের জগৎকে গ্রাস করতে পারে না। তাই জাতীয়তাবাদী মুক্তি প্রকল্পগুলির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রভুত্বাধীনের বিশুদ্ধ অন্তর্জগৎকে যাবতীয় কলুষতামুক্ত রাখা। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তর্জগতের আধ্যাত্মিক স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রভুত্বাধীনের প্রকৃত সত্তা থাকবে অসংক্রামিত। মূলত এই যুক্তিটিই পরবর্তীকালে আরোপিত হয় দু’টি বায়ুনিরুদ্ধ প্রকোষ্ঠবদ্ধ পরিসর হিসেবে ‘গৃহপরিসর’ এবং ‘গণপরিসর’কে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। অসংক্রামিত ‘আধ্যাত্মিক আত্ম’র (Spiritual Self) বিচরণস্থল হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায় গৃহপরিসর। আর ‘নারী’ এবং তাঁর তথাকথিত বিচরণক্ষেত্র গৃহপরিসর হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী স্বাজাত্যবোধ এবং অস্মিতাগত স্বাতন্ত্র্যবোধের ধারক এবং বাহক। আর এইভাবেই গণপরিসরে মর্যাদাহানির কাহিনিটিকে আপ্রাণ গোপন করতে গৃহপরিসরের উপর প্রভুত্বাধীন পুরুষতন্ত্র এক প্রশ্নাতীত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এমতাবস্থায় ঔপনিবেশিক শাসন-ত্রাসনের প্রশ্নে নারী স্বভাবতই তার পুরুষ সহযোদ্ধার পাশে একই শর্তে দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রকৃতপক্ষে লিঙ্গ নির্বিশেষে উপনিবেশবাদও তাই আর কেবল একটি সরল জ্ঞানতাত্ত্বিক (Epistemological) এবং সত্তাতাত্ত্বিক (Ontological) সন্ত্রাসের ইতিহাস হয়ে থেকে যায় না। ফলত প্রাধান্য ও প্রতিরোধের সব ভাষাতেই আসে গভীর দ্ব্যর্থবোধকতা (Ambivalence)। স্বভাবতই বাহুবল এবং ক্ষাত্রধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার হৃদয়বিশ্ব লিঙ্গ প্রশ্নে নির্মোহ থাকে না। ফলত প্রভুত্বকারীর অতিপুরুষালি চেতনায় বিজারিত জাতীয়তাবাদী কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার পেয়েছিল সেইসব বিষয়গুলিই যা সুনিশ্চিত করেছিল বিজিত জনসমাজের পৌরুষের পুনঃস্থাপন। আর এই প্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত থেকে গেল তা হল, ‘জয়ী’ এবং ‘বিজিত’ পুরুষতন্ত্রের পেশীশক্তি-আস্ফালনের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল যে জাতীয়তাবাদ, সেই কর্মসূচিতে নারীর জন্য ঠিক কোন স্থানটি বরাদ্দ হল? গভীরতর পাঠে এবং চর্চায় এ বিষয়টি প্রতিপন্ন করা কঠিন হবে না যে, উপরিতলগতভাবে প্রত্যয়ী কিন্তু হৃদয়বিশ্বে গভীর হীনমন্যতাবোধে দীর্ণ প্রভুত্বাধীন পুরুষসমাজ তাদের হৃতপৌরুষ পুনঃস্থাপনের পরিসর হিসেবে বেছে নিয়েছিল ‘নারী’কে এবং তার তথাকথিত পরিসর গৃহস্থলকেই। এই গৃহস্থলেই হিন্দু পত্নীটির কাছ থেকে দাবি করা হয়েছিল নিঃশর্ত এবং স্বতঃপ্রণোদিত আনুগত্য এবং পবিত্রতা। স্বতঃপ্রণোদিত এই আনুগত্যই শেষপর্যন্ত পর্যবসিত হল সেই প্রতীকে যা প্রভুত্বাধীন সমাজের নৈতিক উৎকর্ষতা এবং পবিত্রতা প্রমাণ করার কাজে ব্যবহৃত হল। আর নারীর একগামিতাই এক্ষেত্রে সম্ভাব্য হিন্দু নেশনের ভিত্তিভূমিতে পর্যবসিত হল। মহিমান্বিত করা হল ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রসাধনের প্রতীক ‘বৈধব্য’কে। এই আসক্তিহীন বৈরাগ্যই প্রভুত্বাধীনের গৃহপরিসরকে করে তুলল পবিত্র আবহ মণ্ডিত। কিন্তু আপাতভাবে পবিত্র ও প্রেমময় অন্দরমহলের যে উপস্থাপনা জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণের মর্মস্থল হয়ে উঠতে চেষ্টা করছিল তা কিন্তু প্রভুত্বাধীনের অন্দরমহলের যন্ত্রণাদীর্ণ যাপনের ইতিহাসকে মুছে দিতে পারল না। ঊনবিংশ শতকের শেষ দু’টি দশকে লোককথা এবং পদ্যে এমনকী ১৮৬০-এর দশক থেকে মহিলাদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক লেখাগুলির মধ্যে থেকে উঠে আসতে থাকল এক নিরানন্দময় অন্দরমহলের ছবি, যার দ্বারা চিহ্নিত হতে থাকল সম্মতিহীন সহবাস বা বাল্যবিবাহের অসহনীয় অভিজ্ঞতাগুলি।

সম্মতি ব্যতিরেকে সংঘটিত বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী রুকমাবাই বা বালিকাবধূ ফুলমণির বৈবাহিক ধর্ষণের কারণে মৃত্যু, আদর্শ হিন্দু দাম্পত্যের ধ্বজাধারী প্রভুত্বাধীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সুখস্বপ্নকে ক্রমশ ভেঙে দিতে থাকল। আর ক্রমশই এই বিষয়টি স্পষ্ট হতে থাকল যে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ যে প্রেমহীন কঠিন নিয়মবদ্ধতায় আবদ্ধ গৃহপরিসরকে নির্মাণ করতে উদ্যত হয়েছিল তার সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল ঔপনিবেশিক বাস্তবতার। আত্মগ্লানি ও বিতৃষ্ণার আবহ থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করল একটি ভাঙনবিন্দু (Breaking point)। এমনই এক আত্মগ্লানিতে দীর্ণ জনসমাজের আত্মসমীক্ষার মুহূর্তে জাতীয়তাবাদী সন্দর্ভের মূল ভরকেন্দ্র ক্রমশই ‘দাম্পত্য’ বা আদর্শ ‘যৌথজীবন’ থেকে সরে গেল এবং এক্ষেত্রে দাম্পত্যকে প্রতিস্থাপিত করল দেশমাতৃকা ও তার বীর সন্তানদের স্নেহ সম্পর্ক।

এমতো পরিস্থিতিতে ধ্বস্ত, পরাভূত পুরুষতন্ত্রের সামনে রক্তমাংসের ‘বিষয়ী’ নারী অথবা মাতৃকারূপী প্রতীকী নারীই হয়ে উঠল সৃষ্টিক্ষমতা এবং সঞ্জীবনীশক্তির মূর্ত প্রতীক। যদিও পুরুষতান্ত্রিক এই উদ্‌যাপনে অবান্তর হয়ে পড়ল না নারীর ব্যবহার এবং বিতাড়নের ইতিহাস। প্রসঙ্গত, প্রাবন্ধিক সমীর দয়াল বলেন যে,

Nationalist discourse romanticized the redemptive love of a woman that could nurture and restore the political and social potency of damaged masculinity in the context of the long and often disheartening struggle against colonial subjugation and that would safeguard the cultural essence of Indianness.

সারসত্তাবাদী এমতো চিহ্নিতকরণের রাজনীতি যে গভীর জাতীয়তাবাদী ম্যানিপুলেশনেরই অঙ্গ তাকে প্রমাণ করতে হয়তো খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। Interpellation-এর জটিল রাজনীতি যেন পুরুষতান্ত্রিক শাসন-শোষণের ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে ‘বিষয়ী’ হিসাবে ‘নারী’কে নির্মাণের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রাবন্ধিক এমনই এক জটিল জাতীয়তাবাদী প্রেক্ষিতে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের লৈঙ্গিক মাত্রাটিকে চিনে নিতে চেষ্টা করবেন।

স্বদেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদকে একনিশ্বাসে উচ্চারণের মূলস্রোত প্রবণতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখান যে, জাতীয়তাবাদ আসলে সেই হিংসাশ্রয়ী পন্থা ও প্রকরণগুলির আশ্রয় নেয় যা সে রপ্ত করেছে প্রভুত্বকারী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই। কবির মতে, পৌরুষ- ও বাহুবল-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ ব্যক্তির অন্য সব সামাজিক পরিচিতিকে অকিঞ্চিৎকর করে দেয় এবং ব্যক্তির পরিচিতি হিসাবে রাষ্ট্রীয় সদস্যপদকে বাধ্যতামূলক করে তোলে। তৈরি হয় এক অভিনব ইতিহাসবাদ যা বিশ্বাস করে একটি অভিন্ন সরলরৈখিক পথে অতীত থেকে বর্তমানে প্রবাহিত হয় ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের যাত্রাপথে প্রতিটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতা প্রতিযোগিতায় নৈতিকতা বিবর্জিতভাবেই শামিল হয়। এই প্রতিযোগিতাই শেষপর্যন্ত ‘রাষ্ট্র’ ও জাতির স্বার্থে সন্ত্রাসের নৈর্ব্যক্তিককরণ ঘটায়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, জাতীয়তাবাদী প্রশ্নে কবির অবস্থানটি কালনিরপেক্ষভাবে একই রয়ে গিয়েছে এমন নয়। ‘স্বদেশ’ ও ‘সমাজ’ রচনার আগে এবং পরে বিষয়টি সম্পর্কে কবির অবস্থানের পরিবর্তন নিয়ে চলতে পারে এক সুদীর্ঘ আলোচনা। তবে কেবল রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবন্ধগুলির মধ্যে থেকে জাতীয়তাবাদ বিষয়ে রাবীন্দ্রিক ক্রিটিককে চিনে নিতে গেলে হয়তো আলোচনাটি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। রাজনৈতিক প্রবন্ধ, চিঠিপত্রের বাইরে বিপুল রবীন্দ্রসাহিত্যের মধ্যে বিষয়টিকে তার অসংখ্য ব্যাখ্যাসম্ভাবনায় খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়তো তাই প্রায় অনিবার্য, তবে রাবীন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের লিঙ্গপক্ষপাতী চরিত্রটিকে রাবীন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্বিশ্লেষণ করতে হলে কিছু বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা বিশেষভাবে জরুরি কারণ নারীবাদী বিশ্লেষণের পরিচিত স্ট্র্যাটেজি/রণকৌশলে সবসময় চিহ্নিত করা যাবে না বিষয়টিকে। এক্ষেত্রে আমাদের যেমন পরিচিত লৈঙ্গিক বাইনারিগুলি থেকে এক ধরনের সবিচারলব্ধ ও সচেতন দূরত্ব রাখতে হবে, তেমনই দূরত্ব রাখতে হবে লিঙ্গ রাজনীতির পরিচিত পক্ষ-প্রতিপক্ষের বাদানুবাদ থেকে।

প্রসঙ্গত ২০০২ সালে প্রকাশিত তপোব্রত ঘোষের গোরা আর বিনয়-এর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি তাঁর এই কাজে, স্বভাব-স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা প্রকরণে রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্তর্বিশ্বে চলতে থাকা লিঙ্গ রাজনীতির তথা সম্পর্কজালিকাগুলির গূঢ় চরিত্রকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে সখ্য সম্পর্কগুলির মধ্যে গড়ে ওঠা সমকামী অন্তর্গঠন যা প্রথাসিদ্ধ পাঠ-রণনীতির (Reading Strategy) মধ্যে ধরা পড়ে না। লিঙ্গ রাজনীতির এই বিশিষ্ট দিকটিকে তুলে আনতে লেখক মূলত ব্যবহার করেছেন গোরা উপন্যাসটির দু’টি মুখ্য চরিত্র ‘গোরা’ এবং ‘বিনয়’কে। তপোব্রত ঘোষ লিখছেন,

কিন্তু মুশকিল হল এই যে হিন্দুত্বের খোলস-খসানো গোরা ইদানীং একটা রাজনৈতিক মূর্তিতে পর্যবসিত হয়েছে এবং যাঁরা এই মূর্তিটা বানিয়েছেন তাঁদের কাছে গোরার Homoeroticism আদৌ উপাদেয় বলে মনে হওয়ার কথা নয়।… এই সত্যটা সকলকে বিবেচনা করে দেখতে অনুরোধ করি যে, উত্তর-আধুনিকতার প্রভাবেই হোক, কিংবা অন্য কোনও কারণেই হোক কেন্দ্রীয় যৌনতা থেকে প্রান্তীয় যৌনতার দিকে সম্প্রতি ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা একটু-আধটু তাকাতে শুরু করলেও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা ও সমালোচনায় এখনও বিপরীতকামিতাই একমাত্র স্বতঃসিদ্ধ ‘স্বাভাবিকতা’ বলে পরিগণিত হয়। প্রেম বলতে নর-নারীর প্রেম ছাড়া আর কিছুই যেমন এখানে স্বীকৃত নয়, তেমনই সচেতন যৌনাচার এবং অসচেতন যৌন অনুভূতির পার্থক্য সম্বন্ধে ধারণাও এখানে খুব অস্বচ্ছ।… আমার উদ্দেশ্য আসলে খুবই সামান্য। সাম্প্রতিক রবীন্দ্র-সমালোচনার অচলায়তনে আমি অন্তত একটা উত্তরমুখো জানলা খুলে দেবার চেষ্টা করছি।

সাম্পর্কিক রাজনীতির এই বিশেষ লিঙ্গ চিহ্নিত মাত্রাটির প্রাসঙ্গিকতাকে মাথায় রেখেও সাম্প্রতিক প্রবন্ধে বিষয়টিকে দীর্ঘায়িতভাবে আলোচনার পরিসর নেই। কারণ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও লিঙ্গ রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ককে এক্ষেত্রে যেকোনও ‘প্রকোষ্ঠবদ্ধতা’র বাইরে রাখার চেষ্টা থাকছে সচেতনভাবেই। ফলত ‘লিঙ্গ-নির্দিষ্ট’ বর্গ, যেমন ‘সমকামিতা’, ‘বিসমকামিতা’ বা ‘উভকামিতা’কেই কোথাও সমস্যায়িত হিসাবে ধরতে চাইছেন প্রাবন্ধিক। এই প্রবন্ধটিতে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে যে, অবিমিশ্রভাবে কোনও একটি লিঙ্গের ভিতর প্রকোষ্ঠবদ্ধ নয় কিছু অনিবার্য ‘বৈশিষ্ট্য’ বা ‘মাত্রা’ যা সারসত্তাবাদী লিঙ্গ রাজনীতিকে নির্দেশ করে। লিঙ্গ বর্গটির উত্থাপন এক্ষেত্রে যথেষ্ট আবদ্ধতা-বিরোধী। লৈঙ্গিক সারসত্তাবাদের থেকে উত্তরিত কবি-সৃষ্টির কিছু বিশিষ্ট দিককে এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনার চেষ্টা রয়েছে।

এমনকী বিষয়টির জটিলতার বিশেষত কোনও কোনও ক্ষেত্রে অব্যক্ত অস্পষ্টতার প্রতি সুবিচার করতে তাই তুলে আনতে হয়েছে এমন অনেক প্রেক্ষিত অথবা কবি-সৃষ্টি যা স্পষ্টতই কোনও রাজনৈতিক বক্তব্যে সরব নয়। এক্ষেত্রে মূলত অ-হ্রস্বনীয়ভাবেই তিনটি রাজনৈতিক উপন্যাস গোরা (১৯১০), ঘরে-বাইরে (১৯১৬), চার অধ্যায় (১৯৩৪)-এর আলোকে ফিরে দেখতে চেষ্টা করব জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে নারীর ব্যবহার এবং বিতাড়নের ইতিহাসকে। প্রাবন্ধিক এক্ষেত্রে দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে পাবলিক/প্রাইভেট, নারীত্ব/পৌরুষ, ব্রহ্মচর্য/গার্হস্থ্যর মতো বাইনারিগুলিকে কীভাবে অতিক্রম করে কবির অবস্থান। কীভাবেই-বা এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে ‘প্রেম’, ‘নেতৃত্ব’ এবং ‘বিষয়িতা’র মতো বিষয়গুলি।

এক্ষেত্রে অবশ্য প্রাবন্ধিক বার বার ফিরতে চাইবেন একটি মৌলিক প্রশ্নে, সেটি হল, কেমনভাবে নির্ণীত হবে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পাঠকৌশল? যে পাঠকৌশল কেবল পাঠ্যের আপাতনির্দিষ্ট পরিধির ভিতরই অবরুদ্ধ হয়ে থাকবে না। লেখক অভিপ্রায়ের সন্ধানী হওয়া সত্ত্বেও যা লেখক সার্বভৌমত্বের বাইরে কোথাও অনুভবের নিক্তিতে মেপে নিতে চাইবে কিছু যুগান্তকারী সৃষ্টিকে। আলোচিত ‘পাঠ্য’র সমসময়ের মধ্যে অর্থাৎ অতীত অভিজ্ঞতায় প্রত্যাবর্তনের কথাই কেবল তাই প্রাথমিকতা পাবে না বরং পাঠ্যের সাপেক্ষ সারাৎসারকে খুঁজে নিতে চাওয়া হবে কালের অনুষঙ্গে গড়ে ওঠা বা ভেঙে পড়া অর্থগুলির সঙ্গে। ফলত একদা পুরুষতান্ত্রিক মূলস্রোত পাঠপ্রকরণের মধ্যে থেকেই হয়তো খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে অন্যতর পাঠসম্ভাবনা। পৌরুষপ্রধান ব্যাখ্যা-প্রকরণের বাইরে যা শনাক্ত করতে চাইবে বিষয়ী হিসাবে নারীর অন্যতর অনুভবকে। ব্যাখ্যাবৃত্তের পরিধিকে অতিক্রম করে তাই প্রাবন্ধিক একটি ভিন্নতর ব্যাখ্যাসম্ভাবনাকে স্পর্শ করতে চাইবেন যা লিঙ্গকেন্দ্রিক দ্ব্যণুক বিভাজনকে অতিক্রম করতে চাইবে সারসত্তাবাদের চিরন্তন পিছুটানকে অতিক্রম করে। শুধু তাই নয় এই প্রবন্ধে চেষ্টা করা হবে কীভাবে মূলস্রোত জাতীয়তাবাদী সন্দর্ভের চেনা পৌরুষকেন্দ্রিক ভাষ্যের বাইরে একটি অন্যতর প্রতিরোধের রণকৌশল নির্মিত হতে পারে যার ভিত্তি নিখিল মানবতাবাদী চেতনা। ‘প্রেম’ যার কাঙ্ক্ষিত ভাষা, যেখানে প্রেক্ষিতনির্ভরভাবে এই ‘প্রেম’কে নির্ভর করেই তৈরি হবে রাজনীতির বিশিষ্ট বর্গগুলি। তবে সামগ্রিকভাবে নারীর চেতনাজগতে ও বিষয়ী অবস্থানের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিতকে সচেতনভাবেই প্রবন্ধে লালন করা হবে, যেমনটি বলছেন রিতাফেলস্কি তাঁর বিয়ন্ড ফেমিনিস্ট এস্থেটিক্‌স্-এ,

The Political value of literary texts from the standpoint of feminism can be determined only by an investigation of their social functions and effects in relation to the interest of women in a particular historical context and not by attempting to deduce an abstract literary theory of ‘masculine’ and ‘feminine’, ‘subversive’ and ‘reactionary’ forms in isolation from the social conditions of their production and reception.

এক্ষেত্রে মূলত তিনটি উপন্যাস গোরা, ঘরে-বাইরে, চার-অধ্যায়-এর আলোকে আমরা ফিরে দেখতে চেষ্টা করব জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে নারীর ব্যবহার ও বিতাড়নের ইতিহাস।

রাবীন্দ্রিক স্বদেশচেতনার বৈশিষ্ট্য বা সারমর্মে পৌঁছানোর জন্য অবশ্য আশিস নন্দী উপন্যাসগুলির কালানুক্রমিকতার তুলনায় উপন্যাসগুলির মনস্তাত্ত্বিক ধারাবাহিকতাকে গুরুত্ব দেন। তাই এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটে ঘরে-বাইরে উপন্যাসটির রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব নিয়ে, এরপর আলোচিত হয় চার অধ্যায়-এর রাজনৈতিক নৈতিকতা এবং সবশেষে আসে গোরা উপন্যাসটির রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের আলোচনা। এক্ষেত্রে আমরাও এই ধারাবাহিকতাটিকেই অনুসরণ করব কারণ ‘বিষয়িতা’, ‘নারীত্ব’, ‘নৈতিকতা’, ‘নেতৃত্ব’, ‘ব্যবহার’, ‘বিতাড়ন’, এইসব বিষয়গুলির আলোচনায় প্রাথমিকভাবে ঘরে-বাইরে একটি মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে দেয়, তারপর সেই সূত্র ধরে চার অধ্যায়-এর সঙ্গে চলতে পারে এক ক্রিটিক্যাল কথোপকথন। সবশেষে গোরা সন্ধান দেয় কিছু মনস্তাত্ত্বিক ব্যারিকেড এবং বিকল্পের।

প্রথম আলোচ্য উপন্যাস ঘরে-বাইরে। উপন্যাসটির তিন মুখ্য চরিত্র— নিখিলেশ, বিমলা এবং সন্দীপ। জমিদার নিখিলেশ স্বভাবসিদ্ধভাবেই আত্মস্থ, মৃদুভাষী অথচ দৃঢ়চেতা; নিখিলেশের স্ত্রী বিমলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, আপাত উপস্থিতিতে সাধারণ অথচ কিছু ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যতিক্রমী; সন্দীপ যিনি অনিন্দ্যসুন্দর, তীক্ষ্ণ মেধা ও বাগ্মিতায় উজ্জ্বল এক বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী নেতা এবং নিখিলেশের বাল্যবন্ধু। নিখিলেশের মধ্যস্থতায় বিমলার সঙ্গে পরিচয় হয় সন্দীপের। প্রাথমিক সাক্ষাতের পর থেকেই পাঠক লক্ষ করেন বিমলার হৃদয়ে সঞ্চারিত এক বিপ্রতীপ টান যেখানে সন্দীপের প্রতি মুগ্ধতা এবং সন্দিগ্ধতা সহাবস্থিত থাকে। সন্দীপের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ এবং জটিল মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশন ক্রমশই বিমলাকে সাহস জোগায় এতদিন ধরে সযত্নে লালন করা পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার চৌকাঠ পেরোতে। কিন্তু ‘বাইরে’র যে ছবি বুকে নিয়ে সে তার স্পর্ধী পা রেখেছিল এবং পেরিয়ে গেছিল ঘরের সীমানা, ক্রমশই ভেঙে পড়ে সেটি। ঘটনাক্রম যত এগোয় ততই বিমলার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে সন্দীপের চোখ দিয়ে দেখা জাতীয়তাবাদী স্বপ্নের মধ্যে থাকা মিথ্যাচার, প্রতারণা এবং অসৎ পন্থাগুলি। কিন্তু বিমলার আত্মোপলব্ধির মুহূর্তটি আসে অনেক মূল্য উশুলের শর্ত নিয়ে। বিমলা হারিয়ে ফেলে অথবা উন্মূল হয়ে যায় তার ‘ঘর’ এবং ‘বাইরে’র নিখিলবিশ্ব থেকে। বিমলা ছাড় পায় না তার স্বামীর চরম পরিণতির দায় থেকেও, কারণ বিমলার প্রেমিক সন্দীপের প্ররোচনাতেই যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল শান্ত গ্রাম্যজীবনে তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে মারা যায় নিখিলেশ। নিখিলেশের এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের তরফ থেকে বিমলার নরমাংসভোজী প্রবৃত্তিকেই দায়ী করা হয়। এই উপন্যাসটি আপাতভাবে এক ত্রিকোণ প্রেমের ট্র্যাজিক পরিণতির বয়ান, কিন্তু গভীরতর পাঠে তা ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির স্তরকে অতিক্রম করে যায়। উপন্যাসটি দেখায় যে জাতীয়তাবাদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী যা সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থিত বিবিধতাকে উসকে দিতে পারে এবং তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে এক চিরস্থায়ী চরম বিভাজনের পথে। গভীরতর পাঠে পুনরাবিষ্কৃত হয় বিমলাও। এই বিমলাকেই যেন পরাধীন ভারতবর্ষের ব্যক্তিরূপ হিসেবে পেয়ে যান পাঠক— যার গৃহপরিসর ও বহির্বিশ্ব উপনিবেশবাদ এবং জাতীয়তাবাদী প্রক্রিয়া-প্রকরণে ভয়ংকরভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। অন্য একটি পাঠসম্ভাবনা থেকে বিমলাকে যদি প্রভুত্বাধীন জাতীয় জনসমাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তবে নিখিলেশ এবং সন্দীপ হয়ে উঠতে পারে স্বাদেশিকতার দু’টি প্রতিযোগী পরিবর্ত (Alternative)। স্বদেশপ্রেমের দু’টি প্রতিযোগী ভাষ্যকে পাশাপাশি রেখে রবীন্দ্রনাথ প্রায় নিঃসংশয়ভাবে দেখিয়ে দেন যে, সন্দীপের স্বাদেশিকতার উপরিতলগত জাঁকজমক বা ভাবাবেগ প্রাথমিকভাবে তাকে জিতিয়ে দেয়। সন্দীপের আগ্রাসী অনুপ্রবেশে বিধ্বস্ত হয়ে যায় নিখিলেশের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পরিসর। কিন্তু একইসঙ্গে বিমলার চোখে প্রেমিক অথবা দেশপ্রেমিক কোনও ভূমিকাতেই সন্দীপের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। বিমলা বুঝতে পারে তার স্বামী নিখিলেশের অপ্রমত্ত স্থিতধী স্বাদেশিতার শিকড় সন্দীপের সক্রিয় জাতীয়তাবাদী চেতনার তুলনায় অনেক গভীরে প্রোথিত। এক্ষেত্রে বিমলা অনেকসময়ই পর্যবসিত হয় সেই সংযোগসূত্রে যা স্বাদেশিকতার পুরুষ নির্দেশিত দু’টি বিকল্পের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে বিমলা এক্ষেত্রে কেবল সন্দীপ ও নিখিলেশের বিকল্প স্বাদেশিকতার রণক্ষেত্রই নয়, উত্তমপুরুষে লেখা বিমলার আত্মকথা স্পষ্ট করে দেয় যে, এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তার চেতনার মধ্যেও রয়েছে দু’টি দ্বন্দ্বশীল প্রতিযোগী স্বাদেশিকতার ভাষ্য। নৈতিকতার প্রশ্নে শেষপর্যন্ত নিখিলেশের স্বাদেশিকতাই জয়ী হয়, কিন্তু জয়ের চরম সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্য দিতে হয় বিমলাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপন্যাসটি আমাদের অনেকগুলি নারীবাদী পাঠসম্ভাবনার কাছে নিয়ে আসে (যদিও নারীবাদকে আমরা কঠোর সারসত্তাবাদী অবস্থান থেকে গ্রহণ করছি না)। যেমন, কীভাবে জাতীয়তাবাদ ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’র যুক্তিটিকে তার গভীর অন্তরে লালন করে। কীভাবে ‘দেশমাতৃকা’ বা ‘প্রকৃতির’ মতো স্ত্রীলিঙ্গ চিহ্নিত প্রতীকগুলিকে দখল করার মধ্যে দিয়ে এক আত্মরতিমূলক অনুপ্রবেশসর্বস্ব বীক্ষা নির্মাণ করে জাতীয়তাবাদ, কীভাবে ব্যবহৃত হয় নারীর যৌন পরিচিতি, কীভাবেই-বা নারী পুরুষতান্ত্রিক অভিসন্ধিতে ও যুক্তিকাঠামোয় অজান্তেই শামিল হয়ে যায়, কীভাবে চলে ‘Interpellation’ বা মতাদর্শগত ভ্রান্তিশনাক্তকরণের রাজনীতি যা নারীর ভিতরে ভ্রান্ত বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়, কীভাবে ব্যবহৃত হয় ‘প্রেম’, বিকৃত উদ্দেশ্যসাধনের পন্থা হিসেবে এবং সর্বোপরি কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক ম্যানিপুলেশনে বিধ্বস্ত হয়ে যায় ‘ঘর’ ও ‘বাইরে’কে নিয়ে তৈরি হওয়া নারীর সামগ্রিক অস্তিত্ব। শুধু তা-ই নয়, উপন্যাসটি সমস্যায়িত করে তোলে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য ও বৈধতা বিধানকারী ‘বাইনারি’ বা দ্ব্যণুক বিভাজনগুলিকে, যেমন ‘ঘর’/‘বাহির’, ‘পাবলিক’/‘প্রাইভেট’, ‘ব্রহ্মচর্য’/‘গার্হস্থ্য’।

যেটুকু আমার ভাগে এসে পড়েছে সেইটুকুই আমার, এ কথা অক্ষমেরা বলে আর দুর্বলেরা শোনে। যা আমি কেড়ে নিতে পারি সেইটুকুই যথার্থ আমার, এই হল সমস্ত জগতের শিক্ষা। দেশে আপনা-আপনি জন্মেছি বলেই দেশ আমার নয়; দেশকে যেদিন লুঠ করে নিয়ে জোর করে আমার করতে পারব সেইদিনই দেশ আমার হবে।

সন্দীপের এমন দাবির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেই পৌরুষআশ্রিত আগ্রাসন যা কেবল অধিকারের আর লুণ্ঠনের ভাষা রপ্ত করেছে। যা আত্মস্থ করেছে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’র যুক্তিটি। পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের ‘নৈতিক দেউলিয়াপনা’ এবং ‘ক্ষমতা’-প্রশ্নে তার মাত্রাতিরিক্ত সচেতনতা সন্দীপের ভাবনাচিন্তাগুলির মধ্যে দিয়ে যেমন প্রকাশিত হয় তেমনই তা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সেই মাত্রাটিকে তুলে ধরে যা ‘নারী’ ও ‘প্রকৃতি’কে অধিকার করার ভিতর দিয়ে হৃতপৌরুষের পুনরুদ্ধারকে নৈতিকভাবে প্রশ্ন করে না। আর পুরুষতান্ত্রিক এই যৌন রাজনীতি খুব সহজেই তার যুক্তিগুলিকে চাপিয়ে দেয় ‘নারী’ ও ‘প্রকৃতি’-র উপর। তাই সন্দীপ আক্রোশে ঘোষণা করে,

প্রকৃতি আত্মসমর্পণ করবে, কিন্তু সে দস্যুর কাছে। কেননা, চাওয়ার জোর, নেওয়ার জোর, পাওয়ার জোর সে ভোগ করতে ভালোবাসে।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রাধান্যশীল মতাদর্শ যেভাবে ‘বিষয়ী’ নির্মাণ করে তাতে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে পৌরুষকেন্দ্রিক বাইনারিগুলিতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলত স্ত্রী/পুরুষ অজান্তেই পূর্বতঃসিদ্ধের মতো আত্মস্থ করে ফেলে পুরুষতান্ত্রিক অনুশীলনগুলিকে। সবিচারলব্ধ দূরত্ব থেকে প্রশ্ন করার অভ্যাস হয়তো তৈরিই হতে দেয় না প্রাধান্যশীল মতাদর্শ। তাই স্বামী নিখিলেশের পৌরুষ প্রসঙ্গে বিমলার মনেও সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়, কারণ পৌরুষের পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞার সঙ্গে তা মেলে না। বিমলার আত্মকথায় তাই আমরা পাচ্ছি এমন স্বীকারোক্তি,

আমার মনে হত, ভালো হবার একটা সীমা আছে, সেটা পেরিয়ে গেলে কেমন যেন তাতে পৌরুষের ব্যাঘাত হয়। অনেকবার আমি মনে মনে ভেবেছি, আর একটু মন্দ হবার মতো তেজ আমার স্বামীর থাকা উচিত ছিল।

কিন্তু এরই বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেন নিখিলেশের আত্মস্থ অবস্থানটিকে। যিনি ‘অধিকার’, ‘অনুপ্রবেশ’ আর ‘লুণ্ঠন’-এর বাইরে গিয়ে চিনতে চান তার জীবনের নারীটিকে, হয়তো-বা তার দেশকেও। ঘরকন্নার বাইরে এসে বিশ্বটুকু চিনে নেবার জন্য যিনি বিমলাকে উদ্দীপ্ত করতে চান। বিমলার আত্মকথায় আমরা বিষয়টিকে পাই এইভাবে —

তিনি বলতেন (নিখিলেশ), যে পেটুক মাছের ঝোল ভালোবাসে সে মাছটাকে কেটেকুটে সাঁৎলে সিদ্ধ করে মশলা দিয়ে নিজের মনের মতোটি করে নেয়, কিন্তু যে লোক মাছকেই সত্য ভালোবাসে সে তাকে পিতলের হাঁড়িতে রেঁধে পাথরের বাটিতে ভর্তি করতে চায় না, সে তাকে জলের মধ্যেই বশ করতে পারে তো ভালো, না পারে তো ডাঙায় বসে অপেক্ষা করে তার পরে যখন ঘরে ফেরে তখন এইটুকু তার সান্ত্বনা থাকে যে, যাকে চাই তাকে পাইনি, কিন্তু নিজের শখের বা সুবিধার জন্য তাকে ছেঁটে ফেলে নষ্ট করিনি। আস্ত পাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো, নিতান্তই যদি তা সম্ভব না হয় তবে আস্ত হারানোটাও ভালো।

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ গার্হস্থ্য ও বহিঃপরিসরের বাইনারিটিকেই সমস্যায়িত করে তোলেন। সমস্যায়িত করে তোলেন ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা আদর্শায়িত দাম্পত্যের ধারণাটিকে।

দাম্পত্যের ভিক্টোরীয় কিংবা জাতীয়তাবাদী সংজ্ঞার্থকেই কবি ভারসাম্যহীন করে তুললেন, ভারসাম্যহীন করে তুললেন বিষয়টি সম্পর্কে তৈরি হওয়া যেকোনও সারসত্তাবাদী বিশ্লেষণকেই। ঋতু সেন চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধ ‘রিডিং ঘরে-বাইরে: রিনিগোশিয়েটিং কনজুগ্যালিটি ইন দ্য মোমেন্ট অফ ন্যাশনালিজ্ম’-এ প্রসঙ্গত বলছেন, ‘The novel Ghare-Baire demystifies and deflates the theme of conjugality. It reads conjugality as a fractured process. The predictable notion of conjugality gets fissured as the novel traverses a range of relationship, tainted by the shades of class, religion, morality, love, sexuality, patriotism and nationalism.’১০ দাম্পত্য বিষয়ে নিখিলেশ এবং বিমলার যাত্রাপথ আলাদা। ‘পূজা’ এবং ‘আত্মসমর্পণ’ যদি দাম্পত্যের কাঙ্ক্ষিত ভাষা হয়ে থাকে বিমলার কাছে, তবে নিখিলেশের কাছে তা পারস্পরিক সম্মান ও আদর্শ সখ্যের। দু’জনেরই যাত্রা অবশ্য শুরু দাম্পত্য বিষয়ে কিছু ‘নির্দিষ্ট’ ধারণা দিয়ে (যদিও সেই ধারণাগুলি পৃথক), ধারণাগুলির প্রতি মোহগ্রস্ততার অবসান এবং আবারও একটি অনিশ্চিত প্রেক্ষিতে মুখোমুখি হওয়া এই উপন্যাসের অন্তিম পরিণতি। অনিশ্চিত অথচ সম্ভাবনাময় এই মুখোমুখি হওয়ার ভবিতব্য কবিকে স্বতন্ত্র করে দেয়। স্বতন্ত্র করে দেয় জাতীয়তাবাদী সেই প্রকল্প থেকে যা দাম্পত্যকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল কিছু পুরুষতান্ত্রিক নীতিমান দ্বারা। হৃদয়বত্তা ও মানবপ্রেমের নিরিখে মূল্যায়িত না হওয়া নারী-পুরুষের সম্পর্ককে যখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশুষ্ক সাংস্কৃতিক সারসত্তাবাদের নিরিখে বৈধতা দিয়েছে মূলস্রোত তখন তার বিপরীতে ভালবাসাকেই বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, দাম্পত্যের অস্থিতিশীল রূপরেখাকে চিহ্নিত করতে। এই দাম্পত্যের চেহারাটি ক্রমোচ্চ কাঠামো নয়। সম্পর্কের চিরন্তন নিরিখ বা দখলের ভাষাভিত্তিক নয়। বরং চিরনির্ণীয়মান, অনির্ধারিত এবং ‘সম্পর্ক’ভিত্তিক বা সাম্পর্কিক। তনিকা সরকারের মতে, ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে ভালবাসা বা প্রেমজ সম্পর্কগুলি হয়ে ওঠে বিকৃত, হিংসাশ্রয়ী এবং সংকটাপন্ন। তিনি বলছেন, ‘narrative of Hindu marriage could no longer use the language of love, it had been re-written in terms of force and pain.’১১ নারী-পুরুষ হৃদয়জ সম্পর্কের এই বিকৃতি অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদী চেতনার বিশিষ্ট একটি মাত্রা তুলে ধরে। ঘরে-বাইরে উপন্যাসটিতে প্রেমের এমতো উদ্দেশ্যবাদী বিকৃত ব্যবহারকে এবং বিষয়টিতে বাহুবলের প্রাবল্যকে রবীন্দ্রনাথ তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। অথচ এই সমালোচনার ভাষা অত্যন্ত অপ্রমত্ত, আত্মস্থ অথচ দৃঢ়প্রজ্ঞ। গভীরতর পাঠে ঘরে-বাইরে উপন্যাসটি লিঙ্গ রাজনীতির ও জাতীয়তাবাদের আরেকটি সাম্পর্কিক জটিলতাকেও তুলে ধরে। সেটি হল সংকীর্ণ উদ্দেশ্যসাধন ও জাতীয়তাবাদী আবেগকে উসকে দেওয়ার জন্য ‘নারী’র আদর্শায়ন। বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ সেই জটিল রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেন যা প্রথমে ‘বিষয়ী’কে সমাজ-আরোপিত একটি লিঙ্গ-পরিচিতির সঙ্গে বেঁধে ফেলে এবং তারপর সংকীর্ণ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য তাকে নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক সারসত্তায় বিজারিত করে ফেলে। এর মাধ্যমে আসলে চলতে থাকে মতাদর্শগত ভ্রান্তিশনাক্তকরণ বা Interpellation, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে ‘বিষয়ী’ হিসেবে গণ্য করতে থাকে। যদিও সুকৌশলে কাঠামো ও মতাদর্শ তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হরণ করে নেয়। ঠিক যেমনভাবে বিমলা আদর্শায়িত হয় ‘দেবী’ রূপে, ‘দেশমাতৃকা’ রূপে, এমনকী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ‘মক্ষীরানী’ হিসেবে। সুচতুর সন্দীপ বিমলাকে বিমুগ্ধ করে ফেলে, তার ভিতরে জন্ম দেয় এক ভ্রান্ত ‘বিষয়ী’ চেতনা, যার বুদ্‌বুদ অস্তিত্ব অচিরেই প্রমাণিত হয়। কীভাবে বিমলার মধ্যে জেগে ওঠে এক ভ্রান্ত বিষয়ী চেতনা সন্দীপের ম্যানিপুলেটিভ জাতীয়তাবাদী স্তুতির মধ্যস্থতায়, তা যেন বিমলার এই বক্তব্যের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিমলার আত্মকথায় আমরা পাই:

আমি পারি, সমস্তই পারি, আমার মধ্যে একটা দিব্যশক্তি এসেছে, সে এমন একটা কিছু যাকে ইতিপূর্বে আমি অনুভব করিনি, যা আমার অতীত। আমার অন্তরের মধ্যে এই যে একটা বিপুল আবেগ হঠাৎ এল এ জিনিস কী, সে নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা ওঠবার সময় ছিল না, এ যেন আমারই অথচ এ যেন আমার নয়, এ যেন আমার বাইরেকার, এ যেন সমস্ত দেশের। এ যেন বানের জল, এর জন্য কোনো খিড়কির পুকুরের জবাবদিহি নেই… তিনি (সন্দীপ) কেবলই বলতেন আমরা পুরুষরা কেবলমাত্র ভাবতেই পারি, কিন্তু আপনারা বুঝতে পারেন, আপনাদের আর ভাবতে হয় না। মেয়েদেরই বিধাতা মানস থেকে সৃষ্টি করেছেন আর পুরুষদের তিনি হাতে করে হাতুড়ি পিটিয়ে গড়েছেন। শুনতে শুনতে আমার বিশ্বাস হয়েছিল আমার মধ্যে সহজ বুদ্ধি সহজ শক্তি এতই সহজ যে আমি নিজেই এতদিন তাকে দেখতে পাইনি।১২

মোহাচ্ছন্ন করার এই মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতিকে কবি ফুটিয়ে তোলেন বিমলা ও সন্দীপের প্রেমপর্বটির অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে। আসলে ‘অন্দর’ থেকে ‘বাহির’ আবার ‘বাহির’ থেকে ‘অন্দর’ প্রত্যাবর্তনের যে করুণ কাহিনি রবীন্দ্রনাথ শোনান তা জাতীয়তাবাদী ম্যানিপুলেটিভ রাজনীতির শিকার বিমলার জন্য ‘ভূতগ্রস্ততা’র অবসানে এক মৃতপ্রায় বিষয়িতাকেই অবশিষ্ট রেখে যায়। তাই সে উচ্চারণ করে,

সেই অপদেবতা একদিন রাঙা মশাল হাতে করে এসে আমাকে বললে, আমিই তোমার দেশ, আমিই তোমার সন্দীপ, আমার চেয়ে বড়ো তোমার আর কিছুই নেই, বন্দেমাতরং! আমি হাতজোড় করে বললুম, তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার স্বর্গ, আমার যা-কিছু আছে সব তোমার প্রেমে ভাসিয়ে দেব। বন্দেমাতরং!১৩

প্রতীকী এমনকী আক্ষরিক অর্থে পারিবারিক ও গণপরিসরগত সীমাকে অতিক্রম করে নিজের যৌন ও বৌদ্ধিক আকাঙ্ক্ষাগুলির পূরণ করতে চাওয়া বিমলা শেষপর্যন্ত জাতীয়তাবাদী যুক্তিকে অনুসরণ করে প্রেমিক সন্দীপকে যেমন সংশোধন করতে পারে না, তেমনই পারে না নিখিলেশকে বাঁচাতে। বিমলা বুঝতে পারে নিজেকে ভ্রান্তভাবে শনাক্তকরণের অমার্জনীয় ত্রুটি। বিমলার আত্মকথনে ঝরে পড়ে সেই হতাশা—

কি এরা বলতে চায় এসমস্তই মিথ্যে কথা? আমার মধ্যে যে দেবী আছে ভক্তকে বরাভয় দেবার শক্তি তার নেই? আমি যে স্তবগান শুনেছিলুম, যে গান শুনে স্বর্গ হতে ধুলোয় নেমে এসেছিলুম, সে কি ধুলোকে স্বর্গ করবার জন্যে নয়? সে কি স্বর্গকেই মাটি করবার জন্যে?১৪

বিমলার প্রেম সঞ্জীবনী হয়ে উঠতে পারে না। সে গৃহপরিসর এবং গণপরিসরকে উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়, যে উজ্জীবনের স্বপ্ন তাকে দেখিয়েছিল তার জাতীয়তাবাদী প্রেমিক সন্দীপ।

নারীর ব্যবহার, বিতাড়ন, ভ্রান্ত ‘বিষয়ী’ হিসেবে নারীর নির্মাণ এবং বিষয়গুলির সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটি সম্ভবত ‘গৃহপরিসর’ ও ‘বহির্বিশ্ব’, ‘প্রাইভেট’ ও ‘পাবলিক’, ‘যুক্তি’ ও ‘আবেগ’, ‘পুরুষোচিত’ ও ‘নারীসুলভ’ এই প্রতিটি দ্ব্যণুক বিভাজন বা বাইনারিগুলিকেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করায় এবং এরপর এগুলির সুস্থিত বায়ুনিরুদ্ধ কক্ষবদ্ধতাকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত অ-হ্রস্বনীয়ভাবেই রাজনৈতিক উপন্যাস ঘরে-বাইরে যে বিকল্প রাজনীতির ইঙ্গিতগুলিকে বহন করে নিয়ে আসে তা এক দিকে যেমন পৌরুষ- ও বাহুবল-কেন্দ্রিক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চেতনার একটি আপসহীন ক্রিটিক গড়ে তোলে তেমনই তা যথেষ্ট সমস্যায়িত করে তোলে সেই পৌরুষপ্রধান যুক্তিকাঠামোকে যা ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘পুরুষতন্ত্র’ উভয়ই তাদের নিজের নিজের অবস্থান থেকে সযত্নে লালন করে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদের মতো একটি উত্তপ্ত বয়ানের বিপরীতে কবির রাজনীতি অনেক আত্মসমাহিত ও অপ্রমত্ত। অপ্রাপ্তমনস্কতায় এই রাজনীতি তাৎক্ষণিক জয় ও যশ লাভে লালায়িত নয়, বরং এ বিকল্প রাজনীতির যুক্তিগুলি অনেক গভীর। কবিসৃষ্ট চরিত্র নিখিলেশ আসলে তার জাতীয়তাবাদোন্মত্ত সমকাল থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন এবং তার মানবপ্রেমাশ্রয়ী আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষের মাতৃভূমি উপাসনার উন্মত্ত আবেগ খুব সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। যদি ধরে নিই নিখিলেশই কবির কণ্ঠস্বর তবে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে নিখিলেশও কবিরই মতো ‘কৌমস্বাতন্ত্র্যবাদ’-এর উপর স্থান দিয়েছিলেন ‘কৌম’কে। তৈরি করতে চেয়েছিলেন এমন এক বিকল্প ভারতীয় অস্মিতাকে যা আলোকপ্রাপ্ত, উদার এবং আধুনিক। যদিও এই আধুনিকতা প্রচলিত অর্থে পশ্চিমি আধুনিকতা নয়। জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে বিমলা, নিখিলেশ ও সন্দীপের সাম্পর্কিক টানা-পোড়েনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখালেন যে, অন্দর ও বহির্বিশ্বের মধ্যে বিভাজন, প্রেমের ব্যক্তিগত ও সামাজিক তথা নৈতিকতার ব্যক্তিগত ও সার্বজনীন অনুশীলনের পরিসরগুলি পৃথক পৃথক নয় এবং এগুলির মধ্যে কোনও স্পষ্ট বিভাজিকা টানাও সম্ভব নয়। আসলে নারীবাদের চিরাচরিত স্ট্র্যাটেজিগুলি দিয়ে উপন্যাসটিকে বিনির্মাণ করা যায় না। কারণ জাতীয়তাবাদের পৌরুষআশ্রিত অনৈতিক চেহারাটি উন্মোচিত করলেও উপন্যাসটি বিমলাকে তার ভরকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে না। করে নিখিলেশকে, কারণ বিমলাও প্রাথমিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মাণপ্রকরণের গভীর ম্যানিপুলেশনের শিকার হয় এবং প্রশ্ন করে না জাতীয়তাবাদী আবেগাশ্রিত হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির পূর্বতঃসিদ্ধগুলিকে। রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসটিতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই প্রেমকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক শক্তি হিসাবে উদ্‌যাপন করে। যদিও সেই শক্তির অনুশীলন মূলস্রোত জাতীয়তাবাদী যুক্তিকাঠামোকে অনুসরণ করে কোনও নারী চরিত্রের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত হয় না। সম্পাদিত হয় এমন এক পুরুষের মধ্যস্থতায় যাকে উপনিবেশকারী এবং উপনিবেশিত উভয় জাতীয়তাবাদী সন্দর্ভেই দেখা হয়েছে নারীসুলভ আবেগসর্বস্ব ‘বাঙালিবাবু’ হিসেবে। অর্থাৎ লিঙ্গচিহ্নের ভিত্তিতে বিভাজিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে কবি এক অভাবনীয় সংকটের মুখে দাঁড় করান, যেখানে তথাকথিতভাবে ‘নারীসুলভ’ চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলি অক্লেশে ধারণ করে থাকে এক পুরুষ। কিন্তু মূলস্রোত পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি কীভাবে দেখে নিখিলেশকে? যে-নিখিলেশ কোনওদিন বিমলার উপর স্বামীসুলভ প্রাধান্যবিস্তার করতে যায়নি। জাতীয়তাবাদী প্রেমিক সন্দীপের তুলনায় যাকে বিমলার অনেক ক্ষীণদীপ্ত পুরুষ মনে হয়েছে। নিখিলেশের এমতো অবস্থানকে পুরুষতান্ত্রিক চশমা দিয়ে দেখলে আপাতদৃষ্টিতে বেশ নিষ্প্রভ মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণে মূলস্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এবং প্রকৃত নৈতিক অনুশীলনে আত্মনিয়োজিত এই যোদ্ধাটি আর‍ও একবার ‘বিজয়ী’ সন্দীপের নৈতিক দেউলিয়াপনাকে স্পষ্ট করে দেয়। প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও জাতীয়তাবাদী স্বদেশানুরাগকে অতিক্রম করে নিখিলেশ বার বারই বিমলার যৌন ও বৌদ্ধিক স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বিপরীতে সন্দীপ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে বিমলার সন্দীপের প্রতি তথা তার জাতীয়তাবাদী অবস্থানের প্রতি মোহগ্রস্ততাকে কাজে লাগিয়েছে।

কাহিনির পরিসমাপ্তিতে নিখিলেশের পরিণতি আপাতভাবে এক দুর্বল, অক্ষম জমিদারের সেই পরিণতি যা মূলস্রোতের কাছে খুব অপ্রত্যাশিত নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে আপাতভাবে অত্যন্ত নিরীহ অপ্রমত্ত নিখিলেশের এই পরিণতি কি আর অন্তিম অবিবেচক, বাস্তব জ্ঞানবর্জিত হঠকারী সিদ্ধান্তরই ফলশ্রুতি নয়? নইলে দাঙ্গাবিধ্বস্ত একটি উন্মত্ত পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র সংখ্যালঘিষ্ঠ দরিদ্র মুসলমান প্রজাদের বাঁচাতে তাদের জমিদার প্রভু সম্পূর্ণ নিরস্ত্রভাবে ঘোড়ার পিঠে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবেন কেন? এই উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে কি কবি সেই ‘নারীসুলভ’ বাস্তববিচ্ছিন্ন বাঙালিবাবুর ভূমিকাই নিখিলের জন্য বরাদ্দ করলেন না? যে হঠাৎই তার পৌরুষকে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রজাদের রক্ষক হিসেবে কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে? কিন্তু গভীরতর বিশ্লেষণে এমন এক অন্তিম সিদ্ধান্ত আমাদের সম্বিৎ ফেরানোর সেই মুহূর্ত নিয়ে আসে যেখানে নিখিলেশের নিরস্ত্র প্রতিরোধ আসলে এক চরম নৈতিক আত্ম-অনুশীলনের ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা দেয়। নিখিলেশের অন্তিম সিদ্ধান্তটি যে কেবল তাকে নৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্ষম এক ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করল তা-ই নয়, একইভাবে ‘প্রেম’কে লিঙ্গচিহ্নিত বর্গ হিসেবে তুলে ধরার মূলস্রোত রাজনীতিকেও তা যেন এক চ্যালেঞ্জ জানাল।

নিখিলেশের জীবনে যে কঠোর ‘প্রেম’-এর অনুশীলন তা যেন আরও একবার স্পষ্ট করে দিতে চাইল সে-‘প্রেম’ কেবল ‘নারীসুলভ’ আবেগ নয়, এমনকী তা দাঁড়িয়ে নেই ‘যুক্তি’ বা ‘রাজনীতি’র মতো ‘পুরুষসুলভ’ বর্গগুলির বিপরীতে। একদা লাকাঁ বলেছিলেন যে Ego বা ‘অদস্’ এবং আদর্শ (Ideal)-এর উপরিপতনের ফলশ্রুতি মারাত্মক। যেন প্রায় সেই ভবিষ্যৎ বাণীকেই পুনরাবৃত্ত করে নিখিলেশ। নিখিলেশ তার অন্তিম আচরণে পৌঁছে যায় তার সেই কাঙ্ক্ষিত আদর্শের কাছে যাকে আপাতভাবে মনে হতে পারে আত্মহনন। কিন্তু যতই আমরা উপন্যাসের গভীরে অবগাহন করি ততই আমরা বুঝতে পারি নিখিলেশের এ এক চরম উত্তরণ, যেখানে সে ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে প্রভুকল্পিত ‘বাঙালিবাবু’ নন, সন্দীপের কাছে ‘আদর্শ’ ‘স্বদেশি’ বন্ধুটি নন এমনকী বিমলার প্রার্থিত পুরুষোচিত স্বামীটিও নন বরং সে নিজেই নিজের আদর্শে উত্তরিত এবং ‘বিষয়ী’।

সন্ত্রাসবাদী জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে কবির যে আপসহীন সমালোচনা তার একটি অংশ আচ্ছন্ন করে আছে মতাদর্শগত বি-মানবীকরণের (Dehumanization) সংকট। মূলত এ সংকটের জটিল মানচিত্রই চার অধ্যায় উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট। এই উপন্যাসের তিনটি কেন্দ্রীয় চরিত্র— ইন্দ্রনাথ (বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী নেতা এবং বৈপ্লবিক গুপ্তগোষ্ঠীর প্রধান), অতীন্দ্র (ইন্দ্রনাথের গুপ্তগোষ্ঠীর যুবক সদস্য) এবং এলা (ইন্দ্রনাথের গুপ্তসমিতির সদস্য এবং অতীন্দ্রের প্রেমিকা)। এলার প্রতি আকর্ষিত হয়েই অতীন ইন্দ্রনাথের বৈপ্লবিক গুপ্তসমিতিতে যোগ দেয় এবং ক্রমে ক্রমে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী রণনীতিগুলিকে আত্মস্থ করে নেয়। প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠে যন্ত্রসুলভ আনুগত্য প্রদর্শনে। অতীনের দীক্ষাগুরু ইন্দ্রনাথ (যিনি সচেতনভাবেই আবেগহীন এবং যান্ত্রিক বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী) অতীনকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলেন যে সেও তাঁর মতোই হিংসাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য অর্জনে এক ধরনের নিষ্ঠুর দায়বদ্ধতাকে স্বীকৃতি দিতে থাকে। এই যান্ত্রিক আনুগত্য সবিচারলব্ধ নয়, নৈতিক বা অনৈতিকতার প্রশ্নও এক্ষেত্রে অবান্তর, তাই যতই অতীন্দ্র এই বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়তে থাকে ততই তার মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে বি-মানবীকরণের সংকট। মানবিকতার ক্ষয়প্রাপ্তির এই নিরন্তর ধারায় মাঝে মাঝে ছেদ ঘটায় এলার প্রতি তার প্রেম। যদিও দেশের প্রয়োজনে আজীবন অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় এলা। ঘটনাপ্রবাহ যতই এগোয় ততই বোঝা যায় যে, এলা তার গুপ্তসমিতির কাছেই গলগ্রহ হয়ে উঠছে। দলীয় স্বার্থে এবং অবশ্যই জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামের দোহাই দিয়ে এলাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই দায়িত্বপালনের জন্য নিযুক্ত করা হয় এলারই প্রেমিক অতীন্দ্রকে। বাধা দেয় না এলা, এমনকী অ্যানাসথেসিয়ার সহায়তাও নেয় না সে, অতীনের হাতে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে মৃত্যুবরণ করে এলা। এলার মৃত্যুমুহূর্তেই অতীন এক গভীর আত্মোপলব্ধির সম্মুখীন হয়, সে বুঝতে পারে যে, সে সম্পূর্ণতই ‘স্ব-ধর্ম’ এবং ‘স্বভাবধর্ম’ থেকে বিচ্যুত। শুধু তা-ই নয় এলার মৃত্যু আরও একটি ভয়ংকর সত্যকে উদ্ঘাটিত করে। অতীন বুঝতে পারে যে, এলা আসলে মৃত্যুবরণ করে অতীনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিণতিকে অর্থ দিতেই। জাতীয়তাবাদী যুক্তিকে মেনে আত্মবলিদান দিতে নয়। জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে পৌরুষকেন্দ্রিক হিংসাশ্রয়িতা, বি-মানবীকরণের সংকটকে যেমন উন্মোচিত করে চার অধ্যায় তেমনই তা উন্মোচিত করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সেই দিকটিকে যা সন্তসুলভভাবে উদাসীন নেতৃত্ব ও সম্মোহনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিষয়ে, মতাদর্শগত ভ্রান্তিশনাক্তকরণ বা Interpellation-এর রাজনীতি সম্পর্কে এবং নারীর যৌন পরিচিতি ব্যবহার এবং ব্রহ্মচর্য উদ্‌যাপনের ভঙ্গিসর্বস্বতা বিষয়ে।

এক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নটিকে উহ্য রাখা পৌরুষ ও হিংসাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের স্বরূপ উন্মোচন করতে আমরা একটু জাতীয়তাবাদী ‘নেতৃত্ব’র প্রসঙ্গে ফিরব। কারণ জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসবাদ বিষয়টি ‘নেতৃত্ব’র প্রশ্নটিকে বাদ দিয়ে একরকম অসম্ভব। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ‘নেতৃত্ব’কে আমরা একটি উত্তর-কাঠামোবাদী নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে চিনে নিতে চাইব এবং তারপর আলোচনাটিকে রাবীন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী ক্রিটিকের প্রেক্ষাপটে প্রসঙ্গায়িত এবং প্রলম্বিত করব। উত্তর-কাঠামোবাদী এবং নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নেতৃত্বকে বিশ্লেষণ করার সময় লিন্ডা স্মিরচিচ এবং মার্টা ক্যালাস দেখান যে, ‘নেতৃত্ব’ (Leadership) শব্দটির কোনও স্থির অর্থ নেই এবং নেতৃত্ব বিষয়ে একাধিক অর্থ সৃজিত হতে পারে বিষয়টির বিবিধ অবিনির্মাণবাদী পাঠের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে তারা দেরিদার অবিনির্মাণবাদী পাঠপ্রক্রিয়ার প্রেক্ষিত থেকে বাস্তবতার ভাষাগত নির্মাণের উপর জোর দেন। অর্থাৎ তাঁরা দেরিদাকে অনুসরণ করেই বলেন যে, ‘বাস্তবতা’ বা ‘Reality’ আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় ভাষাগত নির্মাণের মাধ্যমেই। অবিনির্মাণবাদীরা আরও বলেন যে, শব্দগুলি অর্থবাহী এ কারণে হয় না যে তা কোনও বাহ্যিক নির্দেশিতকে উপস্থাপিত করে বরং শব্দ অর্থবহ হয় তার বিপরীত শব্দ থেকে পৃথক্‌করণের মাধ্যমে। সে কারণেই স্মিরচিচ এবং ক্যালাস মনে করেন যে, ‘নেতৃত্ব’কে ব্যাখ্যা করতে এর বিপরীত শব্দ ‘প্রলুব্ধকরণ’ (Seduction)-এর অবতারণা প্রয়োজন। ‘বাস্তবতা’ নির্মাণের রাজনীতিতে ‘নেতৃত্ব’ শব্দটির উদ্দেশ্য হল তার সঙ্গে প্রতিতুলনায় ‘প্রলুব্ধকরণ’ শব্দটির অবমূল্যায়ন করা বা শব্দটিকে মুছে ফেলা। তাই ‘নেতৃত্ব’কে বুঝতে হলে প্রাথমিকভাবে ‘নেতৃত্ব’ এবং ‘প্রলুব্ধকরণ’-এর মধ্যে নির্ভরশীলতা (Dependency)-কে বুঝতে হবে। আসলে যেকোনও ‘নলেজ কমিউনিটি’তেই যেকোনও শব্দের একটি সমমানভুক্ত ব্যাখ্যা (বা Standard interpretation of meaning) থাকে যা শব্দার্থের উপর একটি স্বেচ্ছাচারী সীমানা চাপিয়ে দেয়। অথচ এই সীমা কিন্তু সবসময় Polysemous শব্দের অন্যতর অর্থগুলির আগমনকে প্রতিরুদ্ধ করতে পারে না। ঠিক যেমন ‘নেতৃত্ব’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ‘প্রলুব্ধকরণ’। ঠিক সেই কারণেই প্রচলিত অভ্যাসে নেতৃত্বকে সদর্থক এবং প্রলুব্ধকরণকে নঞর্থক হিসেবে দেখার বাঁধাধরা ছকটিকেই উলটে দেন ক্যালাস ও স্মিরচিচ। এঁরা বলেন যে, Leadership বা নেতৃত্বও আসলে এক ধরনের প্রলুব্ধকরণ বা Seduction, যদিও সেটি বাহ্যিকভাবে বলা হয় না। প্রকৃতপক্ষে ‘নেতৃত্ব’ শব্দটির উদ্ভাবনে ইতিহাসকে অবিনির্মিত করে এঁরা একটি চমকপ্রদ লৈঙ্গিক রাজনীতির সন্ধান দিলেন। এঁরা দেখালেন যে, কীভাবে এতকাল ‘নেতৃত্ব’ সম্বন্ধীয় যাবতীয় আলোচনা কেবল ‘পৌরুষকেন্দ্রিক’ অর্থসম্ভাবনাগুলিকেই প্রাধান্য দিয়েছে, ফলত ব্রাত্য থেকে গিয়েছে নেতৃত্ব প্রসঙ্গে অন্যতর পাঠসম্ভাবনাগুলি। মূলস্রোত ‘নেতৃত্ব’ তাই হয়ে উঠেছে পুংলিঙ্গ নির্দিষ্ট একটি বর্গ। এঁরা অক্সফোর্ড শব্দকোষ থেকে ‘Lead’ কথাটির আভিধানিক অর্থ বের করেন এবং দেখান যে এই কথাটির অর্থ হল নিজে এগিয়ে গিয়ে অন্যদের একটি পথ দেখানো বা পথে স্থিত করা। এর সমার্থক শব্দ হল ‘Guide’ বা ‘Stear’ অর্থাৎ পরিচালনা করা/চালনা করা, অন্য দিকে ‘Seduction’ বা প্রলুব্ধকরণ কথাটির আভিধানিক অর্থ হল অন্যকে বুঝিয়ে বা প্রভাবিত করে বিপথগামী করা এবং এর সমার্থক শব্দগুলি হল ‘Lure’, ‘Entise’, ‘Decoy’, ‘Tempt’ (লোভ দেখিয়ে আকর্ষণ/ফাঁদপাতা/ফুসলানো/প্রলুব্ধকরণ) ইত্যাদি। ক্যালাস এবং স্মিরচিচ এক্ষেত্রে যে বৈপরীত্যগুলি ব্যবহার করেন তা হল নেতৃত্বদান/প্রলুব্ধকরণ (Lead/Seduce), পথপ্রদর্শন/লোভ দেখিয়ে বিপথগামী করা (Guide/Lure)। এই আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে এঁরা অবশ্য বলতে ভোলেন না যে, প্রলুব্ধ করার মধ্যে একটি নেতৃত্বের বিষয় আছে। যদিও প্রলুব্ধকরণকে ভ্রান্তপথে চালিতকরণ হিসেবে দর্শিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে একটি অগ্রিম দুর্নাম তৈরি করাই আছে। অথচ নেতৃত্ব ও প্রলুব্ধকরণ উভয়ের মধ্যেই রয়েছে আকর্ষণ করা, জাগিয়ে তোলার সেই ক্ষমতা যাতে নিরুদ্দিষ্ট (Targeted) ব্যক্তি বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে নেতৃত্বকে অনুসরণ করে। প্রশ্ন হল, নেতা কেন তবে প্রলুব্ধকারী হিসেবে চিহ্নিত নয়? কেন ‘Seducer’ অর্থাৎ পুরুষ প্রলুব্ধকারী কথাটি প্রায় ব্যবহৃত হয় না এবং একেবারেই ব্যবহৃত হয় না এরই প্রতিশব্দ ‘Seducter’ শব্দটি। এঁরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখান যে, ১৭১১ সালের পর ‘Seducer’ কথাটির প্রায় কোনও ব্যবহারই তেমন চোখে পড়ে না। অন্য দিকে এর স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ ‘Seductress’ বা কুহকিনী শব্দটির ব্যবহার চলতে থাকে বিনা বাধায়। আসলে একই অনুশীলনে থাকা পুরুষেরা হন নেতা, এবং রমণীরা হন কুহকিনী বা Seductress। সে কারণে পুরুষতান্ত্রিক অভ্যাসকে অস্থিমজ্জায় বহন করতে করতে অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায় ‘Seducer’ বা ‘Seducter’-এর মতো শব্দগুলি। ‘Lead’ শব্দটি ‘পৌরুষ’ বা ‘পৌরুষ’-চিহ্নিত বর্গগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায় যেমনভাবে ‘Seduce’ শব্দটি সংশ্লিষ্ট হয়ে যায় ‘স্ত্রী’ বা স্ত্রীলিঙ্গ-চিহ্নিত বর্গগুলির সঙ্গে। ‘নেতৃত্ব’ প্রসঙ্গে এমন বিশ্লেষণ জাতীয়তাবাদের রাবীন্দ্রিক ক্রিটিকের নারীবাদী পাঠকে একটি নতুন দিক দেয়। ঘরে-বাইরে, চার অধ্যায় আলোচনার সময় আমরা জাতীয়তাবাদের পুরুষতান্ত্রিক মাত্রাটিকে চিনতে চেষ্টা করেছি জাতীয়তাবাদের নৈতিক দেউলেপনা, সুবিধাবাদী মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশন, নারীর ব্যবহার ও বিতাড়নের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে। এক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট উপন্যাস দু’টিকেই ‘রেফারেন্স’ হিসেবে রেখে ফিরে দেখতে চেষ্টা করব জাতীয়তাবাদী ‘নেতৃত্ব’র পুরুষতান্ত্রিক মাত্রাটিকে। ক্যালাস এবং স্মিরচিচের ‘নেতৃত্ব’ প্রসঙ্গে আলোচনাটিকে ব্যবহার করে দেখতে চেষ্টা করব যে কীভাবে জাতীয়তাবাদ ‘নেতৃত্ব’ ও ‘সম্মোহনের’ লিঙ্গচিহ্নিত বাইনারিটিকে তার গভীরে বহন করে। কীভাবে ‘নেতৃত্ব’র মধ্যে থাকা ‘সম্মোহনের রাজনীতি’কে উহ্য রাখে পুরুষ প্রাধান্যকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা। তাই ঘরে-বাইরে উপন্যাসে সন্দীপ লজ্জিত হয় না এই সত্য ঘোষণা করতে যে ‘কুহক’ তার ইচ্ছেপূরণ এবং উদ্দেশ্যসাধনের অন্যতম পন্থা। খুব সহজেই ‘প্রকৃতি’ ও ‘নারী’কে উপরপতিত হতে দেখে সন্দীপের দর্শন। সে স্পষ্টতই জানায়,

আমি যে চালে চলি তাতে মেয়েদের হৃদয় জয় করতে আমার দেরি হয় না। ওরা যে বাস্তব পৃথিবীর জীব, পুরুষদের মতো ওরা ফাঁকা আইডিয়ার বেলুনে চড়ে মেঘের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় না।… বার বার দেখলুম আমার সেই ইচ্ছের কাছে মেয়েরা আপনাকে ভাসিয়ে দিয়েছে, তারা মরবে কি বাঁচবে তার হুশ থাকেনি। যে শক্তিতে এই মেয়েদের পাওয়া যায় সেইটিই হচ্ছে বীরের শক্তি অর্থাৎ বাস্তব জগৎকে পাবার শক্তি।১৫

জাতীয়তাবাদী নেতা ও প্রেমিক সন্দীপের সম্মোহনী এই ‘কুহক’-এর হাতছানি এড়াতে পারে না বিমলা। উত্তমপুরুষে লেখা ‘বিমলার আত্মকথা’য় তা স্পষ্ট। বিমলা স্বীকার করে,

আমাকে কি বিধাতা আজ একেবারে নতুন করে সৃষ্টি করলেন? তার এতদিনকার অনাদরের শোধ দিয়ে দিলেন?… যে ছিল সামান্য সে নিজের মধ্যে সমস্ত বাংলাদেশের গৌরবকে প্রত্যক্ষ অনুভব করলে। সন্দীপবাবু তো কেবল একটি মাত্র মানুষ নন, তিনি যে একলাই দেশের লক্ষ লক্ষ চিন্তাধারার মোহনার মতো। তাই তিনি যখন আমাকে বললেন মউচাকের মক্ষীরানী, তখন সেদিনকার সমস্ত দেশসেবকের স্তবগুঞ্জন ধ্বনিতে আমার অভিষেক হয়ে গেল। এরপর আমাদের ঘরের কোণে আমার বড়ো জায়ের নিঃশব্দ অবজ্ঞা আর আমার মেজো জায়ের সশব্দ পরিহাস, আমাকে স্পর্শ করতেই পারল না। সমস্ত জগতের সঙ্গে আমার সম্বন্ধের পরিবর্তন হয়ে গেছে।১৬

উপন্যাস থেকে এই দীর্ঘ অংশগুলিকে সরাসরি তুলে আনার কারণ জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব, সম্মোহনের রাজনীতি, ভাবাদর্শগত ভ্রান্তিশনাক্তকরণ বা Interpellation-এর মতো প্রক্রিয়াগুলির জটিল আন্তঃসম্পর্ককে চিহ্নিত করতে চাওয়া। এই চিহ্নিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ জাতীয়তাবাদের মহিমান্বিতকরণের রাজনীতিতে যে নিরাসক্ত নেতৃত্বের ধারণা তাকে সরাসরি সমস্যায়িত করে তোলে এমন বিশ্লেষণ। দেখায় যে, সন্দীপ নিঃসন্দেহেই সেই জাতীয়তাবাদী নেতা যে তার উদ্দেশ্যসাধনের জন্য অসাধারণ বাগ্মিতা, চতুরতা এবং উপরিতলগত পৌরুষের আকর্ষণে বিমলাকে সম্মোহিত করে ফেলতে সক্ষম হয়, যেমনভাবে সম্মোহিত করে ফেলতে সক্ষম হয় অমূল্যর মতো অজস্র মেধাবী ছাত্রকে। আর ঠিক সে-কারণেই দ্বিধান্বিত হয়েও বিমলা যেমন সন্দীপের নির্দেশে দেশের কার্য উদ্ধার করতে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেয় তেমনই নিরীহ বুড়ো খাজাঞ্চিকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করতে এতটুকু সময় নেয় না অমূল্য।

প্রায় একইভাবে অতীনের করুণ পরিণতিকে প্রায় অমোঘ জেনে মরিয়া এলা ইন্দ্রনাথকে অনুরোধ করে অতীনকে নিষ্কৃতি দিতে। আর ঠিক সেইসময়ই সন্তসুলভ নিরাসক্তিতে ইন্দ্রনাথ বলেন,

আমি নিষ্কৃতি দেবার কে? ও বাঁধা পড়েছে নিজেরই সংকল্পের বন্ধনে। ওর মন থেকে দ্বিধা কোনও কালেই মিটবে না, রুচিতে ঘা লাগবে প্রতি মুহূর্তে। তবু ওর আত্মসম্মান ওকে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত।১৭

আর এভাবেই নেতৃত্বের থেকে সম্মোহনকে পৃথক করে ফেলা যায় না। একদা বিশিষ্ট উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ফ্রান্‌জ্‌ ফানোঁ শোষিত মানুষের বিষয়িতাকে পুনরুদ্ধারের জন্য হিংসাশ্রয়ী পথগ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আগ্রাসক ঔপনিবেশিক প্রভুকে বিষয় (Object) হিসেবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে তবেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে শোষিত মানুষের বিস্মৃত বিষয়িতা (Subjectivity)। আর এর প্রায় বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ দেখালেন যে, আবেগহীন, যান্ত্রিক হিংসাশ্রয়িতা যে বি-মানবীকরণের প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্রয় দেয় তা উপনিবেশকারী এবং উপনিবেশিত উভয় জনগোষ্ঠীকেই সংক্রামিত করে। কেড়ে নেয় ‘আত্ম’র নৈতিক স্বনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। যদিও Interpellation-এর রাজনীতি ব্যক্তির সেই সম্বিৎ হরণ করে নেয় যা তাকে ‘ব্যবহৃত’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারত। ব্যক্তির আত্ম-বিষয়িতা সম্পর্কে এক ‘ভ্রান্ত’ প্রতীতীর জন্ম দেয়। ঠিক এমনই ভাবাদর্শগত ভ্রান্তিশনাক্তকরণের শিকার হয়ে যায় এলা, অতীন, বিমলা এমনকী সন্দীপ বা ইন্দ্রনাথও। কিন্তু এক্ষেত্রে ‘বিষয়ী’ হিসেবে নারী বিশেষত তার যৌন পরিচিতির ব্যবহার, সেই ব্যবহারের যাবতীয় প্রমাণ অপনয়ন, ব্রহ্মচর্যের উদ্‌যাপন ইত্যাদির মতো বিষয়গুলি আলোচনাটিকে আরও জটিল করে তোলে। ব্যাখ্যা করে বলা যায় যে, ইন্দ্রনাথ যখন এলাকে নিয়োগ করে তার বৈপ্লবিক গুপ্তসমিতিতে অতীনের মতো যুবকদের আকর্ষিত করতে, তখন কাজে লাগানো হয় মূলত এলার যৌন পরিচিতিকেই। যদিও এলার এমতো ব্যবহারকে নিতান্ত সন্ন্যাসীসুলভ নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতার অক্লেশে সম্পন্ন করে তার দীক্ষাগুরু ইন্দ্রনাথ। এলা চিরকুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। দাম্পত্য, প্রেমজ সম্পর্ক যে জাতীয়তাবাদী মুক্তিকামী মতাদর্শের প্রতি অবিচল থাকার ক্ষেত্রে বিশেষ বাধাস্বরূপ তা সে উপন্যাসের সূচনায় নিজেও বিশ্বাস করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামের আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতার একটি বিশেষ পূর্বশর্ত হিসেবে ‘ব্রহ্মচর্য’কে দর্শানোর বিষয়টি কিন্তু নিতান্ত বিরল নয়। তাই ‘সন্দীপ’ বা ‘ইন্দ্রনাথ’ কাকতালীয়ভাবে ব্রহ্মচারী থেকে যান না। ‘বিবাহ’, ‘বিসমকামী সম্পর্ক’ বিষয়ে ইন্দ্রনাথের মন্তব্য এক্ষেত্রে বিশেষভাবে পাঠকের নজর কাড়ে। উমা ও ভোগীলালের বিবাহ প্রসঙ্গে যিনি বলেন, ‘ওরকম মুগ্ধ স্বভাবের ছেলেকে দলের বাইরে আঙিনায় সরিয়ে ফেলা দরকার। জঞ্জাল ফেলার সবচেয়ে ভালো ঝুড়ি বিবাহ।’১৮

কিন্তু তার মানে এই নয় যে যৌন রাজনীতি জাতীয়তাবাদের যুক্তিকাঠামোয় উহ্য থেকে যায়। ইন্দ্রনাথ নিজেও সে কথা অস্বীকার করে না, সে বলে,

শরীরটাকে ছাই দিয়েছে যে সন্ন্যাসী, আর প্রবৃত্তিকে ছাই করেছে যে ভস্ম কুণ্ড, সেই ক্লীবদের নিয়ে কাজ হবে না বলে। যখন দেখব আমাদের দলের কোনো অগ্নি-উপাসক অসাবধানে নিজের মধ্যেই অগ্নিকাণ্ড করতে বসেছে। দেবতাদের সরিয়ে। আমাদের অগ্নিকাণ্ড দেশজুড়ে, নেবানো মন দিয়ে তা হবে না, আর হবে না তাদের দিয়ে আগুন যারা চাপতে জানে না।১৯

অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী প্রকল্প যৌনতা নিরপেক্ষ কোনও ‘ক্যাটেগরি’ নয়, এমনকী ইন্দ্রনাথ তার স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণতায় এলাকে অক্লেশেই জানাতে পারে,

তোমার কাছ থেকে কাজ চাইনে, কাজের কথা সব জানাইওনে তোমাকে। কেমন করে তুমি নিজে বুঝবে তোমার হাতের রক্তচন্দনের ফোঁটা ছেলেদের মনে কী আগুন জ্বালিয়ে দেয়, সেটুকু বাদ দিয়ে কেবল শুখো মাইনের কাজ করাতে গেলে পুরো কাজ পাব না। আমরা কামিনী কাঞ্চন ত্যাগী নই। যেখানে কাঞ্চনের প্রভাব সেখানে কাঞ্চনকে অবজ্ঞা করিনে, যেখানে কামিনীর প্রভাব সেখানে কামিনীকে বেদীতে বসিয়েছি।২০

আসলে সন্দীপ যখন বিমলকে কুহকী আকর্ষণে সম্মোহিত করে ফেলে বা এলার অমোঘ আকর্ষণে যখন মেধাবী অতীন্দ্র বিপ্লবী দলে যোগ দেয় তখন জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যসাধনে অক্লেশে ব্যবহৃত হয় ‘যৌনতা’ভিত্তিক ম্যানিপুলেটিভ রাজনীতি। শুধু তা-ই নয়, ‘ব্যবহার’-এর পর তার যাবতীয় প্রমাণচিহ্নকেও সযত্নে মুছে ফেলতে দ্বিধান্বিত হয় না অনৈতিক হিংসাশ্রয়িতায় বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদ। তাই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় কোণঠাসা এবং নৈতিক প্রশ্নে ছিন্নভিন্ন বিমলাকে ছেড়ে যেতে বা গোপন বিপ্লবী দলের গলগ্রহ হয়ে ওঠা এলাকে হত্যা করতে পিছপা হয় না মাতৃমুক্তিব্রতে একনিষ্ঠ বীরপুত্রের দল।

অর্থাৎ নেতৃত্ব, সম্মোহনকারী আর সম্মোহিতের দল জাতীয়তাবাদী প্রেক্ষিতে এক জটিল আন্তঃসম্পর্কে স্থিত হয়ে থাকে, সেখানে ‘কুহক’ একটি নেতিবাচক শব্দ হিসেবেই গৃহীত হয়। আর সে-কারণেই পৌরুষ-আশ্রিত জাতীয়তাবাদী এজেন্ডায় ব্রাত্য হয়ে পড়ে বিমলা বা এলা-রা। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে কুহকিনী হয়ে ওঠার কলঙ্কই বহন করে তারা। কখনও পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে আবার কখনও বৈপ্লবিক গুপ্তসমিতিতে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বিতাড়িত হবার ভবিতব্য থেকে নিষ্কৃতি পায় না এরা। আশ্চর্য বিষয় হল এই যে, বিষয়ী হিসেবে এই প্রান্তিকতা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভূতগ্রস্ততার অবসানকেও চিহ্নিত করে। যদিও ভ্রান্ত বিষয়িতা থেকে এই নিষ্কৃতি তথা উত্তরণ ঘটে দীর্ঘ ঘটনাক্রম এবং চরম মূল্যের বিনিময়ে। অমূল্যর মৃত্যু, স্বামী নিখিলেশের চরম পরিণতি যেমন বিমলার জন্য বরাদ্দ হয় তেমনই অতীনের হাতে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে মৃত্যুবরণ করে এলা।

এই আলোচনার শেষে আমরা হয়তো সেই অবস্থানে এসে পৌঁছাই যা অনেকান্ত সম্ভাবনায় আমাদের উদ্দীপ্ত করে তোলে। উদ্দীপ্ত করে তোলে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবন্ধ ও চিঠিপত্রের বাইরেও রাবীন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতগুলিকে চিহ্নিত করতে। পৌরুষ ও প্রতিযোগিতার চেনা ভাষায় যে জাতীয়তাবাদী সন্দর্ভ দাবি করেছিল প্রশ্নহীন আনুগত্য আর বশংবদতা তাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা জুগিয়ে দেন কবি। স্পর্ধা জুগিয়ে দেন সেই নারীবাদী দৃষ্টিকোণটিকে যে নারীবাদ সারসত্তাবাদের বাইরে এসে ‘লিঙ্গ নির্মাণ’ প্রক্রিয়াটিকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রতিস্পর্ধা দেখায় ‘চিহ্নিতকরণ’-এর রাজনীতির বাইরে পা রাখার। কেবল ‘বিষয়ী’ হিসেবে ‘নারী’কে নির্মাণ নয় প্রতীক হিসেবে ‘নারীত্ব’র আরোপণ এবং তার পিছনে থাকা সংকীর্ণ উদ্দেশ্যবাদিতাকে যেভাবে উন্মোচন করেন রবীন্দ্রনাথ তা জাতীয়তাবাদের নারীবাদী ক্রিটিককে অনেকগুলি নতুন সম্ভাবনার কাছে নিয়ে আসে। আর সেই সম্ভাবনাগুলিই রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী ক্রিটিকের একটি নারীবাদী পাঠসম্ভাবনাকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক করে তোলে এবং কথা বলে সেই মানবপ্রেমের ভাষায় যাকে পৌরুষপ্রধান জাতীয়তাবাদ ‘নারীসুলভ’ ‘আবেগাশ্রিত’ বলে প্রান্তিক করে রেখেছিল।

আশিস নন্দী বিষয়টির উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন যে, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের Phallo-centric আগ্রাসী প্রবণতার নেতিবাচক প্রভাব থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির মানবিক সারসত্তাকে অসংক্রামিত রাখার ক্ষেত্রে কবির যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা তা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর উপন্যাসের নারীচরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে ভাষা পেয়েছে। যেমন গোরা উপন্যাসে আনন্দময়ী। গোরার পালিকা মা আনন্দময়ী যিনি তার ধর্ম ও নৈতিক বিশ্বাসে গভীরভাবে প্রোথিত, বাহ্যিক ধর্মাচরণ ও রক্ষণশীলতায় অবিশ্বাসী, অথচ সহজ মানবিকতা ও সহনশীলতায় অবিচল। আনন্দময়ীর এই সহজ মানবপ্রেম কিন্তু কোনও মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে স্থিত নয়। এমনকী গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার উত্তরণের সোপানও অনেকখানি তার মা আনন্দময়ীর সহজ জীবনদর্শন ও মানবতাবাদ। এ কারণেই গোরা নিজের জন্মবৃত্তান্ত উন্মোচন পর্বে সাময়িকভাবে হয়তো আমূল নড়ে যায় কিন্তু সম্পূর্ণ উন্মূল হয়ে যায় না। অন্য দিকে বিমলা বা এলার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিগুলি অনেকাংশে প্রোথিত হয়ে থাকে পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ এবং নেশন স্টেট কেন্দ্রিক মূল্যবোধগুলির অন্ধ অনুসরণের মধ্যে।

প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, রাবীন্দ্রিক চিন্তাচেতনায় মনস্তাত্ত্বিক ব্যারিকেড হিসেবে যে মাতৃত্বের উপস্থিতি বা চর্চা তা কিন্তু জাতীয়তাবাদী সন্দর্ভে পূজিত মাতৃত্বের সারসত্তাবাদী চেহারাটি থেকে আলাদা। পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে মহিমান্বিতকরণের রাজনীতির, যা বিষয়ীর মধ্যে ভ্রান্ত বিষয়ীচেতনার জন্ম দেয়। এবং শেষপর্যন্ত তাকে প্রস্তুত করে এমন ভূমিকা পালনে যা জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যসিদ্ধিতে বিশেষভাবে প্রয়োজন। নারীকে দেবী, মাতা এবং সঞ্জীবনী শক্তির ধারক হিসাবে চিহ্নিত করার সুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে বরাবরই এক ধরনের সবিচারলব্ধ দূরত্ব রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই শক্তিরূপিণী হিসেবে এলাকে চিহ্নিত করলেও ইন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করতে পারে না সে। স্পষ্ট উচ্চারণ করে এলা— ‘তাই বলে মস্ত কথা বলে আপনি ভোলাচ্ছেন আমাদের। আমরা আসলে যা, তার চেয়ে দাবি করছেন অনেক বেশি। এতটা সইবে না।’২১

কিন্তু মাতৃত্বের স্বভাবজাত উদারতা ও মঙ্গলময়ী রূপে শক্তিকে রবীন্দ্রনাথ অবজ্ঞা করেননি। তাই সন্দীপের রাজনীতির শিকার অমূল্যের পরিণতি বিমলাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে যায়। নিঃসন্তান বিমলার সহজাত বাৎসল্য ও স্নেহ জাতীয়তাবাদী হিংসাশ্রয়িতাকে নিমেষে উত্তীর্ণ করে যায়। তাই বিমলা উচ্চারণ করে,

জানি জানি পৃথিবীর বড়ো বড়ো প্রতাপ শয়তানের সঙ্গে রফা করে বেড়ে উঠেছে কিন্তু মা যে আছে একলা দাঁড়িয়ে এই শয়তানের সমৃদ্ধিকে তু্চ্ছ করবার জন্যে। মা তো কার্য সিদ্ধি চায় না, সে সিদ্ধি যত বড় সিদ্ধিই হোক, মা যে বাঁচাতে চায়, আজ আমার সমস্ত প্রাণ চাচ্ছে এই ছেলেটিকে দুই হাতে টেনে ধরে বাঁচাবার জন্যে।২২

একইভাবে গুপ্তসমিতির ছেলেদের পরিণতি এলাকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে। মাস্টারমশাই ইন্দ্রনাথকে সে বলে,

হাঁ তারাই, ছুটল মৃত্যুদূতের পিছন পিছন মরিয়া হয়ে, তারা প্রায় সবাই আমারই মতো বাঙাল। ওরাই যদি মরতে ছোটে আমি চাইনে ঘরের কোণে বেঁচে থাকতে… যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের উদ্দেশ্যটা উদ্দেশ্য না হয়ে নেশা হয়ে উঠছে। আমাদের কাজের পদ্ধতি চলেছে যেন নিজের বেতালা ঝোঁকে বিচারশক্তির বাইরে। ভালো লাগছে না। অমন সব ছেলেদের কোন্ অন্ধ শক্তির কাছে বলি দেওয়া হচ্ছে! আমার বুক ফেটে যায়।২৩

অর্থাৎ রাবীন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সর্বাতিশয় জাতীয়তাবাদী প্রজেক্টটির সর্বশক্তিমান বহিরঙ্গের অন্তরালে থেকে যাওয়া অসংখ্য মিথ্যাচার, অনৈতিকতা, স্ববিরোধিতা যেমন স্পষ্ট হতে থাকে তেমনই স্পষ্ট হতে থাকে এর লৈঙ্গিক ভাবসাপেক্ষ চরিত্রটিও।

আর এখানেই মূলস্রোত জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রান্তীকৃত নারীর বিতাড়ন এবং ব্যবহারের কাহিনির প্রতি স্বেচ্ছাকৃত বধিরতাকে সমস্যায়িত করে তোলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রশ্ন তোলেন উপরিতলগতভাবে অত্যন্ত সুস্থিত ও সরল মুক্তিপ্রকল্পের ধারক জাতীয়তাবাদের নৈতিক বৈধতা প্রসঙ্গে। তিনি সন্ধান দেন এমন এক সমান্তরাল মুক্তিকামী সন্দর্ভের যা চিরাচরিত লিঙ্গ রাজনীতির দ্ব্যণুক বিভাজনগুলির ঊর্ধ্বে এক নিখিল মানবতার ভাষায় কথা বলে।

প্রসঙ্গত তপোব্রত ঘোষের গোরা আর বিনয়-এর একটি বক্তব্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে খুব সংগতভাবেই। যেখানে তিনি বলছেন, ‘জীবনের অন্তিম দশকে রবীন্দ্রনাথ যখন উপনিষদের ধর্ম থেকে মানুষের ধর্মে উত্তীর্ণ হলেন তখন জীবন দেবতা আর মানব দেবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন। এই মানব দেবতা মানুষের সঙ্গে কারোর মধ্যস্থতা করেন না, মানুষকে তার মানব বিশ্বের নিয়ত-সৃজ্যমানতার বিস্ময়ে অনবরত বিস্তারিত করে দেন।’২৪

টীকা সূত্রনির্দেশ

. Ashis Nandy, The Illegitimacy of Nationalism, Rabindranath Tagore and The Politics of Self (India: Oxford University Press, 1998), pp. 49-50.

. Partha Chatterjee, ‘The Natinalist Resolution of the Women’s Question’ in Recasting Women: Essays in Colonial History, eds. Kumkum Sangari and Sudesh Vaid (New Delhi: Zuban, an imprint of Kali for Women, 2010), pp. 237-239.

. Samir Dayal, Repositioning India: Tagore’s Passionate Politics of Love, Positions 15:1 (London: Duke University Press, 2007), p. 183.

. তপোব্রত ঘোষ, গোরা আর বিনয় (কলকাতা: অবভাস, ২০০২), পৃ. ২।

. Rita Felski, Beyond Feminist Aesthetics (Harvard: Harvard University Press, 1989), p. 2.

. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপন্যাসসংগ্রহ (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৪০৪ বঙ্গাব্দ), পৃ. ৮৬৭।

. তদেব, পৃ. ৮৬৮।

. তদেব, পৃ. ৮৫০।

. তদেব, পৃ. ৮৫৩।

১০. Ritu Sen Chaudhuri, ‘Reading Ghare-Baire: Renegotiating Conjugality in the Moment of Nationalism’ in Rabindranath Tagore and the Nation: Essays in Politics, Society and Culture, eds. Swati Ganguly, Abhijit Sen (Punascha in association with Visva-Bharati, 2011), p. 223.

১১. Tanika Sarkar, ‘Hindu Wife, Hindu Nation, Domesticity and Nationalism in Nineteenth Century Bengal’ in Hindu Wife, Hindu Nation: Community, Religion and Cultural Nationalism (Ranikhet: Ashoka University in association with Permanent Black, 2001), pp. 50-51.

১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপন্যাসসংগ্রহ (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৪০৪ বঙ্গাব্দ), পৃ. ৮৭০-৭১।

১৩. তদেব, পৃ. ৯২৯।

১৪. তদেব, পৃ. ৯৩২।

১৫. তদেব, পৃ. ৮৬৯।

১৬. তদেব, পৃ. ৮৭০।

১৭. তদেব, পৃ. ১২৫৫।

১৮. তদেব, পৃ. ১২৫৪।

১৯. তদেব, পৃ. ১২৫৪।

২০. তদেব, পৃ. ১২৫৪।

২১. তদেব, পৃ. ১২৫২।

২২. তদেব, পৃ. ৯২৮।

২৩. তদেব, পৃ. ১২৫২।

২৪. তপোব্রত ঘোষ, গোরা আর বিনয় (কলকাতা: অবভাস, ২০০২), পৃ. ১৪১-৪২।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *