ব্যতিক্রমী অভিনেতা কালীদা
আমি কালীদার যে অভিনয় প্রথমে দেখেছিলাম তা হল বরযাত্রী ছবিতে ‘গণশার’ ভূমিকায়। বলা বাহুল্য, তখন থেকেই আমি তাঁর অভিনয়ের একজন গুণগ্রাহী হয়ে পড়ি। ‘বরযাত্রী’ দেখার পরে পরেই কি কালীদার খুব বেশি ছবি দেখতে পেয়েছি? ওই ‘গণশার’ গল্প নিয়ে ‘টনসিল’ ছাড়া আর তো বিশেষ কিছু মনে পড়ে না। একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগে যে ‘বরযাত্রী’র এমন অনন্যসাধারণ অভিনয়ের পরেও কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনেতা হিসেবে সেরকম নামডাক হতে প্রায় দশ বছর লেগেছিল কেন? বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যে ধরনের মধ্যবিত্ত ইচ্ছাপূরণের গল্পের ওপর নির্ভর করে ছবি করত, এবং সেখানে একটি বালক একটি বালিকা পাইল ফর্মুলায় যে ধরনের তথাকথিত রোমান্টিক নায়কের দরকার হয়, কালীদার চেহারা বা অভিনয়ের ধরন কোনটাই তেমন ছিল না বলেই কি বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ‘বরযাত্রী’ দেখার পরেও প্রায় দশ বছর ধরে তাঁর সম্বন্ধে আগ্রহ বোধ করেনি?
‘বরযাত্রী’র আগেই কালীদা আর একটি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেটি হল ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের চিত্ররূপ। সেই ছবির নায়ক শশীও বাংলা সিনেমার তথাকথিত রোমান্টিক হিরো নয়। বরং বলা যায় অ্যান্টি হিরো। সেই দিক থেকে দেখলে বাংলা সিনেমার তিনিই প্রথম ব্যতিক্রমী নায়ক। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘পরশপাথর’, ‘ডাকহরকরা, ‘নতুন ফসল’, ‘লৌহকপাট’, ‘রাজধানী থেকে’, ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ প্রভৃতি ছবিতে কালীদার দুর্দান্ত অভিনয়গুলো কোনও তথাকথিত রোমান্টিক নায়ককে দিয়ে হত না। এসব অভিনয় জীবন থেকে তুলে আনা, সত্যিকারের মানুষের জীবন্ত চরিত্রচিত্রণ।
এই সত্যিকারের মানুষকে অভিনয়ের মধ্যে ব্যক্ত করার আগ্রহটা সব অভিনেতার থাকে না। কালীদার ছিল, তার কারণ বোধহয় অভিনয় করাটা তাঁর কাছে নিছক শিল্পচর্চা ছিল না। সংগ্রামী বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তিনি জড়িত ছিলেন তাঁর যুবা বয়সে। অভিনয়কর্মের মধ্যে দিয়ে সেই সংগ্রামকে তীব্রতর করার লক্ষ্য নিয়েই তখন তিনি চলচ্চিত্র ও মঞ্চে কাজ করেছেন। এই সচেতনতা তাঁকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে যেমন নিয়ে গেছে তেমনই সেই জনগোষ্ঠীর জীবন তাঁর অভিনয়কর্মকে পুষ্ট করেছে, প্রেরণা দিয়েছে বলেই তাঁর কাজ এতখানি সমৃদ্ধ হয়েছে, সত্যিকারের মানুষের চরিত্রচত্রিণে তিনি এতখানি সফল হয়েছেন।
সত্যিকারের মানুষের বিচিত্র পরিচয় অভিনয়ে তুলে ধরতে চাইতেন বলেই সম্ভবত কালীদার প্রভূত আগ্রহ ছিল মেকআপ সম্বন্ধে। নানান রকমের মানুষের ছবি তৈরি করবেন বলেই নানান রূপসজ্জা গ্রহণ করেছেন। মেকআপ সম্বন্ধে এতখানি আগ্রহ কম অভিনেতারই দেখেছি। যে পেশায় যুবক অভিনেতা তার যৌবন-লাবণ্য প্রদর্শন করতেই বেশি যত্ন নেয়, নিজেকে ডিগ্ল্যামারাইজ করে ভেঙেচুরে অন্য মানুষের প্রতিকৃতি করে তুলতে দ্বিধাবোধ করে, সে পেশায় কালীদার এই রূপসজ্জার বৈচিত্র্য সম্বন্ধে আগ্রহ ও যত্ন একটা বিশিষ্ট গুণ বলেই আমার মনে হয়।
অথচ অভিনেতার যৌবন-লাবণ্যের সব থেকে বড় প্রকাশ যে দেহ, সেই দেহের সৌষ্ঠব কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো খুব কম বাঙালি অভিনেতারই ছিল বা আছে। ‘বরযাত্রী’ ছবিতে সন্ন্যাসী বেশে কালীদার যে নিরাবরণ ঊর্ধ্বদেহ দেখা যায়, তেমন বলিষ্ঠ অথচ সুষমামণ্ডিত শরীর আর কোনও বাঙালি অভিনেতার দেখেছি বলে তো মনে হয় না। কিন্তু কালীদা এই দেহকে আত্মপ্রদর্শনের উপায় না করে সুঅভিনয়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন চিরদিন।
পরিণত বয়সে অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী থেকেও কিছু জনপ্রিয় ভূমিকায় অভিনয় করা ছাড়া সার্থক চরিত্রচিত্রণের সুযোগ তেমন বেশি কিছু তিনি পাননি। এ নিয়ে তাঁর মনে অশান্তি ও অতৃপ্তি ছিল এ আমি জানি। কিন্তু অভিনেতার কাজ বহুলাংশে পরনির্ভর। কালীদার অভিনয়-ক্ষমতাকে পরিপূর্ণ ব্যবহার না করা হয়ে থাকলে তার দায় কলকাতার ফিল্ম ও থিয়েটারের, কালীদার নয় নিশ্চয়ই। তবু যে সব অসামান্য অভিনয় তিনি করে গেছেন তার জন্যেই আগ্রহী দর্শক তাঁকে মনে রাখবে।