ব্যথা
শ্যামল সান্যাল দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন। বাইরে থেকে কেউ যেন বুঝতে না পারে। খুব ভাল হত, ঠোঁটে যদি একটু হাসি আনা যেত। সেটা অসম্ভব। এই অবস্থায় হাসি আনা যায় না। অনেক বড় অভিনেতাও পারবে না। তবে যেভাবেই হোক লুকোতে হবে। ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলে খুব লজ্জার হবে। ঘরে বাইরে কোথাও মুখ দেখানো যাবে না।
শ্যামলবাবু আবার ওপরের পাটির দাঁত দিয়ে নীচে চাপ দিলেন।
পঞ্চান্ন বছর বয়সে এটা সহজ কাজ নয়। ওপর-নীচ, সামনে-পিছনে সব জায়গার দাঁতই দুর্বল হয়ে পড়ছে। কোনওটা নড়ে, কোনওটা কাঁপে, কোনওটা মাঝেমধ্যে চড়াৎ-চড়াৎ করে শিরশিরানি মারে। চোয়ালের দুটোর অবস্থা তো ভয়াবহ! একেবারে ডেঞ্জার লাইনে দাঁড়িয়ে। যেন বাক্স-পেটরা গুছিয়ে তৈরি, যে-কোনও সময় রওনা দিলেই হল। এই কারণে খাওয়া-দাওয়াতেও সমস্যা। শক্ত কিছু মুখে দেওয়া যায় না। ছুটিছাটায় মাংস হলে এখন আর শুধু সিদ্ধ করলে চলে না, ডবল সিদ্ধ করতে হয়। এতে মাংস আর মাংস থাকে না। গলে, ঘেঁটে, বিতিকিচ্ছিরি একটা জিনিস হয়। খেতে বসে কাকলিদেবী রেগে যান। গজগজ করতে থাকেন।
‘খাই তো ন’মাসে ছ’মাসে, তাও যদি এরকম হয় মুখে তুলতে ইচ্ছে করে না। মটন তো নয়, মনে হচ্ছে খিচুড়ি খাচ্ছি।’
শ্যামলবাবু ভাত মাখতে মাখতে নিচু গলায় বলেন, ‘খারাপ কী? মাংসের খিচুড়ি তো খারাপ কিছু নয়। আমার ভাগলপুরের মামিমা ছিলেন খিচুড়ি স্পেশালিস্ট। মনে হয় খিচুড়ি নিয়ে গবেষণা করতেন। নিরামিষ, আমিষ— সবরকম। ওগরা, কাউন, ভূনি, ডালিয়া কত যে নাম সেসবের! একবার হল কী জানো কাকলি, পূজোর ছুটিতে ভাগলপুরে গিয়েছি…।’
কাকলিদেবী চাপা গলায় ধমক দিয়ে ওঠেন, ‘চুপ, চুপ একদম।’
শ্যামলবাবু চুপ করে যান। মাথা নামিয়ে খেতে থাকেন ফের। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিবারই তিনি স্ত্রীর ধমকে চুপ করে যান। কাকলিদেবী বকছেন আর তিনি জোর গলায় প্রতিবাদ করছেন, এমন কখনও হয় না। সামান্য যেটুকু করেন সেগুলো একেবারেই মিনমিনে ধরনের আপত্তি। শুধু স্ত্রী নয়, মানুষটার ধরনই এরকম। ঝগড়া, ঝামেলা সহ্য করতে পারেন না। আসলে ছোটবেলা থেকেই এক-একজন এরকম হয়। এরা খেলার মাঠে গোলমাল হলে বন্ধুদের হাতে মার খেয়ে বাড়ি ফেরে। বড় হলে খেলার মাঠ থাকে না কিন্তু গোলমাল রয়ে যায়। তখনও এরা একইভাবে পালাতে যায়। কিন্তু পুরোটা পারে না। অন্য গোলমাল এসে যায়। গোলমাল থেকে পালানোর গোলমাল।
আজও হয়েছে। কাকলিদেবী সকাল থেকেই উত্তেজিত, ‘কথাটা তোমাকে আর কতবার বলতে হবে?’
‘কোন কথাটা?’
‘এই যে, সবসময় চুপ করে থাকবে না, কিছু বলবে—এই কথাটা?’
শ্যামলবাবু শান্ত গলায় বললেন, ‘তুমি তো জানো কাকলি আমি ওসব পারি না।’
‘পারো না মানে! গালে একটা চড় মেরে চলে যাবে আর তুমি পারো না বলে চুপ করে বসে থাকবে?’
‘চড়! কই গালে তো কেউ চড় মারেনি!’
কাকলিদেবীর গলায় উত্তেজনা বাড়ল। বললেন, ‘মারেনি! মারতে বাকি রেখেছে কোথায়? বাড়িওয়ালার কাজের মেয়ে ঘর ঝাঁট দিয়ে দোতলা থেকে উঠোনে ময়লা ফেলছে। একদিন ফেলছে না, রোজ ফেলছে। বারণ করা সত্ত্বেও ফেলছে। এটা চড় নয়? অবশ্যই চড়। এক গালের বদলে দু’গালে চড়।’
‘তুমি কি আমাকে বাড়িওয়ালার কাজের লোকের সঙ্গে ঝগড়া করতে বলছ?’
‘বলিনি। তবে মনে হচ্ছে এবার বলতে হবে। যে-পুরুষমানুষ নিয়মিত ভাড়া দেওয়ার পরও বাড়িওয়ালাকে ধমক দিতে ভয় পায়, তার বাড়িওয়ালার কাজের লোকের সঙ্গেই ঝগড়া করা উচিত।’
‘আস্তে বলো। সবাই শুনতে পাবে।’
কাকলিদেবী গলা নামিয়ে বললেন, ‘শুনতে পেলে পাবে৷ আরও জোরে বলব। গলা ফাটিয়ে বলব। আমি জানি তাতেও তোমার টনক নড়বে না।’
শ্যামলবাবু খবরের কাগজটা মুখের কাছে তুলে বললেন, ‘ও তুমি জোরে আস্তে যেভাবেই বলো, আমি ওসব পারব না।’
কাকলিদেবীর আগে রান্নাবান্নায় মন ছিল। বিয়ের প্রথম প্রথম, দিনের বেশি সময়টাই রান্নাঘরে কাটাতেন। এখন অনেক কমে গেছে। বছরখানেক আগে ছেলে চাকরি পেয়ে বহরমপুরে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে খাওয়ার মানুষ বলতে মাত্র দু’জন। অত রান্না করে হবেটা কী? তার ওপর দু’জনেরই বয়স বাড়ছে। খাওয়া-দাওয়ায় হাজারগন্ডা বারণ। রান্নার মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে টানটা পুরো কাটেনি। সকাল আটটা বাজতে না বাজতে শোওয়ার ঘরের মেঝেতে আনাজপাতির ঝুড়ি, বঁটি, জলের বাটি সাজিয়ে বসেন। মাস কয়েক আগে পর্যন্ত রান্নাঘরেই বসতেন। গরম লাগে বলে কিছুদিন হল জায়গা বদলেছেন। তা ছাড়া আরও একটা সুবিধা আছে। এই সময়টা শ্যামলবাবু এ ঘরে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলান। তরিতরকারি কাটতে কাটতে ঘর-সংসারের দু’-একটা জরুরি কথা বলে নেওয়া যায়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় কাকলিদেবী বুঝেছেন, দিনের শুরুতেই সংসারের জরুরি কথা সেরে নেওয়া ভাল। এইসময় গলায় তেজ থাকে। বেলা যত বাড়তে থাকে সেই তেজ কমে আসে। সংসারের জরুরি কথা বলার সময় গলায় তেজ না থাকলে কথার কোনও দাম থাকে না।
বঁটিটাকে কাছে টেনে এনে কাকলিদেবী বললেন, ‘পারবে না তো বুঝতেই পারছি। নইলে ঘরে বাইরে তোমার এই অবস্থা হয়? অফিসে চারপাশে সবাই ফরফর করে প্রোমোশন পেয়ে এগিয়ে গেল, আর উনি এখনও সেই ক্লার্ক হয়েই বসে রইলেন। মা গো! আজকাল কাউকে ক্লার্ক বলা যায় নাকি?’
শ্যামলবাবু আরও শান্ত গলায় বললেন, ‘সবাই সবকিছু পারে না।’
‘চুপ, চুপ। সকালবেলা জ্ঞানের কথা শোনাতে এসো না। সবাই সবকিছু পারে না, আর তুমি কিছুই পারো না। একটা রিকশাওয়ালা পর্যন্ত চোখ রাঙিয়ে দু’টাকা বেশি নিয়ে চলে যায়।’
‘দু’টাকা নয়, এক টাকা। তা ছাড়া সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল। এক টাকার জন্য রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করব নাকি?’
‘থাক, এক টাকা কেন, এক হাজার টাকা হলেও তুমি কিছু করতে না। করতে পারতে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, সব ছেড়ে-ছুড়ে পালাই। বহরমপুরে চন্দনের কাছে গিয়ে উঠি।’
শ্যামলবাবু নিচু গলায় বলেন, ‘উঠবে কী করে? ছেলে নিজেই তো এখনও ঠিকমতো দাঁড়াতে পারেনি। পাঁচজনের সঙ্গে মেসে থাকে। মেসে গিয়ে উঠবে নাকি?’
‘দরকার হলে তাই উঠব। মেসে গিয়েই উঠব। তোমার সঙ্গে থাকার চেয়ে ছেলের মেসে গিয়ে ওঠা ভাল। যে-ছেলের বাবা এরকম; তাকে আজীবন মেসেই থাকতে হবে। ছেলের জন্য জীবনে কী করেছ যে তার নিজের গাড়ি-বাড়ি আশা করো? খরচ করে পড়াতেও তো পারোনি। যেমন তেমন করে একটা বি কম পাশ। এর একটা ভাল চাকরি-বাকরির জন্য কাউকে মুখ ফুটে বলেছ কখনও? এখন তো শুনি সবার ছেলে-মেয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি মাইনে পায়।’
‘ওসব গল্প। মাইনের কাগজপত্র দেখাতে বলো, পালাবে।’
কাকলিদেবী আরও রেগে গেলেন। বললেন, ‘হাবিজাবি বলে নিজের দোষ ঢেকো না। সব গল্প আর উনি বিরাট সত্যি এসেছেন! ছেলেটার বিয়ের কথা পর্যন্ত ভাবো না একবার। মেয়ে থাকলে আমার সর্বনাশ হত। সারাজীবন হয়তো আইবুড়োই হয়ে থাকত বেচারি। এরকম পুরুষমানুষকে কী বলে জানো?’
হাতে ধরা আলুটা ঘস করে বঁটিতে দু’ভাগ করলেন কাকলিদেবী। আলুর পেটে দাগ। ফেলে দিতে হবে। বাজার করতে গিয়ে ঠকে আসাটা তাঁর স্বামীর বেলায় নতুন কিছু নয়। এরকম বোকা মানুষকে লোকে ঠকাবে না তো কী করবে? বাজার তো আর মন্দির নয় যে ‘আয় আয়’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরবে। তিনি মুখ তুলে কঠিন চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। শ্যামলবাবু সেই চোখ দেখেও না-দেখার ভান করে যত্ন করে খবরের কাগজটা ভাঁজ করলেন। তারপর উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। স্নানে যেতে হবে। আজকাল অফিসে একটু দেরি হলেই সুখময় সামন্তু ঝামেলা করছে। যারা গলা ফাটিয়ে আর ইউনিয়ন ধরে ম্যানেজ করে রেখেছে তাদের কিছু হয় না। হবে কেন? বস্ হলেও সুখময় সামন্ত কী জিনিস অফিসের সবাই জানে। লোকটার অনেক গণ্ডগোল। বড় বড় ফাইলের ঘুষের পয়সা ওর পকেট পর্যন্ত যায়। তারপর তো সাপ্লায়ার, কন্ট্রাক্টর সবাই আছে। তাই যে চোখ রাঙাতে পারে তার কাছেই কুঁকড়ে থাকে ব্যাটা। যত হম্বিতম্বি নরমদের ওপর।
কাকলিদেবী বললেন, ‘কী হল বললে না তো?’ দু’হাতে তখন আলুর টুকরো দুটো ধরা।
শ্যামলবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘কী বলব?’
‘এই যে তোমার মতো পুরুষমানুষকে কী বলে— সেইটা বলবে।’
শ্যামলবাবু মৃদু স্বরে বললেন, ‘আঃ কাকলি! যত দিন যাচ্ছে তুমি ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছ। আমাকে নিয়ে পড়লে আর থামতে চাও না। প্রেশারের ওষুধটা ঠিকমতো খাচ্ছ তো?’
কাকলিদেবী ফোঁস করে ওঠেন, ‘তোমার মতো লোকেদের বলে ম্যাদামারা। ম্যাদামারা পুরুষমানুষ। সংসার সবরকম পুরুষমানুষ নিয়ে চলতে পারে। সাধু-লম্পট, চোর-ডাকাত, সবরকম। কিন্তু ম্যাদামারা পুরুষমানুষ নিয়ে চলতে পারে না। বুঝলে?’
তোয়ালে হাতে নিয়ে শ্যামলবাবু বাথরুমে ঢুকলেন। ঢুকতে ঢুকতে টের পেলেন ডান হাঁটুর কাছটা শিরশির করছে। এর অর্থ ব্যথাটা আবার আসছে। দ্রুত হাতে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন শ্যামলবাবু। অল্পক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রণায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেল মানুষটার।
ব্যথাটা কেমন যেন! অদ্ভুত। বেশিরভাগ সময়টাই ঘাপটি মেরে আছে। যেন গুঁড়িসুড়ি মেরে লুকিয়ে পড়েছে। হাড়ের পাশ বা পেশি-টেশির পিছনে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। কোনও কোনও সময় মনে হচ্ছে, সেরেই গেছে, আর হবে না। ঠিক তখনই মাথা-টাথা নেড়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে! যেন শিংওয়ালা বুনো মোষ! তেড়ে আসছে ঝোপের আড়াল থেকে। ঝনঝন করে উঠছে একেবারে। প্রথমে হাঁটু, তারপর হাঁটু ছাড়িয়ে গোটা পা। শেষ পর্যন্ত সেই ঝনঝনানি উঠছে কোমরের দিকে। বাপ রে। ভয়ংকর! তবে রক্ষে একটাই, বেশিক্ষণ নয়, বড়জোর তিরিশ কি চল্লিশ সেকেন্ডের। একটু কমও হতে পারে। কিন্তু ওইটুকুই মনে হচ্ছে অনেক। চোখ মুখ কুঁচকে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আর সেই যন্ত্রণা লুকোতেই এত কসরত। কখনও দাঁতে দাঁত চাপছেন শ্যামল সান্যাল। কখনও কামড়ে ধরছেন ঠোঁট। কখনও আবার হাতের মুঠি পাকিয়ে রাখছেন গায়ের জোরে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে কষ্ট লুকোনোর নানা পথ খুঁজছেন। নইলে উপায় কী? কোনও উপায় নেই। চোখমুখে ব্যথার ছাপ পড়লে কেলেঙ্কারি। সবাই জানতে চাইবে কী হয়েছে?
মানুষ যেমন নানা ধরনের বাধা টপকে বড় হয়, তেমন অনেকরকম ব্যথাও পেরোতে হয়। শ্যামলবাবুকেও হয়েছে। মচকে যাওয়া, ধাক্কা লাগা, গর্তে পড়া তো আছেই, একবার হাত পর্যন্ত ভেঙেছিল। তখন কোন ক্লাসে পড়ছেন? সেভেন না এইটের শেষ? ক্লাস মনে না থাকলেও ঘটনা মনে আছে। প্রথম ভাঙা বলেই মনে আছে। সাধারণত জীবনের প্রথম ভাঙা এবং প্রথম জোড়া দুটোই মনে থাকে। স্কুলে টিফিনের সময় বন্ধুদের ধাক্কায় পড়েছিলেন শানবাঁধানো বারান্দায়। মিনিট তিন-চারের মধ্যে বাঁ হাতের কবজির ওপরটা ফুলে ঢোল। একুশ দিনের প্লাস্টার। ব্যথার নিয়ম হল, ব্যথার সঙ্গে ব্যথা ছাড়াও আরও একটু কিছু থাকবে। রাগ, দুঃখ, বিরক্তি বা অভিমান। সেদিন হাত ভাঙায় শ্যামলবাবুর কষ্ট যত না হয়েছিল, অভিমান হয়েছিল বেশি। বন্ধুদের ওপর অভিমান। ওরা কেন ধাক্কা দিল? আর আজ এই প্রায় বুড়ো বয়সের ব্যথায় শ্যামলবাবুর লজ্জা করছে। খুব লজ্জা করছে। সেইজন্যই লুকোনোর এত চেষ্টা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত লুকোনো গেল না!
দুই
কাকলিদেবী ফিসফিস করে বললেন, ‘ছি ছি।’
শ্যামলবাবুর দুটো চোখই বন্ধ। যন্ত্রণায় চোখের পাতা এবং ভুরু কুঁচকে আছে। কপালে ঘাম জমছে। ডান পায়ের হাঁটু চেপে ধরে তিনি বসে আছেন খাটের মাঝখানে। অন্ধকারে মনে হচ্ছে মানুষটা বুঝি ধনুকের মতো বেঁকে গেছে।
কাকলিদেবী খাট থেকে নামলেন। আলো জ্বালিয়ে ফিরে এলেন আবার। এখন কত রাত? দেওয়াল ঘড়িটা টিভির মাথায় ঝোলানো। আগে ছিল দরজার ওপর। বছরখানেক হল কাকলিদেবী সরিয়ে এনেছেন। টিভির মাথায় ঘড়ি থাকা দরকার। সময় দেখে চ্যানেল ঘোরাতে হয়। এক-একটা সময় এক-একটা চ্যানেলে প্রোগ্রাম। তবে সেই ঘড়ি এখন বন্ধ। কাল বিকেলে চারটে বাজার পর থেকেই থেমে আছে। ব্যাটারি ফুরিয়েছে। বন্ধ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে কাকলিদেবী আরও বিরক্ত হলেন। প্রতিবারই এই কাণ্ড হয়। ব্যাটারি ফুরিয়ে ঘড়িটা পড়ে থাকে দু’দিন, তিনদিন, এমনকী চারদিনও। মেয়েমানুষ তো আর টুলে উঠে ঘড়ির ব্যাটারি বদলাতে পারে না।
বিরক্ত কাকলিদেবী আবার বললেন, ‘ছি ছি। কী কাণ্ড!’
মিনিটখানেক একইভাবে চুপ করে বসে থাকার পর শ্যামলবাবু সোজা হয়ে চোখ খুললেন। ঝনঝনানি কমছে। নিচু গলায় বললেন, ‘আমাকে ছি ছি বলছ কেন? আমি কী করলাম?’
কাকলিদেবী চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ওমা, বলব না! এই বয়সে পুলিশের লাঠি খেয়েছ, ছি ছি করব না তো কি মেডেল দেব?’
‘আমি কি ইচ্ছে করে খেয়েছি?’
‘পুলিশের মার কেউ ইচ্ছে করে খায় না। তুমি একটা চোর-ডাকাত দেখাও তো যে থানায় গিয়ে মারুন বলে পিঠ পেতে দিয়েছে।’ কাকলিদেবী স্বামীর পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখি কোন জায়গাটায় মেরেছে। ফুলেছে নাকি?’
‘মেরেছে বলছ কেন?’
‘তা হলে কী বলব, আদর করেছে? রাতদুপুরে ঘুম থেকে তুলে ঢঙ কোরো না। দাও দেখি, পা-টা এদিকে দাও। সেঁক দেব?’
শ্যামলবাবু চাপা গলায় বললেন, ‘এইজন্যই এতদিন বলিনি। জানতাম তোমরা বিষয়টাকে একটা হাসি-তামাশায় নিয়ে যাবে।’
কাকলিদেবী গজগজ করে বললেন, ‘বলোনি ভালই করেছ, লাঠির বাড়ি এমন ব্যাপার নয় যে ঢাক পিটিয়ে বলতে হবে।’
কথা শেষ করে কাকলিদেবী ফের হাত বাড়ালেন। শ্যামলবাবু পা সরিয়ে নিলেন। ব্যথাটা আবার চলে গেছে। খাটের ওপর পা লম্বা করে পরীক্ষা করলেন। না, নেই। যথারীতি ভ্যানিশ। কে বলবে খানিক আগেই টাটিয়ে উঠেছিল? উফ, একেবারে ঘুম ভাঙিয়ে ছেড়েছে! ঘটনাটার তিনদিন হয়ে গেছে কিন্তু এতটা কখনও হয়নি। এতদিন যে ঝনঝনানি কোমর পর্যন্ত উঠেছিল, আজ ঘুমের মধ্যে মনে হল সেটা একেবারে মাথা পর্যন্ত গেছে! ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন শ্যামলবাবু। পাশে কাকলি শুয়ে। ওর ঘুমটা পাতলা। সামান্য আওয়াজেই উঠে পড়ে। অন্ধকার খাটে বসেই শ্যামলবাবু ব্যথা সামলানোর চেষ্টা করলেন। ভেতরে বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যায়নি তো? যদি টিস্যু বা নার্ভ-টার্ভ ছিড়ে থাকে? কে জানে ছোট কোনও হাড়ে হয়তো চিড় ধরেছে। পুলিশের লাঠিতে কী হয়? হেমারেজ হয় কি? রক্তক্ষরণ? রক্তক্ষরণ অতি মারাত্মক জিনিস। বিশেষ করে নিঃশব্দে হলে তো কথাই নেই। যন্ত্রণার মধ্যেই হুড়মুড় করে এসব মাথায় এল। আর তখনই শ্যামলবাবু ভয় পেলেন। খুব ভয়। হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে ধাক্কা দিলেন।
‘শুনছি, এই যে শুনছ। ওঠো একবার। তাড়াতাড়ি ওঠো।’
কাকলিদেবী চোখ খোলেন। উঠে বসে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘কী হল? কী হয়েছে?’
‘ব্যথা করছে। ভীষণ ব্যথা করছে।’ অস্ফুটে বললেন শ্যামলবাবু।
কাকলিদেবী ঝুঁকে পড়লেন। একটা হাত স্বামীর বুকে রেখে ঘুমজড়ানো আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘ব্যথা! বুকে।’
এই আতঙ্ক স্বাভাবিক। এই বয়সে মাঝরাতে ব্যথা শুনলে প্রথমে বুকের কথাই মাথায় আসে। শ্যামলবাবু কাতর ভঙ্গিতে বললেন, না না, বুকে নয়, পায়ে। তুমি উঠে আগে আলোটা জ্বালাও। জল দাও একটু।’
‘পায়ে! কোথায় পড়েছিলে?’
উফ! এই যে ডান পায়ে, হাঁটুর পিছনে। কোথাও পড়িনি। পুলিশের লাঠি লেগেছে।’
খাট থেকে নামতে গিয়েও থমকে যান কাকলিদেবী। লাঠি! পুলিশের লাঠি! এই মানুষটাকে পুলিশ মেরেছে। ঠিক শুনলেন তো? মনে হয় না ঠিক শুনলেন। তাঁর স্বামী চোর-ডাকাত নয়। পার্টিবাজি করে না। কোনও সাতে-পাঁচেই নেই। ভিতু, গোবেচারা বোকা ধরনের ভদ্রলোক। তাকে খামোকা পুলিশ মারতে যাবে কেন?
‘কী বললে?’
শ্যামলবাবু এবার একটু বিরক্ত হন। বললেন, ‘কিছু বলিনি। বললাম, পায়ে পুলিশের লাঠি লেগেছিল। তিনদিন হয়ে গেছে। তারপর থেকে বাজে একটা ব্যথা হচ্ছে। ব্যথাটা আজ হঠাৎ বেড়েছে, ঘুম ভেঙে গেল তাই তোমায় ডাকলাম।’
আলো জ্বালিয়ে এসে কাকলিদেবী টেবিলে রাখা জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢাললেন। স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ছিঃ, এ আবার কী কাণ্ড? কোনও ভদ্রলোক পুলিশের হাতে মার খায় নাকি? আমি তো বাপু পুলিশের মার খাওয়া মানুষ কখনও দেখিনি। ওই যা কাগজে-টাগজে পড়ি। এমা!’
শ্যামলবাবু এক চুমুকে জল শেষ করলেন। এই ভয়টাই করছিলেন। ঘটনাটা জানাজানি হলে একটা লজ্জার ব্যাপার হবে। কাকলির কথাটা মিথ্যে নয়। পুলিশের পিটুনি খাওয়া লোকজন তো আর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় না। যদিও তিনি মার খাননি। কিন্তু সেকথা কে বিশাস করবে? বালিশটা পিঠের কাছে দিয়ে শ্যামলবাবু আধশোয়া হয়ে বসলেন।
‘হট ওয়াটার ব্যাগ দেব? মলম-টলম কিছু দিলে পারতে তো।’
কাকলিদেবীর গলা খানিকটা নরম হয়েছে। হওয়াই উচিত। ঘটনা যতই লজ্জার হোক, স্বামীর বাথা তো।
‘না, থাক। কমে গেছে। এখন আর নেই।’
‘এখন নেই, কিন্তু আবার হতে কতক্ষণ?’
‘সেটাই তো মুশকিল। হঠাৎ হঠাৎ চাড়া দিচ্ছে।’
কাকলিদেবীর গলায় উদ্বেগ, ‘সে আবার কী গো! হঠাৎ ব্যথা কিন্তু ভাল নয়।’
শ্যামলবাবু হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে শুকনো হাসলেন। বললেন, ‘ব্যথার আবার ভাল-মন্দ কী কাকলি?’
কাকলিদেবী সরে এসে স্বামীর ডান হাঁটুর উপর হাত রাখলেন। বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘অত জানি না। ছোটকুর বাবার এরকম হত। হঠাৎ হঠাৎ ফিক ব্যথার মতো। এমনি সময় ঠিক, কিন্তু শুরু হলে এমন কষ্ট যে, বুড়ো মানুষটা একেবারে মাটিতে বসে পড়ত। একবার বাজারে গিয়েও হল। মাছ কাটা বঁটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর কী।’
শ্যামলবাবু আনমনে বললেন, ‘ওটা পেট। পেট আর পা এক জিনিস নয়।’
কাকলিদেবী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘ওই একই হল। রাতদুপুরে তক্কো কোরো না। এমন একটা করছ যেন পুলিশ তোমাকে মারেনি, আমায় মেরেছে।’
শ্যামলবাবু নিচু গলায় বললেন, ‘তুমি একই কথা বারবার বলছ কেন? বলছি তো পুলিশ আমাকে মারেনি। ঘটনাটা শুনলেই বুঝতে পারবে। বুধবার অফিস যাওয়ার সময় শিয়ালদা ফ্লাইওভারের মুখটায় বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আর যাবে না। কী ব্যাপার, না সামনে গোলমাল। রোড ব্লকড। রাস্তা আটকে কারা বসে পড়েছে।’
কাকলিদেবী বললেন, ‘কেন? বসে পড়েছে কেন?’
‘সে তো আমি বলতে পারব না। আমি তো বসিনি। যারা বসেছে তারা বলতে পারবে। আজকাল যে-কোনও কারণে মানুষ রাস্তায় বসে পড়ে। তুমি তো আর রাস্তায় বের হও না। বেরোলে জানতে। অ্যাকাউন্টসের সন্তোষ সেদিন বাছিল, গেল রোববার ওদের ওখানে শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে কোন বাড়ির বউ নাকি দুই ছেলের হাত ধরে যাদবপুরের মোড়ে গিয়ে বসে পড়েছিল। গাড়ি-টাড়ি আটকে সে এক একাকার কাণ্ড।’
‘ঠিক আছে, তোমার কী হল বলে।’
‘কী আর হবে, খানিকটা অপেক্ষা করে সবাই বাস থেকে নেমে পড়ল। আমিও নামলাম। অফিসে লেট হয়ে গেছে। বসে সময় নষ্ট করার মতো অবস্থা নেই। ঠিক করলাম হেঁটেই যাব। বাস থেকে নেমে দেখি রাস্তায় খুব ভিড়। গাড়ি-টাড়ি সব দাঁড়িয়ে। কাতারে কাতারে মানুষ। আমি ফুটপাথ বদলে তাড়াতাড়ি হাঁটা দিলাম।
‘কোনদিকে হাঁটলে?’
শ্যামলবাবু দুটো পা সামনের দিকে মেলে দিলেন। কাকলিদেবী ডান হাঁটুর তলায় একটা বালিশ দিয়েছেন। লজ্জার ঘটনা বলতে এখন আর ততটা খারাপ লাগছে না শ্যামলবাবুর। বরং একটা স্বীকারোক্তির মতো মনে হচ্ছে। কে জানে, হয়তো লজ্জার কথা বলে ফেলার মধ্যে স্বস্তির ব্যাপারও থাকে।
‘কোনদিকে আবার? ভাবলাম একটু এগিয়ে ডানদিকের গলি ধরে পালাব। আসলে ওইদিকের ফুটপাথটা নর্মাল ছিল। শান্ত, স্বাভাবিক। লোকটোক হাঁটছিল। দু’-একটা হকার বসে আছে। সত্যি কথা বলতে কী, ঝামেলা নেই দেখেই আমি ওদিকে গেলাম। খানিকটা এগোলামও, অসুবিধে হল না। তারপই হঠাৎ…।’ শ্যামলবাবু থামলেন।
কাকলিদেবী উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, হঠাৎ কী? কী হঠাৎ?’।
শ্যামলবাবু স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ শুনি একটা হইহই। দেখি উলটোদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে। পুরুষ মহিলা সবাই, বাচ্চারাও আছে। কী করব বুঝতে পারছি না। দেখি কোথা থেকে যেন ইটের টুকরো উড়ে আসছে। বড় নয়, ছোট ছোট ইটের টুকরো। আমি হাতের ব্যাগটা তুলে মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করলাম। হকাররা তখন পড়িমড়ি করে জিনিস গোটাচ্ছে। কারা যেন চিৎকার করে বলল, “লাঠি! লাঠি! লাঠি চালাচ্ছে পুলিশ।’ এই পর্যন্ত বলে দম নিতে একটু থামলেন শ্যামলবাবু। ফের শুরু করলেন, ‘কাকলি, তুমি তো জানো আমি আগে কখনও এরকম অবস্থায় পড়িনি। এরকম কেন? এর সিকি গোলমালেও থাকি না। ঘটনায় এতটাই নার্ভাস হয়ে গেলাম যে পিছন ফিরে পালাতেও ভুলে গেছি। সত্যি কথা বলতে কী এই অবস্থায় যে পালাতে হয়, সেটাও যেন মাথা থেকে উরে গেছে! যখন সংবিৎ ফিল ততক্ষণে ঘাড়ের কাছে লাঠি উঁচিয়ে পুলিশ চলে এসেছে।’ শ্যামলবাবু আবার থামলেন। পায়ের দিকে তাকালেন। বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার আওয়াজ এল। তার মানে ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই। শেষরাতে দু’-একটা কারে ট্রাক ছাড়ে।
কাকলিদেবী শাড়ির আঁচল মুখে চেপে বসে আছেন। সেই অবস্থায় বললেন, ‘তারপর কী হল? ওরা তোমাকে মারল?’
‘মারল। তবে ইচ্ছে করে মারল এমন নয়। মিথ্যে বলব না। মিথ্যে বলাটা ঠিক হবে না। নিশ্চয় আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছিল।’
‘কী বুঝতে পেরেছিল?’
‘কী পেরেছিল তা জানি না। তবে পুলিশ সব বুঝতে পারে। একটা বয়স্ক মানুষ, হাতে অফিসের ব্যাগ, ফুটপাথ দিয়ে চুপচাপ হাঁটছে। লোকটা যে সাতে-পাঁচে নেই, ওরা বুঝতে পারবে না? এটা তুমি কী বলছ কাকলি? নিশ্চয় পেরেছিল। তবে এলোপাথাড়ি চালাতে গিয়ে লাঠির একটা বাড়ি আমার পায়ের পিছনে এসে লাগল। এই যে এখানে। ওদের কোনও দোষ নেই। ওই একটাই যথেষ্ট। আমি ছিটকে পাশের সরু গলিতে ঢুকে গেলাম। ব্যথা তখনও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলাম বিকেলে, অফিস ছুটির পর। ট্রামে ওঠার সময় ঝনঝন করে উঠল।’
কাকলিদেবী নরম গলায় বললেন, ‘তোমার আগেই বলা উচিত ছিল।’
শ্যামলবাবু এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর অস্ফুটে বললেন, ‘কেমন যেন একটা অস্বতি হচ্ছিল কাকলি। যতই হোক পুলিশের লাঠি। কীভাবে নেবে… এই তো খানিক আগে তুমিও বলছিলে। বলছিলে না?’
কাকলিদেবী গলায় জোর এনে বললেন, ‘বলব না তো কী করব? বাপের জন্মে লাঠি খাওয়া কাউকে এত কাছ থেকে দেখেছি নাকি? এখন একেবারে পাশে শুয়ে আছে! বাপ রে! যাক, কালই ডাক্তারের কাছে যাবে।’
শ্যামলবাবু খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘ভেবেছিলাম ডাক্তার লাগবে না, এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। এখন বুঝতে পারছি, লাগবে। নাও আলোটা নেভাও। দেখি একটু যদি ঘুমোতে পারি। সকাল তো হয়েই এল।’
রাত-জাগা ঘুম ভাল নয়। ভাঙা ভাঙা ঘুমের ভেতর বিদঘুটে স্বপ্ন আসে। শ্যামলবাবর বেলাতেও এল। সেই স্বপ্ন যেন বেশি বিদঘুটে। দেখলেন, টিভিতে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন তিনি। মোটা মোটা হাতলের সোফা। হাতে চায়ের কাপ। উলটোদিকে কম বয়সের একটা মেয়ে। মেয়েটার স্কার্ট শেষ হয়েছে, ঊরুর ওপরে। পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে সিনেমার নায়িকার মতো। জামাও গোলমেলে। সামান্য ঝুঁকলেই বুকের অনেকটা বেরিয়ে আসে। শ্যামলবাবু চোখ সরিয়ে নিলেন। একগাল হেসে ন্যাকা-ন্যাকা গলায় সেই মেয়ে বকবক শুরু করল।
‘সুধী দর্শকমণ্ডলী, শুভসন্ধ্যা। আজ আপনাদের সামনে এমন এক মানুষকে আমরা উপস্থিত করতে পেরেছি যাঁকে মাত্র তিনদিন আগে পুলিশ মেরেছে। লাঠি মেরেছে ডান পায়ে। আপনারা জানেন, এ ধরনের কৃতী মানুষরা খুবই লাজুক প্রকৃতির হন। এঁরা কিছুতেই মিডিয়ার সামনে আসতে চান না। থাকেন অধরা। কিন্তু শ্যামল সান্যাল রাজি হয়েছেন। আমাদের অনেক অনুরোধের পর স্টুডিয়োতে এসেছেন। তাকে ধন্যবাদ। তাকে অভিনন্দন। শ্যামলবাবু আজ আপনাদের কাছে তার লাঠি খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলবেন। শুধু তাই নয়, উনি কথা দিয়েছেন ব্রেকের পর আমাদের একটা আবৃত্তিও শোনাবেন। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে সবকিছুর আগে আমি অনুরোধ করব, উনি যেন দর্শকদের তাঁর লাঠি খাওয়া পা-টা একবার তুলে দেখান। স্যার এই যে, এইদিকে ক্যামেরা… আপনি সবাইকে পা তুলে দেখান। লজ্জার কিছু নেই…।’
শ্যামলবাবু পা তুলতে যান এবং ঘুম ভেঙে যায়।
তিন
ঝন্টু এসে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘সাহেব আপনাকে ডাকে।’
অফিসে বসের পিয়নরা সাধারণত একটু রাশভারী ধরনের হয়। কম কথা বলে, কম হাসে। সম্ভবত দীর্ঘক্ষণ বসের কাছাকাছি থাকার ফলে তাদের মধ্যেও একটা ‘বস বস’ ভাব আসে ঝন্টু সেরকম নয়। বসের পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও সে ফাজিল প্রকৃতির ছেলে। শ্যামল সান্যালের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু চোখ নাচাল না, মুচকি মুচকি হাসলও।
ফাইল, কাগজপত্র টেবিলে ছড়ানো। শ্যামলবাবু দ্রুত হাতে সেগুলো গোছাতে থাকেন। সুখময় সামন্তু কেন ডাকছে তিনি জানেন। লেটের জন্য কথা শোনাবে। মাসের মধ্যে তিনদিনের বেশি যাদের লেট হয় তাদের বসের ঘরে ডেকে কথা শোনানো হয়। অবশ্য সবাইকে নয়, যাদের হাঁকডাক, ইউনিয়ন, স্লোগান, চোখ রাঙানি নেই শুধু তাদের। ঘরে ডাকার পর খানিকটা সময় দেখতে না পাওয়ার ভান করে সুখময়। এই মিনিটখানেকের মতো। মাথা নামিয়ে কাগজপত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর মুখ তুলে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘রোজ রোজ লেট না করে এক কাজ করুন, কটা দিন বরং ছুটি নিয়ে নিন। এই সপ্তাহখানেক ধরুন। দশদিনও নিতে পারেন। চিন্তা করবেন না স্পেশাল লিভ করে দেব।’
‘বাড়িতে স্যার মিস্ত্রি লেগেছে। বোঝেনই তো স্যার মিস্ত্রি কী জিনিস। সকাল আটটায় আসব বলে দশটা বাজিয়ে ছাড়ল।’
‘আহা, বুঝি সব, সবই বুঝি। সেইজন্যই তো ছুটির অ্যাডভাইস করছি। সেরকম হলে ছুটি নিয়ে মিস্ত্রির সঙ্গে কাজেও নেমে পড়তে পারবেন। বিদেশে তো এই সিস্টেম। সবাই মিলে বাড়ি রং করে। কে মালিক, কে মজুর বোঝা যায় না। কাজের সময় সব সমান।’
শ্যামলবাবু বসের ঘরে ঢোকার সময় ‘কথা শোনা’র জন্য প্রস্তুত হলেন। আজ মনে হচ্ছে, ‘কথা শোনার চেয়েও বেশি কিছু হবে। কারণ বেশ দেরি হয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙল অনেকটা পরে। সম্ভবত ডাক্তারবাবুর ব্যথার ওষুধে ঘুমের কিছু ছিল। আবার নাও হতে পারে। ডাক্তার দেখানোর কারণে হয়তো মনটা হালকা লাগছিল। মন হালকা হলে ঘুম ভারী হয়।
পুলিশের লাঠি শুনে ডাক্তারবাবু প্রথমটায় থতমত খেয়ে যান। বয়স্ক মানুষ। বাঁ হাতে চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, ‘কী বললেন? লাঠি!’
শ্যামলবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, লাঠি। পুলিশ লাঠি মেরেছে। তবে অনেক মারেনি, মাত্র একটা ঘা দিয়েছে। ওনলি ওয়ান। অফিস যাওয়ার সময় গোলমালে পড়েছিলাম।’
কথাটা বলে শ্যামলবাবু ডাক্তারের দিকে চেয়ে হাসলেন। বোকার মতো হাসি।
কাকলিদেবীও সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন। শ্যামলবাবুই আটকেছেন। বললেন, ‘তুমি গিয়ে কী করবে? আমি অফিস থেকে ফেরার পথে একেবারে ডাক্তারের চেম্বার হয়ে আসব।’
‘আমার সন্দেহ হচ্ছে।’
‘সন্দেহ! সন্দেহ কীসের?’
‘আমার মনে হচ্ছে তুমি ডাক্তারকে লাঠির কথাটা বলবে না। লুকোবে। সেই কারণেই আমার যাওয়া দরকার।’
‘শ্যামলবাবু মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বললেন, ‘খেপেছ? সব বলব।’
কাকলিদেবী স্বামীর ব্যাগে টিফিনবাক্স পুরে দিতে দিতে বললেন, ‘তাই বলবে। উকিল আর ডাক্তারের কাছে কিছু লুকোতে নেই। ঘটনা খুব লজ্জার হলেও নয়।’
কাকলিদেবীর সন্দেহ মিথ্যে নয়। শ্যামলবাবু ভেবে রেখেছিলেন আসল কথা চেপে যাবেন। বানিয়ে অন্য কিছু বলবেন। বাস থেকে নামতে গিয়ে লেগেছে, বাজারে পা হড়কেছে ধরনের কিছু। ব্যথা বাথাই। ব্যথার ওষুধের গায়ে তো আর ‘বাস থেকে পড়া’, ‘বাজারে পা হরকানো’ বা ‘পুলিশের লাঠি’ লেখা থাকে না। এই ঘটনার কথা যত চেপে যাওয়া যায় ততই ভাল। অফিসে বসে শ্যামলবাবু মনে মনে ‘বাসে লাগা’র গল্পটা ফাইনাল করেন। কিন্তু সন্ধ্যায় ডাক্তারের সামনে বসে কী যেন হল। মুখ থেকে ফস করে লাঠির কথাটা বেরিয়ে পড়ল। বলেই বুঝতে পারলেন, কাজটা ঠিক হল না। কম্পাউন্ডার ছোকরাটা ঘরে ঘুরঘুর করছিল। লাঠি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। ব্যাটা শুনতে পেল নাকি? শ্যামলবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘মনে হয় ওরা ঠিক বুঝতে পারেনি ডাক্তারবাবু।’
চশমা চোখে দিয়ে ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন। দুটো ভুরুই কোঁচকানো। ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসির মতো। হাসি কি? ঘরের কোণে রাখা একফালি শোওয়ার জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, ‘নিন, শুয়ে পড়ুন। কারা বুঝতে পারেনি?’
শ্যামলবাবু শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন, ‘পুলিশ। পুলিশ বুঝতে পারেনি। পাবলিকের ব্যাপার তো, কে ভাল, কে মন্দ বোঝা যায় না। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই…। এই যে ডাক্তারবাবু এই পায়ে, এখানে, হাঁটুর পিছনে।’
ডাক্তারবাবু পা পরীক্ষা করতে করতে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ফালতু ঝামেলায় যান কেন? সরে যেতে পারলেন না?’
শ্যামলবাবু উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘যেতাম ডাক্তারবাবু, ঠিকই সরে যেতাম। কিন্তু ভিড়ে আটকে গেলাম। তার ওপর অফিসের লেট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে মাথাটা যেন কাজ করল না। আর মিনিটখানেক হলেই সামনের গলিটায় ঢুকে যেতাম।’
পা পরীক্ষার পর টেবিলে ফিরে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখলেন ডাক্তারবাবু। বললেন, ‘নিন, দুটো ওষুধ দিলাম। সঙ্গে ভিটামিন। দিন কয়েক খান। পেন না কমলে একটা এক্স-রে করাব। তবে মনে হচ্ছে না দরকার হবে।’
‘ভয়ের কিছু নেই তো? এমন ঝনঝন করে উঠছে… তাও সবসময় নয়। এক-এক সময়। কাল রাতে তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম। হেমারেজ-টেমারেজ যদি কিছু হয়।’
ডাক্তারবাবু এতক্ষণ পর একটু হাসলেন। বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। দেখে তো ভয়ের কিছু মনে হল না। আসলে কী জানেন, পুলিশের লাঠির ট্রিটমেন্ট আমি আগে কখনও করিনি। ইনফ্যাক্ট ডাক্তারিতে তো আলাদা করে কিছু নেই। তবে যখন ছাত্র ছিলাম হাসপাতালে এ ধরনের কেস এলে বন্ধুরা মজা করে বলত পুলিশ নাকি মারবার সময় লাঠিতে একটা স্পিন ছাড়ে। চরের মতো। হাত, পা, পিঠের নার্ভ সেই চক্কর ক্যারি করে মাথা পর্যন্ত নিয়ে যায়। তখন মাথায় সমস্যা হয়। সেই কারণে ট্রিটমেন্ট স্যুড স্টার্ট ফ্রম দ্য ব্রেন। আগে মাথায় চিকিৎসা, তারপর ব্যথার। ওসব ছিল ঠাট্টা। আপনি চিন্তা করবেন না। ইফ অ্যাম নট রং, মনে হচ্ছে, দিন কয়েকের মামলা।’
ডাক্তারের হাসি যে-কোনও রুগির পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ। হাসি অল্প হলেই হয়। শ্যামলবাবু গদগদ মুখে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, বেশি করে জল খাব? ছেলেবেলায় মা বলতেন জলে ব্যথা-বেদনা সারে।’
‘জল! হঠাৎ জল কেন? ঠিক আছে খাবেন। তবে আবার এ ধরনের ঝামেলায় পড়লে জল, ওষুধ কেউ কিছু করতে পারবে না। সুতরাং এবার থেকে অ্যালার্ট থাকবেন। মনে রাখবেন, বয়স হয়েছে। বেশি বয়সে ব্যথা ভাল জিনিস নয়।
বসের ঘরে কাঁপা পায়ে ঢুকে চমকে উঠলেন শ্যামল সান্যাল। রাশভারী সুখময়ের ঠোঁটেও চিলতে হাসি।
‘বসুন, বসুন!’
শ্যামলবাবু ঘাবড়ে গেলেন। লোকটা বসতে বলে কেন? এবার থেকে কি এই অফিসে বসিয়ে বকুনি দেওয়ার সিস্টেম চালু হল? জড়সড় হয়ে বসলেন শ্যামলবাবু। টেবিলের ওপর হাত দুটো রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে নামিয়েও নিলেন। ঢোঁক গিলে বললেন, ‘স্যার আজ লেট হত না। আসলে কাল…।’
‘ওসব লেট-ফেট ছাড়ুন। আগে বলুন কী খাবেন? চা বলি? নাকি কফি? এখানে কফিটা পারে না, চা-ই খান। আপনাকে বরং একদিন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কফি খাওয়াব। আমার মিসেস কফিতে এক্সপার্ট।’
কথা বলতে বলতেই সুখময় বেল টিপল। ঝন্টু ঘরে ঢুকতে চায়ের অর্ডার হল। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট। শ্যামলবাবুর এবার ভয় করছে। ভয় পাওয়ারই কথা। দীর্ঘ চাকরিজীবনে তাঁর কখনও বসের ঘরে বসে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। কেনই বা হবে? এই অফিসে তিনি একজন অতি সামান্য মানুষ। বসের ঘরের চা খাওয়ার মানুষ নন। তাঁকে অনেকে চেনেও না। কে শ্যামল সান্যাল?
‘খবরটা চেপে গিয়েছিলেন কেন?’ সুখময়ের গলা চাপা। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে আবার বলল, ‘কেন?’
শ্যামলবাবু অবাক হন। বলেন, ‘কোন খবরটা স্যার?’
‘কোনটা আবার, লাঠি, পুলিশের লাঠি।’
বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠল। মানুষটা জানল কী করে?
‘না না, স্যার…’
সুখময় সোজা হয়ে বসে বড় করে হাসল। হাত দেখিয়ে বলল, ‘না, হ্যাঁ কিছু বলতে হবে না, সব জেনে গেছি। এভরিথিং। কার্তিক যখন বলল তখন প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি। কার্তিক কে জানেন মশাই? আপনার ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। যার কাছে আপনি লাঠির ব্যথা সারাতে গিয়েছিলেন। ছোকরা থাকে ভবানীপুরে। আমার ভায়রার বাড়ির কাছে। এটা-সেটা কাজে ও-বাড়িতে যাতায়াত আছে। ওখানেই পরিচয়। কাল রাতে গিয়ে দেখি ব্যাটা বসে আছে। ভায়রার প্রেশার মাপছে। আমায় দেখে দাঁত বের করে বলল, স্যার, আপনাদের শ্যামল সান্যাল পুলিশের লাঠি খেয়েছে। আমি বললাম, কে শ্যামল স্যান্যাল? তখন কার্তিক আপনার চেহারার ডেসক্রিপশন দিল। আমি তো থ। বিশ্বাসই করতে পারছি না মশাই। আপনি! আউট অফ অল পারসেনস আপনি পুলিশের সঙ্গে মারপিট করেছেন?’
শ্যামলবাবু নড়েচড়ে বসলেন। এখন কী করবেন? অস্বীকার? বাজে কথা বলে উড়িয়ে দেবেন? সেটা কি ঠিক হবে। মনে হচ্ছে না ঠিক হবে। এ লোক অতি ঝানু। অনেকটা নিশ্চিত হয়েই কথা শুরু করেছে।
‘স্যার সেরকম কিছু নয়। সেদিন হঠাৎ অফিসে আসার পথে ঝামেলায় পড়লাম।’
‘থাকা আর বলতে হবে না। ঘটনাটা তা হলে সত্যি? এটাই যথেষ্ট। আপনি যে তলে তলে এতখানি কে জানত। আমি তো শুনেছিলাম শান্তশিষ্ট মানুষ। মাসে তিন দিন লেট, পাঁচটা ফাইলের মধ্যে দুটোতে ভুল। হা হা।’
সুখময় শরীর দুলিয়ে হাসল। ওর গলাটা কেমন যেন লাগছে। অচেনা। এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন পার্সোনেল বিভাগের এই কেরানিটিকে তিনি বিশেষরকম পছন্দ করেন। বহুদিন ধরেই চেনাজানা। লোকটাকে থামাতে হবে। শ্যামলবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘মারপিট-টারপিট কিছু নয় স্যার।’ কথার মাঝখানেই ঝন্টু চা নিয়ে ঢুকল। শ্যামলবাবু চুপ করে গেলেন। ঘরে ঢোকা লোককে আর বিশ্বাস নয়। কম্পাউন্ডার ছোকরা একেবারে মাথা হেঁট করে দিয়েছে। ছি ছি। আর বলবি তো বল একেবারে অফিসের বড়বাবুকে?
ঝন্টু বেরিয়ে যেতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুখময় বলল, ‘আজ অফিসে এসেই একটা কাণ্ড করেছি। আপনার ‘সি আর’-টা বের করলাম। কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট। ভেবেছিলাম এত সাহস যখন নিশ্চয় হট ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। ঝান্ডা, স্লোগানের ব্যাকগ্রাউন্ড। রিপোর্ট খুলে দেখি যা বাবাঃ। নো স্পট। একেবারে সাদা! একেই বলে কোন ছাইয়ের তলায় আগুন চাপা আছে কে বলতে পারে? হা হা।’
কথা শেষ করে বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে সুখময় সামন্ত আবার হাসতে লাগল। শ্যামলবাবুর কপালে ঘাম জমছে।
‘স্যার, বিশ্বাস করুন, সেদিনের ঘটনাটা ওরকম নয়। একেবারে আচমকাই ঘটেছে। বোকার মতো ঝামেলায় পড়ে গেলাম। আমি কখনও কোনও গোলমালে থাকি না স্যার। সেদিন ইউনিয়ন থেকে রিলে অনশন হল, সবাই এল, আমি পেট ব্যথা বলে বাড়িতে ছিলাম। এক দিনের সি. এল. কাটা গেল। আপনি তো সবই জানেন। এই কার্তিক ছেলেটা বাড়িয়ে বলেছে।’
সুখময় এবার টেবিলের ওপর ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে শ্যামলবাবুর হাতটা সামান্য র্স্প করল। নিচু এবং গম্ভীর গলায় বলল, ‘এইজন্যই চিন্তা। সাহসী মানুষের সাহস নিয়ে ভাবনা নেই, কিন্তু ভিতু মানুষের সাহসের কথা শুনলে চিন্তা আছে। সে সত্যি হলেও চিন্তা, বানানো হলেও চিন্তা। দেখুন শ্যামলবাবু, আজ আপনি কেউ নন, কিন্তু কাল কেউ হবেন না তার গ্যারান্টি কী? কোনও গ্যারান্টি নেই। আমার এক কাকা থাকেন জলপাইগুড়িতে। টাউন থেকে একটু দূরে। গোবেচারা, বোকাসোকা ধরনের মানুষ। একদিন সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এক হাবিলদারের গায়ে। হাবিলদার ব্যাটা ঠাসিয়ে দিল এক চড়। ব্যস, এই এক চড়েই কাকার কপাল খুলে গেল। একেবারে চিচিং ফাঁক। সে বছরই কারা যেন তাঁকে জোর করে ইলেকশনে দাঁড় করিয়ে দিল। মিউনিসিপ্যালিটি ইলেকশন। স্রেফ চড় ইস্যুতে কাকা গেলেন জিতে। তারপর থেকে রমরমা কাণ্ড। এখন টাউনের ওপর তিনতলা বাড়ি করেছেন। মার্বেল ফ্লোর। এলাহি কারবার। সুতরাং ও রিস্ক নেওয়া যায় না। আমি নিতে পারব না। আপনিও যে আমার কাকার মতো কিছু একটা হবেন না কে বলতে পারে? আর এ তো চড় নয়, একেবারে লাঠি। কালই হয়তো এখানকার ইউনিয়নে প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। তখন? তখন আমার কী হবে?’
বাঁ হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে শ্যামলবাব বললেন, ‘এসব কী বলছেন স্যার? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সুখময় হাসল। বললে, ‘এবার কাজের কথায় আসি। দেখুন শ্যামলবাবু, আমার এখানে আরও বেশ কয়েক বছর চাকরি আছে। আপনিও আছেন। এই ক’টা দিন আমি আপনাকে দেখব, আপনিও আমাকে দেখবেন। ইউনিয়ন নিয়ে যত খুশি হইচই, হট্টগোল করুন কোনও অসুবিধে নেই। শুধু দেখবেন আমার গায়ে যেন আঁচ না লাগে। ফলস্ আঁচে সমস্যা নেই। সত্যি না হলেই হল। আই শ্যাল পে ফর দ্যাট। আমি এর জন্য আপনাকে দাম দেব। অনেক বছর আপনার এখানে কোনও প্রমোশন হয়নি। এটা ঠিক কথা। প্রপার জাস্টিস হয়নি। এত বছর সার্ভিসের পরও আপনি কেন সামান্য একজন ক্লার্ক হয়ে থাকবেন? এ চলতে পারে না। আমি দেখব। নিশ্চয় দেখব। ব্যস, এই আপনার সঙ্গে কথা হয়ে গেল। ফাইনাল কথা। নিন, এবার কোথায় মেরেছে দেখান। আহা, পা-টা তুলবেন তো!’
শ্যামলবাবুর মাথায় কিছু টুকছে না। তিনি কিছু বুঝতেই পারছেন না! মানুষটা কী বলছে? পাগল-টাগল হয়ে গেছে? নাকি ফাঁদ পাতছে? হতে পারে। বদ লোকেরা সব পারে। তিনি যন্ত্রের মতো সস্তা স্যান্ডাক পরা ডান পা-টা তুলে ধরলেন বাসের মুখের দিকে।
টিফিনের আগে এবং পরে দুটো ঘটনা ঘটল।
টিফিনের আগে বহরমপুর থেকে টেলিফোন করল চন্দন। এই ঘরে ফোন থাকে সেকশন অফিসার অলক বোসের টেবিলে। লোকটা বিরাট পাজি। আগে শুধু ফোন করতে হলে খাতায় সই করতে হত। কোথায় ফোন, কেন ফোন সব লেখা চাই। হঠাৎ একদিন নিয়ম করল, ফোন এলেও লিখতে হবে কার ফোন এসেছে। বেশিরভাগই বানিয়ে লিখত। একজিন সরোজ লিখল, কেন্দ্রীয় জনকল্যাণ দপ্তরের উপমন্ত্রীর ফোন। অলক বোস খেপে লাল। সরোজ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আপনি মন্ত্রীকে ফোন করে দেখুন মিথ্যে বলছি কিনা। মন্ত্রী আমার ছেলেবেলার বন্ধু। দেখলেন না তুই-তোকারি করছিলাম।’ ঝগড়া হল খুব। তবে লাভ হল একটা। ফোন এলে নাম লেখা উঠে গেল।
শ্যামলবাবু উঠে গিয়ে ফোন ধরতে চন্দন চিৎকার করে বলল, “হ্যালো বাবা, করেছটা কী? অ্যাঁ, কী করেছ তুমি? মা আগে তো বলেনি, আজ বলল। খানিক আগে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। তারপর থেকে টানা তোমাকে ধরবার চেষ্টা করছি।’
শ্যামলবাবু রিসিভারটা প্রায় মুখে ঢুকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “তোর মা বলবে কী করে? জানত না তো।’
‘অন্যায় করেছ। কলকাতার বাস ধরব? এখন ব্যথাটা কীরকম?’
চন্দন মোবাইল থেকে ফোন করছে। কথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। শ্যামলবাবু ছেলের কথায় লজ্জা পেলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না না, ব্যথা নেই। তোরা সবাই মিলে কী শুরু করেছিস বল তো? ডাক্তার বলেছে কিছু না। নিজে থেকেই কমে যাবে। ইনফ্যাক্ট একদিনের ওষুধেই কমতে শুরু করেছে। এই তো আজ সকাল থেকে একবারও হয়নি। মনে হচ্ছে, আর হবেই না। তোকে আসতে হবে না। তোর মা কেন যে খামোকা তোকে বলতে গেল। মিছিমিছি টেনশনে ফেলা।’
‘বাঃ, বলবে না। বাবা এত বড় সংগ্রামী হয়েছে, লাঠি খাচ্ছে, জেলে যাচ্ছে, ছেলে জানবে না? বুড়ো বয়সে একেবারে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে বসলে? আঁ!’
‘যাঃ, বাজে কথা বলিস না। এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট।’
‘আমিও মাকে বললাম। বললাম, বাবা ঝগড়া-টগড়াতেই থাকে না, এ তো একেবারে লাঠি-সোটার মামলা। তবে মা মনে হয় না পুরোটা বিশ্বাস করল। এমনভাবে বলল যেন তোমার দোষ ছিল।’
শ্যামলবাবু অলক বোসের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোর মা ওইরকমই। তুই ফোন ছাড়। মোবাইলের কার্ড খরচ হচ্ছে।’
ফোন নামিয়ে শ্যামলবাবু চিন্তিত মুখে নিজের টেবিলে এলেন। পুরো এক গ্লাস জল খেলেন। ফাইল খুললেন অন্যমনস্কভাবে। কাকলি আর কাকে বলেছে? আত্মীয়দের বললে কেলেঙ্কারি।
পরের ঘটনা ছোট, কিন্তু মারাত্মক
টিফিনের খানিক পরেই সুজিত গুপ্ত দলবল নিয়ে টেবিলের সামনে এসে হাজির। মুখ তুলে চমকে উঠলেন শ্যামলবাবু। খোদ ইউনিয়নের সেক্রেটারি তার সামনে! সুজিত একগাল হেসে চেয়ার টেনে বসল। চকচকে মোবাইলটা টেবিলে রেখে ডান হাত বাড়িয়ে দিল।
‘কনগ্রাচুলেশন শ্যামলদা। অভিনন্দন। আপনার মতো একজন সহকর্মী পেয়ে আমরা গর্বিত। ঘটনাটা আমরা এইমাত্র শুনলাম। আর শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বুধবার ছুটির পর একটা সভা করব। বড় কিছু নয়, ছোট সভা। শ্যামল সান্যালের সংবর্ধনা সভা।’
শ্যামলবাবু কিছু একটা বলতে গেলেন। সুজিত এবার দুটো হাত জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘নো নো, আপনার কোনও আপত্তি শুনব না, শ্যামলদা। কোনও কথা নয়। খবর পেয়েছি আপনি খুব শাই। লাজুক ধরনের মানুষ। কিন্তু দাদা আমাদের কাছে লজ্জা করলে তো চলবে না। সংবর্ধনা আপনাকে নিতেই হবে। বেশি কিছু নয়। শুরুতে একটা গান, তারপর আমি কিছু বলব। সুখময়বাবু আপনার হাতে ফুল তুলে দেবেন। যতই হোক উনি আমাদের বস। শেষে আপনার মুখ থেকে সেদিনের ঘটনা শুনব। ব্যস, চা-শিঙাড়া দিয়ে ফিনিশ। বউদিকে আনতে হবে কিন্তু।’
সুজিত দলবল নিয়ে চলে গেলে বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে এলেন শ্যামলবাবু। হাতের কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেল। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছিলেন না আজ। মনের ভিতর অস্বস্তি, সংকোচ। কী যে সব হয়ে গেল! খুব লজ্জা করছে। খালি মনে হচ্ছিল, অফিসে সবাই তাকিয়ে আছে। এমনকী ঝন্টুটা পর্যন্ত। না, না, বুধবার কিছুতেই অফিসে আসা যাবে না। জ্বর বলে দু’দিন কামাই করতে হবে। ইস, দু’-দুটো সি এল নষ্ট। তবে সবকিছুর মধ্যে একটাই যে ভাল, ব্যথাটা পাকাপাকিভাবে গেছে। সারাদিনে একবারও হল না। এরকম আগে হয়নি ওষুধের গুণ আছে। একদিনেই অ্যাকশন। লজ্জার মধ্যেও মনটা ভাল লাগছে। না, ডাক্তারের কাছে আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল।
সামনের ট্রামটায় উঠে পড়লেন শ্যামলবাবু।
হেদুয়া ছাড়িয়ে খানিক এগোনোর পর ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়ল। উর্দি পরা বুড়ো কন্ডাক্টর টঙাস-টঙাস শব্দে দু’বার ঘন্টি বাজিয়ে ঘোষণা করলেন, ট্রাম আর যাবে না। সামনে গোলমাল। শ্যামলবাবু জানলার পাশে বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। গোলমাল শুনে চমকে উঠলেন। আবার গোলমাল! ভুল শুনলেন না তো? হতে পারে। বাসে-ট্রামে ঝিমিয়ে পড়লে মানুষ অনেকসময় ভুল শোনে। তবে এটা ভুল নয়। শ্যামলবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন সবাই দ্রুত নেমে পড়েছে। তিনিও নামলেন। নেমেই বুঝলেন, ঘটনা সত্যি। খানিকটা এগিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মানুষ মরেছে। উত্তেজিত জনতা বাসে আগুন ধরিয়েছে। আকাশে সেই আগুনের ধোঁয়া উঠছে গলগল করে। ধোঁয়ার সঙ্গে আগুনের হলকা। এতটা দূর থেকে পাওয়া যাচ্ছে ভাঙচুরের আওয়াজ। গাড়ির কাচ ভাঙছে? সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ আর দমকল ছুটে গেল পাশ দিয়ে। ভেসে এল চিৎকার। উন্মত্ত মানুষের চিৎকার। শ্যামলবাবু দ্রুত চিন্তা করছেন। কোন গলিতে ঢুকবেন? কোনটা পালানোর পক্ষে বেশি সুবিধেজনক হবে? ডান না বাঁ? হাতে বেশি সময় নেই। এই গোলমাল আরও বাড়বে, ছড়াবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত। সেবারের মতো যেন ভুল না হয়। সামনে থেকে চেরা, তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে এল। গুলি চলল নাকি?
শ্যামলবাবু পা বাড়াতে গেলেন। আর ঠিক সেই সময় সে ফিরে এল! ফিরে এল নিঃশব্দে, আরও বেশি শক্তি নিয়ে যেন। সজোরে কামড় বসাল পায়ে, হাঁটুর পিছনে। তারপর কামড়াতে কামড়াতে উঠতে লাগল ওপরে। ঊরু, কোমর, পেট, বুক ছাড়িয়ে মাথার দিকে। শ্যামলবাবু থমকে দাঁড়ালেন। এ কী! এখনও যায়নি! হারামজাদা রয়ে গেছে এখনও! জাপটে জড়িয়ে গা ঢাকা দিয়ে রয়ে গেছে ভেতরে! যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে এল। কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি হচ্ছে রাগ। তীব্র রাগ। যে-জিনিস এতক্ষণ লজ্জা হয়ে কুঁকড়ে-মুকড়ে দিয়েছিল, সে যেন হঠাৎ গাদাখানেক রাগ এনে মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল! ইচ্ছে করছে ব্যথাটার গলা টিপে ধরতে। তারপর শরীর থেকে উপড়ে, টেনে মাটিতে ফেলে, থেতলে, পিষে মারতে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন শ্যামলবাবু। রাস্তা ভরতি মানুষ। কেউ যেন বুঝতে না পারে।
ডান বা বাঁয়ে গলি নয়, ভিড় ঠেলে রাগী আর বোকা শ্যামল সান্যাল এখন হাঁটছেন সামনে। ধোঁয়া, আগুন, গোলমালের দিকে। ছাতা আর অফিসের ব্যাগটা হাতে শক্ত করে ধরা।
দেশ, ২ জুন ২০০৮