ব্যক্তি ও সংগঠন
সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা যে লাভজনক তা মানুষ দেখতে পায়, কিন্তু তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিগতই থেকে যায় মৌচাকের মৌমাছির বিপরীতে। সমাজজীবনে এই জন্য অসুবিধা দেখা দেয় এবং জরুরি হয়ে পড়ে সরকার গঠন। কারণ, একদিকে সরকার প্রয়োজনীয় : সরকার ছাড়া সভ্য দেশের কিয়দংশ মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু অপরদিকে রয়েছে অসমতা বিজড়িত ক্ষমতা (সরকারের) এবং যাদের হাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রয়েছে তারা এর ব্যবহার করে থাকে সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় অধিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য। এইভাবে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচার একইভাবে হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক। তাই সুখী হতে হলে প্রয়োজন এক ধরনের আপসের।
এই অধ্যায়ে আমি আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন সম্বন্ধে-সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনা নয়। অবশ্যই এই বিষয়টির পার্থক্য গণতান্ত্রিক ও সর্বগ্রাসী দেশে অনেক। কারণ, কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও শেষোক্ত দেশে সংশ্লিষ্ট সংগঠনই রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। আমি যতটুকু সম্ভব প্রথম জরিপে বিবেচনার বাইরে রাখব এই পাথর্কটি।
দুটো পন্থায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিবিশেষকে প্রভাবিত করে। কিছু নীতি ব্যক্তিবিশেষের আশা-আকাক্ষা চরিতার্থ করার জন্য তার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পিত। আবার কিছু অনেকের বৈধ স্বার্থ ব্যাহত করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত। পার্থক্যটি পরিস্কার নয় : পুলিশ রয়েছে সৎ লোকের স্বার্থ রক্ষা এবং সিদেল চোরকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে। এর প্রভাব অনেক বেশি জোরালো সভ্য মানুষের চেয়ে সিঁদেল চোরের জীবনের উপর। আমি আবার ফিরে আসব এ পার্থক্য। এ মুহূর্তে আলোচনা করব সভ্য সমাজে মানবজীবনের যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সংগঠনগুলো সিদ্ধান্তকারী ভূমিকা পালন করে সেগুলো।
প্রারম্ভেই জন্ম : একজন ডাক্তার বা একজন যাত্রীর সেবা অপরিহার্য। অতীতে যথেষ্ট ছিল একজন সম্পূর্ণ অশিক্ষিত মিসেস গ্যাম্পের সেবা। কিন্তু আজকাল তা যথেষ্ট নয়–এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি কর্তৃপক্ষের দ্বারা ধার্য নির্দিষ্ট স্তরের দক্ষতা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুর স্বার্থ রক্ষা করা। বিভিন্ন সরকারি দায়িত্বের মান শিশু-কিশোরের মৃত্যুহারে প্রতিফলিত হয়। পিতামাতা তাদের কর্তব্যে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলে সরকারি কর্তৃপক্ষ শিশুটির পালন পিতামাতা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে দিতে পারেনি। শিশুটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে আসে পাঁচ অথবা ছয় বছর বয়সে এবং তখন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত বাধ্য হয়। সরকারের পছন্দ অনুযায়ী বিষয়গুলো শিখে নিতে। এই প্রক্রিয়া শেষে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সারা জীবনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় মতামত ও মানসিক অভ্যাস।
ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে শিশুরা প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে অন্য কিছুর উপর, যা আরোপিত হয় না রাষ্ট্র কর্তৃক। পিতামাতা ধার্মিক বা রাজনীতিবিদ হলে তারা ধর্মীয় বা দলীয় নীতি শিক্ষা দেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু ক্রমাগতভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে সংঘটিত আমোদ-প্রমোদে। যেমন-সিনেমা, ফুটবল খেলা ইত্যাদি। সে মোটামুটি বুদ্ধিমান হলে সংবাদ মাধ্যম কর্তৃক হতে পারে প্রভাবিত। রাষ্ট্রীয় স্কুল ভিন্ন অন্য কোনো স্কুলে পড়লে সে স্বাভাবিকভাবে এক প্রকার অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে-ইংল্যান্ডে তা হচ্ছে জাতি বা গোষ্ঠীর উপর সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব। ইতিমধ্যে সে একটি নৈতিক আচরণবিধি আত্মস্থ করে যা তার যুগের সম্প্রদায়ের বা জাতির। এই নৈতিক আচরণবিধি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর সংজ্ঞা প্রদান করা সহজ নয়। কারণ তিন প্রকার কর্মবিধি রয়েছে যেগুলোর পার্থক্য স্পষ্ট নয়। প্রথমত সাধারণ অপবাদ সত্ত্বেও এগুলো পালন করতে হয়; দ্বিতীয়ত খোলাখুলিভাবে অমান্য করা যাবে না কতগুলো; তৃতীয়ত যেগুলো পরিপূর্ণ উপদেশ হিসেবে গণ্য করা হয়, শুধু দরবেশ ব্যক্তিই তা পালন করতে পারেন। মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি সম্পূর্ণত না হলেও প্রধানত ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত ধর্মীয় ঐতিহ্যের ফলাফল। এগুলো টিকে থাকতে সক্ষম দীর্ঘ অথবা স্বল্পকাল। তাছাড়া পেশাগত আচরণবিধিও রয়েছে-কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো কোনো অফিসার, ডাক্তার অথবা ব্যারিস্টার অবশ্যই করবে না। কিন্তু আজকাল সাধারণত পেশাগত সমিতি ও এ ধরনের বিধি পরিকল্পনা ও প্রণয়ন করে। এটা উপদেশমূলক যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ব্যাপারে চার্চ ও সেনাবাহিনীর ভেতর সংঘাত দেখা দিলে সেনা-আচরণবিধি অফিসারদের ভেতর বিস্তার লাভ করে। আইনের বিরুদ্ধে প্রসার লাভ করে চিকিৎসা ও দোষ স্বীকার সম্পর্কীয় গোপনীয়তা।
যুবক বা যুবতী অর্থ উপার্জন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠন তাদের কার্যকলাপ প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। চাকরিদাতা সাধারণত একটি সংগঠন; অধিকন্তু নিয়োগদাতাদের একটি ফেডারেশন। ট্রেড ইউনিয়ন এবং তাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র। ইনস্যুরেন্স এবং ফ্যাক্টরি আইনের মতো বিষয়গুলো ছাড়া রাষ্ট্র ট্যারিফ ও সরকারি আদেশের মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের নির্বাচিত বৃত্তি লাভ করবে না অবদমিত হবে তা স্থির করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। শিল্পোন্নয়ন প্রভাবিত করতে পারে মুদ্রা, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অথবা জাপানের অভিলাসের মতো সবরকম পরিস্থিতি।
বিবাহ এবং সন্তানের প্রতি কর্তব্য আবার একজন মানুষকে আইন এবং প্রধানত চার্চ থেকে প্রাপ্ত নৈতিক আচরণবিধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে। যদি তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন এবং খুব গরিব না হন তবে তিনি সর্বশেষ বৃদ্ধকালীন বয়স্ক-ভাতা ভোগ করতে পারেন। সতর্কতার সঙ্গে আইন ও চিকিৎসার দ্বারা তার মৃত্যু তত্ত্বাবধান করা হয় যাতে এটা নিশ্চিত হতে পারে যে তার মৃত্যু ঘটেনি নিজের ইচ্ছায় বা অন্যের দ্বারা।
কিছু ব্যাপার রয়ে গেল যা ধার্য হয়ে থাকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই। কোনো ব্যক্তি একজন মহিলা রাজি হলে তাকে বিয়ে করতে পারেন। যৌবনে তার সবিশেষে স্বাধীনতা রয়েছে জীবিকা অর্জনের পথ বেছে নেয়ার ব্যাপারে। ইচ্ছানুসারে অবসর সময় কাটাতে পারেন সীমাবদ্ধতার ভেতর। ধর্ম বা রাজনীতিতে আগ্রহী হলে যোগ দিতে পারেন সবচেয়ে আকর্ষণীয় সম্প্রদায় বা দলে। পছন্দ-অপছন্দের স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও বিবাহ সম্পর্কিত ব্যাপার ছাড়া তিনি নির্ভরশীল সংগঠনের উপর। খুব ব্যতিক্রমধর্মী না হলে তিনি ধর্ম প্রতিষ্ঠা, দল সৃষ্টি, ফুটবল ক্লাব সংগঠন অথবা পারেন না নিজের পানীয় বানাতে। তিনি শুধু সদাপ্রস্তুত বিকল্পের ভেতর চর্চা করতে পারেন নিজের রুচি। কিন্তু এর সব বিকল্পকে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার গণ্ডির ভেতর সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তোলে প্রতিযোগিতা।
এ পর্যন্ত সভ্য সমাজে সংগঠনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তুলনামূলক অনুন্নত সামজের কৃষকদের তুলনায় মানুষের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা। তুলনা করা যাক পাশ্চাত্য দিনমজুরের জীবনের সঙ্গে একজন চীনা কৃষকের জীবন। এটা সত্য যে তাকে শিশু হিসেবে যেতে হয় না স্কুলে। কিন্তু অতি অল্প বয়স থেকেই তাকে কাজ করতে হয়। সম্ভবত শৈশবকালে অর্থাভাব ও চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। যদি বেঁচে থাকেন এবং সৈনিক বা বান্ডিট না হন অথবা কোনো বড় শহরে স্থানান্তরের ঝুঁকি না নেন তবে জীবিকা অর্জনের জন্য রুচি চর্চা করার সুযোগ পাবেন না তিনি। বািবহের ব্যাপারে সামান্যতম স্বাধীনতা ছাড়া প্রথা তার সর্বস্ব হরণ করে। বাস্তবে তার অবসর বলতে কিছুই নেই এবং যদি থেকেও থাকে তবে এ নিয়ে আনন্দ করার মতো কিছুই নেই এবং যদি থেকেও থাকে তবে এ নিয়ে আনন্দ করার মতো কিছুই নেই। তিনি সবসময় বেঁচে থাকেন ন্যূনতম জীবিকার উপর নির্ভর করে। দুর্ভিক্ষের সময় তার পরিবারের এক বিরাট অংশ ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করে। লোকটির জীবন যতই কঠিন হোক না কেন তার স্ত্রী বা কন্যা সন্তানদের জীবন এর চেয়েও কঠিন। গড়পড়তা চীনা কৃষকদের জীবনের তুলনায় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেকার যুবকের জীবনও স্বর্গের মতো।
এবার আসা যাক অন্য এক শ্রেণির সংগঠনের বেলায়। এগুলো একজন লোককে অন্য মানুষের আহত করা থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে পরিকল্পিত হয়েছে : পুলিশ এবং ফৌজদারি আইন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খুন, ডাকাতি ও রাহাজানির উপর এগুলো হস্তক্ষেপ করলে ব্যতিক্রমধর্মী অল্প সংখ্যক হিংস্র ব্যক্তি ছাড়া সবারই স্বাধীনতা এবং সুখ বৃদ্ধি পায়। যেখানে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে লুণ্ঠনকারী ছাড়া সবারই বেসামরিক জীবনের আনন্দ অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশ্যই একটা বিপদ রয়েছে : পুলিশের পক্ষে দুবৃত্ত দলের মানুষ সাজা সম্ভব অথবা যে কোনোভাবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা সম্ভব। এই বিপদ কোনোক্রমেই কাল্পনিক নয়, তবে সুপরিচিত এর রহিত কারণও। এ রকম বিপদও রয়েছে যে, ক্ষমতাসীনরা পুলিশ ব্যবহার করতে পারে সংস্কারের লক্ষ্যে সংঘটিত আন্দোলন ঠেকানোর জন্য। বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত এ রকম ঘটে যাওয়া প্রায় অপরিহার্য বলে মনে হয়। নৈরাজ্য রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো এমনই যে তা বর্তমান অবস্থানের পরিবর্তন আরও দুরূহ করে তোলে তা মৌলিক প্রতিবন্ধকতাগুলোর অংশবিশেষ। এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সভ্য সমাজের অনেক মানুষ ভাবতে পারে যে পুলিশ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা সম্ভব।
এ পর্যন্ত আমরা কোনো চিন্তা করিনি যুদ্ধ, বিপ্লব এবং এগুলোর ভয় সম্বন্ধে। এগুলোর ভেতর রয়েছে আত্মরক্ষামূলক রাষ্ট্রীয় প্রবণতা। এই কারণে রাষ্ট্র ব্যক্তি জীবনের উপর চরম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কায়েম করে। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই বাধ্যতামূলক সার্বজনীন সামরিক চাকরি বিদ্যমান। যুদ্ধ দেখা দিলে সর্বত্রই সামরিক বয়সের প্রত্যেক পুরুষকে যুদ্ধে ডাকা হয় এবং সরকার বিজয় লাভের জন্য যেসব কাজ উপযোগী মনে করে তা করার জন্য আদেশ করে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের। যাদের কার্যকলাপ শত্রুপক্ষের অনুকূলে মনে হয় তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। শান্তির সময়ে সব সরকারই সময়মত প্রত্যেকের যুদ্ধ করার ইচ্ছা এবং জাতীয় প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সম্ভাব্যতার মাত্রা অনুসারে সরকারের পদক্ষেপ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে বিপ্লবাত্মক বিষয়ে। বিপ্লবের ঝুঁকি বেড়ে যায় অন্যান্য জিনিস অপরিবর্তিত থাকলে এবং জনকল্যাণমূলক কাজে সরকারের মনোযোগ কমে গেলে। কিন্তু সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের মতো দৈহিক নিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিক ও অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে মানসিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে সরকারের হাতে থাকলে এই সরকার অপেক্ষাকৃত কম প্রগাঢ় সরকারের চেয়ে অপ্রিয় হয়ে পড়ে। কারণ বিপ্লবী চেতনায় সংগঠন ও প্রসার সহজ নয়। সুতরাং আশংকা করা যায় যে, রাষ্ট্র ও জনসাধারণের ভেতর স্পষ্ট সীমারেখা থাকলে সরকার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রত্যেক ধাপে জনকল্যাণমূলক কাজে আরও বেশি উদাসীন হবে।
উপরের সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান থেকে অনুমিত হয় যে, সরকারের আত্মরক্ষামূলক কাজ থেকে উদ্ভূত প্রবাহ ব্যতিরেকে প্রধানত সংগঠনগুলো ব্যক্তি জীবনে বৃদ্ধি করে থাকে মানুষের শখ ও মঙ্গল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি, দারিদ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলো এমন যে নীতিগতভাবে এগুলো সম্বন্ধে কোনো বির্তক থাকা উচিত নয়। এর সবই নির্ভর করছে উন্নত সংগঠনের উপর। কিন্তু যখন আমরা যুদ্ধে পরাজয় বা বিপ্লব রোধে পদক্ষেপ নিই তখন ব্যাপারটি হয়ে থাকে ভিন্ন। এসব পদক্ষেপের যতই প্রয়োজন মনে করা হোক না কেন আসলে এগুলো নিরানন্দের এবং এ কারণেই শুধু সংরক্ষিত হয় যে বিপ্লব এবং পরাজয় আরও বেশি নিরানন্দের। সম্ভাবত পার্থক্য শুধু মাত্রার দিক থেকে। বলা যেতে পারে যে, টিকা, শিক্ষা এবং রাস্তা নির্মাণ নিরানন্দের, কিন্তু বসন্ত, অজ্ঞতা ও দুর্গম জলাভূমি এর চেয়েও নিরানন্দের। মাত্রাগত পার্থক্য এত বেশি যে, তা বস্তুগত পার্থক্যের শামিল। অধিকন্তু শান্তিপূর্ণ অগ্রগতিতে জড়িত কাজের নিরানন্দ অস্থায়ী। বসন্ত নিমূর্ল করা যেতে পারে, তখন টিকা নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়বে। উন্নত পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় শিক্ষা ও রাস্তা নির্মাণ। কিন্তু কৌশলগত যে কোননা অগ্রগতি যুদ্ধকে অধিক বেদনাদায়ক ও ধ্বংসাত্মক করে তোলে। মানবতা ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী পদ্ধতিতে বিপ্লব প্রতিরোধ করা ধ্বংসাত্মক।
অন্য একটি পন্থা রয়েছে ব্যক্তি ও সংগঠনের সম্পর্কের শ্রেণিকরণের : ব্যক্তি হিসেবে তিনি একজন ক্রেতা, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সদস্য অথবা হতে পারেন শত্রু।
তিনি ক্রেতা হিসেবে দেখবেন যে সংগঠন তাকে উপভোগে সাহায্য করছে, কিন্তু বৃদ্ধি করছে না তার ক্ষমতা। অবশ্য তিনি ভুল বুঝতে পারেন এগুলোর ব্যাপারে : ক্রীত পিলটি উপকারে না আসতে পারে, বিয়ার খারাপ হতে পারে, ঘোড়দৌড়ে অর্থহানি হতে পারে। তা সত্ত্বেও সংগঠন থেকে তিনি কিছু লাভ করছেন। যেমন– আশা, বিনোদন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ। নতুন গাড়ি কেনার সম্ভাবনা আপনাকে কিছু ভাবনা ও বলার সুযোগ দেয়। অর্থ ব্যয়ের স্বাধীনতা আনন্দদায়ক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আসবাবপত্রের প্রতি আকর্ষণ একটি ব্যাপক ও শক্তিশালী আবেগ। কিন্তু তা আর থাকে না রাষ্ট্র সুসজ্জিত বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে।
মানুষ যেসব সংগঠনের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সদস্য সেগুলো হচ্ছে রাজনৈকি দল, চার্চ, ক্লাব, বন্ধু, সমাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিযোগিতায় এগুলো একই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, ভিন্ন মতাবলম্বী চার্চ, প্রতিযোগী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা আগ্রহী ব্যক্তিদের মনে ক্ষমতা তাড়না নাটকীয় মনোভাবের জন্ম দেয়। রাষ্ট্র দুর্বল না হলে এই প্রতিযোগিতা আইনের অধীন থাকে। রাষ্ট্র শান্তির ব্যবস্থা করে থাকে সহিংসতা ও প্রতারণামূলক কাজ ধরা পড়লে। কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বিরোধী সংগঠনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত রক্তপাতহীন হলে তা উৎসাহ যোগায় মানুষকে উন্মাদনা ও ক্ষমতামোহ হাসে। অন্যথায় এর ফলে জন্ম দেয় এক বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা।
রাষ্ট্র উদাসীন হলে এবং নিরপেক্ষ না হলে রাজণৈতিক বিরোধ, দাঙ্গা, হত্যা অথবা গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হয়। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে এই বিপদ এড়ানো গেলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে উন্নতির লক্ষন।
মানুষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সংগঠনটির অনিচ্ছুক সদস্য-তা হচ্ছে রাষ্ট্র। এ পর্যন্ত নাগরিকত্ব প্রদানে সফল জাতীয়তা নীতি নাগরিকদের ইচ্ছানুসারে প্রণীত হয়-ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছায় নয়।
হতে পারতেন তিনি একজন রুশ
ফরাসি, তুর্কি অথবা প্রোসিয়ান
অথবা হয়তো ইতালির কিন্তু
এতগুলো সম্ভাবনার পরেও তিনি
রয়েছেন একজন ইংরেজ।
তবে অধিকাংশ মানুষ সুযোগ পেলেও নাগরিকত্ব পরিবর্তন করে না যদি রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি শত্রুতামুলক মনোভাব না দেখায়। সফল জাতীয়তা নীতি ছাড়া অন্য কিছুই রাষ্ট্রকে এত শক্তিশালী করতে পারে না। নাগরিকত্ব ও দেশপ্রেম হাতে হাত ধরে চললে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সংগঠনের প্রতি আনুগত্যের চেয়েও গভীরতর হয়।
ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রেরণা বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের। অনুরূপ একটি প্রেরণা রয়েছে স্বদেশপ্রীতি ও পরিবারপ্রীতির। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আনুগত্যে অনুরূপ প্রেরণা থাকে না ক্ষমতাপ্রীতি ও বৈদেশিক আক্রমণজনিত ভয়ের দ্বৈত প্রেরণায় উজ্জীবিত না হলে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরূপ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা অবাধ হয়ে পড়ে। সভ্য দুনিয়া আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে একটি লিন্ডবার্গ শিশুর হরণ ও এর হত্যায়। কিন্তু পরবর্তী যে যুদ্ধের জন্য আমরা ব্রিটেনে আমাদের আয়ের এক-চতুর্থাংশ খরচ করছি সে যুদ্ধে তা দাঁড়াবে সাধারণ ব্যাপার হয়ে। কোনো প্রতিষ্ঠানই জন্ম দেয় না জাতীয় রাষ্ট্রের অনুরূপ আনুগত্যের। বিশাল সংখ্যঅর মানুষ হত্যার জন্য প্রস্তুতি নেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। মৃত্যু ঝুঁকিসহ সংগঠনের প্রতি আনুগত্যই সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র মেনে নিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। এতে বাসস্থান, ছেলেমেয়ে এবং সভ্যতা ধ্বংসের ঝুঁকি ও বিদেশি শক্তির বশ্যতা স্বীকার করার চেয়ে ভালো। বেদনাদায়ক সমস্যা ঘটছে ব্যক্তি-মনোবিজ্ঞান ও সরকারি সংগঠনের। আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের নিস্তার নেই যদি এই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার উপযুক্ত পথ খুঁজে বের না করি।